শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ৬ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





ছয়

সাংবোস্টন থেকে ফিলাডেলফিয়ায়

(৬)

 বেঞ্জামিন যদিও জেমসের নিজের ভাই ছিল তথাপি জেমস ভাইয়ের সঙ্গে নিজের অধীনস্থ কর্মচারীর মতো ব্যবহার করতেন। ছাপাখানার মালিক হিসেবে তিনি অন্যান্য কর্মচারীদের কাছ থেকে যতটুকু কাজ এবং যে ধরনের বাধ্যতা দাবি করতেন ঠিক ততটাই তিনি দাবি করেছিলেন নিজের ভাইয়ের কাছ থেকেও। বেঞ্জামিন এই কথাটা মোটেই পছন্দ করেন নি। জেমস তাকে করতে দেওয়া কতগুলি কাজ তিনি অতিশয় অপমানজনক বলে মনে করেছিলেন।ফলে দাদা-ভাই দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটির সৃষ্টি হত। জেমস কিছুটা রাগী প্রকৃতির লোক ছিলেন।মাঝে মাঝে তিনি ভাইকে মারধরও করতেন।পরিস্থিতি ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠায় বেঞ্জামিন ছাপাখানার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু সেটা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ একুশ বছর না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাদার ছাপাখানায় চাকরি করতে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন।

 কিন্তু ঘটনাক্রমে বেঞ্জামিনের মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার একটা সুযোগ এসে গেল।The New England Courant এর কোনো একটি সংখ্যায় বোস্টনের বিধান পরিষদকে সমালোচনা করে লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। কাগজটির সম্পাদক জেমস প্রবন্ধ লেখকটির নাম প্রকাশ করতে রাজি না হওয়ায় তাকে বিধানসভার অধ্যক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী এক মাসের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হল। জেমসের অনুপস্থিতে বেঞ্জামিনকেই অস্থায়ীভাবে কাগজটি চালাতে হল। বেঞ্জামিন দাদার নানা কথায় অসন্তুষ্ট ছিল যদিও বোস্টনের শাসকরা খবরের কাগজের একজন সম্পাদককে এভাবে নিগ্রহ করা কার্যকেও সমর্থন করতে পারেননি। সেই জন্য কাগজটির সম্পাদনা করার অস্থায়ী দায়িত্ব গ্রহণ করেই বেঞ্জামিন শাসকদের আক্রমণ করে লেখা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে লাগলেন। এর আগেও তিনি শ্রীমতি সাইলেন্স ডগ উডের ছদ্মনামে শাসকদের স্বৈরাচার এবং আতিশয্যের সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

 এক মাস পরে জেমস জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন; কিন্তু বিধানসভা এই বলে হুকুম জারি করল যে জেমস ফ্রাঙ্কলিন The New England Courant নামের খবরের কাগজটা প্রকাশ করতে পারবেন না। এইরকম পরিস্থিতিতে কাগজটি বেঞ্জামিনের নামে প্রকাশ করা ছাড়া জেমসের অন্য কোনো উপায় ছিল না। এই উদ্দেশ্যে জেমস এবং বেঞ্জামিনের মধ্যে থাকা চুক্তিপত্রটি নতুন করে করতে হল, কারণ পুরনো চুক্তি-পত্র মতে বেঞ্জামিন একজন মাত্র শিক্ষানবিশ ছিলেন আর জেমস ছিলেন প্রকাশক। নতুন করে কোনো অভিযোগে যদি কাগজটি পুনরায় বিচারের সম্মুখীন হতে হয় এবং খানা তল্লাশির ফলে পুরোনো চুক্তিপত্রটা বিচারকের হাতে পড়ে, তাহলে বিধান সভার আদেশ উপেক্ষা করে জেমসই কাগজটির প্রকাশক হয়ে থাকা বলে প্রমাণিত হবে।

 বেঞ্জামিন কাগজটির প্রকাশক তথা স্বত্বাধিকারী হল সত্যি, কিন্তু তখনও দাদা তার ওপরে খবরদারি চালাতে ছাড়ল না। দুজনের মধ্যেই আগের মতো ঝগড়াঝাটি চড় থাপ্পড় চলতে থাকল। কিন্তু এখন যেহেতু বেঞ্জামিন কাগজটির মালিক, অন্তত নামে, সেই জন্য তিনি আগের মতো দাদার শাসন মেনে চলল না। ফলে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য বেড়ে চলল। অবশ্য এখানে বেঞ্জামিনের মহত্ত্ব যে দাদার সঙ্গে চলতে থাকা এই মনমালিন্যের জন্য তিনি কেবল দাদাকে দোষ দেননি। সব সময় আত্ম-সমালোচনা করে নিজের স্বভাব চরিত্র উন্নত করতে বেঞ্জামিন নিজেও আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন যে দাদা তার ওপরে সব সময় ক্রুদ্ধ হয়ে থাকার জন্য তিনি নিজের স্বভাবকেও কিছু পরিমাণে দায়ী করেছেন।

 সে যাই হোক না কেন, বেঞ্জামিনের প্রতি দাদার দুর্ব্যবহার ক্রমশ এতটা বেড়ে চলল যে তা অবশেষে সহ্যের অতীত হল। তিনি ছাপাখানার চাকরি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। জেমস যখন জানতে পারল যে ভাই তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার জন্য মনস্থির করে নিয়েছে তখন তিনি বোস্টনের ছাপাখানার মালিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেঞ্জামিনকে তাদের ছাপাখানায় চাকরি না দিতে অনুরোধ করলেন। বেঞ্জামিন তখন বুঝতে পারল যে বোস্টন ত্যাগ করে ভাগ্যের অন্বেষণে অন্য কোনো শহরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই।

 তিনি নিউইয়র্কে যাবার কথা ভাবলেন। নিজের বইয়ের সংগ্রহ থেকে কিছু বই বিক্রি করে জাহাজের ভাড়ার জন্য টাকা যোগাড় করলেন। তারপরে তিনি একদিন নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তখন তার বয়স সতেরো বছর। ইতিমধ্যে তিনি ছাপাখানা পরিচালনার বিদ্যা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছেন। সেই কম বয়সে তিনি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশি বই পড়ে ফেলেছেন। তাই ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি যখন বাড়ি ছেড়ে বের হলেন, তখন তার একমাত্র মূলধন ছিল গভীর আত্ম-বিশ্বাস।

 সমুদ্রপথে বোস্টন থেকে নিউইয়র্কের দূরত্ব প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার। তিন দিনে সেই পথ অতিক্রম করে বেঞ্জামিন যখন নিউইয়র্কে পা রাখলেন, তখন তার পকেট প্রায় খালি; অন্যদিকে কারও কাছ থেকে সাহায্য বা আশ্রয় চাওয়ার মতো পরিচিত কেউ নিউইয়র্কে ছিল না।

 যেহেতু বেঞ্জামিন একমাত্র ছাপাখানার কাজই ভালোভাবে জানেন, সেই জন্য তিনি নিউইয়র্কে একটা ছাপাখানা খুঁজে বের করলেন। ছাপাখানাটার মালিকের নাম উইলিয়াম ব্রেডফোর্ড। ব্রেডফোর্ডের ছাপাখানায় তখন কোনো পদ খালি ছিল না। কিন্তু তিনি বেঞ্জামিনকে চাকরি দিতে না পারলেও একটা আশার খবর জানালেন। নিউইয়র্ক থেকে একশো ষাট কিলোমিটার দূরে ফিলাডেলফিয়া শহরে ব্রেডফোর্ডের এক ছেলে থাকে। সে একটি ছাপাখানার মালিক। কিন্তু তার প্রধান সহকারীর কিছুদিন আগে মৃত্যু হয়েছে। বেঞ্জামিনকে ব্রেডফোর্ড বললেন যে তিনি যদি ফিলাডেলফিয়ায় যান, তাহলে ব্রেডফোর্ডের ছেলের ছাপাখানায় তিনি একটা চাকরি পেলেও পেতে পারেন।

 বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়ায় নৌকায় যাবেন বলে স্থির করলেন। কিন্তু তার এবারের ভ্রমন ছিল অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ। প্রচন্ড তুফান তার নৌকাটিকে পথচ্যুত করে লং আইল্যান্ডের দিকে ঠেলে দিল। লং আইল্যান্ডের কাছে গিয়ে তিনি দেখলেন–শিলাময় উঁচু খাড়াইতে সাগরের ফেনিল ঢেউ গুলি আছড়ে পড়ছে; সেখানে নৌকা ভিড়ানোর কোনো উপায় নেই। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা নৌকায় বসে রইল। নৌকার ছইয়ের অসংখ্য ফুটো দিয়ে বৃষ্টি পড়ে তাদেরকে কাক ভেজা করে তুলল। ক্ষুধা- তৃষ্ণা তাদেরকে আধ-মরা করে ফেলল, কারণ প্রায় ত্রিশ ঘন্টা তাদের পেটে একটা দানাও পড়েনি। বিকেলের দিকে বেঞ্জামিনের তীব্র কম্পণের সঙ্গে জ্বর এল।

 রাতের দিকে জ্বর কিছুটা কমল। অন্য একটি পথ দিয়ে নৌকা পারে লাগিয়ে বেঞ্জামিন সেখান থেকে আশি কিলোমিটার দূরের বার্লিংটন নামের শহরে পায়ে হেঁটে যাত্রা করলেন।বার্লিংটন থেকে ফিলাডেলফিয়া নৌকায় যাওয়া যায় বলে তিনি জানতে পেরেছিলেন।

 বার্লিংটন যাওয়া পথটাও খুব একটা সুখের ছিল না। সারাদিন আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল।ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে বেঞ্জামিন আধমরা হয়ে পড়েছিলেন।তার চেহারা এরকম হয়েছিল যে লোকেরা তাকে কারও বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা চাকর বলে সন্দেহ করেছিল। এভাবে অশেষ দুঃখ কষ্ট সহ্য করে তিনি একদিন বারলিংটনে পৌছালেন এবং সেখান থেকে ফিলাডেলফিয়া যাওয়া নৌকায় উঠে তিনি অবশেষে তার গন্তব্যস্থল অর্থাৎ ফিলাডেলফিয়ায় পা রাখলেন।

 ক্ষুধায় আধমরা হয়ে এবং হাতে একটিও কড়ি না থাকা অবস্থায় ফিলাডেলফিয়ায় এসে উপস্থিত হওয়ার দিন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে সেই দরিদ্র এবং অজ্ঞাত কুলশীল ভাগ্যান্বেষী যুবক শহরে প্রথম পা দেওয়ার ঘটনাটিকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য ভবিষ্যতে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তার বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হবে?


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...