বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
পাঁচ
বেঞ্জামিনের আত্মশিক্ষার শুরু
সাংবাদিক বেঞ্জামিন
বেঞ্জামিন যখন তার দাদার ছাপাশালায় শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন তখন তার বয়স ছিল বারো বছর ।জেমস অর্থাৎ বেঞ্জামিনের দাদা নিজের ছাপাশালা থেকে ‘বোস্টন গেজেট’ নামের একটি খবরের কাগজ প্রকাশ করতেন। কাগজটা ভালো চলল না। জেমস সেটি অন্যকে বিক্রি করে দিয়ে The New England Courant নামের একটি নতুন খবরের কাগজ প্রকাশ করলেন। সেই কাগজে বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ লিখতে শুরু করে বেঞ্জামিন ১৬ বছর বয়সে নিজের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত করেন।
কিন্তু বেঞ্জামিনকে প্রবন্ধ গুলি লিখতে হয়েছিল ছদ্মনামে।নিজের নামে লিখলে দাদা তার লেখা না ছাপাতে পারে বলে তার মনে শঙ্কা ছিল।ছদ্মনাম হিসেবে তিনি বেছে নিলেন একজন মহিলার নাম— শ্রীমতি সাইলেন্স ডগ উদ।শ্রীমতি ডগ উদ লিখতে শুরু করে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন এই বলে —‘আমি অনাচারের শত্রু এবং সদাচারের বন্ধু।’ ছদ্মনামে বেঞ্জামিন যে সমস্ত প্রবন্ধ এবং ব্যঙ্গ রচনা লিখেছিলেন সেই গুলিতে তিনি মানুষকে নানা নৈতিক উপদেশ দেবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ধরনের সামাজিক সমস্যা আলোচনা করে সেইগুলির সমাধানের পথ দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন।বেঞ্জামিন তাঁর সময়ের তুলনায় যথেষ্ট অগ্রণী ছিলেন ।সেই ষোলো বছরের ছেলেটি তখনই ধর্মীয় ভণ্ডামির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন এবং নারী শিক্ষার সপক্ষে উকালতি করেছিলেন। তাঁর সমালোচনা মূলক ব্যঙ্গ রচনা গুলি পড়ে সমাজের মুখ্য ব্যক্তিরা ক্রোধে জ্বলে উঠেছিলেন; কিন্তু অন্যদিকে সেই রচনা গুলি The New England Courant কে করে তুলেছিল বোস্টনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খবরের কাগজ।
বেঞ্জমিনের এই বয়সের আরও একটি বিশেষ ঘটনার কথা এইখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কারণ ঘটনাটি তার মানসিকতা বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে।
জ্ঞানের সন্ধানে বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়াটা ছিল বেঞ্জামিনের নেশা বা অভ্যাস। প্রায় ষোলো বছর বয়সে তিনি কোনো একজন ট্রায়ন নামের লেখক লেখা একটি বই পড়ার সুযোগ পেলেন। বইটিতে আমিষ আহারের চেয়ে নিরামিষ আহারকে স্বাস্থ্যের জন্য বেশি হিতকর বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। লেখকের যুক্তিতে বিশ্বাস করে বেঞ্জামিন আমিষ আহার ত্যাগ করে নিরামিষাশী হওয়া স্থির করলেন। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দিল। তার দাদা অর্থাৎ ছাপাশালার মালিক জেমস মা-বাবার সঙ্গে না থেকে নিজের কর্মচারী এবং শিক্ষানবিশদের সঙ্গে আলাদাভাবে মেস করে থাকতেন। বেঞ্জামিন তাদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু বেঞ্জামিন নিরামিষ আহার খাবেন বলে ঠিক করার ফলে তার জন্য আহার আলাদাভাবে রান্না করতে হল। জেমস সেই কথায় অসন্তুষ্ট হলেন। তখন বেঞ্জামিন দাদাকে এই বলে প্রস্তাব দিলেন যে বেঞ্জামিনের খাবার জন্য সপ্তাহে যতটুকু টাকা খরচ হয় তার মাত্র আধা টাকা যদি জেমস বেঞ্জামিনকে দিতে রাজি হয়, তাহলে তিনি নিজের আহার নিজেই রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। জেমস সেই প্রস্তাবে রাজি হলেন। বেঞ্জামিন তখন ট্রায়নের বইটি পড়ে নিরামিষ আহার প্রস্তুত করার কয়েকটি সহজ নিয়ম শিখে নিলেন। নিরামিষ আহার খেতে আরম্ভ করে দেখলেন যে জেমসের কাছ থেকে পাওয়া টাকার অর্ধেক তার খাওয়ার জন্য খরচ হয়; বাকি আধা টাকা বেঁচে যায়।। বেঁচে যাওয়ার ফলে সেই টাকা দিয়ে তিনি আগের চেয়ে বেশি বই কিনতে সক্ষম হলেন।কেবল তাই নয়, বই পড়ার জন্য তিনি আগের চেয়ে বেশি সময় বের করতে সক্ষম হলেন।
জেমস এবং তার কর্মচারীরা দুপুরের আহার খাওয়ার জন্য বাড়িতে যায়। সেই সময়ে বেঞ্জামিন ছাপা শালায় একা থাকেন। কয়েক টুকরো পাউরুটি বা অল্প ফল টল আর এক গ্লাস জল– এটাই হল বেঞ্জামিনের দুপুরবেলার আহার।এই লঘু আহার খেয়ে নিয়ে তিনি বই পড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং দাদা এবং তার সঙ্গীরা কাজে ফিরে আসা না পর্যন্ত তিনি পড়াশোনা করতে থাকেন। বেঞ্জামিন বিশ্বাস করতেন যে সহজে হজম করতে পারা লঘু আহার মগজকে পরিষ্কার রাখে আর সেই অবস্থায় পড়া কথাগুলি বুঝতে বেশি সহজ হয়।
কিন্তু বেঞ্জামিনের নিরামিষ আহারের প্রতি আসক্তি মাত্র এক বছর স্থায়ী হল। একবার তিনি বোস্টন থেকে জাহাজে উঠে কোনো একটি জায়গায় গিয়েছিলেন।সেটাই ছিল সমুদ্র ভ্রমণের তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা ।জাহাজের যাত্রীরা সমুদ্রের অনেক কড মাছ ধরে সেই সব ভেজে খেতে লাগলেন। ট্রায়ানের যুক্তিতে বিশ্বাস করে নিরামিষাশী হওয়ার আগে বেঞ্জামিন মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন। এখন ভাজা মাছের গন্ধ তার নাকে লাগার সঙ্গে সঙ্গে লোভে তার জিহ্বায় জল আসতে লাগল।কিন্তু তা বলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে লোভের কাছে নতি স্বীকার করলেন না। একদিকে তার নীতি, অন্যদিকে লোভ— এই দুটিকেই তিনি কিছু সময় দাঁড়িপাল্লার মাপতে শুরু করলেন। কী করা উচিত সেই কথা ভেবে থাকার সময় হঠাৎ একবার তাঁর মনে পড়ল যে একবার একটি বড়ো মাছের পেট চেরার সময় তা থেকে অনেক ছোটো মাছকে বেরিয়ে আসতে তিনি দেখেছিলেন।আমিষ আহারের বিপক্ষে ট্রায়নের একটি প্রধান যুক্তি ছিল এই যে আমিষ আহার খাওয়ার অর্থই হল প্রাণী হত্যা—যা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু বড়ো মাছের পেট থেকে ছোটো মাছ বের করার দৃশ্যটি মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্জামিন নিজেকে প্রশ্ন করলেন–‘মাছগুলি যদি একে অপরকে খেতে পারে তাহলে আমি মাছ খেলে কী আর এমন অসুবিধা হবে?’
নিজের সঙ্গে এভাবে তর্কবিতর্ক করে অবশেষে বেঞ্জামিন আশ মিটিয়ে ভাজা মাছ খেতে শুরু করলেন।
এই সম্পূর্ণ ঘটনাটিতে বেঞ্জামিন পুনরায় মাছ খেতে শুরু করার কথাটার চেয়ে যে কথাটি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হল ঘটনাটির মধ্য দিয়ে ফুটে উঠা বেঞ্জামিনের যুক্তিবাদী মনের পরিচয়। তিনি নিজেই লিখে রেখে গেছেন—‘সমস্ত কথাকে যুক্তির মাধ্যমে বিচার করে দেখতে পারার ক্ষমতা থাকলে নানা প্রকারের সুবিধা হয়। তখন মানুষ যে কোনো কথার সপক্ষে বা বিপক্ষে নানা যুক্তি আবিষ্কার করতে পারে।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন