দারোগা বাড়ির স্মৃতিকথা
মো.রিমেল
গ্রীষ্মের সকালে দারোগা বাড়ির প্রধান ফটকে মেঘবালক দাড়িয়ে আছে। একটু পরে কৃষ্ণচূড়ার গাছের অদূরে একটা আম গাছের গুড়িতে বসে সূক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ।
থাকার ঘরের সংকীর্ণ বাতায়নে তাকিয়ে কিছু একটা জিনিসে গভীর মনোনিবেশ করছে দারোগা বাড়ির দাদি। রতন,নিলয় মতিনরা ঢেঁকি ঘরের পূর্বদিকে মাটি খুড়ে চলছে।কারোর হাতে ছোট্ট লাঠি আবার কেউ কাঁচি নিয়ে মাটি খুড়েই চলছে। যেন রাজা গোবিন্দমানিক্য গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছে সে জায়গায়।
স্কুল ছুটি শেষে পাড়ার অনেকে খবর জানতে পেরে যোগ দিয়েছে রতন, নিলয়দের সাথে।কিন্তু কি চলছে?মেঘবালক আর দাদি কেউই অনুমান করতে পারল না।বাতায়নে দাদিকে আর দেখা যাচ্ছে না। হয়তো এই বিষয়ে নালিশ করতে গেছে তার ছেলে জসিম ও মহসিনের কাছে।
একটু পরে রতনের উল্লাস শোনে বুঝা গেল হয়তো সে গোবিন্দমাণিক্য রাজার গুপ্তধন পাতে পেয়ে গেছে।সবাই আরো বেশি মাটি খুড়াতে ব্যস্ত, আমাকে ও পেতে হবে। রতনের খুড়াখুড়ি শেষ। মেঘবালক বলল,
“রতন কি রে?ছেলেমেয়েরা কি খুজে? আর তুই কি পেয়েছিস?
মিষ্টি আলু।
মিষ্টি আলু?
হুম।দেখছো না একপাশে মিষ্টি আলুর লতাগুলো স্তুপ করে রেখেছে। গতকাল পলাশ ভাই মিষ্টি আলু তুলেছে।
-তুলে নিলে তরা আবার কিভাবে এখন মিষ্টি আলু পাচ্ছিস?
পলাশ ভাই ভালো করে তুলে নি। অনেক আলু এখনো মাটির নিচে রয়ে গেছে।”
ঢাক-ঢোলের আওয়াজ ।রতন তার মিষ্টি আলু একটা গাছের তলায় রেখে নিলয়,মতিন নিয়ে পথের দিকে তাকাতেই দেখে একদল লোক ঢাক-ঢোল বাজিয়ে দারোগা বাড়ির দিকে আসছে।
রত্না দিদির বিয়ে উপলক্ষে পানি নিতে ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে একটা দল আসলো দারোগাবাড়ির পুকুরে। তাদের পিছু পিছু চললো রতন নিলয় মতিন সহ বাকিরা। পুকুরপাড়ে বিয়ের গীত গাইতে দেখা গেল খোকাদার মা,রাতুলের দিদি সহ পাড়ার কিছু নারীদের যেন এক উৎসমুখর পরিবেশ।নিয়ম মেনে একটা ডিম পানিতে ফেলে কলস ভরে পানি নিয়ে রওনা হলো রত্না দিদির বাড়িতে।এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই।ঢাক-ঢোলের আনন্দে মগ্ন হয়ে নাচতে শুরু করে দিল রাতুল নিলয়।কিন্তু একটু পরে লক্ষ্য করল মতিন নেই।বাগান,পুকুর ঘাট,উঠোন
সব জায়গায় খুজেও মতিনকে পাওয়া গেল না।রতন,নিলয় বাড়ি চলে গেল।
ঢেঁকি ঘরের পিছনে আম গাছে বেশ টসটসে রসালো আম।আমের পাকা হলদে রঙ দেখে যে কারোর খেতে মন চাইবে। তবে খেতে অনেক টক বলে দারোগাবাড়ির কেউ খায় না। ঢেঁকি ঘরের পিছনে কিছু বিষাক্ত গাছ জন্মেছে। তাই সহজে কেউ যায় না। তবে আজকে জসিম মিয়ার ছেলে আবদুল্লাহ টক আম খেতে বায়না ধরে।
রতনকে ডেকে আনা হলো।
“একটা চগম লাগবো। চগম দিয়ে ঢেঁকি ঘরের উপরে উঠলে পাকা গুলো পাড়া যাবে।
জসিম মিয়া,নে উঠ। মই এর অবস্হা মোটেই ভালো নয়।
অনেক কষ্টে ঢেঁকি ঘরের চালায় উঠলো রতন।আম গুলো যাচাই বাছাই করে পাকাগুলো দেখতে লাগলো রতন। জীর্ণ দেহের ঢেঁকিঘরের মরিচাধরা চালায় পা দিলে যেন চালা ভেঙ্গে নিচে পড়ে যাওয়ার শঙ্কায় অতি সর্তকতায় আম পাড়ার চেষ্টা।মই,জীর্ণদেহের ঢেঁকি চালার লগে লড়াই করে অর্ধেক বস্তা আম নিয়ে নিচে নিচে নামল।
রতন হাত পরিষ্কার করতে গেল পুকুর পাড়ের কলটাতে।এই কল নিয়ে অনেক অলৌকিক কথার প্রচলন আছে।শোনা যায় এই কলে রাতে নাকি পরির এক দল আসতো।কল থেকে পানি নিয়ে যেত।পানি নেওয়ার সময় তাদের পায়ের নুপুরের আওয়াজ শোনা যেত পুরো বাড়িজুড়ে।তাই রাতে কেউ কলে পানি নিতে আসে না।
পাশের বাড়ির সানু মিয়া একদিন রাতে বাড়ি ফিরছিল। পানি পিপাষা পাওয়ায় সেই কলটির কাছে যেতেই তীব্র আলো জ্বলজ্বল করতে দেখেছিল।সাথে নুপুরের আওয়াজ।ভয়ে সানু মিয়া পানি পান করা ছাড়াই বাড়িতের দিকে রওনা হল।
হাত ধোয়া শেষে পেছনে ফিরতে ছোট্ট আবদুল্লাহ দুইটি আম নিয়ে এসে,
নাও খাও,,,
রতন,না তুমিই খাও,,,
জসিম মিয়া,রতন কিছু আম নিয়ে যা বাড়িতে খাইস।ধর,,,
লাগবে না
আরে নিয়ে যা,
আজকে টক খেতে মন চাইছে না।
বিকেলে দারোগা বাড়ির বাগানের দক্ষিণপাশে বেশ বাতাস বইছে।উঠোন ও পুরো বাড়ি জুড়ে প্রশান্তির অনুভতি।
আজ বিকেলে কোনো গোল্লাছুট বা অন্য খেলায় কেউ আসে নি।সবাইকে বাগানের দক্ষিণপাশে আনন্দে মেতে উঠেছে।সবাই নারিকেল পাতার পাখা বানিয়ে প্রতিযোগিতা করছে।দারোগা বাড়ির ছোট ছোট খেজুর গাছগুলোর আর রক্ষা নেই।সব কাটা গায়েব করে দিয়েছে ছেলেমেয়েরা।কারণ নারিকেল পাতার পাখাগুলো চালাতে খেজুর গাছের কাটা লাগে।
দারোগা বাড়ি থেকে মতিনকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল।
মতিন মন খারাপ করে বাড়ি ফিরছে। কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে বুঝা গেল। কিরে মতিন মন খারাপ কেন?
রতন,নিলয়ের সাথে জামেলা হয়েছে।
কি নিয়ে?
মনে আছে কিছু আগে রত্না দিদির বিয়ের জন্য সবাই পানি আনতে গিয়েছিল?
হঠাৎ তাদের কথার কথোপকথন আটকে যায় স্বার্থময় পৃথিবীর ইটের দালানে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন