পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১০
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi
তৃতীয় অধ্যায়, দশম অংশ
(দশ)
সৌম্যদা টেন্ট পাততে চাওয়া শিবিরটা ব্যস্ততার জন্য আমরা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। আমি সৌম্যদাকে বললাম—সৌম্যদা আমাদের কাজগুলি সুষম গতিতে এগিয়ে চলেছে। এখন টেন্ট শিবিরে ব্যস্ত হলে দৈনন্দিন কাজগুলিতে অসুবিধা হবে। টেন্ট শিবিরটা আমরা এখন অনুষ্ঠিত না করে পিছিয়ে দিলে ভালো হবে। নলবাড়িতে রাসমহোৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় শিবিরের আয়োজন করলে অংশগ্রহণকারীরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান দর্শন করার সুযোগ এবং সুবিধা লাভ করবে। তখনই অনুষ্ঠিত করা ভালো হবে নাকি? সৌম্যদা আমার সঙ্গে একমত হলেন। আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম আমাদের পর্যটক নিবাস মুক্ত করার পরের দিন আমরা আমাদের টেন্ট শিবির উন্মোচন করব। আমরা পর্যটক নিবাস তৈরি করার কাজের খবর লাভ করে রাস কমিটি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাঁরা আমন্ত্রণ করা থিয়েটারের বিশিষ্ট অভিনেতা অভিনেত্রীদের জন্য থাকার অসুবিধা। নলবাড়ির হোটেলগুলি চাহিদা পূরণ করতে পারবেনা। আমরা বলেছি রাস পূর্ণিমার দিনেই যেহেতু আমরা উদ্বোধন করার কথা ভাবছি, আপনারাই প্রথম গ্রাহক হতে পারেন।
এই সমস্ত কথার সঙ্গে আমি সৌম্যদাকে আমাদের কাজেরও অগ্রগতির সম্পূর্ণ আভাস দিলাম। জানালাম ঝুপড়িগুলি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। আপনার পাঠানো মানুষ দুটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজগুলি সম্পন্ন করেছে। মানুষ দুটি কর্মঠ। কারেন্ট এবং জলের সরঞ্জাম গুলি আনা হয়েছে। রান্নাঘর এবং কাজ করা মানুষ থাকার জন্য ব্যবহার করা ঘর গুলির মেঝে পাকা করা কাজ সম্পূর্ণ হবে।
সৌম্যদা গাছের চারা রোপণ করার কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্রতিটি বাড়ির মানুষ তাদের বাড়ির পরিসরে গাছের চারা রোপণ করার অনুমতি দিয়েছে। দু একজন প্রথমে দিচ্ছিল না, পরে আমাদের স্বার্থহীন মনোভাবের কথা জানতে পেরে আমাদের নিমন্ত্রণ জানাল। দুই একটি বাড়ির লোকেরা গাছের চারা রোপন করতে যাওয়ার পরে গামছা দিয়ে সম্বর্ধনা জানাল। আমি অত্যন্ত আপ্লুত হয়ে সৌম্যদাকে জানালাম।
—ভালো কাজ করলে, ভালো ফলাফল পাবে। মনে পড়ায় বলে রাখি, তোমাদের মধ্যে যিনি পর্যটক গৃহ সমূহ পরিচালনা করবেন তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন আছে। তিনি যদি প্রকৃতি পর্যটনের ক্ষেত্র সমূহ দেখেননি, তাহলে তাকে দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এক কথায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
—সৌম্যদা। একজন নয়, তিনজনের মতো পাঠাতে হবে। তখন তারা একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারবে। একজনকে পাঠালে অনুষ্ঠানে তাঁর মাতব্বরি বেড়ে যাবার আশঙ্কা আছে।
—উদয়,তুমি ঠিকই বলেছ। তিনজনকেই পাঠিয়ে দাও। আমি শৈলেশদাকে বলে রেখেছি। আজ পুনরায় মনে করিয়ে দেব। এখনই পাঠিয়ে দিলে নিবাসটা আরম্ভ করার সময় তুমি ওদের দায়িত্ব দিতে পারবে। ওরা যদি নিবাস নির্মাণের কোনো দায়িত্বে আছে তিনজনকেই আজ তার থেকে মুক্ত করে দাও।
—আমি সম্পাদককে নীতিনির্ধারক কমিটি একটি সভা আহ্বান করার জন্য অনুরোধ করব। তাতেই তাদের তিনজনকে নির্বাচন করা হবে এবং অভয়াপুরির শৈলেশদার আস্থানায় প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হবে।
সৌম্যদার সঙ্গে কথা অনুসারে সকালবেলা আমি সুনন্দের বাড়িতে উপস্থিত হলাম।সুনন্দ পনেরো দিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়িতে আছে।আমি সুনন্দকে নীতি নির্ধারক কমিটিটার বৈঠক আহ্বান করার জন্য অনুরোধ জানালাম।আমরা কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে।সুনন্দ জিজ্ঞেস করল –আগামীকাল? আমি বললাম—যত তাড়াতাড়ি পারা যায়!সুনন্দ আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি অনামিকাকে জানিয়েছি নাকি?আমি বললাম জানাই নি,তুমি জানিয়ে দিও।আমার মনে হয় অনামিকা কাজের তদারকি করার জন্য দশটার সময় সেখানে যাওয়া উচিত।আমি তাকে বলেছিলাম সে কাজগুলিকে গুরুত্ব দেয় নি।সম্পাদক গুরুত্ব না দিলে কীভাবে হবে!সেইজন্য ভাবছি সে ওখানে যাবে।তুমিও যাবে।আলোচনার মাধ্যমে কাজগুলিকে এগিয়ে নিতে হবে।তিনটি ছেলে নির্বাচন করে পরিচালনার প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে হবে।রাঁধুনি দুজনের কথাও এখন চিন্তা করতে হবে।আমাদের মধ্যে কোনো প্রকৃ্তি কর্মীর রন্ধন দক্ষতা বা রন্ধন প্রকরণে জড়িত হওয়ার ইচ্ছা থাকলে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে নিতে পারব।আমাদের পর্যটক নিবাসের দ্বার উন্মোচন করার মুহূর্ত থেকে আমাদের সুদক্ষ পরিচালক,রন্ধন কর্মী এবং সহায়কারীর প্রয়োজন হবে।তাঁদের প্রত্যেককেই পরিবেশ কর্মী হতে হবে,তাঁদের ব্যবহারে থাকতে হবে অতিথি পরায়ণতা।
সুনন্দের বাড়ি থেকে আমি বিদায় নিয়ে সোজাসুজি নির্মাণ স্থলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম।বাঁধ থেকে নেমেই দেখতে পেলাম কিছুটা সামনে দিয়ে অনামিকা যাচ্ছে।অনামিকার হাতে একটি ব্যাগ।জানি না ব্যাগে কী আছে।অনামিকা সোজাসুজি কাজের লোকদের থাকার জন্য তৈরি বাড়িটার দিকে যাচ্ছে।সে সেখানে ব্যাগটা রেখে ইতিমধ্যে নির্মাণ সমাপ্ত হওয়া ঝুপড়ি দুটোতে ঢুকেছে।ঝুপড়ি দুটোর বিদ্যুৎ এবং জল জোগানোর সাজসরঞ্জাম গুলি লাগানো হয়েছে।আজ ব্যবহৃত বাঁশে পোকা না ধরার জন্য ঔষধ ছিটিয়ে দেবে আর তারপরে বার্নিশ করবে।এই কাজটুকু করলে ঝুপড়ি দুটিতে বিছানা পাতা এবং অন্যান্য সামগ্রী ঢোকানো যাবে।বাকি দুটি ঝুপড়ির বিদ্যুৎ জল পরিবহনের সরঞ্জামগুলি লাগানোর কাজ বাকি রয়েছে।আগামী দুদিনে সেই কাজটুকুও সমাপ্ত করতে হবে।আগামী দশ দিনের মধ্যে স্বপ্নের পর্যটন নিবাসটি বাস্তব রূপ লাভ করবে।
আমাকে আসতে দেখে অনামিকা এগিয়ে এল।আমি গাছের নিচে পেতে রাখা একটা চেয়ারে বসলাম,সেও এসে পাশের চেয়ারটাতে বসল।
--কোথাও গিয়েছিলেন?রুমে দেখতে পেলাম না যে!
তোমার কী প্রয়োজন—ভেবেছিলাম এভাবে বলব।সকাল সকাল ওকে অপদস্থ করতে ইচ্ছা হল না।
--সম্পাদকের ঘরে গিয়েছিলাম।
--আমি কোনো সম্পাদক নই নাকি?না কি সম্পাদিকার ঘরে যান না?
--সম্পাদিকা নিজের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করছে।সম্পাদক করছে না বলে তার ঘরে যেতে হল।আমাদের দুজন সম্পাদক বলে খারাপ হয়েছে।তবে তোমরা দুজন মিলিত হয়েছ কি?ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কী ভাবছ?
--আপনাদের এইজন সম্পাদকও এসেছে দাঁড়ান।মুখোমুখি কথাগুলি খোলশা করে নেওয়া ভালো হবে।
কিছুক্ষণ পরে সুনন্দ এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করল।
--সুনন্দ, তুমি অনামিকার সঙ্গে কথাগুলি আলোচনা করেছ কি?দুজনে মিলে কথাগুলি আলোচনা করে মিলে-মিশে এগোবে।আমি আজ আছি,কাল নেই।নভেম্বরের শেষে আমার ছুটি শেষ।আমি চলে যাব।তোমাদেরই সবাইকে পরিচালনা করতে হবে।তোমাদের মধ্যে বিপিন ডেকা মানুষটি ভালো।তার উপরে নির্ভর করতে পার।
--আপনি যে আমাদের মাঝখান থেকে চলে যাবেন,সেটা তো ভাবতেও খারাপ লাগে।
--উপায় নেই।একেই বলে চাকরি।চাকুরীজীবীরা অতি বেশি সময়ের দাস।যাই হোকনা কেন তোমরা সংগঠনের নামে থাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তোমাদের সভাপতি সম্পাদকের সইয়ের দ্বারা টাকা উঠানোর মতো ব্যবস্থা করে নেবে।কমিটি গঠন হওয়ার আগেই অ্যাকাউন্টটা খোলা হয়েছিল বলে আমার নামেই করা হয়েছিল।পঞ্জীয়নের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন।ব্যাঙ্ক অফিসার হিসেবে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আমার সুবিধাও ছিল।এখন যেহেতু পঞ্জীয়ন হয়ে গেছে প্রত্যেককেই নিয়মের মধ্য দিয়ে এগোনো ভালো।তোমরা দুজন আগামীকাল গিয়ে কাজটা এগিয়ে রাখবে।সঙ্গে নীতি নির্ধারক কমিটির একটি বৈঠকও আগামীকাল অনুষ্ঠিত কর।সেখানে আমাদের আগামীকাল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।বিশেষ করে তিনটি ছেলেকে পর্যটক নিবাস পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য অভয়াপুরীর আস্থানায় পাঠাতে হবে।নিবাস দেখা-শোনার জন্য ব্যবস্থা করা রাঁধুনি এবং সহায়কদের বিষয়েও আলোচনা করতে হবে।নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করতে হবে।সে কথাও আলোচনা করতে হবে।ভবিষ্যৎ কার্যপন্থা কীরকম হবে আলোচনা করার জন্য পর্যটকনিবাস সমিতিটাও তৎকালে গঠন করতে হবে।দ্রুততার সঙ্গে করার মতো কয়েকটি কাজ আছে।
আমি সুনন্দর দিকে কথাটা বলতে থাকার মধ্যে অনামিকা উঠে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।
--কোথায় যাচ্ছ।আমার কথায় গুরুত্ব দিচ্ছ না নাকি।
--এভাবে কেন বলছ উদয় দা।আপনি এরকমম ভাবলে খারাপ লাগে।আমি ব্যাগটা আনতে যাচ্ছি।
--যাও।যাও।
কাজ করা লোকদের জন্য তৈরি হওয়া বাড়িটার জন্য অনামিকা ব্যাগটা নিয়ে এল।ব্যাগের ভেতর থেকে সে একটা ফ্লাস্ক,একটা টিফিন এবং তিনটি ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া গ্লাস বের করল।
--অনামিকা বৌ্দি কী এনেছ?
--সকালের জলখাবার।
--বাঃ সুন্দর।এতক্ষণ বলনি কেন।দাও তাড়াতাড়ি দাও।আমিও বাড়িতে কিছু না খেয়েই চলে এসেছি।আসলে আমার মন বলছিল তুমি আমাদের জন্য বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসবে।
সুনন্দ এভাবে বললেও আমি বুঝতে পারছি অনামিকা এভাবে সকালের জলখাবার আনার কারণ কি।আমি যে ওকে বলেছিলাম তোমরা আমি এক কাপ চা খেয়েছি কিনা তাও জিজ্ঞেস কর না।আবেগিক মুহূর্তে আমার মুখ থেকে বের না হওয়া কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল এবং এটা তারই ফল।
--কেন এনেছ এসব।প্রয়োজন ছিল না।
--সত্যিই প্রয়োজন ছিল না নাকি?তাহলে রেখে দিচ্ছি।
--বৌ্দি যা করার কর,মাত্র আমার অংশটুকু দিয়ে দাও।
সুনন্দ অনামিকাকে খ্যাপানোর উদ্দেশ্যে বলল।
ওকে এভাবে বললেও আমারও অবশ্য ক্ষুধা পেয়েছিল।হরিণের দোকানে সবসময় আসা যাওয়া হয় না।কখনও মেগী সিদ্ধ করে খেয়ে নিই।প্রায়ই খাওয়া হয় না।এভাবেই সারা দিন পার হয়ে যায়।জিজ্ঞেস করার মতো কেউ নেই।অনামিকা নিয়ে আসা কলাপাতায় দেওয়া পিঠা এবং লাল চা সহ আমাদের সকালের জলপান সুকলমে সম্পন্ন হয়ে গেল।
পর্যটক নিবাস পরিচালনা করার প্রশিক্ষণের জন্য আমরা কাকে কাকে পাঠালে ভালো হবে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করা উচিত।সঙ্গে দুজন রাঁধুনী।যদি আমাদের প্রকৃ্তি কর্মীদের মধ্যে কোনো ভালো রাঁধুনী থাকে ,সেরকম দুজনকে পাঠানো ঠিক হবে।
--তিনজন পরিচালক নির্বাচনের জন্য আমরা একটা কাজ করি চলুন।তিনজনেই একটা একটা করে কাগজ নিয়ে তাতে তিনটা করে নাম প্রস্তাব করি।তিনজনের মধ্যে যে তিনজন বেশি প্রাধান্য লাভ করবে তাদের নির্বাচিত করা হোক।হবে তো?
অনামিকার প্রস্তাবটা খারাপ মনে হল না।আমরা তিনজনেই তিনটা কাগজ হাতে নিলাম।কিন্তু একটা কলম ছিল বলে অনামিকাকে প্রথম নামটা লিখতে বললাম।তারপরে সুনন্দ এবং সবার শেষে আমি তিনজনের নাম লিখলাম।অনামিকাকে বললাম এখন তুমি কাগজ তিনটাতে থাকা নামগুলি ডেকে দাও।আমাদের তিনজনকেই অবাক করে দিয়ে আমরা তিনজনেই একই নাম তিনটা লিখলাম—অচ্যুত,পুলক আর রাতুল।আগামীকাল আনুষ্ঠানিকভাবে তিনজনের নামটা প্রস্তাব করবে এবং পরের দিন তিনজনকেই অভয়াপুরী যাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলবে।সকালের বহাগী নামের রেলটিতে ওরা তিনজন বঙ্গাইগাওঁ যাবে।
স্টেশন থেকে অভয়াপুরীতে অনেক ছোটো গাড়ি চলাচল করে।তাঁরা তাতেই অভয়াপুরী যেতে পারবে।আমি সৌ্ম্যদার মাধ্যমে সমস্ত যোগাড়-যন্তর করে রাখব,কোনো সমস্যা হবে না।
নীতিনির্ধারক কমিটির সভাটা আগামীকাল সন্ধ্যা চারটায় এখানেই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল।
সেই অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ের আগে তিনটার সময় অনামিকা এসে হাজির।হাতে একটা ব্যাগ।সারাদিনের কাজ কর্মের খতিয়ান নিয়ে আমি ঠান্ডা বাতাস পাওয়ার জন্য গাছের নিচে চেয়ার পেতে বসেছিলাম।নিজের অজান্তে আমি তন্দ্রালস হয়ে পড়েছিলাম।সামনে অনামিকাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম।
--চমকে উঠলে যে,উদয়দা,কোনো দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন নাকি?
যে অনামিকা আমি সামনে থাকলে কয়েকহাত দূরে চুপ করে থাকত, তুমি সম্বোধন করার পর থেকে দেখছি আজকাল ঝাঁঝালো সুরে কথা বলে। একই কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আপন বলে ভেবেই বলেছে। অনামিকা চেয়ারে বসে ব্যাগ থেকে দুটো টিফিন বের করল। তারপরে নিন বলে একটা থালা আমার দিকে এগিয়ে দিল।
— কী করছেন?
— আগে ধরুন ।তারপর জিজ্ঞেস করবেন কী করছি।
যন্ত্রের মতো আমি থালাটা হাতে নিলাম। অনামিকা টিফিন দুটির একটি খুলে দেওয়ায় জুহা চালের গন্ধ ভেসে এল।
— আমি দিনের বেলা ভাত খাই না।
—জানি, রাতেও খান না। খেতে না পেলে কোথা থেকে খাবেন?
মাঝেমধ্যে আমি ধর্ম সংকটে পড়ি। কখনও ছোটো ছোটো কথায় কখনও বড়ো বিষয় নিয়ে। অনামিকা টিফিন বক্স থেকে ভাত এবং ভাজা বের করে আমি ধরে থাকা থালার উপরে ঢেলে দিয়ে টিফিন বক্সটা বন্ধ করে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল তারপরে অন্য টিফিন বক্সটা খুলে তার মধ্যে থাকা তরকারির সঙ্গে থাকা টিফিনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।
— এখন আমি উঠলাম, তারা কি কাজ করছে দেখে আসি। আমি থাকলে আপনি খেতে লজ্জা পাবেন। আপনাকে তো জানি। ব্যাগের ভেতরে জলের বোতল আছে। বের করার কষ্টটুকু করে নেবেন।
অনামিকা সোজাসুজি কাজ করতে থাকা লোকগুলির দিকে এগিয়ে গেল। সত্যি অনামিকা পাশে থাকলে আমার ভাত খাওয়া হত না। আর এখনও ভাতগুলি একান্ত বাধ্য হয়েই খেতে হচ্ছে। মাগুর মাছ আর ভেদাইলতা আলুর ঝোল। সবুজ ঝোলের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা আলুর টুকরো গুলির সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে কেন যে ইচ্ছা হল। তিন টুকরো বড়ো বড়ো মাগুর মাছ। আজকের দিনটাতে আমার জন্য রীতিমতো অভিজাত খাদ্য। অনামিকা আসার আগে আমি কোনো মতে ভাতটা খেয়ে নিলাম।
— বোতলটা দাও।
— আমি জল ঢেলে দিলে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। হাতটা ধুয়ে নিন।
পরিবেশটা আমার কেমন যেন ভালো লাগল না। তথাপি আমি অনামিকার সঙ্গে সহযোগিতা করলাম। জলের বোতলটা আবার তার হাতে ফিরিয়ে দিলাম। অনামিকা বাসনপত্র গুলি গুছিয়ে নিয়ে ব্যাগে ভরে পুনরায় আমার কাছে বসল। খাবার কেমন হয়েছে সেও আমাকে জিজ্ঞাসা করল না, আমিও কিছু বললাম না।
— উদয় দা, চলে গেলে আমরা চালাতে পারব কি? তার চেয়ে আপনি বরং এখানেই থেকে যান।
— চাকরি ছেড়ে দেব নাকি?
— ছেড়ে দিন।
এত তাৎক্ষণিকভাবে অনামিকা বলেছিল যে বেচারার প্রতি আমার করুণা জন্মাল। প্রায় লক্ষ টাকার একটা চাকরি ছেড়ে দেওয়া কি মুখের কথা । তথাপি অনামিকাকে জানতে এবং বুঝতে আমার ইচ্ছা হল।
— আমাকে কে খাওয়াবে?
— আমি।
— কোথা থেকে?
— পর্যটক নিবাস থেকে। আমার পেনশন থেকে।
কাকাবাবুর বৌমা সত্যিই এখনও ছোট্ট মেয়েটির মতোই রয়েছে। সংসারে প্রবেশ করেছিল মাত্র। বুঝে ওঠার আগেই সমস্ত কিছু কেমন যেন গন্ডগোল হয়ে গেল। আমি আর তার সঙ্গে কথা বাড়াতে চাইলাম না। আমি ভাবলাম এখন থেকে আমাকে সংযত হতে হবে। আমি চুপ করে রইলাম।
— কী হল উদয় দা। ভয় পেলেন। আমি জানি আপনার মতো সরল মনের মানুষ পর্যটক নিবাস চালাতে পারবে না। ব্যাবসা এভাবে হয় না। আপনি যা যা বলেন সবাই বিশ্বাস করে। বুদ্ধি করে খরচ করতে জানে না।
আমি চুপ করে রইলাম। অনামিকা আমাকে বুঝতে চাইছে বলে মনে হল।
আপনি এতটা কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন অথচ একজন মানুষকেও কোনোদিন কোনো শক্ত কথা বলেন নি।
— সেরকম ভাবে বলার প্রয়োজন হয়নি। ছোটো ছোটো কথাগুলি উপেক্ষা না করলে সংগঠন করবেন কীভাবে। সেই জন্য আমি সংগঠন করব আর তোমরা ব্যবসা। পর্যটক নিবাসের কমিটিটাতে আমি থাকব না, অরণ্য গ্রামের কমিটিতে থাকব। অরণ্য গ্রাম আমার স্বপ্ন।
--আর পর্যটক নিবাস আপনার কাছে বাস্তব ।আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। নিবাসটা বন্ধ হয়ে গেলে?
—তোমাদের যতটুকু দরকার আমি করে দিয়েছি, এখন যা করবে তোমরা।
— আপনার টাকা পয়সা গুলি বিফলে যাবে নাকি?
— আমি বললাম— অনেক প্রশ্নের উত্তর না থাকার মতো এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর আমার হাতে নেই।
—-আপনার হাতে উত্তর আছে আপনি সেটাই স্বীকার করতে চান না।
অনামিকা আর আমি তর্কের সুরে কিছু সমস্যার সমাধান আলোচনা করছিলাম। তখনই পুলক এবং রাতুল এল। সুনন্দ এবং বিপিন ডেকা এল। চারটার সময় আমাদের সভা আরম্ভ হল। নীতি নির্ধারক কমিটির সভা। আমরা আলোচনা করা অনুসারে অচ্যুত পুলক এবং রাতুলকে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত শুনে তিনজনই খুব আনন্দ পেল।। ওরা দশ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যাবে সমস্ত ব্যবস্থা সৌম্যদা করে রেখেছে বলে সকাল বেলা আমাকে ফোন করে জানিয়েছে। রান্নার কথা উঠায় পুলক বলল তার বন্ধুও মায়াপুরে যে অ্যাপেটাইজার নামে রেস্টুরেন্ট আছে সেও নাকি দুজন রাঁধুনি দিতে পারবে। দুজনেই ভালো রাধুনী। আমি বললাম তাদের সঙ্গে চুক্তিপত্র করে নিতে হবে। অন্যথা মাঝ রাস্তায় চট করে চলে গেলে সমস্যায় পড়বে। অবশ্যই ওরা যখন কাজ করতে শুরু করবে তাদের দুজন থেকে তোমাদের কেউ কেউ রন্ধন রন্ধন প্রকরণের বিষয়ে শিখে নিতে হবে। তাহলেই রান্নার সমস্যার সমাধান হবে। স্থানীয় প্রকৃতি কর্মী না পাওয়া গেলে তোমরা ক্ষতিকর ভাবে দুজনকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতে হবে।নীতি নির্ধারণ কমিটির সভায় আগামী রবিবার প্রকৃতি পর্যটন অর্থাৎ পর্যটক নিবাস এবং অরণ্য গ্রাম পরিচালনা করার জন্য দুটি কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির কোনো প্রকৃতি কর্মী যদি প্রকৃতি নিবাসে কাজ করতে চায় তাকে প্রাধান্য দেওয়াটা জরুরী বিবেচনা করতে হবে। সেই জন্য দুটি কমিটি গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। আজ বুধবার। আগামী রবিবার পর্যন্ত পারা যাবে কি? আমি নবজিৎ বৈশ্যকে জিজ্ঞেস করলাম। নবযুগের মতে না পারার কোনো কারণ নেই।
আমরা সবার কাজ প্রায় শেষ করেছি। সেই সময় দেখতে পেলাম একদল ছেলে আমাদের দিকে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। দলটির সবচেয়ে বড় ছেলেটির বয়স চৌদ্দ বছরের মতো হবে। তার পেছন পেছন বিভিন্ন বয়সের একদল ছেলে। সে দৌড়ে এসে আমাদের বলতে শুরু করল যে সেখানে একজন মানুষ একটা গাছ কাটতে শুরু করেছে। আমরা বাধা দেওয়ায় আমাদের মারার জন্য তেড়ে এসেছিল। তার বাড়ির গাছ সে কাটবে কিনা কাটবে সেটা নাকি তার নিজস্ব ব্যাপার।
আমি নবজিৎকে বললাম দুটো গাছের চারা নিয়ে সঙ্গে চল।গাছের চারা দুটি নিয়ে আমরা ছেলেদের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম। আমরা গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মানুষটা গাছটা কেটে প্রায় ফেলে দেবার উপক্রম করেছিল। আমরা যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম গাছটা তিনি কি প্রয়োজনে এই সন্ধ্যা বেলা কাটতে শুরু করেছেন তখন তিনি বললেন এমনিতে থাকার চেয়ে কেটে ফেলব ভাবছি। আমি নবম শ্রেণির ছেলেটিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম তুমি এখন কাকুকে বুঝিয়ে দাও আমাদের কেন গাছ কাটা উচিত নয়।ছেলেটিকে আমরা কেউ কিছু শিখিয়ে দিইনি। সে একনাগারে একটা গাছের উপকারিতা সম্পর্কে বলে গেল। গাছ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অম্লজান যোগায়।গাছ আমাদের ছায়া দান করে। ফলমূল দান করে আমাদের এখানকার মতো নদী তীরের অঞ্চলগুলিতে গাছ ভূমির ক্ষয় রোধ করে। গাছের শুকনো ডাল আমাদের কাছে ইন্ধন। কিন্তু সম্পূর্ণ গাছ একটা কেটে ফেললে আমাদের পরিবেশের উপরে তার খারাপ প্রভাব পড়বে। কথাটা বলে প্রথমেই ছেলেটি গাছ কাটা মানুষটার দিকে এবং পরে আমার দিকে তাকাল। ছেলেটির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই জোরে হাতে তালি দিয়ে উঠলাম।ছোটো ছেলেদের দলটি চেঁচিয়ে উঠল। এটা ভেবে ভালো লাগলো যে আমাদের অজ্ঞাতসারে বরকুরিহা গ্রামে আমাদের পাখিদের পাড়া প্রতিবেশীতে বয়স নির্বিশেষে প্রকৃতি আন্দোলন জেগে উঠেছে।
—দাদা এই ছোটো ছেলেটি বুঝতে পেরেছে গাছের উপকারিতা এবং আপনি অপ্রয়োজনে একটা গাছকে হত্যা করেছেন৷
মানুষটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। তিনি কী করবেন না করবেন বুঝতে পারছেন না। মানুষটাকে সহজ করে দেবার জন্য আমি বললাম এখন যা হবার হয়ে গেছে। যা হয়ে গেছে তাকে তো আর ফেরানো যাবে না। আপনি গাছটার কাছে একটা গাছের চারা লাগিয়ে দিন। আর ছেলেটি—কী কি নাম তোমার ভাই– নয়ন— এখন নয়ন তুমি অন্য গাছের চারাটা একটু দূরে লাগিয়ে দাও । মানুষটা একটা শব্দ ও উচ্চারণ না করে হাতে থাকা দা নিয়ে গর্ত খুঁড়তে লাগল। দুজনে দুটি চারা রোপণ করার পরে মানুষটাকে চারা দুটি প্রতিপালন করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে নমস্কার করলাম।
আসার সময় নয়নকে জড়িয়ে ধরে সুন্দর কাজের জন্য তাকে প্রশংসা করলাম এবং ছোটো ছোটো ছেলের দলকে বললাম— তোমরা আসবে , আমরা একসঙ্গে চারাগাছ লাগাব। ছেলেদের মধ্যে অরণ্য সংরক্ষণের মনোভাব জেগে ওঠা কার্যকে আমরা আমাদের সফলতা বলে বিবেচনা করছি।
পরের দিন আমরা এরকম অন্য একটি সমস্যার সম্মুখীন হলাম। আমাদেরই একজন প্রকৃতি কর্মী, নাম অবিনাশ। নলবাড়ি মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র। সকালবেলায় সে এসে আমি থাকা পর্যটন নিবাসের ঘরে উপস্থিত হল। জোরে সাইকেল চালিয়ে আসার জন্য তার কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। সে এসেই আমাকে বলল ওদের গ্রামের কয়েকজন ছেলে রাতে জাল পেতে একটা ভাম ধরেছে। সেটা নাকি আজ মেরে ভোজ খাবে। তাই আমাকে যেতে হবে। আমি নবজিৎকে ফোন করলাম। নবজিৎ তখনও বিছানায়।নব জিৎ কে বললাম কিছু মনে কর না এটা সময়ের দাবি। আমি ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিয়ে নবজিতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।দশ মিনিটের মধ্যে নবজিৎ এসে উপস্থিত হল।ঘটনাস্থলে আমাকে এবং নবজিৎকে দেখতে পেয়ে ভাম ধরা ছেলেরা অবাক। নবজিৎ বলল প্রায় প্রত্যেকই তার ছাত্র। ওদের মধ্যে কোনো একজন জালে বন্দি হয়ে থাকা জন্তুটাকে মারার জন্য খোঁচাতে শুরু করেছে, কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করছে। আমাদের দেখে ওরা পিছিয়ে এল। নবজিত বলল— তোরা পাগল হয়েছিস? এই অবুঝ জন্তুটার ওপর এত অমানুষিক অত্যাচার করছিস কেন? তোরা হয়তো জানিস না, অরণ্য আইন অনুসারে তোরা শাস্তির যোগ্য। ছেলেরা নিশ্চুপ।ছেলেদের একজন অভিভাবক দৌড়ে এসে নবজিৎকে জিজ্ঞেস করল কে আপনি? আপনি কে?
নবজিৎ রুখে দাঁড়িয়ে বলল— আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করার আপনি কে? এই জন্তুটা ধরতে আপনি ছেলেদের সাহায্য করেছেন নাকি?জালটা কি আপনার ?
ছেলেরা দেখল ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াচ্ছে। স্যার না রেগে যান।রেগে গেলে কি অবস্থা হতে পারে সেটা তারা বিদ্যালয়ে দেখতে পেয়েছে।
— স্যার!স্যার! আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা না জেনেই—
—কী ভুল হয়েছে তোদের? বন্য জন্তু,ইনি কি তার মালিক নাকি?
অভিভাবকটি পুনরায় বেপরোয়া ভাব ভঙ্গিমায় উচ্চবাচ্য করতে লাগল। অভিভাবকের স্ত্রী দৌড়ে এসে মানুষটাকে হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল— ইনি আমাদের বাপুর স্যার, আপনি কেন এভাবে বলছেন। দেখি,আপনি এখান থেকে চলে আসুন।
মানুষটার তখন চেতনা ফিরে এল। তিনি ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে পড়লেন।
সেই সুযোগে আমি ছেলেদের বললাম— তোমাদের কেউ জন্তুটাকে চিনতে পেরেছ কি?
—-স্যার ভাম।
উপস্থিত ছেলের দলের মধ্যে একজন বলল।
— তুমি ঠিকই বলেছ। এটাকে অসমিয়াতে তাড়ি খাওয়া ভাম বলা হয় । ইংরেজিতে এশিয়ান পাল্ম সিভেট। বৈজ্ঞানিক নাম পারাডকচারচ হারমাফ্রডাইটাচ। এই জন্তুটা এখন দুষ্প্রাপ্য জন্তুর সারিতে পড়ে। তোমাদের জন্তুটিকে ছেড়ে দিতে হবে। মাংসের জন্য হত্যা করার ফলে অসাম থেকে ভাম বিলুপ্ত হওয়ার অবস্থা হয়েছে। তোমরা এত ভালো ছেলে, বন্য জন্তু গুলিকে তোমাদের ভালোবাসা উচিত।এদের বাসস্থান বৃদ্ধি করার জন্য গাছ রোপণ করতে হবে। দেখতো প্রাণ রক্ষার জন্য কীভাবে সে সজল নয়নে তোমাদের দিকে তাকাচ্ছে। ভামটার এই অবস্থা দেখে তোমাদের মধ্যে কার কার খারাপ লাগছে হাত ওঠাও। একজন ছাড়া প্রত্যেকেই হাত উঠাল। যে ছেলেটি হাত উঠায়নি তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কেন হাত উঠায় নি। তার মতে পৃথিবীর সমস্ত কিছুই মানুষের ভোগের জন্য।ভামটা নিজের ভোগের জন্য ইঁদুর খায়।আমি তাকে বললাম তুমি কেন ভাবছ যে নিজে খাওয়াটাই ভোগ। সে ইঁদুর খায়, সেটা তার খাদ্য। ভাম নিজের ভোগের জন্য তোমার খাদ্য খায় না। তুমি তার গতিবিধির লক্ষ্য করে, তাকে সংরক্ষণ করে ও ভোগ করতে পার। পাখ-পাখালি, জীবজন্তু গুলি মরে না গেলে তুমি তোমার সন্তানরা কী নিয়ে ভোগ করবে। ছেলেটি নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম, তোমরা এসো, আমরা একসঙ্গে পাখ-পাখালি জীবজন্তু ইত্যাদির সংরক্ষণের জন্য কাজ করব। তারপর দেখবে হত্যা করার চেয়ে জীবন দান করায় বেশি ভোগ করা যায়। দশের হিতের জন্য ত্যাগের সঙ্গে কাজ কর। এখন তোমরা একে ছেড়ে দাও। দেবে তো?
প্রতিবাদ করা ছেলেটিই প্রথম বলল– হ্যাঁ স্যার দেব।
ওরা ভামটাকে ছেড়ে দেবার যতই চেষ্টা করছে, সে ততই জালটাতে আরও জড়িয়ে পড়ছে। জালটার এক মাথায় ধরে তুলে দিয়ে আমি একটু কষ্ট করে ভামটাকে ছাড়িয়ে আনলাম। ভামটা তীব্র বেগে দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
এই ঘটনা থেকে আমরা কয়েকটি শিক্ষা গ্রহণ করলাম। প্রথমে আমাদের স্থানীয়ভাবে কয়েকটি সজাগতা শিবিরের আয়োজন করতে হবে। আমরা একটি ফোন নাম্বার সবাইকে দিতে হবে যাতে এই ধরনের ঘটনার বিষয়ে কেউ কোনো খবর পেলেই আমাদের প্রকৃতি কর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেবে।
মাছ মারা জালে ফেঁসে যাওয়া সাপের উদ্ধার, খাঁচায় বন্দি করে রাখা পাখিকে মুক্ত করে দেওয়া এই ধরনের কয়েকটি কাজ আমাদের প্রকৃতি কর্মীরা শুরু করেছে। সাপের বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করা নবজিৎ বর্মন কর্মীদের সাহায্য করছে। ফোন পেলেই নবজিৎ দৌড়ে আসে। নতুন নতুন কর্মগাঁথুনির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে অরণ্য গ্রাম এবং পর্যটন নিবাসের কাজ।
আজ রবিবার। আজ পর্যটক নিবাস এবং অরণ্য গ্রাম পরিচালনা করার জন্য দুটি কমিটি গঠন করার কথা। সময় দেওয়া হয়েছে এগারোটার সময়। নয়টা থেকে প্রকৃতি কর্মীরা ইতিমধ্যে রোপণ করা প্রতিটি গাছের চারার দেখাশোনা করবে। গোড়ায় গজিয়ে ওঠা জঙ্গল পরিষ্কার করবে। বেড়াগুলি মেরামত করবে। কোথাও কোনো চারা যদি মরে যায় তাহলে সেই জায়গায় নতুন চারা লাগাবে। এগারোটার সময় প্রত্যেকেই মিলিত হবে সাংগঠনিক ভিত্তি সবল করার জন্য। অচ্যুত ,পুলক এবং রাতুল ইতিমধ্যে অভয়া পুরীতে গিয়ে শৈলেশদার অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। আমি তাদের নিয়মিত খবরাখবর করছি।
সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তির তৎপরতায় পর্যটক নিবাস উদ্বোধন করার জন্য প্রায় প্রস্তুত হয়ে উঠেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন