শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৪

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudeb Das

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





চার

বেঞ্জামিনের আত্মশিক্ষার শুরু

 স্কুল ছাড়ার পরে প্রায় দুই বছর বেঞ্জামিন তাঁর পিতার ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

  বেশিরভাগ দুঃখী ছেলে-মেয়ে স্কুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি হওয়া বলে মনে করে। কিন্তু বেঞ্জামিনের ক্ষেত্রে হল ঠিক উল্টোটা। স্কুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হল তার আত্মশিক্ষার সাধনা— যা অব্যাহত ভাবে চলতে থাকল তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজে লিখে গেছেন—’শৈশব থেকেই বই পড়তে আমি খুব ভালোবাসতাম। হাতে কিছু টাকা এলে আমি সেই টাকা অন্য কোনো কাজে খরচ না করে কেবল বই কিনতাম। বুনিয়ানের Pilgrims Progress নামের বইটি পড়ে খুশি হয়ে আমি তার অন্য বই গুলোও কিনেছিলাম। সেই বইগুলি ছিল আমার বইয়ের প্রথম সংগ্রহ। পরে সেই বইগুলি বিক্রি করে সেখান থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে আমি আর বার্টনের ইতিহাস রচনার সংকলন গুলি কিনেছিলাম।বইগুলির আকার ছোটো ছিল এবং দামও বেশি ছিল না।আমার বাবার ছোটো গ্রন্থাগারটিতে থাকা বইগুলির বেশিরভাগ ছিল ধর্ম সম্পর্কে বাদানুবাদের বই। বই গুলির বেশিরভাগই আমি পড়েছিলাম যদিও মনে এই বলে একটা আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল যে সময় আমার জ্ঞানের তৃষ্ণা ছিল অতি প্রবল, সেই সময়ে সেইরকম তৃষ্ণা পূরণ করার জন্য বই পড়তে পেলে আমার নিশ্চয় বেশি উপকার হত ।আমি যেহেতু ধর্মযাজক হওয়ার সংকল্প বাদ দিয়েছিলাম সেই জন্য ধর্ম সম্পর্কিত বই পড়া থেকে আমার বিশেষ কোনো লাভ হল না। বাবার গ্রন্থাগারে প্লুটার্কের Lives বইটা ছিল। সেটা আমি উল্টেপাল্টে পড়েছিলাম আমি এখনও ভাবি যে সেই বইটি পড়ার পেছনে যে সময়টুকু খরচ করেছিলাম তা সম্পূর্ণ সার্থক হয়েছিল।গ্রন্থাগারটিতে ডিফোর Essays on Projects এবং ডক্টর মেথারের Essays to do Good নামের অন্য দুটি বই ছিল। আমার জীবনে ভবিষ্যতে ঘটতে চলা কয়েকটি প্রধান ঘটনার ওপরে সেই বই দুটির প্রভাব পড়েছে বলে আমার মনে হয়।’

 পিতার ছোটো গ্রন্থাগারটির বইপত্র পড়ে শেষ করার পরে অন্যান্য জায়গায় বইয়ের খোঁজ করতে লাগলাম। পিতা প্রথমে তাকে ধর্মযাজক করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু বইয়ের প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে তিনি অবশেষে প্রিন্টার তথা মুদ্রক করার জন্য ঠিক করলেন।আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে একটি নতুন সভ্যতার শুরু করা ইংরেজদের মধ্যে সেই সময়ে ছাপাশালা একটি অতি জনপ্রিয় ব্যাবসা ছিল। জোসিয়া ফ্রাঙ্কলিনের অন্য একজন ছেলে জেমস ইংল্যান্ডের মুদ্রণ বিদ্যা শিখে স্বদেশে ফিরে এসে বোস্টনে একটি ছাপাশালা আরম্ভ করেছিলেন এবং সেখান থেকেই তিনি একটি খবরের কাগজ বের করেছিলেন। পিতার নির্দেশ অনুসারে বেঞ্জামিন শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিলেন। তখন তার বয়স মাত্র বারো বছর।

  জেমসের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল যে একুশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাদার ছাপাশালায় শিক্ষানবিশ হয়ে থাকবেন এবং সেই সময় তিনি বেতনের পরিবর্তে কেবল দৈনিক হাজিরা পাবেন। সে যে কাজে হাত দেয় সেই কাজটির সমস্ত কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝে নিয়ে তাকে নিখুঁতভাবে করাটা ছিল তার স্বভাব। ছাপাখানার কাজও তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে শিখতে লাগলেন। অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে তিনি সেই কাজে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠলেন।

 কিন্তু ছাপাখানার কাজে যোগ দিয়ে তিনি বইয়ের কথা ভুলে যাননি।বরং বই খোঁজার কাজ আগের চেয়ে সহজ হয়ে উঠল, কারণ বই ব্যাবসায়ীর সঙ্গে ছাপা শালার ওতপ্রোত সম্পর্ক। ছাপাশালার কাজের মধ্য দিয়েই বইয়ের দোকানে কাজ করা একজন কর্মচারীর সঙ্গে বেঞ্জমিনের পরিচয় হল। কিন্তু যেহেতু দোকানে বিক্রির জন্য রাখা বই দিনের বেলা বের করে দেওয়া যায় না, সেই জন্য বেঞ্জামিন সন্ধ্যাবেলা বই দোকান থেকে ধার করে আনে এবং রাতে ঘুমের ক্ষতি করে হলেও বইটি পড়ে শেষ করে। সকালবেলা সে বইটি ফিরিয়ে দেয়। বইটি যাতে কোনো ভাবে নষ্ট না হয় বা ধুলোবালি লেগে নোংরা না হয় সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি থাকে।

 যে মানুষ নিজেকে সাহায্য করে তাকে ভাগ্যও সাহায্য করে। ম্যাথিউ আদমস নামের একজন স্থানীয় ব্যাবসায়ী প্রায়ই বেঞ্জামিনের ছাপাখানায় আসতেন। তাঁর নিজস্ব একটি গ্রন্থাগার ছিল। বইয়ের প্রতি বেঞ্জামিনের গভীর অনুরাগ দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন এবং নিজের গ্রন্থাগারের দরজা তিনি বেঞ্জামিনের জন্য মুক্ত করে দিলেন। ম্যাথিউ আদমসের গ্রন্থাগারটা ছিল যথেষ্ট বড়ো। বেঞ্জামিন এবার মনের আশ মিটিয়ে বই পড়তে লাগলেন।

 কিন্তু কেবল বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেই বেঞ্জামিন সন্তুষ্ট ছিলেন না । উৎকৃষ্ট গদ্য রচনা করার ক্ষমতা অর্জন করাটা ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই কঠোর সাধনায় ব্ৰতী হয়েছিলেন। 

 বেঞ্জামিন গদ্যের সাধনায় ব্রতী হওয়ার পেছনে তাঁর জীবনের একটি ছোটো কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল।

 বেঞ্জামিনের জন কলিন্স নামের একজন বন্ধু ছিল। বেঞ্জামিনের মতো তিনিও বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। দুই বন্ধুর মধ্যে প্রায়ই নানা বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হত। একদিন তর্কের বিষয় হল নারী শিক্ষা।কলিন্সের মতে নারী শিক্ষা লাভের উপযুক্ত নয়, কারণ শিক্ষা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিভা প্রকৃতি তাদের দেয়নি। বেঞ্জামিনের মত হল ঠিক তার উল্টো। বেঞ্জামিনের যুক্তি বেশি সবল ছিল যদিও তর্কে তিনি হেরে গেলেন, কারণ ভাষার ওপরে কলিন্সের দখল ছিল অনেক শক্তিশালী। কেবল বাক নৈপুণ্যের জোরে তিনি বেঞ্জামিনকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে দিলেন।

 কিন্তু বেঞ্জামিন এই পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারলেন না কারণ তার যুক্তি যে বেশি সবল ছিল সে কথা তিনি নিজেও ভালো করে জানতেন। তর্কযুদ্ধের পরে অনেকদিন তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। সেই সময় বেঞ্জামিন একদিন তাঁর যুক্তিগুলি পরিষ্কার করে লিখে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিলেন। বন্ধুটিও তার উত্তর লিখিতভাবে দিলেন। এভাবে বেশ কয়েকটি চিঠির আদান-প্রদান হল, অর্থাৎ তর্কযুদ্ধটা এবার মৌখিকভাবে না হয়ে চিঠির মাধ্যমে হল। এই সময় বেঞ্জামিন কলিন্সকে লেখা একটি চিঠি বেঞ্জামিনের পিতার হাতে পড়ল। তিনি চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে সেই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য বেঞ্জামিনকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ছেলেকে বললেন–’ তোমার বানান শুদ্ধ। যতি চিহ্নও ঠিক জায়গায় দিতে শিখেছ। এই বিষয়ে তুমি তোমার বন্ধুর চেয়ে এগিয়ে রয়েছ। কিন্তু তোমার ভাষা সরল নয়। কথাগুলি পাঠকের সহজ বুদ্ধিতে বুঝতে পারার মতো তাকে রসালো করে তুলতে তুমি পারনি। এই বিষয়ে উন্নতি করার জন্য তোমাকে আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে।’

 পিতার কথায় বেঞ্জামিন সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলেন, কারণ পিতা তার কথার সমর্থনে বেঞ্জামিনের লেখা থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরলেন। বেঞ্জামিন তখনই সংকল্প করলেন যে ভাষার ওপরে দখল বাড়ানোর জন্য আরও ভালো গদ্য লেখার কায়দাটা আয়ত্ত করার জন্য সে চেষ্টার কোনো রকম ত্রুটি করবে না।

 সেই সময়ে তিনি একটি বইয়ের দোকানে’ স্পেকটেটর’(Spectator) নামের একটি ইংরেজি পত্রিকার একটি বাঁধানো খন্ড দেখতে পেলেন। তিনি এর আগে পত্রিকাটি কখন ও দেখেননি বা তার নামও শোনেন নি। পত্রিকাটি কিনে এনে তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়তে লাগলেন। পত্রিকাটির গদ্যরীতি তাকে এতটাই মুগ্ধ করল যে সম্ভব হলে তিনি নিজেও সেই গদ্যরীতির অনুকরণ করতে এবং সেই রীতিতে গদ্য লিখতে মনস্থ করলেন।

 পত্রিকাটি পড়ার সময় বেঞ্জামিন একটি কথা জানতেন না তিনি পড়ে মুগ্ধ হওয়া পত্রিকাটি আসলে ছিল ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ পত্রিকার একটি। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন জোসেফ এডিসন (১৬৭২-১৭১৯)একজন বিরাট প্রতিভাশালী গদ্য-লেখক এবং প্রবন্ধকার হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অন্য একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি ডঃসেমুয়েল জনসন বলেছিলেন—‘ইংরেজি ভাষায় উৎকৃ্ষ্ট গদ্য রচনার কৌশল যারা আয়ত্ত করতে চায় তাঁরা দিন রাত জোসেফ এডিসনের রচনাবলী অধ্যয়ন করায় মনোনিবেশ করতে হবে।’স্পেকটেটরের বেশিরভাগ লেখক ছিলেন জোসেফ এডিসন।এডিসনের গদ্য বিষয়ে ডঃজনসন কী বলেছিলেন সেকথা না জেনে বেঞ্জামিন তাঁর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করেছিলেন।

 বেঞ্জামিন নিজে লিখে রেখে গেছেন—‘স্পেকটেটরের গদ্য রচনার কৌশল আয়ত্ত করার জন্য আমি পত্রিকাটার প্রবন্ধগুলি পড়ে প্রত্যেকটি বাক্যের ভাবার্থ গুলি লিখে রাখলাম।কয়েকদিন পার হয়ে যাবার পরে আমি বইটা না দেখে সেই স্পেকটেটরের মূল প্রবন্ধটির সঙ্গে আমার নিজের লেখাটা মিলিয়ে দেখলাম। যে সমস্ত ভুল ভ্রান্তি আমার চোখে পড়ল সেগুলি পুনরায় শুদ্ধ করলাম। কখনও আমি ইতিমধ্যে লিখে রাখা ভাবার্থ গুলি মিশ্রিত করে ফেলে কয়েক সপ্তাহ পড়ে পুনরায় সেগুলি পরিপাটি করে সাজিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম। এরকম করার উদ্দেশ্য ছিল ভাব গুলি পরিচ্ছন্নভাবে সাজানোর জন্য নিজেকে শেখানো। মূল প্রবন্ধের সঙ্গে আমি নিজের লেখা গুলি মিলিয়ে দেখে দ্বিতীয়বার চোখে পড়া ভুল ভ্রান্তি গুলি শুদ্ধ করলাম। এভাবে অভ্যাস করার সময় আমার মনে হল যে কিছু কথা মূল প্রবন্ধের চেয়ে আমি বেশি ভালো করে লিখতে পারব। একজন ভালো গদ্য লেখক হওয়াটা ছিল আমার জীবনের একটি প্রধান আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারব বলে এখন আমার মনে আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। এভাবে গদ্যরচনার অনুশীলন করার জন্য এবং পড়ার জন্য আমি কেবল রাতের বেলায় সময় পেতাম। কাজ থেকে ফিরে এসে বা সকালে কাজ আরম্ভ করার আগেই আমি রাতের মধ্যে লেখা এবং পড়া দুটো কাজই করতাম। আমার পিতার আকাঙ্ক্ষা অনুসারে আমি রবিবার গির্জায় না গিয়ে তার পরিবর্তে ছাপা শালায় যেতাম —যাতে ছাপাশলায় কোনো মানুষ না থাকা অবস্থায় আমি সেখানে শান্তিতে লেখাপড়া করতে পারি।’( বেঞ্জামিন লেখা মূল কথাটা এখানে সরল এবং সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে)।

 অতি সাধারণ অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় উন্নতি করে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তার সমসাময়িক পৃথিবীর একজন অতি মহৎ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে পরিগণিত হয়েছিলেন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজে স্বীকার করে গিয়েছেন তার এই উন্নতির মূলে ছিল ভালো গদ্য লেখার দক্ষতা— যা তিনি অত্যন্ত কষ্ট করে আয়ত্ত করেছিলেন। মনের ভাব সরল এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করার ওপরে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি লিখে রেখে গেছেন—’ গদ্য রচনা আমার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে এবং এটা আমার উন্নতির একটি প্রধান কৌশলে পরিণত হয়েছিল।’

 





 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...