পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৮
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi
তৃতীয় অধ্যায়, অষ্টম অংশ
(৮)
সুনন্দ পাঁচ দিন গুয়াহাটি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে থেকে ফিরে এল।ডান হাত নড়াচড়া করায় কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। কেউ ভাত খাইয়ে দিলে তবে খেতে পারে। বাঁ হাতে খাওয়া-দাওয়া এবং অন্যান্য কাজগুলি করায় সে অসুবিধা অনুভব করে, পারে না। বাড়িতে ফিরে আসার পরে জ্যোৎস্না জ্যোতি মালা তার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখছে। সময়ে ঔষধ খাইয়ে দেওয়া ভাত বেড়ে যাওয়া কাপড় বদলে দেবার দায়িত্ব আলাদা আলাদা ভাবে জ্যোৎস্না জ্যোতি মালার ওপরে পড়েছে। আমি ভেবেছিলাম ঘটনাটার পরে সুনন্দ ভেঙ্গে পড়বে।কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করার পরে বুঝতে পেরেছি যে সে যথেষ্ট দৃঢ় রয়েছে।আমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় সে আমাকে একনাগাড়ে ঘটনাগুলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে গেল।
আমি বললাম— একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। আমরা এখন নতুন অধ্যায় একটা আরম্ভ করার জন্য এগোতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠ।
আগামীকাল সুনন্দের সেলাই কাটার জন্য নলবাড়ির অসামরিক হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তারপরে তাকে আরও দুই তিন দিন বিশ্রাম নিতে হবে। সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে কিছুদিন সময় লাগবে।তাই কাজের দায়িত্ব নবজিৎ বৈশ্য এবং কীচকের ওপরে পড়েছে।গরমের বন্ধ খুলতে আরও কয়েকদিন মাত্র বাকি আছে। এই সময়টুকুর মধ্যে কাজ আরম্ভ না করলে কাজে গতি আনতে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক সময় লাগবে। নবজিৎ মইরাদাঙ্গা গিয়ে গাছের চারার ব্যবস্থা করে রেখে এসেছে। তারা প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজন অনুসারে পাঁচশো চারা দিতে পারবে বলে সম্মতি জানিয়েছে এবং চারা কয়টি নিয়ে আসবে বলেছে। পরে আরও পাঁচশো চারা লাগবে। নবজিৎকে বলেছি দ্রুত চারাগুলি এনে থানে জমা করতে হবে। বিপিন ডেকা পাঁচশো সিমেন্টের বস্তার পরিবর্তে বস্তা তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা কয়েকটি নাইলনের থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে। বলেছে সিমেন্টের বস্তার চেয়ে সেগুলি বেশি ভালো। প্রয়োজন অনুসারে ছোটো বড়ো করে কেটে নেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে সিমেন্টের বস্তার চেয়ে উঁচু। গরু ছাগল ঢুকতে ঢুকতে গাছের চারা বড়ো হয়ে যাবে। সেগুলিও সংগ্রহ করতে হবে।
নবজিৎ এবং কীচককে বলেছিলাম— সবকিছু করার আগে বাঁশগুলি এনে মাপ জোক করে কেটে রাখা ভালো।
একটা ঠেলায় করে দুটি ছেলে আজ সকালবেলা দশটা বাঁশ রেখে গেছে। বাঁশগুলি সোজা,দেখতে পুরুষ্ঠ ।আটটার সময় দুজন কাজ করা মানুষ এল। তারা আমার কাছে এসে বাঁশগুলি কী মাপে কাটতে হবে জিজ্ঞেস করল।
সাড়ে তিন ফুট মাপে। আধা ফুট মাটির নিচে এবং বাকি তিন ফুট মাটির উপরে।
আমার কথা বলার ধরণ দেখে মজা পেল বোধ হয়, দুজনেই হাসতে লাগল।
আমি লক্ষ্য করলাম তারা দুজন একটা করাত দিয়ে সাড়ে তিন ফুট করে বাঁশগুলি কাটতে শুরু করেছে। আমি তাদের এক টুকরো বাঁশ দুইফালা করে প্রতিফালা থেকে চারটি করে মোট আটটি বের করতে দেখিয়ে দিলাম। আমি দেখানো অনুসারে তারা দুজন সন্তুষ্ট হল এবং সেই অনুসারে তারা বাঁশ কাটা এবং ফালা শুরু করল। সঙ্গে আমি তাদেরকে জানালাম যে বাঁশের ডালগুলি চেঁছে মিহি করতে হবে না,কেবল সূঁচলো করে রাখলেই হবে। কাজ করতে থাকা মানুষ দুজনকে দুই কাপ চা এবং বিস্কুট দেওয়ায় মানুষ দুটি আমাদের প্রতি বড়ো সন্তুষ্ট হওয়া বলে মনে হল। নবজিৎ ঘরের কাজ সামলে আসতে আসতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল।
— আজ মরোয়ার বাজার ছিল। বাড়ির বাজার করে এসেছি।
চা খাবার জন্য ব্যবহার করা কাগজের গ্লাস দুটো দেখে নবজিৎ দুজনকে চা দিয়েছি কিনা আমাকে জিজ্ঞেস করল ।আমি বললাম দিয়েছি। তারপর নবজিৎ কাজ করার মানুষ দুটিকে হরেনের চা দোকানে দুজনের চা এবং ভাতের বন্দোবস্ত করেছে বলে জানাল। দুজনেই সময়মতো গিয়ে খেয়ে আসলেই হল।
—পাঁচশো গাছের চারার জন্য চারটি করে মোট দুই হাজার বাঁশের চাঙ লাগবে। তুমি তাদের হিসেব করে রাখতে বলবে। সমস্ত কাজ আগে থেকেই করে রাখলে, পরে কোনো অসুবিধা হয় না।
নবজিৎ আমার কথায় সায় দিল।
গত দুই দিনে কাজ করা মানুষ দুটি দুই হাজার বাঁশের ফলা কেটে সূঁচলো করে রাখল। রাতুলের সহযোগে একটা টেম্পো ভ্যানে পাঁচশো গাছের চারাও মইরাদাঙা থেকে এসে পৌঁছাল। সেই চারাগুলি আমি থানের ভাঁড়ার ঘটিতে জল ছিটিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দিলাম। বিপিন ডেকাও নিজের দায়িত্ব সুচারু রূপে পালন করল। সমস্ত কিছু জোগাড় হয়ে যাওয়ার পরে আমরা একত্রিশ তারিখ দিন ঠিক করলাম। গাছের চারা রোপণ করার জায়গা নির্বাচিত হল থানে। থান পরিচালনা সমিতির সভাপতি সম্পাদক এবং পুরোহিত শর্মার উপস্থিতিতে কীভাবে গাছের চারা রোপণ করলে ভবিষ্যতে অসুবিধা হবে না তা আলোচনা করা হল। কাকাবাবু এবং কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্ব নবজিৎ এবং কীচকের ওপরে দেওয়া হল। জেপি পঞ্চাশটি ছেলেমেয়েকে নিমন্ত্রণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করল। মাটি খোঁড়ার জন্য আজকাল এক ধরনের বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যন্ত্রটা দেখতে অর্ধ চুঙ্গা আকৃতির। সেই যন্ত্র ব্যবহার করলে গর্ত খোঁড়ার সময় হাত দিয়ে মাটি স্পর্শ না করলেও হয় এবং কম সময়ে অধিক গর্ত খনন করা যায়। পুলক নিজের বাড়ি থেকে সেই যন্ত্র আনবে বলে কথা দিল। গিঁট দেবার জন্য তাঁর এবং তাঁর কাটার জন্য একটা প্লাস আনার কথা আমি নবজিতকে মনে করিয়ে দিলাম। সঙ্গে একটা কাঁচি।
৩১ তারিখে সকালবেলা নটার সময় প্রথম চারাটা রোপণ করবে শহীদ পত্নী অনামিকা। সেই সম্মানটুকু অনামিকার প্রাপ্য। দ্বিতীয় চারাটা রোপণ করবে সুনন্দ এবং জ্যোৎস্না। প্রকৃতি রক্ষার জন্য সুনন্দকে শারীরিক নির্যাতন স্বীকার করে নিতে হয়েছে। তথাপি সে পিছু হটেনি। সুনন্দকে আমাদের তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা এবং স্বীকৃতির চিহ্ন স্বরূপ প্রদান করা এটা সাধারণ সম্মান। তারপরে সামগ্রিকভাবে চারা রোপণ করার কার্য আরম্ভ করা হবে। চারা সমূহ রোপন করার পরে আরম্ভ হবে ঘিরে দেওয়া পর্ব। নিজের নিজের চারাটা ভবিষ্যতে দেখা শোনার দায়িত্ব যে রোপণ করবে তাকেই নিতে হবে। প্রয়োজনে চারাটা বড়ো হলে সেই চারাটা সে রোপণ করার চিহ্ন হিসেবে নিজের খরচে ফলক লাগাতে পারবে। নিজের নামটা ক্ষোদিত করার ইচ্ছায় ছাত্রছাত্রীরাই শুধু নয় জ্যেষ্ঠরা বৃক্ষরোপণ কার্যে উৎসাহ বোধ করছে নাকি। জেপি সহৃদয়তার সঙ্গে আমাকে জানাল।
সকালবেলা সময়ের চেয়ে আগে এসে প্রকৃতি কর্মীরা হাজির হল। সুনন্দ অতি ধীরে সুস্থে পায়ে হেঁটে এসেছে। পাশে রয়েছে জ্যোৎস্না। অনামিকা কাকাবাবু এবং কাকিমাকে আমি আসতে দেখেছি। ছেলেমেয়েদের দেখেছি ওরা সেলফি উঠায় ব্যস্ত। থানটার পরিবেশ উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। বাপুটির সহযোগে গতকাল নবজিৎ এবং পুরোহিত শর্মা সুতো ট্রেনে নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের টুকরো দিয়ে একটা করে খুঁটি পুঁতে রেখেছিল। পুলক গর্ত খোঁড়ার বিশেষ যন্ত্র নিয়ে ইতিমধ্যে খুঁটি পুঁতে রাখা স্থান সমূহে গর্ত খুঁড়তে শুরু করেছে। বিশেষ যন্ত্রটি তিনবার মাটিতে চালিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক একটি চারা রোপণ করার জন্য গর্ত তৈরি হয়ে যায়। পুলক খুব কম সময়ের মধ্যে গর্তগুলি একনাগাড়ে করে চলেছে। পুলকের সাহায্য করছে তার মাছ ধরার সঙ্গী রাতুল।
এখন সকাল ন'টা বেজেছে। আমি সৌম্যদাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে আজকের অনুষ্ঠান বিষয়ে সকলকে অবগত করার জন্য অনুরোধ জানালাম। সৌম্যদা প্রথমে গ্রামের যে সমস্ত ব্যক্তি সামাজিক কর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে মরনোত্তর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন।শহীদ জ্যোতিষ ডেকার উদ্দেশ্যে স্যালুট জানালেন। সুনন্দের মতো প্রকৃতি কর্মীর সাহস এবং নিষ্ঠা আমাদের প্রত্যেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে সুনন্দকে স্বীকৃতি জানালেন। সৌম্যদা কাঠ খড়ির দোকান পরিত্যাগ করা অচ্যৃতকে একজন নিষ্ঠাবান প্রকৃতি কর্মী হিসেবে অভিহিত করে বললেন তোমাদের কর্মস্পৃহাকে স্বাগত জানিয়ে আমরা প্রত্যেকেই প্রকৃতির রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর হলাম। অসমের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অরুণ্য গ্রাম হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য আমরা যত্নের কোনোরকম ত্রুটি করব না । আসুন বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পালন করি । প্রথম ক্ষেত্রে কাজ গুলি রোপণ করার জন্য শহীদ জ্যোতিষের পত্নী অনামিকাকে আমরা গ্রামবাসীর তরফ থেকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি । তাকে সহযোগিতা করবে জ্যোতিষের পিতা-মাতা। দ্বিতীয় চারটি লাগানোর ক্ষেত্রে আহ্বান জানাচ্ছি সুনন্দ এবং জ্যোৎস্নাকে। তৃতীয় চারাটির জন্য একাধিক্রমে বর কুরিহা গ্রামের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের তারপরে আমার প্রিয় বন্ধু যুবক যুবতীদের, সুহৃদ ছাত্র-ছাত্রীদের এবং একেবারে শেষ চারাটা এইথানের মাননীয় পুরোহিত কৈলাস শর্মাকে রোপণ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনাদের মধ্যে একজন ব্যক্তি একটি বা ততোধিক চারা রোপণ করতে পারবেন। যুবতি এবং মহিলাদের উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে এক সময় পাঁচশো চারা রোপণের কার্যসূচি আরম্ভ হয়ে গেল । নবজিৎ, কীচক, জেপি, টিংকু ,পুলক, রাতুল উপস্থিত সবার সামনে রোপণের জন্য একটা একটা করে চারা রেখে যেতে লাগল।
ঘিরে দেবার আগে রোপণ করা চারা গুলির গোড়ায় জল দিতে হবে,এ কথাটা যেন কেউ ভুলে না যায়, আমি প্রত্যেককে অনুরোধ জানালাম। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী ঘের দেওয়ার কাজটা চেষ্টা করেও পারছেনা। পুলক কীচকরা দেখিয়ে দিচ্ছে যদিও অনভ্যাসের জন্য ওদের বারবার ভুল হচ্ছে। বাঁশ কাটার জন্য আগত কাজের মানুষ দুটিকে নবজিৎ আজও কাজে লাগিয়েছে।এটা সে ভালো কাজ করেছে।, তারা দুজন না থাকলে ঘের দেওয়ার কাজটা এগোত না। আজকের চারা রোপণ কার্য থেকে আমার একটি অভিজ্ঞতা হল। এরপরে এভাবে চারা রোপণ করতে হলে আগে থেকে গর্ত খুঁড়ে বাঁশের কঞ্চি গুলো পুঁতে রাখতে হবে।প্রকৃতি কর্মীরা চারাটা রোপণ করবে, জল দেবে এবং অভিজ্ঞ কাজের লোক দুটি ঘেরগুলি দিয়ে যাবে।
শিক্ষক সাংবাদিক প্রদীপ ডেকা বৃক্ষরোপণের আলোকচিত্র সংগ্রহ করছে। চারা রোপণ করার পরে বিভিন্নজন চারার সঙ্গে সেলফি তুলছে। জ্যোৎস্না সুনন্দকে ধরে এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে।সে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আমি দেখতে পেয়েছি কাকাবাবু আমার দিকে আসছে।
— তাহলে তোমার প্রথম অভিযান সফলভাবে শেষ হল। এখন তুমি হয়তো আমাদের,বাড়িতে যেতে পারবে।
আমি ঈষৎ হেসে কাকাবাবুকে বললাম—কাকাবাবু আমার অভিযান আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু তা বলে আপনাদের বাড়িতে যাব না, সেরকম কোনো কথা নেই। যাব যাবই। কথা দিলাম। কাকাবাবুরা আমি বা সুনন্দ কেউ তাদের বাড়িতে একদিনের জন্য না গেলেও এক মাসের জন্য না যাওয়ার মতো আক্ষেপ করে। কখনও কাকাবাবুর জন্য দুঃখ হয় আর কখনও রাগ।তবে আমরা কাকাবাবুকে আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাই না।
প্রদীপ ডেকা এগিয়ে এসে আমার করমর্দন করল।
—আপনার প্রোগ্রাম সাকসেস। আমি ভালোভাবে একটা খবর করব। প্রত্যেকের জানা উচিত এরকম একটি ভালো খবর।
— তার জন্য আপনারা ধন্যবাদের পাত্র। খবরটা প্রকাশিত হলে প্রকৃতি কর্মীরা উৎসাহিত হবে। আগামী রবিবার আমরা পুনরায় কার্যসূচি নিয়েছি।সেখানে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকবে না। আমাদের প্রকৃতি কর্মীরা নদীর পরিত্যক্ত জমিতে গাছের চারা রোপণ করবে। আশা করি আপনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও দেখা দেবেন।
— নিশ্চয় আসব এই গাছ চারাগুলি শুধু কাঠের জন্য?
সাংবাদিক হিসেবে প্রদীপ দেখা কিছু প্রশ্নের অবতারণা করলেন। আমি উত্তর দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম।
— না না। বিভিন্ন ফলের গাছও আছে। আম, জাম, কাঁঠাল, লটকা, পেয়ারা ইত্যাদি।
বিভিন্নজন এসে আমার এবং সৌম্যদার সঙ্গে কথা বলে গেল। তার মধ্যে কাকাবাবুর পরিবারের মুখে দেখতে পেলাম অপ্রাপ্তির ছায়া।অবশ্য কিছুদিন আমি কাকাবাবুর বাড়িতে না যাওয়াটা সত্য। সুনন্দদের বাড়িতে গিয়েছি।আমার সাজ সরঞ্জামে চার্জ দেওয়া কাজটা ওদের বাড়িতেই করেছি।আমি অনুমান করছি সেসবের কোনো একটি জায়গায় কাকাবাবুর মনে বিষন্নতা লুকিয়ে রয়েছে। কাকাবাবুর পরিবার সে কথা প্রকাশ্যে জানিয়ে গেল। বৃদ্ধ মানুষ ছোটো ছেলে মেয়েদের মতো।অকারণে অভিমান করে। কাকাবাবুর অভিমান ভাঙ্গার জন্য আজ সন্ধেবেলা সৌম্যদাকে নিয়ে একবার তাদের বাড়িতে যেতে হবে।
অনুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত প্রত্যেককে নিয়ে আমরা পুনরায় একবার বসার কথা ভাবলাম। আজকেই পরবর্তী বৈঠকের দিন ঠিকঠাক করে নেওয়া ভালো। আমরা ভাবছি প্রতিটি কার্যসূচি শেষ হওয়ার দিনেই আমরা পরবর্তী কার্য সুচির ক্রমনিকা স্থির করব। এটি একটা পরম্পরা হিসেবে গড়ে নেওয়া উচিত। নাহলে আজ কাল করে পিছিয়ে যাবার অবকাশ থাকে।
পুকুরে হাত পা ধুয়ে এসে নবজিতরা থানের ত্রিপল এনে মাটিতে পেতে বসে পড়ল।। আবহাওয়া ধীরে ধীরে মেঘলা হয়ে উঠছে।পূব থেকে পশ্চিমে ফুরফুরে এক ঝাঁক বাতাস বইছে। গরমের প্রকোপ কমেছে যদিও এক ঝাঁক বৃষ্টি হলে ভালো হত। চারা গুলি উজ্জীবিত হয়ে ওঠার সুযোগ পেতো।। নবজিতরা পরবর্তী কর্মসূচি স্থির করবে বলে জানতে পেরে জ্যোৎস্না জ্যোতিমালার সঙ্গে অনামিকা থেকে গেল। সুনন্দ চেয়ারটিতে বসে রয়েছে।জ্যোৎস্না সঙ্গে আনা জলের বোতল থেকে জল এবং ঔষধ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে।
—নবজিৎ আগামী রোববার আমরা পুনরায় বৃক্ষরোপণ করতে চাইছি। চারা জোগাড় হয়ে যাবে কি?
আমি আরম্ভ করলাম। না হলে দেরি করে থাকলে দেরি হতেই থাকবে। সুনন্দদের বেশি সময় আটকে রাখতে চাইছি না।
— হবে। তারা আমাকে আরও পাঁচশো চারা দিতে পারব বলে বলে রেখেছে।
—তাহলে আমরা এবার নদীর তীরে চারা রোপণ করার ব্যবস্থা করব। তুমি আমাদের প্রকৃতি কর্মীদের উপস্থিত থাকতে বলে দিও। তুমি আজ মনের মতো একটা কাজ করেছ। ভালো লাগল।
— কী উদয়দা, নবজিৎ বৈশ্য জিজ্ঞেস করল।
—তুমি যে উপস্থিত পরিবেশ কর্মীদের স্বাক্ষর এবং ফোন নাম্বার সমূহ সংগ্রহ করে রেখেছ সেইসব আমাদের কয়েকটি দিকে সাহায্য করবে। আর মনে রাখবে একটা সময় হয়তো এই খাতাটাই ইতিহাস হবে।যাইহোক কাজ করা মানুষ দুজনকে তুমি বাঁশের কাজটুকু করে রাখতে বল। বস্তা তৈরি করা নাইলনের থান আমাদের আর ও লাগবে।।প্রত্যেকবারই বিপিন ডেকাকে বলা উচিত হবে না।সেই সামগ্রীগুলি কোথায় কত দামে পাওয়া যায় তাকে জিজ্ঞেস করে কিছু বেশি করে কিনে এনে রাখবে।। বেশি করে কিনে এনে না রাখলে হঠাৎ প্রয়োজন হলে পাবে না।তখন খারাপ লাগবে।
—আমরা এইবার নদীর তীরে চারা রোপণ করার চেয়ে মানুষের বাড়িতে রোপণ আরম্ভ করব নাকি?
নবজিৎ বৈশ্য নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করল।
—আমি ভাবছি নদীর তীরে চারা রোপণ করলে প্রত্যেকের চোখ পড়বে এবং আমাদের কার্যসূচি আরম্ভ করছি বলে গ্রামবাসীরা জানতে পারবে। সম্ভবত তখন প্রতিটি ঘরের মানুষের বাগানে বস্তিতে চারা রোপন করতে আমাদের সুবিধা হবে।
নবজিৎ আমার মতামতকে সমর্থন জানাল।তাই আগামী রবিবার আমরা নদীর তীরে চারা রোপণ করার কার্যসূচি গ্রহণ করব। আমি ভাবছি সেদিনই আমরা একটা সংগঠনের জন্ম দেব এবং সংগঠনটি করার জন্য বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দ আমাকে সমর্থন জানাল।
—আমিও কথাটা ভাবছিলাম।।কোনো সংগঠনের পতাকার নিচে হলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারব। আমাদের কাজগুলি সুচারু রূপে এগিয়ে যাবে।। আমরা আমাদের পরিচয়ও লাভ করব সংগঠনের মাধ্যমে। প্রকৃতি কর্মীরা নিজেদের পরিচিত করে তোলার সুযোগ পাবে।
— তাহলে আমাদের শিবির গুলিতে উপস্থিত থাকা প্রতিটি প্রকৃতি কর্মীকে সেদিন উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান জানাবে। বয়োজ্যেষ্ঠদেরও জানিয়ে দেবে ।সঙ্গে তোমরা ভেবে আসবে সংগঠনের নাম কী রাখা যেতে পারে।
— অর্থযুক্ত হতে হবে কিন্তু আমাদের সংগঠনের নাম।
— আপনি ঠিকই বলেছেন। সংগঠনের নাম অর্থ ভাবাপন্ন হতে হবে। সেই জন্য তোমরা যে কোনো নাম চট করে না দেওয়াই ভালো।
আমি অনামিকাকে সমর্থন করলে অনামিকার মুখ হাস্যমুখর হয়ে পড়ল।
ধীরে ধীরে আমাদের কাজগুলি এগিয়ে চলেছে।
—নবজিৎ তুমি যে কংক্রিটের খুঁটি, রিং আদি তৈরি করা মানুষটির কথা বলেছিলে, জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেয়েছ কি—চাঙের নিচের সেই খুঁটির খরচ কত পড়বে।
—না উদয়দা। আমি আজকে যাব তার কাছে।
—যাবে। কারণ সেগুলি ঢালাই করার পরে প্রায় এক মাস সময় রাখতে হবে। কংক্রিটের খুঁটিগুলি আসার পরে আমরা উপরের বীমগুলি ঢালাই করতে পারব। সেগুলি তৈরি হতে প্রায় আরও একমাস। তারপর আমাদের বাড়ি তৈরি করার কাজ শুরু হবে। তাই আমাদের ঝুপড়ি গুলি তৈরি হতে প্রায় তিন মাস সময় লাগবে। সময়ের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে, কাজগুলি পিছিয়ে যেতে থাকবে।
—খারাপ সময়ে আমার অঘটনটা ঘটল। নবজিৎদার ওপর বেশি চাপ পড়ে গেছে।
সুনন্দ আক্ষেপ করে বলল।
—উদয়দা আমার ওপরে তো কিছু কাজের দায়িত্ব দিতে পারেন।
পুলক সুনন্দকে সমর্থন জানাল।
নবজিতকে সবকিছু করতে হবে সেরকম কিছু নেই। তোমরা দায়িত্ব নিতে চাইলেই হল। তখন নবকে আরও অন্য অনেক দায়িত্ব দিতে পারা যাবে। মনে কর, আগামী তিন মাস আমাদের জন্য যুদ্ধের সময়। সামনে যা কাজ হবে, ভাগাভাগি না করে আমরা সবাই করে যাব।
—উদয়দা আমার ভাগে কী দায়িত্ব পড়েছে?
অনামিকা জিজ্ঞেস করল।
—আপনি আগামী রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। মাঝখানে মাত্র কয়েকটা দিন।
নিজের কৌতূহল চেপে রেখে অনামিকাকে ইতস্তত করতে দেখে আমি পুনরায় বললাম—আপনি কোনো গভীর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
—উদয়দা আপনি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলে খুব খারাপ লাগে। কথাটা বলব বলব বলেও অনেকদিন বলতে পারিনি। আপনি কি আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করতে পারেন না? অনামিকা বলে ডাকতে পারেন না?
সবার সামনে অনামিকার এই ধরনের অনুরোধ শুনে আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম ।
—সম্ভবত পারব না। তবুও ভেবে দেখি।
সাধারণভাবে উপেক্ষা করার মতো আমি একটু কায়দা করে বললাম যাতে সে মনে আঘাত না পায়।
—আপনারা প্রত্যেকে রবিবারের জন্য প্রস্তুত হন।
রবিবারের নির্দিষ্ট দিনটিতে বিভিন্ন বয়সের একশোরও অধিক প্রকৃতি কর্মী জমায়েত হল। আমাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে গাছের চারা রোপণ করার পরে আমরা সংগঠনের নাম এবং সংগঠনের একটি তদর্থ কমিটি গঠন করার জন্য আলোচনায় বসব। সেই অনুসারে আমরা গাছের চারা রোপণ করতে শুরু করলাম। পুলক এবং রাতুলের তত্ত্বাবধানে গতকাল এই কাজ করা চারটি করে বাশের কঞ্চি গর্ত গুলির চারপাশে পুঁতে রেখেছে। একশোর মতো চারা রোপণ করার পরে একজন মানুষকে নদীর তীর ধরে দৌড়াদৌড়ি করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখতে পেলাম। লোকটা আমাদের দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমি পুনরায় কোনো অঘটনের গন্ধ পেলাম।
আমাদের কাছে পৌঁছে লোকটি গর্জন করে উঠল।
—আমার মাটিতে আপনারা একটিও চারা লাগাবেন না। আমি বুঝতে পারছি আপনারা বুদ্ধি করে মাটি দখল করতে চাইছেন।
আমি মানুষটাকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি দ্বিগুণ ক্রোধে জ্বলে উঠলেন।
—কিসের জন্য ক্ষান্ত হব? কেন শান্ত হব? আমার মাটি তোমরা দখল করবে আর আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকব। আমাকে কি শাড়ি পরা ভেবেছ নাকি?
—দাদা, একটু মুখ সামলে কথা বলবেন। সমস্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েরা আছে। আপনি বয়স্ক হয়ে কেন এই ধরনের ব্যবহার করছেন।
আমাদের মধ্যে থাকা জ্যেষ্ঠ প্রকৃতি কর্মী মানিক কলিতা লোকটিকে প্রতি আক্রমণ করল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মানুষটা একটু শান্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে হল।
—আমি সেসব জানিনা। আমার কথা হল আমার জমিতে গাছ রোপণ করা চলবে না।
—ঠিক আছে। আপনার জমি কোনটা দেখিয়ে দিন।
এখন মানুষটা ঠিক বেকায়দায় পড়ল। নদীর মাঝখানের জমি। কোথাও একটা সীমার খুঁটি নেই।
—আমি জানিনা। আপনারা মন্ডল ডেকে আনুন এবং আমার জমিট বের করে দিন।
—শর্মা বাবু।আপনার এখানে জমি নেই। যদি থেকে থাকে মন্ডল এনে আপনিই বের করে নিন।
বিপিন ডেকা এভাবে বলার সঙ্গে সঙ্গে মানুষটা আহত জন্তুর মতো ছটফট করতে লাগলেন। তিনি পুনরায় চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলেন।
—ডেকা। মুখ সামলে কথা বলবেন। পূর্বপুরুষের আমল থেকে এখানে আমাদের জমি থাকার কথা আপনি জানেন। এখন নাই বলে উড়িয়ে দিলেই হবে।
–শর্মা বাবু ।আপনার ব্যবহার আপনার পরিচয়। ভদ্রলোকের মতো কথাবার্তা বললে সমাধান সূত্র বের করা যায়। আপনি যে এত চিৎকার চেঁচামেচি করছেন, মনে হচ্ছে আপনি যেন মারপিট করার জন্য এসেছেন।
—প্রয়োজন হলে মারপিট করতে হবে।
মানুষটার কথায় কেউ কোনো গুরুত্ব না দিয়ে চারা রোপণ করার কাজ শুরু করল। মানুষটা বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। আমি ভাবলাম মানুষটা যে মুড নিয়ে চলে গেল তিনি হয়তো এবার সঙ্গে বেশি লোকজন নিয়ে পুনরায় ফিরে আসবেন। বিপিন ডেকা মানুষটাকে ভালোভাবেই জানে।
— তিনি আগে ধুবরির মহামায়া থানের পূজারী ছিলেন। এখন ছেলেটি থাকে বলে তিনি গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। ছেলেটির সঙ্গে আলোচনা করা ভালো হবে। অত্যন্ত শান্ত অমায়িক ছেলে। সামাজিক কাজের সঙ্গেও জড়িত।
আমি যেরকম ভেবেছিলাম তাই হল। তবে একদল নয়, সঙ্গে একটি ছেলেকে নিয়ে শর্মা পুনরায় ফিরে এসেছে। বিপিন ডেকা দূর থেকেই ছেলেটিকে চিনতে পারল।
— ওই যে ছেলেটি। ওকে এনে লোকটি নিজের হাতের কুঠার পায়ে মেরেছে। ছেলেটি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে বাপকে উড়িয়ে দেবে দেখবে। বলবে—আমি জনগণের সঙ্গে আছি।
আর অবশেষে সেটাই হল। বাপ ছেলেকে সমস্ত কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা হল। আপনার মাটি আপনারই থাকবে। আমরা কেবল গাছের চারা বুনতে চাইছি। গাছের ফলও আপনার ,গাছও আপনার। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল গ্রামটাকে সবুজ করে তোলা। আমরা এমনকি আপনার বাড়ির পাশের খালি জায়গাতেও, বাগানে বস্তিতেও গাছের চারা রোপণ করে যাব। আপনার সম্পদ হবে। আপনিই দেখাশোনা করবেন। অরণ্য গ্রাম এবং প্রকৃতি পর্যটনের ওপরে কিছু বলায় সে আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারল।
— এমনিতেও পতিত মাটি।চাষ-বাস ও হয় না। গাছ রোপণ করলে ভালোই হবে।
ছেলেটি খুশি মনে বাপের সঙ্গে চলে গেল। আমাদের দলটির প্রকৃতি কর্মীরা নিজের নিজের ভাগের কাজ সমূহ শেষ করে ফেলল। পাঁচশো গাছের চারা রোপণ করা হয়ে গেল। কাজ করা মানুষ দুটি ঘের দেওয়ার কাজ করছে। দুই একজন তখনও নদী থেকে জল এনে গাছের চারা গুলির গোড়ায় দিচ্ছে। আমরা তাদের জন্য অপেক্ষা করছি। বাপুটি একটা কেটলিতে লাল চা এবং হাতে ঝুলিয়ে আনা ব্যাগটায় বিস্কুট এবং কাগজের গ্লাস আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে। ব্যস্ততা সহকারে প্রত্যেকেই নিজের নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছে।
গাছের ছায়ায় পেতে রাখা ত্রিপলটিতে আমরা সবাই বসে পড়লাম।
— তোমাদের মধ্যে কে কে আমাদের সংগঠনের নাম করণের ব্যাপারে ভেবে এসেছ?
কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আমরা আরম্ভ করলাম। দুজন তখনও মহা আয়েশে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছিল।
— ন্যাচারস বোন মানে প্রকৃতির হাড়।
একজন বলল। অন্য একজন বলল ন্যাচারস ব্যাকবোন। আমি বললাম নামটা অসমিয়া ভাষায় হলে কী রকম হয়?
— উদয়দা, ভালো হয়।
অচ্যুত বলল। সৌম্যদা প্রকৃতি কর্মীদের মনোভাব লক্ষ্য করে চলেছে।
— তাহলে তুমি বল কী ভাবছ।
— প্রাকৃতিক বৈভব।
—তুমি তো দেখছি তোমার দোকানের নামটাই বলে দিলে।
—সেটা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই নামটা—
— আমি বললাম— আমি একটা নাম বলছি।
— বল, বল।
কয়েকজন আমাকে আমি ভাবা নামটা বলতে অনুরোধ করল।
— দহিকতরা।
— এতো দেখছি একটি পাখির নাম। তার তো বিশেষ কোনো অর্থ নেই।
নবজিৎ বৈশ্য নিজের মন্তব্য জানাল।
— উদয়, একটা অর্থবহ নাম রাখ।
সৌম্যদা আমাকে মনে করিয়ে দিল।
সৌম্যদা, অর্থ আছে। দহিকতরা মানে দশের ভেতরে কাজ ত্যাগের সঙ্গে করা।
আমি এভাবে বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকেই প্রচন্ড জোরে হাততালি দিল। আমি পুনরায় বলতে লাগলাম দহি কতরা পাখির কণ্ঠস্বর উল্লেখযোগ্য। সুললিত সংগীত ছাড়াও পাখিটি ভিন্ন কণ্ঠস্বরে অন্য প্রাণীকে বিপদের সংকেত জানায়। সেই সংকেতের দ্বারা মানুষও বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি জানতে পারে। ছোট্ট পাখিটি দশের হিতের জন্যও কাজ করে।
অবশেষে প্রত্যেকেই আমাকেই সমর্থন জানাল এবং আমাদের সংগঠনের নামটা দহিকতরা হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল।তারপরে আমরা প্রত্যেকেই একত্রিত হয়ে তদর্থ কমিটিটা গড়ে ফেললাম। কাকাবাবু, সৌম্যদা,বিপিন ডেকা এবং আমি উপদেষ্টা।নবজিৎ বৈশ্যকে সভাপতি ,সুনন্দ এবং অনামিকাকে সম্পাদক হিসেবে রাখা হল। অনামিকা আপত্তি করেছিল, কিন্তু কোনোভাবেই সেই আপত্তি টিকল না। কীচক এবং জেপি সহকারী সম্পাদক ।পুলক রাতুলরা বিভিন্ন পদে বহাল রইল। মোট একুশ জনের কমিটি। আমাদের শিবির গুলিতে অংশগ্রহণ করা সমস্ত সদস্যই হল সাধারণ সদস্য।। আজ উপস্থিত থাকার সদস্যের সংখ্যা হল একশো দুই জন। আমাদের প্রত্যেককেই নির্দিষ্ট পরিমাণের ধন দান হিসেবে দিয়ে সভ্য পদ নিতে হবে। সমস্ত হিসেবের খতিয়ান সুচারুরূপে রাখার জন্য কার্যপন্থা এবং দৈহিক কতরার সংবিধানটি কোনো একজন জানাশোনা ব্যক্তির দ্বারা লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করার জন্য কমিটিকে অনুরোধ জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হল। অন্য একটি প্রস্তাব অনুসারে অনন্য গ্রাম এবং প্রকৃতি পর্যটনের জন্য দুটি কমিটির গঠন করা হবে ।কমিটির দুটি স্বতন্ত্র হবে না। তারা মূল কমিটির কাছে দায়বদ্ধ থাকবে এবং কার্য পালনের ক্ষেত্রে তৎপরতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। মূল কার্যনির্বাহকের সদস্যদের থেকে সেই কমিটি দুটি গঠন করা হবে। সঙ্গে এই প্রস্তাব গ্রহণ করা হল যে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য কার্যনির্বাহক কমিটি মিলিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই জন্য কার্যনির্বাহক সমিতির মূল সদস্যদের নিয়ে একটি নীতি নির্ধারক কমিটি গ্রহণ করা হোক। সেখানে উপদেষ্টারা, সভাপতি সম্পাদক এবং সহকারী সম্পাদক কয়েকজন এবং প্রতিনিধি হিসেবে একজন কার্যনির্বাহক সদস্য কমিটিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।উপস্থিত প্রত্যেকেই সমর্থনে নীতি নির্ধারক কমিটিটিকে অনুমোদন জানানো হল। সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল আগামী রবিবার আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাছের চারা রোপণ করব। প্রতিটি সদস্যই তাতে অংশগ্রহণ করবে এবং সজাগতা বৃদ্ধির জন্য তৎপরতা প্রদর্শন করবে। গাছের চারা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সমস্ত সদস্যই যৎপরোনাস্তি গুরুত্ব প্রদান করবে— উপদেষ্টারা সেই আহ্বান জানিয়ে আজকের প্রকৃতির শিবির তাতেই সম্পন্ন হওয়া বলে ঘোষণা করলেন।
সৌম্যদা সকলের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করে বললেন —আমি আগামীকাল আপনাদের বিদায় জানাব। পুনরায় তিন মাস পরে আপনাদের সাক্ষাৎ পাওয়ার সৌভাগ্য ঘটবে। আশা করব এই সময়ের ভেতরে আপনারা গাছের চারা রোপণের কাজ প্রায় শেষ করবেন এবং পর্যটক নিবাস সমূহগুলির নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হবে। তারপরে আরম্ভ করব নতুন পরিকল্পনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন