সোমবার, ১ জানুয়ারী, ২০২৪

হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় ।। বাসুদেব দাস,Basudev Das

হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়

বাসুদেব দাস



১৫ আগস্ট সমগ্র ভারতবাসীর জীবনে এক স্মরণীয় কিন্তু বেদনাদায়ক দিন। শত শহীদের রক্তে রাঙানো ১৫ আগস্ট, আজ আমাদের জাতীয় জীবনে কোনো শিহরণ জাগায় না। দূরদর্শন ও বেতারে মন্ত্রীদের রাজনৈতিক আশ্বাস,লালকেল্লার শীর্ষে  তেরঙা ঝান্ডার উত্তোলন এবং কিছু সামরিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় কর্তব্যের বর্ণাঢ্য সমাপ্তি ঘটে। আজকাল আর লতা মঙ্গেশকরের সুরেলা কন্ঠে ‘এ মেরি বতন কি লোগো জরা আখোঁমে ভর লোঁ  পানী’ শোনা যায় না।কেবল ও দূরদর্শনের  কল্যাণে এখন আমরা যথেষ্ট সাবালক এবং আধুনিক হয়ে উঠেছি। কোনো ধরনের আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো মূর্খামি আমাদের নেই ।

আজ একটু পুরোনো দিনের দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছা করছে। দেখা যাক না স্বাধীনতা রূপ ছেলের হাতের মোয়াটা কি ব্রিটিশ রাজশক্তি আমাদের প্রতি দয়া দেখিয়ে দান করে গেছে নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অনেক রক্তাক্ত ইতিহাস। প্রথমে মেদিনীপুর থেকে ঘুরে আসা যাক। ১৯৩১ সনের ৩০ এপ্রিল। এপ্রিল মাসটা ইংরেজদের কাছে খুব একটা প্রীতিপ্রদ নয়। ১৯৩০ সনের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের সূর্যসেন এবং তাঁর  সতীর্থদের হাতে যে  ভীষণ মারটা খেতে হয়েছিল ব্রিটিশ সিংহ আজও তা পুরোপুরি হজম করে উঠতে পারেনি। পরের বছর ৭ এপ্রিল এই মেদিনীপুরের মাটিতেই লুটিয়ে পড়েছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডি। আমাদের দেশের মায়েরা বর্গির  ভয় দেখিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়ায়।

‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে’।

শ্বেতাঙ্গ জননীরাও খুব একটা আলাদা নয়। তাদের ভীত বিহ্বল কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে,Baby sleep on, Another April is coming.’এ হেন এপ্রিল মাসে ইংরেজরা একটু বেশি সতর্ক থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কী। দ্বিতীয়ত, মেদিনীপুর বলে কথা। সেদিনও সতর্কতার কোনো রকম অভাব ছিল না। সন্ধ্যায় ডিস্টিক্ট বোর্ড অফিসে সভার কাজ পরিচালনা করছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ডগলাস। হঠাৎ সমস্ত রকম সতর্কতাকে অস্বীকার করে রিভলভার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুই বিপ্লবী তরুণ প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য এবং প্রভাংশু পাল। গুলি বর্ষণে মিস্টার ডগলাস গড়িয়ে পড়লেন। শুরু হল হইচই। বিপ্লবীরা ততক্ষণে ছুটে চলেছেন। কাজ শেষ। এবার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাবার পালা।পেছনে ছুটে আসছে বিরাট পুলিশ বাহিনী এবং অগণিত রাজভক্ত প্রজার দল। ব্যবধান একটু একটু করে কমে আসছে। রিভলভার নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রভাংশু। শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন তিনি। তবে রিভলভারে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেওয়ায় প্রদ্যোত ধরা পড়লেন। বন্দি বীরকে হাতের মুঠোয় পেয়ে ইংরেজদের আনন্দের আর সীমা রইল না। প্রদ্যোৎ কিন্তু নির্বিকার। থানায় ঢুকেই দারোগাকে লক্ষ্য করে বললেন—‘ বড্ড গরম লাগছে স্যার। একটু স্নান করব।’ কড়া পাহারায় স্নান সেরে এসে বললেন—‘ এবার একটু ঘুমোব। দেখবেন কেউ যেন আমাকে ডিস্টার্ব না করে।’ শত নির্যাতনেও প্রদ্যোতের কাছ থেকে তার সঙ্গীর নাম জানা গেল না। মহামান্য ইংরেজ বাহাদুর এবার অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন। প্রদ্যোতের দাদা শর্বরীভূষণকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হল। অমানুষিক নির্যাতনে তিনি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গেলেন।বন্ধু ফণী দাস,ক্ষিতি সেন,  নরেন দাসও রেহাই পেল না। বিচারে প্রদ্যোতের প্রাণদণ্ড হল। ট্রাইব্যুনালের অন্যতম বিচারপতি আইসিএস জ্ঞানাঙ্কুর দে বিচারকের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন। তাঁর বক্তব্য আসামির বয়স কম। তাছাড়া দেখা যাচ্ছে প্রদ্যোতের রিভলভারে যান্ত্রিক গোলযোগ

ছিল। গুলি করেছে অন্য লোক। এ অবস্থায় ফাঁসির হুকুম সংবিধান বিরোধী। হাতের মুঠোয় পাওয়া সিংহশাবককে ছেড়ে দিতে ব্রিটিশ শক্তি রাজি নয়। মামলা শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে গড়াল। হুকুমের কোনো পরিবর্তন হল না।

 ১৯৩৩ সনের ১২ জানুয়ারি। ভোর পাঁচটা। স্নান শেষে পুজো, এরপর চন্দন তিলক এঁকে  প্রস্তুত। প্রদ্যোত বলিষ্ঠ পা ফেলে ফাঁসিমঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেল এক অমূল্য তাজা প্রাণ। প্রদ্যোৎ হারিয়ে গেছে। তবে রয়ে গেছে কারাগার থেকে মাকে লেখা অমূল্য চিঠিগুলি।–‘মা তোমার প্রদ্যোৎ কি কখনও মরতে পারে? আজ চারদিকে চেয়ে দেখ লক্ষ লক্ষ প্রদ্যোৎ তোমার দিকে চেয়ে হাসছে। আমি বেঁচে রইলাম মা অক্ষয় অমর হয়ে।’

  ১৯৪৫ সালের ২৯ মার্চ। রেঙ্গুন থেকে ঝাঁসির রানী বাহিনীর দেড়শ সৈনিককে নিয়ে দেবনাথ দাস নেতাজির নির্দেশে ব্যাংককের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সঙ্গে রয়েছে রানী বাহিনীর সুদক্ষ লেফটেনান্ট প্রতিমা পাল এবং ক্যাপ্টেন রাওয়াতের নেতৃত্বে একশো আজাদি সৈনিক। তাদের প্রধান কাজ রানী বাহিনীর বোনেদের নিরাপত্তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।প্রথম দিন ভালোভাবেই কেটে গেল। বিপদ এল দ্বিতীয় দিন। সামনেই রয়েছে সীতাং নদী। খেয়া নৌকা ছাড়া ওপারে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। হঠাৎ আশেপাশের বিপদজ্ঞাপক সাইরেনগুলি একসঙ্গে বেজে উঠল। বুমমমম বুমমমম।গোটা অঞ্চল কেঁপে উঠল একের পর এক প্রচন্ড বিস্ফোরণে। মালপত্র নষ্ট হলেও কোনো প্রাণহানি হল না। এবারের যাত্রা ট্রেনে। আড়াইশো মানুষের জন্য একটি বগি মাত্র। তাও সাধারণ কামরা নয়।ওয়াগন। দরজার কোনো বালাই নেই। কে আগে উঠবে এ নিয়ে আজাদি সৈনিক এবং মেয়েদের মধ্যে লড়াই বেঁধে গেল । জওয়ানদের বক্তব্য বোনেরা আগে উঠুক। হাতে যতক্ষণ অস্ত্র রয়েছে ততক্ষণ তারা বোনেদের গায়ে আঁচর লাগতে দেবে না।স্টেলা  জোসেফাইন,কমলারা কিছুতেই রাজি নন। তাদের দাবি মরতে হয়তো আমরাই মরব। তবুও জওয়ান ভাইদের এভাবে মরতে দেব না। কে না জানে ভবিষ্যতের সংগ্রামের জন্য আজাদী ভাইদের প্রয়োজন রয়েছে। বোনদের দাবির কাছে আজাদী ভাইদের হার মানতে হল। রাইফেল হাতে দরজা আগলে বসে রইলেন স্টেলা,জোসেফাইন,কমলা  প্রমুখ কয়েকজন মেয়ে। ওয়াগনের ছাদের ওপরে পরপর কয়েকটি বালির বস্তা সাজিয়ে মেশিনগান সহ পজিশন নিয়েছেন ক্যাপ্টেন রাওয়াৎ।প্রতিটি মুহূর্ত বিপদ সংকুল। ইঞ্জিনের সার্চলাইট নিভিয়ে রাতের আঁধারে যাত্রা শুরু হল। আলো জ্বালানো মানেই শত্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। গাড়িটা তখন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে । সহসা দূরে একটি আলোর বিন্দু দেখে ক্যাপ্টেন রাওয়াত সতর্ক হয়ে উঠেন। তার আশঙ্কা অমূলক নয়। বোঝা গেল ওটা শত্রুপক্ষের গেরিলাবাহিনীর সিগন্যাল। নিমেষের মধ্যে স্টেলা, জোসেফাই্ন, কমলা প্রমুখ নারী সৈন্যরা তৈরি হয়ে নিলেন ।ক্যাপ্টেন রাওয়াতের নির্দেশ পাওয়া মাত্র ছাদের 

ওপরের মেশিনগান গর্জে উঠল চারদিক কাঁপিয়ে ট্যা  ট্যা  ট্যা  ট্যা…।নিচ থেকে সাড়া দিল স্টেলা, জোসেফাইনের রাইফেল দ্রাম,দ্রাম।মাত্র কয়েক মিনিট …তারপরেই সব শান্ত।ট্রেন বিপদসীমা অতিক্রম করে এসেছে।কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার  হয়ে গেছে।হাবিলদার মিস স্টেলা ,---জোসেফাইন চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন ।  আর কোনোদিনই তাদের কণ্ঠে শোনা যাবে না ‘মরতে হয় তো আমরাই মরব,তবুও জওয়ান ভাইদের আমরা মরতে দেব না।’কমলার কী হল ? বাঁ হাতে গুলি লেগেছে কমলার।পুরো বাঁ হাতটাই কেটে বাদ দিতে হল। তারপর পেরিয়ে গেল অনেকগুলি বছর। স্বাধীন ভারত এই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মেয়েদের অবদানের কথা মনে রাখে নি। তাই ১৫  আগস্টের এই প্রভাতে কোনো  রাজনৈতিক নেতার মুখেই এঁদের নাম উচ্চারিত হতে না দেখলে আমাদের বিষ্মিত হওয়ার কিছু নেই ।

----------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...