বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৩

রম্য রচনা ।। প্রেমের সাত কাহন ।। কাশীনাথ সাহা, Kashinath Saha

রম্য রচনা

প্রেমের সাত কাহন

কাশীনাথ সাহা 



সেই কবে শুনেছিলাম, প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে.... 

না,এখন জীবনে প্রেম একবার আসে না। বারেবারেই আসে যায়।প্রেমের খেলা কে বুঝতে পারে! না পারারই কথা! প্রেম যখন আসে সাইক্লোনের মতো বেগবান হয়ে আসে। তখন সেই উজানে ভেসে যেতেই হয়। স্বয়ং কৃষ্ণ রাধিকার প্রেমে যমুনার নীল জলে ভেসে গিয়েছিল। আমরা তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষ!  রাধাও তো তাই! কৃষ্ণ কদমের মগডালে বসে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে আর কলঙ্কিনী রাই রাত-বিরেতে ছুটে চলেছে সব লোকলাজ ভুলে।

আমাদের সেসময়ে প্রেম ছিল, একটু আড়ালে আবডালে। অভিভাবকরা সবাই কমল মিত্র। নয়তো মোগাম্বো! বাড়িতে কিশোরী মেয়ে থাকলে তাঁর ত্রি সীমানায় অলিখিত  ১৪৪ ধারা জারি থাকতো।চোখে চোখে তাকানো বহুৎ দূর কী বাত্ আড়চোখে তাকাতেও শরীর হিম হয়ে যেত। তবুও ওই সময়ে দাঁড়িয়ে কি করে যে শরৎ চন্দ্র দেবদাসের মতো মারকাটারি একখানা প্রেমের উপন্যাস নামিয়ে দিয়েছিল,ভাবলেই অবাক লাগে। তবে দেবদাস বাঙালিদের প্রেমের প্রাচীর ভাঙার প্রথম কাজটা করতে পেরেছিল। আর প্রেমে গাড্ডা খেলে মদ খাওয়াটা যে অপরাধ নয়, সেটাও বাঙালি প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ইংল্যান্ডের কোন এক যুবরাজ নাকি প্রেমের জন্য পুরো রাজ সিংহাসনটাই ত্যাগ করে দিয়েছেন। আমাদের সময়ে ভ্যালেন্সটাইন ডের মতো একটা গোটা প্রেমের দিন ছিল না। আমাদের প্রেম দিবস মানে সরস্বতী পূজা, স্বাধীনতা দিবস,২৬ শে জানুয়ারী। মানে যেদিন একটু খোলামেলা মেলামেশা করবার ১০% সুযোগ থাকতো।সেখানেই এক পলকে একটু দেখা, আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি। ক্ষতি নেই!  কারণ ততোদিনে উত্তম সুচিত্রা-র নিরামিষ আমিষ প্রেম আমাদের তাতিয়ে দিয়েছে। এই পথ যদি না শেষ  হয়...  কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার... 

সেই সিন দেখে আমাদের পাড়ার রতনদা যে কতো মেয়ের কানে কানে বলেছিল, ওগো তুমি যে আমার...।সাথে সাথে মধুবালা দিলীপ কুমার কম যায় না! প্যার কিয়া কোয়ী চোরী নহী কিউ ছুপছুপ কা ইয়ে ডরনা ক্যায়া...। আহা প্রেম জমে ক্ষীর। প্রাণ যায়ে পর প্রেম না যায়ে। বহুদিন আসমুদ্রহিমাচল মজে ছিল সেই চোরাটানে।

তারপর এলো রাজেশ খান্নার যুগের প্রেম। সেই প্রেমকে টপকে দিয়ে ময়দানে নামলো অমিতাভ - রেখার মারকাটারি রসায়ন। এই প্রেম গাছের ডালে কিচিরমিচির প্রজাপতি প্রেম নয়। এক্কেবারে মারকাটারি প্রেম। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান! তারপর দিলবালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে..

দিকে দিকে যতো প্রেম বাড়ছে ততো কমছে প্রেমের নিরিবিলি জায়গা। ভিক্টোরিয়া, গড়ের মাঠ,গঙ্গার পাড়ে যাদের জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়, ওরা সত্যিই মহাপুরুষ। একটা চার ফুট জায়গায়  চারজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা। এক জোড়ার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে আর এক জোড়া প্রেমিক। কি করে পারে!

জানি না এই প্রেম হৃদয়  সর্বস্ব না শরীর সর্বস্ব!

কবি লিখেছেন না,

" তেমন করে ডাকতে পারো যদি

তবেই আমি শরীর জলে

গড়বো এক নদী"।

এখন ডাক তো আছে কিন্তু নদীতে যে চড়া পড়ে গেছে!

লেখকদের কথা শুনে মাঝে মাঝেই গুলিয়ে ফেলি, কোন প্যায় আসলি প্যার! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো বলেই দিয়েছেন, প্রেম মানেই পরকীয়া। ঘরের বউয়ের সাথে  সংসার করা যায়, কিন্তু প্রেম!  নৈব নৈব চ।ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর।পেট ভরে মন ভরে না। প্রেমের জন্য পাশের বাড়ির শ্রীদেবী! আরে আরে আমাকে দোষ দিয়ে কি হবে, এখন সরকারও তো পরকীয়াকে আইনী সীলমোহর দিয়ে দিয়েছে। পরকীয়া আর আইনের চোখে অপরাধ নয়।  এতে জনসাধারণের লাভলোকসান কি হয়েছে জানি না। তবে পুলিশের উপরি রোজকারে একটু টান তো পড়েছেই। যখন তখন জলে জঙ্গলে, নদীর কিনারে আর চোখ রাঙিয়ে টাকা হড়পাতে পারছে না। 

প্রেম কোন কাঁটাতারের সীমানা মানে না। পাকিস্তানের প্রেমিকা প্রেমের টানে ইন্ডিয়ার কাঁটাতার টপকে এপারে চলে আসছে। এপারের প্রেমিকাও ছুটছে ওপারে। প্রেম সিগন্যাল মানে না... 

এপারে আমি আর ওই পারে তুমি, মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়!  এখন সেই যুগ নেই। নদীতে ব্রীজ তৈরী হয়ে গেছে। সেই ব্রীজের উপর, দোলে দোদুল দোলনায় উড়ছে তাবৎ প্রেমিক যুগল!

সনাতনীদের যেমন রাধাকৃষ্ণ আছে। ওদেরও তেমন লায়লা- মজনু আছে৷ লায়লার টানে কতো মজনু যে, পাগলা হাওয়ায় বানভাসি হয়ে তলিয়ে গেছে তার ঠিকঠিকানা নাই।সিনেমাওয়ালারাও লায়লা মজনু, আর দেবদাস-এর দৌলতে কম কামায় নি।কোটি কোটি। আমাদের শ্রেয়া ঘোষালও তো ওরই জোরে উতরে গেছলো। ডোলা রে ডোলা রে.... 

প্রেমের যথার্থ বয়স কতো হওয়া উচিত?  এ বিষয়ে এখনও সম্ভবত কোন মাপকাঠি নেই। প্রেমের আবার বয়স কি। অমিতাভ যাঁহা সে খাড়া হোতা ওহিসে লাইন শুরু হোতা! প্রেমেও সেই অবস্থা। যে বয়সে পড়বে সেখানেই শুরু। গুরু গুরু...  শেষ বয়সে কি খেল দেখালে বস্!  মন্ত্রী, এম.এল. এ, কলকাতা পৌরসভার সবচেয়ে উঁচু পদটাকে এমন কি দিদিকেও বাইপাস সার্জারি করে বৈশালী - র হাত ধরে নিরুদ্দেশ হতে বুকের পাটা চাই ব্রাদার্স। হিম্মত লাগে। শোভন দা সেই হিম্মত দেখিয়েছেন। এরপর হয়তো লেখক নতুন উপন্যাস ফাঁদবেন " দেবদাস " এর মতো! শোভন - বৈশালীর ককটেল!  আমরা আম আঁটি চোষা পাবলিক শুধু দেখেই সার্থক। সাহস টা সৎ না অসৎ সেটা পরে বিবেচ্য,কিন্তু আমাদের সংসারী জনগণের সেই দুঃসাহসটাই নেই। 

পার্থদা অপার সম্পর্কটা জমবো জমবো করেও ঠিক জমলো না, কোথায় যেন একটা লক্ষ্মণের গন্ডীরেখায় আটকে আছে। কারামুক্তি হলে কি ঘটে সেটাও দেখার!

প্রেমে শক খেলে সবসময় সবাই দেবদাস হয়ে টালমাটাল হয়ে ভ্যাগাবন্ড হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে ঘুরতে পার্বতীর বাড়ির সামনে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়বে এমন কোনও কথা নেই। এখন যুগ পাল্টেছে। চরিত্রও বদলে গেছে। এই তো এক প্রেমিক প্রেমিকার পরকীয়া সহ্য করতে না পেরে মাত্র বিয়াল্লিশ টা ছুরি মেরে প্রেমিকার জান খতম করে দিলো। তার মানে  প্রেমেও এখন আমিষ ঢুকে গেছে।  প্রেম আছে অথচ সন্দেহ নেই এমনটা সচরাচর চোখে পড়ে না। শিখা-র সাথে সুভাষের প্রেম তখন বেশ জমজমাট। বাংলার গ্রান্ড ক্যানিয়ন গনগনির লাল মাটিতে হাত ধরাধরি করে দুজনেই শিলাবতীর উপর সূর্যাস্ত দেখছে। দু'জনে দুজনের প্রেমে টইটম্বুর। সুভাষ বললো, তুমি আমার কল্পনার চেয়েও বেশি, অনেক অনেক বিউটিফুল। কথাটা শুনেই শিখা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। সম্পর্কেও লালবাতি জ্বেলে দিল। সেদিন থেকেই শিখা খুঁজে চলেছে, কল্পনা টা কে? একবার তার খোঁজ পেলে হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিতাম! বোঝ ঠ্যালা।


আচ্ছা একটা জিনিস ঠিক মাথায় ঢুকে না। সিনেমার নায়ক নায়িকাদের যেমন হুড়দাড় প্রেম হয়। নেতা মন্ত্রীদের তেমন প্রেম হয়না কেন? আপত্তিটা কোথায়?  শাসক দলের নেতা নেত্রীর সাথে বিরোধী দলের নেতা নেত্রীর একটু আধটু প্রেম হলে, কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!  বরং সেক্ষেত্রে নির্বাচনী সমঝোতা আরও গভীর হতো।লালের সাথে হলুদের, গেরুয়ার সাথে সবুজের একটু মাখোমাখো কিছু হলে বেশ জমতো কিন্তু। মোহব্বত কি নহী যাতা মোহাব্বত হো যাতি হ্যায়...

ঘটুক ঘটুক এমন অঘটন। আচ্ছা প্রেমের পরে বিবাহ নাকি বিবাহের পরে প্রেম কোনটা টেকসই? কোনটার স্থায়িত্ব বেশী? 

তবে এখন প্রেমেও অংক ঢুকে গেছে। মেয়েরা প্রেম করবার আগে ছেলের ঠিকুজি কুষ্ঠি মিলিয়ে দেখে নেয়ে। চাকরি যোগ কেমন!  হিসাব নিকেশ করে তবে ময়দানে নামে। অবশ্য একদিকে ঠিকই আছে। প্রেমের জোছনা সংসারের গাড্ডায় পড়লে সাঁতার না জানলে সলিল সমাধি। তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা....

প্রেমের পর রোজগার না থাকলে সে প্রেম ভোঁ কাট্টা। তবুও নিয়ম বহির্ভূত প্রেম কি হচ্ছে না। কিন্তু মাঝে মাঝে একই গাছের ডালে একই ওড়নায় দুজনেই ঝুলছে খবর পড়লেই, অমন নিয়ম বহির্ভূত প্রেমে আস্থা হারিয়ে ফেলি। 

প্রেমের কোনও জাতপাত নেই। কথায় প্রবচনে আছে, " পিরিতে মজিলে মন,কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম"! প্রেমের চোরা স্রোতে পড়লে! তোর কোঁকড়া কোঁকড়া চুলে যেন সমুদ্র ঢেউ খেলে। ও তোর লাল লাল ঠোঁটে যে বিড়ির ধোঁয়া ওঠে,  আমি সেখানেই পাগল হয়ে যাই"! এই হচ্ছে প্রেমের আসল কথা। সেখানে ব্রাহ্মণ কায়স্থ, চন্ডাল হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান সব একাকার। কবির কথা তখনই সার্বিকভাবে সার্থক হয়। " আমরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম... ইত্যাদি ইত্যাদি... 

 খুব গোপনে একটা কথা বলছি, দয়া করে পাঁচকান করে কেস খাওয়াবেন না। এই বয়সে জেলে যেতে চাইছি না। আচ্ছা ভেবে দেখেছেন কখনো। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একলা,মুখ্যমন্ত্রী একলা এমন কি বিরোধী দলের কেন্দ্র কিংবা রাজ্য প্রধান প্রতিপক্ষ দু'জনেই সিঙ্গেল!  এঁদের হাতে পড়ে দেশে প্রেম যে এখনও নিরাপদ আছে,  এটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছেন নাকি? খুব কি ভুল বললাম।আপনারা একা থাকুন খেতি নাই, কিন্তু আমাদের অধম শ্রেণির প্রেমে কাঁটা বিছিয়ে দিবেন না, এটাই অনুরোধ। প্রেম ছাড়া বাঙালি বাঁচবে না, সিনেমা বাঁচবে না, সিরিয়াল বাঁচবে না, আর কবিদের বুক থেকে প্রেম ঝরে গেলে কবিতার কি হবে? কে লিখবেন... 

" তেমন করে ডাক দাও যদি

বসন্তে বসন্তে জলঝারি

সাড়া দিতে পারি আমি

অবিশ্বাস্য সাড়া দিতে পারি "!

 প্রেম না থাকলে তাজমহল ভিক্টোরিয়ার প্রত্যেকটা ইঁট খসে খসে পড়বে।দীঘার সী বিচ শুনসান হয়ে যাবে। গঙ্গার মিলেনিয়াম পার্ক ধূধূ মরুভূমির মতো ধুঁকবে।বইমেলা হারাবে তার জৌলুষ। মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল জনশূন্য হয়ে যাবে। ফুচকার স্টলে ভিড় থাকবে না।রেষ্টুরেন্ট খাঁ খাঁ করবে। সংগীত হারাবে সুর লয় তাল।সরস্বতী পূজা উঠে যাবে। পলাশ ফুলের রঙ ফিকে হয়ে যাবে।ভ্যালেন্সটাইন ডে ভ্যানিস হবেই হবে। গোলাপের চাহিদাই থাকবে না। রামধনু হারিয়ে ফেলবে তার সাত রঙের অহংকার! ধুসর হয়ে যাবে পৃথিবীর তাবৎ জৌলুষ!  সেজন্য প্রেম থাকুক দখিনা বাতাসের মতো বাঙালির পাঁজরে।শীতের একফালি রোদ্দুরের গরিমা নিয়ে আমাদের হৃদমাঝারে।

কিন্তু সমস্যা হলো 

" তকদীর হ্যায়, মগর কিসমত নেহী খুলতি

তাজমহল বনানা চাহাতা হুঁ

লেকিন মমতাজ নেহি মিলতি"!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...