হে আমার স্বদেশ- ৪৭
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das
লেখক পরিচিতি--এ সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(৪৭)
বার্ড কোম্পানি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সম্বলপুরের জঙ্গল নিয়েছিল। তার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। কাঠের ব্যবসা চালানোর জন্য কোম্পানি ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও জঙ্গলের সন্ধান করে থাকে এবং লাভজনক জঙ্গলের সন্ধান পেলেই স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সেই জঙ্গলের কাঠ থেকে শ্লিপার তৈরি করে বিক্রি করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এইবার বার্ড কোম্পানি অসমের খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় এবং অসম নেপালের সীমাবৰ্তী এলাকায় কয়েকটি জঙ্গল পেয়ে রেলওয়ে কোম্পানিতে শ্লিপার জোগানের কাজ অব্যাহত রাখবে বলে পরিকল্পনা করল।নিজেকে একজন দায়িত্বশীল জঙ্গল পরিদর্শক এবং জঙ্গলে চলা কাজের পরিচালক রূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সক্ষম হওয়ায় লক্ষ্মীনাথ কোম্পানির সাহেবদের বিশ্বাস‐ ভরসার পাত্র হয়ে পড়েছেন।তাই নতুন করে নেওয়া জঙ্গল গুলির কাজের দায়িত্ব দেবার জন্য ১৯২৭ সালের ৩০ জুলাই তারিখে কোম্পানির বড়ো সাহেব তারযোগে লক্ষ্মীনাথকে কলকাতার অফিসে ডেকে পাঠালেন।
লক্ষ্মীনাথ সম্বলপুর থেকে কলকাতার অফিসে এলেন। সাহেব তাকে শিলঙের কাছাকাছি নতুন জঙ্গল নেবার কথা বললেন। জঙ্গলগুলির কাঠের কাজ পরিচালনা করার দায়িত্ব অর্পণ করলেন। অসমের শিলঙের কাছাকাছি জঙ্গলে কাজ—এদিকে পরিবার থাকবে সম্বলপুরে, লক্ষ্মীনাথ এই দায়িত্বটা গ্রহণ করতে অসুবিধা অনুভব করলেন। মানে আগের মতো মনে সাহস পেলেন না। তবে চূড়ান্ত আর্থিক সংকটে তার অনুরোধ রক্ষা করে বার্ড কোম্পানি চাকরি দিয়েছিল। কোম্পানি থেকে বেতন, বোনাস পায় বলেই তিনি এখন আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। তার চেয়েও বড়ো কথা হল এই চাকরিটা ছেড়ে দিলে এত টাকা বেতনের অন্য একটি চাকরি কোথায় পাবেন?এ সমস্ত ভেবে লক্ষ্মীনাথ বার্ড কোম্পানির হয়ে অসমের জঙ্গলে কাঠের ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। কোম্পানির বড়ো সাহেব তখন শিলঙের জঙ্গল পরিদর্শন করে লক্ষ্মীনাথকে একটা প্রতিবেদন প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন।
লক্ষ্মীনাথ যে অসমের শিলঙের জঙ্গলের কাজের দায়িত্ব নিল, কথাটা প্রথমে প্রজ্ঞাকে জানাল না। অক্টোবরের ১৯ তারিখ কলকাতা থেকে শিলং অভিমুখে যাত্রা করলেন । পরের দিন শিলং পৌঁছে কয়েক দিন ধরে অমলিং,ননগ্ৰাম ইত্যাদি জায়গার জঙ্গল ঘুরে ঘুরে ৯ নভেম্বর কলকাতায় এসে কোম্পানিকে জঙ্গল পরিদর্শনের প্রতিবেদন দাখিল করলেন । প্রতিবেদন পাঠ করে কোম্পানি লক্ষ্মীনাথকে অসমের যোগবানীতে যাবার নির্দেশ দিলেন।এবার অসমের জঙ্গলে যাওয়ার কথাটা প্রজ্ঞাকে না বলে কীভাবে থাকেন? অসমের জঙ্গলে গিয়ে এক সপ্তাহ দশ দিন থাকা নয়, দীর্ঘ আড়াই মাস থাকতে হবে। না জানিয়ে আড়াই মাস অসমের জঙ্গলে থাকাটা উচিত হবে না। অবশেষে প্রজ্ঞাকে বললেন। প্ৰজ্ঞা চিন্তিত হয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল অসমের জঙ্গলে আড়াই মাস থেকে কাঠের ব্যবসা দেখাশোনা করবে বলে সাহেবদের কথা দিয়ে এলে, সত্যিই তুমি পারবে?'
' কেন পারব না? এই কাজই তো করছি—।'
'ওগো, এখন তোমার বয়স হয়েছে। তুমি এখন তেষট্টি বছরের বুড়ো । তাছাড়া ,যখন তখন তোমার নাক দিয়ে রক্তপাত হতে থাকে, তখন তুমি এতটাই দুর্বল হয়ে পড় যে তিন চার দিন বিছানা থেকে উঠতে পার না। তেমন কিছু হলে আসামের ওই গভীর জঙ্গলে কে তোমাকে দেখবে, শুনি? তাছাড়া তোমার হজম শক্তি কমে এসেছে। তোমার এখন প্রায়ই অম্বল হয়। বনে জঙ্গলে থাকলে দিনের পর দিন বাইরের খাবার খেতে হবে। ওভাবে তোমার পেটের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। কোম্পানির সাহেবরা তোমার এসব কথা বিবেচনা করল না ?'
প্রজ্ঞা অভিজ্ঞ, বিচার জ্ঞান সম্পন্ন। জঙ্গলে থাকা অবস্থায় স্বামীর কী কী অসুবিধা হতে পারে তার জন্য তিনি সচেতন বলেই এভাবে বললেন।আর তিনি সঠিক কথাই বললেন।
লক্ষ্মীনাথ কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অসহায় ভাবে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে বললেন ,'চাকরি বাঁচাতে হলে আমাকে আসামে যেতে হবে।'
' বয়সের কথাটা বিবেচনা করে কোম্পানির সাহেবরা জঙ্গলে না পাঠিয়ে তোমাকে অফিসের কাজ দিতে পারত।'
'ওহো, বার্ড কোম্পানির কাঠের ব্যাবসাটা জঙ্গল নিয়েই। এত বছর ধরে জঙ্গলের কাজ করছি—অভিজ্ঞতার জন্যই কোম্পানি আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। আর আমি কি শখ করে জঙ্গলে যাচ্ছি? আড়াই মাস তোমাকে ছেড়ে, মেয়েদের ছেড়ে জঙ্গলে থাকতে আমারে কি ভালো লাগবে? দেখ পরি, সবই তো বোঝ —সাংসারিক খরচ তো আছেই। কলকাতায় হোস্টেলে রেখে রত্না- দীপিকার ইংলিশ স্কুলে পড়ানোর খরচ, তারপর ওদেরকে বিয়ে দিতে হবে। বিয়ে দেওয়ার জন্য এখন থেকেই তো টাকা-পয়সা জমাতে হবে।'
কথাটা সত্য।সব কথাই বাস্তব। কঠোর এই বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া লক্ষ্মীনাথের উপায় নেই।
' সবই মানছি।' গম্ভীর কন্ঠে প্রজ্ঞা বলল, আমি কখনও তোমার কোনো কাজে বাধা দিই না। আমাদের বাড়িতে রেখে তুমি কত জায়গায় ঘুরে বেড়াও, কখন ও না করি না। এবারও তোমাকে বাধা দিচ্ছি না। কিন্তু তোমার এই বয়স আর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে কেন যেন মনে হচ্ছে এখন তুমি এত দিনের জন্য আসামের জঙ্গলে থেকে কাজ করাটা তোমার পক্ষে ঠিক হবে না।'
তথাপি লক্ষ্মীনাথ যোগবানীতে এলেন। যোগবানী অসমের সীমান্ত অঞ্চলে জনবসতিহীন নির্জন স্থান। জঙ্গল। ওখান থেকে এক ফারলঙের মতো দূরত্বে নেপালের সীমা। এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একটা মারোয়াড়ি দোকান দেখতে পেলেন। দোকানের মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি গোলার ছোটো একটি ঘর নিয়ে বাস করতে লাগলেন। লক্ষ্মীনাথ সম্বলপুর থেকে উড়িয়া কাজের লোক ভালুককে ( আসল নাম মুকুন্দ) নিয়ে এসেছেন। এই বনবাসে একান্ত অনুগত ভালুক হল তার সঙ্গী, তার রাঁধুনি এবং তার বিপদের বন্ধু। ভালুর সঙ্গে ছোটো গোলাটাতে থেকে লক্ষ্মীনাথ জঙ্গলের কাজকর্ম চালাতে লাগলেন।
কিন্তু থাকা খাওয়ায় কষ্ট হল। লক্ষ্মীনাথ মানুষের সঙ্গে কথা বলে হাসি ঠাট্টা করে থাকায় অভ্যস্ত। তার কাছে পান্ডব বর্জিত এই জায়গায় থাকাটা এক ধরনের বন্দিত্ব। অপূর্ব শ্যামলীমা নিয়ে এর প্রকৃতি উদার যদিও ৩-৪ দিন থেকেই লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে পড়েন। বেশি অস্থির হয়ে পড়লে এটা ওটা কাজ দেখিয়ে তিনি কোম্পানির গুয়াহাটির অফিসে চলে আসেন এবং কোম্পানির বাগান রোডের বাসভবনে দুই এক দিন থেকে জীবনের শক্তি নিয়ে পুনরায় কর্মস্থলে যান। এভাবে তার দেহের অবস্থা সত্যিই খারাপ হয়ে পড়ল। তিনি নিজেই অনুভব করলেন শরীরে আগের মতো শক্তি নেই। ভগবানের কাছে ভরসা করার সঙ্গে কাজের ভালুকে সারথি করে জঙ্গলে থেকে তিনি কাজকর্মের দেখাশোনা করতে লাগলেন।
গহন অরণ্যে থেকে কাঠের কাজ।জন্তু-জানোয়ার ছাড়া ম্যালেরিয়ার বীজানু নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মশা, বিষাক্ত সাপ ,রাতে বিদ্যুতের আলো নেই, খাবার জলের অসুবিধা। অসমিয়া জাতীয় অনুষ্ঠান অসম সাহিত্য সভার সর্বজনপূজ্য প্রাক্তন সভাপতি লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া এখন জীবিকার জন্য অনিশ্চিত এবং বিপদ সংকুল জীবন বেছে নিয়েছেন। তবে এটাই সত্য তিন কুড়ি বছর পার করা লক্ষ্মীনাথ এই সত্যটিকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন ।আগের বাসস্থান ছেড়ে তিনি নতুন করে কাজ আরম্ভ হওয়া গুয়াহাটির কাছে জঙ্গল লাইলাকে ঘর নিলেন।
লাইলাকের জঙ্গলে গাছ কাটা হয়,করাতিরা গাছ কেটে শ্লিপার তৈ্রি করে,সেখান থেকে গাড়োয়ানের মাধ্যমে গরুর গাড়িতে ননগ্রাম জঙ্গলের কাছে থাকা গোলায় এনে রেলের ইঞ্জিনিয়ারকে খাতির করে শ্লিপার ‘পাস’করাতে হয়।প্রতিটি খেপে লক্ষ্মীনাথ লাইলাক থেকে ননগ্রামে হেঁটে আসেন।এভাবে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে আসা যাওয়া করাটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক।
সম্বলপুর থেকে প্রজ্ঞার উদ্বেগভরা চিঠি আসতে লাগল।জঙ্গলে স্বামীর থাকা-খাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে,সেবা-যত্নের অভাবে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়ছে। প্রজ্ঞা তাকে দ্রুত সম্বলপুরে ফিরে যেতে অনুরোধ করল।পত্নীকে সান্ত্বনা দিয়ে লক্ষ্মীনাথ লিখলেন—‘পরি,আমি নিজেও এখানে থাকতে চাই না।কিন্তু কোনোমতে আর কটা দিন কাটিয়ে একেবারে কাজ ছেড়ে চলে আসব।কাল যতীশ দাস ডাক্তার দুঃখ করল যে আমাকে অন্যায়ভাবে এরকম ভয়ানক জঙ্গলে পাঠানো হয়েছে।এই জঙ্গলের জল-হাওয়া খুবই খারাপ।এখানে রোজ বৃষ্টি হচ্ছে।ভীষণ ডেম্প।বার্ড কোম্পানির সাহেব বেটারা ভীষণ সেলফিস।নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাকে দিয়ে এভাবে কাজ করিয়ে নিচ্ছে।যাই হোক,সাবধানে আছি।জল ফুটিয়ে খাচ্ছি।ভালু আমাকে দেখাশোনা করছে।তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা কর না।ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন।’
কিন্তু ঈশ্বর লক্ষ্মীনাথের প্রতি সদয় হলেন না।জঙ্গলে তার কষ্ট বৃ্দ্ধি পেল।
এমনিতে মানুষের জীবনে অরণ্য একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।গাছপালায় সবুজ অরণ্যানী হল পাখ-পাখালি,জন্তু-জানোয়ারের বাসস্থান।জঙ্গলের নিজস্ব একটা রূপ আছে।এই রূপটি লক্ষ্মীনাথকে আকৃ্ষ্ট করে।এক সময়ে তিনি মৃগয়ায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলেন।বন্দুক হাতে নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঢুকে মৃগয়ার উন্মাদনায় এক আনন্দ উপভোগ করতেন।মৃগয়া ছেড়ে দেওয়ার পরে লক্ষ্মীনাথ বনে জঙ্গলের নৈ্সর্গিক রূপটা দেখতে পেলেন। বিশেষ করে জ্যোৎস্না রাত– কী অপূর্ব রূপ, যেন রূপ সৌন্দর্যে অপরূপা হয়ে স্বপ্নপুরীর পরীরা মর্ত্য লোকে নেমে আসে। লক্ষ্মীনাথ চায়। এত কষ্ট, থাকা খাওয়ার এত অসুবিধাতেও প্রকৃতির এই রূপটি তাকে এক বিমল আনন্দ দান করে।
নির্জন অরণ্যের এই অপরূপ দৃশ্যগুলি লক্ষ্মীনাথের অন্তরের রোমান্টিক ভাব সত্তাটিকে সজীব করে তোলে। লক্ষ্মীনাথের তখন প্রিয়তমা পত্নীর কথা মনে পড়ে। তার জন্যই অক্লান্ত পরিশ্রম করে দিনের শেষে অস্থায়ীভাবে থাকা বাড়িতে এসে কেরোসিনের ক্ষীণ আলোতে পত্নীকে চিঠি লিখতে বসেন। এভাবে একদিন দুদিন পরে পরে এই চিঠি লেখাটা হল প্রজ্ঞার সঙ্গে হৃদয়ের দরজা খুলে আলাপচারিতা। এভাবে বনবাসে থাকার নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা কিছুটা প্রশমিত হয়, সামান্য হলেও দিনের ক্লান্তি নিরসন হয়।
লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞাকে লেখেন,' তোমার পাঠানো মিষ্টি পেলুম। তুমি যে নাড়ু দিয়েছিলে, সেগুলো প্রায় একমাস ধরে খেলুম।' অন্য একটি চিঠিতে,' আমি জঙ্গলের ভেতরে তাঁবুতে আছি। ভালো আছি। একরকম চলে যাচ্ছে। আমার জন্য তুমি অস্থির হবে না। ঈশ্বরের ওপরে ভরসা রাখ, ঈশ্বর আমাকে একরকম করে চালিয়ে নেবেন।' পরবর্তী একটি চিঠিতে,' তোমার মুক্তার মতো হস্তলিপি এইমাত্র পেলুম। মনটা হু হু করছিল। তোমার অমন সুন্দর চিঠিখানা পড়তেই আগুনে জল পড়লে যেমন ঠান্ডা হয়, সেইরকম মনটা আমার তৎক্ষণাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। তুমি যে কী ঔষধ জান, তুমি সত্যিই দেবী প্রজ্ঞা সুন্দরী।'
কিন্তু অসমের গহন অরণ্যে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা বা প্রেম অনুরাগে পত্নীকে চিঠি লেখাটা তার কাজ নয়। তিনি বার্ড কোম্পানির নির্দেশে এখানে এসেছেন। কোম্পানির সাহেবরা ধুরন্ধর ব্যাবসায়ী। বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে তাকে কোম্পানির ব্যাবসায়িক স্বার্থ দেখতেই হবে।
জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় কাজ হয় না। শ্লিপার তৈরির উপযোগী গাছের অবস্থান অনুসারে করাতিদের কোথায় কোথায় গাছ কাটতে হবে সেটা মহরি এবং করাতিয়ারা স্থির করে। এদিকে জঙ্গলের মধ্যে পথঘাট নেই। করাতিয়ারা কাজ করার জায়গায় পায়ে হেঁটে যেতে হয়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কাজ দেখার জন্য কোনো কোনো দিন কুড়ি মাইল পর্যন্ত হাঁটতে হয়।
একদিন এভাবে ঘুরে ঘুরে জঙ্গলের কাজ দেখতে দেখতে কখন যে সূর্য ডুবে গেল বুঝতেই পারলেন না। এত গভীর জঙ্গল যে সূর্যের আলো দেখা যায় না।
রাতের অন্ধকার নেমে এল। সঙ্গী ভালুর সঙ্গে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে লক্ষ্মীনাথ পথ হারিয়ে ফেললেন। তথাপি সাহস করে এগিয়ে যেতে গিয়ে জঙ্গলের লতা পাতা তাদের পা ঘিরে ধরল। জায়গাটা এত খারাপ যে তারা আর এগোতে পারলেন না।
এদিকে অনতিদূরে বন্য জন্তু-জানোয়ারের চিৎকার শুনে লক্ষ্মীনাথ প্রমাদ গুণলেন। এরকম মনে হল যে তারা যেন আর রক্ষা পাবেন না। রাতের মধ্যে তারা জন্তু-জানোয়ারের শিকার হয়ে যাবেন। ভয়ে লক্ষ্মীনাথের গলা শুকিয়ে গেল।শেষে আর পারলেন না। ভয়ে ক্লান্তিতে পরিশ্রান্ত হয়ে একটা পাথরের ওপরে বসে পড়লেন।
মনিবের এই অবস্থা দেখে ত্রিশ বত্রিশ বছরের ভালু এখন কী করবে? কীভাবে এখান থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে? নিরুপায় হয়ে ভালু কাতর কণ্ঠে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাতে লাগল।
ভগবান যেন ভালুর প্রার্থনা শুনলেন। কিছুক্ষণ পরে পাশ দিয়ে দুজন গারো করাতিকে যেতে দেখে ভালু ওদের ডাকল। কাকুতি মিনতি করে ওদেরকে ডেকে এনে পাথরে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকা মনিব লক্ষ্মীনাথকে দেখিয়ে ভালু সাহায্য চাইল।
লক্ষ্মীনাথকে পড়ে থাকতে দেখে গারো করাতি দুজনের খারাপ লাগল। ওদের সঙ্গে বাঁশের চুঙ্গায় চা থাকে। ওরা লক্ষীনাথকে সেই চা খাওয়াল। ধীরে ধীরে লক্ষ্মীনাথ ও জ্ঞান ফিরে পেলেন। তারপরে গারো করাতি দুজন লক্ষ্মীনাথ এবং ভালুকে ওদের সঙ্গে হাঁটতে বললেন। কিন্তু লক্ষীনাথের অবস্থা এতই শোচনীয় এবং এতটাই দুর্বল যে হাঁটার শক্তি নেই। তিনি অসহায় ভাবে বললেন,' আমি হাঁটতে পারছি না।'
অবশেষে গারো মানুষ দুজনের একজন লক্ষ্মীনাথকে পিঠে তুলে নিয়ে তারা থাকা জায়গাটায় নিয়ে এল।
মনিবের দুর্দশার দিকে তাকিয়ে বেচারা ভালু বলল,' 'সাহেব আমি কোনোদিন, আপনাকে এত কষ্ট করতে দেখিনি।'
নির্বিকার কন্ঠে লক্ষ্মীনাথ বললেন,' কী আর করবি? বিধির বিধান কে খন্ডন করবে?'
' আপনাকে এভাবে কষ্ট করতে দেখলে মেম সাহেব কেঁদে ফেলতেন।'
জঙ্গলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এত অসুবিধা এত কষ্ট… সত্যি লক্ষ্মীনাথ আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন, এভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। এত অত্যাচার তার দেহ সহ্য করতে পারবে না। এর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে বার্ড কোম্পানির চাকরি ছাড়তে হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটা নয়। নয় মানে আর্থিক দিকটা চিন্তা করেই লক্ষ্মীনাথ চাকরি ছাড়তে পারেন না।
প্রজ্ঞা ছাড়া রত্না এবং দীপিকা তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। অরুণা-সত্যব্রত উদ্বেগ প্রকাশ করে তাকে কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেবার জন্য চিঠি লিখল। তারপরও লক্ষ্মীনাথ চাকরি ছাড়ল না। প্রতিশ্রুতি দেওয়া অনুসারে তিনি আড়াই মাস পূর্ণ করেই চাকরি ছাড়বেন। কথাটা জানতে পেরে বরোদা থেকে অরুণা‐- সত্যব্রত টেলিগ্রাম করল,' রিজাইন ইমিডিয়েটলি এন্ড কাম ব্যাক টু হোম।'
তারপরেও লক্ষ্মীনাথ লিখলেন, এই জঙ্গল সত্যিই ভীষণ, ভয়ঙ্কর। এখানে এলে কান্না পায়। তবু বলছি, আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে তোমরা ভেব না। কোনো মতে আর কটা দিন কাটিয়ে দেব।'
এভাবে চিঠি লিখল যদিও শেষে লক্ষ্মীনাথ আর পারলেন না। পরিশ্রমের পরে বিশ্রাম হয় না।জঙ্গলের প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে অপরিশোধিত পানীয় জল খাওয়া-দাওয়া চূড়ান্ত অনিয়ম। নাক দিয়ে রক্তপাত না হলেও লক্ষ্মীনাথের বদহজম হতে লাগল ।সঙ্গে পিত্ত শূল বেড়ে চলল। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ল। অবশেষে লক্ষ্মীনাথ নিয়তির সঙ্গে আপোষ করতে বাধ্য হলেন।
কার্কপেট্রিকের পরে দায়িত্ব নিলেন মিঃ জেনার। কিছুদিন পরে মিঃ জেনার কলকাতার মূল অফিসে বিভাগীয় দায়িত্বে বাহাল হলেন। ইতিপূর্বে তিনি কাজ করা পদে এলেন মিস্টার উইথঅল।পালমার নামে এক কম বয়সী সাহেবের সঙ্গে মিঃ উইথঅল লক্ষ্মীনাথ কাজ চালিয়ে থাকা জঙ্গল দেখতে গেলেন। কাজকর্ম দেখে তারা লক্ষ্মীনাথের প্রশংসা করলেন।
তার জন্য লক্ষ্মীনাথের মনটা পুনরায় পরিবর্তিত হল। পদত্যাগের কথা না লিখে লক্ষ্মীনাথ মিঃ জেনারকে জানালেন তিনি সুদীর্ঘ বারো বছর ধরে বার্ড কোম্পানিকে সেবা করে আসছেন।নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কখনও ছুটি নেননি। কিন্তু গত দুমাস অসমের অস্বাস্থ্যকর জঙ্গলে থেকে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। কলিক পেইন, ইনডাইজেশন এন্ড উইকনেসে আক্রান্ত হয়েছেন।তাই তাকে স্বাস্থ্যকর কোনো জায়গায় বদলি করা হোক অথবা তাকে তিন মাসের ছুটি মঞ্জুর করা হোক।
অবশ্য বার্ড কোম্পানির কর্তারা এত অকৃতজ্ঞ নয় তারা ১৯২৮ সালের মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে লক্ষ্মীনাথের ছুটি মঞ্জুর করলেন কিন্তু লক্ষ্মীনাথ শান্তি পেল না নিজের ইচ্ছামতো ছুটি পেয়েও মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া অশান্তিটা কমল না। আসলে গত দুই মাস জঙ্গলে থাকার কষ্ট এবং তিক্ততা তাকে এমন করে তুলেছে। তার জন্যই চাকরি থেকে তার মন উঠে গেছে। এটাই লক্ষ্মীনাথের চরিত্রের এক বৈশিষ্ট্য। কোনো কারণে একবার যদি কোথাও থেকে মনটা উঠে যায় তারপরে তিনি আর মনটাকে ঘুরিয়ে আনতে পারেন না। তখন তিনি বৈষয়িক লাভ লোকসানের কথা ভাবতে পারেন না ।ভোলানাথের সঙ্গে সংঘাত লাগার পরে বি বরুয়া কোম্পানি থেকে বেরিয়ে আসার সময়ও লক্ষ্মীনাথ এটাই করেছিলেন।
মোটের ওপর এখন তিনি বার্ড কোম্পানি ছাড়ার জন্য ভেতরে ভেতরে সংকল্পবদ্ধ হয়ে পড়লেন। কোম্পানি থেকে দ্রুত অব্যাহতি লাভ করার জন্যই তাড়াতাড়ি শিলং গেলেন্। অফিসে কোম্পানির হয়ে করতে লাগা কাজটুকু করলেন। চারদিন পরে গুয়াহাটিতে এসে স্লিপার পাঠানোর জন্য রেলের কামরার বন্দোবস্ত করলেন।পরের দিনই ডাকযোগে বার্ড কোম্পানিতে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করলেন। ১৯২৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।তার ১৪ দিন পরে গুয়াহাটি অফিসে এসে মিঃস্মার্ট সাহেবকে নিজের দায়িত্বে থাকা সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দিলেন।
দুই মাসেরও বেশি দিন জঙ্গলে থাকা হল। সাধারণ জনজীবনের চেয়ে অরণ্যের জীবনটা আলাদা। সম্বলপুরে ঝাড়চোগোড়া চামুন্ডা লুড-লোরি বরছাই ইত্যাদি জঙ্গলে কাজ করেছিলেন। কিন্তু আসামের জঙ্গলে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা আলাদা। এখানকার জঙ্গলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশটা লক্ষ্মীনাথকে অন্যরকম করে তুলেছিল। প্রতিদিন দাড়ি কামানোতে অভ্যস্ত লক্ষ্মীনাথ গত দুই মাস একবারও দাড়ি কামান নি। চুল কাটেন নি। প্রিয়তমা পত্নী এবং প্রাণাধিক মেয়েদের থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি চুল দাড়ি কাটার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন।সাজ পোশাকেও যত্ন নেননি। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে
গুয়াহাটিতে এসে নাপিত ডেকে এনে চুল কেটে, দাড়ি কামিয়ে পরিষ্কার শার্ট প্যান্ট পরে পুনরায় তিনি ভব্য সাহেব হয়ে পড়লেন।
বার্ড কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার পরে তাৎক্ষণিকভাবে ভালো লাগলেও মার্চের এক তারিখ রেলে কলকাতায় যাবার সময় বিগত ১২ বছরের অনেক স্মৃতি তার মনের আকাশে ভেসে উঠল। সেই সব তাকে বিরক্ত করল, ব্যথিত করল। তারপরে মনটা অনিশ্চয়তায় ভরে উঠল।
অনিশ্চয়তাটা হল এর পরে কী করবেন? জমা টাকায় কিছুদিন ঘর-সংসার মেয়ে দুটির পড়ার খরচ চালাতে পারলেও তারপরে কীভাবে চলবে? রত্না দীপিকাকে বিয়ে দেবার টাকা সংগ্রহ করবেন কীভাবে? জীবনের বাকি থাকা দিনগুলি কীভাবে চালাবেন? প্রশ্নগুলি তাকে অস্থির করে তুলল। এরকম মনে হল যেন আগন্তুক দিনগুলি ভয়াবহ এক রূপ নিয়ে এগিয়ে আসছে।
তথাপি লক্ষ্মীনাথ মনোবল হারালেন না। শেষে ভাবলেন বর্তমানেই সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটা উপায়ই খোলা আছে। সেটা হল পুনরায় কাঠের ব্যাবসা করা। কিন্তু বি বরুয়া কোম্পানি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্রভাবে ব্যাবসা করতে গিয়ে সফল হতে পারেননি। এখন তিনি তিন কুড়ি চার বছর বয়সে পড়া এই শরীর নিয়ে কাঠের ব্যবসা নেমে সফল হতে পারবেন কি?
অসমিয়া জাতি অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের উন্নতির জন্য সেবা দান করে অসমিয়া জাতীয় জীবনে একজন বরেণ্য পুরুষ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তার জন্য অসমিয়া মানুষ তাকে ভালোবাসে, সভা সমিতিতে আমন্ত্রণ করে সহস্র জনের মধ্যে ফুলে শোভিত গামছা পরিয়ে হাতে শরাই তুলে দিয়ে তাকে সম্বর্ধনা জানায়। সহস্রজনের উচ্ছ্বাস ভরা হাততালি শুনে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন বলেই মনে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এটাই যে বেঁচে থাকার জন্য বা নিজের পরিবারকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য উপাদানটুকু কীভাবে যোগাড় করবেন সেটা অসমিয়া জাতির কেউ চিন্তা করেন না।…এসব ভাবলে লক্ষ্মীনাথের মনের ভেতরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।তা বলে জাতীয় দায়িত্ব থেকে তিনি নিজেকে বিরত রাখেন না।
গুয়াহাটি থেকে কলকাতায় এসে জোড়াসাঁকোতে ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে একদিন থাকলেন। হোস্টেলে থাকা রত্না এবং দীপিকার সঙ্গে দেখা করে তাদের কলেজের ফি দিয়ে পরের দিন সম্বলপুরে এলেন।
লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞার অন্তরটা ব্যথিত হয়ে পড়ল। স্বামীর স্বাস্থ্য এত খারাপ হয়ে পড়েছে। প্রজ্ঞার এরকম মনে হল যেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। কিন্তু তার আবেগ উচ্ছ্বাস কম। তিনি সেদিনই ডাক্তার ডেকে এনে লক্ষীনাথের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালেন। হজম ভালো হয় না, অম্লশূলে কষ্ট পাচ্ছেন। ডাক্তার ঔষধ লিখে দিলেন। সেইসব খাইয়ে প্রজ্ঞা স্বামীর সেবা যত্ন করতে লাগলেন।
পত্নীর সেবা যত্ন আদর পেয়ে লক্ষ্মীনাথও মনে মনে শপথ নিলে্ন, না ভবিষ্যতে আর কখনও প্রজ্ঞাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আর্থিক দিকে কষ্ট হলেও প্রজ্ঞা থেকে আলাদা হয়ে থাকবেন না।
দুদিন বিশ্রাম নিয়ে লক্ষ্মীনাথ পুনরায় কাজে লাগবে বলে ভাবলেন। এমন সময় দুঃসংবাদ এল। ১৯২৮ সনের দুই মে প্রাগজ্যোতিষপুরের লৌহিত্যতট পঞ্চতীর্থে পন্ডিত হেমচন্দ্র গোস্বামী দেহত্যাগ করেছেন। তিনি দেহত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য পরম্পরার এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের অন্ত পড়ল।কলকাতায় থেকে জোনাকি প্রকাশের সময়ে অন্যতম প্রধান সহযোগী প্রিয় বন্ধু হেম গোঁসাইয়ের বিয়োগে লক্ষীনাথের অন্তরটা শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। লক্ষ্মীনাথ লিখলেন সেদিন কেবল ফেব্রুয়ারি মাসের ২৯ তারিখ আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম। কে জানত যে সেই বিদায়ই আমার কাছে শেষ বিদায় হবে। আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যাতে আমি তার কাছে থাকতে পারি সেজন্য মাটি এক টুকরো নিয়ে একটা বাড়ি তৈরি করতে বলেছিলেন, ‘আপনি আসুন দুজনে কাছাকাছি একসঙ্গে বসবাস করি।’
আজ কার কাছে কে বাড়ি তৈরি করে থাকবে, নিয়তি কে জিজ্ঞেস করছি। আজ অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামীকে হারিয়ে যে ক্ষতি হল সেই ক্ষতি সহজে পূরণ হবে না। অসমিয়া ভাষার সাহিত্য একজন একনিষ্ঠ সেবক হারাল।
হেমচন্দ্রের মৃত্যু শোক কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল ।এদিকে ব্যবহারিক বাস্তব বড়ো নিষ্ঠুর। লক্ষ্মীনাথ জীবিকার উপায় নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। হেমচন্দ্রের মৃত্যু শোক মনে নিয়েও কয়েকবার ঝাড়চোগোড়ায় গিয়ে উড়িষ্যার কোথাও জঙ্গল নেবার জন্য চেষ্টা করলেন। অবশেষে ১৯২৮ সনের ৭ মে লক্ষ্মীনাথ ৫৫৮৩ টাকার বিনিময়ে সম্বলপুর জেলার জমিদারের লাইরা জঙ্গল লিজে নিতে সক্ষম হলেন ।
প্রজ্ঞার সান্নিধ্য এবং সেবা যত্ন পেয়ে ভালো হলেও লক্ষ্মীনাথ সম্পূর্ণ সুস্থ হলেন না। এদিকে নতুন করে নেওয়া জঙ্গলের কাজ পরিদর্শন করতে হবে। শ্লিপার পাস করাতে হবে। ‘বাঁহী’তে প্রবন্ধ লিখতে হবে এবং অসমের সমস্যার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। জঙ্গল নিয়ে কাঠের ব্যবসা চালানো এবং সাহিত্যচর্চা করা দুটি একেবারে বিপরীত ধর্মী কাজ। তথাপি সম্বলপুরে নিজের বাড়িতে থেকে ধীরে সুস্থে ব্যাবসা চালানো ছাড়াও তিনি অসমিয়া সাহিত্য রচনায় মগ্ন হলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন