হে আমার স্বদেশ- ৪৫
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das
লেখক পরিচিতি--এ সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(৪৫)
বন্ধুত্ব রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিরোধ বিতর্ক যে বাধা নয়, ভোলানাথ সেটা কয়েকবার প্রমাণ করল।আসলে, লক্ষ্মীনাথ কলকাতা ছেড়ে সম্বলপুরে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করার পরে ভোলানাথ তার অভাবটা বেশ ভালোভাবে অনুভব করতে লাগলেন। তার জন্য হঠাৎ একেক দিন ভোলানাথ সম্বলপুরে চলে আসেন। অথবা টেলিফোন করে ঝাড়চোগোড়ায় লক্ষ্মীনাথকে ডেকে আনেন।লক্ষ্মীনাথের উপস্থিতি, তার রসালো কথাবার্তা, আন্তরিক ব্যবহার ভোলানাথকে আনন্দ দান করে। লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে বসে বিরামহীন ভাবে কথা বলে পান-আহার করেন। তারপরে বিদায় নেবার সময় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতোই আদর করে জিজ্ঞেস করেন— বেজ, তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি? টাকা পয়সা লাগবে?অল্পতেই সন্তুষ্ট লক্ষ্মীনাথের মনটা ভরে উঠে। অসুবিধা থাকলে অকপটে জানায়। ভোলানাথ লক্ষীনাথকে উদারভাবে সাহায্য করেন।আর সেদিনও লক্ষ্মীনাথ তার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা ধার নিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা,অকৃতদার ভোলানাথের আগের শরীরের বাঁধন এখন নেই।বিপুল সম্পত্তির অধিকারী ভোলানাথের কথাবার্তায় আগের মতো প্রাণোচ্ছলতা নেই।
এদিকে বার্ড কোম্পানির উড়িষ্যার জঙ্গলের ম্যানেজারের কাজ করা ছাড়া লক্ষ্মীনাথ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দায়িত্ব কিছু পালন করেন। ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করে বিনোদনমূলক কর্মসূচিতেও জড়িত হয়ে পড়েন।অসমিয়া ভাষা সাহিত্যে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ার পরে বিদ্যায়তনিক দিকেও তাঁর গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। তার জন্যই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক লক্ষ্মীনাথকে পুনরায় ১৯২২ সনে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার জন্য দুটি প্রশ্নপত্র প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ করে। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে প্রশ্নপত্র দুটি প্রস্তুত করে লক্ষ্মীনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে রেজিস্টার করে পাঠিয়ে দিলেন।
বাড়ির অন্দরমহল মানে সংসারটা প্রজ্ঞাই পরিচালনা করে। চাকরের মাধ্যমে বাজার টাজার করা, রান্না বান্না করা এবং বাড়ির কাজ সব প্রজ্ঞাই সামলায়।মেয়েদের পড়াশোনা খারাপ কিছু দেখলে তাদের শাসন করা বা বুঝিয়ে সুঝিয়ে চরিত্র গঠনের কাজও প্রজ্ঞাই করে থাকে।রত্না দীপিকা কলকাতার সেই একই কলেজে পড়াশোনা করছে। মাসে পনেরো দিনে অথবা ছুটি পেলেই তারা সম্বলপুর চলে আসে। তাই লক্ষ্মীনাথের সমস্ত কিছুই ভালোভাবেই চলছে।।
অবশ্য মাঝখানে কেষ্ট বাবু নামে একজন মুহুরী খারাপ ভাবে অভিযোগ করার জন্য মিস্টার কার্ক পেট্রিক লক্ষ্মীনাথকে খারাপ পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু মিঃ ডেভেন পোর্ট নামে ওভারসিয়ার দাখিল করা রিপোর্টে এটা প্রমাণিত হল যে লক্ষ্মীনাথ তার কাজ ভালোভাবেই করছেন- তার জন্য কার্ক র্পেট্রিক ১০০ টাকা ইনক্রিমেন্ট দিয়ে লক্ষ্মীনাথের বেতন ৫০০ টাকায় বৃদ্ধি করলেন।
কিন্তু সুখ নিরবিচ্ছিন্ন হয় না। সাধারণ একটা ঘটনা কখনও অসাধারণ দুঃখ কষ্টের কারণ হতে পারে। ঘর সংসার আরম্ভ করার পর থেকে লক্ষ্মীনাথের ঘরে পোষা জন্তু জানোয়ার থাকেই। প্রতিদিন ২-৩ বার করে দানা পানি দেওয়া, অসুস্থ হলে ঔষধ খাইয়ে লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞা যত্ন নেয়। পোষা জীব গুলির মধ্যে বিড়াল দুটির নাম মিনি এবং মিকা। পাখিটার নাম ভৃঙ্গরাজ। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ খুব জোরে একটা চিৎকার করে দি ব্লেকি মারা গেল। অনেক বছরের সঙ্গী কুকুরটিকে হারিয়ে লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞা খুবই দুঃখ পেল। তার পরে সেরকমই একটি দুর্ঘটনা ঘটল একই বছরের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। সুরভি যখন ছয় মাসের শিশু কখন লক্ষ্মীনাথ চিৎপুর হাট থেকে একটা টিয়া পাখি কিনে এনেছিলেন। প্রজ্ঞা পাখিটার ভৃঙ্গরাজ নাম রেখে তাকে রাধা কৃষ্ণ ডাকতে শিখিয়েছিল। কেউ কাছে গেলেই খাঁচায় থাকা পাখিটা ভৃঙ্গরাজ ‘রাধা কৃষ্ণ’বলে ডেকে উঠত। কলকাতায় কয়েকবার বাড়ি বদলেছে,কলকাতা থেকে সম্বলপুরে এসেছে। ভৃঙ্গরাজও তাদের সঙ্গে এল। এভাবে ভৃঙ্গরাজের বয়স ২৭ বছর হল কিন্তু অক্টোবরের ৯ তারিখ বিষাক্ত পোকার কামড়ে তার মৃত্যু হল। বুড়ো ভৃঙ্গরাজের নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের হৃদয় যন্ত্রণায় মথিত হয়ে পড়ল। তার আত্মার শান্তি কামনা করে তিনি তাকে বিদায় দিলেন।
এদিকে লক্ষ্মীনাথ খবর পেলেন ভোলানাথের শারীরিক অবস্থাটা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। এক সপ্তাহের চেয়ে বেশি কোথাও না থাকা মানুষটা এখন গৃহবন্দী। তিনি আর ব্যবসা-বাণিজ্য দেখেন না। দেখেন না মানে দেখার শক্তি নেই। একদিন সকালবেলা লক্ষীনাথ ভোলানাথকে দেখে এলেন। শয্যায় পড়ে মানুষটা প্রলাপ বকছে। স্মরণ শক্তি হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা।লক্ষীনাথের দিকে তাকিয়ে প্রথমে চিনতে পারলেন না। পরে চিনতে পেরে ভোলানাথের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন –
‘বেজ ,বেজ তুমি এসেছ—কত দিন তোমাকে দেখিনি। এতদিন কোথায় ছিলে? তুমি আমাকে কেন দেখতে আসনি?’
লক্ষ্মীনাথ কী বলবেন? ভোলানাথের দিকে একবার তাকিয়ে তার মুখে কোনো কথা জোগাল না। তিনি বুঝতে পারলেন যে ভোলানাথের জীবন শেষ হয়ে আসছে। তথাপি তিনি পরমেশ্বরের কাছে ভোলানাথের আশু আরোগ্য কামনা করলেন।
বিপদ থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করার পরেও বিপদ পেছন ছাড়ে না। একসময় শিকার করতেন। সেটা ছিল এক ধরনের উন্মাদনা। শিকারে গিয়ে জন্তু-জানোয়ারকে গুলি করে হত্যা করতেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে সেটাও একটি অন্য বিষয়। এমনিতে লক্ষ্মীনাথ জন্তু-জানোয়ারকে ভালোবাসেন। তথাপি তাকে একটা জানোয়ারের হিংসার শিকার হতে হল।
লক্ষীনাথ ঝাড়চোগোড়ার নগেন চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছিলেন ।তখন সকাল ছটা বেজেছে।গলির মধ্যে ঘুরে বেড়ানো একটা কুকুর দৌড়ে এসে লক্ষ্মীনাথের পায়ে কামড়ে রক্ত বের করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাছাকাছি একটা ফার্মসিতে গেলেন। ফার্মেসির কম্পাউন্ডার ক্ষতস্থান আয়োডিন দিয়ে ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন ।পরের দিন সম্বলপুরে এসে একজন ডাক্তারকে দেখালেন।
ডাক্তার কুকুরে কামড়ানোর চিকিৎসা হিসেবে সাত দিনের জন্য ট্যাবলেট খেতে দিলেন।কিন্তু পরের দিন বিকেলে লক্ষ্মীনাথের অবস্থাট খারাপ হয়ে পড়ল। তিনি খেতে পারছেন না। এখন কুকুরে কামড়ানোর নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা হয় অসমের শিলঙে। শুভার্থীরা দ্রুত লক্ষ্মীনাথকে শিলং যেতে পরামর্শ দিলেন। সেই কথায় প্রজ্ঞাও জোর দিল। অবশেষে লক্ষ্মীনাথ শিলং যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। দুই মেয়ে দীপিকা এবং চাকর আদিকে নিয়ে কলকাতায় এসে রত্নার সঙ্গে দেখা করলেন। রত্নাও শিলং যাবার জন্য প্রস্তুত হল। ওদেরকে নিয়ে হাওড়া থেকে মেইল ট্রেনে লক্ষ্মীনাথ অসমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
পরের দিন পান্ডু ঘাটে জ্ঞানদাভিরাম এসে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু তিনি এখন জলাতঙ্কের রোগি। দ্রুত চিকিৎসা আরম্ভ না করলে ভয়ঙ্কর জলাতঙ্কে আক্রান্ত হবেন। তাই একদিনের জন্য সময় নষ্ট না করে লক্ষ্মীনাথ সেদিনই শেষ বাসে শিলংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
বর্ষার সময় নয় যদিও শিলঙে এখন বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে কাদা হয়ে রাত সাড়ে সাতটার সময় মিস্টার মজিদের ঘর 'গুলেস্থানে' পৌঁছালেন।মিঃ মজিদের জনপ্রিয় কন্যা মিসেস রহমানের আদর আপ্যায়ন আন্তরিক। মিসেস রহমান রত্না–দীপিকা সহ লক্ষ্মীনাথকে নিয়ে 'বথ-ওয়েল' হাউসে থাকতে দিলেন। এই হাউসের ঘরগুলি বড়োসড়ো। খাবার ব্যবস্থাও ভালো। রাতের বেলা খেতে বসার পরে মিসেস রহমান বললেন,' আপনি বোধ হয় জানেন, শিলঙে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এলে—।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!' কুকুরে কামড়ানোর যন্ত্রণা ভুলে লক্ষ্মীনাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লেন,' রবি কাকা!'
' হ্যাঁ ,তিনি এসেছেন বেশ কিছুদিন হয়।
' কোথায় আছেন তিনি?'
' জিৎ-ভূমিতে।']
সকালবেলার চা খেয়ে একটা টেক্সি ডেকে এনে রত্না দীপিকাকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ জিৎ-ভূমি হাউসে উপস্থিত হলেন।
পাহাড়ের গায়ে পূব এবং দক্ষিণ খোলা কিছু পাকা, কিছু কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা সুদৃশ্য বাংলোয় পাহাড় প্রেমিক কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ অবস্থান করছেন। নোবেল পুরস্কার লাভের পরে বহু দেশ থেকে কবির কাছে আমন্ত্রণ এসেছিল। কিন্তু শান্তিনিকেতনকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেবার পরে কর্মব্যস্ততার জন্য তিনি সেই সমস্ত নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। অবশেষে গত দুই মাস ইউরোপ এবং আমেরিকা ভ্রমণ করলেন। বিদেশ থেকে আসার পরে কিছুদিন শান্তিনিকেতনে থেকে গ্রীষ্মকাল কাটানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ শিলঙে এসেছেন। তিনি আগেও একবার অসম এসেছিলেন। তখন অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাই গুয়াহাটি আৰ্ল ল কলেজের অধ্যক্ষ জ্ঞানদাভিরাম বরুয়ার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন। সেখানে দিন চারেক থেকে সেখান থেকে শিলং এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেখানেই যাক না কেন, তার সৃষ্টির ধারা অব্যাহত থাকে। শিলং বেড়াতে এসে এর সরলবর্গীয় পাইন, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি সবুজ গাছপালার অপরূপ দৃশ্যের সঙ্গে গুঞ্জরিত ঝর্ণাগুলি কবির সৃষ্টিশীল সত্তাকে আর ও সক্রিয় করে তোলে।
জিৎ-ভূমির বাংলোটার বাইরে বিশাল বারান্দায় বসে রবীন্দ্রনাথ নিজের সৃষ্টিকর্মে মগ্ন। এখন তার বয়স ৬২ বছর। নির্বাচিত তরকারিতে খাদ্যাভ্যাস, শরীর চর্চার সঙ্গে যোগাসন, বিকেলে ভ্রমণ….
সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিতে শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রাত্যহিক জীবনের জন্য রবীন্দ্রনাথ এখনও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কিন্তু দীর্ঘ চুল এবং বুক পর্যন্ত বিস্তারিত দাড়ি পাকতে শুরু করেছে।
বাংলোটার সামনে সুন্দর পোশাক পরা রূপসী মেয়ে দুটিকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ ট্যাক্সি থেকে নামলেন।
টেক্সি দাঁড়ানোর শব্দ শুনে ঢিলা আলখাল্লা পরিহিত রবীন্দ্রনাথ মাথা তুলে এদিকে ওদিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্লিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে লক্ষ্মীনাথকে আদর করে জড়িয়ে ধরলেন।
লক্ষ্মীনাথ কাকা শ্বশুরের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। রত্না দীপিকা প্রণাম করতে যেতেই প্রশস্ত দুই হাতে রবীন্দ্রনাথ ওদের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর করে চুমু খেলেন। রত্না- দীপিকা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নাতনি। স্বভাবসুলভ রঙ্গ রসিকতায় কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে রবীন্দ্রনাথ তাদের অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর লক্ষ্মীনাথকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে নিজেও বসলেন।
অসমিয়া এবং বাংলা ভাষা সাহিত্যের দুই আলোক দীপ্ত পুরুষ। স্বধর্ম ,ঐতিহ্যময় অতীত সংস্কৃতির পরম্পরা রক্ষা করে জাতীয় চেতনা, স্বদেশানুরা্গ, স্বকীয় সৃষ্টি প্রতিভার ঐশ্বরিক গুনে তারা এখন নিজের নিজের জাতির মানসপুরুষ। তারা যে আজ এভাবে হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা, শিলং নগরের নৈসর্গিক এই পরিবেশে সামনাসামনি হয়ে বসেছেন—এটা এক অসাধারণ সংযোগ। অসমিয়া বাঙালির জন্য সত্যিই এক ঐতিহাসিক ক্ষণ।
এক সময়ে অসমিয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কাকাশ্বশুর এবং জামাইয়ের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল। ভাষা সাহিত্যের ঐতিহাসিক চেতনা সমৃদ্ধ লক্ষ্মীনাথের সবল যুক্তির কাছে নতিস্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতো অসমিয়া ভাষার প্রাচীনত্বকে মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছেন এবং লক্ষ্মীনাথ যেভাবে নিজের মাতৃভাষার সেবা করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ মুক্ত কণ্ঠে তার প্রশংসা করেছেন। তার জন্য এখন দুজনের সম্পর্কটা সৌহার্দ্যপূর্ণ।
লক্ষ্মীনাথ শিলং আসার উদ্দেশ্যটা ব্যক্ত করলেন। তাকে কুকুর কামড়েছে জেনে রবীন্দ্রনাথ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। নিজে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হয়েও তিনি অনতিবিলম্বে সম্ভব হলে আজকেই একমাত্র শিলঙে সুলভ কুকুরে কামড়ানোর প্রতিষেধক ইঞ্জেকশন নেবার জন্য উপদেশ দিলেন।
তারপরে তাদের আলোচনায় পারিবারিক কথাবার্তা উঠে এল। অরুণার বিয়েতে আসতে না পারার জন্য রবীন্দ্রনাথ দুঃখ প্রকাশ করলেন। জামাই সত্যব্রত মুখার্জির কথা শুনে তিনি আনন্দিত হলেন। তখনই লক্ষ্মীনাথ জানাল যে অরুণা ইতিমধ্যে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এইবার রবীন্দ্রনাথের আনন্দ আরও বাড়ল। তিনি বললেন যে প্রজ্ঞাকে বিয়ে করে লক্ষ্মীনাথ যেভাবে ভালোবাসার বন্ধনে সুসমন্বয়িত গার্হস্থ জীবনযাপন করছেন, অরুণার নারীসুলভ গুণের জন্য সত্যব্রতও সেরকম একটি সুন্দর জীবন লাভ করে সুখী হবে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্মীনাথ এরকম দুজন ব্যক্তি যে তাদের কর্মকাণ্ড কেবলমাত্র পারিবারিক ঘটনা ক্রমের মধ্যে আবদ্ধ নয়। দুজনেই অসামান্য সৃষ্টি প্রতিভার অধিকারী। বুদ্ধি জ্ঞানের সঙ্গে দুজনেই অভিজ্ঞতায় প্রবীণ। দুজনেরই মানস-জগতে খেলা করতে থাকে নতুন নতুন সৃষ্টিকর্মের পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণের জন্য মগজে চলতে থাকে চিন্তন মনন এবং মানস জগতে রূপ লাভ করা পরিকল্পনার সফল প্রকাশের প্রচেষ্টা। আর সেটাতেই তাদের আনন্দ। তার জন্য দেশ সমাজে ঘটা ঘটনাগুলি নিয়ে তারা সচেতন।
লক্ষ্মীনাথ রাজনীতি পছন্দ করেন না। অন্তরঙ্গ না হলে কারও সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু রাজনীতি না করেও কাকাশ্বশুর রবীন্দ্রনাথ যে দেশের ব্রিটিশ শাসনের জনবিরোধী কর্ম এবং নীতির সমালোচনা এবং প্রতিবাদ করেন, সেটা লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগে।
'কাকাবাবু, ১৯১৯ সনের ১৩ এপ্রিল তারিখ পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে শান্তিপূর্ণ জনতার উপরে জেনারেল ডায়ার গুলি বর্ষন করায় আপনি নাইট উপাধিটা ত্যাগ করলেন—তারপর ব্রিটিশের সঙ্গে আপনার রিলেশনটা কেমন চলছে?’
লক্ষ্মীনাথের প্রশ্নটা শুনে রবীন্দ্রনাথ গম্ভীর হলেন। চোখে ফিতা লাগানো গোলাকার চশমা জোড়া খুলে হাতে নিয়ে বললেন,' লক্ষ্মীনাথ, শুধু বেঙ্গল নয়, সমগ্র ভারতবর্ষেই এখন একটা জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। সাউথ আফ্রিকা থেকে মিঃ গান্ধী আসার পর সেটা একটা বড়ো ধরনের আন্দোলনের রূপ নিয়েছে।মিঃগান্ধী অহিংসা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে আমাদের মতো কবি সাহিত্যিককে ওদের পক্ষীয় করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ওই নাইট উপাধিটা দিয়েছিল। কিন্তু কোনো কবি সাহিত্যিক কি সাহেবদের মানবতার বিরোধী কাজকে সমর্থন করবে? করতে পারে? না, পারে না।'
'না বলছিলাম কি, নাইট উপাধিটা ত্যাগ করার জন্য ব্রিটিশরা কি আপনার বিরুদ্ধে আক্রোশ মূলক মনোভাব—।'
' আরে লক্ষ্মীনাথ, আমার নামের পেছনে যে সুইডিস একাডেমির নোবেল পুরস্কারের তকমা লেগেছে।' লক্ষ্মীনাথকে শেষ করতে না দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন,' সেরকম কিছু করলে ইউরোপ আমেরিকায় ব্রিটিশের ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে যাবে যে। তাই নাইট উপাধিটা ত্যাগ করায় ওদের আঁতে ঘা লাগলেও আমার বিরুদ্ধে কিছু করতে সাহস পাচ্ছে না।'
' কাকাবাবু, জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা কেমন দেখছেন?'
মিঃগান্ধীর নেতৃত্বের উপর আমার ভরসা আছে। ওর নেতৃত্বের উপরে দেশের মানুষের যেরকম আস্থা‐ বিশ্বাস দেখছি মনে হচ্ছে তিনি ভারতবর্ষের মুক্তি কামী মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারবেন।'
' আপনি তো ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে এলেন। তার আগে জাপান ভ্রমণ করলেন। ওখানকার দৃশ্যপট কেমন?'
' দেখ লক্ষীনাথ। জাপানিরা দেশভক্ত। খুবই কর্মপটু। ওদের আরও একটা জিনিস আমার ভালো লাগল। সেটা হল, ওরা খুবই ধর্মভীরু। ভগবান বুদ্ধের কাছে সমর্পিত। আমাদের দেশবাসীর জাপানিদের থেকে এসব শেখবার আছে। তারপর ইউরোপ আমেরিকার কথা বললেন— না লক্ষীনাথ, বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রচুর বিকাশ হওয়ায় ওদের বৈভব প্রাচুর্য আকর্ষণীয় হলেও ওরা বড়ই যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ইউরোপের ব্রিটিশ, ফ্রান্স, জার্মা্ন, পর্তুগিজদের আমাদের এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো নিজেদের দখলে এনে উপনিবেশ করার যেরকম আগ্রাসি তৎপরতা— খুবই ভয়াবহ। আমার তো মনে হচ্ছে আবার একটা বিশ্বযুদ্ধ লাগবে।'
সকালে ঘুম থেকে উঠে রবীন্দ্রনাথ বড় একটি গ্লাসে নিম পাতার রস পান করেন তারপরে প্রাতঃকৃত্য করে স্নান করে যোগব্যায়াম, ধ্যান, ব্রহ্মোপাসনা। উপাসনার পরে স্বল্প আহার পানীয় গ্রহণ করে সৃষ্টিকর্ম।। তারপরে তাকে লেখা চিঠিপত্রের উত্তর লেখা। লক্ষীনাথ এরকম সময়ে এখানে এসেছিলেন। এতক্ষন কথা বার্তা হওয়ার পরে সকালের আহারের সময় হল। ভেতর থেকে বয়স্ক পরিচারিকা একজন তাদেরকে খাবার জন্য ডাকলেন ।
সকালের জলখাবার যদিও ভাইঝির জামাই লক্ষ্মীনাথের সম্মানে আয়োজন আড়ম্বরপূর্ণ। ফুলকো লুচি, পটলের দোলমা, আমের আচার, তিন ধরনের মিষ্টি এবং মালভোগ কলার সঙ্গে কিছু ফল। ভেতরে এসে ডাইনিং টেবিলে বসতে গিয়ে দেখলেন রত্না এবং দীপিকা ইতিমধ্যে খাবার শুরু করেছে। পরিহাস প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ‘তোরা দেখছি আমাদের আগেই সব খেয়ে ফেললি’ বলে আরও একবার রঙ্গ করে লক্ষ্মীনাথকে খাবার জন্য অনুরোধ করলেন।
উপাদেয় খাদ্য ।লক্ষ্মীনাথ ভোজন রসিক।রন্ধন বিদ্যায় পারদর্শিনী প্রজ্ঞার জন্য তার খাবার রসনা আরও বেড়েছে। ভোজনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের রুচিও কম নয়। দুই ভাষার দুই সাহিত্যরথী শ্বশুর জামাই মুখোমুখি বসে খেতে লাগলেন।
‘ লক্ষ্মীনাথ তোমার লেখালেখির ব্যাপারটা কেমন চলছে?’
রবীন্দ্রনাথ যে এই ধরনের একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন, লক্ষ্মীনাথ ভেবে রেখেছিলেন। তিনি বললেন, ‘কাকাবাবু আমি তো আর আপনার মতো স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় উদ্দীপ্ত কবি বা সাহিত্যিক নই। সব সময় সমান গতিতে লিখতে পারি না। আর হাওড়ার লরেলসে থাকার সময় যেভাবে লিখছিলাম বা লেখা নিয়ে যেরকম পরিকল্পনা করতে পারতাম, সম্বলপুরে আসার পর সেটা হয়ে উঠছে না।’
‘ না, লক্ষ্মীনাথ এটা ঠিক হচ্ছেনা।। লুচি খাওয়া থেকে বিরত হয়ে অনুশাসন করার সুরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমি প্রজ্ঞার থেকে শুনেছি, ‘আসামী’ জাতির জাগরনের ক্ষেত্রে তোমার লেখাগুলো খুবই অনুপ্রেরণামূলক। তুমিও তোমার সৃষ্টির দ্বারা জাতির স্বাধীনতাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করছ।এভাবে ভারতবর্ষের প্রত্যেক প্রদেশের প্রত্যেকটি জাতি জাগ্রত হয়ে উঠলে ভারতমাতা আবার জগত সভায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে । তাই তুমি লেখা ছাড়বে না। যে কোনো অবস্থাতে নিজের সৃষ্টিকর্ম অব্যাহত রাখবে। রবীন্দ্রনাথের উপদেশ লক্ষ্মীনাথের কাছে আশীর্বাদ। ইতিমধ্যে লক্ষ্মীনাথের আহার শেষ হয়ে এসেছে।তার দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘লক্ষ্মীনাথ তুমি কতটুকু খেলে বলতো? আর দুখানা লুচি নাও। ওহে পঞ্চুর মা আমাদের জামাই বাবাজীবনকে আরও দুখানা লুচি আর মিষ্টি দাও তো—।’
না কাকাবাবু, আমার পেট ভরে গেছে। লক্ষ্মীনাথ বললেন, ‘আমি আর খেতে পারব না।’
‘ সে কি! তুমি জামাই মানুষ। শ্বশুর বাড়ি এসেছ। এত কম খেলে কি হয়?’
‘ আমি তো আজকের জামাই নই। আমার এখন বয়স হয়েছে। জামাই হিসেবে আমি পুরোনো হয়ে গেছি।’
কপট ধমক দেবার সুরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, কী বলছ হে লক্ষ্মীনাথ, জামাইয়ের কি কখনও বয়স বাড়ে? তাছাড়া শ্বশুরবাড়িতে জামাই কোনোদিন পুরোনা হয় না। খাওতো—লুচি না খেলেও সন্দেশ খাও।শিলঙের সন্দেশগুলি মন্দ নয়।
লক্ষ্মীনাথ বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী কাকাশ্বশুর রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসাকে অবহেলা করতে পারলেন না। তাকে আরও একটি সন্দেশ খেতে হল। তারপরে রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্মীনাথ কে নিয়ে পুনরায় বাইরের বারান্দায় এসে বসলেন।
ইতিমধ্যে পাহাড়ের গায়ে নির্মাণ করা ছোটো বড়ো বাড়ির উপরে সূর্যের কিরণ পড়ায় পরিবেশটা মনোরম হয়ে উঠেছে। সঙ্গে ফুরফুরে বাতাস বয়ে যাবার ফলে আবহাওয়াটা সুন্দর হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের উপর দিয়ে তুলোর মতো পাতলা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তাকে লক্ষ্য করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কাকাবাবু,এখন আপনি কি লিখছেন?’
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কী আর লিখব বল,তোমরাই তো অসমিয়া ভাষার স্বতন্ত্রতা নিয়ে সংগ্রাম করে বাংলা ভাষার পাঠকের সংখ্যা কমিয়ে দিলে।তার জন্যই এখন আর লেখাতে তেমন উৎসাহ পাই না।’
এটা কী বললেন? বিশ্ববরেণ্য কবির মুখ দিয়ে এটা কি কথা উচ্চারিত হল? অসমিয়া বাংলা ভাষার উপভাষা নয়, অসমিয়া গদ্য বাংলা গদ্য সাহিত্যের চেয়ে পুরোনো এই সমস্ত স্বীকার করার পরও রবীন্দ্রনাথের মুখে এই ধরনের কথা। লক্ষ্মীনাথের মাথাটা গরম হয়ে উঠল। তার প্রতিবাদী সত্তা জেগে উঠল। পরে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথের সেই অনুযোগের সঙ্গে কিছুটা চাপা ক্ষোভ মিশ্রিত হয়েছিল।ছিল গ্লানিদায়ক এক যন্ত্রণা। তাই কোনো কিছু না বলে লক্ষ্মীনাথ নীরবতা অবলম্বন করলেন।
‘ তথাপি বুঝলে লক্ষ্মীনাথ, আমার কলম থেমে থাকে নি। আমার কলম থামেনা। মানে শব্দ, শব্দের সারিগুলো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। লক্ষ্মীনাথের নীরবতায় গুরুত্ব না দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলে গেলেন,পাশ্চাত্ত্যের দেশগুলি ভ্রমণ করার সময় রাষ্ট্রপ্রধানদের যে ধনলিপ্সা দেখেছি তারই প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা ‘যক্ষপুরী’ নাটক। লেখার পরে মনে হল যক্ষপুরী নামটা ঠিক হল না। তাই ভেবেছি ওই নামটা পাল্টে ‘রক্তকরবী’ রাখব। লক্ষ্মীনাথ ‘রক্তকরবী’ নামটা কেমন হবে বল দেখি?
কিছুক্ষণ আগে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যের জন্য মন খারাপ করা লক্ষ্মীনাথের মনোভাব পরিবর্তিত হল। আসলে ,কাব্য ভাবে রবীন্দ্রনাথ বলা কথাগুলির ব্যঞ্জনা গুলি আলাদা ।লক্ষ্মীনাথ বললেন, অতি সুন্দর। সত্যি, রক্তকরবী ভীষণ অর্থব্যঞ্জক নাম।'
'শিলঙের উঁচু নিচু রাস্তার পাশেই ফুলে ফুলে হাসতে থাকা রক্তকরবীর গাছগুলি দেখে এই নামটা মনে এল।' আত্মতৃপ্তির ভাব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন,' তারপর শিলঙের পটভূমিতে একটা রোমান্টিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেছি। ভেবেছি উপন্যাসটার নাম দেব 'শেষের কবিতা।' যাক ,অনেকদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা—অনেক কথা হল। আরও কথা হবে। এদিকে বেলা যে এগারোটা বেজে গেল। তোমার এখন কুকুরের কামড়ের চিকিৎসাটা আর্জেন্ট। তুমি তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট শুরু কর। যাও এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যাও—।'
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাকাশ্বশুর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সারগর্ভ আলোচনা করার দিনেই প্যাসিওর ইনস্টিটিউটে এসে কুকুরে কামড়ানোর পরীক্ষা করার জন্য ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললেন। ভালো করে পরীক্ষা করে ডাক্তার প্রতিদিন দুটো করে ১৪ টা ইনজেকশন দিতে বললেন। সেদিনই দুটো করে ইঞ্জেকশন নিয়ে লক্ষ্মীনাথ চিকিৎসা শুরু করলেন।
এদিকে গুয়াহাটি থেকে বাসে আসার দিন রত্না বৃষ্টিতে ভিজেছিল। পরের দিন তার জ্বর হল। মেয়েদের কারও কিছু হলেই লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে পড়েন। সামান্য কিছু একটাতে কষ্ট পেলেই লক্ষ্মীনাথ সহ্য করতে পারেন না।জ্বরে কাঁপতে থাকা রত্নাকে নিয়ে তিনি শিলঙের ডাক্তার জি এম বসুকে দেখিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। তার ঔষধে কাজ না হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ নিজের সঙ্গে রাখা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দিলেন। তার জন্য যে ধৈর্যের প্রয়োজন সেই ধৈর্য লক্ষ্মীনাথের নেই। তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলার জন্য আবার ডাক্তার পরিবর্তন করলেন। তখন স্বনামধন্য ডাক্তার বিধান রায় শিলঙে। তাকে ডেকে নিয়ে রত্নাকে দেখালেন। তিনি রত্নার জিভ দেখে টাইফয়েড হয়েছে বললেন।লক্ষ্মী নাথের অস্থিরতা বেড়ে গেল। টাইফয়েডের নিরাময়ের জন্য দীর্ঘকালীন চিকিৎসার প্রয়োজন।
এদিকে রত্না কোনো কিছু খায় না। মাথায় অসহ্য ব্যথা, রাতে ঘুমোতে পারে না। দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরে ‘মা মা’ বলে চিৎকার করে। মেয়ের কষ্ট দেখে লক্ষ্মীনাথ দিশাহারা হয়ে পড়লেন। এত চিকিৎসা করার পরেও রত্না সুস্থ হচ্ছে না। লক্ষীনাথ নিজেকে অক্ষম পিতা বলে অনুভব করলেন। অবশেষে তিনি প্রজ্ঞার কাছে টেলিগ্রাম করলেন। তা বলে টেলিগ্রাম করে লক্ষ্মীনাথ চুপ করে রইলেন না। কুকুরে কামড়ানোর চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন নাভির নিচে দুটো করে ইঞ্জেকশন নেন। ইঞ্জেকশন নেওয়ার পরে সুপরির মতো জায়গাটা উঁচু হয়ে ওঠে। অসহ্য সেই ব্যথা নিয়েও পরের দিন লক্ষ্মীনাথ লিংডো নামে একজন খাসিয়া ডাক্তারকে ডেকে এনে রত্নাকে দেখিয়ে ডঃ বিধান রায়ের চিকিৎসার কথা বললেন। ডক্টর রায়ের চিকিৎসা ঠিকই আছে বলে তার সেবা যত্নের জন্য একজন নার্সকে রাখার পরামর্শ দিলেন। লক্ষীনাথ সঙ্গে সঙ্গে মাঝ বয়সি মাতৃভাবাপন্ন মিসেস ষ্টিনলিকে নার্স রূপে রাখলেন। টেলিগ্রাম করার তৃতীয় দিন ন্টি বাবুর সঙ্গে প্রজ্ঞা শিলং এসে পৌঁছলেন। ঔষধ, সেবা শুশ্রষা এবং মায়ের যত্নে রত্না সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল।
এদিকে কুকুরে কামড়ানোর ১৪ টা ইনজেকশন নেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মীনাথ অসুস্থ রত্নার সঙ্গে প্রজ্ঞা এবং দীপিকাকে শিলঙে রেখে লক্ষ্মীনাথ গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। দুপুরবেলা বন্ধু চন্দ্রকুমার আগরওয়ালার বাড়িতে এলেন। প্রিয় মাজিউর সঙ্গে দেখা হওয়া মানে হৃদয় মনের সমস্ত দরজা খুলে কথাবার্তা বলা। কিন্তু নিজের এবং মেয়ে রত্নার অসুখের সময় এত কষ্ট পেলেন যে কথাবার্তা বলার শক্তি নাই হয়ে গেল। এদিকে সম্বলপুরে চাকরির কথা আছে। মাজিউর সঙ্গে দুই দিন থাকতে পারলে ভালো হত। যদিও উপায় নেই।পরের দিন লক্ষ্মীনাথ কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
কলকাতায় এসেই খবর পেলেন ভোলানাথের একেবারে অন্তিম অবস্থা। জোড়াসাঁকোতে স্নান করে দুপুর বেলার খাবার খেতে বসলেন। কিন্তু খেতে পারলেন না। ভোলানাথকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে পড়ল। জোড়াসাকো থেকে হাওড়া এসে ডবসন রোডের বাড়ির ওপরের মহলে উঠলেন। ভোলানাথ বিছানায় শুয়ে আছেন। নিশ্চুপ, প্রায় নিঃসার। চোখ দুটিতে অন্তহীন এক শূন্যতা। কাছে গিয়ে লক্ষীনাথ ‘দাদা ও দাদা’ বলে ডাকলেন। চোখের পলক পড়ল যদিও ভোলানাথ লক্ষীনাথকে চিনতে পারলেন না।
লক্ষীনাথের অন্তরে করুণ সুর বেজে উঠল।
নগাঁও শহরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসে অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভোলানাথ কলকাতায় এসেছিলেন।তাঁর ছিল তীক্ষ্ণ ব্যবসায়িক বুদ্ধি। তাছাড়া কথা-বার্তায় মজাদার, মাতৃভাষা অসমিয়া ছাড়া বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি এবং উড়িয়া ভাষায় অনায়াসে কথা বলার দক্ষতা। মানুষের চরিত্র সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের সঙ্গে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য মানুষকে পরিচালিত করায় কৌশলী,চিরকুমার ভোলানাথ পূর্ব ভারতের এক নম্বর কাঠের ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন।কাঠের ব্যাবসার জন্যই কলকাতা,দিল্লি,ঝাড়চোগোড়া ইত্যাদি জায়গায় অফিস ঘর কেনার সঙ্গে তিনি লন্ডনে অফিস খুলে ছিলেন।বিপুল ধন সম্পত্তির অধিকারী হয়ে ভোলানাথ সেইসব নিজের সুখ-ভোগের জন্য কুক্ষিগত করে রাখেননি। তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে অনেক অসমিয়াকে নিয়োগের সুবিধা দেওয়া ছাড়া জাতির উন্নতির জন্য তিনি বহু ধন দান করেছেন। তার ধনসম্পত্তি এবং উদার মনের কথা জানতে পেরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসে অসমিয়া বিভাগ খোলার জন্য তদানীন্তন ভাইস চ্যান্সেলর বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিজে ভোলানাথের সঙ্গে দেখা করে আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলেন। ভোলানাথ অতি আনন্দিত মনে বারো হাজার টাকার চেক স্যার আশুতোষ মুখার্জির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ভোলানাথের আরও একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল অসমে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের জন্য যোরহাট ‘প্রিন্স অফ ওয়েলস’ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার জন্য এক লক্ষ টাকার অনুদান। নিজের নাম না দিয়ে তিনি ‘হিজ হাইনেস দা প্রিন্স অফ ওয়েলসের’ নাম দেওয়ার উদ্দেশ্যটা ছিল ব্রিটিশ সরকার প্রতিষ্ঠানটাকে ভালোভাবে লালন পালন করবে। তাছাড়া তিনি বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমিয়া ছাত্রদের অধ্যয়নের সুবিধা করে দিয়েছিলেন। তার বদান্যতার জন্যই আর্থিক সংকটে পড়া লক্ষ্মীনাথ রচনা করা মহাপুরুষ শংকরদেব এবংমাধব দেব গ্রন্থ ছাপা হয়ে প্রকাশিত হতে পেরেছিল ।একই ধরনে পন্ডিত হেমচন্দ্র গোস্বামী রচনা করা সাহিত্য সম্পর্কে গ্রন্থ কয়টি প্রকাশ করে বের করার জন্য ভোলানাথ আর্থিক অনুদান দিয়েছিলেন। তাছাড়া ভোলানাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের কতবার ভারত ভ্রমণ কালে কত ঘটনা কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা….। পরবর্তী সময়ে কোনো কারনে মনটা অস্থির উন্মনা হয়ে পড়লেই লক্ষীনাথের কাছে এসে ‘বেজ’ অথবা ‘সাহেব’ বলে ডাক দিয়ে মনের সমস্ত জানালা দরজা খুলে কথাবার্তা বলার সঙ্গে পান আহার….।কথাগুলি মনে পড়ছে। স্মৃতিগুলো এতই কাতর করে ফেলল যে লক্ষীনাথের চোখজোড়া সজল হয়ে গেল।
নিঃসার হয়ে পড়া ভোলানাথকে দেখে লক্ষ্মীনাথ ঝাড়চোগোড়ায় এলেন। পরের দিন টেলিগ্রাম এল ভোলানাথ আর ইহ সংসারে নেই। ব্রিটিশ সরকার থেকে কাইজার-ই-হিন্দ সোনার পদক প্রাপ্ত সদাগর ভোলানাথ বরুয়া রাত ২-৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ৩০ মে ১৯২৩ ।লক্ষ্মীনাথ তার দিনলিপিতে লিখলেন,‘এ গ্রেট ম্যান এন্ড মাই ফ্রেন্ড হ্যাজ গণ।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন