পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi
তৃতীয় অধ্যায়, দ্বিতীয় অংশ ।। পাখিদের পাড়া- পড়শী
***/..
আমরা ভারতীয় পর্যটকদের পকেটের দিকে তাকিয়ে হাঁটা মানুষ। ডলারের তুলনায় টাকার মানদণ্ডের দুর্বলতা আমাদের কাছে সত্যিই পরিতাপের। ১৯৪৭ সনে এক টাকা এক ডলারের সমান ছিল। আজ এক ডলারের মান প্রায় ৬৭ টাকা। ৪৭ সনের মতো টাকার মান ডলারের সমান হলে ভারতীয়রা অনায়াসে পর্যটক হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত। লাউসে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আমার মনে প্রথমে ডলারের কথাই এল। হলেও যাব বলে ভাবছি যখন খরচের অংক বেশি করে না করাই ভালো— আমি ভাবলাম।
আমার দেশ আমাকে পৃথিবীর যে কোনো দেশে যাবার অনুমতি পত্র অথবা পারপত্র দিয়েছে।
পারপত্র বের করতে যথেষ্ট পয়সা খরচ করতে হয় এবং অনেক সময় লাগে— বিভিন্ন জন বলা কথার ওপর নির্ভর করে আমারও সেরকম ধারণা ছিল। তবে কথাটা শুদ্ধ নয়। আমি অনলাইনে আবেদন করলাম। প্রয়োজনীয় টাকাও ইব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান করলাম। তারা আমাকে অনলাইনযোগে নির্দিষ্ট দিন তারিখ জানাল। নির্দিষ্ট দিনে আমি গুয়াহাটি পারপত্র কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে আমার তথ্য সমূহ পারপত্র কার্যালয়ে প্রদান করতে হবে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেৰ কাছ থেকে আপত্তিহীনতার প্রমাণপত্র। আমার ব্যাংকের শাখার পরিচালকের থেকে আমি আপত্তিহীনতার প্রমাণপত্র সংগ্রহ করলাম। চাকরি করা ব্যক্তির জন্য এটাই গুরুত্বপূর্ণ নথি। সঙ্গে লাগবে বিভাগীয়ভাবে প্রদান করা পরিচয়পত্রটি। তাছাড়া ভোটার তালিকা, জন্মের প্রমাণপত্র, স্থায়ী নিবাসীর প্রমাণপত্র যাকে আমরা পিআরসি বলি, এই সমস্ত কিছু নিয়ে আমি গুয়াহাটি পারপত্ৰ কার্যালয়ে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হলাম। নির্দিষ্ট সময় মানে অতি নিৰ্দিষ্ট। আমার অনলাইন আবেদনের বিপরীতে তারা আমাকে দেওয়া তথ্য সমূহে সময় ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। সেই নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে নিরাপত্তারক্ষী আবেদনকারীকে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না।
পারপত্র কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে একটা অন্যরকম পরিবেশের সম্মুখীন হলাম। অসমের কোনো কার্যালয়ে না দেখা পরিবেশ। একের পর এক টেবিল অতিক্রম করে গিয়ে তৃতীয় টেবিলটিতে আমার দুটি হাতের ছাপ এবং আলাদা আলাদা প্রত্যেকটি আঙ্গুলের ছাপ নিল। সঙ্গে ক্যামেরা দিয়ে আমার আলোক ছবি গ্রহণ করল। নথিপত্র গুলি ফটোকপি করে আমার মূল নথি গুলি ফিরিয়ে দেওয়ায় আমি জিজ্ঞেস করলাম—আমার হয়ে গেছে নাকি?
— হ্যাঁ। হয়ে গেছে।
আমার সামনে থাকা হৃষ্টপুষ্ট কর্ম তৎপর মেয়েটি বলল।
— পারপত্রটি কবে কীভাবে পাব?
— আপনি আপনার ঠিকানায় ডাকে পেয়ে যাবেন।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটির কথামতোই এক সপ্তাহ পার হতে না হতেই আমি আমার পারপত্রটা লাভ করলাম। পারপত্রের সাদা পৃষ্ঠাগুলি উল্টে উল্টে ভাবলাম— কবে এখানে কোনো দেশের ভিসার মোহর লাগাতে পারব!
সম্ভবত সেই মুহূর্তটি এসে আমার সামনে উপস্থিত হল।
লাউসে ভিসার জন্য অনলাইন আবেদন করা যায়। আমি সেই সুবিধা গ্রহণ করলাম। তিনটি কাজের দিনে তারা ভিসার কাজ করে দেয়। ভিসার জন্য আমাকে টাকার হিসেবে এগারো হাজার ছশো আটানব্বই টাকা পঁচাশি পয়সা দিতে হল। টাকা জমা দেবার পরে কাজ এগুলো এবং আমি লাউস সরকারের কাছ থেকে তাদের দেশে প্রবেশ করার অনুমতিপত্র লাভ করলাম।
এখন আমার সামনে উত্থাপিত প্রশ্নটা হল লাউসের রাজধানী ভিয়েনটিয়েনে কীভাবে যাওয়া যায় । অর্থাৎ কোন পরিবহন ব্যবস্থায়। তার জন্য আমাকে দুটি কথায় মনোযোগ দিতে হল। প্রথম কথা হল কোন পরিবহন ব্যবস্থায় কম খরচে যাওয়া যেতে পারে। আর দ্বিতীয় কথাটা হল সময়। অবশ্য এটা ওটার পরিপূরক। সময় কম লাগলে খরচের মাত্রাও কম হতে দেখা যায়। আমি কলকাতা থেকে ভিয়েনটিয়েনে যাবার সুবিধার বিষয়ে অনুসন্ধান করলাম । তিনটি বিমান পরিবহন সংস্থা কলকাতা থেকে ভিয়েনটিয়েনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। সেগুলি হল চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স, বিমান বাংলাদেশ এবং এয়ার ইন্ডিয়া।
চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের বিমান কলকাতা থেকে কুনমিঙ এবং কুনমিঙ থেকে ভিয়েনটিয়েনে উড়ে যায়। একইভাবে ফেরার পথ আছে ভিয়েনটিয়েন থেকে নানিং, নানিং থেকে কুনমিঙ এবং কুনমিঙ হয়ে কলকাতা। কলকাতা থেকে কুনমিঙে সময় লাগে দুই ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট কুনমিঙ থেকে ভিয়েনটিয়েনে মাত্র ত্ৰিশ মিনিট। অথচ গোটা যাত্রা পথে সময় লাগে বারো ঘন্টা ত্রিশ মিনিট। কারণ হল সকালবেলা পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কুনমিঙ পৌছান আকাশযানটা কুনমিঙ ছাড়ে বিকেল দুটোয়। ফিরে আসতে সময় লাগে তেরো ঘণ্টা পাঁচ মিনিট। বিমানের টিকেটের জন্য খরচ পড়ে ছশো সাত দশমিক নয় এক ডলার অর্থাৎ চল্লিশ হাজার তিনশো উনচল্লিশ টাকা একুশ পয়সা। বিমানটা কলকাতা থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ব্যাংককে যায়। ব্যাংকক থেকে ভিয়েনটিয়েনে যাবার জন্য তারা থাই এয়ারওয়েজের বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেয়। যাবার সময় বিমান পরিবহন ব্যবস্থা সময় নেয় বাইশ ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিট। অবশ্য ফিরে আসার সময় যথেষ্ট কম সময় লাগে। মাত্র সাত ঘন্টা চল্লিশ মিনিট।
খরচের দিক দিয়ে এয়ার ইন্ডিয়াৰ বিমানের রেট অনেকটা বেশি।সাতষট্টি দশমিক শূন্য পাঁচ ডলার। অর্থাৎ একান্ন হাজার একশ আঠাশ টাকা ষোলো পয়সা। তার কারণ আছে। কেননা বিমানটা কলকাতা থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে ব্যাংকক এবং ব্যাংকক থেকে ভিয়েনটিয়েনে যায়। সময় লাগে উনিশ ঘন্টা। এভাবে ফিরে আসে ভিয়েনটিয়েন থেকে ব্যাংকক, ব্যাংকক থেকে দিল্লি এবং দিল্লি থেকে কলকাতা আসে। সময় লাগে কুড়ি ঘন্টা পঁয়ত্ৰিশ মিনিট।
সমস্ত ভেবে শুনে আমি চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের বিমানে ভিয়েনটিয়েনে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।কুনমিঙ এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে হওয়ার সময়টুকুতে চাইনিজ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন মানুষের চাল চলন দেখেই সময় কাটাব এবং বই পড়ব।কুনমিঙেৰ সঙ্গে পরাধীন অসমের ভালো যোগাযোগ ছিল। যোরহাটের ররৈয়া বিমানবন্দর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুনমিঙে নিয়মিত যুদ্ধবিমান এবং মাল বহনকারী বিমান চলাচল করত। সেই স্মৃতি স্মরণ করার জন্য কোনো বিমানবন্দরের অপেক্ষা গৃহ নিশ্চয় উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ভিয়েনটিয়েনে আসা যাওয়া টিকিটের ব্যবস্থা ও হয়ে গেল। তেরো আগস্ট যাত্রা আরম্ভ হবে এবং আঠারো আগস্ট যাত্রার সমাপ্তি ঘটবে। তেৰো থেকে আঠারো আগস্ট পর্যন্ত সরকারি বন্ধ। তাই ষোল থেকে আঠাৰো আগস্ট পর্যন্ত ছুটি নিতে হল। সমস্ত জোগাড় করে এখন যাত্রার দিনটির জন্য আমি অধীর ভাবে অপেক্ষা করছি। বিদেশের মাটিতে পা রাখার সুযোগ লাভ— এই কথাটাই আমাকে আহ্লাদিত করে রেখেছে।
বারো আগস্টের রাতের রাজধানী এক্সপ্রেস উঠে আমি তিনসুকিয়া থেকে গুয়াহাটি পৌছালাম। রেলস্টেশন থেকে সোজাসুজি গোপীনাথ বরদলৈ আন্তরাষ্ট্রীয় বিমানবন্দর। দশটার ইন্ডিগো বিমানে কলকাতা যাত্রার জন্য বিমানের টিকেট, লাওসের টিকেট কাটার দিন একসঙ্গে কেটে রেখেছিলাম। কলকাতা পৌঁছাতে এক ঘন্টার চেয়ে একটু বেশি সময় লাগল। এই এক ঘণ্টা সময় আমি প্রায় ঘুমিয়ে কাটালাম। রাতে ঘুম হয়নি বলে আমার সুন্দর ঘুম হল। বিমানটা টেক অফ করার সময় চাকার ঘর্ষণে আমি জেগে গেলাম।
কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল আমার বন্ধু সুদীপ্ত সে আমার সহপাঠী ছিল সেও ব্যাংকে চাকরি করে যদিও তার আর আমার ব্যাংকের শিরোনাম পৃথক। কলকাতায় যাব বলে তাকে জানানোয় সে বলল যে সেদিন যেহেতু তারও বন্ধ তাই দুপুরের আহার একসঙ্গে করতে চায়। সুদীর্ঘ দিনের বিরতিতে আমার সঙ্গে তার দেখা হবে। মনের মধ্যে ভালো এবং খারাপের মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। তার পরিবার-পরিজন আছে। তার বউ আমি কেন বিয়ে করিনি বলে জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেব সেটা আমি আগেই ঠিক করে রেখেছি। না হলে কখন ও কখন ও বড়ো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার মুখেই সুদীপ্ত আমার জন্য দাঁড়িয়েছিল। সে আমাকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে দিল। আমি তার কাছে দৌড়ে যাবার মত করে গিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা মাটিতে রেখে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। এক মুহূর্তের মধ্যে আমি পড়াশোনা করা বিদ্যালয়টা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে এবার তার হাত দুটি জড়িয়ে ধরলাম।
পরস্পরের খবরা-খবর সাধারণভাবে বিনিময় করে সে আমার ব্যাগটা নেবার ইচ্ছা জানাল।
— আরে ভাই তুই আমার বন্ধুহে, বন্ধু পাঠিয়ে দেওয়া গাড়ির চালক নয়!
একটার দিকে এগিয়ে দেওয়া হাতটা গুটিয়ে নিয়ে সে নির্দিষ্ট একটি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
— তোর গাড়ি?
আমি সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম। মাথা নেড়ে বলল —হ্যাঁ।
— আরে বাবা খুব সুন্দর গাড়ি নিয়েছিস!
আমি তাকে খ্যাপানোর জন্য বললাম। হাতে থাকা রিমোট কন্ট্রোলে গাড়ির দরজা খুলে নিয়ে আমাকে সামনের আসনে বসতে বলল আরক্ষী আটক করা অতি অবাধ্য অপরাধীর মতো আমি গাড়িতে উঠলাম। আমার বেগটা সেই ডিকিতে ভরিয়ে নিল। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে কলকাতা মহানগর বেশ ভালোই দূর। এঁকেবেঁকে বিভিন্ন পথে এসে সে একটা বিশাল মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং এর সামনে এসে দাঁড়াল। তারপরে ডিকি থেকে আমার ব্যাগটা বের করে হাতে নিয়ে সে লিফটের জন্য এগিয়ে এল।
সুদীপ্তের ফ্লাটের বৈঠকখানাটাও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সুগৃহিনীর হাতের স্পর্শে লাবণ্য মধুর। ঘরে ঢুকে আমি চারপাশে চোখ বোলালাম। শীতল এবং মসৃণ কার্পেটে খালি পায়ে হেঁটে কোনো তারাখচিত হোটেলের লনে হাঁটছি বলে মনে হল। আমাদের উপস্থিতির কথা জানতে পেরে সুদীপ্তের ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
— নমস্কার বৌদি।
— নমস্কার।
সুদীপ্তের পত্নী সাবলীল অসমিয়ায় জিজ্ঞেস করলেন— আপনি ভালোভাবে এসেছেন? পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
—হ্যাঁ, কোনোরকম অসুবিধা হয়নি ।ভালোভাবে পৌঁছে গেছি।
আমি সুদীপ্তের স্ত্রীর মুখ থেকে চোখ না সরিয়ে বললাম। সুদীপ্তও কথাটা নিয়ে মজা করছিল।
— এভাবে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছিস যে?
সুদীপ্তের বন্ধুত্ব সুলভ প্রশ্নটি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সুদীপ্তের পত্নীর সামনে নিয়ন্ত্রণ না হারানোর জন্য আমি বললাম— পত্নী বিষয়ক আমার কোনো ধারণা নেই। মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ধারণা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি।
— তবে এর চেয়ে আর বেশি এগোস না।
— সুদীপ্ত তোর পুরোনো স্বভাবের আর বদল হল না।
এক ধরনের গর্জে উঠার মতো বললাম।
— বাঁদর যত বুড়ো হয় তত গাছের উপরে উঠে। আমরা মানুষরা বাঁদরের জাত, তাই বুড়ো হচ্ছি মানে ততই গাছের—
আমি সুদীপ্তকে আর কথা বলার সুযোগ দিতে চাইলাম না। আমাকে কথার সুর বদল করার চেষ্টা করতে দেখে, সে তার পত্নীকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
— এই যে আমার স্ত্রী। একতারা সাহা।
— আমি জিজ্ঞেস করলাম একটা তাঁর নাকি একটা তারা। আচ্ছা এত সুন্দর অসমিয়া বলে যে?
সুদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল— কেন বলবে না? গুয়াহাটির মেয়ে যে।
আপনারা বসুন ,আমি চা নিয়ে আসছি।
সুদীপ্তের স্ত্রী একতারা ভেতরে চলে গেল।
— ছেলেমেয়েরা?
— আমাদের দ্বিতীয় শনিবার বন্ধ, ওদের তো আর বন্ধ নেই।
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
সুদীপ্ত দেখিয়ে দেওয়া অনুসারে আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। বাথরুমটাও বেশ সুন্দর। তারাখচিত হোটেলের বাথরুমের মতো। সুদীপ্তের গাড়ি– বাড়ি দেখে আমি কিন্তু নিজেকে একবারও প্রশ্ন করলাম না— আমি সারা জীবনে কী করলাম? এই প্রশ্নটি কখন ও আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হলে আমি উত্তরটা তৈরি করে রেখেছি— আমি শুরু করেছি মাত্র। এমন একটি কাজ যা দশের উপকার করতে পারে, হিতসাধন করতে পারে।
একতারা এনে দেওয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে আমাদের মধ্যে আরম্ভ হল স্মৃতি রোমন্থন। কোথা থেকে আরম্ভ হয়েছে আমাদের কথা কোথায় শেষ হয় আমরা দুজনে আন্দাজ করতেও পারলাম না। কত কথাই যে আমরা বললাম। সুদীপ্ত তার বিয়ের কথা বলল ।কর্মক্ষেত্রের কথা বলল ।বলল জীবনের বহু উত্থান এবং পতনের বহু অ-কথিত কাহিনি। একতারা আমাদের দুজনের জন্য দুপুরের আহার তৈরি করার সঙ্গে মাঝেমধ্যে এসে দুই পাঁচ মিনিট আমাদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে যায়। মুখে সে কিছুই বলে না, কেবল আমাদের কথা শুনে যায়। একতারার মুখে হাসি আছে দেহের গঠনে আছে লাস্যময় ভঙ্গিমা। সুদীপ্তের কথা আর বলে লাভ নেই, মুখের কোনো লাগাম নেই কখন যে একতরার সামনে কী সব বলে দেবে ভেবে ভয় হয় । ভয় করার কী আছে , আমাকে অপ্রস্তুত অথবা বেকায়দায় ফেলার জন্য সে আগে থেকেই চেষ্টা করে থাকে। কেবল আমি তাকে সুযোগ না দিলেই হল।
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল— উদয় এখনও সময় পার হয়ে যায় নি তুই বিয়ে টিয়ে করলি না, তবে এখন অন্য কোনো বিশেষ কাজে ব্যস্ত আছিস নাকি?
এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে আমার বেশ কিছু সময় লাগল। আমি এক দিক থেকে আদ্যোপান্ত বলে যেতে লাগলাম। আর একতারা গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শুনতে লাগল। আমি বলতে থাকা বিষয় সম্পর্কে সুদীপ্তের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। সেই জন্য সে অনেক কথা বুঝতে পারছিল না এবং আমাকে পরপর প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। আমি তাকে ছোটো ছোটো কথায় জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাম। অনামিকার জীবনে এসে পড়ার দুর্ভাগ্যের প্রতি সে সহানুভূতি প্রকাশ করেও নিজের চরিত্রকে শোধরাতে না পারা সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করতে ভুলল না — মহিলাটিকে দেখতে কেমন ?
একতারা সুদীপ্তের পিঠে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিল। নারীসুলভ সেই অভিব্যক্তিতে কি লুকিয়ে ছিল জানিনা, হয়তো সুদীপ্তের চরিত্রের কিছু ত্রুটি শুধরানোর ব্যর্থ চেষ্টা । আমি সুদীপ্তকে কোনো উত্তর দিইনি। এই ধরনের প্রশ্ন উত্তর দিতে আমি মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি। সুদীপ্ত জানে বলে এরকম প্রশ্ন আমাকে প্ৰায়ই করে ব্যতিব্যস্ত করে আমোদ লাভ করে।
আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দুই চারটি কথা আমি সুদীপ্তকে জানালাম।। সে আমাকে শুভেচ্ছা জানালেও যদিও আমি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেবার ব্যাপারটাকে সে মোটেই সম্মতি জানাল না। তার মতে আমি চাকরি করে থাকা অবস্থাতেই সবার সেবা সমাজ সেবামূলক কাজ গুলি চালিয়ে নেওয়া যুক্তিযুক্ত। আমি সুদীপ্তের মনের ভাবকে সম্মান জানালাম এবং অবশেষে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেব না বলে তাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হল।
তুই যেভাবে নিজের খেয়াল খুশি মতো কাজ করিস তোর কথা বলতে পারি না। তুই হঠাৎ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিবি।তাই তুই আমার কাছে এই ধরনের শপথ খেতে হবে না।
--কোনোমতেই চাকরিটা ছাড়বেন না দাদা।
একতারার কন্ঠে আবদার এবং স্নেহ মিশ্রিত সুর। বহুদিনের পরিচিত কোনো আত্মীয়ের আত্মিক দাবি। অবশেষে আমি পতি পত্নীর কাছে শপথ খেয়ে নিস্তার পেলাম। আমাকে যে মা কালীর নাম উচ্চারণ করে কানে ধরতে হল না, আমি অল্পতেই রক্ষা পেলাম বলে মনে হল।
দুপুর বেলা একতারা অতি তৃপ্তিদায়ক খাবার রান্না করে আমাদের খাওয়াল। সরষে বাটা দিয়ে রান্না করা ইলিশ মাছ, আলু টমেটো দিয়ে রান্না চিতল মাছ এবং লঙ্কা দিয়ে রান্না করা স্থানীয় মুরগির মাংস। জুহা চালের ফুরফুরে গন্ধে ভাত খাওয়া ঘরটা ইতিমধ্যে ভরে উঠেছে।এইসব খাদ্য সম্ভার দিয়ে একবেলা খাওয়া আমার কাছে স্বপ্নেরও অগোচর।
আমরা ভাত খাবার সময় একতারা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসার জন্য বিদ্যালয় গেল।
-- ছেলেমেয়েদের স্কুল কাছে নাকি?
আমি সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম।
না তা নয়। পাঁচ কিলোমিটারের মতো দূরে। গাড়ি নিয়ে যাবে যখন এখনই চলে আসবে।
সুদীপ্তের পত্নী একতারা রান্নাবান্না করে ছেলে মেয়েকে আনতে স্কুলে গেছে ভাব তেই আমার কেমন ভালো লেগে গেল। সুদীপ্ত প্রতিজন স্বামী আকাঙ্ক্ষা করার মতো কর্মদক্ষ সুপত্নী লাভ করেছে। খাওয়া-দাওয়া হওয়ার পরে সুদীপ্ত আমাকে শোবার জন্য বলল।
-- রাতের ফ্লাইটে ঘুম নাও হতে পারে। সেজন্য একটু ঘুমিয়ে নে।
-- দিনে ঘুমালে বরং রাতে ঘুম আসবে না
ফ্লাইটে দেওয়া একটা পেগ খেয়ে নিবি। তবে তুই তো আবার সে স্পর্শ করবি না। যা হওয়ার হবে, একটু রেস্ট নিয়ে নে।
সুদীপ্তকে একটু অবসর দেওয়ার ইচ্ছায় আমি তাকে সম্মতি জানালাম এবং সে দেখিয়ে দেওয়া অতিথির জন্য ব্যবহৃত ঘরটাতে ঢুকে গেলাম। সুদীপ্ত ঘরে থাকা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটির তাপমান ঠিক করে দিল। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল কততে রাখবে। আমি বললাম তোর ইচ্ছা। সে হয়তো ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেখেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে সুদীপ্ত অতি ধীরে ধীরে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে গেল। বিছানাতে শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম এসে পড়ল। আমি বিছানার কাছেই থাকা সেদিনের হিন্দু কাগজটা মেলে ধরলাম এবং মূল খবরটাতে চোখ বোলাতে লাগলাম।
সুদীপ্ত আমাকে যখন জাগিয়ে দিল তখন কলকাতা মহানগরকে রাতের অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। আমি মুখ হাত বেসিনের জলে ধুয়ে বৈঠকখানা ঘরে সুদীপ্তের কাছে বসলাম। একতারা ম্যাগি এবং কফি তৈরি করে সাজিয়ে টেবিলে রেখেছে।দুপুরের ভুরি-ভোজের পরে আমার খুব একটা ক্ষুধা ছিল না।আমি কেবল কফি খেলাম।একতারা আমাকে ম্যাখি খাওয়াবার জন্য খুব চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমি রাজি হলাম না।
সুদীপ্ত বিবিসির কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছে। মূল শীর্ষক খবরের পরে পরিবেশন করছে আবহাওয়ার খবর।
-- চিনে বৃষ্টি হতে পারে। চিনে হলে লাউসেও হবে।
-- হলে হবে। বৃষ্টি দিলে কী আর এমন বড়ো কথা হল ।
চিনের বৃষ্টি নিয়ে সুদীপ্ত আমাকে এরকম একটা পাঠ পড়াতে চেষ্টা করল যেন আমি চিনের বৃষ্টিতে ভেসে গিয়ে সাগরে পড়ব। আমি জানি চিনের বৃষ্টির বদনাম রয়েছে। বৃষ্টি হলে দুর্যোগ না হয়ে থাকে না। পাহাড়ি লাউসে সেরকম হওয়ার আশঙ্কা নেই। আমি সুদীপ্তকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম রাত বারোটা ত্রিশের সময় আমার ফ্লাইটের সিডিউল। এগারোটা ত্রিশে আমাকে বিমানবন্দর পৌঁছাতে হবে। আমি আটটার সময় সুদীপ্তকে বললাম-‘আমার সময় হয়েছে, আমি যাই।’
-- ‘পাগল হয়েছিস নাকি তুই? ভেবেছিস আমি প্লেনের সময় জানি না।ঠিক সময় মতো আমি পৌঁছে দেব তুই মিছামিছি এত ব্যস্ত হয়ে পরিস না।’
সুদীপ্তের কথা শুনে আমি চুপ করে যেতে বাধ্য হলাম, কেননা একতারা সুদীপ্তের চেয়েও বেশি।
‘আপনি রাতের খাবার খেয়ে যাবেন।আমি বাজার করে এনেছি।’
আমি বুঝতেই পারলাম না কোন ফাঁকে একতারা গিয়ে বাজার করে এনেছে ।সুদীপ্ত সত্যিই ভাগ্যবান পুরুষ। ছেলে মেয়েদের স্কুলথেকে আনা, বাজার করে এনে রান্নাবান্না করা ,এই বিদূষী গৃহিণী সমস্ত কাজ নিজেই সমাপন করে। বেশ শক্তিমান এনার্জেটিক।
সুদীপ্ত আমাকে এবার তার ব্যক্তিগত রুমে নিয়ে গেল। বাঃ এত সুন্দর! আমার অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ।তারা চিহ্নিত একটি হোটেলের মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সমস্ত সুবিধা সংলগ্ন ।সে ঘরের শীতাতপ যন্ত্রটিকে নির্দিষ্ট ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ফ্যান চালিয়ে দিল। দুটো সুইচ দেওয়ার পরে ঘরটিতে মসৃণ রঙে সমুজ্জল হয়ে পড়ল। আমি কোনো কল্পনা রাজ্যে বসবাস করা যেন অনুভব করতে লাগলাম।
—তুই সত্যি মদ খাস না?
–উহু।
আমি সজোরে মাথা নাড়লাম।
—মদ খাওয়া মানুষের সঙ্গে বসতে তোর আপত্তি আছে নাকি?
—মোটেও নেই।যদি হে অদরকারী কথাগুলি আবোল-তাবোল ভাবে বকতে শুরু না করিস।
—তুই কি সমস্ত মদ খাওয়া মানুষকে মদ্যপী বলে ভাবিস নাকি?
—ভাবি না বলেই তো বসায় আপত্তি নেই বলে বললাম।
কথা বলতে থাকার মধ্যে সে একটা সেলফ খুলল। সেলফটিতে বিভিন্ন ধরনের কারুকাৰ্য খচিত মদের বোতল। তারই একটা বের করে এনে সে সেলফেই সাজিয়ে ৰাখা বিশেষ জায়গাটিতে রাখল। তারপরে এসে নিচের বড়োসড়ো একটি সেলফ খুলল।আসলে আমি সেলফ বলে ভুল করেছিলাম। সেটি একটি সুন্দর দেখতে ছোট্ট ফ্রিজ। সে ফ্রিজ থেকে জলের বোতল এবং একটি সোডার বোতল বের করে আনল। আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তাকিয়ে থাকলাম। তার বোতল থেকে জল এবং সোডা মেশানোর প্রক্রিয়া দেখতে লাগলাম। মদের গ্লাসটিতে জল ঢালায় সৃষ্টি হওয়া রিমঝিম শব্দ আমাকে বেশ আকর্ষণ করল।
গ্লাসটিতে আলগোছে জড়িয়ে ধরে সুদীপ্ত সেলফগুলির কাছ থেকে এসে আমার সামনে চেয়ারে বসল। একসঙ্গে পড়াশোনা এবং চাকরি করা সুদীপ্তের ঐশ্বর্য দেখে আমি কিছুটা বিমুগ্ধ এবং কিছু পরিমাণে হতচকিত হয়ে পড়লাম। সত্যিই জীবন মানুষকে কীভাবে গড়ে তোলে।মানুষের জীবনটা জলের চেয়েও তরল। যে ধরনের পরিবেশে রাখা যায় জীবনটা তার চেয়েও বেশি সেরকম পরিবেশে নিজেদের গড়ে নেয় ।
গ্লাসে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে সুদীপ্ত নিজের জীবন-বীক্ষা আরম্ভ করল।
—উদয়শংকর কী আছে জীবনটাতে ?কী আছে তুইও বলতে পারিস না ।আমিও পারিনা।
সুদীপ্ত আমার দিকে এভাবে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার মনে হল সে আমার কাছ থেকে উত্তর চাইছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে মৌন হয়ে থাকায় সে পুনরায় বলতে লাগল।
মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবে। পরিবার নিয়ে ছেলেটি চাকরি করে দূরে থাকবে, যেভাবে আমি রয়েছি। কী করব তখন বুড়ো বুড়ি?যান্ত্রিক জীবনের এই পর্যায় আমাদের ইতিমধ্যে সমস্ত আত্মীয় কুটুম্ব থেকে দূরে নিয়ে এসেছে। সুদীপ্ত গ্লাসটাতে একটা দীর্ঘ চুমুক দিল। আমার হাতে উত্তর আছে কিন্তু আমি নিরুত্তর হয়ে রইলাম। সুদীপ্তের চোখে না পড়ার মতো করে আমি মনে মনে হাতের ঘড়িটার দিকে লক্ষ্য করছিলাম যদিও সে দেখতে পেল। তবে সময়ের প্রতি আমার লক্ষ্য করাকে গুরুত্ব দিল না।
-- তুই কিছুই বলছিস না যে?
কী বলব সুদীপ্ত? আমরা একই পৃথিবীতে বসবাস করলেও আমরা দুজন দুটি পৃথক পৃথিবীর বাসিন্দা। আমার ধারণার সঙ্গে তোর ধারণা সম্পূর্ণ পৃথক। আমি সঙ্গী চেয়ে প্রকৃতি এবং মানুষের কাছে যাই। আর তুই, আমার বলার দরকার নে্ই, তুই নিজেই জানিস তোর স্থান আর স্থিতি তোকে যেভাবে গড়ে তুলেছে তুই সেভাবেই গড়ে উঠেছিস। তাই দুঃখ প্রকাশ করে লাভ নেই।আর যদি জীবনের কোনো বাঁকে দাঁড়িয়ে তুই নিজের পথের পরিবর্তন করতে চাস, প্রকৃতি আর মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চাস আমার ফোন নাম্বার তোর কাছে আছে। আমাকে ফোন করিস।
কথার মধ্যে মাঝে মাঝে সুদীপ্ত হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে এবং মাঝেমধ্যে ঐশ্বর্যশালী পৃথিবীর একজন বাসিন্দা হয়ে উল্লসিত হয়ে পড়ে।সুদীপ্ত গ্লাসে দ্বিতীয় পেগ ঢেলে নেয়নি। আমাকে রেখে এসে নাকি আরও দুটি পেগ নেবে একা একা। হতাশা এবং বর্ণহীন নিঃসঙ্গতাতাকে জড়িয়ে ঘুমানো মানে পুনরায় গতানুগতিক একটি দিনের শুরু।
-- চল একতারা ডাকছে।
মোবাইল ফোনটার অনুজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে সুদীপ্ত বলল।
আমি তার এই বাক্যগুলির জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলাম।
ভাত খাওয়ার টেবিলে বিভিন্ন তরকারি এবং একজন মানুষের জন্য একটা থালা সাজানো ছিল। আমি সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে একা খেতে হবে।সে সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল--এই আর কি ।
একা ভাতের থালায় বসতে যাওয়া আমার পক্ষে একটু সংকোচের ছিল। এক তারা আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল-‘ইনি আপনাকে রেখে এসে খাবে।’আমি আগেই বুঝতে পেরেছি যদিও একতারার কথায় আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
--এত কষ্ট করে এতগুলি--
-- কোথায় আর এত রেঁধেছি।
একতারা ঢাকনায় দিয়ে রাখা থালাগালি থেকে একের পরে এক ঢাকনা সরাতে লাগল।
থালাটা সামনে এনে আমি ভাতের থালাটা সাজিয়ে রাখা হাতাটা ভাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। গরম বাসমতি চালের ভাতের গন্ধটা আমার নাকের ভিতরে ঢুকে গেল। মাংস এবং একটু তরকারি ভাতের ওপরে ঢেলে দিলাম। কাজুবাদাম, কিসমিস, মগজ এবং মসলা দিয়ে রান্না পাঁঠার মাংস। গন্ধ এবং স্বাদে মনে হল আমার ক্ষুধা আরও বেড়ে গেছে। শুধু ভাত এবং মাংস নিতে দেখে একতারা পনির, বিন এবং গাজর দিয়ে রান্না করা মিক্সড ভেজ এক হাতা আমার থালার কাছে সাজিয়ে রাখল। অন্য একটি থালা থেকে বেসন গোটা সর্ষে দিয়ে রাঁধা ক্যাপসিকামের বড়া দুটিও খালার ওপরে রাখল। একতারা পুনরায় কিছু দিতে তৈরি হতেই আমি বললাম-- এত পারব না, দেবেন না।
ভালো করে খেলে তবে আপনার ঘুম ভালো ঘুম হবে।গিয়েই ফ্লাইটে শুয়ে পড়বেন। অসুবিধা কোথায়?
একতারার আন্তরিকতাকে বাধা দিতে না পারার জন্য পরিমাণের চেয়েও আমাকে বেশি করে খেতে হল। আমার বাধা না মেনে পুনরায় একহাতা মাংস অবশিষ্ট ভাতের ওপরে জোর করে ঢেলে দিল। ভাতও দিতে চেয়েছিল, হাত দুটি দিয়ে থালাটা ঢেকে ধরে কোনোমতে রক্ষা। নারীর সুলভ আন্তরিকতা একতারা কে আমার সামনে একজন অতিথি পরায়ন সুগৃহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল।স্বামীর বন্ধুকে আপ্যায়ন করায় একতা্তারা কোনো ত্রুটি রাখেনি। এরকম একজন একতারা থাকার পরেও সুদীপ্ত নিঃসঙ্গ।
একতারা এবং তার পরিচ্ছন্ন ঘর থেকে বিদায় নিতে হওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাত্র একটা দিন অথচ এরকম মনে হলো যেন বহু দূর অতীত থেকে রক্ষা করে আসা বছর বছর ধরে রাখা আন্তরিক সম্পর্ক। একতারা বিদায়ের সময় বারবার বলল --আবার আসবেন অনুগ্রহ করে। সম্পর্ক রক্ষা করবেন। ফিরে যাবার সময় পারলে চলে আসবেন।
ফিরে আসার সময় আসা হবে না। আমি দুপুরবেলা কলকাতা পৌছাব আর এক ঘন্টা পরেই আমার গুয়াহাটির জন্য ফ্লাইট। তার মধ্যে সেদিন ব্যাংক খোলা থাকবে। সুদীপ্ত অসম্ভব ব্যস্ত থাকবে।
একতারার কথায় মনে হল সম্ভবত সুদীপ্তের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে আসা আমি একমাত্র ব্যক্তি ।তাই মনের আশ মিটিয়ে একতারা নিজেই বাজার করেছে নিজেই রেঁধেছে এবং নিজেই আপ্যায়ন করেছে। মানুষের হৃদয়ে মনিকোঠায় সম্পর্ক রক্ষার জন্য আকাঙ্ক্ষা সঞ্চিত হয়ে থাকে। সেই আকাঙ্ক্ষাকে অবহেলা করলেই আমরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি আর হতাশাগ্রস্ত।
সুভাষচন্দ্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিদেশ উড়ানের মূল প্রবেশদ্বারে নামিয়ে সুদীপ্ত চলে গেল। যাবার সময় তার দুচোখ জলে ভরে উঠল বলে মনে হল।
-সময় পেলে আসবি। কোথায় আসবি? তোকে আবার জীবনে দেখতে পাব কিনা?
-পাবি। কেন পাবি না। তুই তোর বাড়ি দেখালি আমি একদিন তোকে আমার সমাজটা দেখাব।
ফিরে যাওয়া সুদীপ্তের দিকে অনেকক্ষণ আমি নিরন্তর তাকিয়ে রইলাম।। সে যাবার পরে তবেই আমার বিদেশ ভ্রমণের ঔৎসুক্য শুরু হল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন