হে আমার স্বদেশ- ৪১
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(৪১)
ছাত্র সম্মেলন শেষ হওয়ার পরেও লক্ষ্মীনাথ এক সপ্তাহ গুয়াহাটিতে থাকল।তখন তিনি জিসি ফুকনের সভাপতিত্বে আয়োজিত আসাম কনফারেন্সের সভায় যোগদান করলেন।দুদিন পরে অসমিয়া যুবকরা মঞ্চস্থ করা ‘ভাগ্য পরীক্ষা’নাটক উপভোগ করলেন।এখন অসমিয়া নাটকের কাহিনির বিন্যাস,পরিচালনা এবং অভিনয় আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। লক্ষ্মীনাথ নাটকটির উদ্যোক্তা এবং অভিনেতাদের প্রশংসা করলেন।পরের দুদিনের প্রথম দিন সকালবেলা তরুণরাম ফুকন,জ্ঞানদাভিরাম,লতিকা,প্রজ্ঞা এবং অরুণাদের সঙ্গে নিয়ে নীলাচল পাহাড়ে উঠে কামাখ্যা মন্দির দর্শন করলেন।নতুন বছরের (১৯১৭ সন)প্রথম দিন গুয়াহাটি থেকে কলকাতায় যাত্রা করবেন বলে স্থির করলেন।
যাত্রার দিন সকালবেলা।গুয়াহাটি ঘাট থেকে ছোটো একটা জাহাজে উঠলেন।পরিবারের সঙ্গে বের হওয়া লক্ষ্মীনাথকে আমিনগাঁও রেল স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্য বের হল তরুণরাম ফুকন,জ্ঞানদাভিরাম,লতিকা,এবং আরও কিছু ছাত্র।জাহাজটা ঘাট থেকে ছাড়ার মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে চল্লিশ-এক চল্লিশ বছরের বয়স্ক একজন ছাত্র উঠল।তার হাতে কাগজে ঘেরা একটি পুঁটলি।মানুষটা ধীরে ধীরে লক্ষ্মীনাথের দিকে এগিয়ে এল।কাছে যেতেই লক্ষ্মীনাথ তাকে চিনতে পারলেন।আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে শয্যাশায়ী পিতৃদেবকে দেখে কলকাতায় ফিরে যাবার সময় বি বরুয়া কোম্পানিতে চারমাসের জন্য সপ্তাহে দুদিন করে কেরানির কাজ করা লখিমপুরের সে কুশল দুয়ারা।
কাছে এসেই লক্ষ্মীনাথের পা দুটি স্পর্শ করে প্রণাম করে বিনীতভাবে কুশল জিজ্ঞেস করল,স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘লখিমপুর থেকে আজ সকালে গুয়াহাটি পৌছেছি।আপনি ছাত্র সম্মেলনের সভাপতিরূপে গুয়াহাটিতে আসছেন জানতে পেরে গুয়াহাটি আসব বলে ভেবেছিলাম।সভায় উপস্থিত থেকে আপনার বক্তৃতা শোনার আগ্রহ ছিল।কিন্তু সেদিনই আমার মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল।আসতে পারলাম না।মা সুস্থ হয়ে উঠার পরে জানতে পারলাম ,আপনি এখনও গুয়াহাটিতে আছেন।তাই মা বোনা এটা হাতে নিয়ে আপনাকে প্রণাম জানাতে এলাম।আপনি গুয়াহাটিতে কোথায় আছেন খবরটা নিয়ে প্রিন্সিপাল বরুয়া স্যারের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম যে আপনি কলকাতার জন্য বেরিয়ে পড়েছেন।আমার ভয় হল,আপনার সঙ্গে হয়ত দেখা হবে না।তথাপি দৌড়াদৌড়ি করে জাহাজঘাটে এসে দেখি,আপনার জাহাজ ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।দৌড়ে এসে উঠে পড়লাম।
কুশল হাতের পুঁটলিটা থেকে একটা চেলেং চাদর বের করল। মিহি মুগা কাপড়ের সুন্দর চেলেং চাদর। চাদরটা মেলে লম্বা করে ভাঁজ করে কুশল শ্রদ্ধানতভাবে লক্ষ্মীনাথের গলায় পরিয়ে দিল। তারপর পুনরায় দুই হাত জোর করে নমস্কার করার ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
কুশল লক্ষ্মীনাথের বক্তৃতা শোনার জন্য এবং মা বোনা চেলেং চাদরের দ্বারা তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য লখিমপুর থেকে এত কষ্ট করে গুয়াহাটিতে এসেছে! কুশলের এই আন্তরিক ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা পেয়ে লক্ষ্মীনাথ অভিভূত হয়ে পড়ল। তাকে কাছে বসিয়ে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ আদর করে কুশল বার্তা নিল।
কুশল কলকাতায় বি.এ পড়তে শুরু করেছিল। ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিল। উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে লক্ষ্মীনাথের গোপীকৃষ্ণ লেনের বাড়িতে গিয়েছিল। লক্ষ্মীনাথ কুশলকে সাহায্য করেছিল। প্রতি শনি এবং রবিবার অফিসে এসে সে কিছুদিন কাজ করে নিজে চলতে পারার মতো অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবেই সে বিএ ডিগ্রি নিতে সক্ষম হত। কিন্তু গ্রহণী বেমারে পিতার অকাল মৃত্যু হওয়ায় বি এ পাঠ সম্পূর্ণ না করেই কুশল লক্ষ্মীমপুরে ফিরে আসতে বাধ্য হল। এখন এখন সে গ্রামের স্কুলটির একজন শিক্ষক।
' স্যার, ছোটো বড়োকে কিছু বলতে সাহস করাটা ঠিক নয়।' কিছুক্ষণ পরে কুশল বলল, তবু আপনাকে একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে–।'
ব্রহ্মপুত্রের বুকে ভাসমান জাহাজে বসে লক্ষ্মীনাথ উদাস ভাবে ধীরে ধীরে সরে যাওয়া গুয়াহাটি নগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এভাবে চেয়ে থাকা অবস্থায় লক্ষ্মীনাথ বলল,'বল।'
' কথাটা শুনে খারাপ পাবেন নাকি?'
' পাব না।বল-।'
' আমাদের জন্য, অসমিয়া জাতির জন্য আপনি এত কাজ করেছেন, এখনও করছেন। সবকিছুই কলকাতায় থেকে করছেন। আমাদের মধ্যে থেকে এইসব করলে আমরা আপনার সান্নিধ্য পেতাম, আমরা আরও বেশি উপকৃত হতাম।'
এবার গুহাটিতে এসে গুয়াহাটির জনগণ বিশেষ করে ছাত্রদের থেকে যে স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছেন তাতে অসমের প্রতি লক্ষ্মীনাথের টান আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার জন্য তিনি নিজেই অসমে থাকার কথা ভাবতে শুরু করেছেন। কলকাতায় আধুনিক যুগের সমস্ত উপাদানে জীবন সমৃদ্ধ। কলকাতার বৌদ্ধিক সাংস্কৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ বাতাবরণে থাকার আলাদা আকর্ষণ এবং আনন্দ আছে ।কিন্তু জন্মভূমির পরিচিত পরিবেশে স্বজাতির সঙ্গে থাকার সুখটা সত্যিই আলাদা ।এই সুখের কোনো তুলনা হয় না।
কলকাতায় থেকে লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের সাধনা করে। তার প্রতিটি সাহিত্যকর্মে অসম ,অসমিয়া মানুষ, অসমিয়া- ভাষা সাহিত্য,অসমিয়া জাতীয় জীবনের সজীব চিত্র, মানুষের অন্তরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু দুই আড়াই বছর পরে পরে পনেরো-কুড়ি বেশি হলে দেড় মাস সময়ের জন্য অসমে আসেন। তার বাইরে তিনি স্বদেশ-স্বজাতি থেকে দূরে সরে থাকেন। এভাবে সরে থাকাটা তার কাছে বেদনাদায়ক।কলকাতায় থাকার সময় এই বেদনাটা সদা সর্বদা অনুভূত হয় বলেই সেগুলি তার লেখায় প্রকাশ পায়।এখন কুশল তাকে অসমে থাকার জন্য বলল– কেবল কুশল নয়। তার অসমে থাকাটা স্বর্গবাসী পিতাও চেয়েছিলেন। তার কলকাতায় থাকা নিয়ে দাদাদের মনেও ক্ষোভ রয়েছে। আর এখন, তার সাহিত্যের গুণগ্রাহী অসমের অনেকেই চায়, বাকি জীবনটা অসমে থেকে তিনি অসমিয়া ভাষা সাহিত্য এবং জাতির জন্য কাজ করুন।
' আপনি আমাদের মধ্যে থাকলে আমরা আরও এগোতে পারব। আপনি যদি কলকাতা থেকে এসে অসমে থাকতে শুরু করেন–।'
লক্ষ্মীনাথের মুখটা অসহায় হয়ে পড়ল। কাতর ভাবে প্রথমে ব্রহ্মপুত্রের প্রবহমান জলের দিকে তাকালেন, তাকালেন ছেড়ে আসা ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা উমানন্দ ভৈরবের মন্দিরটার দিকে, তাকালেন গুয়াহাটির ঘরবাড়ি গুলির দিকে, শূন্যতায় ভরা চোখে তাকালেন দূরের নীলাচল পাহাড়ের ওপরের তন্ত্রসাধনার অন্যতম পীঠস্থান কামাখ্যা মন্দিরের দিকে। ওপরের বিশাল নীল আকাশের দিকে তাকালেন। তিনি নিঃশ্বাস নিলেন।বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে শক্তি গোটানোর চেষ্টা করলেন। পারলেন না ।তারপরে এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ জোড়া জলে ভরে এল। লক্ষ্মীনাথ কুশলকে কিছু একটা বলতে চাইলেন কিন্তু তার মুখে কথা ফুটল না।
কলকাতায় এসে পুনরায় আগের জীবন। আবার আগের ব্যস্ততা। বার্ড এণ্ড কোম্পানির চাকরি…। চাকরির জন্যই এক সপ্তাহ অফিস করেই দিল্লি মেইলে বাকিংপুরে যেতে হল। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বাকিংপুর থেকে বক্তিয়ার পুর হয়ে রাজগীরে গেল। সেখান থেকে পুনরায় বাকিংপুর এল। সেখানে দুদিন থেকে গয়ায় এসে ডাক্তার মিত্রের ঘরে অতিথি হলেন। সেদিন ডক্টর মিত্র বাড়িতে ছিলেন না পরের দিন কলকাতা থেকে এসে ডক্টর মিত্র লক্ষীনাথকে সঙ্গে নিয়ে নগর পরিদর্শনে বেরোলেন।… এভাবে ভ্রমণ শেষ করে এসে দুদিন কলকাতায় থেকে লক্ষীনাথ এলাহাবাদ ,বিহারের মুঙ্গের ,জামালপুর ইত্যাদি জায়গা ঘুরে এলেন।
বছরটির প্রথম সাত মাস ভ্রমণ করতেই পার হয়ে গেল। পরিশ্রমের কাজ হলেও খুব একটা খারাপ লাগল না। কোম্পানি থেকে একটা নিরিখে ভ্রমণ বোনাস, হোটেলে থাকা খাওয়ার খরচ পায় সেখান থেকে কিছু টাকা বেঁচে যায়। বেতন ছাড়া এই টাকাটুকু ঘর সংসার চালিয়ে নেওয়ায় কিছুটা সাহায্য করে।
এত ভ্রমণ করলেও লক্ষ্মীনাথের লেখার কাজ বন্ধ থাকে না। ভ্রমণের সময় বেগে নিজের লেখার কাগজপত্রের সঙ্গে 'বাঁহী'র জন্য আসা লেখাগুলোও সঙ্গে নিয়ে যায়। হোটেলে থাকার সময় সেই সব বের করে 'বাঁহী'র জন্য নির্বাচন করা প্রবন্ধ গল্প কবিতার সম্পাদনার কাজ করে। কোম্পানির কাজে ব্যস্ততার মধ্যেও অসমিয়া মাসের প্রথম সপ্তাহে'বাঁহী' ছাপা হয়ে বের হয়।
'বাঁহী'র জনপ্রিয়তা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এখন 'বাঁহী'র কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকার এবং পাঠকরা লক্ষ্মীনাথের জন্য একটি বড়ো পরিবারের মতো হয়ে পড়েছে।'বাঁহী' তার সৃষ্টি চেতনাকে গরিমাময় করে তুলেছে।'বাঁহী'র পাতায় গড়ে ওঠা তরুণ লেখকদের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ অসমের সোনালি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।'বাঁহী'কে নিয়ে সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবেই লক্ষ্মীনাথ নিজের ব্যাবসায়িক ব্যর্থতার যন্ত্রণা এবং ভোলানাথ বরুয়া থেকে প্রাপ্ত অপমানের গ্লানি ভুলে থাকে। আর সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে নিজের সৃষ্টিসত্তার সঙ্গে যে'বাঁহী'কে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন‐- এটাই এখন তার বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান শক্তি এবং আনন্দ হয়ে পড়েছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত পা ধুয়ে লক্ষ্মীনাথ ঠাকুর ঘরে নাম প্রসঙ্গ করতে বসল। অন্যদিনের মতো আজও গুণগুণ করে নাম প্রসঙ্গ করার পরে লক্ষ্মীনাথের মনটা পবিত্রতার বোধে ভরে উঠল। তারপরে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে নিজের পড়ার ঘরে এসে বসল। বৈষ্ণব তত্ত্বকথা পড়তে শুরু করল। কিছুদিন ধরে এসবই পড়ছে। সঙ্গে পড়ছে বেদান্তের সারকথা। এই অধ্যয়নে তাঁর আত্মা শান্তি লাভ করে।
কিছুক্ষণ পড়ার পরে জানালা দিয়ে দেখল, রত্না এবং দীপিকা সামনের ফুলবাগানের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে। প্রভাতের কোমল আলোতে ফুটে থাকা বাগানের ফুল এবং ফুলের মত কোমল রত্না এবং দীপিকার উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর… লক্ষ্মীনাথের মনটা অদ্ভুত এক তৃপ্তিতে ভরে উঠল। তখনই তার মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের একটি বক্তৃতার কথা। বক্তৃতার একটি অংশে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ভগবান দূরে অবস্থান করে না। তিনি আমাদের সঙ্গে থাকেন। তিনি থাকেন ঋতুকালীন ফুলে, তিনি থাকেন সুমিষ্ট ফলে, তিনি থাকেন সুন্দর বিশ্বের অপরূপ নৈসর্গে, তিনি থাকেন অবিশ্রান্ত ধারায় বইতে থাকা বৃষ্টিতে, তিনি থাকেন শারদীয়া রোদের ঝলমলে কিরণে। আমরা আমাদের ভগবানকে কোমল হৃদয়া নারীর ভালোবাসায় অনুভব করি, আমরা ভগবানের অস্তিত্ব বীর্যবান পুরুষের সততা কর্তব্য নিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ করি। আমরা আমাদের ভগবানকে দেখতে পাই নবজাত শিশুর মধ্যে…। নবীন প্রাণ নিয়ে উৎফুল্ল আনন্দে খেলতে থাকা আত্মজা রত্না-দীপিকার দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবে আলোড়িত হয়ে লক্ষ্মীনাথ অপার এক আনন্দলাভ করল। বেশিক্ষণ পড়ল না যদিও ভরপুর তৃপ্তি নিয়ে সে তারপরে অফিসে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।
'কী হল?'ভাতের টেবিলে খেতে বসা লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞা বলল,' আজ যে মহাশয়ের একেবারে আত্মমগ্ন ভাব!'
' আত্মমগ্ন নয় গো। অভূতপূর্ব দিব্যভাব?'
' উৎস?'
' উৎস আমাদের ফুলের বাগানের পাশে খেলাধুলায় মগ্ন তোমার ফুটফুটে দুটি কন্যা রত্ন।'
প্রজ্ঞা কথাটা বুঝতে পারল না। সে অবাক হয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
' বুঝতে পারলে না বুঝি?' মুচকি হেসে লক্ষ্মীনাথ বলল,' আরে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবিকাকার একটি বক্তৃতার কিছু কথা মনে পড়ে গেল। সত্যি রবি কাকার ওই কথাগুলোয় আমি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান ভগবানের মহিমার কথা বুঝতে পারলাম। আজ আমি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলাম আমাদের মহাপুরুষ শংকরদের ঠিক এভাবেই বিশ্ব চরাচরের সব কিছুতে ভগবানের রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন।'
বুদ্ধিমতী এবং সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী যদি প্রজ্ঞা এখনও লক্ষ্মীনাথের মতো আধ্যাত্মিক চেতনা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। তথাপি তিনি স্বামীর কথা গুলি ভাবতে শুরু করলেন।
খাওয়া শেষ করে উঠে লক্ষ্মীনাথ কাছেই থাকা বেসিনে মুখ হাত ধুয়ে নিল। তারপরে পত্নীর হাত থেকে গামছাটা নিয়ে মুখ মুছলেন।
' কতদিন থেকে রবি কাকার সঙ্গে দেখা হয় না, বলতো? কতবার বললাম, চল শান্তিনিকেতনে গিয়ে একবার দেখা করে আসি। তা কী যে একটা চাকরি নিলে মাসের কুড়ি দিনই তোমাকে কলকাতার বাইরে থাকতে হয়। দুই তিন দিনের জন্যও অফিস কামাই করতে পার না বুঝি?'
' অফিস কামাই করা যায় না, প্রিয়ে। অফিস থেকে ছুটি নিতে হয়।'
' তা বড় সাহেবকে বলে তিন চার দিনের ছুটি নাও না।'
' ছুটি নিয়ে কী হবে? এখন তো রবি কাকা আমেরিকায়। আমেরিকা ভ্রমণ শেষ করে দেশে ফিরে আসুন। তারপর ছুটি নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে শান্তিনিকেতনে যাব।'
' শুধু দেখা করতে যাবে। দুদিন থাকবে না?'
' নিশ্চয় থাকব। আর থাকতেই হবে। রবি কাকার থেকে আমার যে অনেক কিছু জানবার আছে।'
নির্ধারিত সময়ের আগেই লক্ষ্মীনাথ অফিসে উপস্থিত হয়। সময়ের হিসেব করে সময়ের আগে নিজের গাড়িতে অফিসে এল। ইতিমধ্যে বার্ড এণ্ড কোম্পানি উড়িষ্যা সরকারের কাছ থেকে পাঁচ বছরের জন্য বিশাল এলাকার একটা জঙ্গল নিয়েছে। অবশ্যই জঙ্গল বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রে লক্ষ্মীনাথ এই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। তিনি সম্বলপুর গিয়ে ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে দেখা করে এই বিষয়ে কথা বলেছিলেন। এটা লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা। উড়িষ্যা সরকারের সঙ্গে এই ধরনের একটা লাভজনক চুক্তি সম্পাদনা করার ক্ষেত্রে লক্ষীনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় তার ওপরে কোম্পানির সাহেবদের আস্থা বাড়ল। বড়ো সাহেব নিজের চেম্বারে ডেকে তার প্রশংসা করলেন এবং ধন্যবাদ জানালেন।
কিন্তু বার্ড কোম্পানির সম্বলপুরে কোনো অফিস নেই। কলকাতায় থেকে সম্বলপুরের সেই জঙ্গল দেখাশোনা করাটা সম্ভব নয়। তাই বার্ড কোম্পানি সম্বলপুরে অফিস খুলবে। সেই অফিস থেকেই নতুন করে নেওয়া জঙ্গলটির দেখাশোনা চলবে। তার জন্য বার্ড কোম্পানির বড়ো সাহেব আইরন সাইড টিম্বার বিভাগের অফিসার কার্ক পেট্রিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে লক্ষ্মীনাথকে সম্বলপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।
কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্মীনাথের ওপরে বিশাল এলাকার সেই জঙ্গলটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব থাকবে। তার জন্য তাকে সম্বলপুরে থাকতে হবে। অবশ্য বার্ড কোম্পানির কর্ম–কর্তারা লক্ষ্মীনাথের বেতনের কথাটা নতুন ভাবে বিবেচনা করল। নতুন এই চাকরির জন্য তার মাসিক বেতন হবে ২০০ টাকা।
এটা পদোন্নতি। সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্য পরায়ণতার স্বীকৃতি। দীর্ঘ পনেরো মাস ধরে আর্থিক সংকটে ভুগছিলেন, ঘর সংসার চালানোর জন্য, ঘরের চাকর-বাকরের বেতন দেবার জন্য, মেয়ে তিনটির পড়াশোনার খরচ যোগানোর জন্য কত দিক থেকে টানাটানি করে টাকা জোগাড় করে দিনগুলি পার করছিলেন।এখন এই চাকরিতে যোগদান করলে এই আর্থিক কষ্টের কিছুটা অন্ত পড়বে ।
আর্থিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পেয়ে লক্ষ্মীনাথ অবকাশ পেল। কিন্তু এই সুযোগটা গ্রহণ করলে কলকাতা ছাড়তে হবে।
কলকাতা ছেড়ে সম্বলপুর থাকতে হবে– কথাটা ভাবতেই লক্ষ্মীনাথের অন্তরে একটা সুতীব্র বেদনা অনুভব করতে লাগলেন। ২২ নম্বর রোজমেরি লেনে লরেলস ঘরটা কিনে সেখানে থাকতে শুরু করার পরে যতীন্দ্রনাথ ছাড়াও অনেকেই তাকে কলকাতায় স্থায়ী ভাবে থাকবেন কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। কলকাতায় থাকার ইচ্ছা যদিও লক্ষ্মীনাথ তখন 'ভাগ্য মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারেনা' বলেছিলেন। এখন সম্বলপুরে থাকতে শুরু করলে সেই কথাটা সত্য হবে। এত জ্ঞান বুদ্ধি নিয়েও লক্ষ্মীনাথ ভাগ্য দেবীর ক্রীড়ানক না নিজের ভুলের জন্য তিনি ভাগ্য দেবীর হাতের পুতুল হয়ে পড়েছেন?
অসমিয়া ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে সম্মান স্বীকৃতি পাওয়া লক্ষ্মীনাথ দৈববাদী নন। তিনি সংশয়বাদে বিশ্বাস করেন না। তিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষ। নিজের চেতনা বোধে তিনি ব্যক্তি বিশেষের কর্মকে বিচার করেন। তার জন্যই তিনি বুঝতে পারলেন, এটা ভাগ্য নয়। জীবিকার উপায় রূপে স্থিতিশীল কিছু একটা আহরণ করার ক্ষেত্রে তিনি অসফল। সভাপতি রূপে ছাত্র সম্মেলনে যোগদান করে গুয়াহাটি থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় লখিমপুরের কুশল দুয়ারা তাকে অসমে থাকতে বলেছিল। কুশল এভাবে অনুরোধ করায় মাতৃভূমির প্রতি থাকা ভালোবাসা লক্ষ্মীনাথকে আবেগিক করে তুলেছিল। তখন জীবনের বাকি দিনগুলি অসমে কাটাতে ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু জীবনের দুই কুড়ি বারো বছর অতিবাহিত করার পর থাকতে হলে অসমের মাটিতে যে আর্থিক স্থিতি দরকার, সেটা তার ছিল না। এবং সেটা অর্জন করার সামর্থ্য নাই বলে অনুভব করেছিলেন। কুশলের সামনে বসে লক্ষ্মীনাথ ভেতরে ভেতরে বড়ো অসহায় অনুভব করেছিলেন। মাতৃহারা অসহায় কিশোর একটার মতো তিনি চোখের জল ফেলেছিলেন। এখন কলকাতায় থাকাটা নিয়েও সেরকম অবস্থা হতে চলেছে।
মন খারাপ নিয়ে লক্ষ্মীনাথ নিজের গাড়িতে উঠলেন।
ইতিমধ্যে কলকাতার বুকে বিকেলের ছায়া নেমে এসেছে। সেপ্টেম্বরের শুরু যদিও গরমের তীব্রতা কমেনি। কিন্তু অন্য দিনের মতো আজও বাতাস বইছে। গঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে চলা ফুরফুরে বাতাস। এই বাতাস কলকাতা মহানগরের এক অপূর্ব সম্পদ। বাতাসের ঝাঁকটা সারাদিনের ক্লান্তি অবসাদ দূর করে ফেলে। ঘোড়ার গাড়িতে বসে হাওড়া গামী হওয়ার জন্য লক্ষীনাথ দেহ শীতল করা এই বাতাসটা আরও ভালোভাবে উপভোগ করছে। তার গাড়ির দুইপাশ দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে গাড়ি, মানুষ এবং আলোক- উজ্জ্বল দোকান পাট। এত বছর ধরে কলকাতায় থাকার ফলে সবকিছুই পরিচিত। নগরটির প্রকৃতির সঙ্গে সে অভ্যস্ত। মাতৃভূমি নয় যদিও ছাত্র জীবনের পাঁচ বছর এবং কর্মজীবনের সুদীর্ঘ তেইশ বছর কলকাতায় অতিবাহিত করেছেন। প্রথম থেকে এখানে এসে বিগত ২৮ বছর এই কলকাতায় থেকেই লক্ষ্মীনাথ হয়ে উঠেছেন অসমিয়া ভাষার প্রথিতযশা সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া।
এন্ট্রান্স পাস করার পরেই লক্ষ্মীনাথ কলকাতা এসেছিলেন। কালীঘাটের বেনীমাধব হালদারের ঘরে থাকা, খাওয়া দাওয়া এবং কলেজে আসার কষ্টের জন্য তার উঠে এসে কলেজ স্ট্রিটের মেসে থাকা, কলেজে পড়ার সময়ই স্টার বেঙ্গল, ন্যাশনাল থিয়েটার উপভোগ করা, বিএ পড়তে গিয়ে কাব্যিকভাবের উন্মাদনায় বাংলা কবিতা লেখার প্রচেষ্টা, তাতে বিফল হয়ে কয়েকটি মেসের অসমিয়া ছাত্রদের সঙ্গে মিলিতভাবে শনিবারের চায়ের মেলা পেতে অ. ভা. উ. সা. সভা গঠন করা, চন্দ্র কুমার ,হেমচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে ইডেন গার্ডেনে বসে'জোনাকী' বের করার পরিকল্পনা করা, নবীন উদ্যম এবং জাতীয়তাবোধে' 'জোনাকী'র প্রকাশ, বাড়ির প্রত্যেকের বিরোধিতাকে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে কলকাতার মেস থেকে বরযাত্রীদের সঙ্গে জোড়াসাঁকো গিয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরীর সঙ্গে বিবাহ পাশে আবদ্ধ হওয়া, ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে বি বরুয়া কোম্পানি খুলে কাঠের ব্যাবসা আরম্ভ করা, ব্যাবসায় উত্থান ,ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে সংঘাতের পরে বি বরুয়া কোম্পানি পরিত্যাগ,' আসাম বেঙ্গল স্টোর্স' নাম দিয়ে নতুন করে কাঠের ব্যাবসা আরম্ভ, মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই ব্যাবসায় চূড়ান্ত ভাবে অসফল, তারপরে বার্ড কোম্পানির চাকরিতে যোগদান… কত ঘটনা, আর এই সমস্ত ঘটনা ঘটল কলকাতার বুকে । এখন বার্ড কোম্পানির চাকরি করতে হলে কলকাতায ছাড়তে হবে!
লক্ষ্মীনাথের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবন। পন্ডিত- দার্শনিক-রাজনীতিবিদদের কেউ কলকাতায় এলেই নোটবুক একটা নিয়ে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য টাউন হলে উপস্থিত হওয়া, নতুন নাটক মঞ্চস্থ হলেই হলে গিয়ে থিয়েটার উপভোগ করা, ব্যাবসায় বা অন্য কোনো সমস্যায় সম্মুখীন হলে বিশেষ ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে শলাপরামর্শ নেওয়া… সম্বলপুরে থেকে চাকরি করতে হলে এই সমস্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। ২৮ বছর কলকাতায় থেকে এর সংস্কৃতিপ্রেমীদের সঙ্গে যে মিত্রতা গড়ে উঠল জোড়াসাঁকো ছাড়া কলকাতায় এত আত্মীয় বন্ধু তাদের সঙ্গে জ্ঞানোন্মেষকারী আলোচনায় যে বৌদ্ধিক তৃপ্তি, হাওড়ার লরেলস থেকে বেরোলেই ছোটো থেকে বড়ো প্রত্যেকেই এত সম্মান করে–ছোটো শহর সম্বলপুরে গিয়ে এইসব কিছুই পাবে না।
বিয়ের পরে প্রজ্ঞাকে নিয়ে কলকাতার কত জায়গায় থাকল… শোভারাম বসাক লেনের ভাড়া ঘরে তাদের সাংসারিক জীবনের শুরু… অবশেষে প্রজ্ঞাসুন্দরীর নামে কেনা ২২ নম্বর রোজমেরি লেনের এই লরেলসে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য ঘর- সংসার গড়ে উঠল। এদিকে লক্ষ্মীনাথের বুকের এক টুকরো হল'বাঁহী'।'বাঁহী' প্রকাশের পরিকল্পনা, প্রকাশ এই লরেলসে থেকেই। লরেলস 'বাঁহী'র কার্যালয়। লরেলসের কাছে সালকিয়া প্রিন্টিং হাউস। এতদিনে প্রেছের মালিকের সঙ্গে এরকম একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে যে তার কর্মচারী বাড়ি থেকেই ছাপার লেখাগুলি নিয়ে যায়, কম্পোজ করার পরে কর্মচারীর মাধ্যমে প্রুফ দেখার জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, ছাপা-বাঁধার কাজ শেষ হওয়ার পরে'বাঁহী'র প্যাকেট গুলি বাড়িতে দিয়ে যায়। প্রেছটি থেকে কাগজটা বের করার খরচ ও তুলনামূলকভাবে কম। সম্বলপুরে গিয়ে এই ধরনের সুবিধা পাবে কি? তাছাড়া এই লরেলসে থাকা তেরোটা বছরই হল লক্ষ্মীনাথের সাহিত্য সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল সৃষ্টির কাল।
কিন্তু অবস্থা পরিস্থিতি এরকম হয়ে পড়ল যে এখন বহু ঘটনার স্মৃতি বিজড়িত এই লরেলসের মায়া ত্যাগ করতে হবে। ইউরোপে চলতে থাকা মহাযুদ্ধ কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারেনা। যুদ্ধ চলতে থাকলে লক্ষ্মীনাথের মতো কাঠের ব্যাবসায়ীদের মন্দা অবস্থা কাটিয়ে উঠা অসম্ভব। এদিকে নতুন করে কোনো ব্যাবসা আরম্ভ করার মতো লক্ষ্মীনাথের হাতে পুঁজি নেই। লরেলস বন্ধকে রেখে টাকা নিয়েছিল-সেই ধন পরিশোধ করতে না পারার জন্য চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। তাই কেবল মায়া ত্যাগ করাই নয়, লরেলস বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। লরেলস বিক্রি করার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবার নিয়ে লক্ষ্মীনাথ যাযাবর হয়ে পড়বে। তারপরে কলকাতায় থাকতে হলে জীবিকার সংস্থান খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে বাসস্থানের জন্য পুনরায় ভাড়াঘর নিতে হবে। কিন্তু সম্বলপুরে থাকলে বার্ড এণ্ড কোম্পানির বেতন ছাড়া পরিবার নিয়ে থাকতে পারার মতো ঘর ভাড়া দেবে, চাকর-বাকরের বেতন দেবে, গাড়ির খরচ দেবে। তাই আর্থিকভাবে স্থিতিশীল পারিবারিক জীবনের জন্য ম্যানেজার হয়ে সম্বলপুরে যাওয়া ছাড়া লক্ষ্মীনাথের সামনে আর কোনো উপায় নেই।
এটা লক্ষ্মীনাথের জন্য হতাশা জনক এক স্থিতি। বৈষয়িকভাবে সত্যিই তিনি বিধ্বস্ত, পরাজিত। বৈষয়িক কারণেই তাকে স্বপ্নের মহানগর কলকাতায় থাকার আশা ত্যাগ করতে হবে। আর এখন, এই বয়সে কলকাতা ছেড়ে যাওয়াটা হবে তার কাছে ' স্বর্গ হতে বিদায়'। লক্ষ্মীনাথ ভেতরে ভেতরে ভীষণ অসহায় বোধ করলেন। সমগ্র দেহে নেমে এল এক আশ্চর্য ক্লান্তি।
কিছুক্ষণ পরেই বাড়ি পৌঁছে যাবেন। বাড়ি পৌঁছে তিনি প্রজ্ঞাকে কীভাবে বলবেন যে কিছুদিনের মধ্যে কলকাতা ছেড়ে তাদের প্রত্যেককে সম্বলপুরে যাত্রা করতে হবে। কিন্তু যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন, কথাটা প্রজ্ঞাকে জানাতে হবে। কলকাতা ছেড়ে যাওয়াটা প্রজ্ঞার জন্যও বেদনাদায়ক হবে। তবে প্রজ্ঞা জীবনসঙ্গিনী ,তার সুখ দুঃখের সঙ্গী, বান্ধবী। সমস্ত শুনে খারাপ লাগলেও অন্তর থেকে মানতে না পারলেও সংবেদনশীল হৃদয়ের প্রজ্ঞা তার সঙ্গে সহযোগিতা না করে থাকবে না। মনে এই বিশ্বাস নিয়ে কোচোয়ান ইতিমধ্যে লরেলসের সামনে রাখা গাড়ি থেকে সীমাহীন অবসাদ নিয়ে লক্ষ্মীনাথ ধীরে ধীরে নেমে এল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন