পাখিদের পাড়া পড়শি- ১২
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi
দ্বিতীয় অধ্যায়,
(বারো)
সাতাশ তারিখ প্রজাপতি বিষয়ক প্রকৃতি শিবিরটার পরিবর্তে পক্ষী বিষয়ক প্রকৃতি শিবিরের ব্যবস্থা করা হল। আঠাশ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে প্রজাপতি বিষয়ক প্রকৃতি শিবির। অর্থাৎ এবারের প্রকৃতি শিবির দুদিনের জন্য অনুষ্ঠিত হবে। একনাগাড়ে কাজগুলি সম্পন্ন করতে হবে। না হলে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার সময় এসে যাবে। অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীদের অনুরোধের প্রতি উদয়শঙ্করকে গুরুত্ব দিতেই হবে। অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীরাই তার কাছে মূলধন ,সামাজিক পুঁজি।
শিবিরের ব্যস্ততার মধ্যেও উদয়শঙ্কর বকের আস্থানার আশেপাশে একবার হলেও পদার্পণ করছে। দিনে কিছুক্ষণের জন্য না গেলে সে মনের মধ্যে অনুভব করে অসহ্যকর যন্ত্রণা।
বকগুলি প্রজননের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। উদয়শংকর অতি মনোযোগের সঙ্গে ওদের লক্ষ্য করার সময় আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েই থাকে। পুরুষ বকটি ঠোঁটের দুই অংশ দিয়ে টক টক শব্দ করে ধীরে ধীরে স্ত্রী বকটির কাছে হাজির হয়েছে। তারপর দীর্ঘ ঠোঁট দিয়ে গাছের একটি কোমল ডাল ভেঙে নিয়ে স্ত্রী বকটিকে অর্পণ করে প্রেম নিবেদন করছে, কোনো যুবক ছেলে একজন যুবতিকে প্রদান করা একটি গোলাপ ফুলের মতো। প্রজনন সক্ষম হওয়ার সামর্থ্য প্রদর্শন করে ধীরে ধীরে পুরুষ বকটির পায়ের সামনের ভাগ হলদে হয়ে পড়েছে । উদয়শঙ্করের জন্য দুঃখের বিষয় এটাই যে বক গুলির ডিম পাড়া পর্যন্ত ডিম থেকে বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত– এই সুদীর্ঘ সময় সে ওদের সঙ্গে থাকতে পারবে না । থাকতে পারবে না পাখিদের পাড়া-প্রতিবেশীতে। পাড়ায় অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে পাঁচটি বকের পরিবার ওদের ঘর তৈরি করেছে। গাছের ডালের শাখায় মঞ্চের মতো করে গাছের ছোটো ছোটো ডাল বাঁশের মোড়ার টুকরো এবং গাছ পাতা দিয়ে তৈরি করেছে এক একটি ঝুপড়ি। ঝুপড়িতে ওদের সংসার দেখতে সত্যিই মনোরম ।
সুনন্দ সকাল বেলা চিৎকার চেঁচামেচি করায় সুনন্দের কণ্ঠস্বর শুনে বিছানা থেকে ধড়মড় করে উঠে বসল উদয়শংকর।
– ঘুমাচ্ছিলেন উদয়দা?
–উহু। বিছানায় শুয়ে সঞ্জয়ের দৃষ্টি দিয়ে বকের বাসা নিরীক্ষণ করছিলাম।
– কী দেখলেন?
উদয়শঙ্কর কী দেখতে পেল, কী দেখছিল সুনন্দকে বোঝানোর চেষ্টা করল।
– তুমি কখনও এখানে দাঁড়িয়ে ওদিকে তাকিয়ে থাকলে গুয়াহাটি দেখতে পাও কি?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুনন্দ বলল– হ্যাঁ। দেখতে পাই। পরিষ্কার রাতে দূর দূরান্তে সাদা বিস্তৃত অঞ্চল দেখলে গুয়াহাটি মহানগরের আলো বলে মনে হয়। দীঘলী পুকুরের পাড়ের কথা মনে পড়ে যায়। সেই জায়গাটা আমার ভালো লাগে। আর বর্ষার দিনে সে দিকে মেঘ দেখলে গুয়াহাটিতে বৃষ্টি পড়ছে বলে থাকি।
– এভাবে বিছানায় পড়ে থাকলে দেখতে পাই 'পাখিদের পাড়া পড়োশী' এবং প্রকৃতিশিবিরে অংশগ্রহণ করা অংশগ্রহণকারীদের। দেখতে পাই পাগলাদিয়ে নদীর দুই পার অধিক সবুজ হয়ে ওঠা, দেখতে পাই বড়শি বাইতে থাকা বিদেশি পর্যটক, উপন্যাস লিখতে আসা কোনো ভারতীয় লেখককে। আর, আর দেখতে পাই এখানকার ছেলেদের অভিধানে বেকার নামের শব্দটা নাই হয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি তাদের ভাত দিচ্ছে, কাপড় দিচ্ছে, বেঁচে থাকার বাসনায় নতুন রঙ এবং মাত্রা দিচ্ছে। উদ্ধত যুবকদের মনে এসেছে কর্ম তৎপরতার উদ্দাম স্পৃহা।
– উদয়দা। এই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে কত বছর কত যুগ লাগবে?
সন্ধিহান হয়ে জিজ্ঞেস করে সুনন্দ ।
– আরে বাবা। কাজ করা মানুষের জন্য জীবনটা অনেক ছোটো। বছর-যুগ লাগতে হলে দেখছি আমাদের জীবনের অর্থহীন আত্মাকে দায়িত্ব সমূহ সঁপে দিতে হবে। শিবিরে অংশগ্রহণ করা ছেলে মেয়েদের উৎসাহিত করে কাজে লাগাতে পারলে আগামী বছরে আমরা হয়তো কোনো সুফল দেখতে পাব।
সুনন্দ উদয়শংকরের কাছ থেকে আগে এই ধরনের কথা শুনতে পায়নি। মানুষটা নিজের কল্পনাগুলি বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য বেশি তাড়াহুড়ো করছে হয়তো, তার জন্য সেও কখনও না ভাবা কথাও বলে ফেলেছে। মানুষটা মনের মধ্যে কী পরিকল্পনা পুষে রেখেছে জানার জন্য সুনন্দ ইচ্ছা প্রকাশ করায় ওদের সংকট ধীরে সুস্থে মনের কথাগুলি দুই একটা করে বলে গেল। উদয়শঙ্করের কথা শুনে সুনন্দের এমন মনে হল– সে যেন ধীরে ধীরে অন্য একটি পৃথিবীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কল্পনার পৃথিবীটি বাস্তবের পৃথিবীতে পরিবর্তন করার অপ্রতিম ইচ্ছা পোষণ করে ওরা দুজন আগামী সপ্তাহে শিবিরে দুইদিন কীভাবে সুকলমে পার করবে তার পরিকল্পনা করতে লাগল।
– সুনন্দ, পাখি বিষয়ক প্রকৃতি শিবিরটা পরিচালনা করবে সৌম্যদা এবং প্রজাপতি বিষয়ক শিবিরটা পরিচালনা করবে প্রণব কুমার ভাগবতী।
–দুজনেই আসবে কি? কী বলেছে আপনাকে?
– আসবে। আসবে। আমি ফোন করেছিলাম। সৌম্যদা আসতে পারবে বলেছে। কিন্তু তিনি বলেছেন এবারের শিবিরটা নাকি বন্ধ ঘরে করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রজেক্টর ব্যবহার করলে একটা জেনারেটর লাগবে। কারেন্ট কখন যাবে কখন আসবে তার ঠিকানা নেই। সৌম্যদা ব্যবস্থা করা যাবে কিনা বলে জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম–হবে। সুনন্দই করবে। সুনন্দ হবে কি? আমি সৌম্যদাকে সম্মতি জানিয়ে বিপদে পড়লাম না তো!
– কোনো বিপদে পড়নি। ব্যবস্থা করা যাবে। অল্প হয়তো কষ্ট হবে। নদীতে মাছ মারতে আসার সময় যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম পখিনদা, তার ভাই প্রদীপের টেন্টহাউস থেকে জেনারেটর নিতে পারব। আমাদের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য জানতে পারলে খুব কম ভাড়া নেবে, হয়তো না নিতেও পারে। প্রজেক্টরও পাব। আমার একজন বন্ধু আছে, গুয়াহাটিতে ক্যামেরা, প্রজেক্টর আদির ভাড়ার ব্যবসা করে। তাকে বললে সে নিয়ে আসবে। কুছিয়া মাছ তার খুব প্রিয়, তাকে শুধু কুছিয়া মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ালেই হবে।
– তাহলে এগুলির ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম।
– হবে আমি আজই তাদের দুজনকে বলে প্রজেক্টর এবং জেনারেটরের ব্যবস্থা করব।
সুনন্দের আশ্বাসে উদয়শংকর নিশ্চিত হল। উদয়শঙ্করের ভয় হয়েছিল– প্রজেক্টররের ব্যবস্থা করতে না পারলে সৌম্যদাকে কী বলবে।
সেদিন সন্ধেবেলা উদয়শঙ্করের ঘরে এসে সুনন্দ শিবিরের প্রথম দিনের দুপুরের আহার জোগাড় হওয়ার কথা উদয়শঙ্করকে জানাল। সুনন্দ বলল যে বিকেলের দিকে সে বগলস চকে যাবার সময় বিপিন ডেকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মানুষটা বগলছ চ'ক বণিক সংস্থার সম্পাদক। সে সুনন্দকে জিজ্ঞেস করল–' তোমরা নাকি আজকাল থানে কীসব কাজ করছ। সুনন্দু তাকে তারা কী কাজ করছে, কীভাবে করছে তা বিস্তৃতভাবে জানাল। প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ওপরে ডেকা, তার পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কিছু অংশ বর্ণনা করল। জায়গাটা এক সময় কীভাবে গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল, পাখ-পাখালিতে পরিপূর্ণ ছিল, এমনকি বিভিন্ন বন্য জীবজন্তুর মধ্যে একটা সন্তুলনের ভার দেখা যেত– মানুষের উপদ্রব্ পেয়ে সেই সমস্ত কীভাবে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।তাঁর মন্তব্য অনুসারে তোমরা তরুণরা দায়িত্ব না নিলে শেষ রক্ষা করা যাবে না। জলাশয়ের বিভিন্ন পাখিগুলিও একদিন আমাদের মধ্য থেকে শকুন নাই হওয়ার মতো নাই হয়ে যাবে। সুনন্দ তখন বিপিনদাকে ২৭-২৮ তারিখ অনুষ্ঠিত হতে চলা প্রকৃতি শিবিরের কথা জানাল এবং বলল–' দাদা যদি পারেন একবার এসে দেখে যাবেন। সুনন্দের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে বিপিন ডেকা তাকে জিজ্ঞেস করল— সুনন্দ, কতজন ছেলেমেয়ে হবে বলে মনে হয়। সুনন্দু তাকে জানাল যে ত্রিশ-চল্লিশ জনের মতো হতে পারে ।এখনই নির্দিষ্ট সংখ্যাটা বলা একটু মুশকিল। সুনন্দকে মানুষটা অনুরোধ করার সুযোগই দিল না, তিনি নিজে থেকে বললেনঃ তাদের জন্য দুপুরের খাওয়া দাওয়া ব্যবস্থা করতে হবে। নয় কি? সুনন্দ লাগবে বলে জানাল। তখন বিপিন ডেকা বলল–– তাহলে সেদিনের দুপুরবেলার খাবারটা আমিই দেব। জীবনে কোনোদিন কোনো পুণ্যের কাজ করিনি। ভালো কাজ করতে ইচ্ছা বা ছেলেমেয়েগুলিকে এক বেলা খাইয়ে নিজের জীবনটাকে কিছুটা ধন্য করতে চেষ্টা করি। না কি বল! সুনন্দ মানুষটাকে মুচকি হেসে একটা ধন্যবাদ জানাল।
– ভালোই হয়েছে। এক বেলার সমস্যার সমাধান হল। পরের দিনে অবশ্য ছেলেমেয়ে কম হবে। সেদিনের সমস্যাটা আমিই সমাধান করে দেব।
সুনন্দ উদয়শঙ্করকে কী বলবে ভেবে পেল না।
– সুনন্দ। খাদ্য, প্রজেক্টর এবং জেনারেটরের ব্যবস্থা হল। আচ্ছা পাখির শিবিরটার কথা নিয়ে ভেবেছ?
– হ্যাঁ। বলতে ভুলে গেছি। পাখির শিবিরটা যেহেতু ব্যবহারিক না হয়ে বিদ্যায়তনিক হবে সেই জন্য আমি গঙ্গাপুখুরি হাইস্কুলের কথাই ভাবছি। স্কুলের হলঘরটিতে হলে খারাপ হবে না। আমি হেড স্যারের কানে কথাটা দিয়ে রেখেছি। স্যার বলেছেন প্রতুলকে বলে রাখবে। সে আমার থেকে চাবি নিয়ে নেবে এবং তোমাদের প্রয়োজনীয় ঘরটা তোমরা খুলে নেবে।
– সুনন্দ তুমি দেখছি ভেতরে ভেতরে সব ঠিক করেই ফেলেছ
– উদয় দা, আপনাকে জানাতে ভুলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।
সুনন্দের মনে জেগে ওঠা অপরাধবোধ দূর করার জন্য উদয়শঙ্কর বলল– এভাবে কেন ভাবছ। করার কাজ তুমি করে গেছ। এর মধ্যে জিজ্ঞেস করার তো কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
– তবু। ঘরটা পছন্দ হবে কিনা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।
– হয়তো ছিল। জনগণের কাজ সম্মতি সাপেক্ষে করা ভালো। তোমার যদি ভুল করেছ বলে মনে হয়ে থাকে, তাহলে তুমি শিখতে কৃপণতা করছ না। সামাজিক কাজের জন্য এটা হয়তো তোমার কাছে প্রথম পাঠ। অংশগ্রহণকারীদের জানানো হয়েছে কি?
– নবদা এবং কীচককে দায়িত্ব দিয়েছি। জেপিও দায়িত্ব নিয়েছে।
‐- ত্ৰিশ জনের বেশি যেন না হয়। আর দেখবে যাতে, একটু বেশি সচেতন অংশগ্রহণকারীর অংশগ্রহণ যেন সুনিশ্চিত করা যায়।
‐- সেই কথায় আমি একটু বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছি। যাতে ভবিষ্যতে তারা এই ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করতে পারে।
সুনন্দ এই কয়েকদিন প্রতিদিন সন্ধেবেলা এসে উদয়শঙ্করকে খবরা খবর জানিয়ে গেছে। নবদাএবং কীচকও এসেছিল । তারাও শিবিরের প্রস্তুতির বিষয়ে খবর নিয়ে গেছে । মোটের উপর প্রত্যেকেই উৎসাহী এবং উদ্বিগ্ন।
শিবিরের দিন সকাল বেলা সৌম্যদা সোজাসুজি গঙ্গাপুখুরি হাই স্কুলে এল। গুয়াহাটিতেই একটু দেরি হওয়ায় তাড়াতাড়ি এসে বগলস চকে পৌঁছাতে পারল না। সৌম্যদা এসেই প্রজেক্টর এবং জেনারেটরের ব্যবস্থা কী ধরনের একবার দেখে নিল। সৌম্যদা সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে হল উদয়শঙ্করের।
‐- ছেলেমেয়েরা আসার আগে একবার প্রজেক্টরটা স্টার্ট করে দেখ তো।
‐- দাদা ।আমি সবকিছু সংযুক্ত করে একবার দেখে নিয়েছি। ঠিকই আছে।
সুনন্দের বন্ধু বলীন বলল।
‐- আছে তো!
– হ্যাঁ আছে।
বলীন আশ্বাস দেওয়ায় সৌম্যদা উদয়শঙ্করকে জিজ্ঞেস করল – কতজন প্রকৃতি কর্মী অংশগ্রহণ করবে ।
— ত্রিশ জন পঞ্জীয়নের টাকা দিয়েছে। আরও দুজন হয়তো বাড়তে পারে।তাঁরা আজ পঞ্জীয়ন করার কথা ছিল।
নটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে শিবির আরম্ভ হল। বন্ধুরা কি করছে একবার দেখে যাই আর তিনি বলা অনুসারে তাঁর ছেলেগুলি দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করেছি কিনা দেখতে এসে শিবিরে উপস্থিত হয়েছিল বিপিন ডেকা। উদয়শঙ্কর বিপিন ডেকাকে শিবির উন্মোচনের দায়িত্ব দেওয়ায় মানুষটা আপত্তি করল– সবাইকে নমস্কার জানিয়ে বলছি, আমি ব্যবসায়ী মানুষ, এই সমস্ত কিছু বুঝি টুঝি না। এত সম্মানের দায়িত্ব আমাকে দেবেন না।
সুনন্দ এবং উদয়শঙ্কর মানুষটার উপরে জোর করায় তিনি বললেন– উপস্থিত জনগণ। আপনাদের শত কোটি প্রণাম। এই অভাজনকে এই দায়িত্ব দেওয়ায় আপনাদের শ্রদ্ধা এবং আমার চেয়ে বয়সে ছোটো সবাইকে ভালোবাসা জানাচ্ছি। সঙ্গে এই অভাজন দোষ ত্রুটির মার্জনা চেয়ে এই শিবিরটা উদ্বোধন করা হল বলে ঘোষণা করলাম।
হলঘরটা হাততালিতে ভরে গেল।
মানুষ কতটা আন্তরিক এবং সৌজন্যমুখী হলে নিজেকে হেয় করে দেখাতে পারে– বিপিন ডেকা সম্ভবত তার নৈষ্ঠিক উদাহরণ।
শিবিরের দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে সৌম্যদা নিজের ধরনে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে পরিচিত হয় ক্রম সংখ্যা দাঁড়াল তেত্রিশ জন।
তৃতীয় পর্বে সৌম্যদা শিবিরের নির্দিষ্ট কার্য আরম্ভ করল।
পাখি কাকে বলে? বল, তোমরা কে জান? সব সময় দেখছ।
কী বলবে। সব সময় দেখছে অথচ বলার যেন কিছু নেই।
– বলার দায়িত্ব আমাকেই দিয়েছে নাকি প্রত্যেকে? যাই হোক পাখি মানে হল– বিশেষ ধরনের ডানা, ঠোঁট থাকা ডিম পারা এক ধরনের উষ্ণ রক্তের মেরুদন্ডী প্রাণী যার উড়ার ক্ষমতা আছে। তার মধ্যে হয়তো দুই একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। তার মধ্যে বাদুর ডিম পারে না, বাচ্চা দেয়, উটপাখি উড়তে পারেনা।
সৌম্যদা অংশগ্রহণকারীদের প্রাগ ঐতিহাসিক সময় থেকে পাখির বিবর্তনের সম্যক জ্ঞান দিতে চেষ্টা করলেন-থেকোডেন্ট ডাইনোসর থেকে আরম্ভ করে প্র-আভিছ ,আর্কেয়রনিস এবং শেষে আধুনিক পাখির জন্ম কাহিনি। স্লাইডে দেখিয়ে দিলেন পাখিগুলির 'কম্পিউটার ইমেজ'। সৌম্যদা কিছু প্রাগ ঐতিহাসিক পাখির নাম বলল। সেইসব ক্রমে– জলচর পাখি হেছপেরোরনিছ, বৃহৎ আকৃতির স্থলচর পাখি ডায়াট্রাইমা, ডায়াট্রাইমার পরবর্তী সময়ের বৃহৎ আকৃতির পাখি জলাভূমির অরণ্যে বাস করা পাখি হোয়াটিজিন ইত্যাদি অনেক। হোয়াটিজিন পাখির যে আলোকচিত্র সৌম্যদা স্লাইডে দেখাল সেটা সবাইকে বিস্মিত করে তুলল। এত সুন্দর এবং শক্তিশালী ছিল পাখিগুলি!
তারপরে সৌম্যদা আরম্ভ করল বর্তমানের পাখির ওপরে আলোচনা।
– তোমরা জান কি পাখি কেন উড়তে পারে? পাখির উড়তে পারার রহস্য কী, সে কথা প্রতিটি পক্ষীপ্রেমী তথা পক্ষী পর্যবেক্ষকের জানা উচিত।
অংশগ্রহণকারী প্রকৃতিপ্রেমিকদের মাঝখান থেকে কেউ সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ধৃষ্টতা করল না। কাকাবাবুর বৌমা অনামিকার চোখে চোখ পড়ল সৌম্যদার। দুজনেই দু'পাশে চোখ ঘুরিয়ে আনল–সৌম্যদাও বলল না তুমি বল এবং বৌমা অনামিকাও বলার প্রয়াস করল না।
– পাখির দেহের গঠন, অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ, ওজন, ডানা এবং তার বিন্যাস, দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সজ্জা ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জীব বিজ্ঞানীরা পাখির এই অসাধারণ ক্ষমতার মূল উৎসের সন্ধান বের করতে সমর্থ হয়েছে। পাতলা অথচ শক্তিশালী শরীর, ডানার গঠন, ডানার বিন্যাস, পুচ্ছাংশ,ঠেং, ঠোঁট ইত্যাদি পাখির উড়ার কাজে সাহায্য করে। পাখির উড়ান প্রক্রিয়ায় ডানার ভূমিকা অনবদ্য। ডানা ঝাপটে পাখি বাতাসে উড়ে থাকতে এবং ডানা না ঝাপটে পাখি বাতাসে গ্লাইডারের মতো ভেসে থাকতে সক্ষম। পাখির ডানাটা মেলে ধরে পাখির বিন্যাস ডানার বিন্যাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় যে ডানার প্রথম অংশটা একটু স্থুল, তারপরে ক্রমান্বয়ে ডানাটা নিচের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ফলে উড়তে থাকার সময় পাখি বাতাসকে বেশিদূর পেছনদিকে ঠেলে দিতে পারে। ফলে পাখির গতিবেগ বৃদ্ধি পায় এবং এই বক্রতার জন্য ডানা ঝাপটে বাতাসের চাপ পাখির পিঠের উপরে কম পড়ে।
উড়তে শুরু করা এবং উড়তে থাকা পাখির ডানার সঞ্চালন দুটি শ্লাইডের সাহায্যে দেখিয়ে সৌম্যদা বুঝিয়ে বলা কথাটা আর ও সহজ সরলভাবে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করল। তারপরে সৌম্যদা প্রজেক্টরের মনিটরে প্রক্ষেপ করলেন বিভিন্ন পাখির বিভিন্ন আকৃতির পাখি। পাখির শ্লাইডটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে সৌম্যদা পুনরায় বলতে শুরু করলেন।
– ডানা পাখির এক বিশেষ ধরনের আবরণ। সাধারণভাবে পাখির সংজ্ঞা দিলে বলা হয় ডানা থাকা সমস্ত প্রাণীই পাখি। আমাদের নখ আর চুলের মতো পাখির মূল উপাদান হল কেরাটিন। ডানা পাখির দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন রঙে রঙিন করে প্রকৃতি পাখির বিভিন্ন সামাজিক তথা নৈসর্গিক দিককে প্রভাবিত করে, পাখিকে মসৃণ করে রাখে। পাখির প্রজাতিভেদে পাখির রং আলাদা হয় বলে পাখির পর্যবেক্ষণ এবং সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে ডানা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পাখির ডানা সময়ে সময়ে খসে পড়ে এবং সেই জায়গায় পুনরায় একই বর্ণের ডানা গজাতে দেখা যায়। পাখির ডানাকে প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়– সেগুলি হল কনটুর বা আচ্ছাদন পাখি, ফিলোপ্লুম বা সূতালাহি পাখি আর প্লুমিউল বা কপাহী পাখি।
শ্লাইডে সৌম্যদা তিন শ্রেণির ডানার চিত্র প্রদর্শন করে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করে গেলেন। সঙ্গে বর্ণনা করলেন ডানার গঠন প্রণালী। শ্লাইডে দেখানোর জন্য অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি প্রেমিকদের বুঝতে যথেষ্ট সুবিধা হয়েছে।
প্রতিটি ডানার মধ্য দিয়ে একটি কাঠি বা সেফট থাকে, তার দুপাশে কিছুটা ঊর্ধ্বগামী অবস্থায় কয়েকশো কোমল সুতোর মতো ফিলামেন্ট থাকে। প্রতিটি ফিলামেন্টের সঙ্গে যুক্ত থাকে বারবিউল অথবা ছোটো ফিলামেন্ট। কাছের ফিলামেন্টকে খামচে ধরে রাখার জন্য প্রতিটি বারবিউলের সঙ্গে আছে কয়েকশো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অতি ক্ষুদ্র হুক।
সৌম্য দা স্ক্রিনে উদ্ভাসিত হওয়া প্রতিটি অংশ সুন্দর করে দেখাচ্ছে ।
–এখন আসছি পাখির পুচ্ছাংশে।পুচ্ছাংশের সাহায্যেই পাখি বাতাসে তীব্র গতিতে বিচরণ করার সময় দিক পরিবর্তন করে বাতাসে নিজের গতিবেগ কমানো বাড়ানো করতে পারে, এমন কি বাতাসে ভেসে থাকার জন্য ও পাখি তার পুচ্ছাংশ ব্যবহার করে । প্রজাতি ভেদে পাখির পুচ্ছাংশের ব্যবহারে ধরন ধারন ভিন্ন । শরীরের ভর প্রয়োগ করে পাখি গাছের ডালে ভারসাম্য বজায় রাখতে জলের নিচে প্রবেশ করার জন্য ক্ষিপ্রতা বাড়ানোর আবশ্যক হিসেবে পাখি পুচ্ছাংশের ব্যবহার করে। অভিব্যক্তি সূচক তথা ভাব বিনিময়ের জন্য প্রজাতিভেদে পাখির পুচ্ছাংশের গতিবিধি ভিন্ন । কিছু পাখির প্রজাতির পুরুষ এবং স্ত্রী পাখির পুচ্ছাংশ ভিন্ন অবয়ব এবং ভিন্ন রংয়ের হতে দেখা যায়। কোনো কোনো প্রজাতির পুচ্ছাংশ পূর্ণবয়স্ক হওয়ার তথা প্রজনন ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় । পাখি পর্যবেক্ষকদের জন্য এই সমস্ত এড়িয়ে চলতে না পারাটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি বলা কথাগুলি তোমরা প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছ কি ?
সৌম্যদা শ্লাইডে প্রত্যেকেই সাধারণত দেখতে পাওয়া দশটা প্রজাতির পাখির ভিন্ন আকৃতির পুচ্ছাংশের রেখাচিত্র দেখালেন । এই রেখাচিত্রগুলিতে অঙ্কিত বিভিন্ন আকৃতির পুচ্ছাংশ সাধারণভাবে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তারপরে সৌম্যদা পরবর্তী শ্লাইডটি স্ক্রিনে প্রক্ষেপ করলেন। তার মধ্যে অঙ্কিত রয়েছে দশ ধরনের ভিন্ন পাখির ঠ্যাঙের রেখাচিত্র । রেখাচিত্র সমূহের নিচে পাখি গুলির নাম লেখা আছে । প্রথমটিতে লেখা আছে কাঠঠোকরা পাখির ঠেং এবং শেষেরটিতে লেখা আছে বন্য মোরগের ঠেং। সৌম্যদা পাখির ঠেং গুলির দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর সময় হঠাৎ প্রজেক্টর চালানো ছেলেটির অসাবধানতাবশত একটা হাত প্রজেক্টরে লেগে স্ক্রিন থেকে ছবিগুলো নাই হয়ে গেল।
– তোমার নাম কি?
প্রজেক্টর চালানো ছেলেটির দিকে তাকিয়ে সৌম্যদা জিজ্ঞেস করল।
– দাদা, বলীন। ছেলেটি সমীহের সঙ্গে বলল।
– বলীন, তুমি কাজটা ভালো করলে না। একটু দেখেশুনে–
সৌম্যদা অসন্তুষ্ট মনে বাইরে বেরিয়ে এলেন। সৌম্যদাকে বেরিয়ে আসতে দেখে উদয়শঙ্কর পেছন পেছন বারান্দায় বেরিয়ে এল। বলীন অবশ্য বেশি সময় নিল না। দৌড়াদৌড়ি করে প্রজেক্টরটা ঠিক করতে সে সমর্থ হল।
– একটা মুডে কথা গুলি বলা হয়। মুড অফ হয়ে গেলে খারাপ লাগে।
বলীন প্রজেক্টরটা পুনরায় সঠিক অবস্থানে আনার পরে সৌম্যদা পাখির ঠেঙের ওপরে বলতে শুরু করলেন।
– পাখি যে প্রাগ ঐতিহাসিক কালের কোনো একটি যুগে সরীসৃপ ছিল তার আভাস আমরা পাখির ঠেঙে দেখতে পাই। সেটা হল– প্রায় সমস্ত পাখির ঠেঙে আমরা ছাল বা স্কেল দেখতে পাই। সরীসৃপের শরীরে ছালগুলি বেশিরভাগ পাখির ডানায় রূপান্তরিত হলেও ঠেঙের দিকের ছাল সেরকমই থেকে গেল। পাখির ঠেং অধ্যয়ন অথবা পর্যবেক্ষণ করে পাখি গুলির বাসস্থান সম্পর্কে ধারণা করা যায়। সেভাবে ঠেং পর্যবেক্ষণ করে পাখির জীবনযাত্রা প্রণালীর অনেক কথা জানতে পারা যায়। পাখির ঠেঙ কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাতের মতো কাজ করে। ভূমি থেকে বাতাসে উড়ার সময় কিছুটা দৌড়ে যায়, ফলে পাখির শরীর বাতাসে ভেসে থাকায় সুবিধা হয়। এর জন্য পাখির ঠেঙের প্রয়োজন যথেষ্ট। পাখি সাঁতরানোর জন্য ঠেং ব্যবহার করে। মাংসাহারী পাখিগুলি শিকার ধরার জন্য ঠেঙের ব্যবহার করে।
শ্লাইডে থাকা এক একটি ঠেং দেখিয়ে সৌম্যদা পাখির ঠেঙের ব্যবহারের উপর বক্তব্য রাখলেন । পাখির ঠেঙের ওপরে বলার পরে সৌম্যদা ল্যাপটপের ' এন্টার বাটনে' আঙ্গুল দিয়ে আস্তে করে টোকা দিয়ে শ্লাইডটা পরিবর্তন করে নিলেন । শ্লাইডটাতে দেখতে পাওয়া গেল পাখির কয়েক ধরনের ঠোঁটের রেখাচিত্র।
–এবার তোমাদের পাখির ঠোঁটের বিষয়ে কিছুটা আভাস দেবার চেষ্টা করব। আমাদের হাত, পাখির ঠোঁট। ঠোঁটের সাহায্যে পাখি শিকার করে, খাদ্য গ্রহণ করে বা খাদ্য তুলে নেয়, আত্মরক্ষা, সন্তান লালন- পালন করা, ঘর তৈরি করা, শরীরের যত্ন নেওয়া এমনটি ঠোঁটের সাহায্যে পাখি নিজের স্বরের তারতম্য ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠস্বর বের করে।
সৌম্যদা শ্লাইডটার পরিবর্তন করল। শ্লাইডটাতে দেখতে পাওয়া গেল বিভিন্ন পাখির রেখাচিত্র। সৌম্যদা এক এক করে বিভিন্ন পাখির ঠোঁটের বর্ণনা দিল এবং প্রতিটি ব্যবহারের বিষয়ে বলে গেল।
– বিভিন্ন খাদ্য খাওয়ার জন্য পাখির ঠোঁটের গঠন প্রণালী বিভিন্ন। এখানে তোমরা তাকিয়ে দেখ এই ধরনের ঠোঁট জল বা কাদা থেকে খাদ্য খাওয়ার জন্য, এগুলি ঠোঁট আবার পোকা ধরার জন্য, এই ঠোট গুলি বীজের অভ্যন্তর ভাগ খাওয়ার জন্য, এই ঠোঁটগুলি কাঠ ফুটো করার জন্য, এগুলি মাংস কাটার জন্য, এগুলি পোকা এবং গুটি খাওয়ার জন্য, এগুলি শস্য খাওয়ার জন্য, এগুলি ফল খাওয়ার জন্য, এগুলি মধু চোষার জন্য, এগুলি গভীর কাদা থেকে পোক ইত্যাদি খাবার জন্য, এগুলি মাছ শিকারের জন্য, এগুলি সবকিছু ভক্ষণের জন্য উপযোগী।
প্রতিটি ঠোঁটের খাদ্য উপযোগিতার বিষয়ে বলে যাবার সময় সৌম্যদা প্রতিটি ঠোঁটের উপরে হাতে থাকা ছোটো একটি লাঠি দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছেন। ফলে অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যেকেরই ঠোঁট গুলি চিনতে সুবিধা হয়েছে।শ্লাইডে থাকা কয়েকটি ঠোঁট দেখে প্রতিজন প্রকৃতিপ্রেমী সেটা কোন পাখির ঠোঁট সহজে চিনতে পারতে সক্ষম হয়েছে।
– পাখির দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণ শক্তি এবং শ্রবণশক্তির বিষয়ে পাখি পর্যবেক্ষকরা প্রথমেই একটু জেনে নেওয়া আবশ্যক। পাখির দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। পাখির তীব্র গতি, আকাশ থেকে নিচের ভূপৃষ্ঠে দৃষ্টিপাতের প্রয়োজনীয়তা, অরণ্যে উড়ে বেড়ানোর সময় বাধাহীন ভাবে গাছের ডাল এবং শিলের পাহাড় গুলিকে স্পর্শ না করে বা ধাক্কা না খেয়ে উড়ে বেড়ানোর দক্ষতা, শিকার খুঁজে বেড়ানো অথবা নিজে শিকার হয়ে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে বেড়ানোর সময় পাখির তীব্র দৃষ্টিশক্তির অতীব প্রয়োজন। পাখি দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে বস্তুর দূরত্ব মাপতে পারে, সেই দূরত্ব কত গতিতে অতিক্রম করবে সেটা ঠিক করে। পাখির দৃষ্টিশক্তি যেমন প্রবল তেমনি ঘ্রাণ শক্তি বড়ো দুর্বল। ব্যতিক্রম হিসেবে নিউজিল্যান্ডের কিবি পাখির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিবি পাখি প্রায় দৃষ্টিশক্তিহীন, ঘ্রাণ শক্তির উপরে নির্ভর করেই এই ধরনের পাখি গুলি জীবন যাপন করে। পাখির ঘ্রাণশক্তি ক্ষীন হলেও শ্রবণশক্তি অত্যন্ত প্রবল। লক্ষ্মী পেঁচা ইঁদুরের ক্ষীন শব্দ শুনে ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও শিকার করতে পারে। সদ্য জন্মানো পাখির শাবক গুলির ও শ্রবণশক্তি প্রবল। উদাহরণ হিসেবে মা ঠোটে খাবার জিনিস এনে সাংকেতিক শব্দ করার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় থাকা সবগুলি শাবক খাবার জন্য ঠোঁট মেলে চিৎকার করতে শুরু করে। পাখির শ্রবণশক্তি পাখির অন্যতম প্রধান ইন্দ্রিয়শক্তি।
পাখির দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণ শক্তি এবং শ্রবণ শক্তির বিষয়ে বলার পরে সৌম্য শ্লাইডের পরিবর্তন করল।
– এগুলি পাখির বাসা। তোমরা প্রত্যেকেই জান পাখি ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হলে সেই বাচ্চাকে লালন পালন করে গড়ে তোলার জন্য পাখি বাসা তৈরি করে। প্রজননকার্য সম্পন্ন হওয়ার আগে থেকেই অথবা প্রজননকালে পাখির স্বভাবে বাসা তৈরি করার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। প্রজাতি ভেদে এই বাসা তৈরি করার দায়িত্ব তথা প্রবণতা পুরুষ এবং স্ত্রী উভয়ের মধ্যে দেখা যায়। কিছু প্রজাতির মধ্যে তৈরি করার কাজটা কেবল পুরুষ পাখিকে করতে দেখা যায়, কিছু প্রজাতির মধ্যে আবার স্ত্রী পাখি বাসা তৈরি করার কাজ করে। কিছু পাখির প্রজাতির মধ্যে স্ত্রীপুরুষ উভয়েই বাসা তৈরি করার কাজ করে । সাধারণত দেখা যায় বড়ো আকৃতির পাখিগুলি মুক্ত স্থানে বাসা তৈরি করে এবং ছোটো পাখিগুলি তুলনামূলক ভাবে গুপ্ত অঞ্চলে বা লুকিয়ে চুরিয়ে বাসা তৈরি করতে পছন্দ করে।প্রজাতি ভেদে এবং বসবাস করার পদ্ধতি ভেদে পাখিগুলি বিভিন্ন স্থানে বাসা তৈরি করে। কিন্তু প্রত্যেকটি প্রজাতি যখন বাসা তৈরি করে তখন তার আশেপাশে প্রাকৃতিক খাদ্য ভান্ডার আছে কিনা সেদিকেও লক্ষ্য রাখে। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল নিরাপত্তা। শুধুমাত্র পাখির বাসা সম্পর্কে দুই ঘন্টা বলা যেতে পারে। পরবর্তীকালে এই বিষয়ে আমরা তথ্য সহকারে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব। আজ আমাদের কম সময়ের মধ্যে পাখির ওপরে সম্যক ধারণা একটা গ্রহণ করতে হবে।
সৌম্যদা শ্লাইডটা বদলে দিল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল পাখির কয়েকটি ডিম। পাখির ডিমগুলি প্রকৃতি কর্মীদের দেখিয়ে সৌম্যদা পুনরায় শ্লাইডটা বদলে দিল। এবার শ্লাইডে ভেসে উঠলো ডিমের গঠন এবং চার ধরনের ডিমের আকৃতি।
– তোমরা প্রত্যেকেই পাখির ডিম দেখেছ। খাবার জন্য আনা হাঁস বা মুরগির সিদ্ধ ডিমের কথা মনে কর। তারপরে ডিমের গঠন প্রণালীর এই রেখাচিত্রটির দিকে তাকাও। ডিমের বাইরের কঠিন আবরণটিকে ডিমের খোসা এবং ইংরেজিতে বলা হয় সেল। ডিমের খোসাটা ছাড়ানোর পরে একটা অত্যন্ত পাতলা ত্বক আমরা দেখতে পাই। তাকে অভ্যন্তরীণ বলে বলা হয়। ডিমের ভোঁতা অংশের দিকে একটি বাতাসের থলে থাকে। সিদ্ধ ডিমের সূঁচলো অংশের বিপরীত অংশ বাতাসের থলের মতো ভোঁতা।দেখেছ তো! তারপর দেখতে পাবে ডিমের সাদা অংশ । এটিকে এলবুমিন বলা হয়।অধিকাংশ প্রোটিন দিয়ে এই অংশ গঠিত । সাদা অংশের মাঝখানে থাকে ডিমের কুসুম বা ইয়ক। এটা ডিমের শক্তি ভান্ডার । এখানে থাকে ভ্রুণ । ভ্রুণ থেকে পাখির বাচ্চার জন্ম হয়। এটা অতি সাধারণ ব্যাখ্যা। তোমাদের মধ্যে যারা ডিমের আকৃতি শুধু গোলাকার বলে ভেবেছ– তোমরা এই আকৃতি চারটি দেখ। ডিমের আকৃতি চার ধরনের। গোলাকার, ডিম্বাকার, আপেক্ষিক ডিম্বাকার এবং প্রায় শঙ্কু আকারের। প্রকৃতিতে যে সমস্ত পাখি বেশি বিপর্যস্ত অথবা খাদ্য শৃংখলায় যে সমস্ত পাখির যোগদান অত্যন্ত বেশি সেই সব পাখি ছোটো ছোটো ভাগে বছরের বিভিন্ন সময় একাধিক ডিম পাড়ে। আকারের বড়ো পাখির ডিমও বড়ো আকারের । খাদ্যের প্রাচুর্যতার ওপরে নির্ভর করে পাখি একবার পাড়া ডিমের সংখ্যার তারতম্য হতে দেখা যায়। ডিমের বর্ণ সাধারণত সাদা হলেও প্রজাতি অনুসারে পাখির ডিমের বর্ণ নীল ,নীলাভ, সবুজ ,সবুজ মেটে রংয়ের,খয়েরি এবং ফুটফুটে হতে পারে।
সৌম্যদা পাখির ডিমের সমস্ত দিকের ওপরে আপাতদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করে গেলেন।
– তোমাদের পাখির বিষয়ে আদ্যোপান্ত বলার মতো আজ সময় হবে না। একেবারে সাধারণ ব্যাখায় এভাবে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যাতে তোমরা একটি ন্যূনতম ধারণা করতে পার। তোমাদের পাখির শ্রেণীবিভাজনের কথা বলতে চাইনি। সেটা পাখির পর্যবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এড়িয়ে চলা যায়। তোমাদের জানানোর জন্য এখন পাখি পর্যবেক্ষণের সময় মনে রাখার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথার ওপরে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
তখনই উদয়শঙ্কর সৌম্যদার কাছে এসে কানে কানে বলল– চায়ের বিরতি দেওয়া যাবে নাকি?
– তোমাদের জন্য দশ মিনিটের চা বিরতি। কেউ বাইরে থেকে আসতে চাইলে যেতে পার। কী নাম ছিল তোমার–বলীন– তুমিও তাড়াতাড়ি এক কাপ চা খেয়ে নাও।
তিন ঘন্টা সময় কীভাবে পার হয়ে গেল অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীরা বুঝতে পারল না। তাদের মধ্যে দুজন বাইরে গেল। দুজন জায়গায় বসেই আড়মোড়া ভেঙ্গে নিল। সবাইকে নিজের নিজের বসা জায়গায় চা এবং একটা করে সিঙ্গারা দেওয়া হল। সিঙ্গারা গুলি বিপিন ডেকা তার একজন কর্মচারীর মাধ্যমে তুলিকা মিঠাই ঘর থেকে আনিয়েছে। চা- সিঙ্গারা পর্ব দশ মিনিটের মধ্যেই শেষ হল। সৌম্যদা পুনরায় শিবিরের আলোচনা আরম্ভ করল।
– তোমাদের পাখি পর্যবেক্ষণের কয়েকটি দরকারি কথা বলার প্রয়োজন আছে। পাখি পর্যবেক্ষণের অভ্যাস বর্তমানে প্রকৃতি বিজ্ঞানের অন্যতম অপরিহার্য এক কার্যক্রম। পাখি পর্যবেক্ষণ এবং অধ্যয়নকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় – অরিন্থোলজি আর যে সকল ব্যক্তি এই কাজের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে বলা হয় অরিন্থোলজিস্ট।তোমাদের জেনে রাখা ভালো যে একটা পাখিকে দেখলে বা তার নাম জানলেই পাখির পর্যবেক্ষণ করা বোঝায় না। একটা পাখিকে পর্যবেক্ষণ করা মানে পাখিটির বাহ্যিক ক্রিয়া কলাপ , ভাব-ভঙ্গি ,ব্যবহার, জীবন-চক্র তথা জীবন নির্বাহের পদ্ধতিগত জ্ঞান এবং সর্বোপরি একটা পাখির সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধ এবং সম্পর্কের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার প্রয়াস করা। তার জন্য পাখি পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে, অধ্যবসায়ের সঙ্গে পাখিটিকে অনুসরণ করতে হবে এবং পাখিটার সঙ্গে প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের সম্পর্ক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হতে হবে।
পাখি পর্যবেক্ষণের শুরু করতে হবে পাখিটাকে শনাক্তকরণের মাধ্যমে। পাখিটা কী প্রজাতির তার নাম কী জানতে হবে। একজন পাখি পর্যবেক্ষক হিসেবে তুমি দেখতে হবে তুমি দেখতে পাওয়া পাখিটা দেখতে কী ধরনের, পুরুষ না মহিলা, একা আছি না দলের মধ্যে আছে, খাদ্য সন্ধানে আছে না বিশ্রাম নিচ্ছে, ডানার যত্ন নিচ্ছে নাকি, পাখিটা কোথায় বসে আছে, কীভাবে বসে আছে, চুপচাপ বসে আছে না মুখ দিয়ে শব্দ করছে, তার কন্ঠস্বর কী ধরনের, হাঁটার সময় কীভাবে হাঁটছে, উড়ে যাবার সময় কীভাবে উড়ছে, একনাগারে কতটা উড়ে যাচ্ছে, গিয়ে কোথায় বসছে ইত্যাদি অনেক কথা নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করে দেখা ব্যক্তিকে আমরা ভালো পর্যবেক্ষক হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
সৌম্যদা বিরতিহীন ভাবে বলে চলেছেন।
‐ প্রথম কথা হল পাখিটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া। অপরিচিত একটি পাখির সঙ্গে পরিচিত হতে হলে প্রথমেই পাখিটার আকৃতি কী রকম নোট বইয়ে তা লিপিবদ্ধ করবে। তার জন্য কিছু পাখিকে তুলনামূলক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ছোট্ট চড়ুই একটা ছয় ইঞ্চির হলে, শালিক পাখি নয় ইঞ্চির, পায়রা তেরো ইঞ্চির, কাক সতেরো ইঞ্চির, শকুন ছয়ত্ৰিশ ইঞ্চির‐ এসব পাখিকে মাধ্যমিক হিসেবে নিয়ে তুমি দেখতে পাওয়া পাখিটা এর মধ্যে কোন মাপের ভেতরে পড়ে তা বের করে নেওয়া যেতে পারে। চড়ুই পাখির চেয়ে বড় হলে লিখবে‐- চড়ুই পাখি আর পাশে একটা যোগাত্মক চিহ্ন। ছোটো হলে লিখবে চড়ুই পাখি এবং পাশে লিখবে একটি বিয়োগ চিহ্ন। সমান হলে যোগ চিহ্নের নিচে একটা বিয়োগ চিহ্ন বসিয়ে দেবে। এভাবে শালিক, পায়রা, কাক এবং শকুনের মাধ্যমে পাখি পর্যবেক্ষণের সময় তুমি দেখতে পাওয়া পাখিটির আকৃতির মান বের করে নিতে পারবে। ক্রিকেট খেলার একজন দর্শক খেলার মাঠের কোন স্থানকে কী নামে জানা যায় না জানলে, কোন খেলোয়াড় কোথায় অবস্থান করছে জানতে অপারগ হয়। ফলে সে পরিশীলিত দর্শক হতে পারে না। সেভাবে একজন পাখি পর্যবেক্ষক পাখির শরীরের কোন স্থানকে কী নামে জানা যায় তা না জানলে তাকে পরিশীলিত পর্যবেক্ষক বলা যায় না। এবং সেই ব্যক্তি পক্ষীর পর্যবেক্ষণে কোনো মতেই সফল হতে পারেনা।
পাখির শরীরের অংশগুলির নাম মনে রাখতে পারলে অপরিচিত একটি পাখির নির্দিষ্ট স্থানগুলিতে কী বর্ণের পাখি আছে তোমরা স্থান অনুসারে নোট বইয়ে টুকে নিতে পারবে। পাখিটার শরীরে কোন রঙের প্রাধান্য বেশি, পাখির ঠোঁটটা কী রংয়ের, কত লম্বা এবং কত ছোটো তোমাদের নোট বইয়ে তা লিপিবদ্ধ করতে হবে। তারপর তোমরা লক্ষ্য করবে পাখিটার পুচ্ছাংশ। পুচ্ছাংশে কী রংয়ের প্রাধান্য লাভ করেছে, কতটা দীর্ঘ অথবা কতটা ছোটো, কোনো বিশেষত্ব রয়েছে কিনা, পুচ্ছাংশ নাচাতে থাকে না স্থির করে রাখে ইত্যাদি কথাগুলি একাদিক্রমে নোট বইয়ে লিপিবদ্ধ করবে। এভাবে লিপিবদ্ধ করার ফলে তোমার নোট বইয়ে পাখিটা সম্পূর্ণরূপে ধরা দেবে। পাখি পর্যবেক্ষণের কোনো গ্রন্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে অথবা কোনো অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করলে পাখিটাকে শনাক্ত করতে তুমি সক্ষম হবে।
সৌম্যদা অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি প্রেমিকরা কীভাবে তার কথাগুলি গ্রহণ করছে অনুধাবন করার জন্য কিছুক্ষণ মৌন হয়ে রইল। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী আগ্রহের সঙ্গে তার কথা শুনে গিয়েছে এবং বোঝার চেষ্টা করেছে।
– তোমরা বুঝতে পেরেছ কি?
– হ্যাঁ পেরেছি।
অস্ফুট কন্ঠে সবাই সমস্বরে বলে উঠল।
– তোমরা আর ও মনে রাখবে– পাখি পর্যবেক্ষণ কেবল চাক্ষুষ মাধ্যমেই করা হয় না, শ্রবণের মাধ্যমেও করা হয়। সঙ্গে পাখি পর্যবেক্ষকের নিজের বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও কিছু বিশেষ গুণ থাকা দরকার । তোমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে কীভাবে নিঃশব্দে অরণ্যে অথবা পাখি থাকা অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতে পারা যায় । তোমাদের বলেছি যে পাখির শ্রবণশক্তি অত্যন্ত প্রবল। তাই তুমি করা অত্যন্ত সাধারন একটা শব্দে একটা পাখি উড়ে চলে যেতে পারে। তুমি পরিধান করা জুতো জোড়ার ওপর গুরুত্ব দেবে, হাঁটার সময় যেন খটখট করে শব্দ না করে । আরক্ষী বা সৈনিকের প্রয়োজনীয় পোশাক- পরিচ্ছদের কিছু দোকান থাকে। তোমাদের কাছে রঙ্গিয়ার রেল জংশনের কাছে সেই ধরনের দোকান আছে । সৈনিক ব্যবহার করা কাপড়ের জুতো কিনতে পাওয়া যায়, সেটা ব্যবহার করতে পার। মনে রাখবে, পাখি পর্যবেক্ষণের সময় তুমি গুরুত্ব দিতে হবে তুমি পরিধান করা পোশাক- পরিচ্ছদের ওপরে। এ কথাও তোমাদের জেনে রাখা দরকার যে পাখির শ্রবণ শক্তির সঙ্গে পাখির দৃষ্টিশক্তিও খুব প্রখর। তাই তুমি পরিধান করা উজ্জ্বল রংয়ের পোশাক দেখলে পাখি পর্যবেক্ষণ তোমার পক্ষে সুখকর হবে না। সেই জন্য অরণ্যের সবুজের সঙ্গে খাপ খাওয়া খাকি, খয়েরি, অনুজ্জ্বল ,মেটে হলদে জলপাই সবুজ , ছাই রং ইত্যাদি অনুজ্জল রঙের পোশাক পরিধান করবে । সঙ্গে তুমি পরিধান করা কাপড় একেবারে ঢিলেঢালা হলে ভালো। অঙ্গ সঞ্চালন করার জন্য এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যেমন বুকে ভর দিয়ে এগোনোর জন্য, লাফানোর জন্য সুবিধে হয়। যতটা সম্ভব তুমি খালি চোখে পাখি পর্যবেক্ষণ করবে। বাইনোকুলারের অতিরিক্ত ব্যবহার তোমার চোখের ক্ষতি করতে পারে। পাখি পর্যবেক্ষণের সময় আলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাখির ডানার সঠিক রং প্রত্যক্ষ করতে হলে পাখি পর্যবেক্ষণের সময় আলো সবসময় পর্যবেক্ষকের মাথার পেছন দিক থেকে এলে ভালো হয়, মুখোমুখি আলো হলে অর্থাৎ সূর্যের দিকে পাখি পর্যবেক্ষণ অসুবিধা জনক। পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ঋতু বা সময় নেই। দিনের বা বছরের যে কোনো সময় পাখি পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। তবে সকালের দিকে এবং সন্ধ্যের সময় পাখি বেশি সক্রিয় হয়ে থাকে বলে সেই সময় পাখি পর্যবেক্ষণ করা ভালো। শীতের দিনে আমাদের এখানে পাখির প্রব্রজন ঘটে বলে শীতের দিনে প্রব্রজনকারী পাখি পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা। তোমরা সেই সুবিধা গ্রহণ করতে পার। ফাগুন চৈত্র মাসে শীর্ণ গাছে পাখি দেখতে ভালো,গাছের পাতার আড়াল নিতে পারেনা বলে পাখিকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। পাখি যখন বাসা তৈরি করে, ডিম পেড়ে তা দেয় তখনও পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত সময় । শেষে তোমাদের জানিয়ে রাখি – কোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে নিয়মিত ভাবে পাখি পর্যবেক্ষণ করতে হলে কৃত্রিম ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করে থেকে সহজে পাখি পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে । স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ গাছ- পাতা- লতা ব্যবহার করে তৈরি ঝোপের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে অতি সন্তর্পনে কাছ থেকে পাখি পর্যবেক্ষণ করলে খুব সুফল পাওয়া যায়।বাজারে এলুমিনিয়াম রড এবং প্যারাসুট কাপড়ের তৈরি এক ধরনের কৃত্রিম ঝোপ কিনতে পাওয়া যায় ।
সৌম্যদা সাবলীল ভাবে বর্ণনা করে গেল । তার বর্ণনা শুনে অংশগ্রহণকারীরা কৃত্রিম ঝোপের ভেতরে প্রবেশ করে পাখি পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা লাভের আনন্দ অনুভব করল ।সৌম্যদা পাখি পর্যবেক্ষণের সময় পাখির প্রতি গ্রহণ করা সাবধানতার কথাও বলল। ডিম পাড়া পাখি এবং ডিমের কোনোভাবেই অনিষ্ট করা অনুচিত ।সঙ্গে সৌম্যদা বলল কোনো কারনে পাখির ডিম বা বাচ্চা যাতে পর্যবেক্ষণকারীরা সংগ্রহ না করে । একটি একটি শ্লাইড পরিবর্তন করে সৌম্যদা বিভিন্ন পাখি দেখিয়ে গেল। সঙ্গে বলল– পাখিগুলি বিভিন্ন অবস্থানে বসবাস করে। তার মধ্যে জলাশয়, মাটি,তরুতৃণ, ঝোপ,খোড়ল,গুল্মে , বৃক্ষে বা জঙ্গলে বাসা তৈরি করে বসবাস করা পাখিগুলিকে শ্লাইডে আলাদা আলাদা ভাবে দেখানো হয়েছে। অবশ্য তার মধ্যে কিছু পাখি যেমন বার্ড বাটন কোয়েল, এক ধরনের মেটে রঙের পাখি অরণ্য, তৃণভূমি এবং এমনকি ঝোপ ঝাড়ে ও বসবাস করে।সৌম্যদা প্রায় তিনশো পাখি শ্লাইডে দেখিয়ে পাখিগুলি শনাক্তকরণের ভিত্তি এবং ইংরেজি নামগুলি মনে রাখার জন্য কী করা উচিত তার আভাস দিয়ে গেলেন।
-এই পাখিটা দেখ।কী নাম?
– বুলবুলি।
অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীরা সমস্বরে বলল।
‐- এই পাখিটার ইংরেজি নাম হল রেড- ভেনটেড বুলবুল । ভেন্ট মানে ফুটো বিষ্ঠা বের হওয়ার ফুটো। এই পাখিটাৰ বিষ্ঠা বের হওয়া ফুটো থাকা জায়গাটা লাল। তার থেকে নাম হয়েছে রেড ভেন্টেড। এভাবে এই পাখিটা টুনি পাখি। এটাও তোমরা সচরাচর দেখতে পাওয়া পাখি। ইংরেজি নাম স্কেলি-ব্রেস্টেড মুনিয়া। স্কেলি ব্রেস্টেড মানে বুকে ছাল থাকা। পাখিটা মুনিয়া ধরনের। তাই বুকে ছাল থাকা টুনি পাখির এই প্রজাতিটার ইংরেজি নাম স্কেলি ব্রেস্টেড মুনিয়া। পুনরায় একটি উদাহরণ দিচ্ছি‐ এই পাখিগুলো তোমরা দেখে থাক। অসমিয়া নাম নাচুনি চড়াই। ইংরেজি নাম হোয়াইট থ্ৰোটেড ফেন টেইল। থ্ৰোট মানে গলা। এই পাখির গলার দিকটা সাদা। অন্যদিকে ফ্যান মানে হাওয়া করা। নৃত্যরত পাখিটার পুচ্ছাংশ দেখতে পাখার মতো। এভাবে অনুবাদ করে নিলে পাখিগুলির নাম মনে রাখতে সুবিধা হবে। চেষ্টা করে দেখতে পার।
সৌম্যদা অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীদের দুই চারটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সেদিনের মতো প্রশিক্ষণ শিবির শেষ করল। সঙ্গে বলল যে আগামী বছরে ব্যবহারিকভাবে পাখির বিষয়ে শেখার জন্য পুনরায় একটি পর্যবেক্ষণ শিবিরের ব্যবস্থা করা হবে ।শিবির সমাপ্ত করার পরে বিপিন ডেকা সৌম্যদার কাছে এগিয়ে এল এবং সৌম্যদার হাত দুটি জড়িয়ে ধরল। পাখির বিষয়ে জানতে পেরে মানুষটা আপ্লুত ।
‐চোখের সামনে দেখতে থাকা কথা অথচ আমরা জানি না ।আপনি আজ আমার জীবনটা ধন্য করে দিলেন। সৌম্যদা বিপিন ডেকাকে শিবিরে উপস্থিত থাকার জন্য ধন্যবাদ জানালেন ।পাখির সঙ্গে আগে পরিচিত করে দেওয়ার জন্য এবং সৌম্যদার বই ইতিমধ্যে পড়ার জন্য সৌম্যদার বলা কথাগুলি সুনন্দ সহজে বুঝতে পারল ।সৌম্যদা বলা কথাগুলি 'অসমের পাখি পর্যবেক্ষণ'এর হাত পুঁথিতে সাবলীল ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বইটি থেকে সুনন্দ যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন