রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৩৪ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Santosh Kumar Karmakar

 হে আমার স্বদেশ- ৩৪

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(৩৪)

উত্তর ভারত ভ্রমণ শেষ করে উদার এক মন নিয়ে ভোলানাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ ১৯০৬ সনের ৭ তারিখ হাওড়া উপস্থিত হল। বাড়ি পৌছেই একটা খারাপ খবর পেল। ছেলে দেবেনকে নিয়ে মেজদাদা গোবিন্দচন্দ্র পুনরায় কলকাতা এসেছিল। প্রজ্ঞা হরিনাথকে শিয়ালদহ স্টেশনে না পাঠানোর জন্য তিনি অসন্তুষ্ট হলেন । উগ্র স্বভাবের গোবিন্দচন্দ্র তার জন্য প্রজ্ঞাকে খারাপ ভাবে গালিগালাজ করলেন । দুপুর বেলা ভাত খেতে বসে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে আধ খাওয়া অবস্থাতেই ভাতের টেবিল থেকে উঠে তিনি ডক্টর গোলাপচন্দ্র বেজবরুয়ার বাড়িতে চলে গেলেন।

প্রজ্ঞার কাছে এই সমস্ত কথা শুনে খারাপ লাগল যদিও অন্য একটি সুখবর পেয়ে লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগল। সেদিনেই স্বর্ণলতা বাড়িতে এসে জ্ঞানদাভিরামের বিয়ের বৌভাতের নিমন্ত্রণ জানাল। আগে কথা হয়েছিল যে ব্যারিস্টারি পাশ করে আসার পরে জ্ঞানদাভিরামের সঙ্গে অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো মেয়ে লতিকার বিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু কন্যা পক্ষের বিশেষ আগ্রহ এবং স্বর্ণলতার তৎপরতার জন্য বিলেত যাওয়ার আগেই জ্ঞানদাভিরামের বিয়েটা হয়ে গেল। লক্ষ্মীনাথ কাশ্মীর থেকে আসার পরের দিন ২৪ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতে জ্ঞানদাভিরামের 'বৌভাত' অনুষ্ঠিত হল। প্রজ্ঞা, অরুণা-রত্না, ভোলানাথ, হরিনাথ ,ভুবন আদি প্রত্যেকেই বৌভাতের ভোজ খেয়ে খুব আনন্দ ফুর্তি করল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকালীন সমস্ত কাজ করে স্নান করে লক্ষ্মীনাথ নাম প্রসঙ্গ করল। এক কাপ চা খেয়ে নিজের পড়ার ঘরে বসে নতুন করে আরম্ভ করা ই. মার্সডেনের 'হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া ফর স্কুল' শিক্ষক বইটি অসমিয়ায় অনুবাদ করতে লাগলেন। কাজটা আগেই করা উচিত ছিল। কিন্তু কাশ্মীর ভ্রমণে যাবার জন্য দেরি হয়ে গেল।এক পৃষ্ঠা মাত্র অনুবাদ হয়েছে, তখনই হরিনাথ ঘরে প্রবেশ করে বলল,' দাদা তেজপুর থেকে পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া এসেছেন।'

পদ্মনাথ এসেছে-হাতের কলমটা রেখে লক্ষ্মীনাথ উঠে পড়ল। আসামে শিক্ষা বিস্তার বিশেষ করে অসমিয়া মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পদ্মনাথের অবদান অপরিসীম। অসমের সভা সমিতিতে যে অসমিয়া ভাষাতেই সমস্ত কার্য চালাতে হয়, এক্ষেত্রে ও পদ্মনাথ অগ্রণী। তাছাড়া মাতৃভাষায় সাহিত্যের উন্নতির জন্য পদ্মনাথ যে একজন অক্লান্ত কর্মী এটা ও লক্ষ্মীনাথ স্বীকার করে। কিন্তু তার সম্পাদনায় প্রকাশিত 'বন্তি' যে খুব ধীর পন্থী -এটা লক্ষ্মীনাথ পছন্দ করে না। বিশেষ করে 'বন্তি'তে রাজনৈতিক প্রবন্ধ গুলি হল ' শক্ত কথা না বলে প্রশংসা করে করে' চাকরি ইত্যাদি সবকিছুতে অসমিয়াদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তোষামোদি প্রচেষ্টা চালানো। তবে মতবিরোধ থাকলেও বা এত পছন্দ না করলেও লক্ষ্মীনাথ পদ্মনাথের কর্মকে স্বীকৃতি দেয়। তাই বাইরে এসে লক্ষ্মীনাথ বারান্দায় বসে থাকা পদ্মনাথকে সম্ভাষণ জানালো এবং বয়সে ছোটো যদিও সম্মান সহকারে ডেকে এনে বৈঠকখানা ঘরে বসার জন্য অনুরোধ করল।

প্রাথমিক কুশল বার্তা আদান-প্রদানের পরে প্রজ্ঞাকে ডেকে চা মিষ্টি দিয়ে পদ্মনাথ কে আপ্যায়ন করে দুজনেই আলোচনায় মগ্ন হল।

' আপনি আমার অগ্রজপ্রতিম। আপনার বিচারবোধ আমার চেয়ে উন্নত। আপনি অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পান। আপনার কাছে দুঃখের কথা আর কী বলব?'

দীর্ঘ ভূমিকা পেতে কথা বলাটা পদ্মনাথের স্বভাব। লক্ষ্মীনাথ আধুনিক মনের মানুষ। এসব পছন্দ করে না যদিও ধৈর্য ধরে সম্মানীয় অতিথি পদ্মনাথের কথা শুনতে লাগল।

' গুয়াহাটি থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের' জোনাকী' দুই বছর প্রকাশ হয়েই পুনরায় বন্ধ হয়ে গেল। ভবিষ্যতে আর জোনাকী প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমাদের সাহিত্য পত্রিকার জগতে শূন্যতার সৃষ্টি হল।'

' হ্যাঁ বরুয়া, কথাটা ভেবে আমারও খারাপ লাগে।'

' এদিকে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকিয়ে সচেতন জনগণ আমাদের ভাষার গতি পুনরায় অনিশ্চিত হয়ে পড়া বলে বলতে শুরু করেছে। সেদিন শিলং গিয়ে আসাম ক্লাবে আমাদের ভাষার পরমহিতৈষী মেজর গর্ডন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনিও আমার মতোই একই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন ।'

'সত্যিই এটা একটা আশঙ্কার কথা হয়ে পড়েছে। কিছুদিন আগে,মানে কাশ্মীর ভ্রমনে যাওয়ার আগে, খুব শীঘ্রই কিছু একটা করব বলে আমিও অনুভব করেছিলাম।'

বিষয়টা নিয়ে আমাদের তেজপুরের অসমিয়া ভাষা উন্নতি সাধিনী সভার একটা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এই বিষয়ে সমস্ত কথা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে একটা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং সভা সর্বসম্মতভাবে এই অভাজনকে প্রস্তাবিত কাগজটির সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানায়।'

' নামকরণ হয়েছে কি?'

' হ্যাঁ, একটা নাম দেওয়া হয়েছে।'উষা','উষা' হবে প্রস্তাবিত সাহিত্য পত্রিকাটির নাম।

' নামটি ভালোই হয়েছে। আমারও মনে হয় ,এ রকম একটি মহৎ কাজের জন্য আপনিই উপযুক্ত ব্যক্তি।'

' একটা সময় আপনি সম্পাদক ছিলেন ।আপনার সম্পাদনায় দুই বছর 'জোনাকী' প্রকাশিত হয়েছিল। আপনি ভালো করেই জানেন একটি সাহিত্য পত্রিকা চালানো কাজটা খুব সহজ নয়। তার জন্য মূলধন চাই, প্রাণপাত পরিশ্রম করার জন্য দেহমনে শক্তি চাই, মনের মতো প্রবন্ধ ,লেখা আদির নিয়মিত যোগান চাই। আর চাই গ্রাহকদের আর্থিক সহায়তা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।'

' আপনি 'বিজুলী'র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন 'বন্তি'র সম্পাদনা করে চলেছেন । কাজেই সম্পাদনার কাজে আপনি আমার চেয়ে অভিজ্ঞ। আপনি চাইলে কাগজ প্রকাশিত হবেই।

লক্ষ্মীনাথ আস্থা ব্যক্ত করায় আশ্বস্ত হয়ে পদ্মনাথ বলল,' তথাপি আপনাদের মতো অগ্রজদের সহায় সহযোগিতা ছাড়া এই ধরনের গুরুদায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে অসম্ভব হবে। তার জন্যই গত ফেব্রুয়ারি থেকে শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র গোস্বামী এবং শ্রীযুক্ত সত্যনাথ বরা মহাশয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি, তারা সহমত ব্যক্ত করে সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন।'

 ভালোই হল। আপনি এগিয়ে যান।'

' তবে বেজবরুয়া মহাশয় , পত্রিকাটিকে উচ্চ মানের করে প্রকাশ করার জন্য আপনার মতো কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা নিয়মিত প্রকাশ করার কথা ভাবছি। শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র গোস্বামী, শ্রীযুক্ত সত্যনাথ বরা এবং আপনার লেখা প্রস্তাবিত 'উষা'র প্রতিটি সংখ্যায় থাকবে বলে আশা করছি। অন্যদিকে, গ্রাজুয়েট যুবকদের মধ্যে ধরেছি যোগেন্দ্র বরুয়া, কুলধর চলিহা এবং কালীকান্ত বরুয়াকে। এখন আপনি যদি প্রকাশিতব্য 'উষা'র প্রতিটি সংখ্যার জন্য অন্তত একটি করে লেখা দেবার আশ্বাস দেন, তাহলে আপনার কাছে আসার উদ্দেশ্য এবং শ্রম সার্থক হয়।'

' দেশ জাতির জন্য এই ধরনের মহান কর্মে সহযোগিতা করতে পারাটা সৌভাগ্যের কথা, বরুয়া। আশ্বাস নয়, আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম–'উষা'র প্রতিটি সংখ্যার জন্য আমি একটি করে লেখা পাঠাব।'

' দাদু ,আজকের স্টেটসম্যান কাগজে জাতীয় কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতা বালগঙ্গাধর তিলকের একটা স্টেটমেন্ট বেরিয়েছে–।'

' পড় তো।'

' তিলক বলেছেন,' স্বধর্ম মেনে চলতে হলে আমাদের স্বরাজ লাগবেই। স্বরাজ ছাড়া কোনো সামাজিক সংস্কার হতে পারে না, জাতীয় জীবনের কোনো আশাই পূর্ণ হতে পারে না।' তারপরে দেখুন, তিলক কতটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন–' স্বরাজ আমাদের জন্মস্বত্ব অধিকার।'

লক্ষ্মীনাথ ব্যবসার হিসেব দেখছিল। আসাম বেঙ্গল স্টোর্স খোলার পরে হরিনাথ ব্যবসায়িক লেনদেনের হিসেব লেখে। লক্ষ্মীনাথ প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে সেই হিসেব পরীক্ষা করে। হিসেবে একটা গন্ডগোল দেখে তার রাগ হল। তাছাড়া সকালবেলা দিয়ে যাওয়া 'স্টেটসম্যান' কাগজটা পড়ে জ্ঞানই অনভিপ্রেত সেই খবরটা বলায় তার ক্রোধ, বিরক্তি আর ও বড়ে গেল।

' এদিকে অন্য একজন উগ্রপন্থী নেতা অরবিন্দ ঘোষ দেখছি এ সমস্ত কথা খোলাখুলি ভাবেই বলে থাকেন।'

' আইসিএস পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করা অরবিন্দ ঘোষ?'

' হ্যাঁ দাদু। অরবিন্দ ঘোষের মতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা নাকি একটি জাতির জীবনীশক্তি।'

ক্রোধ বিরক্তি সামলে লক্ষ্মীনাথ বলল,' কথাটা অবশ্য মিথ্যা নয়। এমনিতেও অরবিন্দ ঘোষ এই ধরনের কথা বলতে পারেন। অরবিন্দ ঘোষ অনন্য সাধারণ মেধা, উচ্চ ডিগ্রি, অতুলনীয় বাগ্মীতার সঙ্গে অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকা পুরুষ। কিন্তু এই দুঃখিনী ভারতবর্ষে তার মতো পুরুষ কয়জন আছে, বলতো? একজন দুজন অরবিন্দ ঘোষ এত বিশাল দেশটা চালাতে পারবে না। দেশ চালানোর জন্য অন্তত একশো জন অরবিন্দ ঘোষ প্রয়োজন। ভারত মাতা কখনও একশো জন অরবিন্দ ঘোষকে জন্ম দেবে ? তাই গঙ্গাধর তিলক বা অরবিন্দ ঘোষ এভাবে বললেই হবে না।এখনই ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আসবে না। '

' তবে দাদু ,বঙ্গভঙ্গ আইন পাশ করার পরে কংগ্রেসের চরমপন্থীরা সক্রিয় হওয়ার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের সাভারকার 'অভিনব ভারত' বাংলায় সতীশচন্দ্র বসু 'অনুশীলন সমিতি' এবং আমাদের অসমে অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী 'সেবা সংঘ' ইত্যাদি উগ্রবাদী সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তারা ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়ে পড়েছেন। লেফটেন্যান্ট গভর্নর এণ্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে উগ্রপন্থীরা মেদিনীপুরের কাছে একটা ট্রেন লাইনচ্যুত করেছে । তিনি কোনো রকমে রক্ষা পেলেও ঢাকার বিচারপতি বিসি এলেনকে সন্ত্রাসবাদীরা হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে ।'

এসব লক্ষ্মীনাথ জানে। তবু এসব বলে জ্ঞান যেন বোঝাতে চাইছে যে ভারতবাসী স্বরাজ পাওয়ার জন্য জাতীয় কংগ্রেস অথবা সন্ত্রাসবাদী কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। তবে আন্তরিকতার সঙ্গে স্বদেশ প্রজাতির উন্নতি কামনা করলেও লক্ষ্মীনাথ এখনও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কথা ভাবে না, ভাবতে পারেনা। কেন ভাবতে পারো না সেটা জ্ঞানদাভিরামকে বুঝিয়ে বলার ধৈর্য-সময় তার নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল,' দেখ জ্ঞান, বিয়ে করে সংসার করলেও এখনও তোমার শরীরে যুবকের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। তার জন্যই সেইসব উগ্রবাদী ঘটনা তোমাকে এতটা রিঅ্যাক্ট করছে। কিন্তু স্বরাজ পাওয়ার উন্মাদনায় সশস্ত্র পন্থা গ্রহণ করার যুবকরা যে বোমা মেরে রেল উল্টে দিয়েছে, বন্দুক পিস্তল দিয়ে সাহেবদের গুলি করে হত্যা করছে – এসব কি সঠিক কাজ করছে?'

জ্ঞানদাভিরাম কী বলবে ভেবে পেল না।

' কী দুঃখের কথা, লেখাপড়া শিখে এই যুবকরা শিখল কিনা চোরের মতো লুকিয়ে চুরিয়ে সাহেবদের গায়ে বোমা ছুঁড়তে, বন্দুক দিয়ে সাহেবদের খুন করতে। পশুর ভেতরে শ্রেষ্ঠ পশুরাও এই ধরনের নির্লজ্জভাবে অন্যকে আক্রমণ করে না। বলি তোদের শরীরে যদি শক্তি নেই সাহস নেই এই ধরনের কাজ করতে যাস কেন ? সাপের কামড়ে অনেক লোকের মৃত্যু হচ্ছে । তবু মনুষ্য বংশ নির্বংশ করে এই পৃথিবীতে সর্পরাজ্য স্থাপন করতে পারে নি । সে গর্তে ঢুকে বোমা- ডিম পেড়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে দুই চারটি মানুষ মারা ছাড়া আর কি মহৎ কাজ করতে পেরেছে?'

' দাদু ,এভাবে বলে আপনি কিন্তু সশস্ত্র পন্থায় দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন যারা দেখছে তাদেরকে চোর বললেন। খুনি ,পশুর চেয়ে অধম এবং শেষে তাদের গর্তে লুকিয়ে থাকা সাপের সঙ্গে তুলনা করলেন!'

' নিজের লোক বলে ভেবে তোমাকেই বললাম।' কণ্ঠস্বর নামিয়ে এনে লক্ষ্মীনাথ বলল,' আমি কখনও পাবলিকলি এসব পলিটিক্যাল মতামত দিই না।'

' বন্দেমাতরম ধ্বনিকে কেন্দ্র করে দেশে যে জাতীয় জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে, এটাও তাহলে আপনি পছন্দ করেন না?'

' বন্দেমাতরম হল বঙ্কিমবাবু সৃষ্টি করা' আনন্দমঠ' এর সন্তানদের মাতৃভূমিকে বন্দনা করার মন্ত্র। বাঙালি এই ধ্বনিটিকে তাদের বীজমন্ত্র করেছে। ভালোই করেছে। শুনতে ভালো লাগে।' বন্দেমাতরম' উচ্চারণ করলে শরীরের রক্ত গরম হয়। কিন্তু বাঙালি বন্দেমাতরমের সম্মান রক্ষা করতে পারেনি। কালে অকালে যেখানে- সেখানে এই বীজ মন্ত্র উচ্চারণ করে তার মান ইজ্জত নষ্ট করে ফেলেছে। আচ্ছা বাবা জ্ঞানদাভিরাম – জ্ঞানের অলংকারে ও অভিরাম, রাজনীতর আলোচনা বন্ধ করে এখন'উষা' কাগজটি কীরকম চলছে সেই সম্পর্কে কিছু বলতো ।'

' উষা' প্রকাশ হওয়ার প্রস্তুতি পরবে পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া কলকাতার এই হাওড়ার বাড়িতে গত বছরের আগের বছর এসেছিলেন। তিনি আসার কিছুদিন আগে কাশ্মীর ভ্রমণ করে লক্ষ্মীনাথ বাড়ি ফিরেছিল। এসেই ব্যবসায় সৃষ্ট হওয়া সমস্যা গুলি দূর করতে একমাস সময় লেগে গিয়েছিল। তবু ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া অনুসারে ১৯০৭ সনের এপ্রিল মাসে 'উষা'র প্রথম বছরের প্রথম সংখ্যার জন্য লক্ষ্মীনাথ ' বাপিরাম' বলে একটি গল্প পাঠিয়েছিল। সেই সংখ্যায় হেমচন্দ্র গোস্বামীর কবিতা 'উষা', সম্পাদক পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়ার সামাজিক প্রবন্ধ ' অসমীয়া বধূ', রজনীকান্ত বদলৈর ' মনোবিজ্ঞান', নারায়ণ বরুয়ার 'খেতি' ইত্যাদি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। কাগজটির কলেবর ছিল ৩২ পৃষ্ঠার। প্রথম পৃষ্ঠায় ছিল অরুণোদয়ের ছবি। সঙ্গে সম্পাদক পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া তার নিখুঁত এবং অর্থপূর্ণ ভাষায়'উষা'র জন্মের উদ্দেশ্য তুলে ধরেছিল,'...'অরুণোদয়' হওয়ায় আসামে দিনটা' বিলাসিনী' হয়ে মনের উৎসাহে এগিয়ে গিয়েছিল। সেই উৎসাহের জোরেই আসামে ' অসাম বন্ধু 'লাভ করল।… উন্নতির কার্যক্ষেত্রে তখন পরিশ্রমী 'মৌ' ঘুরেফিরে উৎসাহ দিল। এই গেল সকাল- দুপুর- বিকেলের কথা। সময়ের স্বাভাবিক গতিতে গোধূলি এল। সন্ধে থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকী পোকা অসমীয়ার পদুলি এবং বাড়িঘর সুন্দর করতে লাগল। নিচে 'জোনাকী'র আলো, আকাশে সঙ্গে সঙ্গে তারা উঠল,' আসাম তারা'র ঝলমলানি রাতকে মধুময় করে তুলল।

… অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারও রয়েছে। তার মধ্যে মেঘ ঘনিয়ে এসে তাকে আর ও ঘোরতর করে তুলল। এই সময় 'বিজুলী'র অভাব পড়ল, স্বাভাবিক নিয়মে তারও আবির্ভাব হল। অন্ধকারে হাতরে বেড়ানো অসমীয়াকে পথ দেখিয়ে সেও যথেষ্ট উপকার করল।

… এখন 'উষা'যাত্রার শুভক্ষণ উপস্থিত হল। অসমীয়া এই শুভক্ষণে শুভযাত্রা করে জাতির উন্নতির নিশান নিয়ে, কার্যক্ষেত্রে এগোতে হবে। চিরকাল সময়ানুসারে শুভ কর্মের দিকে গুলি নির্দেশ করার জন্য' ঊষা'র আবির্ভাব।…'

সৎ প্রচেষ্টা এবং আন্তরিক নিষ্ঠার জন্য সম্পাদক পদ্মনাথ প্রবীণ সাহিত্যিকদের আশীর্বাদ লাভ করল। সঙ্গে তিনি নতুন লেখকদেরও কাছে টেনে আনতে সক্ষম হলেন। এভাবে অসমিয়া পাঠকদের ভালোবাসা ' উষা'কে আঁকড়ে রইল। পূর্ব থেকে কিছু ঘটনার জন্য ভেতরে ভেতরে এত পছন্দ না করলেও লক্ষ্মীনাথ পদ্মনাথকে প্রশংসা না করে থাকতে পারল না। এবার তিনি মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করলেন পদ্মনাথের দ্বারা সম্পাদিত 'উষা' সত্যিই অসমিয়া ভাষার একটি মানসম্পন্ন সাহিত্য পত্রিকা। লক্ষ্মীনাথ উৎসাহিত হয়ে পুনরায় তার প্রিয় কৃপাবরী লেখা দিতে আরম্ভ করল এবং ' উষা'র দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে ' কৃপাবর বরুয়ার প্রত্যাগমন'এর রম্যরচনা গুলি প্রকাশ পেতে লাগল।

ক্ষণিক চিন্তা করে জ্ঞানদাভিরাম বলল,’সম্পাদক বরুয়ার সবচেয়ে বড়ো কৃ্তিত্ব হল ‘উষা’র মাধ্যমে নবীন লেখকদের উৎসাহ দান।’

লক্ষ্মীনাথ একটা সিগারেট জ্বালাল।একটা টান দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল,’হ্যাঁ ,ঠিকই বলেছ।’

' গত দুই বছরে 'উষা'র পাতায় সিদ্ধেশ্বর গোঁহাই, প্রেমধর গোহাঁই, পদ্মধর চলিহা, রত্নকান্ত বরকাকতী, মহীচন্দ্র ভূঁঞা, সূর্য কুমার ভূঁঞা, লক্ষীকান্ত বরুয়া আদি লেখকের লেখা পড়ার সুযোগ পেলাম ।'

'উষা'র মাধ্যমে পদ্মনাথ বরুয়া ভাষার ক্ষেত্রেও কিছু কাজ করেছে।'

' কী ধরনের?'

' দেখ জ্ঞান, হেমচন্দ্র বরুয়া আমাদের ভাষায় না থাকা কিছু শব্দ তৈরি করেছিল। যেমন-সম্পাদকের শরাই, বাতরি-কাকত(খবরের কাগজ), দীপকাঠি,পানীগছা (সাগরে সৃষ্টি হওয়ার জলস্তম্ভ)। পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়াও 'উষা'য় আজিকোপতি,অনতিপলমে,ঘূরনীয়া মেজ-মেল(গোল তেবিল বৈঠক) সুকীয়া-সুকীয়া (আলাদা আলাদা),আচল,এথোন ইত্যাদি শব্দ চালু করেছেন। সাধারণভাবে দেখলে একটি নতুন শব্দ বের করা খুব একটা কঠিন নয় বলে মনে হয়। কিন্তু তা করার জন্য কত চিন্তা কত পড়াশোনা করতে হয় সেটা গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন। যাহোক,'উষা' বেঁচে থাকুক। তবে জ্ঞান, তুমিও তো লিখতে পার।'

' আমি লিখব–।'

' প্রতস্মরণীয় আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকনের বংশধর এবং ইতিহাস গবেষক রায় বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়ার পুত্র হয়ে তুমি বংশকুলের ধারাটা রক্ষা করবে না কি?'

' লিখব, ব্যারিস্টারি ডিগ্রিটা নিয়ে এসে জীবিকার একটা ব্যবস্থা করে নিয়ে লিখতে শুরু করব।'

সিগারেটে আরও একটি টান দিয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' ৩০ মার্চ(১৯০৮) তোমাদের যাত্রার তারিখ। বোম্বাই হয়ে লন্ডনে। তোমার সঙ্গে ভোলা দাদাও যাবে। অসুবিধা হবে নাকি?'

ভোলানাথের সঙ্গে যাবার কথায় জ্ঞানদাভিরাম অস্বস্তি বোধ করল। লক্ষ্মীনাথের আন্তরিক প্রচেষ্টার জন্যই প্রিন্সিপাল ক্ষীরোদ চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিধবা দিদি স্বর্ণলতার বিয়ে হল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রী লতিকার সঙ্গে জ্ঞানদাভিরামের বিয়ে হওয়ার ক্ষেত্রেও লক্ষ্মীনাথ- প্রজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাই স্বর্ণলতা- জ্ঞানদাভিরামের কাছে লক্ষ্মীনাথ একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক। জ্ঞানদাভিরাম অন্তরের গভীরতা থেকে লক্ষ্মীনাথকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। লক্ষ্মীনাথের কোনো রকম অপমান হলে বা কেউ তাকে বঞ্চনা করলে জ্ঞানদাভিরাম দুঃখ পায়। ভোলানাথ বরুয়া ব্যবসায়িক কথায় লক্ষ্মীনাথকে বঞ্চিত করেছে, অনভিপ্রেত কিছু ঘটনা নিয়ে অন্যায় ভাবে তাকে অপমানিত করেছে। তার জন্য জ্ঞানদাভিরাম ভোলানাথকে পছন্দ করে না। ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধিতে সুচতুর ভোলানাথকে সে সহ্য করতে পারে না। এরকম একজন ব্যক্তির সঙ্গে এখনও লক্ষ্মীনাথ কীভাবে সুসম্পর্ক রেখে চলেছে আর সেই মানুষটির সঙ্গে কীভাবে তাকে বিলেত যেতে বলছে, এটা জ্ঞানদাভিরামের কাছে একটা বড়ো প্রশ্ন।

' অসুবিধা মানে–। অসুবিধা হবে জেনেও

জ্ঞানদাভিরাম বলল,' এরকম একজন মানুষের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করাটা–।'

' অ্যাডজাস্ট করে নিও। সমুদ্রযাত্রার কয়েকদিন তোমার সঙ্গে একজন সিনিয়র মানুষ থাকবে, ভালোই হবে।

' লন্ডনে তাঁর কোনো কাজ আছে নাকি?'

' কাজ মানে অনেক বড়ো কাজ। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ এলাকায় রেললাইন পাতা হবে বলে জানতে পেরেছেন। তার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিভাগের মন্ত্রীর অনুমোদন আনাটা তার উদ্দেশ্য। তাছাড়া তার বিলাত দর্শনের শখ হয়েছে। বিলাতের আদব-কায়দা জানেন না, পথঘাট চেনেন না। তার জন্যই তোমার সঙ্গে যেতে চাইছে। বিলেতে থাকা দিনগুলি তাকে সাহায্য করবে। এদিকে আমি তাকে তোমায় ২০০০ টাকা লোন দিতে বলেছি। তোমার জন্য সেটা একটা উপকার হবে। টাকা পেয়েছি বলে একটা রসিদ লিখে দেবে।

' কিন্তু লতিকাকে ছেড়ে এতদিন মানে প্রায় দেড় বছর লন্ডনে থাকবে। ধূমায়িত সিগারেট হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে লক্ষ্মীনাথ বলল,' পারবে থাকতে?'

লজ্জিত ভাবে হেসে জ্ঞানদাভিরাম বলল,' পারতে হবে।'

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লক্ষ্মীনাথ কাঠের ব্যবসাটা মোটামুটি ভাবে সুস্থির এক অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হল। আরও উন্নতি করতে পারত। কিন্তু বি ব্রাদার্স কোম্পানির জন্য লক্ষ্মীনাথ যে আন্তরিকতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিল, হরিনাথ তা করে না। সেই ধরনের দায়িত্ববোধ, কর্তব্য নিষ্ঠা হরিনাথের নেই। তার জন্য লক্ষ্মীনাথ তাকে গালিগালাজ করে। মাথা নিচু করে হরিনাথ গালি শোনে, অথচ তার চরিত্রের কোনো সংশোধন হয় না।

লেখালেখির ক্ষেত্রে এই বছর লক্ষ্মীনাথের বেশ ভালোই অগ্রগতি হয়েছে।'উষা'য় খন্ড খন্ড ভাবে প্রকাশ পেতে থাকা কৃপাবরী রম্য রচনা গুলির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেল। তাছাড়া সে 'জোনাকী' তে প্রকাশিত গল্পগুলির একটি সংকলন বের করবে বলে ভাবল। পিতা দীননাথ বেজবরুয়াকে নিয়ে একটা জীবনী গ্রন্থ লিখবে বলেও পরিকল্পনা করল।

তখনই একটা শোকাবহ ঘটনা ঘটল। ঘটনাটা হল রায় বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়ার মৃত্যু। অসুস্থ শরীরে তিনি যোরহাট থেকে কলকাতা আসছিলেন উন্নত চিকিৎসা লাভের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ডাক্তার তাকে সুস্থ করে তুলতে পারল না। ১৯০৭ সনের ২১ এপ্রিল ৫১ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। খবরটা শোনা মাত্র ডবসন রোড থেকে ভুবনকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ লোয়ার সার্কুলার রোডে গিয়ে উপস্থিত হল। ব্রিটিশ সরকার দেওয়া চাকরিতে প্রবেশ না করে নিজের কর্মকুশলতায় চা-এর চাষ করে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে অসমের অর্থনৈতিক এবং অসমিয়া জাতীয় জীবনের উন্নতির জন্য অহোপুরুষার্থ করা , ইংরেজি ভাষায় সুবক্তা রায় বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়াকে অন্তিম শয়নে দেখে শোকে দুঃখে লক্ষ্মীনাথের চোখ ছল ছল করে এল। তারপরে কলকাতায় থাকা অসমিয়া লোকজনকে ডেকে এনে তার শবদেহ শোভাযাত্রা করে নিমতলা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ সংস্কার করল।

এদিকে লক্ষ্মীনাথের বাড়ির সব কিছু ঠিকঠাক চলছে। অসম থেকে আত্মীয়-স্বজন আসা চলছেই। তারা লক্ষ্মীনাথের বাড়িতে থেকে কলকাতা বেড়ানো ছাড়া পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শন করার জন্য যায়। কাঠের ব্যবসায় নিযুক্ত হরিনাথ ম্যানেজার হিসেবে সফল হল না। সে হেমপ্রভা নামে একটি মেয়েকে ভালোবাসে। সেটা জানতে পেরে উদারমনা লক্ষ্মীনাথ মেয়েটির সঙ্গে হরিনাথের বিয়ে দিয়ে দিল।

এখন বৈবাহিক জীবনযাপন করার জন্য হরিনাথের আলাদা একটি ঘরের প্রয়োজন। এদিকে কটক থেকে মেয়েদের নিয়ে স্বর্ণলতা আসে। কলকাতায় থাকলে লতিকাকে নিয়ে জ্ঞানদাভিরাম ও এই বাড়িতে দুই চার দিন থাকতে ভালোবাসে। তাই আরও ঘরের প্রয়োজন। লক্ষ্মীনাথ পাকা মিস্ত্রি লাগিয়ে' লরেলসের' উপরমহলে চারটি ঘর নির্মাণ করালো। তারপরে পুরো বাড়িটা নতুন করে চুনকাম করানোর পরে হাওড়া অঞ্চলে লরেলস একটা দর্শনীয় বাড়ি হয়ে উঠল।

বৈষয়িক এই সমৃদ্ধি আনন্দ দিলেও মৃত্যুশোকে রাজসিক গুণসম্পন্ন সাহসী কর্মীকেও স্থগিত করে দেয়। ১৯০৭ সনের ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ১৯ নম্বর রোজমেরি লেনের বাড়িতে লক্ষ্মীনাথের দাদা ডঃ গোলাপ বেজবরুয়ার আকস্মিকভাবে মৃত্যু হল। পিতা দীননাথ বেজবরুয়া স্বর্গগামী হয়েছেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ব্রজনাথ পরলোকে চলে গেছেন। তাদের মৃত্যু দেখেনি। কিন্তু পরম আত্মীয়ের মৃত্যু যে কত মর্মদাহী হয়, তা এবার ডাঃ বেজবরুয়ার মৃত্যু শয্যার কাছে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীনাথ নিদারুণ ভাবে অনুভব করল।

ডাঃ বেজবরুয়ার জীবনটা মসৃণ ছিল না । পিতার মতের বিরুদ্ধে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়েছিলেন । মেডিকেলের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য মেজ দাদা গোবিন্দচন্দ্র তাকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিল। সেখানে আর্থিক কষ্টে পড়ে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার জন্য বাড়ির সবাই অসন্তুষ্ট হয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। সেই অভিমানে তিনি আর কখনও আসাম যাননি। কিন্তু কলকাতায় পড়তে এসে লক্ষ্মীনাথ যখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, তখন আমেরিকা থেকে গোলাপ বেজবরুয়া লক্ষ্মীনাথের পড়াশোনা এবং মেসে থাকা খাওয়ার জন্য প্রতি মাসে অন্ততপক্ষে ২৫ টাকা করে পাঠিয়েছিল। তখনকার দিনে লক্ষ্মীনাথের জন্য সেই টাকা পর্যাপ্ত ছিল। মেসের খরচ, কলেজের ফিস দিয়েও সাহিত্য দর্শনের বই কিনে পড়ে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করেছিল, থিয়েটার দেখে আনন্দ উপভোগ করেছিল ।

তারপরে জীবিকার সন্ধান নিয়ে ডাঃবেজবরুয়া সাউথ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন। সেখানে বেশিদিন থাকতে না পেরে কলকাতায় এসে ডাক্তারি করতে শুরু করেছিলেন। বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্কটা ছিল প্রকৃতার্থে দাদা ভাইয়ের। তিনি যখন বাড়িতে এসে 'লখী' বলে ডাক দিয়ে সামনে দাঁড়াতেন লক্ষ্মীনাথ তখন তার প্রতি ভালোবাসার টান অনুভব করতেন। তাই গত বছর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ একদিন বিকেলে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বাড়িতে এসে যখন বললেন পাশের বাড়ির একজন ফিরিঙ্গি তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে– জ্ঞানদাভিরামকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ তখনই তার বাড়িতে গিয়ে গোলাবাড়ি থানার একজন পুলিশকে তার পাহারায় রেখে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল। ধর্মান্তরিত হয়ে দুটো ছেলে থাকা একজন বিধবা মহিলাকে বিয়ে করার জন্য লক্ষ্মীনাথ কখনও তাকে খারাপ চোখে দেখেনি। একই মা না হলেও ডঃ গোলাপ বেজবরুয়া এবং লক্ষ্মীনাথ একই পিতার সন্তান। কেবল সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই লক্ষ্মীনাথ তাকে ভালোবেসে এসেছে।

পরলোকগত ডাঃ গোলাপ বেজবরুয়ার বিদেহী আত্মা যাতে শান্তি পায়, তার জন্য লক্ষ্মীনাথ সমস্ত ব্যবস্থা করল। শোক–মন খারাপ সামলে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ ডবসন রোডে থাকা ব্রাউন এণ্ড কোম্পানিকে খবর দিল। কোম্পানির মানুষ এল। ক্রিশ্চান ধর্ম মতে মৃতদেহ সৎকার করার জন্য লক্ষ্মীনাথ ১০০ টাকা বের করে দিল। কোম্পানির মানুষ হার্স বা মৃতদেহকে কবরে নিয়ে যাবার জন্য গাড়িটা এনে শোকযাত্রা করে লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরখানায় নিয়ে গেল। এতোটুকুতেই লক্ষ্মীনাথের দায়িত্ব শেষ হল না।ডাঃ বেজব্রুয়া ১৯ নম্বর রোজমেরির ভাড়া ঘরটির আসবাবপত্র বিক্রি করে বাকি থাকা ঘর ভাড়া পরিশোধ করে বাড়িটা ছেড়ে দিল। তারপরে ডাঃ বেজবরুয়ার গাড়িটা ২০০ টাকায় বিক্রি করে সেই টাকা বিধবাকে দিয়ে টিকিয়াপাড়ায় থাকা তার মায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।

দাদা ডাঃ গোলাপ বেজবরুয়ার মৃত্যুর পরই লক্ষ্মীনাথ মৃত্যুর শোক থেকে রেহাই পেল না। চার মাস পার না হতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষিতীন্দ্রনাথের পত্নী এবং তার দুদিন পরে প্রজ্ঞার বড়ো দাদা হিতেন্দ্রনাথের মৃত্যু হল। প্রজ্ঞার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরে লক্ষীনাথ যখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ছিল, তখন এই হিতেন্দ্রনাথ ও তাকে 'ষোলো আনা বাঙালি' করে বাংলায় লিখতে উৎসাহিত করেছিল। পরে যখন দেখল লক্ষ্মীনাথ একটা' বশে আনতে না পারা জেব্রা', তখন তারা সেই প্রচেষ্টা ছেড়ে লক্ষ্মীনাথের ব্যক্তিত্বকে সম্মান করতে শুরু করেছিল এবং আন্তরিক আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছিল।

ঠাকুরবাড়ির এই দুটো মৃত্যুতেই মৃত্যুর শোভাযাত্রা শেষ হল না। শিবসাগর থেকে দাদা জগন্নাথ বেজবরুয়া, বৌদিরা এলেন কলকাতা এবং গয়া ভ্রমণ করার জন্য। একদিন কলকাতায় থেকে কালীঘাট দর্শন করে গয়ায় যাবার দ্বিতীয় দিনেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বৌদির মৃত্যু হল। লক্ষ্মীনাথ জানে মৃত্যু অপ্রতিরোধ‍্য, অমোঘ, মৃত্যুকে কেউ জয় করতে পারে না। সমস্ত সুখ- সম্ভাবনায় সুন্দর নিষ্পাপ একটি পরিবারে এই মৃত্যু যে কী নির্মম এবং কী ধরনের করাল রূপ ধারণ করে, সেটা স্বর্গীয় গুণাভিরাম বরুয়ার পরিবারে দেখতে পেয়েছিল। এখন সেরকম একটি রূপ লক্ষীনাথ নিজের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে দেখতে পেল। সন্ত্রস্ত মনে সে ভাবল, তার সামনে আর কোনো মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে নাকি? কিন্তু নেই, গয়ায় লক্ষ্মীনাথের ছোটো বৌদির মৃত্যুর পরের দিন( ১৯০৮ সনের ৪ নভেম্বর) প্রসব বেদনায় অশেষ কষ্ট পাওয়ার পরে প্রজ্ঞা আরও একটি কন্যা শিশুর জন্মদান করল।

মৃত্যুর পরে জন্ম সবসময়ই আনন্দের। কিন্তু তিনটি কন্যার পরে চতুর্থ কন্যার জন্ম বাড়িতে আনন্দ বহন করে আনল না। আশা ভঙ্গ হওয়ার হতাশায় লক্ষ্মীনাথের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। তা বলে সে কারও সামনে সেই হতাশার বেদনা প্রকাশ করল না।

একনাগারে তিন দিন কষ্ট পাওয়ার পরে শিশুকন্যাটিকে জন্ম দিয়ে সীমাহীন দুর্বলতায় প্রজ্ঞা বিছানায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। লক্ষ্মীনাথ বিছানার কাছে আসতেই প্রজ্ঞা চোখ মেলে তাকাল। অসহায় করুন চাহনি। দেখতে দেখতে প্রজ্ঞার দুই চোখ জলে ভরে উঠল।

' তোমার চোখে জল!'

' পারলাম না।' প্রজ্ঞা কেঁদে ফেলল,' এবারও তোমাকে ছেলের মুখ দেখাতে পারলাম না।'

লক্ষ্মীনাথ বিচলিত বোধ করল। বিছানার কাছে বসে পত্নীর ডান হাতটা টেনে নিয়ে আদর করে বলল,' ছেলের মুখ দেখাতে না পারাটা কি তোমার দোষ? পরমেশ্বর যা দিয়েছেন, তাই আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে।'

' তবু–।'

' ওভাবে কেঁদ না,পরী। কাঁদলে আমাদের হয়ে যে এসেছে, তার অকল্যাণ হবে।'

মঙ্গলের মধ্যেও কখনও অমঙ্গলের কিছু সূচনা থাকে। তবে সেই সব নিয়ে লক্ষ্মীনাথ এতটা ভাবেনা। পৈতৃক সূত্রে ধর্মীয় নৈষ্ঠিকতা পেলেও ধর্মীয় আচার-সংস্কার তার চেতনা বোধকে বেঁধে রাখতে পারেনি।‌ আসলে সে জ্ঞান পিপাসু। বিচার বিশ্লেষণে আধুনিক মনের মানুষ। আধুনিক জীবনের জন্য তাকে বাস্তব চেতনা সম্পন্ন হতেই হবে। ব্যবসায়িক ব্যস্ততার মধ্যেও পূর্বের পরিকল্পনা অনুসরণ করে নতুন বছরের( ১৯০৯ সন) তিন মাস পার না হতেই সে প্রথম গল্প সংকলন বের করল। পরলোকবাসিনী প্রথম সন্তান আদরের সুরভির নাম অনুসারে বইটির নাম রাখল 'সুরভি'। সঙ্গে প্রকাশ করল কৃপাবরী সাহিত্য ' কৃপাবর বরুয়ার প্রত্যাবর্তন' এবং স্বর্গীয় পিতৃ দেবকে নিবেদনার্থে বের করল' দীননাথ বরুয়ার জীবন চরিত'। লক্ষ্মীনাথের কাছে নিজে রচনা করা বই প্রকাশ করা হল আত্মতৃপ্তি। বই প্রকাশ করার পরে কলকাতায় পড়তে থাকা অসমিয়া ছাত্র, পরিচিত অসমিয়া ব্যক্তি এবং অসমের অনুরাগী পাঠকদের কাছ থেকে যে ধরনের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেল, সেটাও আনন্দদায়ক। তথাপি লক্ষ্মীনাথ সন্তুষ্ট হতে পারল না।তাঁর সৃষ্টিকর্ম শেষ হয়নি ।সে আরও লিখবে। তার আরও অনেক লেখার আছে।

এর মধ্যে একদিন গোধূলির আগেই হরিনাথ বাড়িতে এসে লক্ষ্মীনাথের খোঁজ করল। লক্ষ্মীনাথ বাড়িতে নেই।তাঁর তার খোঁজে হরিনাথ ইন্ডিয়া ক্লাবে গেল।

ইন্ডিয়া ক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করে হরিনাম দেখল, একজন সাহেবের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ বিলিয়ার্ড খেলায় মগ্ন। হাতে বিলিয়ার্ডের স্টিক ,মুখে সিগার। দাদাকে ডাকতে ইতস্তত করছিল। লক্ষ্মীনাথ হরিনাথ কে দেখতে পেল। তার মুখের দিকে তাকিয়েই লক্ষ্মীনাথ অনুমান করল, নিশ্চয় কোনো অঘটন ঘটেছে। তবু নিজের দানটা খেলে প্রতিদ্বন্দ্বী সাহেব খেলোয়াড়কে 'এক্সকিউজ মি মিস্টার রাইট' বলে স্টিকটা হাতে নিয়ে ভাইয়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল‐ 'কী হয়েছে ,ক্লাবে আসতে হল যে?'

কণ্ঠস্বর নামিয়ে এনে হরিনাথ বলল‐-' অসম থেকে তোমার নামে একটা চিঠি এসেছে।'

' কীসের চিঠি?'

' তোমার নামে অসাম সরকার আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছে।'

' কীসের জন্য?'

' আমি ভালো করে বুঝতে পারছি না ।তুমি এসে দেখে যাও।'

মুখ থেকে সিগারেটটা নামিয়ে রেখে লক্ষ্মীনাথ কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপরে বলল আচ্ছা তুই বাড়িতে যা আমি গেমটা শেষ করে আসছি।'

হরিনাথ ক্লাব থেকে বের হয়ে গেল। লক্ষ্মীনাথ মিস্টার রাইটের সঙ্গে পুনরায় বিলিয়ার্ড খেলতে শুরু করল যদিও আগের মতো মনসংযোগ করতে পারল নাং


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...