হে আমার স্বদেশ- ৩২
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(৩২)
যোরহাটে আসার পরে প্রত্যেকদিনই বি এ জগন্নাথ বরুয়া গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। গাড়িতে এসে বরুয়ার বিশাল বৈঠকখানা ঘরে বসে কথাবার্তা হয়। এখন শিক্ষিত যোরহাটবাসী জনগণের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ একজন পরিচিত সাহিত্যিক। কলকাতা থেকে লক্ষ্মীনাথ এসেছে জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য যোরহাটের সাহিত্য অনুরাগী নাগরিকরা এলেন। লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করে অসমিয়া সাহিত্য এবং দেশ বিদেশের কথা আলোচনা করে তাঁরা আনন্দিত হলেন।
বকাবকি করলেও গোবিন্দচন্দ্র স্নেহপ্রবণ।মনটাও উদার।ভাই লক্ষ্মীনাথ কলকাতার ঠাকুর পরিবারের জামাই এবং বর্তমান অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তি। মুখে না বললেও এই সমস্ত ভেবে ভেতরে ভেতরে তিনি গৌরব অনুভব করেন।ছয় দিন থাকার পরে যোরহাট থেকে গোলাঘাটে রওয়ানা হওয়ার দিন গোবিন্দচন্দ্র ভাইয়ের বউ প্রজ্ঞাকে মুক্তা খচিত সোনার আংটি এবং ভাইঝি অরুণা-রত্নাকে মনির মালা উপহার দিলেন। তারপর তিনি নিজেই যোরহাট রেল স্টেশনে গিয়ে তাদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে বিদায় জানালেন।
রাত সাতটার সময় লক্ষ্মীনাথ কমারবান্দা এসে পৌছাল। রেলস্টেশন থাকলেও কমারবন্দা একটি পুরোনো গ্রাম। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো নয়। দাদা শ্রীনাথকে একটি ঘোড়ার গাড়ি এবং একটি গরুর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করে থাকতে দেখে লক্ষ্মীনাথ নিশ্চিত হল।
লক্ষ্মীনাথের ওপরের দাদা হল শ্রীনাথ। দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান বেশি নয়। অনেকদিন পরে দেখা হওয়ার মুহূর্তে লক্ষ্মীনাথের শ্রীনাথের বিয়ে করার ঘটনাটা মনে পড়ল। শ্রীনাথ বিয়ে করেছিল' অসম বুরঞ্জী'র লেখক কাশীনাথ তামুলী ফুকনের জ্যেষ্ঠ পুত্র কমলা নাথ ফুকনের মেয়েকে। বয়সে ছোটো হলেও লক্ষ্মীনাথ এই বিয়ের দুর্ঘোর প্রতিবাদ করেছিল। কারণ, তখন শ্রীনাথ ছিল স্কুলের ছাত্র। সে ছিল সরল মনের যুবক। লক্ষ্মীনাথ বুঝিয়ে-সুজিয়ে শ্রীনাথকে বিয়ে না করার জন্য রাজি করিয়েছিল। কিন্তু বাড়ির বড়োদের চাপে সে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। শ্রীনাথের বিয়ে সম্পাদিত হল, প্রত্যেকেই ভোজ-ভাত খেয়ে আনন্দ করল। কিন্তু বিয়ের পরেই শ্রীনাথের ছাত্র জীবনের অন্ত পড়ল। এই ঘটনাটি লক্ষ্মীনাথকে খুব কষ্ট দিয়েছিল।
প্রজ্ঞা, মেয়ে দুটি এবং আয়াকে গরুর গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে চাকর ভাগরথীকে নিয়ে শ্রীনাথ এবং লক্ষ্মীনাথ ঘোড়ার গাড়ি করে গোলাঘাট পৌঁছাতে রাত সাড়ে নটা বেজে গেল। লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞাদের নিয়ে গোলাঘাটের ডাকবাংলোয় থাকবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু নিজের বাড়ি থাকতে ভাই, ভাইয়ের পরিবার নিয়ে ডাকবাংলোয় থাকাটা শ্রীনাথের পক্ষে লজ্জার কথা।এদিকে লক্ষ্মীনাথ এখন আর ছাপোষা মানুষ নয়। কথাবার্তা, চালচলন, পোশাকে পরিচ্ছদে আধুনিক, একেবারে সাহেব। ভাইয়ের বউ ও সাধারণ বাঙালি ঘরের কন্যা নয়। কলকাতার উচ্চশিক্ষিত এবং অভিজাত বাঙালিদের শিরের মুকুট ঠাকুরবংশের কন্যা। শ্রীনাথ দুটো লোক লাগিয়ে বাড়িতে তাঁবু তৈরি করে লক্ষ্মীনাথ- প্রজ্ঞার থাকার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করলেন।
এইসব দেখে লক্ষ্মীনাথ–প্রজ্ঞা আশ্চর্য হল। দাদার অনাবিল স্নেহ অনুভব করে আপ্লুত হল। এদিকে রূপসী বৌমা স্নেহের নাতনি দুজনকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ এত বছর পরে এসেছে– মা ঠানেশ্বরী ও খুব আনন্দিত হলেন। আকুল ভাবে আত্মজাদের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে ঠানেশ্বরী আদর করতে লাগলেন। আদর করার সময় তার দুচোখ দিয়ে অবিরল ধারায় আনন্দাশ্রু বইতে লাগল। তারপরে আবেগ সামলে কলকাতায় থাকা ডক্টর গোলাপ বেজবরুয়া এবং হরিনাথের কথা জিজ্ঞেস করলেন। প্রজ্ঞার মা এবং তিন দাদার শারীরিক কুশল বার্তা নিলেন। লক্ষ্মীনাথ আশঙ্কা করেছিল গোলাপ দাদা ছেলে মেয়ে সহ বিধবা মহিলাকে বিয়ে করায় গোবিন্দ দাদার মতো মা ও হয়তো নানা কথা বলবে। কিন্তু ঠানেশ্বরীর বয়স হয়েছে। বার্ধক্য জনিত কিছু অসুখ তাকে দুর্বল করে ফেলেছে। তিনি আর কতদিন এই সংসারে বেঁচে থাকবেন? তাই নতুন যুগের নতুন জীবন বিন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি আর কাউকে আগের নীতি- নিয়মে চালাতে পারবেন না।
স্নেহময়ী ঠানেশ্বরী, স্নেহশীল শ্রীনাথ দাদা, শৈশবে অত্যন্ত আদর করা বৌদি, ভাইপো ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞা বড়ো আনন্দে দুটো দিন কাটাল। সবাই আপন, প্রত্যেকে প্রত্যেকের কথা ভাবে। কার ও সঙ্গে সংঘাত নেই। নেই কোনো বাদ- প্রতিবাদ। এখানে কৃত্রিম আভিজাত্যের অহংকারে জীবন ভারাক্রান্ত নয়। এখানে জীবনের ধারা নিস্তরঙ্গ, সহজ সরলতায় স্বচ্ছন্দ।
গোলাঘাটে থাকা দুটোদিনেও অনেক মানুষ বাড়িতে এসে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা বলল। মহিলাদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ হল প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। তাকে দেখে, তার সঙ্গে দু একটি কথা বলে সুন্দর সাজ পোশাক পরা ফুলের মত কোমল অরুণা- রত্নাকে আদর করে খুব খুশি হল। দূর থেকে এসব দেখে লক্ষ্মীনাথ ও ভেতরে ভেতরে ভাবুক হয়ে পড়ল। এরাই অসমিয়া মানুষ। এদের অন্তরে এত ভালোবাসা। তবে এখন ও অধিকাংশই অশিক্ষিত, গোলাঘাটের বাইরের জগতটিতে কী ঘটছে কিছুই জানে না। জানার প্রয়োজন ও অনুভব করে না। এই সমস্ত লোক কবে দেশ জাতি সম্পর্কে সচেতন হবে? কবে নিজের সঙ্গে দেশের উন্নতির কথা ভাববে?
অবশেষে মা ঠানেশ্বরী এবং বাড়ির সবার কাছ থেকে লক্ষ্মীনাথ বিদায় নিল। গরুর গাড়িতে সবাইকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ পুনরায় কমারবন্ধা স্টেশনে এল। রাত দুটোর সময় ডিব্রুগড়গামী এবি ট্রেইনের রিজার্ভ কামরায় উঠল। পরের দিন দুটোর সময় তিনসুকিয়া পৌঁছাল। লক্ষ্মীনাথ টেলিগ্রাম করে চন্দ্রকুমার আগরওয়ালাকে তাদের আসার কথা জানিয়েছিল। সেই অনুসারে চন্দ্র কুমার স্টেশনে এসে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করল। তিনসুকিয়া থেকে ডিব্রুগড় সদিয়া ট্রেনে বিকেল চারটার সময় লাহোয়াল স্টেশনে নামল। প্রজ্ঞা, অরুণা, রত্না এবং আয়াকে একটা গরুর গাড়িতে উঠিয়ে দিল। তারপর অন্তরঙ্গ দুই বন্ধু লক্ষ্মীনাথ এবং চন্দ্রকুমার গরুর গাড়ির পেছন পেছন তামোলবারীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
তেজপুরের পুরোনো প্রেছ ছাড়াও কলকাতায় 'আসাম -বেঙ্গল প্রেছ' চালিয়ে চন্দ্র কুমার অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের সেবা করে চলেছে। একই সঙ্গে সে একজন সফল ব্যবসায়ী। চন্দ্রকুমার ইতিমধ্যে কয়েকটি চা বাগান কিনে চা চাষ করতে শুরু করেছে। তেজপুরের চা বাগান কয়টি ছাড়াও উজানে এই তামোলবারীতে চা বাগান কিনেছে। তার জন্য তাকে কখনও তেজপুর, কখন ও কলকাতা, আবার কখনও তামোলবারীতে এসে থাকতে হয়।
বিকেল চারটার সময় লাহোয়াল স্টেশন থেকে তারা হাঁটতে শুরু করে। তামোল বারী পৌঁছতে গোধূলি হয়ে যাবে। একনাগাড়ে দু'ঘণ্টা সময় পায়ে হাঁটা… তবে লক্ষ্মীনাথের অসুবিধা হচ্ছে না। অনেকদিন পরে বন্ধু চন্দ্রকুমার সঙ্গে থাকার জন্যই কোনো অসুবিধা অনুভব করছেন না। অসমের মাটিতে হেঁটেছেন। গাছপালায় সমৃদ্ধ ছায়া শীতল গ্রাম, দুপাশের মাঠে ফলে থাকা ধান ক্ষেত এবং বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজ চা বাগানের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় লক্ষ্মীনাথ মাটির গন্ধ পাচ্ছেন। শৈশবে বাবার সঙ্গে জলপথে অসমের বিভিন্ন জায়গায় যাবার সময় অথবা নিজে কলকাতায় জলপথে যাওয়া আসা করার সময় যে অসমকে দেখেছিল… তার চেয়ে উজানের এই অসম আলাদা। উজানের এই অসমের মাটি আর ও সারবান, এই অসমের প্রকৃতি আর ও বেশি নিবিড় এবং রহস্যময়। লক্ষ্মীনাথ দেখছেন, গলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আকুল আগ্রহে দেখছেন।
' বেজ, তোমার জন্য একটা গাড়ি জোগাড় করতে পারলাম না। এভাবে হাটতে তোমার বোধহয় কষ্ট হচ্ছে।'
লক্ষ্মীনাথ হাসতে হাসতে বলল,' মাজিউ তোমার সঙ্গটা আমার কাছে বড়ো আনন্দের। তুমি সঙ্গে থাকলে আমার কোনো কষ্টই কষ্ট বলে মনে হয় না।'
' তবু গোলাঘাট থেকে সবাইকে নিয়ে এখানে এভাবে আসাটা‐‐-।'
' কী কথা বলছ?এবার অসম আসার পরে তোমার কথা মনে পড়ছিল। তোমার সঙ্গে দেখা না করে কলকাতায় ফিরে গেলে খুব খারাপ লাগত।'
' আচ্ছা ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে তোমার ব্যবসায়িক সমস্যাগুলির সমাধান হয়েছে?'
' এখন ও সবকিছুর নিষ্পত্তি হয়নি। তার জন্য আমি তাকে চাপ দিচ্ছি না। গ্রেগরি কোম্পানি থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে নিজের মতো ব্যবসা করছি। শিব সাগর থেকে হরিনাথকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ব্যবসা শিখিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছি। তবে‐-।'
' আর কোনো সমস্যা?'
' এত চেষ্টা করছি তবু ব্যবসাটা ঠিক জমাট বাঁধছে না। কিছু কিছু কথায়, বিশেষ করে নতুন কিছু কন্ট্রাক্টে ফেইলিওর হয়েছি। আমার উপরে পার্টিদের আস্থা কম দেখছি। এদিকে সেদিন যোরহাটের মেজদাদা মানে গোবিন্দ দাদা বিজনেসের কথা শুনে আমাকে ডিসকারেজ করেছে।'
' পার্টনারশিপ বিজনেস ছেড়ে নিজের করে আরম্ভ করা বিজনেসের শুরুতে কিছুটা সমস্যা হয়। পার্টনারশিপ বিজনেসে দায়িত্বের ভাগ ভাগ করা থাকে। পার্সোনাল বিজনেসে সমস্ত দায়িত্ব একা বহন করতে হয়।একাই চারদিক দেখতে হয়।'
'ঠিকই বলেছ। স্বাধীন ব্যবসায়ী হিসেবে আমি সফল হতে পারিনি।এদিকে কলকাতার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আমার মনে একটা ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে। কলকাতায় থাকার সময় রাজনৈতিক কাণ্ডকারখানা নিয়ে আমার মনোভাবটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।অসমে এসে সেদিন জগন্নাথ বরুয়ার সঙ্গে কথা বলে ক্রাইসিসটা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।'
‘কথাটা ভেঙ্গে বুঝিয়ে বলতো।’
‘মানে কলকাতায় ‘জোনাকী’প্রকাশ করার সময় আমরা রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে ভাষা-সাহিত্যের উন্নতির মাধ্যমে স্বজাতির উন্নতির শপথ গ্রহণ করেছিলাম। এখন দেখছি,রবিকাকা আই মীন,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিও বঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়েছেন।এদিকে জগন্নাথ বরুয়ার মতো মানুষও বললেন,রাজনৈ্তিক স্বাধীনতা না থাকলে নাকি দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব নয়।’
চন্দ্রকুমার চিন্তিত হয়ে পড়ল।আলোচনা গভীর হয়ে উঠার জন্য তাঁদের হাঁটার গতি কমে এল।তারফলে আগে আগে যেতে থাকা গরুর গাড়ি এবং তাঁদের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে গেল।সেটা দেখে গরুর গাড়িতে বসে পেছনে বাবাকে দেখতে থাকা অরুণা চিৎকার করে উঠল,’পাপা,ও পাপা তুমি কত পিছিয়ে পড়েছ।পা চালিয়ে তাড়াতাড়ি এসো।’
লক্ষ্মীনাথ হাত তুলে অরুণাকে আশ্বস্ত করে হাঁটার গতি বাড়াল।তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চন্দ্রকুমার বলল,’এসব তো তাত্ত্বিক কথা।রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নেমেছে,বাঙালির স্বার্থে বাঙালি কবি হিসেবে তাকে তো আন্দোলনে নামতেই হবে।এইধরনের কাজ তুমিও করছ।এমনিতেও রবীন্দ্রনাথের কথাটা একটু আলাদা।তোমার-আমার মতো তাকে ব্যবসা করে জীবন ধারণ করতে হয় না।এই মুহূর্তে ব্যবসা করতে গিয়ে শাসক ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলে আমাদের কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। তাই ব্রিটিশের সঙ্গে আমাদের আপোষ করার নীতিই মেনে চলতে হবে।’
চন্দ্রকুমার বলা শেষের কথাগুলি লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগল না। তা বলে কথাটার বিরুদ্ধাচারণ ও করল না।অনেকক্ষণ নীরবে হেঁটে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে লক্ষ্মীনাথ বলল ,’বুঝেছ মাজিউ,এবার অসমে এসে আমি অন্য একটি জিনিস পেয়েছি।’
‘কী পেয়েছ?’
‘যোরহাট,গোলাঘাট যেখানেই গিয়েছি–মানুষের সমাদর পেয়েছি,ভালোবাসা পেয়েছি।’
‘তার কারণ তোমার অপূর্ব লেখনি। তোমার লেখায় অসমের মানুষ নিজেকে খুঁজে পেয়েছে।তুমি তোমার লেখনিতে তাঁদের অন্তরের কথা,আত্মার কথা ব্যক্ত করতে পেরেছ।অন্যদিকে,আমি তোমাকে আগেই বলেছি–আমরা রাজনীতি করা মানুষ নই।রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার চেয়ে লেখার মাধ্যমেই আমরা স্বদেশ-স্বজাতির উন্নতি সাধন করতে হবে।আর দেখ বেজ,তোমার লেখনির শক্তি আমাদের সবার চেয়ে বেশি।সেটা লক্ষ্য করে অসমিয়া জাতি তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে।আমার বিশ্বাস,তুমি অসমিয়াদের আশা পূরণ করতে পারবে এবং সেটা রাজনীতি করার চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হবে।’
তামোলবারী পৌছতে গোধূলি হয়ে গেল।নাগরিক সভ্যতা থেকে দূরে নির্জন শান্তিপূর্ণ এক পরিবেশ। চারপাশে সবুজ আঁচল বিছিয়ে দেওয়া চা-বাগান।ঢুকতেই বাগানের অফিস,পাশেই চা উৎপাদনের জন্য উঁচু চাল দেওয়া বিশাল কলঘর।পূবদিকে চাং ঘরে বাগানের ম্যানেজার এবং মালিকের জন্য চাং বাংলো। এই চাং-বাংলোর বেশ বড়ো সড়ো বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।বাগানের চাকর -বাকর ঘরের সমস্ত কাজ করে দেয়।বিকেলের জলপান খেয়ে লক্ষ্মীনাথ একঘন্টা বিশ্রাম নিল।তারপরে লক্ষ্মীনাথকে সঙ্গে নিয়ে চন্দ্রকুমার দক্ষিণ-পূবদিকের ঘরে বসল।পূব এবং দক্ষিণদিকে খোলা জানালা।মেঝেতে সুদৃশ্য চেয়ার-টেবিল পাতা এবং দেওয়ালে গাথা প্রাকৃ্তিক দৃশ্যের ছবি।আধুনিক রুচিতে সাজানো ঘরটা সস্ত্যিই সুন্দর।
‘এখন আমাকে এই রুমে নিয়ে এলে যে?’
রহস্যময় হাসি হেসে চন্দ্রকুমার বলল,’আগেরবার কলকাতা যাওয়ার সময় তুমি প্রতিদিনই গোধূলি যে রসে আমাকে আপ্লুত করেছিলে ,আমিও তোমার জন্য সেই রসের জোগাড় রেখেছি।’
‘তুমিও সেইসব রসের রসিক হয়ে পড়লে নাকি?”
‘রসিক হয়েছি বলব না। তবে যোগার রাখি।সাহেবরা এলে তাঁদের হুইস্কি ব্রাণ্ডি দিয়ে অ্যাপায়ন না করলে মান থাকে না।তাছাড়া তুমি যেরম রাজসিক গুণসম্পন্ন বন্ধু,তোমাকেও সেভাবে আপ্যায়ণ করতে না পারলে আমার দিক থেকে ত্রুটি থেকে যাবে।’
‘আচ্ছা,বামুন পৈ্তা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করছে –তোমার মঙ্গল হোক।’
লক্ষ্মীনাথ এভাবে বলতেই আধবয়সী খানসামা বড়ো একটা ট্রেতে করে হুইস্কির বোতল,গ্লাস,জলের জার এবং প্লেটে খাওয়ার জিনিস এনে টেবিলে রেখে দুজনকেই সেলাম করে বেরিয়ে গেল।
কারুকার্যখচিত উঁচু গ্লাসে বিদেশি সুরা ঢেলে দুজনেই পান করতে লাগল।পান করার সময় চন্দ্রকুমার বাগানে কাজ করা কুলিদের কথা বলতে লাগল। তাঁর বাগানের কুলিদের অবস্থা তাও কিছুটা ভালো।কিন্তু ব্রিটিশ্ররা চালানো বাগানের কুলিদের অবস্থা সাংঘাতিক।কাজ করানোর জন্য চাবুক দিয়ে প্রহার,বুটজুতোর লাথি তো সাধারণ কথা,কুলিদের যুবতি মেয়েদের বাংলোয় এনে ভোগ করাতেও সাহেব ম্যানেজাররা কুণ্ঠা বোধ করে না।ওদের অত্যাচার এতটাই বেড়েছে যে অফিসে কাজ করা কোনো বাবুর যুবতি মেয়ে বা বোনের ওপর চোখ পড়লে আর রক্ষা নেই। তাকে ভোগ করার জন্য সেই বাবুর ওপরে নানা ধরনের চাপ চলতে থাকে।
এসব শুনে লক্ষ্মীনাথের সুরা পানের আগ্রহ নাই হয়ে গেল। তখনই অদূরের কুলিরা বাজানো মাদলের শব্দ ভেসে এল। লক্ষ্মীনাথ বলল, 'মাদল বাজানোর শব্দ!'
' বাগানের কাজ শেষ করে গোধূলিতে কুলিরা আকন্ঠ চোলাই খায়।' হাতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে চন্দ্রকুমার বলল,' তারপরে পুরুষরা মাদল বাজাবে। মহিলারা হাতে হাত ধরে ঝুমুর নৃত্যে মাতাল হবে।'
' চল, মাজিউ, দেখে আসিগে–।'
' বস্তিতে গিয়ে সে সব দেখা যায় না। তুমি যদি বল আগামীকাল ওদেরকে ডাকব। বাংলোর বাইরের করিডোরে বসে দেখবে। বৌদি এবং মেয়ে দুটিও দেখে খুশি হবে।'
তারপরে লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে উঠল। দু পেগ খাওয়ার পরেই নেশা ধরে যায়। আমেজ পূর্ণ ঘোরে ভালো লাগতে থাকে। আজ তা হয়নি। তার কানে মাদলের শব্দটা বিশাল হয়ে ভেসে আসছে। তখনই জানলা দিয়ে পূব দিকে তাকাতেই দেখতে পেল পূব আকাশে ধীরে ধীরে চাঁদ উঠছে । কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ। উজ্জ্বল নাহলেও সামনের বাগিচা এবং বাগিচার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাছগুলির ওপরে জ্যোৎস্না পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়াময় এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। অপরূপ সেই দৃশ্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লক্ষ্মীনাথ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কলকাতায় বাড়িঘর করে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে আমি কি কিছু অন্যায় করলাম ?'
' হঠাৎ এই প্রশ্ন!'
' না এবার যে অসমে এলাম–প্রত্যেকেরই এত ভালোবাসা, সবাই চায় আমি অসমে থাকি।'
' কলকাতায় থেকে নিজেকে সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই প্রত্যেকে তোমাকে এত ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।'
' না,কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়া শিখে তোমরাও নিজেকে গড়ে তুলেছ। হেম গোঁসাই, পদ্মনাথ,তুমি আমাদের প্রত্যেকেই অসমে ফিরে এসে নিজের নিজের জায়গায় থেকে অসমিয়া জাতি অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের সেবা করে চলেছ। একমাত্র আমি কলকাতায় থেকে গেলাম।'
মুচকি হেসে চন্দ্রকুমার বলল,' তার জন্যই লেখার ঐশ্বর্যে তুমি আমাদের সবার চেয়ে ব্যতিক্রম।'
' কিন্তু কিছু লোক বলে আমি নাকি শ্বশুর বাড়ি এবং পত্নীর দ্বারা এতই প্রভাবান্বিত যে তাদের জন্যই আমি কলকাতা ছাড়তে পারছি না।'
' এটা ঠিক যে শিক্ষিত অসমিয়া জাতি এবং অসমিয়া ভাষার সাহিত্য এখনও বাংলা এবং বাংলা ভাষার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারেনি কিন্তু আমাদের জন্য এটাও একটা বড়ো কথা যে কলকাতায় থেকে তুমি যেভাবে অসমিয়া জাতি এবং অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রে বাঙালি এবং বাংলা ভাষার সাহিত্যের প্রভাবটা বুঝতে পার সেটা অন্য কেউ বুঝতে পারে না, পেতে পারেনা। সেই জন্যই তোমার মতো কেউ আমাদের ভাষার ওপরে আসা আক্রমণ গুলি প্রতিরোধ করতে পারেনি।'
লক্ষ্মীনাথ যখনই কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয় অথবা মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয় তখনই চন্দ্রকুমার নিজের উপলব্ধির গভীরতা দিয়ে সেটা বিচার করে যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ এগিয়ে সুন্দর সমাধান দেয়। এবারও চন্দ্রকুমারের কথায় লক্ষ্মীনাথ সুস্থির হল। তথাপি মনটা শান্ত হল না। সে আর গ্লাসে থাকা সুরাটুকু খেল না। যন্ত্রণাময় এক অস্থিরতায় বাইরের আকাশের দিকে চাঁদের দিকে তাকাল। চাঁদের আলো আগের চেয়ে ম্লান হয়ে এসেছে।
রাতের আহার খেয়ে উঠার পরে চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করল' এখান থেকে তুমি ডিব্রুগড় যাবে। দুদিন থেকে ডিব্রুগড় থেকে স্টিমারে গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। এবার শিবসাগরে যাবে না নাকি?'
' শিবসাগরে এখন আমাদের আত্মীয়দের অনেকেই থাকে না।
' বড়ো দাদা?'
' ব্রজনাথ দাদার গত বছর ডিসেম্বর ২৯ তারিখে মৃত্যু হয়েছে।'
' ইস, বড়ো দুঃখের কথা।'
' তবু শিবসাগর যেতে ইচ্ছা করে,মাজিউ। কিন্তু কলকাতায় হরিনাথের ওপরে বিজনেসের সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে এসেছি। সে এখন ও ব্যবসাটা বুঝে উঠতে পারেনি। বেশিদিন বাইরে থাকলে বিজনেসের অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে। তাই এবার আর শিবসাগর যাওয়া হবে না।'
গভীর কন্ঠে লক্ষ্মীনাথ প্রিয় বন্ধুকে শুভরাত্রি জানাল। খেতে ইচ্ছা করছিল না যদিও অভিজ্ঞ খানসামা রান্না করা কয়েক ধরনের সুস্বাদু ব্যঞ্জনের জন্য গুরু ভোজন হয়ে গেল। এদিকে শোবার ব্যবস্থা ও আরামদায়ক। কিন্তু বিছানায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমোতে পারল না। লক্ষ্মীনাথের শিবসাগরের পৈতৃক ঘরটার কথা মনে পড়ল। স্মৃতি পটে ভেসে উঠল শৈশবের ঘটনাগুলি।
শিবসাগর। লক্ষ্মীনাথের প্রিয় শিবসাগর। কতকাল শিবসাগর দেখা হয়নি। এখন শিবসাগর দেখতে কীরকম হয়েছে? শিবসাগরের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি জায়গা, প্রত্যেকটা রাস্তাঘাট লক্ষ্মীনাথের পরিচিত। শিবসাগরের প্রতিটি গাছপালার সঙ্গে তার বুকের বাঁধন ছিল। নির্মল জলে মহিমা মন্ডিত বিশাল বড়ো পুকুরটা নিশ্চয় বুকে নিয়ে শিবসাগর শান্তি লাভ করেছে। সোনার কলসি ঝলমলে শিবদৌলটা আর দু'পাশে বিষ্ণু দৌল এবং দেবীদৌল দুটোই বোধহয় আগের মতো শিবসাগরের মাঝামাঝি জায়গায় ভাব গম্ভীর রূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
শিবসাগরের কোলে বিশাল বরদৌলের মাঠটার ওপরে নানা বর্ণের পাকা ধানের ওপরে বাতাস বয়ে যায় কি? শরীর শান্ত করে যাওয়া বশিষ্ঠ, গঙ্গা,দিখৌর খবর কি?
নিশ্চয় দিখৌ আগের মতোই অনন্ত জলরাশি নিয়ে বয়ে থেকে শিব সাগরের জীবন প্রাণবন্ত করে রেখেছে।
এই দিখৌ-দিখৌতে সাঁতরে লক্ষ্মীনাথ অপার এক আনন্দ লাভ করত । বর্ষায় দুই পার উপচে যাওয়া দিখৌ সে সাঁতরে এপার ওপার হত। দিখৌ ঘাটের মাঝি ছিল রঙাই। রঙ্গাই মানুষটা লম্বা-চওড়া, রং ফর্সা। লক্ষীনাথ তাকে রঙ্গাই রাজখোঁয়া বলে ডাকত। এভাবে সম্বোধন করে ডাকার উদ্দেশ্যটা ছিল মাঝির মনে সন্তোষ দান করে পয়সা না দিয়ে নৌকায় পারাপার করা। নৌকায় উঠে দিখৌর মাঝামাঝি পৌঁছেই নৌকা থেকে ঝাঁপ মেরে সাঁতরে লক্ষ্মীনাথ ওপারে গিয়ে উঠত।
তারপরে লক্ষ্মীনাথ আর ভাবতে পারল না। বিকেলে লাহোয়াল স্টেশনে নেমে সেখান থেকে প্রায় চার মাইল পথ হেঁটে এই তামোলবারী বাগিচায় এসেছে। ক্লান্ত দেহে পান এবং তারপরে গুরু ভোজন… ঘুম তাকে চেপে ধরল। কিন্তু চন্দ্রকুমারের সঙ্গে এভাবে কথাবার্তা হওয়ার পরে মাতৃভূমির জন্য বিশেষ কিছু করতে পারেনি বলে একটা দুঃখ তাকে বিব্রত করে তুলছে। দুঃখী মন নিয়ে সাড়ে চার ঘন্টা শুয়ে থেকে লক্ষ্মীনাথ স্বপ্ন দেখতে লাগল।
স্বপ্নে দেখল, হু হু করে প্রবল কিন্তু করুণ এক ঝাঁক বাতাস বয়ে গেল। তখনই কোথায় কিছু একটা শব্দ হল। কিছুক্ষণ পরই জরাজীর্ণ পোশাক পরা একজোড়া বুড়ো-বুড়িকে দেখতে পেল । বুড়ো বুড়িরা তার পরিচিত। কোথাও দেখেছিল বলে মনে হল। কোথায় দেখেছিল, মনে করতে চেষ্টা করল এবং শেষে মনে পড়ল।
তারপর দেখল, পিতৃদেব দীননাথের সঙ্গে বসে সে নৌকায় করে ব্রহ্মপুত্রে ভেসে চলেছে । তখনই দেখল নদীর তীরের একটি ঝুপড়ি থেকে একজোড়া জেলে বুড়ো বুড়ি তাদের নৌকার দিকে এগিয়ে আসছে । বুড়ো লোকটি শ্বাসের রোগে আক্রান্ত। বুড়ো তার রোগের বৃত্তান্ত বলল। তারপরে বাবা দীননাথের কাছ থেকে ওষুধ খাওয়ার এবং লাগানোর বিবরণ শুনে দুজনেই বাবাকে প্রণাম করে সেই ঝুপড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। বুড়ো বুড়িকে একা নদীর পাড়ে থাকতে দেখে লক্ষ্মীনাথ প্রথমে উদাস হয়ে পড়েছিল এখন সেই দৃশ্যটি পুনরায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠায় শৈশবকালে যেমন ব্যথিত হয়ে পড়েছিল আজও ঠিক তেমনই অনুভব করল, তাকে যেন ব্রহ্মপুত্রের তীরে ছোটো একটা ঝুপড়ি বানিয়ে চিরদিনের জন্য সেখানেই থাকতে হবে।
‘
'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন