রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

পাখিদের পাড়া পড়শী- ১০ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi

 পাখিদের পাড়া পড়শী- ১০

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  


Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi



দ্বিতীয় অধ্যায়, পাখিদের পাড়া- পড়োশী

(১০)

সৌম্যদা এবং উদয়শঙ্কর সকালবেলা পাখিদের পাড়া পড়োশীর উদ্দেশ্যে বের হল ।

ঘরের বাইরে তখন কুয়াশা এবং অন্ধকারের নৈশ বিহারের অন্ত পড়েনি। কাছের মানুষকে চেনা যায় না। এরকম সময়ে শিমুলের নিচ থেকে বকের সংসারটা যে দেখা যাবে তাতে সন্দেহ রয়েছে।সৌম্যদা উদয়শঙ্করকে বলল– তুমি দেখতে পাওয়া বা না পাওয়াটা বিশেষ কথা নয়, তুমি সেখানে যাবে এবং ওদের কখন দেখতে পাও তার জন্য অপেক্ষা করবে। তোমার নোট বইয়ে সেটা টুকে রাখবে। তুমি নোট বই বানিয়েছ কি?

তার মধ্যে কী কী লিখেছ একবার আমাকে দেখাবে।

উদয়শঙ্কর মনোযোগের সঙ্গে সৌম্যদার কথা শুনে চলেছে।সৌম্যদা অনুস্বরে কথা বলছে। বাপুটির মতে এটা ভূত-প্রেতের সময়। প্রকৃতি কর্মীর জন্য এই সময়টুকু নিশাচর প্রাণী সংস্থাপন করার সময়। শিশির এবং কুয়াশার জাল ভেদ করে তারা যখন গিয়ে মৃত গাছটির প্রাকৃতিক চেয়ারটির কাছে পৌঁছাল তখন ও চারপাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। শিমুল গাছে থাকা বক গুলি আছে না নাই জানার জন্য অসুবিধা হচ্ছিল। উদয় শঙ্কর সাধারণত বসা প্রাকৃতিক চেয়ারটিতে সে সৌম্যদাকে বসতে বলল। সৌম্যদা সেখানে বসে নিয়ে সন্তুষ্টির সঙ্গে চারপাশে একবার তাকাল।

– ওই জায়গাটিতে কয়েকদিন আগে একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছিল।

উদয়শঙ্কর দেখিয়ে দেওয়া জায়গাটার প্রতি সাধারণ কথার মতো সৌম্যদা বিশেষ গুরুত্ব দিল না।

– দেখি। তোমার নোট বইটা বের কর তো।

উদয়শঙ্কর তার নোট বইটা বের করে সৌম্যদাকে দেখাল।

 অস্পষ্ট আলোতে মানুষটা তার নোট বইয়ে নজর দিল।

– ঠিকই আছে। কিন্তু তুমি কয়েকটি কথায় গুরুত্ব দাও নি ।যেমন ধর আজকের দিনটিতে আমি এসেছি, পাখি গুলি কুয়াশার জন্য দেখতে পাইনি, সে কথা ও তুমি নোট বইয়ে নোট করে রাখা উচিত হবে । সময়ের হিসেবে কতটার সময় তুমি ওদের দেখার সুবিধা পেলে– সেটাও গুরুত্বপূর্ণ কথা। এই প্রক্রিয়াটি একটি সাক্ষাৎকারের মতো। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার সময়ে নির্দিষ্ট বক্তা হাসলেও লিখতে হবে, তোমার প্রশ্ন কে গুরুত্ব না দিলেও লিখতে হবে তার ফলে তুমি সমগ্র পরিবেশটিকে সময়ে বিশ্লেষণ করার সুবিধা পাবে। মোটের উপর তুমি এখানে উপস্থিত হওয়ার পর থেকে কি কি পরিঘটনা ঘটেছে সমস্ত কথাই লিপিবদ্ধ করতে হবে।

– চল। আমরা এগিয়ে যাই।

সৌম্যদার আগ্রহকে সম্মতি জানিয়ে উদয়শঙ্কর সেই জায়গা ছেড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।

দুজনেই সোনকুরিহার সেতুটা পার হয়ে বিপরীত দিকের বাঁধটার দিকে এগিয়ে গেল। কিছু দূর যাবার পরে ওরা বেশ কিছু খেজুরের গাছ দেখতে পেল। গাছগুলিতে কাটা কিছু খাজ থেকে। সেই গাছগুলি থেকে একটা সময়ে তাড়ি সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানা যায় ।

সৌম্যদা গাছগুলিকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করছে । উদয়শঙ্কর সৌম‍্যদার প্রতি নজর রেখে বলল — একটা সময় এই গাছগুলি থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়েছিল ।

ঠিক তখনই সুনন্দ সেখানে এসে উপস্থিত হল।

— সৌম্যদা আপনাদের খুঁজে খুঁজে আমি এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি।

উদয়শঙ্কর সুনন্দকে বলল– তুমি আসবে বলে ভাবতেই পারিনি । গতকাল তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে।

সৌম‍্যদা সুনন্দকে কয়েকটি খেজুর গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুনন্দ বলল –সৌম‍্যদা এক সময় এখানে কিছু বিহারী মানুষ এসে খেজুরের রস সংগ্রহ করত । তাদের ভাষায় তাড়ি। কিন্তু স্থানীয় ছেলেদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে ওরা এই ব্যবসা ত্যাগ করতে বাধ্য হল । ছেলেগুলি গুলতি মেরে তাড়ির কলসগুলি ফুটো করে নিচে মুখ পাতে । ছেলেগুলির কাছে সেটা তারুণ্যের স্ফুর্তি। বিহারী লোকগুলি ওদের কোনোমতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না । ফলে তাড়ির ব্যবসা ছেড়ে দিতে হল। চান্দকুছির মোষ মারা পুকুরের পাড়ে থাকা খেজুর গাছগুলিতেও তাড়ি সংগ্রহ করতে যাওয়া বিহারীদের নাকি স্থানীয় যুবক একইভাবে উৎপাত করত। শোনা যায় নলবাড়ি শহরের কাছে পাগলাদিয়ার বাঁধের উপরে তারা এখন ও নাকি তাড়ির ব্যবসা করে চলেছে ।

— প্রকৃতিকে অত্যাচার করে চালিয়ে যাওয়া এই ধরনের ব্যবসা তাদের ছাড়তে হল। বিশেষ করে পাখি, ভাম, কাঠবিড়ালি ইত্যাদির শিকার। তোমরা গ্রামাঞ্চলে পাখি শিকার করতে আসা কিছু শিকারি দেখতে পাও। তারা পূর্বাপর থেকে এই ব্যবসা করে আসছে। জাতিগতভাবে তারা এই ব্যবসা করে। কিন্তু সময়ের দাবির প্রতি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তাদের এই ব্যবসা ছাড়তে হবে। বাঁশের খাঁচার ভেতরে একটা ডাহুক পাখিকে ভরিয়ে নানা জায়গা ঘুরে বেড়ানো কিছু মানুষকে তোমরা নিশ্চয় দেখেছ। ডাহুক পাখি কে ইংরেজিতে হোয়াইট ব্রেষ্টেড ওয়াটার হেন বলে। বৈজ্ঞানিক নাম এমরনিচ ফ'নিকিউরাচ। পাখি শিকারিরা খাঁচায় বন্দি করে রাখা ডাহুকটা বিশেষ জায়গায় সংস্থাপিত করে। অপরিচিত পাখিটিকে আক্রমণ করার জন্য আসা অন্য ডাউক পাখিকে শিকারিরা বন্দি করে। মাংস লোভী একদল শিক্ষিত মানুষের জিহ্বার স্বাদের জন্য বলি হয় এই সুন্দর পাখি গুলি। তোমরা এবার এসব বন্ধ করার চেষ্টা করবে।

উদয়শঙ্কর পাখির পরিচয় দিতে কেন ইংরেজি নাম এবং বৈজ্ঞানিক নামটা বলে সুনন্দ এখন বুঝতে পারল– এটা উদয়শঙ্করের ওপরে সৌম্যদার প্রভাব।

– কী ভাবছ সুনন্দ?

সুনন্দ সৌম‍্যদার কাছে ধরা পড়ে গেল।

– না এমনি। বিশেষ কিছু চিন্তা করছি না।

সুনন্দ সৌম্যদার দৃষ্টি থেকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করল।

– তোমরা হয়তো জানো এখন ও কাছিমের চোরাই ব্যবসা চলছে।

– চলছে সৌম‍্যদা। ব্রহ্মপুত্রের বালুচর গুলিতে কাছিম ডিম পাড়তে আসার সময় স্থানীয় লোকেরা সেই কাছিমগুলি ধরে এবং মাছ ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। মাছের ব্যবসায়ীরা সেই কাছিম চোরাই করে এনে লোভী খরিদ্দারের কাছে অনেক দামে বিক্রি করে। শুনেছি কাছিমের মাংস প্রতিকিলো গ্রামের দাম এক হাজার টাকা। এখান থেকে বারো কিলোমিটার দূরের বর্ণিবাড়ি নামের একটি জায়গায় বাজার বসে। সেখানে আজ থেকে কিছুবছর আগেও কাছিমের খোলা বাজার ছিল। এখন ও নাকি চোরাই ভাবে কাছিম বিক্রি হয়। আমি যেখানে চাকরি করি সেখানে কাছিম চোরাই বাজারে পাওয়া যায় বলে শুনেছি।

সৌম্যদাকে প্রত্যুত্তরে সুনন্দ জানাল।

– কাছিমের কয়েকটি প্রজাতি আই ইউ সি এন এর বিলুপ্তপ্রায় ভাগে পড়ে।

– সৌম‍্যদা আই ইউ সি এন কি?

– ঠিক আছে। তোমাকে আই ইউ সিএন এর বিষয়ে বলার জন্য আমরা একটু বসে নিই। উদয়শঙ্কর বেগ থেকে বসার জন্য ব্যবহার করা প্লাস্টিকের চাদর কয়েকটা বের করে নিল। আর প্রত্যেকেই নিজের নিজের বসার সুবিধার জন্য বাঁধের ওপরে প্লাস্টিকের চাদর পেতে নিল। বাঁধের এই জায়গাটা থেকে নদীটা ভালোভাবে দেখা যায়। কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে পাগলা দিয়া নদী এখন ও ঘুমিয়ে আছে। সৌম্যদা সুনন্দের দিকে তাকিয়ে আই ইউ সিএন এর বিষয়ে বলতে আরম্ভ করল।

– আই ইউ সি এন হল' ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দি কনজারভেশন নেচার এন্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস এবং অসমিয়ায় 'প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংস্থা'। বিলুপ্তিকে আধার হিসেবে নিয়ে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন জীব-জন্তুর একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেটিকে 'রেড লিস্ট' বলে জানা যায়। সেই রেড লিস্টে ছয়টি সূচাঙ্ক থাকে। সেগুলি ক্রমে সি আর( ক্রিটিক্যাল এন- ডেঞ্জারড)– চূড়ান্ত বিলুপ্তির সম্ভাবনা থাকা জীবকুল; ই এন (এন-ডেঞ্জারড), চূড়ান্ত বিলুপ্তির চেয়ে কম বিলুপ্তির সম্ভাবনা থাকা জীবকুল;ভি ইউ ( ভালনারেবল)– বিলুপ্তির সম্ভাবনা থাকা জীবকুল; এন টি ( নিয়ার থ্রেটেণ্ড)– বিলুপ্তির সম্ভাবনা থাকা জীবকুল;এল সি( লিস্ট কনসার্নড)– বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম; ডিডি( ডাটা ডেফিশিয়েন্ট)– তথ্য উপলদ্ধ না হওয়া জীবকুল। আমাদের এখানে পাওয়া ব্ল্যাক সফট সেল টাইটেল নামের কাছিম

 মানুষের মাংস লোভের বলি হয়ে এখন সি আর শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমি জানামতে হাজো বরপুকুরিতে এবং চতিয়ার নাগশঙ্কর পুকুরে এই প্রজাতির কয়েকটি কাছিম সংরক্ষিত রয়েছে। খবরের কাগজের খবর অনুসারে বেলসরের বিল্লেশ্বর মন্দিরে উদ্ধারকারীরা ছেড়ে দেওয়া কাছিম কয়েকটি হয়তো ব্ল্যাক সফটসেল টার্টল হতে পারে। তবে সেই সময় কাউকে বলতে শুনেছিলাম সেগুলি নাকি এশিয়ান ব্রাউনের টরটয়েজ। সুনন্দ কাছিমের ওপরে বিস্তৃত অধ্যয়ন সচরাচর করতে দেখা যায় না।

– হ্যাঁ সৌম‍্যদা। সেই জন্য আমরা কাছিমগুলিকে চিনতে পারিনা। আমি আজ কয়েক মাস আগে চোরাইভাবে বেচতে আনা দুটো কাছিম দেখতে পেয়েছিলাম।কী কাছিম জানিনা। কেবল মনে আছে কাছিমগুলি দেখতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সৈনিকরা পরা টুপির মতো। আর মাথায় দেখতে পেয়েছিলাম অশ্বত্থ বা কাঁঠাল গাছের পাতা কিছুদিন মাটিতে পড়ে থাকার পরে যেরকম দেখা যায় সেরকম দেখতে।

সেগুলি নিশ্চয় পিকক সফটসেল টার্টল। বৈজ্ঞানিক নাম নিলছ'মিয়া হুরুম। হুরুম শব্দটির জন্য কাছিমদের প্রজাতিটার নাম আমার মনে রয়ে গেছে । তোমরাও বৈজ্ঞানিক নাম মনে রাখার সময় এভাবে একটি শব্দের সাহায্য গ্রহণ করতে পার।

সুনন্দ আই ইউ সি এন এর ওপরে করা প্রশ্নের উত্তরে সৌম্যদা বলা কথাগুলি সুনন্দকে অনেক কথা জানার সুযোগ করে দিল।

– সৌম্যদা এই কথাগুলি আমাকে লিখে রাখতে হবে। ফিরে গিয়ে আমি লিখে নেব, আর ও একবার বলে দেবেন।

– নিশ্চয়। হবে। তুমি কোনো একটি প্রকৃতি শিবিরে আমাদের প্রকৃতি কর্মীদের বুঝিয়ে দেবে। চল। এখন যাই।

পেতে রাখা প্লাস্টিকের চাদর গুলি উঠিয়ে ঝেরে ঝুরে উদয়শঙ্কর বেগে ভরিয়ে নিল। হেঁটে যেতে যেতে ওরা বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে লাগল। কথা বলতে বলতে যাবার জন্য ওরা কতদূর হেঁটে চলেছে বুঝতে পারেনি। যেতে যেতে সুনন্দরা জয়পাল থানে গিয়ে পৌঁছাল। থানের মূল মন্দিরটা জয়পাল রাজা নির্মাণ করার জন্য মন্দিরটার নাম জয়পাল মন্দির। মন্দিরটিতে পৌঁছে সুনন্দের মনে হল যে ওরা অনেক দূর চলে এসেছে। বাঁধের দু'পাশে মানুষ বসা বলে বাঁধ থেকে এই জায়গাটায় নদীটা দেখা যায় না। সেই জন্য সৌম্যদাও ইচ্ছা করা সত্বেও নদীর সেই অংশের প্রস্থের বিষয়ে অনুমান করতে পারল না।

তাঁরা পুনরায় ভাঙরা গোঁহাই থানে ফিরে এল। এবার তারা নদীর স্রোতের দিকে নদীর তীর ধরে হাঁটতে শুরু করল। এভাবে হেঁটে হেঁটে প্রায় এক কিলোমিটারের মতো যাওয়ার পরে নদীটাকে বাঁধের কাছে ধাক্কা খেতে দেখল। নদীর বালু তীর ধরে হাঁটতে হলে তাদের এখন বাঁধে উঠে কিছুদূর বাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে পুনরায় নেমে যেতে হবে। সৌম‍্যদা নদীর সেই জায়গায় দেওয়া পাথরের উপর দিয়ে বেয়ে বাঁধের ওপর উঠল। সৌম্যদাকে দেখলে এরকম মনে হয় বেয়ে উঠাটা সাধারণ কথা মাত্র । একটু কষ্টের বিনিময়ে উদয়শঙ্কর এভাবে বেয়ে উঠে বাঁধের উপরে উপস্থিত হল। সুনন্দ ভাবল– এখন পড়ল ফড়িংয়ের মরণের পালা । অবশ্য পাথরের স্পার বেয়ে ওপরে উঠতে সুনন্দ যেরকম ভেবেছিল সেরকম কোনো অসুবিধা হল না।

– এই পুকুরটা!

সৌম‍্যদা পুকুরটা দেখে সুনন্দকে খুব ভালো লেগেছে বলে উষ্মার সঙ্গে জানাল। সঙ্গে বলল যে পুকুরটার অবস্থানটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নদীর এত কাছেই পুকুরটা খোঁড়ার প্রয়োজনীয়তার ওপরে তিনি সন্দেহ এবং আশ্চর্য ব্যক্ত করলেন।

– পুকুরটার নাম গঙ্গাপুকুরি। আসলে নদীটা পুকুরের এত কাছে ছিল না। একটা সময় নদীটা যথেষ্ট দূরে ছিল। সময়ের স্রোত এবং নদীর স্রোত একাকার হওয়ায় দুজন দুজনের কাছে চলে এল। পুরাতন কাহিনি অনুসারে শাপগ্রস্তা গঙ্গা দেবী নদীর স্পর্শ পেলেই নাকি মুক্তি লাভ করবে। অসম সরকারের জল সম্পদ বিভাগের নিষ্ঠার জন্য দুজন দুজনকে সাক্ষাৎ করার সুযোগটাও পায়নি‌।

– নদী এবং পুকুর দুজন দুজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য অপেক্ষা করা এই জায়গাটা সত্যিই অনন্য। আমার মনে হয় অসমের আর কোথাও এর দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই।

– নিজের গ্রামের বিষয়ে বর্ণনা করার জন্য সুবিধা পাওয়া সুনন্দ গৌরবের সঙ্গে পুকুরটার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সৌম‍্যদা এবং উদয়শঙ্করের সামনে ব্যাখ্যা করতে লাগল।

– বাসন্তী পূজার সময় এখানে দশমীর দিন গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়ার মতো অস্থি বিসর্জন দিয়ে পিতা মাতার মুক্তি কামনা করা হয়। এখানে পালন করা দুর্গাপূজা প্রকৃত দুর্গাপূজা। এটা বসন্তকালীন দুর্গাপূজা। শরতের অকালবোধন নয়। সঙ্গে এখানে জুন- জুলাই মাসে মাছ মারার জন্য' পাশ' দেওয়া হয়, মানে অনুমতি প্রদান করা হয়। তার জন্য ন্যূনতম পরিমাণের ধন পুকুর সমিতি নির্ধারণ করে। অগ্রিমধন দিয়ে নিজের নাম পুঞ্জিভুত না করলে সময়ে জায়গা পাওয়া সম্ভব নয়।

– মাছ যে ধরে,কীভাবে ধরে। বিল হলে কথা নেই, খাল শুকিয়ে–জুলুকি- জাকৈ! গঙ্গা পুকুরে মাছ ধরার জন্য জাল ব্যবহার করে?

– না না। জলের মধ্যে চাং তৈরি করে বড়শি বায়।

সুনন্দ উত্তরটা দেওয়ার জন্য যেন অপেক্ষা করছিল।

– তারমানে এখানে বরশি বাওয়া উৎসব হয়!

– সৌম‍্যদা, বলতে হবে মহোৎসব। বড়শি বাওয়ার জন্য এত মানুষ আসে যে তা মহোৎসবে পর্যবসিত হয়। দূরদূরান্ত থেকে বিশেষ করে গুয়াহাটি থেকে অনেকেই আসে। অস্ট্রেলিয়ান ছিপ নিয়ে আসে একেক জন। লাখের হিসেবে দাম। সঙ্গ দেবার জন্য দুই তিন জন চাকর থাকে, গলফ খেলার মতো। দামি দামি চার চাকার সমাহার ঘটে। তাদের বেশ–ভূষা দেখলে আশ্চর্য লাগে । পুকুরটাতে যথেষ্ট বড়ো বড়ো মাছ আছে। বিভিন্ন জন সেরকম মাছ মারার স্বাদ লাভ করার জন্য প্রতিবছর আসে। আমাদের কমিটি প্রমোট করতে পারেনি বলে। না হলে আমার মনে হয় অসমের বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে বরশি বাওয়া লোক এসে ভিড় করত।

– উদয়শঙ্কর আমি অসমের কোনো পুকুরে এভাবে বরশি দিয়ে মাছ শিকার করার কথা আগে শুনিনি । এসব নিয়েই দেখছি ইকো ট্যুরিজম হতে পারে ।

– সৌম‍্যদা আমি একটা পরিকল্পনা করছি । আপনাকে শীঘ্রই জানাব। কথাগুলো একটু সাজিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। দুই তিনটি শিবির এবং কিছু সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। আমি ভাবছি, মাস দুয়েক পরে আমি আবার এখানে আসব। ছেলেমেয়েদের একটা শিবিরে ডেকে নেব এবং এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক সচেতনতার জন্য তাদের কর্ম–তৎপর করে তুলব।

– আমি জানিনা তোমার পরিকল্পনা কী ধরনের। আমি কেবল বলব তুমি এখানে ইকো ট্যুরিজমের ব্যবস্থা কর।

– সঙ্গে আমি ভাবছি ' ভিল- এজ ফরেস্ট্রির কথা।

– বলতো কীরকম পরিকল্পনা করেছ?

– ভারত সরকারের বন মন্ত্রালয় বলেছে– যে সমস্ত বাসিন্দা স্বাভাবিকভাবে অরণ্যে বসবাস করছে, তারা অরণ‍্যেই বসবাস করবে এবং অরণ‍্যকে রক্ষণাবেক্ষণ দেবে। ভিল এজ ইন এ ফরেস্ট্রি। আমরা এরকম একটি ধারণা আরম্ভ করতে পারি না কি– আমাদের যে সমস্ত গ্রামবাসী এই ধরনের গ্রামে বসবাস করছে, যেখানে অরণ্যের ব্যাপক সমাহার দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে গ্রামবাসী তাদের নিজেদের গ্রামে বসবাস করা ছাড়াও অরণ‍্যকে রক্ষণাবেক্ষণ দেবে। গাছপালা কাটবেনা। পাখিদের বাসা ভাঙবে না । বন্য জীবজন্তুদের হত্যা করবে না এবং গ্রামটিকে একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মতো গড়ে তুলবে ।সেটাই হবে ভিলেজ ফরেস্ট্রি ।তুমি ঠিকই বলেছ। ভালো চিন্তা। সদর্থক। এই জায়গা গুলি কোনোমতে অরণ্যের ভেতরে পড়ে না অথচ সবার অজান্তে এখানে গড়ে উঠবে অরণ্যাঞ্চল । অথচ এসবের রক্ষণাবেক্ষণ না দিলে কালক্রমে নিশ্চিহ্ন হবে। উদয়, তুমি এখানে নতুন পরিকল্পনা করতে পার‐- জলাশয়টাকে কেন্দ্র করে, পাগলা দিয়া নদীর দু'পারকে কেন্দ্র করে , গঙ্গাপুকুরকে মুখ্য হিসেবে নিয়ে। এখানে গড়ে উঠতে পারে পর্যটক নিবাস, গড়ে উঠতে পারে পক্ষী নিরীক্ষণের জন্য নৈমিত্তিক শিবির, গঙ্গাপুকুরে মাছ ধরার জন্য মৎস্য মহোৎসবের মতো অনুষ্ঠানের।

দুজনের কথাবার্তা শুনে সুনন্দ বলল‐-

‐- সৌম্যদা নদীতে মাছ ধরার জন্য ও নদীতে অনেক মানুষ আসে। বিশেষ করে স্থানীয় কিছু মানুষ জাল বড়শি দিয়ে নদীতে মাছ ধরে। কিছুটা প্রচার এবং প্রসার হলে নদীতে মৎস্য শিকার বাণিজ্যিকভাবে, বিশেষ করে মৎস্য পর্যটনের অন্য এক অংশ হতে পারে।

সুনন্দের কথার সূত্র ধরে উদয়শঙ্কর বলল‐- এই ধরনের একটি অভিলাষী পরিকল্পনা নিতে হবে যার ফলে এই অঞ্চলের রং রূপ বদলে যাবে ।আমি সেই ধরনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগুনোর কথা ভাবছি। আশা করছি আগামী তিন বছরের মধ্যে আমরা সফল হতে পারব।

‐- উদয়শঙ্কর তুমি ইকো ট্যুরিজমকে প্রাধান্য দেওয়া কয়েকজন ব্যক্তির কাজ করার ধরন ধারন বুঝে নেওয়া উচিত। অভয়াপুরীর শৈলেশদার কাছে যেতে পার। এই ধরনের কয়েকজন ব্যক্তির আমি নাম ঠিকানা দিতে পারি। যাদের কাছ থেকে তুমি সাহায্য পেতে পার।

উদয়শঙ্করের মনে শিকড়গড়া ধারণাটা পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। নতুন চিন্তাকে নতুন কর্মপন্থায় এগিয়ে নেওয়ার জন্য সে সংকল্পবদ্ধ হয়ে পড়ল। কেবল ই-কো ট্যুরিজম কেন‐- বাঁধ থেকে নদী পর্যন্ত থাকা এক বিস্তৃত অঞ্চলে গাছ রোপণ করে বনাঞ্চল গড়ে তোলা যেতে পারে। তবে মাটিগুলি পাট্টার মাটি, মালিক আছে। তাদের সচেতন করার জন্য, মেনে নেবার জন্য তাকে সংগঠন করতে হবে। তবে উদয় শঙ্কর তো বকের বিষয়ে অধ্যয়ন করার জন্য এখানে এসেছিল। তাহলে কি হল‐- একজন প্রকৃতি কর্মী হিসেবে সে নিজের দ্বৈত দায়িত্ব পালন করা উচিত। কোনো মানুষই নিজেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বেঁধে রাখা অনুচিত, যখন তার সামনের লক্ষ্য প্রসারিত হয়ে পড়ে।

 স্পষ্ট উদ্দেশ্য অথচ ধূসর বাস্তবকে সামনে নিয়ে উদয়শঙ্কর এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...