হে আমার স্বদেশ- ৩১
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(৩১)
প্রতি বছরের মতো এবারও লক্ষ্মীনাথ নিজের বাড়িতে কলকাতায় থাকা সমস্ত অসমিয়া আত্মীয়-স্বজন,বন্ধুবান্ধব এবং কলেজ স্ট্রিট, প্রতাপ চ্যাটার্জী স্ট্রিটের অসমিয়া ছাত্রদের ডেকে শঙ্করদেবের জন্মতিথি পালন করল। যতই জরুরি থাকুক না কেন, বিশেষ এই দিনটিতে লক্ষ্মীনাথ নিজের ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো কাজ করে না। দুদিন আগে থেকে নিমন্ত্রণ এবং প্রসাদের জন্য বুট-মুগ, ফল-মূল কিনে আনে। গুরুজনার তিথির দিন ঘরের পরিবেশটা শিবসাগরের পৈতৃক বাড়িটার মতো হয়ে পড়ে। শুধু সাদা পাজামা এবং আসাম সিল্কের পাঞ্জাবি পরে গলায় ফুলাম গামছা পরে সাত্ত্বিক আচার-আচরণের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ সত্রের গোঁসাইর রূপ ধারণ করে।
রত্নেশ্বর মহন্ত ছাত্রদের দিয়ে আনুষ্ঠানিক কাজটুকু করিয়ে নেয়। আয়োজন সমাপ্ত হলে সবাই নাম প্রসঙ্গে বসে। নাম চলে। নামের শেষের দিকে লক্ষ্মীনাথ নিজে ভোরতাল নিয়ে উচ্চকণ্ঠে নাম গান গাইতে শুরু করে। এবারও সবকিছু সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হল। ভাব গম্ভীর কন্ঠে রত্নেশ্বর মহন্ত ভাগবতের একটি অধ্যায় পাঠ করলেন। তারপর উপস্থিত ভক্তদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে প্রসাদ বিতরণের পর্ব চলল। এই সময় লক্ষ্মীনাথের মাথা ঘুরতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে মাথা ঘোরানিটা বেড়ে গেল। কিন্তু নিজের শারীরিক অসুবিধার কথা কাউকে বলল না। সবাই বিদায় নেওয়ার পরে ভেতর মহলে আসার পরে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তারপরেই তার নাক দিয়ে কাঁচা রক্ত পড়তে লাগল।
পিতার নাক দিয়ে রক্তের ধারা বইতে দেখে অরুণা চিৎকার করতে লাগল। প্রজ্ঞা সহজে বিচলিত হয় না। সে ধৈর্য হারায় না।প্রতিকূল কিছু ঘটলে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে।অরুণাকে চিৎকার করতে নিষেধ করে সে স্বামীর কাছে এগিয়ে এল। লক্ষ্মীনাথের কাঁধে থাকা উত্তরীয় দিয়ে নাক মুখ মুছে দিয়ে ঠান্ডা জলে কপাল-মাথা ধুয়ে দিল। পুনরায় ধীরে ধীরে কপাল মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে শোবার কোঠায় এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপরে একগ্লাস জল খাইয়ে তার কাছে বসল।
পত্নীর সেবা শুশ্রূষা পেয়ে লক্ষ্মীনাথ আশ্বস্ত হল। তবে তার শরীরে সীমাহীন ক্লান্তি। সঙ্গে কী রকম একটা আমেজ, কীরকম এক প্রশান্তি। লক্ষ্মীনাথের চোখ জোড়া আপনা থেকেই বুজে এল।
সব সময়েই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত, কাজের মধ্যে ও কথায় নানা অঙ্গভঙ্গি করে সবাইকে হাসাতে থাকা বাবাকে এভাবে চোখ বুজে নির্জীব হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে কিশোরী অরুণা অস্থির হয়ে' পাপা' বলে ডাকতে শুরু করল। কিন্তু প্রজ্ঞা মুখে আঙ্গুল রেখে তাকে চুপ থাকতে বলল। পরমেশ্বর ব্রহ্ম বলে জ্ঞান করা মহাপুরুষ শংকরদেবের জন্মতিথিতে এভাবে নাম প্রসঙ্গ করে ভক্তদের আপ্যায়ন করার পরে লক্ষ্মীনাথ আধ্যাত্বিক আত্মপ্রসাদ লাভ করে। তারপরেও তার অন্তরে যেন আরও কীসের একটা যন্ত্রনা থেকে যায়। এভাবে নাক দিয়ে রক্তক্ষরণটা তারই কোনো বহিঃপ্রকাশ নাকি?
প্রজ্ঞা প্রশ্নটার উত্তর পেল না। কিন্তু তিনি ভালোভাবে বুঝতে পারলেন যে এখন দীর্ঘ সময়ের জন্য লক্ষ্মীনাথের বিশ্রামের প্রয়োজন। ঘুমে ঢলে পড়ার পরেও কিছুক্ষণ মাথায় বুকে হাত বুলিয়ে আদর করে বিছানার ওপরে মশারি টাঙিয়ে দিল। তারপর আলো কমিয়ে দিয়ে প্রজ্ঞা অরুণাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
একনাগারে কয়েক ঘণ্টা গভীর নিদ্রায় অতিবাহিত করার পরে শরীরের ক্লান্তি‐ অবসাদ নাই হয়ে গেল। রাত পার হয়ে ঘরের খোলা জানালা দিয়ে ভোরের কোমল আলো ভেসে এল। ঘুম আসার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ স্বপ্ন দেখতে লাগল। স্বপ্নে পুনরায় সেই শৈশবে ফিরে গেল।
শৈশবকালে লক্ষ্মীনাথ এবং তার দাদা ভাইদের দেখাশোনা করা রবিনাথ দাদু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে পারত না।এদিকে লক্ষ্মীনাথের পিতৃদেব ছিলেন ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করা পুরুষ। দেরি করে ঘুমোতে দেখলেই পিতৃদের বকাবকি করে রবিনাথকে বিছানা থেকে উঠিয়ে দিত। এখন লক্ষ্মীনাথ সেই দৃশ্যটিকে স্বপ্নে দেখতে লাগল। লক্ষ্মীনাথ দেখল-বাবা বকাবকি করছে,'অলস অকর্মণ্যের মতো তুমি এখনও বিছানায় পড়ে আছ। এতই ঘুম। শক্ত সমর্থ শরীরটাতে এত আলস্য।'
তখনই লক্ষ্মীনাথের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করল মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখ মেলে তাকিয়েই দেখল, পাশে বসে প্রজ্ঞা তারদিকে মমতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
' ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছিলে।' প্রজ্ঞা বলল,' স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি?'
ঘুমিয়ে পড়ার পরে লক্ষ্মীনাথ সারারাতে একবারও জেগে উঠে নি যদিও প্রজ্ঞা ঘুমোতে পারেনি। পাশের বিছানায় মেয়ে দুটিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে স্বামীর কাছে বসে পুনরায় তার নাক থেকে রক্ত বেরিয়েছে কিনা, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা লক্ষ্য করেছে এবং কিছুক্ষণ পরে পরে আদর করে তার মাথা পিঠ মালিশ করে দিয়েছে। এটা লক্ষীনাথ ও জানে। অসুস্থ অবস্থায় সে পত্নীর ভালোবাসা আর ও নিবিড়ভাবে অনুভব করে। শুধুমাত্র রন্ধন বিদ্যায় নিপুণা নয়, গৃহসজ্জা, তৈলচিত্র অঙ্কনে পারদর্শিনী নয়,অপরূপ রূপ যৌবনে ভালোবাসায় অনুরঞ্জিতা নয়, সেবা-যত্ন করার ক্ষেত্রেও সে একজন আদর্শ নারী। প্রজ্ঞাসুন্দরী বাঙালি, প্রায় ষোলো বছর দাম্পত্য জীবন অতিক্রম করার পরেও তার সঙ্গে বাংলায় কথা বলে। তবু লক্ষ্মীনাথ সুখী।অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য গতকাল রাতে ভালোবাসার আদান প্রদান হয়নি। প্রজ্ঞার ডান হাতটা নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' হ্যাঁ বাড়ির স্বপ্ন দেখছিলাম।'
'কাল নাম প্রসঙ্গ করার সময় তোমার বুঝি মায়ের কথা মনে পড়ছিল?'
' মায়ের কথা!'
' হ্যাঁ মায়ের কথা আর দেশের কথা মনে পড়লেই তো তুমি এমন হয়ে যাও। বিজনেসের যদি কোনো অসুবিধা না হয়, তাহলে চল না সবাই মিলে একবার আসাম ঘুরে আসি।'
' তুমি আসাম যাবে?'
' হ্যাঁ যাব।'
' সত্যি বলছ?'
' বলছি তো যাব।'
সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের মাথাব্যথা নাই হয়ে গেল। উৎফুল্লিত হয়ে বলল,' ঠিক আছে, চল, এবার পুজোয় অসমেই যাই।
সত্যিই পরিবারের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ অসমে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। তার আগে প্রজ্ঞা ঘরোয়া ডাক্তার সত্যব্রত মিত্রকে ডাকিয়ে এনে লক্ষ্মীনাথের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাল। নাম কীর্তন শেষ হওয়ার পরেই কেন লক্ষ্মীনাথের নাক দিয়ে এভাবে রক্ত বের হল, সেই বিষয়ে জিজ্ঞেস করল। ডক্টর মিত্র বললেন, কীর্তন করার সময় অতি মানসিক এক আবেগে তার রক্তচাপ বেড়ে যায়। রক্তক্ষরণের জন্য সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে ও এটা নিয়ে চিন্তা করার মতো কোনো অসুখ নয়।
রেল কোম্পানি দুর্গা পূজার মাসে রেহাই মূল্যে ভ্রমণের সুযোগ দেয়। লক্ষ্মীনাথ এই সুযোগটা গ্রহণ করল। প্রজ্ঞা, অরুণা-রত্না, চাকর ভাগীরথী- কাশীনাথ এবং আয়াকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ শিয়ালদহ থেকে ১৯০৫ সনের অক্টোবরের ৮ তারিখ রাতে গোয়ালন্দ মেইলে অসমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। বি ব্রাদার্স কোম্পানি থেকে আলাদা হয়ে আসাম- বেঙ্গল খোলার পরে লক্ষ্মীনাথ শিবসাগর থেকে ভাই হরিনাথকে ডেকে এনে ম্যানেজার রাখল। লক্ষ্মীনাথের অনুপস্থিতে হরিনাথ ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে।
ইতিমধ্যে ১৯০৫ সনের সাত জুলাই ভারত সরকারের তরফ থেকে বঙ্গ বিভাজনের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠল। দুই-একজন স্বার্থান্বেষী জমিদার, ব্যবসায়ী এবং মুসলমান বুদ্ধিজীবী ছাড়া প্রত্যেকেই এই বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য এগিয়ে এল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকুমার মিত্র, মতিলাল ঘোষ ইত্যাদি নেতার উপস্থিতিতে ১৭ই জুলাই খুলনার বাগেরহাটে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় ইংরেজের বিরুদ্ধে বয়কট প্রস্তাব গৃহীত হল। এই প্রস্তাব অনুসারে যতদিন পর্যন্ত বঙ্গ-ভঙ্গ আইন রদ হবে না, ততদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ পণ্য সামগ্রী বর্জন করা হবে। ১৭ এবং ১৮ তারিখ রিপন কলেজে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র সমাবেশে 'বয়কট' আন্দোলনকে এক পবিত্র শপথ হিসেবে গ্রহণ করা হল। সাত আগস্ট কলকাতার টাউন হলে পাঁচহাজার জন ছাত্র এবং অগণন লোকের সমাবেশে অনুষ্ঠিত সভায় পৌরোহিত্য করলেন কাশিমবাজারের মহারাজা মুনিন্দ্রচন্দ্র নন্দী। এই সভায় ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গ বিভাজন আইনকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করা হল এবং ইতিপূর্বে রিপন কলেজে অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রসমাজ গ্রহণ করার বিদেশি সমগ্র বর্জন করার সিদ্ধান্তটাকে অনুমোদন জানানো হল। এই ধরনের এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে লক্ষ্মীনাথ কলকাতা ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে জন্মভূমি অসম যাত্রা করল।
যাত্রার পরের দিন ভোর বেলা গোয়ালন্দে পৌঁছল। গোয়ালন্দ থেকে দুপুর বেলা দুটোর সময় ডিব্রুগড় গামী জাহাজ ছাড়বে। এদিকে বড়ো হওয়ার জন্য জাহাজটা নদীর তীরে লাগাতে পারল না। মাঝ-নদীর মূল স্রোতে নোঙ্গর করল। তবে পাশের একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো জাহাজে উঠে প্রাতঃকালীন কাজটুকু করে সকালের চা জল খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিল। তারপরে সবাইকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ কলকাতা থেকে রিজার্ভ করা আর এস এন কোম্পানির'ঘাজি' জাহাজের একটি কেবিনে উঠল। দুপুর আড়াইটা থেকে উজানের দিকে জলযাত্রা আরম্ভ হল। জাহাজটা রাত সাড়ে নয়টার সময় ধুবরিতে এসে নোঙ্গর করল। পরের দিন সকাল দশটার সময় জাহাজ ধুবরি ছেড়ে গেল।
অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ।শারদীয়া পরিবেশ।এখন ব্রহ্মপুত্রের দুকুল প্লাবিত নয়।স্রোতের বেগ ও কম। তার জন্য মেইল জাহাজ 'ঘাজি' অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে উজানের দিকে যেতে পারছে। নদীর দুইপাশের সবুজ মাঠ, মাঠে চড়তে থাকা গরু- ছাগল, গাছ-পালায় শ্যামল দূর দূরান্তের গ্রাম… চিত্রময় দৃশ্য। কেবিনের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অরুণা এই গতিশীল দৃশ্য গুলি দেখছে। আয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রত্না ও অপরিসীম কৌতূহল এবং আগ্রহ নিয়ে তাদের পূর্বপুরুষের দেশটা দেখছে। আগে না দেখা কিছু দেখলেই আয়াকে জিজ্ঞেস করছে, এদিকে প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ কেবিন থেকে বেরিয়ে ডকে উঠল। এখন ডকে অন্য কেউ নেই ।লক্ষ্মীনাথ- প্রজ্ঞা দক্ষিণ দিকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
জাহাজের গতিবেগ বৃদ্ধি পেল। দুইপারের সবাই পার হয়ে গেছে। কয়েকটি গ্রাম এবং দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত পার হওয়ার পরে নদীর তীর থেকে কিছু দূরে পাহাড় দেখতে পেল। পাহাড়গুলি এত উঁচু নয়। গাছ পালায় সবুজ পাহাড়ের গায়ে সূর্যের কিরণ পড়ে মনোরম এক দৃশ্য সৃষ্টি করেছে ।পাহাড়গুলির পরে নীল আকাশ, নীল আকাশের কোলে অলস ভাবে ভেসে বেড়ানো সাদা সাদা মেঘ… রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রজ্ঞা নয়ন ভরে এই দৃশ্য উপভোগ করল। সুখ এবং তৃপ্তির হাসিতে তার মুখটা অনুপম হয়ে উঠল।
শৈশব থেকে জন্মভূমির এই সুন্দর দৃশ্য দেখলেও আজ এভাবে প্রিয়তমা পত্নী ,স্নেহের দুই মেয়ে এবং চাকর আয়াদের নিয়ে মাতৃভূমির মুখ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র দিয়ে জলযাত্রার সময় দেখা মাতৃভূমির রূপ‐ লক্ষ্মীনাথের মনে অনুভূত হওয়া পূর্বের সেই সুখ আনন্দের সঙ্গে আলাদা একটি মাত্রা সংযোজিত হল। প্রকৃতির প্রাণময় মুখগুলির দিকে তাকিয়ে সে ভাবুক হয়ে পড়ল।
সুদূর অতীতের কথা স্মরণ করে লক্ষ্মীনাথ বলল যে আজ যে জলপথে যন্ত্রচালিত বিশাল জাহাজে তারা উজান অসমের দিকে যাচ্ছে এই একই পথে একদিন তাদের পূর্বজ কলিবর বরুয়া কান্যকুজ্ব থেকে সেই সময়ের বৈঠা দিয়ে চালিত ছোটো নৌকায় তীর্থ ভ্রমণ করতে এই অসমে এসেছিল।
মনোযোগের সঙ্গে শুনে প্রজ্ঞা তখন আশ্চর্য প্রকাশ করে বলল যে কান্যকুজ্ব থেকে লক্ষ্মীনাথের পূর্বপুরুষেরা যেহেতু অসমে এসেছিলেন তাই তারা অসমিয়া ছিলেন না। প্রজ্ঞার কথাটা স্বীকার করে মুচকি হেসে লক্ষ্মীনাথ বলল যে উজান অসমের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা অধিকাংশই মূলত অসমিয়া ছিল না। বর্তমান কামরূপ এবং প্রাগজ্যোতিষপুর ছাড়া অসম ছিল বনে জঙ্গলে এবং পাহাড়ে পরিপূর্ণ পাহাড়ি এবং জনজাতি লোকের বাসভূমি। কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মার রাজত্বকালে সভ্যতা- সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছিল। তাঁর রাজত্বকালে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েনসাঙ অসমে এসেছিলেন। তারপরে দ্বাদশ শতিকায় পূর্বের পাটকাই পর্বত পার হয়ে আহোমরা এসে জনজাতি গোষ্ঠীর রাজাদের পরাজিত করে আজকের অসমের ভিত গড়েছে। তখন থেকে অসমিয়া ভাষার বিকাশ আরম্ভ হয় এবং আশ্চর্যের কথা এটাই যে অসমে রাজ্য স্থাপন করে আহোম রাজ পুরুষরা মাতৃভাষা তাই ভাষাকে দেশের ভাষা না করে স্থানীয় অসমিয়া ভাষাকে স্বীকৃতি দিল এবং হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করল । তারপরের সেই কনৌজ থেকে অসমে এসে বসবাস করতে থাকা বারভূঞার শিরোমনি শঙ্করদের বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করার জন্য অসমের সমস্ত জায়গায় সত্র- নামঘর প্রতিষ্ঠা করে অসম বাসীদের একতার বন্ধনে বাঁধল এবং অসমিয়া সাহিত্য- সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করল।
প্রজ্ঞা তখন সরল ভাবে জিজ্ঞেস করল যে লক্ষ্মীনাথের পূর্বপুরুষরা যখন অসমিয়া ছিলেন না, তখন সে অসমিয়া ভাষা- সাহিত্যের জন্য এভাবে লড়াই করছে কেন? প্রজ্ঞার এই প্রশ্নটি লক্ষ্মীনাথকে অস্বস্তিতে ফেলল।তাঁর কিছুটা রাগও হল। পরের মুহূর্তে বুঝতে পারল প্রজ্ঞা তাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। অনেকক্ষণ দক্ষিণের উদার আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল, সেটাই হল আজকের অসমিয়া জাতির ইতিহাস। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অসমিয়া না হলেও তাদের অসমে জন্ম হয়েছে। অসমে জন্মগ্রহণ করে মায়ের মুখে অসমিয়া কথা শুনেছে। তাই মায়ের ভাষাই তাঁর ভাষা। মায়ের পরিচয়ই তাঁর পরিচয়। তাই মাতৃভাষার অস্তিত্ব এবং স্বতন্ত্রতা রক্ষার জন্য তাকে লড়াই করতেই হবে। সন্তানের জন্য সেটাই প্রধানতম দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
শিয়ালদা থেকে যাত্রা আরম্ভ করে সপ্তম দিন সকালে কোকিলামুখ পৌঁছাল। কোকিলামুখের ভাসমান ডাকবাংলোয় বসে চা খেল। এগারোটার সময় জোরহাটে থাকা দাদা গোবিন্দচন্দ্র বেজবরুয়া তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে ডাকবাংলোয় এল। এতদিনে সাহিত্যিক রূপে কলকাতা তথা সমগ্র অসমে বিখ্যাত হয়ে পড়া লক্ষ্মীনাথ গোবিন্দচন্দ্রের ভাই। ডাকবাংলোয় উঠার জন্য কড়া মেজাজের অভিভাবক গোবিন্দচন্দ্র লক্ষ্মীনাথকে গালিগালাজ করতে লাগল। তারপরে তিনি লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
দাদা গোবিন্দচন্দ্রের বাড়িতে স্নান করে ,খাওয়া দাওয়া করে লক্ষ্মীনাথ দীর্ঘ সময়ের জন্য বিশ্রাম নিয়ে সাত দিনের যাত্রার ক্লান্তি দূর করল। বিকেলবেলা রায় বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য লক্ষ্মীনাথ বের হল।
বিএ জগন্নাথ বরুয়া কয়েকটি চা বাগানের মালিক। নামে ধামে ধনসম্পত্তিতে তিনি কেবল জোরহাটে নয়, সমগ্র অসমে একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি।তাঁর বাসস্থানটিও বিশাল। বিশাল গেট পার হয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে লক্ষ্মীনাথ ভেতরে ঢুকে নিজের উপস্থিতির কথা বলে একজন কর্মচারীকে ভেতরে পাঠাল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিএ জগন্নাথ বরুয়া বেরিয়ে এলেন। পরনে সাহেবদের পরা ঘরোয়া পোশাক। মাস খানেক আগে কলকাতায় তাঁকে সুস্থ দেখেছিলেন। বয়সের সঙ্গে অসুখ তাকে কাহিল করে ফেলেছে। ওষুধপত্র খেয়েও শরীরটাকে সুস্থ রাখতে পারেননি।
কুশল সংবাদ আদান প্রদান করে থাকার সময় সাদা পোশাক পরা আধবয়সী একজন খানসামা একটা সুন্দর পটে উচ্চমানের চা নিয়ে এল। লক্ষ্মীনাথের কাছ থেকে চায়ে চিনি দুধের অনুপাত জিজ্ঞেস করে খানসামা এক কাপ চা লক্ষ্মীনাথের দিকে এগিয়ে দিল। চিনি দুধ না দিয়ে পাতলা লিকারের চা ঢেলে খানসামা জগন্নাথ বরুয়ার হাতে তুলে দিল।
চায়ের কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে জগন্নাথ বরুয়া বললেন, কলকাতা থেকে এলে, পার্টিশন কার্যকরী হওয়ার পরে কলকাতা আন্দোলনমুখী হয়ে পড়েছে। খবরের কাগজে দেখলাম বন্দেমাতরম স্লোগান দিয়ে হাজার হাজার জনতা কলকাতার রাজপথে নেমে এসেছে। রবিবাবু ' বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হোক পূণ্য হোক হে ভগবান' বলে গেয়ে পার্টিশনের বিরোধিতা করছেন।'
' হ্যাঁ কাকাবাবু, আন্দোলনটা দিন দিন বেড়েই চলেছে।'
' আর ও বাড়বে।'
' কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বাঙালির প্রতিবাদের কাছে নতিস্বীকার না করে পার্টিশন রদ করবে না। ১৮৫৭ সনের সিপাহী বিদ্রোহের চেয়ে ভয়াবহ আন্দোলন ছিল। সেটাকে আন্দোলন না বলে বিদ্রোহ বলাই সঙ্গত। সেই বিদ্রোহকে দমন করেছে যখন, এখন এত বছরে ভারতবর্ষে আরও স্থায়ীভাবে রাজত্ব করা ব্রিটিশ এই আন্দোলনকে সহজেই দমন করতে পারবে।'
' দমন করলে জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলি আরও বেশি করে সংঘবদ্ধ হয়ে উঠবে।
' কিন্তু দাদা ব্রিটিশ আমাদের দেশের উন্নতির জন্য কাজ করেছে। আমাদের অসমের কথাই ধরুন, স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার উন্নতি করেছে। আসামে যে এত লাভজনক চায়ের চাষ হতে পারে, এটা ব্রিটিশেরই আবিষ্কার। তাছাড়া রেললাইন পেতেছে ভালো ভালো জাহাজ কোম্পানি আসার জন্য অসমের জলপথের ও উন্নতি হয়েছে। জেলায় জেলায় প্রশাসনীয় অফিস স্থাপন করে আইনশৃঙ্খলা ধরে রেখেছে।'
' তুমি তাহলে ব্রিটিশ শাসনের পোষকতা কর। তবে লক্ষ্মীনাথ যতই যা বলনা কেন, আমাদের জন্য ব্রিটিশরা বিদেশি। তুমি সাহিত্যের সাধনা করছ। তোমার জ্ঞান- বুদ্ধি আমার চেয়ে বেশি। তুমি নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবে যে দেশের মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকে না।'
ইংরেজিতে শুদ্ধ বক্তৃতার দ্বারা তৎক্ষণাৎ শ্রোতামন্ডলীকে আকর্ষণ করতে পারার ক্ষমতা থাকা জগন্নাথ বরুয়াও ব্রিটিশ ভক্ত। ১৯০২ সালে সপ্তম এডওয়ার্ডের অভিষেক উপলক্ষে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা নিমন্ত্রিত হয়ে তিনি বিলাতে গিয়েছিলেন। অভিষেক উৎসব হয়ে যাওয়ার পরে লন্ডনের মেয়র প্রতিনিধিদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য টাউন হলে ভোট সভার আয়োজন করেছিল। সেই ভোজসভায় জগন্নাথ বরুয়া ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়ে অভ্যাগতদের সম্ভাষণ জানিয়েছিল। বক্তৃতাটি এতই মনোগ্রাহী হয়েছিল যে ম্যানচেস্টার গার্ডেন ইত্যাদি বিলাতের কাগজে বরুয়া মহাশয়কে প্রশংসা করেছিল। ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা রায়বাহাদুর উপাধিতে সম্মানিত জগন্নাথ বরুয়ার কন্ঠে এখন ইংরেজ শাসনের বিরোধিতার সুর শুনে লক্ষ্মীনাথ অবাক হল। কিছুক্ষণ মনে মনে থেকে লক্ষ্মীনাথ বলল,' তাহলে আপনি বলতে চাইছেন নাকি যে এখন আমাদেরও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে।'
'কবে আন্দোলন করতে হবে, সঠিকভাবে বলতে পারছিনা। কিন্তু বেশিদিন যে অপেক্ষা করতে হবে না সেটা অনুমান করতে পারছি।’ জগন্নাথ বরুয়া বললেন ' তারপরে ‘বন্তি’পত্রিকাটা রিভাইভ করার জন্য পদ্মনাথ যে অশেষ চেষ্টা,খবরটা পেয়েছ বোধহয়।’
‘হ্যাঁ, দুই মাস আগে পদ্ম বরুয়া কলকাতায় আমার এবং ভোলা দাদার সঙ্গে দেখা করেছিল। আমরা আমাদের সাধ্যমত সাহায্য করেছি। ইতিমধ্যে 'বন্তি' পুনরায় ছাপা হয়েছে।
' পারবে। পদ্মনাথ ধরেছে যখন 'বন্তি' বের হবেই। পদ্মনাথ খুবই সিনসিয়ার। যে কাজ শুরু করে, একেবারে একনিষ্ঠ হয়ে লেগে থাকে। আচ্ছা তুমি তো এবার কলকাতা থেকে পরিবার এবং মেয়েদের নিয়ে এসেছ। তোমার দাদা তো জি বেজ বরুয়ার বাড়িতে আছে, নয় কি।
'হ্যাঁ কাকাবাবু।'
' জোরহাটে কয়েকদিন থাকবে কি?'
' হ্যাঁ থাকব। তারপরে গোলাঘাটে যাব। আজকাল আমাদের মা শ্রীনাথ দাদার সঙ্গে গোলাঘাটে থাকে।'
' মিসেস কে নিয়ে একদিন আমাদের বাড়িতে ভাত খেতে এসো। গাড়ি পাঠিয়ে দেব। গাড়িতে তাদের নিয়ে এসো।'
লক্ষ্মীনাথের দাদা ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে গতিশীল চরিত্রের মানুষ হল গোবিন্দচন্দ্র বেজবরুয়া। স্বভাবটা কিছুটা উগ্র হলেও তিনি খুব কর্মী মানুষ। গোবিন্দচন্দ্রের জন্যই গোলাপ বেজবরুয়া কলকাতায় পড়াশোনা করতে সক্ষম হয়েছিল। এবং টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে তিনিই গোলাপ বেজবরুয়াকে বিলাত পাঠিয়েছিলেন।তাঁর জন্যই এন্ট্রান্স পাশ করার পরে পিতা দীননাথের ইচ্ছার বিরুদ্ধে লক্ষ্মীনাথ কলকাতায় যেতে পেরেছিল । তিনি লক্ষীনাথ কে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কালীঘাটের বেনীমাধব হালদারের ঘরে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন এবং মির্জাপুরের রিপন কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করে লক্ষ্মীনাথের নাম ভর্তি করেছিলেন।
গোবিন্দচন্দ্র সাজ-পোশাক , চাল-চলনে একেবারে সাহেব। ভাব-ভঙ্গিতেও ইংরেজ। মুখে ইংরেজি কথা-বার্তা। পারিবারিক পরম্পরা অনুসরণ করে তিনি ইংরেজ ভক্ত অসমিয়া। সভা-সমিতিতে তিনি মুক্ত কণ্ঠে বলেন‐ ইংরেজের পান্চুয়ালিটি, ইংরেজের ডিসিপ্লিন, ইংরেজের সাহস, ইংরেজের একতা, ইংরেজের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, ইংরেজদের দেশ ভক্তি আমাদের চাই। গোবিন্দচন্দ্র খাওয়া দাওয়ায় নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের নিয়ম-নীতি মানে না। তিনি মুসলমান স্পর্শ করা পাউরুটি খান, মুরগির ডিম খান, হুইস্কি ব্রান্ডি ও অনায়াসে পান করেন। তবে এইসব নিয়ে কোন লুকোচুরি নেই। তিনি একজন মুক্ত মনের মানুষ। অবশ্য বাড়ির বৈষ্ণব আচার- অনুষ্ঠান মানেন। তিনি বলেন,' সাহেব হলেও আমি অহিন্দু নই।' কিন্তু তাঁর দোষটা হল, তিনি কার ও মন রক্ষা করে অথবা স্থান- কাল- পাত্র বিচার করে কথা বলতে পারেন না। তাই অধিকাংশ মানুষ তাকে পছন্দ করে না। মাত্রাধিক সাহেবিবায়ুগ্রস্ত হওয়ায় তিনি নিজেকে সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্টতা দেখাতে যত্নশীল। তার জন্যই নিজের গোবিন্দচন্দ্র বেজবরুয়া নামটা সংক্ষেপে জি বেজবরুয়া করে নিয়েছেন এবং মানুষ তাঁকে সেভাবে ডাকলেই খুশি হন।
এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও এই গোবিন্দচন্দ্র বেজবরুয়া সমসাময়িক অসমের একজন অন্যতম শিক্ষাবিদ। এতদিনে তিনি একরকম একক প্রচেষ্টায় উজান অসমে ছয়টি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেছেন। সেগুলি হল দেরগাও এবং চারিগাওয়ে একটি করে মাইনর স্কুল, গোলাঘাট, যোরহাট, জাঁজি এবং শিব সাগরে একটি করে হাই স্কুল। স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যেকটিতে একজন করে হেডমাস্টার এবং মাস্টারের নিযুক্তি দিয়ে নিজে ঘুরে ঘুরে স্কুল পরিদর্শন করেন, পরিচালনা করেন। এখন তিনি নিজে যোরহাট হাই স্কুলের হেডমাস্টার।
বিএ পাশ করার পরে সরকারি চাকরি পেয়েও চাকরিতে যোগদান না করার জন্য গোবিন্দচন্দ্র লক্ষ্মীনাথকে খুব গালিগালাজ করেছিলেন। এখন ও তাঁর কথায় সেরকম ভাবই প্রকাশ পেল। রায়বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়ার বাড়ি থেকে এসে লক্ষ্মীনাথ দাদার সঙ্গে বসে ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সংঘাতের কথা বলতেই গোবিন্দচন্দ্র তাঁর স্বভাবসুলভ কর্কশ কণ্ঠে বলল‐' তুই যখন সেই অর্ধশিক্ষিত ধুরন্ধর ব্যবসায়ীটার সঙ্গে ব্যবসা করতে শুরু করলি তখনই ভেবেছিলাম তোকে সর্বনাশে পেয়েছে। তবে তুই হলি একটা 'গোঁয়ার গোবিন্দ' প্রাণী। একবার নিজে যেটা ভাববি, সর্বনাশ জেনে ও সেটাই কামড়ে পড়ে থাকবি। ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে নিজের মতো ব্যবসা শুরু করেছিস, ব্যবসায় তুই এগোতে পারবি না। শোন, আমরা ব্যবসায়ী নই। আমরা বেজবরুয়া বংশের ছেলে। বাবা ঠিকই বলেছিলেন, আমাদের রক্তে ব্যবসায়ীর গুণাবলী নেই।'
কথাগুলির বিরোধিতা করতে গেলেই গোবিন্দচন্দ্র তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। লক্ষ্মীনাথ চুপ করে দাদার কথা শুনতে লাগল।
' আর গোলাপ, তাকে কিসে পেয়েছে যে চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হল ?'চরম বিরক্তি এবং ক্রোধে গোবিন্দ চন্দ্র বললেন,' বিজাতি ব্রাহ্ম বিয়ে করে তুই তবুও দুই এক বছর পরে পরে বাড়িতে আসিস। বাবা খারাপ পাবে বলে কথাটা গোপন রেখে কত কষ্টে টাকা জোগাড় করে, আমি গোলাপকে বিলাতে পাঠালাম। বিলেতে গিয়ে ডাক্তার হয়ে আসা সেই মহা মূর্খটা এখন অসমে আসেই না। তারপরে সে পুনরায় কয়েকটি সন্তান থাকা একটি বিধবাকে বিয়ে করেছে! আর সেই বিয়েতে তুই কিনা তাকে সাহায্য করলি! হায় হায়, এসব কি হল! বাবা বেঁচে থাকলে এইসব দেখে শুনে নিশ্চয় আত্মহত্যা করতেন।'
লক্ষ্মীনাথ এই দাদার ক্রোধ প্রশমিত করার উপায় জানেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসতে হাসতে বলল,' মেজ দাদা, তুমি মিছামিছি রাগ করছ। গোলাপদাদা বিদেশে গিয়ে অভাবে পড়ে কোনো উপায় না পেয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। তারপরে তিনি যে এরকম একজন বিধবা মহিলাকে বিয়ে করেছেন, তাকে ভালো লেগেছে বলেই। ভালোবাসলে কী করবে? ভালোবাসা তো কোনো বিচার মানে না। এমনিতেও কোন রূপসী যুবতি পঞ্চাশ বছরের বয়স্ক মানুষের সঙ্গে বিয়ে বসতে চাইবে? তবে যতই গালিগালাজ কর না কেন, বিয়ের পরে গোলাপ দাদার ভালোই চলছে। শেষ বয়সে বিয়ে করে ঘর-সংসার পেতে একটু যদি সুখ পায় পেতে দাও।'
' আর ওটা শিবসাগর থেকে হরিকে নিয়ে গিয়ে বিজনেসে লাগালি,‐- সে তো একটা অপদার্থ, অলস। তোর সঙ্গে থেকেও ওর কি কোনো গতি হবে? সে নিজে কিছু করে খেতে পারবে কি?'
' ও শৈশব থেকে শিবসাগরে থাকা। ওর শরীর থেকে এখন ও দিখৌপরিয়ার গন্ধ যায়নি। কলকাতার হাবভাব বুঝতে সময় লাগবে।'
' তুই তাকে সহজ-সরল ভাবলে ভুল হবে। ও একটা নির্বোধ। কড়া শাসনে না রাখলে ও পথে আসবে না।'
' হবে হবে। সে নিশ্চয় নিজে থেকে কিছু একটা করে খেতে পারবে।'
' তারমানে তুই ওর কথাটা সিরিয়াসলি নিস নি। লখী তোকে আর শুধরানো গেল না। কোনো কথাকেই তুই গুরুত্ব দিস না।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন