সোমবার, ২ জানুয়ারী, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ২৯ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস Santosh Kumar Karmakar

হে আমার স্বদেশ- ২৯

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস

Santosh Kumar Karmakar 




  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(২৯)

পাকা মিস্ত্রি এবং দুইজন চুণ কাজ করা মানুষ লাগিয়ে নতুন করে কেনা বাইশ নম্বর রোজ মেরিলেনের 'লরেলচে' কাজ করাল। তারপরে বিহারী কুলি লাগিয়ে পুরো ঘরটা পরিষ্কার করে দশ নম্বর সল্টগোলা লেনের ভাড়া ঘরটি থেকে জিনিসপত্র আনানোর ব্যবস্থা করালো।ডবসন রোডের বাড়িটি থেকে প্লাস্টার অফ প্যারিসে তৈরি সুরভির মূর্তিটা এনে ' লরেলসের' ড্রইংরুমে রাখল। এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়িটা সাজিয়ে লক্ষ্মীনাথ- প্রজ্ঞা নতুন বাড়িতে সংসার পাতল।

নতুন বাড়িতে গুছিয়ে বসার পরেই মিস অনুবলা দাসের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের দাদা ডক্টর গোলাপ বেজবরুয়ার বিয়ে ঠিক হল। লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞা চৌদ্দ নম্বর গোপী কৃষ্ণ নন্দনের ভাড়াবাড়িতে থাকার সময় ডক্টর বেজবরুয়া আমেরিকা থেকে এসে কিছুদিন একসঙ্গে ছিল। তারপরে কলকাতার গার্ডেনরিচের কুলির তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার রূপে এক বছর কাজ করে তিনি পুনরায় আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন ।দেড় বছর পরে কলকাতায় ফিরে এসে একটা ভাড়া ঘর নিয়ে থেকে কলকাতায় ডাক্তারি শুরু করেছেন।

বয়োজ্যেষ্ঠ দাদার বিয়ে। অবস্থা বিপাকে তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এদিকে পাত্রী মিস দাস বিধবা,দুটি সন্তানের জননী। নানা দিক থেকে প্রস্তাবিত বিয়েটি ব্যতিক্রমী। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের মনটি উদার।নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব হয়েও বিয়ের আয়োজনে লক্ষ্মীনাথ তৎপর হয়ে পড়ল। তার মনোভাব এরকম যে এক সময় অনেক কষ্ট করা দাদা বিয়ে করে ঘর সংসার পেতে সুখী হোক। তার জন্য হংকং ব্যাংক থেকে তিনশো টাকা তুলে প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে একটি গলার হার,একটি আংটি, এক জোড়া কানের দুল, শাড়ি প্রসাধন সামগ্রী কিনে আনল। হাওড়ার প্রেসবাইটেয়ান গির্জায়, মিস দাসের সঙ্গে ডঃ গোলাপের খ্রিস্টান ধর্ম মতে বিবাহ সম্পন্ন হল। বয়োজ্যেষ্ঠ দাদা ডঃগোলাপ বেজবরুয়া এভাবে বিবাহ পাশে আবদ্ধ হওয়ায় (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ ) লক্ষ্মীনাথ এবং প্রজ্ঞা আনন্দিত হল।

দুদিন পরে অফিসে ভোলানাথ নিজেই লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। তারপরে লক্ষ্মীনাথ এবং অতুলকৃষ্ণ বাবুকে সঙ্গে নিয়ে মেসার্স গ্রেগরি এন্ড জোন্স কোম্পানিতে গেল। ভোলানাথ কোম্পানির ম্যানেজারকে একটি চুক্তি পত্র লিখতে নির্দেশ দিলেন।সেই অনুসারে গ্রেগরি কোম্পানি লক্ষ্মীনাথকে দশ হাজার টাকা ধার দিতে এবং লক্ষ্মীনাথ প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে পরিশোধ করবে। অনাদায়ে শতকরা ছয় টাকা শোধ দিতে হবে। টাকাটা লক্ষ্মীনাথের জন্য ব্যবসায়ের মূলধন হল। ইতিমধ্যেই ভোলানাথ সেগুন কাঠের ব্যবসাটা লক্ষ্মীনাথকে ছেড়ে দিয়েছে। তাছাড়া আজ মূলধন ও জোগাড় করে দিল। তারমানে ডবসন রোডের বাড়িটা ছাড়তে বাধ্য করলেও ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে থাকেন নি। তার সঙ্গে ভবিষ্যতের যোগাযোগ রাখবেন না বলেই ভেবেছিল। কিন্তু ভোলানাথ যে এগিয়ে এসে কথা বলল এবং তার জন্য এই টাকা সংগ্রহ করে দিল, তার জন্য লক্ষ্মীনাথের ক্ষোভ-ক্রোধ কিছুটা কমে এল। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় সে ডবসন রোডের বাড়িতে ঢুকল।

গেট পার হয়ে ভেতরে যাওয়ার সময় লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। সুরভির জন্য তৈরি ছোটো মন্দিরটা ইতিমধ্যেই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের বুকটা টনটন করে উঠল।

এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার সময় যে সমস্ত জিনিস নিজের ছিল, শুধুমাত্র সেগুলিই নিয়ে গিয়েছিল। অন‍্যের অধিকার থাকা কোনো জিনিসে হাত দেয়নি। অরুনা রত্নাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য নিজে চিৎপুরহাটে গিয়ে একটা গাভী কিনে এনেছিল। গাভীটা প্রতিদিন আট-নয় কেজি দুধ দিত। বাড়ির প্রত্যেকেই সেই দুধ খেত। গাভীটা দেখতেও ভালো ছিল। প্রজ্ঞা আদর করে গাভীটিকে পালন করেছিল এবং 'ধুবলি' বলে ডাকত। লক্ষ্মীনাথ গাভীটিকে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে বি এন আর লাইন থেকে ভোলানাথ অতুল কৃষ্ণ বাবুকে চিঠি লিখে নির্দেশ দিলেন যে তাকে লক্ষীনাথের কাছ থেকে গাভীটাকে কেড়ে নিতে হবে। চিঠি পেয়ে অতুলকৃষ্ণ বাবু কিছুই করেনি শুনে ভোলানাথ ভুবনকে নির্দেশ দিয়েছিল। ভুবনও খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি।এই সময়ে অতুলকৃষ্ণ বাবু কথাটা বলায় লক্ষ্মীনাথ বলেছিল,'বি বরুয়ার যদি প্রয়োজন হয়ে থাকে তিনি বা অন্য কেউ যার ইচ্ছে,বাকিটা নিয়ে যেতে পারে।' তারপরে গাভীটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লক্ষ্মীনাথ কয়েকদিন অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু ভোলানাথ অথবা তার কোনো আত্মীয় গাভীটিকে ফিরিয়ে নিতে এল না।

এই ঘটনাটা ভোলানাথের প্রতি লক্ষ্মীনাথের তিক্ততা বাড়িয়েছিল। ভোলানাথ বরুয়া কে সংকীর্ণ মনের মানুষ বলে মনে হয়েছিল। আর এই ধরনের একজন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ঠিক নয় বলে ভাবতে বাধ্য হয়েছিল।কিন্তু লক্ষ্মীনাথ সত্যিই অন্য মানসিকতার মানুষ। ঘটনাচক্রে খারাপ হলেও এক সময়ে ভোলানাথের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল এবং অসুখের খবর শুনেছে যখন, তাকে একবার না দেখে থাকে কীভাবে ? তাই দেখা করতে খারাপ লাগলেও লক্ষ্মীনাথ উপর মহলের ভোলানাথের শোবার ঘরে এল।

অসুখ গুরুতর নয়। কাল রাতে জ্বর উঠেছিল। তার জন্য শরীরটা দুর্বল বলে আজ বিশ্রাম নিয়েছে। লক্ষ্মীনাথ আসায় ভোলানাথ খুশি হল। সে এভাবে কথা বলতে শুরু করল যে দুজনের মধ্যে কোনো বিদ্বেষ ভাব নেই। ভোলানাথের এই ব্যবহার লক্ষ্মীনাথকে আশ্চর্য করল। সঙ্গে মনে একটা সন্দেহ ও জাগল, পুনরায় কোনো ধরনে ফাঁসানোর জন্য নতুন কোনো ষড়যন্ত্র রচনা করছে নাকি?কিন্তু লক্ষ্মীনাথ মনে মনে শপথ খেল, না- ভোলানাথের সঙ্গে সে আর যুক্তভাবে ব্যবসা করবে না ।

বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হল। ক্ষোভ বিদ্বেষ প্রকাশ না করে লক্ষ্মীনাথ সমতা রক্ষা করল। অফিস থেকে এসেছে জানতে পেরে ভোলানাথ চাকরকে ডেকে লক্ষ্মীনাথকে ব্রেড-বাটার, ওমলেট এবং চায়ের সাহায্যে আপ্যায়ন করার ব্যবস্থা করল।

স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে আসতে রাত হল। ভেতরে প্রবেশ করেই তার জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করে থাকা প্রজ্ঞা জিজ্ঞেস করল,' এত দেরি হল যে!'

' ভোলা দাদা অসুস্থ। ওকে দেখতে গিয়েছিলাম।'

' তিনি এখন কোথায়?'

' ডবসন রোডের বাড়িতে।'

'এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর তুমি ওকে ওই বাড়িতে দেখতে গেলে!'

' অসুস্থ শুনে খারাপ লাগল।'

' তথাপি–।'

' না পরি,না গিয়ে পারলাম না। অবশ্য এই যাওয়ার কথাটা নিয়ে আমিও ভেবেছি। দেখ, আমাদের ঝগড়াটা বিজনেস নিয়ে। ভোলা দাদার সঙ্গে আমার বিজনেসের পাটতো চুকেই গেল। ব্যক্তিগতভাবে কেন শত্রুতা নিয়ে থাকি,বল। তাছাড়া, আমি দেখতে যাওয়ায় ভোলা দাদা খুব খুশি হয়েছেন। জম্পেশ করে বিকেলের আহার আর চা খাওয়ালেন।'

‘দাদার সঙ্গে ভাইয়ের তাহলে মিলন হয়ে গেল!'

' বৈষয়িক মিলন নয়। নেহাৎ শিষ্টাচারসুলভ মিলন।'

কলকাতা টাউন হলে স্যার হেনরি কটনের সম্মানার্থে আয়োজিত নৈশভোজে হাওড়া কোর্টের সম্মানীয় অনারেরি ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীযুক্ত বাবু লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া আমন্ত্রিত হল।

এই কটন সাহেব অসমের চিফ কমিশনার হয়ে থাকার সময় গুয়াহাটিতে কলেজ প্রতিষ্ঠা করার বিপক্ষে অভিমত দিয়েছিলেন। লক্ষ্মীনাথ তৎক্ষণাৎ কলকাতায় অ.ভা.উ.সা সভা পেতে ছিল। কটন সাহেবের অভিমতের তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে তার অভিযোগ গুলির অন্তসারশূন্যতা প্রতিপন্ন করেছিল। তারপরে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রস্তুত করে অসম সরকার এবং অসমের শিক্ষিত সচেতন মহলে বিতরণ করেছিল। সেটা বড়ো ফলপ্রসু হয়েছিল।' বন্তি'র সম্পাদক পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া গুয়াহাটিতে কলেজ স্থাপন করার সপক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এদিকে অসমের অন্যতম জাতীয়তাবাদী নেতা রায়বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়া এবং মিঃ মানিক চন্দ্র বরুয়া একই মত পোষণ করে চিফ কমিশনারকে পত্র প্রেরণ করেছিলেন। তারপরে 'অসম অ্যাসোসিয়েশন' এবং যোরহাটের 'সার্বজনিক সভা' ও সভার আয়োজন করে অনুরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করে সরকারের কাছে পাঠিয়ে ছিল। এই সমস্ত অনেকগুলি প্রস্তাব, মতামত, আবেদন- নিবেদন, পর্যালোচনা করে সরকার গুয়াহাটিতে কলেজ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। অবশেষে অসমে একটি কলেজ স্থাপিত হল। প্রথমে আপত্তি ছিল যদিও জনমতের প্রতি সম্মান জানিয়ে হেনরি কটন গুয়াহাটিতে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত করলেন । কলেজটির নামকরণ করা হল 'কটন কলেজ'।

স্যার হেনরি কটনের সম্মানার্থে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য লক্ষ্মীনাথ আগ্রহ অনুভব করলেন। সাহেবি পোশাকে সজ্জিত হয়ে মাথায় হেট পরে লক্ষ্মীনাথ নিজের ঘোড়ার গাড়ি করে কলকাতা টাউন হলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। অসমে কলেজ স্থাপন করার পরে কটন সাহেব অসমিয়াদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে পড়লেন। অসাম থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় তাকে আড়ম্বরপূর্ণ সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল। আজ কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত নৈশ ভোজেও কলকাতায় থাকা অসমিয়ারা তাকে দেখার জন্য বা তার সঙ্গে কথা বলার জন্য এসেছে।

টাউনহলের অনতি দূরে রাখা গাড়ি থেকে নেমে লক্ষীনাথ নৈশ ভোজে এল। কলকাতায় অসমিয়া বন্ধুর চেয়ে লক্ষ্মীনাথের বাঙালি বন্ধু এবং বাঙালি আত্মীয়- কুটুম বেশি।সাহেবি পোশাক পরিহিত দীর্ঘদেহী সুঠাম লক্ষ্মীনাথ প্রত্যেকের সঙ্গে সমান আন্তরিকতায় কথা বলতে শুরু করল। অসমের সঙ্গে শুদ্ধ অসমিয়ায়, বাঙালি বন্ধুর সঙ্গে সূক্ষ্ম রসিকতায় শুদ্ধ বাংলায় এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অথবা সাহেবদের সঙ্গে গম্ভীর কিন্তু সাবলীল ভাবে ইংরেজিতে… নিজের রসপূর্ণ– বুদ্ধিদীপ্ত বাক-কৌশলে কিছুক্ষণের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ প্রত্যেকের আকর্ষণের পাত্র হয়ে উঠলেন। এদিকে নৈশভোজের পরিবেশটাই এরকম যে লক্ষ্মীনাথ ও আহার গ্রহণের আগেই শ্যাম্পেন পান করতে লাগল। উপস্থিত কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় পানের মাত্রাটা কিছুটা বেশি হয়ে গেল। তাই কিছুক্ষণের মধ্যে নেশার জাল তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তার জন্য মূল যে উদ্দেশ্যটা নিয়ে এসেছিল– স্যার হেনরির সঙ্গে পরিচিত হয়ে কথা-বার্তা বলা, সেটা হল না।

নেশাগ্রস্ত হয়ে কিছুটা অপ্রকৃতিস্ত অবস্থায় গাড়িতে উঠে লক্ষীনাথ বাড়িতে এল।

করুনা এবং রত্নাকে শুইয়ে প্রজ্ঞা লক্ষ্মীনাথের জন্য অপেক্ষা করছিল। ভেতরে প্রবেশ করতেই প্রজ্ঞা বুঝতে পারল লক্ষ্মীনাথ সুরা পান করে এসেছে। সূরা পানের বিষয়ে প্রজ্ঞা শুচিবায়ুগ্রস্ত নয়।প্রতিদিনেই নিজের রুমে বসে অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের স্বল্পমাত্রায় সুরা পান করাটা নিয়ে প্রজ্ঞা কোনো আপত্তি করে না।

আর করবেই বা কেন? ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতার অভিজাত বাঙালিদের জন্য এখন এটা একটা সংস্কৃতি হয়ে পড়েছে। তা বলে বাইরে ও লক্ষীনাথ এভাবে সুরা পান করে সামলাতে না পারা অবস্থায় বাড়িতে আসবে!

' তুমি ড্রিঙ্ক করেছ!' উৎকণ্ঠায় উত্তেজিত প্রজ্ঞা চাপা ক্রোধে বলল,' ড্রিঙ্ক করে বেসামাল অবস্থায় বাড়ি ফিরলে!'

' না– বুঝলে পরি, না– আমি ঠিক এতটা নিতে চাইনি।' দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে লক্ষ্মীনাথ বলল,' কিন্তু সিকোয়েন্সটা এমন ছিল যে কেমন করে যেন একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেল।'

' বেশি খাওয়া হয়ে গেল মানে? তুমি রাজ বৈদ‍্যের ছেলে, তোমার বাবা ছিলেন একজন নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব। তুমি এত কথা বোঝ, তুমি অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে টাউন হলে গিয়েছ। সেখানে কত মান্যগণ্য অতিথি, কত লোকের সঙ্গে তোমার জানাশোনা, তাদের মধ্যে তুমি মাত্রাধিক ড্রিঙ্ক করে মাতলামি করলে! বলি, কোথায় রইল তোমার নিজের মান- সম্মান?'

পত্নীর গালিগালাজ খেয়ে লক্ষ্মীনাথের হুঁশ ফিরে এল। অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল,' ভুল হয়ে গেল। আই এম সরি। আমাকে মাফ–।'

লক্ষ্মীনাথ কথা শেষ করতে পারল না। দৌড়ে এসে ডান হাতে লক্ষ্মীনাথের মুখ চাপা দিয়ে ধরে আকুলতা ভরা কন্ঠে প্রজ্ঞা বলল,' না ,তোমাকে মাফ চাইতে হবে না। তুমি মাফ চাওয়াটা আমার সহ্য হয় না। এসো, ভেতরে এসো।'

পরের দিন সকাল বিষন্নতার সঙ্গে অতিবাহিত হল। কিন্তু ইন্ডিয়া ক্লাবে যাওয়ার পরে বি এ জগন্নাথ বরুয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে ভালো লেগে গেল।

অসমের বিখ্যাত চা ব্যবসায়ী রায় বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়া। তিনি ১৮৭২ সনে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করা উজান অসমের প্রথম গ্রাজুয়েট। অবশ্য তার আগেই নিম্ন অসমের আনন্দ রাম বরুয়া বিএ পাস করেছিল। কিন্তু সিভিল সার্ভিস পাস করেছিল বলে আনন্দ রামের বিএ পাশ করার খ‍্যাতি সিভিলিয়ান হওয়ার খ‍্যাতির কাছে চাপা পড়ে গেল। তার জন্যই বিএ পাশ বলে জগন্নাথ বরুয়া বি এ জগন্নাথ নামে বিখ্যাত হয়ে পড়ল।

বিএ পাশ করার পরে জগন্নাথ বরুয়া ' নেটিভ সিভিল সার্ভিস'এর পরীক্ষা দিয়েছিল । সেখানে সুখ্যাতির সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে সরকারের কাছ থেকে উচ্চপদে চাকরি করার আহ্বান পেল । কিন্তু কী মনে হল, তিনি সরকারি চাকরি গ্রহণ করলেন না। পুলিশ ইন্সপেক্টর পিতা হেমধর বরুয়া অবসর গ্রহণ করার পরে সরকার থেকে গ্রান্ট স্বরূপ অনেক জমি পেয়েছিল। গ্রান্টের সেই জমিতে জগন্নাথ বরুয়া চায়ের চাষ করতে লাগলেন। সরকারি চাকরি না করে চায়ের চাষ শুরু করায় আত্মীয় পরিজনরা বিরোধিতা করেছিল। পিতা ও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের কর্মশক্তি, বাগান পরিচালনার দক্ষতা এবং ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার জন্য তিনি খুবই কম সময়ের মধ্যে বিপুল অর্থ- সম্পদের অধিকারী হলেন।

বিএ পাশ করার পরে সরকারি চাকরি পেয়ে লক্ষ্মীনাথও জগন্নাথ বরুয়ার মতো চাকরি না করে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করছে। তাই স্বাধীনচেতা চারিত্রিক গুণটির জন্য লক্ষ্মীনাথ জগন্নাথ বরুয়াকে ভালোবাসে। এদিকে জগন্নাথ বরুয়া এখন কেবল চা ব্যবসায়ী হিসেবেই নয়, অসম এবং অসমিয়ার জন্য তিনি একজন জাতীয়তাবাদী পুরুষ। উচ্চ ভাবে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে পারেন ।তাছাড়া বরুয়া অসমিয়া ভাষা- সাহিত্যের ও অনুরাগী। জগন্নাথ বরুয়া যোরহাটের 'সার্বজনিক সভা'র প্রতিষ্ঠাতা। তার আর ও একটি বড়ো কৃতিত্ব হল ১৮৭২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হয়ে থাকার সময় কলকাতা অসমিয়া সাহিত্য সভার হয়ে মানিকচন্দ্র বরুয়ার সঙ্গে তখনকার ভারতের বড়োলাট লর্ড নর্থব্রুকের হাতে একটি আবেদন পত্র দিয়েছিলেন। সেই পত্রটি ছিল রেললাইন পেতে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মতো অসমকেও সমৃদ্ধশালী করে তোলার আবেদন। কলেজের ছাত্র দুজনের এরকম ভীষণ সাহস দেখে 'ইন্ডিয়ান মিরর','হিন্দু পেট্রিয়ট' এবং অমৃতবাজার পত্রিকা এই কাজকে উদ্ধত যুবকের কর্মকাণ্ড বলে সমালোচনা করেছিল। কিন্তু তার কয়েক বছর পরেই ব্রিটিশ সরকার প্রথমে ডিব্রুগড়-শদিয়া এবং তারপরে আসাম-বেঙ্গল রেল লাইনের ব্যবস্থা করে। এই ধরনের একজন ব্যক্তিত্বশালী পুরুষের প্রতি লক্ষ্মীনাথ আকর্ষণ অনুভব করে। জগন্নাথ বরুয়াও লক্ষ্মীনাথ এবং ভোলানাথকে ভালোবাসেন। ব্যবসা অথবা অন্য কোনো কারণে কলকাতায় এলেই তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা বলে ভাবের আদান প্রদান করেন।

কুশল-বার্তা আদান-প্রদানের পরে জগন্নাথ বরুয়া বললেন,'লক্ষ্মীনাথ, ভোলানাথের সঙ্গে তোমার যে কাঠের বিজনেস– বি ব্রাদার্স কোম্পানি সত্যিই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। দুজনে একত্রিতভাবে কোম্পানিটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে তোমাদেরকে নিয়ে অসম গর্ববোধ করত। পররে আলাদা হয়ে গেলে, তোমরা এভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। আচ্ছা আজ আমাদের অসমের প্রাক্তন চিফ কমিশনার স্যার হেনরি কটন লন্ডন চলে যাচ্ছেন‐-।'

' তাই নাকি?'

' হ্যাঁ ,তিনি আজ হাওড়া থেকে বোম্বাই মেলে বোম্বাই তারপরে বোম্বাই থেকে জাহাজে ইংল্যান্ডে যাত্রা করবেন।'

লজ্জিতভাবে লক্ষ্মীনাথ বলল,গতকাল টাউনহলে তাঁর অনারে অনুষ্ঠিত হওয়া ডিনার পার্টিতে এই অধমও একজন ইনভাইটি ছিল। কিন্তু অধমের দুর্ভাগ্য,তাকে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করা হল না।'

' চল, আজ সাক্ষাৎ করে নেবে। অবশেষে তিনি যে গুয়াহাটিতে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করলেন, তার জন্য আমাদের তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত।'

জগন্নাথ বরুয়ার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ হাওড়া স্টেশনে এলেন। স্টেশনের প্রথম শ্রেণির বিশ্রাম ঘরে বসে কটন সাহেব ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য স্টেশনে অসমিয়া-বাঙালি অনেক ছাত্র এসেছে। রায়বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়া কটন সাহেবের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

একসময়ের চিফ কমিশনার হিসেবে অসমে কলেজ স্থাপন করাটা নিয়ে বিরোধিতা করলেও কটন সাহেব প্রকৃতপক্ষে একজন উদার সংস্কৃতিবান ব্যক্তি। শাসক ব্রিটিশদের যে সাম্রাজ্যবাদী অহংকার থাকে হেনরি কটন সাহেবের কথাবার্তা , অচার আচরণে সেই সমস্ত প্রকাশ পায় না। এমনিতেও পরবর্তী সময়ে অসমের জন্য তিনি কিছু জনহিতকর কাজ করে প্রশাসক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সহাস্যে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে করমর্দন করে প্রবীণ কটন সাহেব বললেন,' হ্যালো মিস্টার বেজবরুয়া , আই হ্যাভ হার্ড এবাউট ইউ। ইউ আর ম্যারেড টু ফেমাস টেগোর ফ্যামিলি অফ ক্যালকাটা।'

লক্ষ্মীনাথ লজ্জিত হয়ে পড়ল,' স্যার আই এম এক্সট্রিমলি সরি‐-।'

' সরি! হোয়াট ফর? হোয়াই ইউ আর ফিলিং সরি?'

' অন টুয়েলভ জানুয়ারি আই ওয়াজ ওয়ান অফ দা ইনভাইটী ইন দা ডিনার পার্টি এরেঞ্জড ইন ইউর অনার এট টাউন হল, ক্যালকাটা, বাট আই কুড নট হ্যাভ এ কার্টছি টক উইথ ইউ।

'বাট টুডে ইউ হেভ শোন এনাফ কার্টসি বাই কামিং টু দ্য হাওড়া স্টেশন টু সি মি অফ‐-।

বলেই স্যার হেনরি কটন হা হা করে হাসতে লাগল। লক্ষ্মীনাথ এবং রায়বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়া ও হাসতে লাগলেন।

'মি: বেজবরুয়া, ইউ আর এ রাইটার।আই হার্ড দেট ইউ আর এ নেশনালিস্ট, ইউ আপগ্রেড ইওর মাদারল্যান্ড আসাম এন্ড ইউর মাদার টাং আসামিছ। ইউ আর এ ট্রু পেট্রিয়ট ।আই উইশ ইউ অল দা সাকসেস।'

এক সময়ে তীব্র বিদ্বেষ অনুভব করা স্যার হেনরি কটনের প্রতি শ্রদ্ধায় লক্ষ্মীনাথের মাথাটা নত হয়ে এল। সবিনয়ে বলল, 'থ্যাংক ইউ স্যার'।

১৯০৫ সনের উনিশ জানুয়ারি যুগপুরুষ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহলোক ত্যাগ করলেন। এত বড়ো একটা জমিদারি এস্টেট চালিয়ে, ব্রাহ্মধর্মের প্রচার-প্রসার করা ছাড়া সনাতন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায় অটল বিশ্বাসী, সফল বৈষয়িক হয়েও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে নিজের প্রতিটি সন্তানকে রত্ন করে গড়ে তোলা, মহান মানবীয় চেতনায় উদার পুণ্যাত্মা পুরুষটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গ সংস্কৃতির একটি যুগের অবসান হল।

প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ সেদিন ও ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেকেরই মনিকূট কর্তামশাই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখতে গিয়েছিল। তখন শয্যাগত থাকলেও তিনি লক্ষ্মীনাথকে চিনতে পেরেছিলেন। কথা বলার শক্তি ছিল না যদিও শুভ্র দাড়ির মধ্য দিয়ে বিবর্ণ অধরে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল।তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সময় নাতিনি জামাই হিসেবে তাঁর স্নেহ মিশ্রিত রসিকতাগুলি লক্ষ্মীনাথের মনে পড়ে যাচ্ছিল। কর্মের দ্বারা, চরিত্র বলের দ্বারা, ঔদার্যের দ্বারা, সাংস্কৃতিক চেতনায় মানুষের সমস্ত মহৎ গুণগুলি আহরণ করতে পারা মহান আত্মা দাদা শ্বশুরের সেটাই অন্তিম দর্শন বলে ভেবে লক্ষ্মীনাথের চোখ জোড়া সজল হয়ে উঠেছিল। তারপরে বাড়িতে এসে সে অনেকক্ষণ উদাস হয়ে রইল।

ব্যবসায়িক কথা নিয়ে মতবিরোধ হওয়ার ফলে এক সময়ে কথাবার্তা এমনকি মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত হয়েছিল। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যে লক্ষ্মীনাথের প্রতি অবিচার করেছিল, এই বোধটা ভোলানাথকে মাঝে মধ্যে দহন করতে থাকে। সম্ভবত তার জন্যই ভোলানাথ পুনরায় লক্ষ্মীনাথের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে লাগল। লক্ষ্মীনাথের রস লাগিয়ে বলা কথাবার্তা, কথাবার্তায় প্রকাশ পাওয়া দেশ-বিদেশের জ্ঞান এবং তার অনাবিল আন্তরিকতা অবিবাহিত ভোলানাথকে লক্ষ্মীনাথের প্রতি আকৃষ্ট করতে লাগল। আর অবশেষে একদিন তিনি নিজেই লক্ষ্মীনাথের বাইশ নম্বর রোজমেরী লেনের লরেলসে বেড়াতে এলেন।

হঠাৎ ভোলানাথকে আসতে দেখে লক্ষ্মীনাথ বিশেষ করে প্রজ্ঞা আশ্চর্য হল। প্রজ্ঞার তাকে ডাকতে অসুবিধা হচ্ছে বলে বুঝতে পেরে ভোলানাথই প্রথম কথা বলল। অরুণা এবং রত্নার জন্য খেলনা, টফি এবং প্রত্যেকের জন্য কেনা মিষ্টির পুঁটলিটা প্রজ্ঞার হাতে তুলে দিয়ে ' অনেকদিন তোমার হাতের চা খাইনি, চা খেতে এলুম' বলে হাসল। তারপরে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়িটা দেখে দুজনে এসে বৈঠকখানা ঘরে বসল।

' শুনলাম তুমি বন্দোবস্ত করে দেওয়া ২৫০ নম্বর গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বাড়িটাতে স্বর্ণরা থাকতে পারল না।

হ্যাঁ দাদা। প্লেগে ওদের চাকরটার মৃত্যু হল। তার জন্য মেয়ে দুটিকে নিয়ে স্বর্ণ সেই বাড়িতে থাকতে ভয় পেল’। লক্ষ্মীনাথ বলল ‘তারপর ওদের আমাদের এখানে এনে রাখলাম। এখানে দুদিন থাকার পরে কটক থেকে ক্ষীরোদ বাবু এসে ওদের নিয়ে গেল।’

‘জ্ঞান?’

‘সেও কটকে গিয়েছে।স্বর্ণদের সঙ্গে দুই মাস থাকবে।’

‘তাহলে স্বর্ণের দুর্দিন পার হল। প্রিন্সিপাল ক্ষীরোদ বাবু মানুষ হিসেবে কেমন?’

‘উদার এবং উচ্চমানের মানুষ না হলে কি প্রিন্সিপাল হয়ে দুই মেয়ের মা বিধবা স্বর্ণকে বিয়ে করে? দেরিতে হলেও তার একটা গতি হল। এখন জ্ঞানের কিছু একটা হলে নিশ্চিত হতে পারতাম।’

‘এখন জ্ঞানকে সুস্থ বলেই মনে হয়।’

‘গোলাপদার পরামর্শ অনুসারে তাকে ডক্টর নীলরতন সরকারকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম।’

‘ডক্টর নীলরতন সরকার!'

' এফ আর সি এস পাশ করে বিলেত থেকে এসে ডক্টর সরকার এখন কলকাতার এক নম্বর ডাক্তার। একেবারে ধন্বন্তরি। শরীরে হাত দিয়েই রোগ ধরতে পারেন। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডঃ সরকার জ্ঞানের সমস্ত কিছু ঠিকই আছে বললেন। এখন তাকে পুনরায় বিলেত পাঠাতে হবে। বিলেতে স্যার জগদীশচন্দ্র বোসের কেয়ারে থেকে ব্যারিস্টারি পড়তে শুরু করেছিল, অসুস্থ হওয়ার জন্য পড়া শেষ করতে পারল না।'

'পুনরায় কবে পাঠাবে?'

'কটক থেকে আসুক। তারপরে তার সঙ্গে কথা বলে কবে পাঠানো যেতে পারে, স্থির করতে হবে।'

ভোলানাথ মনে মনে কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল,' বুঝেছ বেজ আমিও একবার বিলেত থেকে ঘুরে আসি নাকি?'

' যেতে পারেন।'

' গত ডিসেম্বর মাসে 'যোরহাট সার্বজনিক সভা'র প্রতিনিধি রূপে ভুবন, গোপীবাবু, বাপুরা্‌ও, তুমি এবং আমি কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদানের জন্য বিএন মেইলে বোম্বাই গিয়েছিলাম-।'

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কংগ্রেস অধিবেশনে গিয়েছিলাম। যদিও শিবিরে না থেকে আমরা একটা ইংলিশ হোটেলে ছিলাম।কংগ্রেসের মিটিং এটেণ্ড করার চেয়ে টাওয়ার অফ সাইলেন্স,মালাবার হিলস ইত্যাদি সাইট সিয়িং বেশি হয়েছিল।'

' কারণ তুমি জানোই তো অধিবেশনে বসা মানেই কংগ্রেসের পাগড়ি পরা বুড়ো বুড়ো নেতাদের দীর্ঘ লেকচার শোনা আর মাঝে মধ্যে হাততালি বাজিয়ে তারা যাতে আরও দীর্ঘ লেকচার দেয় তার জন্য উৎসাহিত করা। আমার দ্বারা সে সব হয় না। তারপর তোমাকে নিয়ে আমি যে আরব সাগরের তীরে বসে ছিলাম সাগরের ঢেউগুলি এসে পারে আছড়ে পড়ে বালিতে মিশে যাচ্ছিল তখনই আমার মনটা ইউরোপের উদ্দেশ্যে উড়া দিয়েছিল'।

' জ্ঞান লন্ডনে কয়েক বছর থেকে আসা। তার সঙ্গে লন্ডন গেলে সে আপনাকে গাইড করতে পারবে।'

' লন্ডনে গাইডের দরকার পড়বে। তবে লন্ডনে শুধু ঘুরে বেড়ানোটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।'

' তারমানে কোনো বিজনেস ইন্টারেস্ট?'

' শুনছি ব্রিটিশ সরকার উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করার একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আমি যদি ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিষয়ক মন্ত্রীর কাছ থেকে তার জন্য অনুমোদন আনতে পারি, তাহলে ময়ূরভঞ্জের কিছু ফরেস্ট লিজে নিয়ে স্লিপারের বিজনেস করতে পারব। দরকার পড়লে লন্ডনেও একটা অফিস করে নেব।'

তারমানে ভোলানাথ বরুয়া তার কাঠের ব্যবসাটা দেশের বাইরে বিদেশেও সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। লক্ষ্মীনাথ পুনরায় একবার ভোলানাথের প্রখর ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় পেল। আর একবার পরিকল্পনা করেছে যখন, তিনি যে সফল হবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

' আচ্ছা বেজ, আমি যদি জ্ঞানের সঙ্গী হই সে কি খারাপ পাবে?'

 ব্যবসার ক্ষেত্রে লক্ষীনাথের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে বলে জ্ঞানদাভিরাম ভোলানাথ কে পছন্দ করে না।জ্ঞানদাভিরামের মতে ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথকে বি বরুয়া কোম্পানির লভ্যাংশ দেবার ক্ষেত্রে সুবিচার করে নি। সেটা নিয়ে লক্ষ্মীনাথের ও ক্ষোভ ছিল। এখন অবশ‍্য আর সেসব ভাবে না। আসলে লক্ষ্মীনাথের পারিবারিক পরম্পরাটা এরকম যে কারও পেছনে লাগার বা ক্ষতি করার বুদ্ধি তার ছিল না। এখন ও সে সেরকম বুদ্ধির সাহায্যে প্রতিশোধ নেওয়া তো দূরের কথা অপমান করা বা ক্ষতি করা মানুষের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতে পারে না। অন্যের প্ররোচনায় অন্যায় করার জন্য খারাপ পেলেও লক্ষ্মীনাথ খারাপ মনোভাবটা মনের মধ্যে পুষে রাখেনি, রাখতে পারেও না। বংশ কুল থেকে পাওয়া এটাই তার মানবীয় আভিজাত্য। সেই জন্যই সে বলল, ‘না খারাপ পাবে না । এমনিতেও দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার সময় আপনার মতো একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ থাকলে তাকে নিয়ে আমাদেরও আর চিন্তা থাকবে না।’

তখনই প্রজ্ঞা তাকে ডাইনিং রুমে ডাকল। দুজনে উঠে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে দেখল, প্রজ্ঞা মোহনভোগ লুচি আর মিষ্টির আয়োজন করেছে। সেসব দুজনে খাবার সময় টুকরো টুকরো ব্যবসার কথা বলল। ব্যবসার কথা থেকে দেশের বর্তমান রাজনীতির প্রসঙ্গে উঠল।

' আগে আপনি রাজনৈতিক বিষয়ে ইন্টারেস্ট দেখাতেন না। এখন দেখছি আপনি রাজনৈতিক খবরও রাখেন ।'

‘ব্যবসা ও দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক স্থিতির উপর নির্ভরশীল বেজ। তাছাড়া সেদিন মানে চৌদ্দ জানুয়ারি তারিখে দপ্তর রোডের বাড়িতে বিকেলে যে 'গার্ডেন পার্টির' আয়োজন করেছিলাম– অবশ্য সেই পার্টিতে আমি ছিলাম না, ডক্টর গোলাপ বেজবরুয়ার থেকে আমার অনারে দেওয়া কেকটা তুমি আমার হয়ে গ্রহণ করেছিলে।পার্টিতে রায়বাহাদুর জগন্নাথ বরুয়া প্রদত্ত ভাষণটার বিষয়ে ভুবনের কাছ থেকে শুনলাম। তারপর তার সঙ্গে দেখা করে এই বিষয়ে কথাবার্তা বলে বেঙ্গল পার্টিশনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের এই পলিসিটার রহস্য বুঝতে পারলাম । তোমাদের অ. ভা. উ. সা সভা দেখছি দেশের স্বার্থের জন্য কথা বলা। এটা তো একটি জাতীয় স্বার্থ। এই ক্ষেত্রে কিছু করবে না নাকি?'

' কি হল, তুমি যে চিন্তিত হয়ে পড়লে?'

' না দাদা–।' কিন্তু চিন্তিত কন্ঠেই লক্ষ্মীনাথ বলল,' তবে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিষয়টা রাজনৈতিক। আমাদের অ.ভা.উ.সা সভা রাজনৈতিক বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত নয়। আমাদের সভাপতি সম্পাদকের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় ,দেখি।'



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...