হে আমার স্বদেশ- ২৭
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(২৭)
বি ব্রাদার্স কোম্পানির বিএন আর লাইনে শাল কাঠের ব্যবসায়িক কাজকর্ম বৃদ্ধি পেল। কম দিনের মধ্যে এতই বৃদ্ধি পেল যে তার সাত দিনের খরচ যোগানোর জন্য লক্ষ্মীনাথ দশ পনেরো হাজার থেকে পঁচিশ ত্রিশ হাজার করে টাকা কলকাতা থেকে ঝাড়চোগড়াতে পাঠাতে লাগল। সাধারণত সেই টাকা অফিসের বিশ্বাসী কেরানি অথবা চাপরাশির মাধ্যমে পাঠানো হয়। পরিমান বেশি হলে লক্ষ্মীনাথ নিজেই সেই টাকা নিয়ে যায় এদিকে জঙ্গলের কাজ সরকারি কারেন্সি নোটে চলে না। নোট ভাঙ্গিয়ে টাকা,আধলি,সিকি এবং পয়সা করে না পাঠালে হয় না। কারণ অশিক্ষিত করতীয়া ,গাড়োয়ান, এবং কুলিরা নোটের মূল্য বুঝে না।
তাই প্রত্যেক সপ্তাহে হাজার হাজার টাকা ভাঙ্গিয়ে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলের অস্থায়ী অফিসে বসে শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরি দেওয়াটা একটি কষ্টদায়ক কাজ। তাছাড়া কলকাতা থেকে যেতে হয় রেলে। রেলে চোর ডাকাতের উপদ্রব থাকেই। তবে উপায় নেই। সময় মতো মজুরি না দিলে শ্রমিকরা কাজ করবে না। তারমধ্যে আবার এইসব কাজ বেশি হয়েছে। বেশি করে টাকা নিয়ে যেতে হবে। একটা লোহার বাক্সে কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে লক্ষ্মীনাথ একা বেরোলো। এত টাকা পয়সা নিয়ে রাতের রেলে যেতে চলেছে ।প্রজ্ঞা একজন সঙ্গী নিয়ে যেতে বলল। কিন্তু ব্যয় সংকোচ করার জন্য লক্ষ্মীনাথ সাহায্যকারী হিসেবে কাউকে নিল না। কেবল সেটাই নয় রেল কোম্পানিকে ফাঁকি দেবার জন্য লক্ষ্মীনাথ টাকা, আধুলি, সিকি ইত্যাদি মুদ্রার লোহার ভারী বাক্সটা বুক পর্যন্ত করল না। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ (১৯০২ সন) গত সপ্তাহ থেকে কাজের ভীষণ চাপ।অ'. এন্ড আরের কিটিং সাহেবের সঙ্গে দেখা করে লক্ষ্মীনাথ তাকে সেগুন কাঠের নমুনা দেখানোর জন্য শিবপুর টিম্বার ওয়ার্ডে গেল। জার্ডিন কোম্পানি এবং কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের কাছ থেকে পাওয়া চেকগুলি বেঙ্গল ব্যাংকে জমা দিল। শিবপুর লাইনের মাধ্যমে অতিরিক্ত কাঠ গুলি নীলামে বিক্রি করল। তাছাড়া চৌহদের ভেতরে নতুন ঘর একটা তৈরি করার জন্য দুজন পাকা মিস্ত্ৰি লাগাল। তাই সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত ব্যস্ত, যথেষ্ট পরিশ্রম হল। এদিকে গরমও পড়েছে । তারপরে ঝাড়-চোগড়াতে যাবার জন্য রেল ভ্রমণ। বসে বসে লক্ষ্মীনাথ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সে গভীর ঘুমে নিদ্রামগ্ন। রাত একটার সময় রেলগাড়ি ঝাড়চোগড়া এসে পৌঁছাল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ জেগে উঠল না। স্টেশন ছেড়ে গাড়ির ইঞ্জিন হুইসেল দেওয়ার পরেই তার ঘুম ভাঙল, ধড়মড় করে উঠে বুঝতে পারল সর্বনাশ হয়ে গেছে। টাকার বাক্সটা যথাস্থানে আছে যদিও সেটাই যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছে– 'বন্ধু আজ ফাঁদে পড়লে । বেঞ্চের উপরে চিত হয়ে পড়ে নাক ডাকতে থাক।গাড়ি ঝাড় চোগড়া পার হয়ে গেছে। লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে পড়ল । অনিশ্চয়তা আর ভয়ে অন্তরটা শুকিয়ে গেল। এদিকে রেলগাড়ি দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। কী করবে। দু'ঘণ্টা পরে রেলগাড়ি রায়গড় পৌঁছালো ,একটা স্টেশনে ট্রেন বেশিক্ষণ থামেনা। এদিকে রাত তিনটা বেজেছে। নির্জন নিস্তব্ধ স্টেশন ।একটাও কুলি নেই। তবু মরণবাচন পণ করে প্রাণপণে টাকার ভারী বাক্সটা নিজেই টেনে হেঁচড়ে নিয়ে কোনোমতে প্লেটফর্মে ফেলে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল ।ইতিমধ্যে দুই মিনিট পার হয়ে গেছে। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে রেলগাড়ি স্টেশন পার হয়ে রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে হারিয়ে গেল । জন প্রাণীহীন রায়গড় স্টেশনে ধনের বাক্সটা নিয়ে লক্ষ্মীনাথ ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই আলো হাতে নিয়ে দেবদূতের মতো এগিয়ে এল স্টেশন মাস্টার। কণ্ঠস্বর শুনে তিনি বাঙালি বলে বুঝতে পেরে লক্ষ্মীনাথ ও অকূলে কুল পেল । নিজের অঘটনটার কথা দুঃখের সঙ্গে ব্যক্ত করে লক্ষ্মীনাথ স্টেশন মাস্টারের শরণাপন্ন হল । কথাবার্তা শুনে স্টেশন মাস্টার লক্ষ্মীনাথকে বাঙালি বলে ভাবলেন আর বিদেশে বাঙালি বাঙালির জন্য সবসময়ই সজ্জন। লক্ষ্মীনাথের প্রতি ও তার দয়া জন্মাল। সেটা লক্ষ্য করে লক্ষ্মীনাথ যেন তেন প্রকারেন ঝাড়চোগড়াতে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য স্টেশন মাস্টারকে অনুরোধ করল। এক ঘন্টা পরে একটা মাল গাড়ি এল। স্টেশন মাস্টার মালগাড়ির ফিরিঙ্গি গার্ডকে বলে স্টেশনে শুয়ে থাকা একজন কুলিকে ডাকল। তারপর কুলিটা ভারী বাক্সটা মালগাড়ির গার্ডের ডাবায় তুলে দিল।
অনিশ্চয়তার সঙ্গে পরিশ্রম, সময়ে খাওয়া-দাওয়া না হওয়া, বিশ্রাম নেই, ঘুম নেই ,বিগ ব্রাদার্স কোম্পানির উন্নতির জন্য লক্ষ্মীনাথ সমস্ত কিছু সহ্য করেছে। সেদিন চন্দ্রকুমার সতর্ক করে দেওয়ার জন্য মনে সংশয় সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল যদিও লক্ষ্মীনাথ এখন ও নিজেকে ভোলানাথের চেয়ে আলাদা মনে করে না। তার মনোভাবটা এরকম যে এত কষ্ট পরিশ্রম করা মানেই ভোলানাথের উন্নতি এবং ভোলানাথের উন্নতি মানে তার উন্নতি। কিন্তু আত্মভোলা লক্ষ্মীনাথ যেভাবে ভাবে সংসারের সবাই সেভাবে ভাবেনা।
অসম থেকে আগত ভোলানাথের আত্মীয়-স্বজনদের ভেতরে ভবানীচন্দ্র বরদলৈ, ভোলানাথের ভাগ্নে ভুবনচন্দ্র এবং মহীনারায়ণকে কোম্পানির বিভিন্ন কাজে লাগানো হল। কাঠের ব্যবসায়ের কাজে এরা অভিজ্ঞ নয়। দায়িত্ব পালনে এতটা আন্তরিক নয়। শৈশব থেকে অসমে থাকা, লেখাপড়ায় এত অগ্রণী নয় বলে লক্ষ্মীনাথের মতো তাদের কেউ গতিশীল মনের নয়। তার জন্যই ব্যবসায়ের দায়িত্বপূর্ণ বিশেষ করে টাকা-পয়সার লেনদেন এবং হিসাবপত্র রাখার কাজগুলি তাদের দেওয়া হল না। আগের মতো সেই সমস্ত কিছুর দায়িত্ব লক্ষ্মীনাথের কাছে রইল এটা ভোলানাথের আত্মীয় স্বজনদের পছন্দ হল না।। ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথকে বেশি গুরুত্ব দেয় সেটাও আত্মীয়দের কাছে লক্ষ্মীনাথ ঈর্ষার কারণ হয়ে পড়ল। অপদার্থরা নিজে অর্থ উপার্জন করতে পারেনা যদিও অন্যে উপার্জন করা অর্থের প্রতি লোভ করে। তাদের আত্মীয় অকৃতদার ভোলানাথ বরুয়ায় নিজের ঘর সংসার নেই। কলকাতায় কাঠের ব্যবসা করে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী। ভোলানাথ বি ব্রাদারস কোম্পানির মালিক। স্বাভাবিক ভাবেই আত্মীয়রা উত্তরাধিকারী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগল। তাদের এই অভিলাস আকাঙ্ক্ষার কথা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রকাশ পেল এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার যে জোর জল্পনা চলছে এই বিষয়ে প্রজ্ঞাও জানতে পারল। এই বিষয়ে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে কথা বলল। লক্ষীনাথ প্রজ্ঞাকে এই বলে আশ্বস্ত করল যে দাদা হয়ে ভোলানাথ কখনও প্রাপ্য অংশ থেকে তাকে বঞ্চিত করবেনা। কিন্তু প্রজ্ঞার মনের আশঙ্কা দূর হল না। সে জোড়াসাঁকো গিয়ে এই বিষয়ে মা নিপময়ী দেবীর সঙ্গে কথা বলল। মেয়ে জামাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিপাময়ী দেবী অস্থির হয়ে পড়লেন। নিপময়ী দেবীও ভাবেন ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথের দাদার মতো। তার জন্যই প্রতিবছর তিনি ভোলানাথকে জোড়াসাঁকোতে আমন্ত্রণ জানান এবং আদর অভ্যর্থনা করে খাইয়ে কিছু না কিছু একটা উপহার দেন। এবারও দুপুরবেলা খাবার জন্য ভোলানাথকে নিমন্ত্রণ করলেন। ভোজনের পরে ভোলানাথকে একটা মূল্যবান অভারকোট উপহার দিয়ে নিপময়ী দেবী বি বরুয়া কোম্পানির সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিষয়টা উত্থাপন করলেন। বি বরুয়া কোম্পানির উত্থানের ক্ষেত্রে লক্ষ্মীনাথের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি অনুরোধ করলেন যে বিষয় সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ার ক্ষেত্রে ভোলানাথ যেন লক্ষ্মীনাথের প্রতি সুবিচার করেন। উপহার হাতে নিয়ে ভোলানাথ শান্ত হয়ে বসে রইল। নিপাময়ী দেবী পুনরায় অনুরোধ করার পরে ভোলানাথ গম্ভীর সুরে বললেন-‘ আচ্ছা দেখি এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি’ বলে বিদায় নিয়ে চলে এল। লক্ষ্মীনাথের শাশুড়ি মা সক্রিয় হয়ে উঠায় ভোলানাথের ভাগ্নে ভবানী আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সেদিনই আসাম থেকে তাদের আর ও একজন আত্মীয় এল। তার নাম গোলক। এইসব শুনে তিনি বাকিদের সঙ্গে সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত আলোচনা করলেন। তারা এটাও ভাবলেন যে প্রতিপত্তিশালী ঠাকুরবাড়ির মানুষ যখন উঠে পড়ে লেগেছে ভোলানাথের সম্পত্তির সিংহভাগ লক্ষ্মীনাথই পাবে, রক্তের সম্পর্ক থাকা আত্মীয়দের পাওয়ার আশা ক্ষীণ আর পেলেও কণা মাত্র পাবে।
এইসব নিয়ে আরও কথা বাড়ল। কথাগুলি জানতে পেরে একদিন ডবসন রোডের বাড়িতে বসে ভবানীকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে ভোলানাথ বলল,' দেখ ভবানী কেনার দিন থেকে পরিবারদের সঙ্গে বসবাস করছে যখন ডবসন রোডের এই বাড়িটা লক্ষ্মীনাথই পাবে, বিলাসপুরের বাড়িটা মহীকে দেওয়া হবে আর আসানসোলের বাড়িটা তোমাকে দেব।'
তখনই একদিন চন্দ্রের কাছ থেকে ভবানী শুনল যে ভোলানাথ আসানসোলের বাড়িটা চন্দ্রকে দেবে। হতাশ ভবানী অন্ধকার দেখল । এদিকে ভবানী বুঝতে পারল যে ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথকে ভালোবাসে এবং তার প্রতি ভোলানাথ খুবই সদয়। ভবানী লক্ষ্মীনাথের শরণাপন্ন হল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ ভুবনের জন্য ভোলানাথের সম্পত্তির ভাগ দেবার কথা বলতে পারবে না বলে জানাল। তারপরেও অনুরোধ করায় লক্ষ্মীনাথ ভবানীকে নিজে বলার জন্য পরামর্শ দিল।
এতদিন পর্যন্ত ভোলানাথের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অনভিপ্রেত ঝগড়াটা মান সম্মান রক্ষা করে চলে আসছিল। তারপরের ঘটনাগুলি অত্যন্ত নিম্ন রুচির, অতিশয় গ্লানিদায়ক। চাহিদা মতো সাহায্য না পেয়ে ভবানী লক্ষ্মীনাথের বিরোধী হয়ে পড়ল। সে ভোলানাথের কাছে লক্ষ্মীনাথের বদনাম, গোলোককে ভোলানাথের একমাত্র উত্তরাধিকারী বলে প্রচার, বারবার অনুরোধ করার পরও লক্ষ্মীনাথ মহীর মেয়েটিকে ডবসন রোডের বাড়িতে থাকতে না দেওয়ার জন্য মহী 'আমি লক্ষ্মীনাথকে শিক্ষা দেব' বলে ধমক দেওয়া, ভুবন এবং ভুবনের ভাইকে ডবসন রোডের বাড়ির উপরের তলায় থাকতে দিতে হবে বলে কথাটায় লক্ষ্মীনাথ তীব্রভাবে বিরোধিতা করা ইত্যাদি ঘটনাক্রমের পরে ভোলানাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের সম্পর্কটা তিক্ত হয়ে পড়ল।
তারপরে ১৯০৪ সনের ফেব্রুয়ারি ২৪ তারিখ ক্লাইভ রোডের অফিসে গিয়ে লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথের একটা চিঠি পেল। চিঠিটা পড়ে তার মাথার উপরে আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথের সততার উপরে প্রশ্ন তুলেছে। তাছাড়া ব্যবসা পরিচালনায় তার দক্ষতার অভাব বলে অভিযোগ উত্থাপন করেছে। তাই লক্ষ্মীনাথ ভবিষ্যতে বেঙ্গল ব্যাংক এবং হংকং ব্যাংকে লেনদেন করতে পারবে না বলে ভোলানাথ নির্দেশ দিয়েছে। তার মানে সে আর ভোলানাথের বিশ্বাসের পাত্র নয়। এটা অপমান ।সাংঘাতিক অপমান। লক্ষ্মীনাথের এরকম মনে হল যেন ভোলানাথ অন্যায় ভাবে প্রচন্ড শক্তিতে তার মাথায় আঘাত করেছে । তার মাথা ঘুরতে লাগল। মুহূর্তের জন্য ও থাকতে না পেরে অফিস থেকে বেরিয়ে এল।
লক্ষ্মীনাথকে চিঠি দিয়ে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে উক্ত ব্যাংক দুটিকেও লক্ষ্মীনাথ সই করা চেকে টাকা দিতে নিষেধ করলেন। তার জন্যই পরদিন লক্ষ্মীনাথ সই করা চেকগুলি বেঙ্গল এবং হংকং ব্যাংক ফেরত পাঠাল। এটাও অপমান। এই অপমান সহ্য করতে না করতেই লক্ষ্মীনাথ আরও একটি চিঠি পেল। এই চিঠির ভাষা ও মারাত্মক। চিঠির মাধ্যমে ভোলানাথ নির্মমভাবে নির্দেশ দিয়েছে যে তার ভাগ্নে এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্য রান্নাঘর, ডবসন রোডের নিচের মহলটা তখনই খালি করে দিয়ে পরিবার নিয়ে লক্ষ্মীনাথকে উপরতলায় উঠে যেতে হবে।
লক্ষ্মীনাথ দিশাহারা হয়ে পড়ল। কী করবে কী না করবে ভাবতে ভাবতেই পরের দিন অফিসের কর্মচারী গোপী আরও একটি চিঠি নিয়ে এল। এটিও ভোলানাথের চিঠি। পুনরায় সেই একই নির্দেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রান্না ঘরসহ নিচের মহল খালি করে দিতে হবে। এইবার লক্ষ্মীনাথ অনুভব করল সত্যিই তার সর্বনাশ হল। তার চিৎকার করে করে বলতে ইচ্ছা হল অবশেষে রক্ষকই ভক্ষক হল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ নিজেকে সামলে নিল। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল তার পক্ষে ডবসন রোডের নিচের মহল খালি করে দেওয়াটা সম্ভব নয়।
পরেরদিন ভাই ধর্মকে সঙ্গে নিয়ে ভুবন ডবসন রোডের নিচের মহল দখল করতে এল। খালি করে দেব না বলে লক্ষ্মীনাথ নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। কথাটা জানতে পেরে ভোলানাথ সম্বলপুর থেকে টেলিগ্রাম পাঠাল, বেজ. যত দ্রুত সম্ভব আমার নির্দেশ পালন কর। ভোলানাথ এতটাই উত্তেজিত, এতই ক্ৰোধিত হল যে পৃথক একটি টেলিগ্রাম করে অতুলকৃষ্ণ ঘোষকে নির্দেশ দিল লক্ষ্মীনাথ যাতে এখনই নিচের মহল ছেড়ে দেয় তার জন্য আপনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। অতুল কৃষ্ণ ঘোষ আত্মসম্মান থাকা ব্যক্তি।বি বরুয়া কোম্পানির কর্মচারী হয়ে তিনি কেন এই পারিবারিক মামলায় নিজেকে জড়িত করবেন? তিনি সঙ্গে সঙ্গে টেলিগ্রাম করে ভোলানাথকে জানিয়ে দিলেন আপনি নিজে এসে লক্ষ্মীনাথের ঘর ছেড়ে দেওয়ার কথাটা নিষ্পত্তি করুন। ভোলানাথ নিজে না এসে পরের দিন পুনরায় টেলিগ্রাম করে লক্ষ্মীনাথকে ধমক দিলেন এক্ষুনি নিচের মহল খালি করে না দিলে কথা খারাপ হবে।'
কিন্তু ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথের মুখোমুখি হল না। কলকাতার বাইরে অথবা কলকাতার অজানা কোনো জায়গায় অবস্থান করে চিঠি লিখে অথবা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে এবং নিজের ভাগ্নেদের দ্বারা লক্ষ্মীনাথের উপরে চাপ প্রয়োগ করতে লাগল। লক্ষ্মীনাথ অফিসে যায় তবে ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো কাজকর্ম করে না। অতুল কৃষ্ণ বাবু লক্ষ্মীনাথের আপনজন। তিনি সমস্ত কিছু জানেন। তিনি প্রকৃতই লক্ষ্মীনাথের শুভাৰ্থী। তার সঙ্গে কথাবার্তা হলে দুঃখ যন্ত্রণা কমবে কিন্তু তার সঙ্গে এইসব নিয়ে কথা বলতে খারাপ লাগে। কথা বলার কথা ভাবলেই মনে কী রকম একটা গ্লানির সৃষ্টি হয়। ঠেলা ধাক্কা দিয়ে দিনটা কোনোভাবে অতিক্রম করে ইন্ডিয়া ক্লাবে যায়। বিলিয়ার্ডস খেলা শুরু করে। আগের মতো খেলায় মনোসংযোগ করতে পারেনা। প্রতিটি গেমে হেরে ম্লান মুখে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে প্রজ্ঞা এবং সাড়ে তিন বছরের শিশু কন্যা অরুণা। সংবেদনশীল প্রজ্ঞাৰ ভালোবাসা, প্রতিমুহূর্তের সেবা যত্ন তার কাছে বেঁচে থাকার শক্তি। প্রজ্ঞা ঘটে থাকা ঘটনাগুলি দেখছে ।লক্ষ্মীনাথের মনে ঘটনাগুলির প্রতিক্রিয়া জেনে সে বুঝতে পারে। নিজে কিছু বলে না। সেইসব নিয়ে কথা বললে লক্ষ্মীনাথের অন্তরে জ্বলতে থাকা ক্ষোভ- যন্ত্রণার আগুন আরও বাড়বে বলেই সে কিছু বলে না। সকাতরে ভালোবাসার দৃষ্টিতে লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সুদর্শন লক্ষ্মীনাথ সব সময় প্রফুল্ল থাকে, তাঁর কথায় কথায় কত রস, এখনও সতেরো আঠারো বছরের তরুণের মতো এটা ওটা কথা বলে তাকে হাসিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত প্রাণবন্ত করে তোলে। সেই মানুষটা একেবারে নীরব- নিথর হয়ে পড়েছে। লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রজ্ঞার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে।
এগারো দিনের মাথায় ভুবনকে সঙ্গে নিয়ে ঝাড়চোগড়া থেকে ভোলানাথ ডবসন রোডের বাড়িতে এল। কিন্তু এক কাপ চা ছাড়া সকালের জলখাবারের কিছুই খেল না ।লক্ষ্মীনাথকে দেখল যদিও কথা বলল না। প্রজ্ঞা মানসিকভাবে সাহসী মহিলা। সে ভোলানাথের মুখোমুখি হল। শান্ত কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে প্রজ্ঞা বলল,' বাইরে থেকে চিঠি আর টেলিগ্রামের মাধ্যমে আপনাদের যোগাযোগ হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে এটা কি চলছে বলুনতো ?দুই ভাই এক সঙ্গে বসে সমস্যা গুলি আলোচনা করে মিটিয়ে নিলে ভালো হত না কি? প্রজ্ঞা এভাবে বলার পরেও ভোলানাথের রাগ কমল না। বরং প্রজ্ঞার সঙ্গে তিনি কটু ব্যবহার করলেন। পরের দিন লক্ষ্মীনাথ অফিসে গেল না । মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। ইন্ডিয়া ক্লাবে গেল যদিও বিলিয়ার্ড না খেলে নিজের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবল। এবার স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল ,না, এভাবে চলতে পারে না। পুনরায় একটি কঠোর সিদ্ধান্ত নেবার সময় উপস্থিত হয়েছে। সেদিনই রাতে ভোলানাথ বাড়িতে এল। রাতের আহার খাবার সময় হল। টেবিলে সমস্ত কিছু তৈরি করে প্রজ্ঞা নিজেই ভোলানাথকে খাবার জন্য ডাকল। কিন্তু ভোলানাথ খাবার টেবিলে এল না। দেখে লক্ষ্মীনাথের আর সহ্য হল না। দীর্ঘ পদক্ষেপে ভোলানাথের রুমে প্রবেশ করে রোষতপ্ত কন্ঠে বলল –'দাদা এখন ডিনারের সময়। সবকিছু রেডি করে পরি আপনাকে ডেকেছে । আপনি ডিনারে আসেননি কেন?
ভোলানাথ বিছানায় আধা শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে উঠল। স্থির দৃষ্টিতে লক্ষীনাথের দিকে তাকাল। তারপরে অবদমিত ক্রোধের সঙ্গে বলল যাকে আমি নিজের ভাই বলে ভেবেছিলাম সে যদি আমার আদেশ নির্দেশ না মানে তাহলে তার ওয়াইফ রান্না করে দেওয়া খাবার কীভাবে খাই ?
ভাই ,আপনি আমাকে আপনার ভাই বলে ভাবেন? ভাই বলে ভাবলে আপনি আমাকে চিঠির পরে চিঠি লিখে পাঠিয়ে বাড়ি ছাড়ার জন্য আদেশ দিতে পারতেন? টেলিগ্রাম করে এভাবে আমাকে ধমক দিতে পারতেন?
‘বেজ, তুমি উত্তেজিত হয়েছ? তোমার কণ্ঠস্বর তীব্র হয়ে উঠছে ।তুমি কি বলতে চাইছ?’
‘আমি বলতে চাইছি যে আসলে আপনি আমাকে নিজের ভাই বলে ভাবেন না। আমি আপনার ভাই বলে অন্যের সামনে পরিচয় দিয়ে আপনি আমাকে ইউটিলাইজ করেন। এত বছর আমাকে ইউটিলাইজ করে বি ব্রাদার্স কোম্পানি যখন কলকাতা তথা সমগ্র ইস্টার্ন ইন্ডিয়ায় এক নম্বর উড মার্চেন্টের ফার্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত হল তখন আপনি আপনার ভাগ্নেদের উস্কানিতে আমাকে অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে চলেছেন । আপনি আমাকে শেষ করে দিয়েছেন ,আই হ্যাভ বিন রুইনড বাই ইউ।’
লক্ষ্মীনাথের উত্তেজনা বাড়ছে দেখে ভোলানাথ নিজের ক্রোধ উত্তেজনা সংযত করল। এমনিতেও সে বুদ্ধিমান। অনেক ধরনের বিপরীত পরিস্থিতি বেশ কৌশলের সঙ্গে নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে পারে । তার জন্যই সে কিছু সময় নিল। বিছানা থেকে নেমে বেশ বড়ো ঘরের মেঝেতে গম্ভীর ভাবে পায়চারি করে আগের চেয়ে কিছুটা শান্ত কণ্ঠে বলল,' ইউ হ্যাভ বিন রুইনড বাই মি'। আমার চরম শত্রু ও তোমার এই কথা বিশ্বাস করে না । তবে আমি তোমাকে রুইন করতে পারি। কিন্তু করব না। তোমাকে খারাপ পেয়েছি যদিও আমি তোমার সর্বনাশ চাই না ।’
‘আপনি আমাকে খারাপ পেয়েছেন? কেন?আমি কী অন্যায় করেছি?’
‘ সেই সব অনেক কথা। সেই সব বলে তোমার সঙ্গে ঝগড়া বাড়াতে আমি চাইনা।’ ‘কিন্তু আপনাকে সেসব বলতেই হবে। কেন আপনি আমার বেঙ্গল এবং হংকঙ ব্যাংক থেকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি উঠিয়ে নিলেন? আমি কোথায় কী অবিশ্বাসের কাজ করেছি? আমাকে সমস্ত কিছু জানাতে হবে।’
‘ সেইসব বলার আগে তুমি আমাকে বলতো আমার এই সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার কথা নিয়ে আমাদের মধ্যে যখন কথাবার্তা চলছে তখন তোমার হয়ে তোমার শাশুড়ি মা আমাকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডেকে নিয়ে তোমার হয়ে কেন তিনি ওকালতি করতে গেলেন?'
‘তিনি আমার অভিভাবক । তাছাড়া আপনি আমাকে সহোদর ভাই বলে ভাবেন যখন তিনি আপনার আত্মীয় হিসেবে আপনাকে এই কথাটা বলতেই পারেন।’
‘ তথাপি বিজনেসের কথায় শ্বশুরবাড়ির মানুষকে জড়িত করাটা…’
‘ অথচ বিজনেসের শুরুতে আপনি ঠাকুরবাড়ির জামাই লক্ষ্মীনাথ আমার আদরের ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কলকাতার অভিজাত মহলে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য যত্নশীল ছিলেন এবং সেটাকে বিজনেসের একটা ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ভোলানাথ দেখল লক্ষ্মীনাথ আগের মতো তাকে ভয় করছে না, সমীহ করছে না। তার জন্য কী বলবে ভেবে পেল না।
‘ দাদা? আমি যখন কলেজ স্ট্রিটের মেসে থাকতাম তখন থেকে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয় মানে ,আপনি নিজেই আমার মেসে এসে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। খোশ গল্প ,রঙ্গিন কথাবার্তা এভাবে বলতেন যে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। দিনের পর দিন আপনি আমার মন জয় করে নিয়েছিলেন। আমার হয়ে যাওয়া বিয়ের বিষয়ে উদার মন্তব্য দিয়ে আপনি আমার মন জয় করেছিলেন। কণ্ঠস্বরটা নামিয়ে লক্ষ্মীনাথ ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল তারপর থেকে আপনার সঙ্গে আমার রিলেশন। আপনি যখন অসুস্থ হয়ে শয্যাগত হলেন তখন আমি এম এ এবং তার একমাস পরে বিএল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। পরীক্ষার পড়াশোনা একপাশে সরিয়ে রেখে এবং প্রজ্ঞাকে জোড়াসাঁকোতে রেখে দিনের পর দিন আপনার সঙ্গে থেকে আপনার অসুস্থ অবস্থায় আপনাকে সেবা শুশ্রূষা করেছিলাম। আর আপনার সেরকম অবস্থায় সেটাই কর্তব্য বলে আমার বিশ্বাস হয়েছিল। তার জন্য আমি পড়াশোনা করতে পারলাম না। আমার পরীক্ষা ভালো হল না। দুটো পরীক্ষাতেই ফেল করলাম।’
ভোলানাথ চুপ করে কথাগুলি শুনছে যদিও লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকাচ্ছে না।
‘একটা নিঃশ্বাস ফেলে লক্ষ্মীনাথ বলল,' তারপরেও আমি আপনার সঙ্গ ছাড়িনি। আর সঙ্গ ছাড়িনি বলেই স্বাধীনভাবে কিছু একটা করার মানসে আপনার সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলাম। আমি স্বীকার করছি, বেজবরুয়া বংশের সন্তান হওয়ার জন্য আমি ব্যবসার কিছুই জানতাম না। আজ ব্যবসার যা শিখেছি সেটা আপনার কাছ থেকেই শিখেছি। কিন্তু তার জন্য আপনি আমাকে যেভাবে যা করতে বলেছেন সেইসব করতে দ্বিধা করিনি ।কম বেশি হলেও আমার তরফ থেকে নিশ্চয় আন্তরিকতা নিষ্ঠার অভাব ছিল না। আপনি শুনেছেন গত বছর যে লোহার বড়ো বাক্সে টাকা-পয়সা নিয়ে একা রাতে ঝাড়চোগড়ায় যাবার সময় কী রকম বিপদে পড়েছিলাম– লাইফ রিক্স নিয়ে সেই বিপদ থেকে কোনো মতে রক্ষা পেয়েছিলাম। আপনার নির্দেশ অনুসারেই আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কালী কৃষ্ণ প্রামানিকের ফার্ম থেকে অতুল বাবুকে আনিয়েছি আর আপনি এটাও জানেন যে অতুলবাবু কেবল আমার জন্যই বি বরুয়া কোম্পানিতে যোগদান করেছেন। তারপরে –।'
পুনরায় লক্ষ্মীনাথ থামল। সহজাত রুচিবোধ তাকে এসব বলতে বাধা দিচ্ছিল। কিন্তু তার অন্তরে অপরিসীম যন্ত্রণা ।না বললে শান্তি পাবে না ।
'আপনাকে দাদার মতো সম্মান করি বলেই ডবসন রোডের এই বাড়ি কেনার সময় উকিলকে বলে আপনার নামে রেজিস্ট্রি করিয়েছিলাম। আপনি আমাকে আপন বলে ভাবতেন বলেই এই বাড়িটা মেরামতি করে নতুন করে কয়েকটি প্রয়োজনীয় রুম তৈরি করে লন টেনিসের গ্রাউন্ড নির্মাণ করেছি। সেসব করতে গিয়ে দিনে রাতে মিস্ত্রি এবং লেবারদের সঙ্গে লেগে দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে আনার সময় আমার কতটা পরিশ্রম হয়েছে সেসব আপনি দেখেছেন ।এটা আমাদের দুজনের বাড়ি বলেই আমি এভাবে পরিশ্রম করেছিলাম। আর আমরা দুজনে সুখে আনন্দে থাকব বলেই করেছিলাম। অথচ বি ব্রাদার্স কোম্পানির উন্নতি, লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার এবং কয়েক জায়গায় সম্পত্তি দেখে এই সেদিন অসাম থেকে আপনার আত্মীয়রা এসে প্রত্যেকেই সম্পত্তির ন্যায্য উত্তরাধিকারী বলে প্রতিপন্ন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এত অভিজ্ঞ এত বুদ্ধিমান হয়েও আপনি তাদের কথায় আমার পছন্দের নিচের মহলটা ছেড়ে দিতে বললেন। দাদা, এই বাড়ির প্রতিটি ঘরের প্রতিটি ইটে আমার হাতের স্পর্শ রয়েছে। এই বাড়ির এত সুন্দর কালারিং, পেছনে চাকরদের ঘর, ঘোড়ার আস্তাবল, সামনের বাগান, লন টেনিসের কোর্ট, সুরভির জন্য নির্মাণ করা স্মৃতি ঘর, এই সবকিছুই আমার প্লেনিং। আমি আপনাকে আর প্রজ্ঞাকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকব বলেই এত যত্নের সঙ্গে এসব করেছি। অথচ এখন এই বাড়িতে আমি আমার পছন্দ অনুসারে থাকতে পারব না । শেষের দিকে লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল। অপরিসীম হতাশা এবং চূড়ান্ত বিরক্তিতে সে ভোলানাথের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল ।
লক্ষ্মীনাথের আবেগিক অবস্থাটার দিকে তাকিয়ে ভোলানাথের রাগ কমে এল। চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কোমল কন্ঠে বলল' ভাত বেড়ে বৌমা অপেক্ষা করে রয়েছে। চল, খেতে চল।’
সতেরো দিন পরে ভোলানাথ এবং লক্ষ্মীনাথ পুনরায় এক সঙ্গে রাতের আহার খেতে শুরু করল। প্রজ্ঞা পরিবেশন করল। প্রজ্ঞার রান্না করা তরকারি দিয়ে ভোলানাথ বেশ তৃপ্তি সহকারে খেল।
কিন্তু লক্ষ্মীনাথ খেতে পারল না। এখনও তার ক্রোধ কমেনি । তার আরও কিছু কথা বলার আছে ।বিশেষ করে নিজে না এসে ভোলানাথ বাইরে থেকে যে চিঠি এবং টেলিগ্রামে একটার পর একটা নির্দেশ পাঠিয়েছিল এবং তার এই ঝগড়াই যে অতুল কৃষ্ণ বাবুর মতো একজন ভদ্রলোককে জড়িত করে কাপুরুষের কাজ করেছিল এইসব লক্ষ্মীনাথের বলতে ইচ্ছা করল। কিন্তু কিছু ভোলানাথকে অনুতপ্ত দেখে লক্ষ্মীনাথের এসব কথা বলতে খারাপ লাগল।
খেয়ে উঠে ভোলানাথ আশ্বাস দেবার সুরে বলল,' বেজ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি ,কিছুদিনের মধ্যে সমস্ত নিষ্পত্তি করব। তোমার প্রতি যাতে কোনো অবিচার না হয় সেটাও দেখব ।’
লক্ষ্মীনাথ আশ্বস্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু এভাবে বলে ভোলানাথ তাকে অনুগ্রহ করতে দেখে তার মাথায় আগুন জলে উঠল।
' শুনুন দাদা, এই কয়েকদিন আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।' লক্ষ্মীনাথের মুখ কঠিন। চোখ দুটি জ্বলছে,' আপনি বি ব্রাদার্স কোম্পানিতে আমার কী অবদান সেই বিষয়ে যা বিচার করার করবেন । কিন্তু আমার প্রতি আপনার মনে অবিশ্বাস জন্মেছে যখন আমি আর বি ব্রাদার্স কোম্পানিতে আপনার পার্টনার হয়ে থাকব না। দ্বিতীয়ত, ৩৮ নম্বর ডবসন রোডের এই বাড়িটা যেহেতু আপনার নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে, নীতিগতভাবে আমার আর এই বাড়িতে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমরা এই বাড়িটা ছেড়ে দেব। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব। কিন্তু আলাদা একটি বাড়ি খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের এই নিচের মহলে থাকতে দিন।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন