হে আমার স্বদেশ- ২৬
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
(২৬)
' কিছুদিন ধরে বড়ো উদাস উদাস লাগছে। আমার অন্তরটা যেন শূন্যতায় ভরে উঠছে। কিন্তু মাজিউ, আজ সকালে তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে, আমার মনটা অন্যরকম হয়ে পড়ল। শূন্যতার ভাবটা অনেকটা কমে গেল। আসলে এতদিন নিজের অজান্তেই মনে মনে তোমাকে খুঁজছিলাম নাকি?'
' গত সপ্তাহের পরে আমারও তোমার কথা মনে পড়ছিল,বেজ। তবে জান তো, ব্যবসার ঝামেলা। কলকাতা আসব বলে দিন- তারিখ ঠিক করে নিয়েছিলাম। তখনই নতুন করে নেওয়া একটি চা বাগানের শ্রমিকরা গন্ডগোল শুরু করল। বাগানের যুবক ম্যানেজার একজন শ্রমিককে খুব খারাপ ভাবে মারধর করল। সেটা নিয়ে হুলস্থুল। বাগানে গিয়ে তদন্ত করে দেখলাম, ম্যানেজারের দোষ। তাকে সরিয়ে দিয়ে নতুন একজন ম্যানেজারকে ঠিক করে শ্রমিকটিকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমস্ত কিছু স্বাভাবিক করে তুলতে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল।'
' এদিকে তোমার প্রেছ–' আসাম প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স লিমিটেডের কাজকর্ম কী রকম চলছে?'
' মোটামুটি চলছে, কিন্তু বাবার আমল থেকে যে দশম, কীর্তন, গুণমালা ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ প্রকাশ করার কাজগুলি চলছিল, সেগুলি অনেকটা কমে গেল। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় বাবা আগের মতো আর দেখাশোনা করতে পারে না। বাগান নিয়ে আমিও এত ব্যস্ত যে সময় দিতে পারি না। অন্যদিকে, বইও তেমন পাওয়া যায় না। আর পাব কীভাবে? অসমে বই লেখা মানুষ আর কতজন? তোমরা যে কয়জন লেখালেখি করছ, কলকাতাতেই বই ছাপা হয়।'
' তবু তেজপুরের সেই প্রেছটির মাধ্যমে তোমরা অসমিয়া ভাষা- সাহিত্যে ভালো সার্ভিসই দিয়ে চলেছ। তুমি নিজে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত থাকার ফলে তোমাদের প্রেস থেকে ছাপা হয়ে বেরুনো বইগুলির ভাষা এবং বানান শুদ্ধ হয়। আর তুমি পার ও বটে, একদিকে প্রেছের কাজ দেখাশোনা করা, অন্যদিকে কয়েকটি চা বাগান চালানো… তারপরে কাব্য দেবীর সাধনা। তুমিই আধুনিক অসমিয়া গীতি কবিতার প্রবর্তক।'
' বাড়িয়ে বলছ, বেজ। গীতি কবিতার আসনে আমাকে রেখ না। আমি এর যোগ্য নই। অন্যদিকে, ব্যবসার কথা বললে– পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ব্যবসাটা হল আমার জীবিকা। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতেই হবে।'
' ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে মানে? ব্যবসায় তুমি খুবই কৌশলী, অত্যন্ত দক্ষ।'
' এবার কলকাতায় এসে খবরাখবর নিয়ে জানতে পারলাম, ব্যবসায় তুমি আমার চেয়েও অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছ। বেজবরুয়া বংশের কেউ যা করেনি, তাতে গত কয়েক বছরে কলকাতার মতো মহানগরে বাঙালি এবং মারোয়ারিদের সঙ্গে 'টেক্বা' দিয়ে এক নম্বর উড মার্চেন্ট হয়ে উঠেছ। আজ তোমার যে পজিশন … কলকাতার আড়াই একর জমিতে এত সুন্দর ঘর-বাড়ি, বাড়ির ভেতরে এত সুন্দর ফুলবাগান, মন্দির, লন টেনিসের কোর্ট, বিলিয়ার্ড খেলার জন্য ঘর, চাকর- বাকর থাকার জন্য আলাদা ঘর, গাড়ি রাখার ঘর… কলকাতায় এত কিছু করা অন্য অসমিয়া আর কে আছে, বলতো? ব্যবসায়ে তুমি সত্যিই আমার চেয়ে সফল পুরুষ।'
'এই সফলতা আমার জন্য হয় নি,মাজিউ। এই সফলতার গোড়ার মানুষটি হল ভোলা দাদা।'
' হলেও তোমার সততা, শ্রম, আন্তরিক নিষ্ঠা না হলে এত কম সময়ের মধ্যে এতকিছু করতে পারতে না।'
' কিন্তু ব্যবসাটা এক নম্বর পজিশনে টেনে তোলার ক্ষেত্রে ভোলা দাদার স্ট্রেটেজি, প্ল্যানিংগুলি সাংঘাতিক কাম দিয়েছে। কোন কাজটা কখন কাকে দিয়ে করাতে হবে, এই সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় তিনি খুবই দক্ষ। বিশেষ করে, গত বছর আমার মাধ্যমে কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী সেগুন কাঠের বিশেষজ্ঞ অতুল কৃষ্ণ ঘোষকে যেভাবে আমাদের কোম্পানিতে নিয়ে এল, তাতে দূরদর্শিতার প্রমাণ পেলাম। অতুলবাবু আসার জন্য সেগুন কাঠের বিজনেস আমাদের মনোপলি হয়ে পড়েছে। আমরা বাজারে যে দাম স্থির করি, কাস্টমার সেটা দিতে বাধ্য হয়।'
' তবে একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে, যদি কিছু মনে না কর–।'
' কী যে বল না মাজিউ, তুমি কিছু জিজ্ঞেস করবে– তার জন্য আমি তোমাকে খারাপ পাওয়াটা তোমার- আমার সম্পর্কটাকে অপমান করা হবে।'
'না, ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে তোমার দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক–।'
' হলেও তুমি আমার বন্ধু। বন্ধুর কাছে বন্ধু সবকিছু বলতে পারে। কেবল ভাই- দাদার কথা নয়, পিতা-পুত্রের কথা, এমনকি পতি পত্নীর মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার কথাও বলতে পারে।'
' না, কথাটা হল– কলেজে পড়া দিনগুলি থেকে দেখে আসছি, তুমি যতটা বুদ্ধিমান, ততটাই সরল। আসলে, লক্ষ্মীনাথের পরিবর্তে তোমার নামটা ভোলানাথ হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক না কেন, বৈষয়িক বিষয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের কথাগুলি একটু আলাদা। আত্মীয় এমন কি রক্তের সম্পর্ক থাকলেও যখন যুক্তভাবে ব্যবসা শুরু করা হয়, তখনও তাদের মধ্যে একটা এগ্রিমেন্ট বা চুক্তি থাকা উচিত। চুক্তি না থাকলে পরবর্তী সময়ে কোনো মতানৈক্য হলে একে অপরকে বঞ্চনা করল বলে সম্পর্কটা তিক্ত হয়ে পড়ে।'
'অবশ্য আমরা কখনও চুক্তির বিষয়ে ভাবিনি। সত্যি কথা বলতে গেলে, ব্যবসা আরম্ভ করার সময়ে এই কথাটা আমাদের মনে উদয় হয়নি। সেরকম কিছু একটা করে আমাদের মধ্যে অবিশ্বাসের ছায়া ফেলাটা একেবারে অনাবশ্যক এবং খারাপ বলে আমার ধারণা হয়েছিল । তাছাড়া রক্তের সম্পর্ক নেই যদিও ভোলা দাদা সবার সামনে আমাকে নিজের সহোদর বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমার কিছু ভুল দেখতে পেলে দাদা ভাইকে গালিগালাজ করার মতো বকাবকি করে সংশোধন করে দেয়। তার জন্য আমি কোনো কিছু মনে করি না। আমাকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্য থাকলে নিশ্চয় ব্যাংকের লেন-দেন করার জন্য তিনি আমাকে সই করার অধিকার দিতেন না।'
' ভালো কথা। সেরকম বিশ্বাস থাকলে চিন্তার কিছু নেই। তারপরে তোমাদের একটা দোকান আছে না?
মিসেসেলিনিয়াস। ঘর সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিক্রয় কেন্দ্র ।'
সেটা কীভাবে দেখাশোনা কর?'
' ম্যানেজার এবং কর্মচারী রেখেছি। সপ্তাহে সপ্তাহে দেখতে যাই, হিসাব-পত্র দেখে আসি ।'
'ডবসন রোডের এই ঘরটাও তোমাদের দুজনের নামে তো?'
'না, ভোলানাথ বরুয়া আমার নিজের দাদার মতো। তিনি আর আমি একই বলে ভেবে নাও। দুজনে একসঙ্গে থাকব যখন তার নামে দলিল লিখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছি ।'
'কত টাকায় কিনেছিলে?'
' বাড়িটা কেনার ক্ষেত্রে অতুলবাবু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অতুল বাবুর জন্যই কলকাতার এরকম একটি জায়গায় মাত্র বারো হাজার টাকায় বাড়িটা কিনতে পেরেছি। তারপরে পুরো বাড়িটা মেরামত করার সঙ্গে বাউন্ডারিওয়াল ইত্যাদি করতে গিয়ে প্রায় কুড়ি হাজার টাকা খরচা হয়ে গেল।
' এখন তো এটা কয়েক লাখ টাকার সম্পত্তি। তবে বেজ, মাটি- বাড়ি সম্পত্তির কথা। যুক্ত ভাবে করা ব্যবসায়ের আয়ের টাকা দিয়ে কেনা হল যখন, রেজিস্ট্রি করার সময় ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে তোমার নামটাও থাকা উচিত ছিল।'
' শোন অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠল যখন আমি সেই কথায় আসছি। আমি তাকে অবিশ্বাস করি না। দিনরাত এত কষ্ট করে নতুন করে সাজিয়ে তোলার পরে তিনি এই বাড়ি থেকে আমাকে বঞ্চিত করবে বলে ভাবতেই পারি না।'
' ভোলা দাদার প্রতি থাকা তোমার বিশ্বাসের ওপরে আমি আঘাত করছি না,বেজ। আমি সর্বান্তকরণে আশা করি যে তোমাদের মধ্যে দাদা- ভাইয়ের সম্পর্কটা অটুট থাকুক। আমি শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এবং তার সঙ্গে বৈষয়িক উপাদান গুলির বাস্তব প্রেক্ষাপটটা তোমার সামনে তুলে ধরলাম।'
'দেখ মাজিউ, কাল বিকেলে তুমি যে কিছু বৈষয়িক কথা বললে, রাতে শুতে যাবার সময় আমার মনে তা রিয়েক্ট করল। তারপরেও ভোলা দাদার ওপরে বিশ্বাস রেখে কিছু কথা ভাবলাম। ভাবতে গিয়ে গত কয়েকদিনের দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ায় আমার মনে সন্দেহ জাগল।'
' আমার কথায় তোমার মনে সন্দেহ জাগল। তাহলে তো তোমাকে এভাবে বলাটা আমার উচিত হয়নি। ভোলা দাদার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটায় বিরূপ প্রভাব ফেলার জন্য আমি দায়ী হলাম।'
' এভাবে কেন ভাবছ? তুমি তো কেবল সতর্ক করে দিয়েছ। আর বন্ধু হিসেবে তুমি আমাকে সতর্ক করতে পার। তুমি সতর্ক করে দেওয়ার জন্যই ব্যবসায় আমি আমার নিজের স্থিতিটা বুঝতে পারলাম।'
' তুমি কি বুঝতে পারলে বলতো?'
' তুমি এভাবে বলার জন্যই আমার মনে হল যে ভোলা দাদা নিজের ইচ্ছামতো তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর তিনজন আত্মীয়কে ব্যবসায় ঢুকিয়ে নিয়েছে এবং তিনি একেক জনকে এক একটা দায়িত্ব দিয়ে ওদের কাজে লাগিয়েছেন। কাজে লাগার এক বছর পার না হতেই ওরা এরকম একটি ভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে যে বিজনেসের মূল মানুষ ভোলানাথ বরুয়া, আমি অতুল বাবুর মতো একজন কর্মচারী। তারপরে আরও একটি কথা মনে পড়েছে সুরভির মৃত্যুর পরে প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি একটা তৈরি করে সামনের দিকেই ছোটো মন্দিরটায় প্রতিষ্ঠা করা কাজটা তিনি পছন্দ করেননি, মন্দিরটা তৈরি করার সময় আমাকে বলেছিলেন তার সঙ্গে আমি কথা বলে অনুমতি নিয়ে কাজটা করা উচিত ছিল। অথচ আমি ভেবেছিলাম এটা আমারও বাড়ি তাই নিজেরও ইচ্ছা অনুসারে বাড়িতে কিছু একটা করার অধিকার আমার আছে। তার মধ্যে তার এরকম কথা– এখন তার সেই সমস্ত কথা ভেবে আমার এরকম মনে হচ্ছে যেন এই বাড়ির উপরে আমার অধিকার থেকে তিনি স্বীকার করেন না।'
' যাই হোক সচেতন হয়েছ যখন, সাবধান হবে। তবে কাল তুমি বললে বেবি অরুণাকে নিয়ে বৌদি ঝাড়চোগড়ায় গিয়েছে, কিছু দরকার আছে কি?
' কোনো দরকার নেই। ঝাড়চোগড়ায় আমরা একটি কটেজ নিয়েছি। সেখানে আমাদের চাকর-বাকর আছে। ব্যবসার খাতিরে প্রায়ই যেতে হয়। গিয়ে দুই চার দিন থাকতে হয় বলেই এই কটেজের ব্যবস্থা। ঝাড়চোগড়ার কটেজটার কথা প্রজ্ঞাকে প্রায়ই বলাবলি করি। ওর যেতে ইচ্ছে হল। আমিও ভাবলাম দিন চারেকের জন্য একটা চেঞ্জ হবে। তাই পাঠিয়ে দিলাম।'
'তুমি কলকাতায় এসেছ জানতে পারলেই ও চলে আসবে।' দুই-একদিনের মধ্যে টাকা নিয়ে ভোলা দাদা ঝাড়চোগড়ায় যাবে। তিনি প্রজ্ঞাকে নিয়ে আসবেন।'
' না, আনতে হবে না। চেঞ্জে গিয়েছে- থাকুক। কয়েকদিন থেকে নিজের ইচ্ছেমতো আসুক। আমিও পরিবার এবং ছেলে দুটি- নবীন এবং অরুণকে রেখে এসেছি। ভালোই হয়েছে। কয়েকদিনের জন্য আমরা ব্যাচেলারের মতো থাকতে পারব।'
' তারমানে ম্যারেড ব্যাচেলার! অবশ্য দরকার, বিয়ের পরে একনাগাড়ে কয়েক বছর ম্যারেড লাইফ কাটানোর পরে এবং স্ত্রীর ভালোবাসা আরও গভীরভাবে পাওয়ার জন্য এই ধরনের ব্রেক প্রয়োজন।'
' ঠিকই বলেছ। এমনিতে বৌদির রান্না তরকারির মতো স্বাদ না পেলে ও তোমার রাঁধুনির রান্না খেয়ে খারাপ লাগেনি। আচ্ছা কাল থেকে আমরা কেবল বৈষয়িক কথাই বলছি। লেখা-লিখির কোনো কথাই হল না।'
' কারণটা হল বিষয়-সম্পত্তিতে আমাদের বিশেষ আসক্তি।'
বিয়ে করে ঘর- সংসার পেতেছি যখন বিষয় সম্পত্তিতে আসক্তি থাকতেই হবে।'
' ঠিকই বলেছ। ব্যবহারিক জীবনে আমাদের আরাম চাই, আয়াস চাই জীবন যাপনের জন্য আধুনিক উপকরণের প্রয়োজন। বুঝেছ মাজিউ এইসব পেতে গিয়ে সাহিত্য সাধনায় কিছু ব্যাঘাত জন্মেছে। আমরা তামসিক হয়ে পড়েছি ।তারপরে আকস্মিকভাবে সুরভি যে আমাদের ছেড়ে চলে গেল তার শোকে এতই কাতর হয়ে পড়েছিলাম যে সেই সংকটটা কাটিয়ে উঠার জন্য কিছু সময় লেগে গেল। সত্যি সন্তানের প্রতি মায়া-মোহটা বিষম বস্তু। তার জন্য আমি এখন ছোটো মেয়ে অরুণার কাছাকাছি খুব একটা যাই না'।
' সন্তানহারা পিতার কষ্ট- বেদনা অপার। তবে সহ্য না হলেও সহ্য না করে উপায় কি? আর তুমি সহ্য করতে পেরেছ। সহ্য করতে পেরেছ বলেই কাজগুলি করছ। জোনাকিতে খন্ড খন্ড করে প্রকাশিত তোমার 'লিটিকা' গত বছর(১৯০১) সেপ্টেম্বর মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেয়েছে।'
' হ্যাঁ, অনেকদিন লেগে থেকে অবশেষে প্রকাশ করলাম। এরপরে' কর্মের কৃতিত্ব লাভের উপায়' এবং জোনাকীতে প্রকাশিত 'কৃপাবর বরুয়ার কাকতর টোপোলা'ও গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার কথা ভাবছি।'
' আচ্ছা বেজ, রম্যরচনা ক্ষেত্রে কৃপাবর বরবরুয়া বলে ছদ্মনাম গ্রহণ করার রহস্যটা কী বলতো?'
' নিজের সত্তাকে দুটো ভাগে ভাগ করলে একটি সত্তা অপর সত্তাকে বিচার করতে সুবিধা হয়। তাছাড়া চোখের সামনে ঘটতে থাকা সামাজিক- রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে কিছু কথা স্বনামে প্রকাশ করতে কিছু অসুবিধা আছে।'
' কলেজে পড়ার সময় প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল', কালীপ্রসন্ন সিংহের' হুতুম পেঁচার নক্সা', মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' এবং বঙ্কিমচন্দ্রের 'কমলাকান্তের দপ্তর' পড়েছিলাম- সেই সব তোমাকে এভাবে লিখতে উৎসাহিত করেছে নাকি?'
' আমি ডিকেন্সের 'পিক উইক পেপারস' এবং গোল্ডসমিথের ‘সিটি জেন অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড ' ও পড়েছিলাম । সেইসব পড়ছিলাম বলেই কৃপাবর বরবরুয়া নামে লিখছি বলে বলতে পারিনা। তবে অবচেতন মনে এইসব লেখকের কোনো একজনের প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে। '
' কৃপাবরী লেখাগুলি পড়ে এরকম মনে হয় যেন লেখা গুলি লিখতে তুমি খুব মজা পাও।'
' মজা পাওয়া মানে চোখের সামনে কিছু ঘটনা অথবা আমাদের মানুষের চরিত্র বিচার করে আমার কখনও খারাপ লাগে, কখনও আবার রাগ হয়। সেই খারাপ লাগা এবং রাগটাই আমার মাধ্যমে রম্য রচনা রূপে বেরিয়ে আসে। এই ধারার এক একটি লেখা শেষ করার পরে রাগ, খারাপ লাগা কমে আসে। রিলিফ পাই।'
'রিলিফ পাও!'
' মানে আমি থাকি অসমের বাইরে। অসমের বাইরে থাকলেও অসম এবং অসমের মানুষের কথা আমার সব সময় মনে পড়তে থাকে। কলকাতায় থাকি যদিও অসমিয়া জনজীবনের ছবিগুলি আমার মনে ভেসে বেড়ায়। অসমিয়া মানুষ এখনও অনেক পেছনে পড়ে আছে বলে ভাবতে খারাপ লাগে। আমাদের সমাজে থাকা জড়তা, অন্ধ সংস্কার ,কুসংস্কার ,শঠতা, ধর্মীয় ভন্ডামি, দুর্নীতি, ব্যভিচার গুলি আমাকে কষ্ট দেয়। কিন্তু এখানে এই কলকাতায় থেকে সেই সব নিরাময়ের জন্য কী করতে পারি ।আমার হাতে রাষ্ট্রযন্ত্র নেই যে আইন করে সেগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তার জন্যই আমার ভেতর থেকে সেই ধরনের উইট, হিউমার বা স্যাটায়ারধর্মী লেখাগুলি বেরিয়ে আসে বলে মনে হয়। আমি চাই, আমাদের মানুষ এগুলি পড়ুক। এইসব পড়ে নিজেদের বুঝতে চেষ্টা করুক এবং সেই মতো নিজেদের সংশোধন করুক।'
' এই ধারার রচনায় তুমি খুবই সফল বেজ ।তুমি এই ধরনের লেখা লিখে যাও ।'
'লিখতে হবে ।তবে এখন পর্যন্ত আমার দ্বারা ভালো কোনো লেখা বের হল না ।'
'ভালো লেখা!'
'মানে গল্প- উপন্যাস, নাটকের মতো মৌলিক সৃষ্টি। রবিকাকা যেভাবে কবিতা লেখে সেরকম কবিতা লেখা আমার দ্বারা হবে না। তিনি গল্প লিখতে শুরু করেছেন, জমিদার সন্তান হয়েও সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা-বঞ্চনা নিয়ে মানবীয় আবেদনে সমৃদ্ধ গল্প লিখেছেন। অনুপম গল্পগুলির কী কবিত্বময় ভাষা। তারপরে তিনি 'চোখের বালি' বলে একটি উপন্যাস লিখেছেন। লেখা আর লেখা– ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠার পরে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অবিরত ধারায় কেবল লিখেই থাকেন।'
'তোমার কাকা শ্বশুরের কথাটা আলাদা। রবীন্দ্রনাথ হলেন জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদরের নন্দন। তাকে তো আর আমাদের মতো ঘর সংসার চালানোর জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য সামলাতে হয় না।
' তবু সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে রবিকাকা ঐশ্বরিক শক্তি সম্পন্ন পুরুষ বলে মনে হয়। গদ্যে বঙ্কিম বাবু শক্তিশালী। বঙ্কিম বাবুর উপন্যাসগুলিও বাংলা সাহিত্যের অনন্য সৃষ্টি। কিন্তু বঙ্কিম বাবু রবিকাকার মতো গল্প লিখতে পারেননি। মধুসূদন দত্তের পরে রবি কাকা যে কবিতা লিখেছেন– তার এক একটি কবিতার ভাব, এক একটি গীতের অনুভূতি প্রবণ শব্দগুলি কীভাবে তার চেতনা বোধে ধরা দেয় ভেবে অবাক হয়ে যাই।'
' আজকাল তিনি জোড়াসাঁকো থাকেন না বলে শুনেছি। শোন মাজিউ, অসমে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্য গুয়াহাটিতে একটা কলেজ স্থাপন করার জন্য হেনরি কটনের উদাসীন মনোভাবের প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা আমাদের অ.ভা. উ.সা. সবার মাধ্যমে একটা কলেজ স্থাপনের জন্য দাবী জানিয়েছিলাম।'
'গুয়াহাটিতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সরকারি ঘোষণা হতে চলেছে। কলেজটির নাম হবে কটন কলেজ। ইংরেজির সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষারও পথ খুলে দেবে।'
' কিন্তু রবিকাকা নতুন এক শিক্ষানীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। গতবছর(১৯০১) ডিসেম্বর মাসে রবিকাকা বোলপুরের শান্তিনিকেতনে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানে যে শিক্ষা দেওয়া হবে তার উদ্দেশ্য হল প্রভাতের আলো প্রান্তর, সবুজ গাছপাল্ নিয়ে শিক্ষার্থীদের চিত্ত স্পর্শ করানো। সেখানে আধুনিক আভিজাত্য এবং বিলাসের নাম গন্ধ থাকবে না। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেকেই প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষলাভ করবে এখন বুঝতে পেরেছ মাজিউ ব্রিটিশের কল্যাণে দেশের শিক্ষার সংস্কৃতিতে এগিয়েছে যদিও ব্রিটিশের শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয় বলে রবিকাকা নিজের প্রচেষ্টায় নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটা গড়ে তোলার জন্য কর্মক্ষেত্রে নেমে পড়েছেন। কিন্তু আমরা কি করছি? আমাদের অসমের কোনো অসমিয়া সেভাবে চিন্তা করছে বলতো?
কী হল মাজিউ, নাও এক পেগে কিছু হবে না। সারাদিনের এত পরিশ্রম, বিজনেসের এত ঝামেলা, এত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, অফিসের স্টাফদের ম্যানেজ করা, টাকা-পয়সার লেন-দেন, একাউন্টস রাখা- এই কষ্ট ক্লান্তি দূর করার জন্য বিকেলে কিছুটা হুইস্কির প্রয়োজন হয়। কলকাতায় চাটুজ্জে- বাড়ুজ্জে- মুখুজ্জে , বোস-গুহ-ঘোষ প্রতিজন অভিজাত বাঙালি 'কালীমাতার কারণ সুধা' বলে এটা শ্রদ্ধানত ভাবে গ্রহণ করে। এটা ক্লান্তি নাশক, প্রশান্তির আমেজে বিনোদনমূলক। ওহো, তোমার কাছে কঠিন বলে মনে হচ্ছে কেন ? শাকাহারি মাড়োয়ারি বলে অসুবিধা হচ্ছে? তুমি মদ বলে ভেবে অসুবিধা পেয়েছ যদি সনাতন হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে পবিত্র 'সোমরস' হিসেবে গ্রহণ কর।'
' নৈষ্টিক বৈষ্ণব হয়েও এটাতে নিয়মীয়া হয়ে পড়লে নাকি?'
' দেখ, বৈষ্ণবের পুণ্যগ্রন্থ ভাগবতেও কোথাও সুরা গ্রহণ করতে হবে না বলে কোনো উল্লেখ নেই। তাছাড়া একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় সুরা গ্রহণ করে আমি সত্যিই এনার্জি পাই আর তুমি জান আমাদের ব্যাকরণ প্রণেতা হেমচন্দ্র বরুয়াও নিয়মিত সুরা পান করতেন। তার জন্য তিনি যে শক্তি আহরণ করেছিলেন তারই ফসল 'হেমকোষ' অভিধান।'
'তোমার সুরা পানের কথা বৌদি জানেন?'
' ভালোভাবে জানে। বলেছি না, অভিজাত বাঙালি সমাজে পরিমিত মাত্রায় মদ্যপান বিধি সম্মত। সত্যিই তোমার অসুবিধা হচ্ছে নাকি?'
' অসুবিধা হচ্ছে না। এমনিতেও আমি যে একেবারে খাই না তা নয়। আচ্ছা বেজ, এখনো যে বৌদির সঙ্গে তুমি বাংলায় কথা বল?'
' বলি। অবশ্য এ নিয়ে অসমিয়ারা এমনকি আমার একেবারে নিকট আত্মীয়রাও এতে আপত্তি করে। কেউ কেউ এমন অভিযোগ করেছে যে আমি অসমিয়াতে লেখা-লেখি করি সেটা কেবল অসমিয়াদের সেন্টিমেন্ট রক্ষার জন্য। তাদের মতে প্রজ্ঞাসুন্দরীকে বিয়ে করে আমি বাঙালি হয়ে গেছি। অন্য একদল আরও এক পা এগিয়ে আমাকে একেবারে নিচে নামিয়ে দিয়ে বলে, আমি নাকি প্রজ্ঞাসুন্দরীর রূপ যৌবনে বশীভূত। তার সামনে আমার মুখ দিয়ে অসমিয়া বের হয় না।মাজিউ, আমার এই বিষয়টা নিয়ে তুমি নিজে কী ভাব?'
' বেজ এটা তোমাদের পতি-পত্নীর বিষয়। এই বিষয়ে আমি মতামত দেওয়াটা উচিত হবে না ।তবে সাধারণভাবে একটা ধারণা হয় স্বামী যেহেতু অসমিয়া, পত্নী নিজের মাতৃভাষায় কথা বলা ছাড়াও স্বামীর ভাষা শিখে নেবে এবং অবস্থা বিশেষে স্বামীর ভাষায় কথা বলবে। অন্যদিকে তুমি যেহেতু অসমিয়া ভাষা- সাহিত্যের সাধনা কর তাই বৌদি যাতে অসমিয়া ভাষা শিখতে পারে সেদিকে তোমার যত্ন নেওয়া উচিত।
'সাধারণ ভাবে যা হওয়া প্রয়োজন প্রজ্ঞা আর আমার মধ্যে সেটা হয় না বলেই আমাদের সম্পর্কটা অসাধারণ, অস্বাভাবিক নয়, মাজিউ। এখানে তোমাকে জানিয়ে রাখি প্রজ্ঞা অসমিয়া যে বোঝে না তা নয়। আমি কখন ও অসমিয়ায় কথা বললে সে সঠিকভাবেই উত্তর দেয়। দ্বিতীয়তঃ আমি যে আমার মাতৃভাষার সাহিত্য চর্চা করি তাতে প্রজ্ঞা বাধা দেয় না ঠাকুরবাড়ির কন্যা হিসেবে সে কখনও আমার সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক আভিজাত্য বা অহমিকা নিয়ে কথা বলে না এর বিপরীতে বিয়ের পরে জোড়াসাঁকোতে থাকার সময় আমাকে ষোলো আনা বাঙালি করার জন্য আমার ভায়রারা যখন উঠে পড়ে লেগেছিল এবং পরবর্তী সময়ে আমাদের ভাষার স্বতন্ত্রতা নিয়ে রবি কাকার সঙ্গে আমার যে পত্রযুদ্ধ চলেছিল তখন প্রজ্ঞা ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের পক্ষ নেয়নি। বরং প্রজ্ঞা অসমিয়া ভাষার স্বতন্ত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করেছিল। প্রেরণা জুগিয়ে ছিল। তার চেয়ে বড়ো কথা কি জান প্রজ্ঞার সঙ্গে বাংলায় কথা বলার সময় মানসিকভাবে আমার অসুবিধা হয় না। তার সঙ্গে বাংলায় কথা বলার সময় আমি কিছু হারিয়েছি বলে অনুভব করি না বরঞ্চ তার সঙ্গে বাংলায় কথা- বার্তা হওয়ার জন্য বাংলা ভাষা সাহিত্যে বেশি বিশেষ করে রবি কাকার সাহিত্য বেশি ভালোভাবে বুঝতে পারছি। বাংলা সাহিত্য- সংস্কৃতির বেশি গভীরে যেতে সক্ষম হয়েছি। তার ফলে নিজেকে আমি সমৃদ্ধ করে তুলতে পারছি। এই ক্ষেত্রে আমি আমার মনের মধ্যে দুটো চেম্বার মানিয়ে চলি। অর্থাৎ প্রজ্ঞার সঙ্গে ঘরোয়া কথায় আমি বাঙালি। কিন্তু আমি আমার মনের আরও একটি চেম্বারে আমি সম্পূর্ণ অসমিয়া। আর সেটাই আমার প্রকৃত সত্তা। আচ্ছা আবেগের বসে অনেক কথা বলে ফেললাম আমার কথা বাদ দাও অসমে থেকে আমাদের অন্যান্য লেখকেরা কী কী লিখছে বলতো।'
' পদ্মনাথ গোহাঞিবরুয়া ঐতিহাসিক উপন্যাস' ভানুমতী' লেখার পরেই সামাজিক বিষয় নিয়ে লিখেছেন 'লাহরী'। নাটকেও হাত দিয়েছেন।তাঁর 'জয়মতী' নাটকটি একটি ভালো নাটক বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কী হল, বেজ– তুমি যে চিন্তিত হয়ে পড়লে।'
' চিন্তিত হয়ে পড়লাম মানে বয়সে আমার চেয়ে ছোটো যদিও নাটক, উপন্যাস রচনায় পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া আমার চেয়েও এগিয়ে। আসলে তিনি যখন ১৪ নম্বর প্রতাপচন্দ্র চাটুজ্জে লেনে ছিলেন– তখন পাঠ্যপুথিতে লেগে না থাকে তিনি ভাষা- সাহিত্যের বই বেশি করে পড়তেন। তুমি তো দেখেছ আমাদের অ.ভা.উ.সা. এমন কোনো বৈঠক পার হত না যেখানে পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া অনুপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণ প্রসাদ দুয়ারা উদ্যোক্তা হলেও 'বিজুলী' পত্রিকাটা পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া এবং দ্বিতীয় বছর থেকে তিনিই সম্পাদক হয়েছিলেন। বুঝেছ,মাজিউ, পদ্মনাথ যেভাবে একনিষ্ঠভাবে লেগে থাকতে পারে, যতটা সময় দিতে পারে আমি এখন ও সেরকম সময় দিতে পারিনি।'
' সেটা ঠিক। আমরা বিজনেস করি। বিজনেসে লাভ- লোকসানের কথা চিন্তা করতে হয়। তার জন্য অনেক সময় দিতে হয়।'
' আমাদের এই কাঠের বিজনেসটা যে আরও খারাপ। এক জায়গায় বসে থেকে করা যায় না। হাজার হাজার টাকা নিয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার করে কলকাতার বাইরে দৌড়াতে হয় ।আমার আবার আত্মীয়-স্বজনের আপদে- বিপদেও দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। আর তাছাড়া ঘর সংসারের জাল- জঞ্জাল, সুবিধা ও অসুবিধা তো আছেই। বিধবা স্বর্ণ, এবং জ্ঞানকে আমাকেই দেখাশোনা করতে হয়। তারপরে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে লৌকিকতা রক্ষা করার জন্য আজ জোড়াসাঁকোতে মাঘোৎসব ,কাল বসন্ত উৎসব, পরশু অমুক আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ে ,তার পরদিন অমুক কুটুমের ছেলের অন্নপ্রাশন, বিজিতলার বাড়িতে ঠাকুরমশায়ের জন্মদিন, ইত্যাদিতে না গেলে নিজের মান সম্মান থাকে না।
' ইন্ডিয়া ক্লাবে যাওয়া–।'
' কলকাতায় থাকলে বিকেলে ইন্ডিয়া ক্লাবে গিয়ে অন্তত দুটো গেম বিলিয়ার্ড খেলতে হবে। বাড়িতে লন টেনিসের কোর্ট কেটে নিয়েছি। রবিবার, রবিবার লন টেনিস খেলি'
' এখানে থেকে তুমি লাইফটাকে এনজয় করছ?'
' এনজয় মানে যুগের উপকরণ গুলির মধ্য দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছি ।'
'তার জন্যই অসমে ফিরে না গিয়ে কলকাতায় বাড়িঘর তৈরি করে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেছ নাকি ?
'তা অবশ্য বলতে পার।কলকাতার লাইফটা ডায়নামিক এবং এর সাংস্কৃতিক জীবনটি আমাকে যথেষ্ট আকর্ষণ করে। দুর্ভাগ্য বা নিজের অপদার্থতা যাই বল না কেন আইন পরীক্ষায় পাস করতে না পারার জন্য হাইকোর্টের উকিল হতে পারলাম না। হাইকোর্টের উকিল হতে পারলে নিজের সামাজিক স্থিতিটা আর ও কিছুটা অভিজাত করতে পারতাম ।সেটা না হলেও বিয়ে করার জন্য এখানকার সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে ওঠায় কিছুটা সুবিধা হয়েছে ।এখন খারাপ লাগলেও স্বীকার করতেই হবে কলকাতার এই সমাজটা অসমে পাব না।'
' কিন্তু বেজ, তোমাকে অসমের প্রয়োজন। অসমিয়ারা তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। তুমি অসমে থাকার কথা ভাবতে পার।'
' দেখ মাজিউ, তুমি নিজেই তো বললে– এখন আমাদের বিগ ব্রাদার্স কোম্পানি কলকাতায় এক নম্বর উড মারচেন্ট।এতদিনে আমাদের কোম্পানিটি এই সিস্টেমে এসেছে ।আসানসোল ,সম্বলপুর, চক্রধরপুর ঝাড়চোগড়ায় আমাদের ব্রাঞ্চ খোলা হয়েছে। সেই অনুসারে কর্মচারীও নেওয়া হয়েছে। এদিকে বটকৃষ্ণ পাল এবং অতুল ঘোষের মতো দুজন অভিজ্ঞ মানুষের সহায়- সহযোগিতা পেয়েছি। আমরা আমাদের বিজনেস আর ও সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করছি। তাই এখন আমার পক্ষে অসমে যাওয়া সম্ভাব নয়। তাছাড়া কলকাতা থাকলে যে অসমিয়া সাহিত্যচর্চা হয় না এটা তো নয়, উল্টে কলকাতার বাঙালি মানুষ এবং বাংলা ভাষার মধ্যে থেকে অসমিয়া সাহিত্য চর্চাটা বেশি ভালোভাবে হয়। সঙ্গে এটাও ভাবছি ভোলা দাদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারলে সময় বের করে বহল ভিত্তিক একটা পরিকল্পনা নিয়ে লেখালেখি শুরু করতে হবে। ইস, তুমি উঠলে যে আর ও এক পেগ–।'
'না বেজ, আজ এতেই হবে।'
' একটু নেশা চড়াতে হবে। দু পেগে ভালো করে নেশা ধরে না, নাও, আর এক পেগ নাও–।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন