হে আমার স্বদেশ- ২৫
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(২৫)
বাড়ি-ঘর হল, আর্থিক দিকেও স্বচ্ছলতা এল, হাওড়ায় প্রভাব প্রতিপত্তিও কিছুটা হল। পত্মী সুখ, সন্তান-সুখের সঙ্গে সাহিত্যিক হিসেবে সুনাম-যশ ও লাভ করল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের জন্যই সুখ ভোগটা নিরবচ্ছিন্ন নয় ।
সুরভি বড়ো হয়ে উঠতে লাগল। সুরভি সুন্দরী, কথাবার্তা আদুরে। গুণেও সে ব্যতিক্রম। ঠাকুর বংশের কলকাতার অন্যান্য জায়গায় থাকা আত্মীয়-স্বজনদের ভেতরে সেরকম মেয়ে একটিও নেই।
চার বছর বয়সও হয়নি। এখনই সে ইংরেজি নার্সারি রাইমসের একটি বড়ো বইয়ের প্রতিটি কবিতা মুখস্থ করে ফেলল। অবশ্য 'টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার' বলতে গিয়ে সে' টুনি কোল টুনিকোল লিটোল স্টার বলে। অন্যান্য ইংরেজি কবিতা মুখস্ত বলতে পারে। কোনো কার্যের নিমিক্ত মানুষের প্রশংসা করতে গিয়ে 'থেঙ্ক ইউ' বলতে গিয়ে 'ফেঙ্ক ইউ' বলতে শিখেছে। প্রাণময়ী সুরভি লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞার সম্পর্কটাকে আরও নিবিড় করে তুলল। তাকে নিয়ে দুজনের কত আনন্দ, কত যে স্বপ্ন! তার মুখের দিকে তাকালেই লক্ষ্মীনাথের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। অনাবিল অপত্য স্নেহের আবেগে সুরভির মধ্যে সে জ্যেঠাশ্বশুর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরার কথা ভাবে। ইন্দিরা বুদ্ধিমতী, বিদ্যায় সরস্বতী, সাহিত্য–সংস্কৃতিতে অনুরাগ থাকা অসামান্য রূপসী কন্যা। সুরভির চলন-বলন ,কথা-বার্তা, কাণ্ড-কারখানা সেই বয়সের ইন্দিরার মতোই। সমবয়সী মেয়েদের থেকে এত আলাদা, এত চমকে দেওয়ার মতো যে কখনও কখনও লক্ষ্মীনাথের মনে প্রশ্ন জেগে ওঠে–এই মেয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে তো? সেরকম মনে হওয়ার পর মুহূর্তে তিনি নিজেকে সাবধান করেন, না নিজের সন্তানকে নিয়ে এরকম ভাবাটা ঠিক নয়। লক্ষ্মীনাথ তখন আকূল কণ্ঠে পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানায়,' প্রভু আমার মনে এরকম একটি আশঙ্কার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। সুরভিকে তুমি দীর্ঘায়ু কর। নারীর সমস্ত গুনে তাকে মহিমাময়ী করে তোল।'
বাড়িতে থাকার সময়টুকু লক্ষ্মীনাথের সর্বক্ষণের সঙ্গী সুরভি। প্রতিটি কথায় সুরভির বাবাকে চাই। বাবার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, বাবার সঙ্গে খেলাধুলা, বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, বাবার কাছেই তার যত ধরনের দাবি।
একদিন সকালবেলা সে একা বাইরের বারান্দায় পুতুল নিয়ে খেলছিল। তখন সে দেখল সামনের রাস্তা দিয়ে একজন ফেরিওয়ালা মাটির তৈরি সুন্দর সুন্দর পুতুল নিয়ে যাচ্ছে। হাতের কাঠের পুতুলটা ফেলে রেখে দৌড়ে গিয়ে গেটের কাছে গিয়ে বলল ও ফেরিওয়ালা আমাকে একটি পুতুল দেবে ? কৃষ্ণনগর থেকে আগত মাঝবয়সি ফেরিওয়ালা স্নেহের সুরে বলল ,'আমি যে এগুলি বিক্রি করতে এনেছি, মা।'
' কত দাম?'
' চার আনা। তুমি তোমার মায়ের কাছ থেকে চার আনা চেয়ে নিয়ে এসো, আমি তোমাকে দেব।'
সুরভি দৌড়ে লক্ষ্মীনাথের কাছে এল,' পাপা তুমি আমাকে চার আনা দাও তো, আমি পুতুল কিনব।'
লেখার টেবিল থেকে উঠে লক্ষ্মীনাথ বাইরে বেরিয়ে এসে রং করা পুতুলগুলি দেখে ফেরিওয়ালাকে বিদায় দিয়ে সুরভিকে বলল, ওইগুলি মাটির পুতুল মা। খেলতে গেলেই ভেঙ্গে যাবে।'
ফেরিওয়ালাকে চলে যেতে দেখে সুরভি অভিমানী হয়ে পড়ল। নিমেষের মধ্যে তার মুখ লাল হয়ে উঠল।' যাও তোমার সঙ্গে আমার আড়ি' বলে সুরভি ভেতরে গিয়ে রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল
লক্ষ্মীনাথ স্নেহের সুরে ডাকল,' সুরভি, সুরভি–।'
সে শুনল। কিন্তু উত্তর দিল না। লক্ষ্মীনাথ পুনরায় বলল, সুরভি মা আমার দরজা খোল‐।'
সুরভি দরজা খুলল না। এদিকে ঘরটা অন্ধকার। এতই অন্ধকার যে দিনের
বেলাতেও প্রদীপ না জ্বালিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলে গা ছমছম করে।চেঁচামেচি শুনে প্রজ্ঞা দৌড়ে এল। ঘটনার বৃত্তান্ত শুনে' তোমার আদরের জন্যই মেয়ে এত অন্যায় জেদ করছে' বলে লক্ষ্মীনাথকে বকাবকি করল। পত্নীর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে লক্ষ্মীনাথ সুরভির চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে থাকা পোকামাকড় সুরভিকে কামড়াতে পারে। কোনো উপায় না পেয়ে দরজার একেবারে সামনে মুখে এনে লক্ষ্মীনাথ কাকুতি মিনতি করে বলল, 'লক্ষ্মী মা আমি তোমাকে চার আনাই দেব। এই যে পয়সা নিয়ে এসেছি। এবার দরজা খুলে বেরিয়ে এসো।'
ভেতর থেকে সুরভি জিজ্ঞেস করল,' সত্যি করে বল, দেবে।'
' হ্যাঁ দেব। এইতো তোমাকে দেবার জন্যই পয়সা হাতে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।'
' তার জন্য মা আমাকে বকুনি দেবে না তো?'
' না, দেবে না।'
' সত্যি?'
' হ্যাঁগো, সত্যি।'
' তিন সত্যি বল।'
' সত্যি, সত্যি, সত্যি। এবার দরজা খোল।'
অবশেষে দরজার খিল খুলে সুরভি বেরিয়ে এল। বাবার কাছ থেকে চার আনার মুদ্রাটা নিয়ে সুরভি হেসে ফেলল।
তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে প্রজ্ঞা বলল,' কী দস্যি মেয়ে হয়েছে রে বাবা! ওরে তুই যে ওই অন্ধকার ঘরটায় এতক্ষন থাকলি, তোর একটুও ভয় করল না ?'
ব্যস্ততার মধ্যেও লক্ষ্মীনাথ লেখালেখি চালিয়ে গেছে।সকালে লেখালেখির কাজ করে। মনটা তখন প্রফুল্ল থাকে, সতেজ থাকে। লেখাগুলিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে। অসম থেকে এত দূরে, অসমিয়া সমাজের বাইরে,ব্যবসার ক্ষেত্রে সারাদিন বাঙালি মানুষের সঙ্গে থাকে। এমনকি প্রিয়তমা পত্নী এবং আদরের মেয়েটির সঙ্গেও বাংলায় কথা বলে। অথচ লক্ষ্মীনাথ অসমের কথা ভাবে, অসমিয়া জাতির কথা ভাবে। অসমিয়া জাতির উন্নতির কথা ভেবে অসমিয়া ভাষা-সাহিত্যের সাধনা করে। সেই সাধনায় বসে যখন অসমিয়া সাহিত্যের কথা ভাবে, তখন বাংলা তথা ভারতের অন্যভাষার উন্নতি দেখে তার মনটা বিষাদ-বেদনায় ভরে উঠে।অন্য সাহিত্যের উন্নতি-বিকাশের কথা ভেবে সে হীনমন্যতার যন্ত্রণায় কষ্ট পায়। সে তখন মাতৃভাষায় নতুন সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অন্তরের গভীর থেকে অনুপ্রেরণা অনুভব করে। নিত্য নতুন উদ্যমে লিখতে শুরু করে। লিখতে গিয়ে অনুভব করে অনেক কিছু লেখার আছে। কবিতা, গল্প ,উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ইত্যাদি রচনার জন্য তাকে আরও একনিষ্ঠভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে।
এর মধ্যে তিন দিন প্রসব বেদনায় কষ্ট পেয়ে ১৯০০ সনের সতেরো নভেম্বর সকালবেলা প্রজ্ঞা আরও একটি কন্যা সন্তানের জন্মদান করে।তখন সুরভিও জোড়াসাঁকোতে। খবরটা শুনেই লক্ষ্মীনাথ জোড়াসাঁকো এল। সুরভি ভেতর থেকে দৌড়ে এসে বলল,‐ 'পাপা আমার একটি ছোট বোন হয়েছে।'
' ও তাই নাকি! চলো তো দেখি‐।'
' কিন্তু সবাই বলছে, আমার বোনটা নাকি কালো হয়েছে।'
' কালো হয়েছে!'
' আসলে জান পাপা, বোনটা কালো হয়নি। আমার থেকে একটু কম ফর্সা হয়েছে। কিন্তু ওরা আমার কথা মানছেই না।'
সদ্যোজাত শিশুটির সঙ্গে ইতিমধ্যে সুরভির আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।তার বিষয়ে কেউ খারাপ ভাবে কিছু বললে সুরভির কাছে তা বেদনাদায়ক হয়ে পড়ে। লক্ষ্মীনাথ সুরভির দুঃখ, মন খারাপটা বুঝতে পারল। সুরভির গালে আদর করে হাত বুলিয়ে বলল-' মা তুমি একটুও মন খারাপ কর না, যে যাই বলুক তোমার বোন কালো হতে পারেনা।
লক্ষ্মীনাথ দ্বিতীয় কন্যার নাম রাখল অরুণা। দুদিন পরে প্রজ্ঞা, নবজাতকন্যা এবং সুরভিকে নিয়ে বাড়িতে এল। দ্বিতীয়বার কন্যা সন্তান জন্মনেওয়ায় প্রজ্ঞার মনটা কিছুটা খারাপ ছিল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ তাকে বোঝাল পুত্র সন্তানের জন্য কামনা করা যেতে পারে। কামনা পূরণ করাটা তাদের হাতে নেই। তাই পরমেশ্বর যা দিয়েছে তাকে আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করে নিতে হয়। অরুণার জন্মের আট দিন পরের ঘটনা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই লক্ষীনাথ দেখল সুরভি ঢোক গিলতে পারছে না। সুরভির কিছু একটা হলেই লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে পড়ে। মুহূর্তের জন্য না থেমে সে ঘরোয়া চিকিৎসক ডক্টর সত্যব্রত মিত্রকে ডেকে আনল।ডক্টর মিত্র সুরভির গলা পরীক্ষা করে বলল ডিপথেরিয়া হয়েছে।ডিপথেরিয়া-ডিপথেরিয়া শিশু-কিশোরদের জন্য ভয়ংকর সংক্রামক রোগ।লক্ষ্মীনাথের ভেতরটা কেঁপে উঠল, কাতর সুরে ডাক্তারকে দ্রুত ভালো চিকিৎসা দানের জন্য অনুরোধ করল, ডাক্তার মিত্র ওষুধ লিখে দিলেন। সেই অনুসারে ওষুধ খাওয়ানো হল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা ওষুধে কাজ দিল না। বরং ক্রমশ রোগটা দ্রুত বাড়তে লাগল। ঢোক গিলতে না পারার জন্য সুরভির কষ্ট বেড়ে গেছে। জলীয় খাদ্য ছাড়া কিছুই খেতে পারছে না দেখে লক্ষ্মীনাথ দিশাহারা হয়ে পড়ল। অবশেষে বিকেলে সবাইকে নিয়ে জোড়াসাঁকো চলে এল।
পথে গাড়িতে সুরভি লক্ষ্মীনাথের ঘোড়ার দিকে মুখ করে বসল। গঙ্গার উপরে ব্রিটিশের তৈরি হাওড়ার সেতু পার হওয়ার সময় সুরভি বলল,' পাপা আমার ঠান্ডা বাতাস লাগছে। আমি সামনের দিকে বসব।'
সুরভি লক্ষীনাথের কোল থেকে নেমে বাবার দিকে মুখ করে বসল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি পাওয়ার পরেই ডক্টর ডি এন চ্যাটার্জীকে খবর দেওয়া হল। তিনি এসে পরীক্ষা করে ওষুধ দিলেন। ডক্টর চ্যাটার্জির ওষুধেও সুরভির অবস্থার উন্নতি হল না। প্রতিদিন তার অবস্থার অবনতি হতে লাগল। শেষ মুহূর্তে হোমিওপ্যাথিক ডঃ জে এন মজুমদারকে ডেকে আনা হল।তাঁর চিকিৎসাতেও লাভ হল না। সুরভি লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞার হৃদয় জুড়ে ছিল। কিন্তু ১৯০০ সনের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ মঙ্গলবার দিন তাদের হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রেখে সুরভি চলে গেল।
লক্ষ্মীনাথ ইতিপূর্বে কখনও এত বড় শোক পায় নি। সে আদরের সুরভির শোক সহ্য করতে পারল না। শোকে সে এতই কাতর হয়ে পড়ল যে তাকে বিছানা নিতে হল। সুরভির মৃতদেহ কে নিমতলা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করে এল ,সে বলতেই পারে না। সুরভিকে যমের কাছে অর্পণ করে সবার বাধা নিষেধ সত্ত্বেও পরের দিন সকালে লক্ষ্মীনাথ- প্রজ্ঞা নবজাতক কন্যা শিশুটিকে নিয়ে জোড়াসাঁকো থেকে হাওড়ার ডবসন রোডের বাড়িতে ফিরে গেল।
কিন্তু ঘরের ভেতর ঢুকতে গিয়ে যেদিকেই তাকাচ্ছে, সুরভির স্মৃতি তাকে অস্থির করে তুলছে। সুরভিও ফুল ভালোবাসত। ফুলের বাগান দেখাশোনা করার সময় গাছের চারার আশেপাশে মালির সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন চারায় ফুল ফুটতে দেখে অদম্য এক উৎসাহে বাবাকে সেই খবরটা জানাত। বিকেলের দিকে লক্ষ্মীনাথ অতুল বাবুর সঙ্গে লনটেনিস খেলত, পাশের পাথরের বেঞ্চে বসে সুরভি তাদের খেলা দেখত। বাড়িতে কোনো অতিথি এলেই দৌড়ে গিয়ে খবরটা দিয়ে বাবাকে ডেকে আনত। সেই সুরভিকে আর এই ঘরে দেখতে পাওয়া যাবে না। শুনতে পাবে না সুরভির কথা-বার্তা। লক্ষ্মীনাথের চোখ থেকে অবিরল ধারায় অশ্রু-জল নেমে এল। সে অন্ধকার দেখল। সুরভি ছাড়া এই বাড়িতে সে কীভাবে থাকবে?
সুরভির মৃত্যুর পরে ঠাকুর পরিবারের প্রত্যেকের মনে বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে এল। শোকাচ্ছন্ন মন নিয়ে তারা লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞাকে সমবেদনা জানাতে এল। লক্ষ্মীনাথের ভায়রা আশুতোষ চৌধুরী একজন গম্ভীর প্রকৃতির লোক। সুরভির মৃত্যুর খবর শুনে তার দুচোখ দিয়ে অবিরল ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আত্মজার বিয়োগে এত সুতীব্র যন্ত্রণা, বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলি এত দহনকারী। তথাপি সময় এগিয়ে যায়, সময়ই মানুষের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। গভীর শোক- দুঃখ থেকে নিজেকে উদ্ধার করার জন্য লক্ষ্মীনাথ ভাগবত-গীতার আশ্রয় নিল। বিশেষ করে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের অষ্টবিংশ শ্লোকটি তার মনটিকে অনেকটাই সুস্থির করে তুলল।‐
'অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিববেদনা।।’
শ্লোকটা পড়ে নিজের মনে বারবার উচ্চারণ করে লক্ষ্মীনাথ উপলব্ধি করল, এই সংসারে সমস্ত জীব প্রথম অবস্থায় অব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত অর্থাৎ প্রকাশিত। তারপরে মৃত্যু হলে পুনরায় অব্যক্ত হয়। তাই মৃত ব্যক্তির জন্য শোক কিসের জন্য?
লক্ষ্মীনাথের জ্যাঠা শ্বশুর ভারতের প্রথম আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথের বিদূষী কন্যা ইন্দিরা সুরভির মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে একটি কবিতা লিখে পাঠাল,
' সুরভি ছিল তোমার নাম,
তাই বুঝি ফুলের মতন
সৌরভ করিয়া বিতরণ
দুদিনে ত্যজিলে মর্ত্যধাম।
সে সৌরভ চির দিন-রাত
রহিল মোদের এই ঘরে,
তুমি থাক দেবতার তরে,
অমর অমল পারিজাত তরে।'
প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ মাঝেমধ্যে সম্বলপুরে বেড়াতে গিয়েছিল। সম্বলপুরের সরকারি উকিল যোগেন্দ্রনাথ সেন এম এ বি এল এবং তার শিক্ষিত সহধর্মিনী কবি এবং গ্রন্থকার সরোজ কুমারী দেবী লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞার বন্ধু হয়ে উঠেছিল। সম্বলপুরে বেড়াতে এসে তাদের ঘরে লক্ষ্মীনাথ-প্রজ্ঞা অতিথি হয়েছিল। সরোজ কুমারী দেবী আগে সুরভিকে দেখেনি। মৃত্যুর পরে সুরভির একটি ছবি দেখে তিনি শত প্রণোদিতভাবে এই কবিতাটি লিখে পাঠালেন,
'... এসেছিল পথ ভুলে
মা-বাপের স্নেহ-কোলে,
সহসা ভেঙ্গেছে মোর খেলার বাসনা।
তাই সে গভীর রাতে
গেছে সরগের পথে
ধরার বাঁধন খুলি স্নেহের কামনা।
….
সুখের স্বপ্ন প্রায়
চকিতে মিলায় হায়
শুধু ভেঙ্গে দিয়ে গেল দুটি হৃদিকুল।
স্বর্গের সুরভি সে যে সুরভির প্রায় ।
ঢালিয়া জগতে সারা
চলে গেছে মুগ্ধ করি মানব হিয়ায়
সুরভি পরশ করে
কে কোথা পেয়েছে ভবে,
শুধু অনুভব করে শিরায় শিরায়।
স্মৃতির নিরালা ঘরে,
জাগাইয়া অশ্রু থরে,
স্নেহ মন্দাকিনী ধারে সিঞ্চিও তাহায়।'
প্রত্যেকের এত শোকের প্রকাশ, শোক প্রকাশ করার জন্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের এত সমবেদনা, সহানুভূতি প্রকাশ করে অথবা কবিতা রচনা করে প্রেরণ, মৃত্যুকে নিয়ে গীতার অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক বাণী– আত্মার অংশ হয়ে ইহ সংসারে এসে অকালে বিদায় নেওয়াটাকে হৃদয় মেনে নিতে পারে না। লক্ষ্মীনাথ সুরভিকে ভুলতে পারল না। তার জন্যই সে মাঝেমধ্যে বড়ো আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। লক্ষ্মীনাথ সুরভিকে অমর করে রাখার জন্য কিছু একটা করতে চায়। শেষে সে সিদ্ধান্ত নিল, প্লাস্টার অফ প্যারিসে সুরভির একটা মূর্তি তৈরি করবে। কথাটা প্রজ্ঞাকে জানাল। অবিরল ধারায় জল ফেলে প্রজ্ঞা সম্মতি দিল।
লক্ষ্মীনাথ একদিনের জন্যও অপেক্ষা করল না। কৃষ্ণনগরের যদু পাল মাটি এবং প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি তৈরিতে নিপুণ শিল্পী। সে যদু পালকে ডাকিয়ে আনল। যত টাকাই খরচ হোক না কেন, যদু পালকে সুরভির মূর্তি তৈরি করতে বলল। সুরভির ছবি দেখে যদু পাল মূর্তি তৈরি করতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যে মূর্তিটি হুবহু সুরভির রূপ ধারণ করল। সেটা প্রাণহীন হলেও মূর্তিটিতে প্রাণময়ী সুরভিকে দেখতে পেয়ে লক্ষ্মীনাথের বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাটা কিছু কমল। আর মূর্তি তৈরি করিয়েই লক্ষ্মীনাথ ক্ষান্ত হল না। ইট ,বালি ,সুরকি আনিয়ে ঘরের সামনে মন্দিরের মতো একটি পাকা ঘর তৈরি করার জন্য মিস্ত্রি লাগাল।
সুরভির মৃত্যুর পর থেকে লক্ষ্মীনাথ ব্যবসায় মন দিতে পারছিল না। অফিস গেলেও কাজগুলি সুষ্ঠুভাবে করতে পারছিল না। স্বাভাবিকভাবেই পার্টি গুলির সঙ্গে কথার খেলাপ হয়েছে। পাওনা টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না পেয়ে কয়েকজন ঠিকাদার অতুলবাবুর মাধ্যমে ভোলানাথের কাছে অভিযোগ করেছে। এদিকে ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে ভোলানাথকে প্রায়ই সম্বলপুর, ঝাড়চোগড়া, আসানসোলে যেতে হয়– তার জন্য ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথকে কিছুই বলতে পারছে না। সুরভির অকাল মৃত্যুর জন্য ভোলানাথ ও শোকাহত। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের ভারসাম্যহীন আবেগ দেখে তার ভালো লাগেনি। লক্ষ্মীনাথের প্রতি তিনি কিছু পরিমাণে বিরক্ত হয়ে উঠেছেন তথাপি সহ্য করে যাচ্ছিলেন ।কিন্তু বাড়ির সামনে আর ও একটি পাকা ঘর তৈরি করার কাজে লক্ষ্মীনাথকে হাত দিতে দেখে তিনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না।
' বেজ ইট ,বালি, সুরকি এনে মিস্ত্রি লাগিয়েছ, কিসের ঘর তৈরি করছ এখানে?
লক্ষ্মীনাথ সরল ভাবে বলল, 'দাদা একটা ছোটো মন্দির তৈরি করব বলে ভাবছি।
' মন্দির ?এখানে আবার কিসের মন্দির?' 'সুরভির মূর্তি তৈরি করেছে আপনি তো দেখেছেন ।মূর্তিটি এত সুন্দর হয়েছে,অবিকল সুরভি।' লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বরে আবেগ, সেই মূর্তিটা এই মন্দিরে স্থাপন করব।'
ভোলানাথের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। যেন রাগে এখনই লক্ষ্মীনাথকে গালিগালাজ করবেন। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার কপাল কুঁচকে উঠল। তারপর একটি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–' এভাবে এখানে সুরভির মূর্তি স্থাপনের জন্য মন্দির তৈরি করছ, কথাটা আমার সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া উচিত ছিল।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন