হে আমার স্বদেশ- ২৪
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(২৪)
মালিকের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ার জন্য ১৪ নম্বর গোপীকৃষ্ণ পাল লেনের ঘরটা ছেড়ে দিল। বি ব্রাদার্স কোম্পানি ইতিমধ্যে কাঠের ব্যবসায়ী রূপে কলকাতায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এখন ভোলানাথ-লক্ষ্মীনাথ কলকাতায় সুপরিচিত কাঠের ব্যবসায়ী। আয়-উপার্জনের সঙ্গে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিও বেড়েছে। তাই ভালো জায়গায় অন্য একটি ঘর পেতে অসুবিধা হল না। এবার তারা ২৭ নম্বর বলরাম দে স্ট্রিটে উঠে এল। এই বাড়িটাও বড়ো, বেশ বড়োসড়ো।
নতুন ভাড়া ঘর নেওয়ার কিছুদিন পরেই লক্ষ্মীনাথ গাড়ি এবং ঘোড়া কিনল। নিজের গাড়িতে অফিস কাছারি অথবা এখানে সেখানে যাওয়ার সুখটাই আলাদা। কিনে আনার দিনই লক্ষ্মীনাথ গাড়িতে উঠল। গাড়ির জন্য রাখা কোচোয়ান মাথায় পাগড়ি বেঁধে, পাগলিটার সামনের দিকে গাড়ির মালিকের নাম লেখা থাকা পিতলের বড়ো অক্ষর লাগিয়ে , দীর্ঘ চোগা চাপকান এবং ঠেঙ্গা পরে হাতে একটা চাবুক নিয়ে ঘোড়ার পিঠে আঘাত করে গাড়ি চালাতে লাগল। ঘোড়ার সহিসটা গাড়ির পেছনদিকে দাঁড়িয়ে, কোচোয়ানের মতো পাগড়িতে বড়ো অক্ষর লাগিয়ে, গায়ে কোট কোমরে চামড়ার বেল্ট লাগিয়ে, হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত কাপড়ের পট্টি বেঁধে রাজপথ দিয়ে যাওয়া পথিককে সাবধান করে চিৎকার করল,' হেই তফাৎ যাও।'
গাড়ির নরম গদিতে বসা লক্ষ্মীনাথের মনে তখন অপার এক তৃপ্তি। তার মনে এরকম একটি ভাব যেন মৈ দিয়ে ধীরে ধীরে স্বর্গে উঠে যাচ্ছে। আর গাড়িটা যতই এগিয়ে যাচ্ছে,তাঁর মনে হচ্ছে– রাস্তায় এত মানুষ, কিন্তু কোনো পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না কেন? পরিচিত কেউ গাড়িতে এভাবে জমিদারের মতো লক্ষ্মীনাথকে বসে থাকতে দেখে ঈর্ষান্বিত হতেন এবং তাতে তার সুখ তৃপ্তির মাত্রা আরও কিছুটা বৃদ্ধি পেত।
নতুন গাড়িতে এক পাক ঘুরে আসতে বিকেল হয়ে এল। গাড়ি থেকে নেমেই ঘরের ভেতর মহলে গিয়ে দেখল, সুরভি তার সংসার নিয়ে ঘরের মেঝেতে খেলতে শুরু করেছে। তার চারপাশে খেলনার রান্না-বাটির সামগ্রী এবং বিভিন্ন আকারের কয়েকটি পুতুল। এখন সে তিন বছরের আকর্ষণীয় মেয়ে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ ফুটে বেরুচ্ছে। কথাবার্তাও আদুরে। এই বয়সেই বাবাকে এত ভালো করে চিনে ফেলেছে। বাইরে থেকে বাবাকে আসতে দেখলেই হাতের খেলনা ফেলে লাফিয়ে উঠে দুই হাত মেলে 'পাপা পাপা' বলে দৌড়ে এসে কোলে উঠে । লক্ষ্মীনাথ মেয়েকে খুব ভালোবাসে । মেয়ের সঙ্গে মেয়ের বয়সী হয়ে খেলে । তার সঙ্গে নাচে, গান গায়। তার হাজারটা দাবি পূরণ করে। মেয়ের সঙ্গে এত মিত্রতা দেখে প্রজ্ঞা রাগ করে লক্ষ্মীনাথকে বলে তুমি কিন্তু লাই দিয়ে মেয়েকে মাথায় তুলছ!' লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বলে,' 'ও তো আমার মাথায় রাখারই মণি।' প্রজ্ঞা এবার সত্যি সত্যি রাগ করে বলে মেয়ে যখন তোমাকে ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে, তখন মজা বুঝবে।' লক্ষ্মীনাথ হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে সুরভিকে কাঁধে তুলে মেঝেতে নাচতে শুরু করে।
প্রজ্ঞা যে সুরভিকে শাসন করে, সেটা নিয়ে সুরভির কত যে আপত্তি! বাবার কোলে উঠে সুরভি সম্পূর্ণ গ্লাস দুধ খায়নি বলে মা তাকে বকাবকি করতে লাগল, তার জন্য সে অনেকক্ষণ কাঁদল, দুপুরে পুতুলটা নিয়ে খেলার ইচ্ছা ছিল– মা তার হাত থেকে পুতুলটা কেড়ে নিয়ে তাকে ঘুমোতে বাধ্য করল ইত্যাদি। লক্ষ্মীনাথ শোনে মেয়ের সমবয়সী বন্ধু হয়ে শোনে। তারপরে মেয়ের হয়ে কপট ক্রোধ প্রকাশ করে প্রজ্ঞাকে বকাবকি করে।
সুরভির সঙ্গে এভাবে খেলা-ধুলো করে থাকার সময় বাড়ির কাজের ছেলে নিতাই এসে লক্ষ্মীনাথ কে বলল,'সাহেব, বড় সাহেব আপনাকে ডেকেছে।'
কাঁধ থেকে সুরভিকে নামিয়ে লক্ষ্মীনাথ জিজ্ঞেস করল,' বড় সাহেব কখন এসেছে?'
' এই কিছুক্ষণ আগে। কাছারি ঘরে বসে কাগজপত্র দেখছে।'
আজকাল ভোলানাথকে বেঙ্গল-নাগপুর লাইনে অধিক সময় দিতে হচ্ছে। বাইরের কাজগুলি ঠিকঠাক করে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কলকাতায় এসে দুই একদিন বিশ্রাম নেয়। তাই কলকাতার সমস্ত কাজকর্ম দেখাশোনা করার এবং বিভিন্ন কোম্পানি অথবা ব্যক্তির সঙ্গে চিঠি পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগের কাজটা লক্ষ্মীনাথকে করতে হয়। অবশ্য তার জন্য একজন সহকারী আছে। তাছাড়া অসমের লক্ষ্মীমপুরের দুঃখি পরিবারের যুবক কুশলকে নেওয়ার পরে সে সপ্তাহের দুদিন, কখনও তিনদিন অফিসের কাজ করে দেয় বলে লক্ষ্মীনাথের একটু সুবিধা হয়েছে।কাজগুলি শিখে বুঝে নিয়ে কুশল বিশ্বস্ত সহায়কারী হয়ে উঠেছে।
কাছারি ঘরে ঢুকে লক্ষ্মীনাথ দেখল, ভোলানাথ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে মনোযোগের সঙ্গে কোম্পানির কাগজপত্র দেখছে। লক্ষ্মীনাাথের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে কোনো ধরনের ভূমিকা না করে বলল,'দেখ বেজ, আমাদের বিজনেসের টাকা পয়সা ক্রেডিট এণ্ড লেয়নস, ন্যাশনাল ব্যাংক, ক্যালকাটা ব্যাংক, হিন্দুস্তান ব্যাংক, হংকং এবং সাংহাই কর্পোরেশনে জমা হয়ে থাকে। এই সমস্ত ব্যাংকের একাউন্ট যাতে অপারেট করতে পার, তার জন্য তোমাকে পাওয়ার অফ এটর্নি দেওয়া হয়েছে। এখন তুমি একটা কাজ কর–।'
'বল তো।'
' তোমাকে তোমার বেজবরুয়া টাইটেলটাকে একটু বদলে নিতে হবে।'
ভোলানাথ কী করতে চাইছে লক্ষ্মীনাথ বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
' কথাটা হল, তুমিতো চেক গুলিতে এল.এন বেজবরুয়া বলে সই কর। তা না করে এল.এন বি বরুয়া নামে সই করতে শুরু কর। তার জন্য ব্যাংকে যে কাগজপত্র জমা দিতে হবে তা দিয়ে দাও।'
' হঠাৎ টাইটেল বদলাতে হবে কেন?'
'শোন, আমাদের ব্যবসা বাড়ছে দেখে আমাদের লাইনের ব্যবসায়ীদের কিছু লোক হিংসায় জ্বলছে। ওদের ভেতরে কেউ চক্রান্ত করে তোমাকে যে আমি সহোদর ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দিই, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমাকে বিপদে ফেলার চক্রান্ত করতে পারে।'
অবশ্য রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও লক্ষ্মীনাথ ইতোমধ্যেই ভোলানাথের সহোদর ভাই বলে কলকাতার কাঠের ব্যবসায়ী মহলে পরিচিত হয়ে পড়েছে এমন কি বি টি টি কোম্পানির কলকাতা অফিসের বড়ো সাহেব মিস্টার জে আর স্টুয়ার্ট দেখা হলেই লক্ষ্মীনাথকে জিজ্ঞেস করে,' হাউ ইজ ইউর ব্রাদার? ওয়েন হি ইজ কামিং টু ক্যালকাটা?'
প্রথমে সন্দেহ জেগে ছিল যদিও নাম পরিবর্তন করে স্বাক্ষর করার জন্য ভোলানাথ যে ব্যাখ্যা তুলে ধরলেন লক্ষ্মীনাথ মেনে নিল। এমনিতে বুদ্ধিমান যদিও লক্ষ্মীনাথ বড়ো সরল বিশ্বাসী। তাছাড়া একের পরে কৌশল নিয়ে ভোলানাথ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সফল হওয়ায় ভোলানাথের উপর লক্ষ্মীনাথের বিশ্বাস-ভরসা বেড়ে গেছে। তিনি কোনো অহিত কাজ করবেন বা বিপদে ফেলার চক্রান্ত করতে পারে বলে লক্ষ্মীনাথ ভাবতেই পারে না।
' আর দেখ, বেজ-।' ভোলানাথ এভাবে বলল যে লক্ষীনাথের সামনে কিছু একটা গূঢ় রহস্য উন্মোচন করতে যাচ্ছে,' সিদ্ধি সিদ্ধিকে অনুসরণ করে, কথাটার অর্থ জান কি?'
' মানে সাকসেস ফলোজ সাকসেস।'
' ঠিকই বলেছ। শোনো, কাঠের ব্যবসায় কলকাতায় শীর্ষে থাকা গিরিশ বোসের ব্যবসা এখন পড়ে এসেছে। বার্মার যুদ্ধের সময় কোটিপতি হওয়া মাড়োয়ারি ভগবান দাসের ফার্মটির আগের প্রতিপত্তি নেই। চিমনলাল গেন্ধেরীলাল, মতিলাল রাধাকিষণ, আদিকে এখন আমাদের কোম্পানির কাছে হাত পাততে হচ্ছে। তাই কলকাতার মার্কেটে এক নম্বরে উঠে আসার জন্য আমাদের সামনে সুযোগ এসে উপস্থিত হয়েছে।
' কিন্তু সেগুন কাঠের ব্যবসায়ে কালীকৃষ্ণ প্রামাণিক এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাকে ছাড়িয়ে যাওয়াটা–।'
' সে কথা বলার জন্যই তোমাকে ডেকে এনেছি।' কথা বলার ভাবটা এরকম যেন ভোলানাথ গোপন কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। কাছাকাছি কোনো তৃতীয় ব্যক্তি নেই যদিও কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলতে লাগলেন-' তুমি কালীকৃষ্ণ বাবুর কথা বললে, তিনি এখন অশীতিপর বৃদ্ধ। এদিকে তাঁর সেগুন কাঠের ব্যবসার মূল মানুষটি হল তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠা অতুলকৃষ্ণ ঘোষ। অতুলবাবু সেগুন কাঠের বিশেষজ্ঞ। অতুল বাবুর জন্যই সেগুন কাঠের ব্যবসাতে কালীকৃষ্ণবাবুর এত রমরমা। এখন বেশি টাকা বেতন দিয়ে অতুল বাবুকে যদি আমাদের ফার্মে আনতে পারি, তাহলে সোনায় সোহাগা হবে।'
' অতুলবাবু কেবল অন্তরঙ্গ বন্ধু নয়, তিনি আমার আত্মীয়ের মতোই। সুরভিকে তিনি নিজের নাতনির মতোই ভালোবাসেন।'
' সেটা তো আরও ভালো কথা। তুমি তাঁর আস্থা-বিশ্বাসের মানুষ।'
' কিন্তু এত বছর ধরে কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের কাছে চাকরি করছেন। তিনি কি মালিকের সঙ্গে নেমকহারামি করতে রাজি হবেন?' তাছাড়া, কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের সঙ্গে আমাদেরও ভালো সম্পর্ক। প্রথম অবস্থায় ব্যবসায়িক পরামর্শ দেওয়া ছাড়া হাজার হাজার টাকা মূল্যের কাঠ বাকিতে যোগান দিয়ে তিনি আমাদের উদারভাবে সাহায্য করেছিলেন। এখন তাঁদের বিশ্বাসী কর্মচারী অতুলবাবুকে বেশি বেতন দিয়ে আমাদের ফার্মে নিয়ে আসা - এতে কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না কি?'
ভোলানাথ গম্ভীর হয়ে পড়লেন। তিনি লক্ষ্মীনাথের কথায় খুশি হলেন না।তাঁর রাগ হল। রাগটা চেপে ধীরে ধীরে বললেন,'বেজ, স্বদেশ-স্বজাতি এবং ভাষা সাহিত্যের বিষয়ে তুমি যখন কথা বল, তোমাকে বেশ বুদ্ধিমান জ্ঞানী মানুষ বলে মনে হয়। কিন্তু বারবার বলেও আমি তোমাকে বুঝাতে পারলাম না যে ব্যবসা ব্যাপারটা আলাদা। ব্যবসার ক্ষেত্রে সাহিত্যের নৈতিকতা মানবীয়তার কোনো মূল্য নেই। তুমি ব্রিটিশের এত ভক্ত, ব্রিটিশ আমাদের এই দেশে কী করেছে? শাসনের নামে ব্রিটিশ এই দেশে ব্যবসা করেছে। ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিজের দেশ ইংল্যান্ডে নিয়ে গেছে।'
ভোলানাথ শেষের কথাগুলি তিরস্কার করার মতো বলল। লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল।তাঁর আর কথা বলতে ইচ্ছা করল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলল,' দাদা, এই বিষয়ে আপনি নিজেই অতুলবাবুর সঙ্গে কথা বলবেন নাকি–।'
'ওহো, অতুল বাবুর সঙ্গে আমার এতটা ইন্টিমেসি নেই। তোমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর। আমার মনে হয়, সত্যিই তিনি তোমার আত্মীয়ের মতো হয়ে উঠেছেন। তোমার প্রতি তার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তুমি তোমার প্রস্তাব তুলে ধর।'
ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সদাশয় অতুলকৃষ্ণ ঘোষ কে বি ব্রাদার্স কোম্পানির কর্মচারী করার ভোলানাথের এই পরিকল্পনাটা লক্ষ্মীনাথের পছন্দ হল না।
' বুঝেছ, প্রস্তাবটা তুলে ধরার আগে অতুলবাবুকে বোঝাবে যে বৃদ্ধ কালীকৃষ্ণ প্রামানিকের ব্যবসা এখন ভাটির দিকে। তাছাড়া তাঁর ছেলে কাঠের ব্যবসাকে সুনজরে দেখে না। তাই একটা ডুবন্ত নৌকা থেকে নেমে একটা নতুন নৌকায় উঠাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কি হল তুমি যে গম্ভীর হয়ে পড়লে!'
লক্ষ্মীনাথ নিরুত্তর।
' তারমানে অতুলবাবুর সঙ্গে তোমার শ্রদ্ধা–ভালোবাসার সম্পর্কটা তোমাকে সেন্টিমেন্টাল করে ফেলেছে।ইস, এই ধরনের সেন্টিমেন্টের জন্যই অসমিয়াদের দ্বারা ব্যবসা হয় না।' বিরক্তিতে ভোলানাথের কপালটা কুঁচকে গেল। হাতের ফাইলটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ক্রোধের সঙ্গে বললেন,' আরে, ব্যবসায় নেমে কলকাতা ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার উড মার্কেটটা দখল করে একচেটিয়া ব্যবসা করার জন্য একটা পলিসি নিয়েছি। সমস্ত ব্যবসায়ীরাই এই ধরনের পলিসি নেয়। শীর্ষে পৌছাতে হলে আমাদেরকেও নিতে হবে। আর অতুলবাবুকে যে আমাদের ব্যবসার একজন এমপ্লয়ি করব বলে বলেছি– তার জন্য কালীকৃষ্ণ বাবু প্রদত্ত বেতনের চেয়ে আমরা বেশি বেতন দেব, বেশি সুবিধা দেব, ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অন্যায় নয়, অনৈতিক নয়। তাই দু-একদিনের মধ্যে ক্যালিডনিয়া ডকে গিয়ে তুমি অতুল বাবুর সঙ্গে দেখা কর। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের জন্য তোমার প্রস্তাবটা তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না।'
অনুরোধ নয়। একেবারে আদেশ। আদেশ না মানলে ভোলানাথের ক্রোধ আরও বৃদ্ধি পাবে। অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও লক্ষ্মীনাথ অতুলকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হল।
কিন্তু অতুলকৃষ্ণকে কথাটা কীভাবে বলবে, এটা নিয়ে লক্ষ্মীনাথ দুদিন ভাবল। শেষে মনটা শক্ত করে নিয়ে বিকেলের দিকে ক্যালিডনিয়া ডকে গিয়ে অতুলকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করল। বিকেল গড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ডকের কাজকর্ম শেষ হয়ে আসে। লোকজনও তেমন থাকে না। লক্ষ্মীনাথকে কাছে পেয়ে খোলাখুলি ভাবে মনের কথা বলতে পারবেন ভেবে অতুলকৃষ্ণ বাবুর ভালো লাগল। নতুন করে নির্মিত ডক গুলির চেয়ে এই ডকে জাহাজের মেরামতির কাজগুলি বেশি হয়। শুরুতে জাহাজের কথা আলোচনা করার পরে সেগুন কাঠের প্রসঙ্গ উঠল। ভারতের কোথায় কোথায় সেগুন গাছের চাষ হয়, কোন জায়গার সেগুন কাঠ সবচেয়ে ভালো, দেশে বিক্রি করা ছাড়াও বিদেশের কোন কোন দেশে সেগুন কাঠ রপ্তানি হয় ইত্যাদি। এদিকে অতুলকৃষ্ণ বাবুও থিয়েটারের ভক্ত। থিয়েটারের কোন কোন অভিনেতার অভিনয় তাঁর ভালো লাগে,তাঁদের কার কার সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে, ব্যক্তি হিসেবে অভিনেতারা কেমন,–এসবও তিনি বেশ রস লাগিয়ে বললেন। তারপর লক্ষ্মীনাথ আসল কথাটা উত্থাপন করল।
কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের ফার্ম ছেড়ে দিয়ে অসমিয়া মালিকের বিগ ব্রাদার্স কোম্পানিতে যোগদান করার জন্য অনুরোধ করায় অতুলকৃষ্ণ বাবু গম্ভীর হয়ে পড়লেন। তারপর ভোলানাথেরও নির্দেশ অনুসারে যখন কালীকৃষ্ণ প্রামানিকের ফার্ম অবনতির দিকে যাওয়ার কথা বললেন, তখন তিনি মন খারাপ করে বসে রইলেন। আসলে তিনি কাঠের ব্যবসায় কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের পতন চান না। প্রামাণিকের ব্যবসাটা যে আগের মতো চলছে না এবং এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে পতন অপরিহার্য, এই আশঙ্কাটা তাকে দুঃখ দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বললেন যে আজকের যুগে কালীকৃষ্ণের মতো উদার মনের মানুষ দুর্লভ। নিষ্ঠাবান হিন্দু সমস্ত আচার সংস্কারে মানুষটির প্রগাঢ় অনুরাগ। দেব-দ্বিজে অচলাভক্তি। কালীকৃষ্ণের পিতা তারকনাথ প্রামাণিক নিজের বাড়িতে একটি কাপড় পেতে নিয়ে তার ওপরে এক লক্ষ নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণের পদধূলি ফেলে সেই কাপড়টা একটি সোনার কৌটায় ভরে রেখেছেন। তিনি আজও ভাবেন যে ব্রাহ্মণের পদধূলি চিহ্নিত সেই কাপড়টা সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশকারী। সেরকম একজন ব্যক্তির ব্যবসায়ীর সঙ্গে জড়িত থেকে সেবা করাটা পুণ্যকর্ম।
অতুল বাবুর কথা শোনে লক্ষ্মীনাথের মুখে আর কোনো কথা যোগাল না। তারপর দুজনই অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। অতুলকৃষ্ণ বাবু বললেন যে লক্ষ্মীনাথ যেভাবে অনুরোধ করেছে সেটা অস্বীকার করাটা তাঁর পক্ষে কঠিন । সঙ্গে তিনি এটাও বুঝতে পারলেন যে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে চতুর ব্যবসায়িক বুদ্ধির ভোলানাথ বরুয়া আছে যখন, আগন্তুক দিনগুলিতে কলকাতার সমগ্র পূর্ব ভারতে বি ব্রাদার্স কোম্পানি কাঠের ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান রূপে আত্মপ্রকাশ করবে। তাই এখন তিনি বি ব্রাদার্স কোম্পানিতে যোগদান করাটাই উচিত । কিন্তু এখনই তিনি কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের ফার্ম ছেড়ে আসবেন না। এই বিষয়ে তিনি কালীকৃষ্ণ প্রামাণিকের সঙ্গে কথা বলবেন এবং তার অনুমতি সাপেক্ষে অতুলবাবু বি ব্রাদার্স কোম্পানিতে যোগদান করবেন।
তাঁর কথা শুনে লক্ষ্মীনাথ অবাক হল। এতদিন ভোলানাথের সঙ্গে থেকে বুঝতে বাধ্য হয়েছেন যে ব্যবসা হল বস্তুর ক্রয়-বিক্রয়, টাকা-পয়সার লেন-দেনের মাধ্যমে কেবল লাভ করার জন্য চেষ্টা করা। ভোলানাথের মতে মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা আন্তরিক সম্পর্কটিকে ব্যবসার স্বার্থে লাগানো উচিত। কিন্তু ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত অতুলকৃষ্ণ বাবু ব্যবসার ওপরে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটিকে মানবীয় গুনে উচ্চ স্থান দিতে দেখে লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগল। অতুলকৃষ্ণ বাবুর প্রতি তার শ্রদ্ধা আর ও বেড়ে গেল।
' তারপর আপনার মেয়ে সুরভি, সুরভির খবর কি?'
' ভালো আছে।’লক্ষ্মীনাাথ বলল এই বয়সেই আমার ওপরে ওর খুব কর্তৃত্ব।একেবারে গার্জেন।এই যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি ,বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ওর অনুমতি নিয়ে আসতে হয়েছে।বলে দিয়েছে যেন তাড়াতাড়ি বড়ি ফিরি।‘
‘তাই নাকি!ভারী মিষ্টি মেয়ে।তা ওকে নিয়ে আসতে পারতেন।’
‘ইচ্ছে ছিল।কিন্তু বাড়ি ফিরতে আমার রাত হবে বলে ‘বড়ো গার্জেন এলাও করলেন না।’
‘বড়ো গার্জেন!’
‘আমার হেড অফিস,গিন্নী।‘
অতুলকৃ্ষ্ণবাবু হাসতে লাগলেন।লক্ষ্মীনাথও সেই হাসিতে যোগ দিলেন।
‘সুরভি আমাকে হাওড়ার জ্যেঠামশাই বলে ডাকে।ওর ওই সুরেলা ডাক শুনে আমার মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়।’স্নেহসিক্ত কণ্ঠে অতুলকৃষ্ণ বল্লেন-‘সেদিন ভোলানাথ বাবু এবং আপনি যে সুরভিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন,কথা-বার্তা বলার পরে আপনারা বিদায় নিয়ে বাইরে গাড়িতে উঠার সময় সুরভি কি বলেছিল মনে আছে?’
‘বলুনতো-।‘'
'আমার হাত ধরে সুরভি বলেছিল দেখ হাওড়ার জ্যাঠামশাই, হাওড়া আমার ভালো লাগে। তোমাদের এই বাড়িটার কাছেই আমাদের জন্য একটা বাড়ি কিনে দাও না। আমরা হাওড়ায় চলে আসব। সেদিন আমি সুরভিকে কথা দিয়েছিলাম, ৮-১০ দিনের মধ্যেই আমাদের বাড়ির কাছেই তোমাদের জন্য একটা বাড়ি কিনে দেব।'
' হ্যাঁ মনে পড়েছে। আপনি বলেছিলেন।'
আমি কিন্তু ইতিমধ্যেই একটা বাড়ির খোঁজ পেয়েছি। রাস্তার পাশেই অনেকখানি এলাকা জুড়ে বেশ বড় বাড়ি। বাড়িটা বিক্রি হবে। কিন্তু কেনার পরে রিপেয়ারিং করাতে হবে।'
ঠিকানা কী?'
'৩৭ ডবসন রোড, হাওড়া।'
হাওড়ায় অতুলকৃষ্ণ একজন অতি জনপ্রিয় এবং প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। কী ভারতীয় ,কী ইউরোপীয়– কী কথা-বার্তা,কী আচার-ব্যবহারের জন্য প্রত্যেকেই তাকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। তিনি যে সুরভিকে এভাবে বাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, লক্ষ্মীনাথ সেকথা ভুলেই গিয়েছিল। শিশু কন্যা সুরভির কথা রক্ষা করে অতুলকৃষ্ণ সত্যিই সাত দিনের ভেতরে ডবসন রোডের বাড়িটা ঠিক করে ফেললেন।
পরের দিন ভোলানাথকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে লক্ষ্মীনাথ বাড়িটা দেখলেন। প্রায় আড়াই একর জমিতে বাড়িটা দেখে তার পছন্দ হল। বাড়িটার মালিক এক ইংরেজ মহিলা। নাম মিসেস ডিকশন। আর আশ্চর্যের কথা, বাড়িটা দ্রুত কেনার জন্য লক্ষ্মীনাথের চেয়ে ভোলানাথের আগ্রহ বেশি প্রকাশ পেল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২০০০ টাকায় বাড়িটা বন্দোবস্ত করে ফেললেন।
রেজিস্ট্রি করার সময় দলিল লেখা হল শ্রীযুক্ত ভোলানাথ বরুয়ার নামে। সেটা অবশ্য লক্ষ্মীনাথের নির্দেশেই হল। কারণ ভোলানাথ হলেন বি ব্রাদারস কোম্পানির মূল মানুষ। ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথের 'বড়ো ভাই'। সরল মনের লক্ষ্মীনাথ ভাবে ' বি বরুয়া হলাম আমি, আমি বি বরুয়া। কলকাতায় ও বিবাহিত বি বরুয়ার আমি ছাড়া আর অন্তরঙ্গ কেউ নেই। অর্থাৎ ইতিমধ্যে ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথের মন পুরোপুরি দখল করে ফেলেছে ।
কলকাতায় পড়তে এসে প্রথমে কালীঘাটে বেনীমাধব হালদারের বাড়িতে ছিল। এই বাড়িতে থাকতে ভালো লাগত না। তারপরে ৫৩ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের মেস, দুই নম্বর ভবানীচরণ দত্ত লেনে থাকা মেস, বিয়ের পরে কিছুদিন ঠাকুরবাড়িতে, তারপরে শোভারাম বসাক গোপী কৃষ্ণ পাল লেন এবং বলরাম দে স্ট্রিটে বসবাস করল। এভাবে কতদিন আর ভাড়া ঘরে থাকবে? ভাড়া বাড়িতে কিছু অসুবিধা থাকেই। তাছাড়া কোনো কারণে খারাপ লাগলে বা মালিকের সঙ্গে মতানৈক্য হলে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গায় জিনিসপত্র টেনে নিয়ে যাওয়া কষ্টকর। কিন্তু এবার নিজের বাড়ি হল। কলকাতায় নিজের বাড়ি। বাড়িটাকে নিজের পছন্দ অনুসারে সাজিয়ে কন্যা এবং পত্নীকে নিয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে। এরপরে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব কেউ এলে ভাড়া ঘরে থাকার গ্লানি থেকে অব্যাহতি পাবে।
লক্ষ্মীনাথ উৎসাহের সঙ্গে মিসেস ডিকশনের কাছ থেকে কিনে নেওয়া বাড়িটা মেরামত করার কাজে লেগে গেল। চারপাশে ইটের বেড়া দিল,চওড়া পথ-ঘাট নির্মাণ করে উঁচু গেট লাগাল। সামনের দিকে একটা পুকুর ছিল, সেটা বন্ধ করে ফেলল। বাড়ির চার সীমার পাশে চাকর বাকরের ঘর এবং গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করল। লক্ষ্মীনাথ ইন্ডিয়া ক্লাবে গিয়ে লন টেনিস এবং বিলিয়ার্ড খেলে। পর্যাপ্ত মাটি থাকার জন্য লন টেনিসের গ্রাউন্ড নির্মাণ করিয়ে দুপাশে সাদা পাথরের বেঞ্চ বসাল। বিলিয়ার্ড খেলার ইচ্ছায় সামনের দিকে একটা পাকা ঘর তৈরি করল। তারপরে ঘরগুলি রং করিয়ে দরজা জানালায় রং লাগিয়ে হাওড়া অঞ্চলে একটি দৃষ্টিনন্দন বাসস্থান তৈরি করে ফেলল। কাজ ভালো না হওয়ার আশঙ্কায় লক্ষ্মীনাথ ঠিকাদারের হাতে কাজ সমর্পণ করল না। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দিনরাত নিজে খেটে সমস্ত কিছু করাল। লক্ষ্মীনাথ এখানেই থেমে থাকল না। নিজের বাড়ি বলে কথা। তার মধ্যে আবার সাজ- পোশাক, পুরোপুরি সাহেব হলেও পৈতৃক সূত্রে লাভ করা লক্ষ্মীনাথ পুজো পার্বণ, নাম প্রসঙ্গ ছাড়েননি। তার জন্য ফুলের প্রয়োজন। রং-বেরঙের ফুলের চাষ করে বাড়ির সামনের দিকটা জাঁকজমক পূর্ণ করে তুলল।
'অবশেষে ১৯০০ সনের এপ্রিল মাসের বিহুর দিন গৃহপ্রবেশের দিন ধার্য করল। লক্ষ্মীনাথের ইচ্ছে ছিল ভক্তদের ডেকে এনে নাম- প্রসঙ্গ করার। কিন্তু রঙালি বিহুর জন্য ছাত্রদের বেশিরভাগই অসমে চলে গেছে। তাছাড়া প্রজ্ঞার ইচ্ছা, গৃহপ্রবেশটা ব্রাহ্মমতে হোক। তার জন্যই ব্রাহ্মসমাজের আচার্য পন্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নকে ডাকা হল। তিনি ব্রাহ্ম মতে উপাসনা করে ব্রাহ্ম গীত গাওয়ার পরে সপরিবারে এবং সবান্ধবে ভোলানাথ- লক্ষ্মীনাথ ৩৭ নম্বর ডবশন রোডের বাড়িতে প্রবেশ করলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন