স্মৃতিকথা -২৩
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
( গত মাসের পর)
বাবা মায়ের আশীর্বাদে যেমন তেমন করে পাস করে গেলাম হায়ার সেকেন্ডারি । তখন যেমন তেমন করে পাস করাটাই ছিল বিরাট ব্যাপার ।১৯৭৫ সালে হায়ার সেকেন্ডারিতে পাস করেছিল সম্ভবত আট কি নয় শতাংশ ছাত্রছাত্রীরা ।আমি তাদের মধ্যে অবশ্যই অন্যতম । সুতরাং আমায় কে আর পায়! বাড়িতে বেশ আনন্দ, মায়ের বেশি আনন্দ কারণ বাউন্ডুলেটা এ যাত্রা রক্ষা পেল । পরের যাত্রা কি হবে ভগবান জানেন । এবার ভরতি হওয়ার পালা কলেজে । বিনা ঝন্ঞ্ঝাটে মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম । তখন এখনকারমতো লাইন দিতে হত না । মেদিনীপুর কলেজ মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুল থেকে এক পাঁচিলের দুরত্ব । স্কুলে শুধু ছেলেরা পড়তো । কলেজ এসে মহিলাদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়ার স্বাদ পেলাম । প্রথম প্রথম আমাদের মধ্যে জড়ত্ব ছিল । মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতো না প্রথমের দিকে ।ওরা একজোট হয়ে থাকতো । তারপর দুপক্ষের মধ্যে জড়ত্ব কাটতে শুরু করলো । তখন সব মেয়েরা শাড়ি পরে আসতো কলেজে । কলেজে ক্লাসঘর ছাড়া আর একটি অত্যন্ত অন্তরঙ্গ জায়গা ছিল তা হল লাইব্রেরি হল। হাজার হাজার বই সেলফে । ছেলেমেয়েরা বই দিচ্ছে নিচ্ছে ।দেখতে ভালো লাগতো । লাইব্রেরি ঢুকতেই যে জিনিষটি আমার ভীষণ ভালো লাগতো তা হল গেটের পাশেই বেন্ঞ্চের ওপর বোর্ড দিয়ে আটকানো দু-একটি কবিতার দেওয়াল পত্রিকা । আমার খুব ইচ্ছে হত পত্রিকাগুলোয় কবিতা শিখি । কিন্তু প্রথম প্রথম কলেজে এসেছি । বেশ নতুন পরিবেশ । চারদিকে ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে । সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা করছে । আমার তরুণ মন সেসব মেয়ে দেখতো । মনে মনে ইচ্ছে টিচ্ছে যে হত না তা বলবো না । কিন্তু ওই পর্যন্তই । তবে আমার বেশি ইচ্ছে ছিল সাহিত্য আর সাহিত্য । রাতের বেলা ঘুমোনোর আগে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে শুতে যেতাম যাতে ভালো কবিতা লিখে উঠতে পারি। তখন খ্যাতি বুঝতাম না । ভালো লেখার আকাঙ্ক্ষা চেপে বসেছিল । বেশ কিছু লেখা লিখে ফেলেছি কিন্তু তা মনঃপূত হচ্ছিল না বলে দু বছর কোথাও লেখা প্রকাশের উদ্যোগ নিইনি । সময়ের সঙ্গে কলেজে বন্ধু হতে শুরু করলো স্বাভাবিক নিয়মে । কলেজিয়েট স্কুলে কিছু ছেলে আমার সঙ্গে পাস করে কলেজে পড়া শুরু করলো । সে সময় পাসকোর্সে তিন বছর পড়তে হত কলেজে । ফাস্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার ও ফাইনাল ইয়ার । ফাস্ট ইয়ার মানে নিয়ম মেনে ক্লাস করো, ঘুরে বেড়াও, খেলে বেড়াও আর কলেজের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নাও, বাড়িতে পড়াশোনা ত্যাগ করো । সেকেন্ড ইয়ার থেকে কলেজ ছাত্র ছাত্রীরা সিরিয়াস হতো ও ফাইনাল পাস করে চাকরি করতো । এই ছিল সে সময় নিয়ম। তখন আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত ছিলাম । মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি । মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়নি । মাত্র তিনটি কলেজ মেদিনীপুর কলেজ , কৈবল্যদায়িনী কলেজ অব কমার্স আর মহিলাদের জন্য গোপ কলেজ । গোপ কলেজ যাবার জন্য বাসের ব্যবস্থা ছিল । আমার ছোড়দি গোপ কলেজ থেকে পাস করেছিল । ওই কলেজের প্রকৃত নাম রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয় । বড়দি আমি আর দাদা মেদিনীপুর কলেজের থেকে পাস করা । তাছাড়া আর একটি কলেজ আছে সেটি বি টি কলেজ । এছাড়া একটি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ মেদিনীপুর আছে ।
কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ার সময় কবিতার জন্য ব্যাপক উন্মাদনা শুরু হয়ে গেল ।তখন কাগজে কাগজে চিঠিপত্র লেখা আর পোষাচ্ছে না । নিজের কবিতা ছাপার জন্য ভীষণ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলাম ।
আমার এক বন্ধু তাপস দাস মেদিনীপুরের হাঁসপুকুর এলাকাতে থাকতো । আমি সেখানে নিয়মিত যেতাম । তার সঙ্গে পরিকল্পনা করলাম ছোট্ট বই ছাপতে হবে । তাতে থাকবে আমার কিছু কবিতা আর একটি গল্প । নাম দেওয়া হবে ' জরাজীর্ণ বাড়ির দলে ' । সেইমতো কর্ণেলগোলায় আমাদের বাসার কাছে রূপলেখা প্রেসে গিয়ে দরদাম শুরু করি । দরদাম করে ২০০ কপি অস্টোত্তর শতনাম মার্কা বই এর কস্টিং হল ৯০ টাকা । তাপস আমাকে অনেক কষ্টে ৩০ টাকা দিয়েছিল বাড়িতে লুকিয়ে । বাকি ৬০ টাকা কি করে জোগাড় হবে তা নিয়ে আমাদের কি দুশ্চিন্তা ! হঠাৎ মনে হল আমার কাছে সাঁই বাবার একটা লকেট আছে । যা দাদার ছিল । সেটি লুকিয়ে বিক্রি করলাম । পেলাম ১০টাকা । বাকি ৫০ টাকা বাড়ি থেকে টাকা সরিয়ে টরিয়ে টাকা আর লেখা জমা দিলাম প্রেসে । বই বেরলো । সে যে কি কুচ্ছিত বই হলো তা কহতব্য নয় । কিন্তু নিজের নাম আর কবিতা দেখে আমার সে কি আনন্দ! কিছু বই বিক্রি হল বন্ধুদের কাছে । বইটির দাম ছিল ৩৫ পয়সা । বিক্রি হল ২৫ পয়সায় । অতি সামান্য বিক্রি হতেই আমার আনন্দ চতুর্গুণ । আমি তখন কলেজে কবি বলে কিছু ছাত্রর কাছে পরিচিত হচ্ছি । মনে আছে 'জরাজীর্ণ বাড়ির দলে' -র মধ্যে কয়েকটি লেখা এই বয়সেও অবাক করে । একটি ছেলে যা মাত্র ষোল সতের বছরেকি করে লিখতে পারে ভেবে বিস্মৃত হই । কবিতার নাম ' 'আবরণ' যার প্রথম দুটি লাইন: ' ওরা কেউদেখেনা আমাক/ ওরা দেখে আমার রঙিন সোয়েটার । ' যা তখন একজন গ্রামীণ ছেলের কাছে পাওয়া দুষ্কর ছিল ।
স্মৃতি সততই মধুর।
উত্তরমুছুন