পাখিদের পাড়া পড়শি
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi
দ্বিতীয় অধ্যায়,
(ছয়)
গাছ থেকে খসে পড়া শিশিরের ফোঁটার শব্দে পর্যটন নিবাসের ঘরটা ঝকঝকে সকালেই জেগে উঠল।
শীতের কুয়াশা চারপাশে ঘিরে রেখেছে। ঘরের দরজাটা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার রাশি রাশি ধোঁয়া ঘরটিতে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। যেন উদয়শঙ্করের পুরোনো পরিচিত অতিথি। ঠান্ডা হলেও নিত্যকর্ম সমাধা করতেই হবে। কুয়াশা ভেদ করে সে পুকুরের পারে গেল। পুকুরের জলের ওপরেও কুয়াশার আচ্ছাদন। শরীর জলের স্পর্শের নামে শুনতে চায় না। বাইরে নিয়ে যাওয়া বালতিটা এনে পুকুরের জলে ডুবানো নিষেধ । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তত তাড়াতাড়ি করে সে বাড়ির দিকে ফিরে চলল।
ফ্লাস্কে গরম জল ভরা আছে।গরম জলে মুখটা কুলকুলি করে সে কিছুটা আরাম পেল। উদয় শঙ্কর অনুভব করল হঠাৎ তার শরীরটা বেশি ঠান্ডা হয়ে পড়েছে । সে শরীরটাকে উষ্ণতা দানের জন্য পুনরায় কম্বলের ভেতরে ঢুকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীর গরম হয়ে উঠল। ফ্লাক্সের গরম জলে করা এক কাপ চা খেয়ে সে বিলম্ব না করে হাড়গিলার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
বনভোজ খাবার সুবিধা করে রাখা থানের খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে সে হাঁটতে লাগল। মাঠের ছোটো ছোটো ঘাসগুলি শিশিরে ভিজে নতুন প্রাণ পেয়েছে। উদয় শঙ্করের জুতো জোড়া ভিজে সেখানে শুকনো ঘাস বন লেপ্টে রয়েছে। সেসবের প্রতি উদয়শঙ্করের ভ্রুক্ষেপ নেই।
মুক্ত মাঠটা পার হয়ে মানুষ আসা যাওয়া করার সময় সৃষ্টি হওয়া ছোটো পথটি ধরে সে এগিয়ে চলেছে। রাস্তাটাকে ঘিরে ধরে জার্মানি বনগুলি সরানোর চেষ্টা না করে তার নিচ দিয়ে একাত সেকাত হয়ে উদয়শঙ্কর এগিয়ে চলেছে । সেইসব সরানোর চেষ্টা করা মানে শিশির অযথা ভিজিয়ে ফেলা। তার মধ্যে দুই একটি জার্মান বনে মাথাটা ধাক্কা খাওয়ায় খসে পরা শিশির উদয়শঙ্করকে ভেজাতে ভোলেনি। ছোটো পথটি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে উদয়শঙ্কর ডানদিকে কিছুটা খালি জায়গা দেখতে পেল। খোলা জায়গাটার বাঁ পাশে গভীর অরণ্য। এই অরণ্যের একপাশ জলাশয়ে আর অন্য দিক নদীতে বিস্তৃত হয়ে আছে।
মুক্ত জায়গাটিতে উদয়শঙ্কর ভাত খাওয়া অবস্থায় পড়ে থাকা একটা জন্তুর শবদেহ দেখতে পেল। উৎসুকতা নিবারণ করার জন্য সেটা কী জন্তু দেখার জন্য উদয়শঙ্কর এগিয়ে গেল। সে দেখতে পেল জন্তুটা একটি পূর্ণবয়স্ক প্রাপ্ত ছাগলী। মুক্ত মাঠে চড়তে এসে এখানে পৌঁছে শিয়ালের শিকার হয়েছে। ছাগলীটির অর্ধেক অংশ ভক্ষণ করা থেকে অনুমান করা যায় ছাগলীটির শিয়ালের ঝাঁকের পরিবর্তে একটি বা দুটি শিয়ালের আক্রমণের বলি হয়েছে । নিশ্চিত যে রাতের দিকে ছাগলীটির বাকি অংশ খাবার জন্য শিয়াল গুলি পুনরায় এখানে আসবে ।
শিশিরের প্রকোপ বেশি না হলে উদয়শঙ্কর অরণ্যের মধ্য দিয়ে সোজাসুজি জলাশয়ে চলে যেত। অযথা ভেজার ইচ্ছা না থাকায় উদয়শঙ্কর কিছুটা ঘুরে ফিরে মরে পড়ে থাকা শিশু গাছটার গোড়ায় এসে পৌঁছালো। সাধারণত সে যে জায়গাটিতে মহা আয়াসের সঙ্গে বসে সেই জায়গায় অন্ধকারের মধ্যেই আগামী রাতের শিশির তখনও পড়ছে। রাতের শিশিরকে সরিয়ে বসার জন্য উদয়শঙ্কর ব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিক বের করে নিয়ে প্রাকৃতিক চেয়ারটিতে বসে পড়ল।
উদয়শঙ্কর সামনের উঁচু শিমুল গাছটার দিকে তাকাল। গাছটার ওপরের অংশ গাঢ় কুয়াশার মধ্যে ডুবে আছে। ডালে বসে থাকা হাড়গিলা চারটা অস্ফুটভাবে উদয় শঙ্করের চোখে পড়ল। লম্বা লম্বা ঠ্যাং দুটির উপর ভর দিয়ে হাড়গিলাগুলি স্থির হয়ে গাছের ডালে বসে আছে। সাধারণত পাখিদের গাছের ডালে বসে থাকা বলা হয়, দাঁড়িয়ে থাকা বলা হয় না। হাড়গিলা তার ঠেংগুলি ভাঁজ করতে পারে না বলে ডানায় মাথা গুঁজে দাঁড়িয়ে থেকে ঘুমোয়।
ফিরফির করে বইতে থাক ঠান্ডা বাতাস উদয়শঙ্করের হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। ঠান্ডা থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায় হিসেবে উদয়শঙ্কর গুটি-সুটি হয়ে নিজের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার মতো হল। তার থেকে কিছুটা দূরে একটা গাছের শুকনো ডালে বসে একটা পেঁচা কিচিরমিচির করে চিৎকার শুরু করেছে। সকালবেলা এবং সন্ধ্যের সময় এভাবে চেঁচামেচি করাতো এই পাখিটার বৈশিষ্ট্য। ইংরেজিতে ব্ল্যাক ড্রোংগো বলে সম্বোধন করা পাখিটার বৈজ্ঞানিক নাম ডিক্রুরাছ মেক্রোচিরাছ। সামনে মানুষ দেখতে পেলেও পরোয়া না করে চিৎকার করতে থাকা পাখির প্রজাতির এই সদস্যকেও উদয়শঙ্কর পরোয়া করেনি। এভাবে চিৎকার করতে করতে পাখিটা মাঝেমধ্যে শূন্যে উড়ে যায় এবং পুনরায় এসে ডালটিতে বসে। উদয়শঙ্কর পাখিটা খেলতে থাকা সকালের খেলাটা আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করতে লাগল।
বসে থাকা ডালটার চারপাশ থেকে কুয়াশার ঘন আচ্ছাদন ধীরে ধীরে সরে যাওয়ায় পাখি গুলিকে স্পষ্ট করে দেখতে পেল উদয়শঙ্কর। সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকার মধ্যে একটা পাখি বিস্তৃতভাবে ডানা মেলে জলাশয়টির ওপর দিয়ে উড়ে গেল। উচু একটা ছাতিম গাছের আড়াল নিয়ে উড়ে যাবার জন্য হাড়গিলাটা কোন দিকে গেল উদয় শঙ্কর বুঝতে পারল না। পাখিটা উদয়শঙ্করের দৃষ্টির আড়াল হওয়ার কিছুক্ষণ পরে একটি একটি করে বাকি পাখিগুলিও একই দিকে উড়ে গেল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওদের একমাত্র লক্ষ্য আহারের সন্ধান।
হাড়গিলার ঝাঁকটা উড়ে যাওয়ার পরে উদয়শঙ্কর সেই জায়গাতেই বসে রইল। একটা মাছরাঙ্গা পাখি তার অগতানুগতিক চিৎকারের সঙ্গে এসে জলাশয়ের জলের মধ্য দিয়ে আকাশের দিকে বেরিয়ে থাকা শিশুর একটা শীর্ণ ডালে বসল। ডালটাতে বসে পাখিটা কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল। তারপর সেই চিৎকারের পুনরাবৃত্তি করে পাখিটা অরন্যের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পাখিটার ঠোঁটটা লাল। দেখতে হারগিলার ঠোঁটের মত বলে ইংরেজিতে পাখিটিকে স্টক বিল্ড কিংফিশার বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম হেলিয়ন কেপেনছিছ। পাখিটার মাথা এবং বুক খয়েরী রংয়ের। পাখা এবং লেজ নীল। পা দুটি লাল। পাখিটা দেখতে অতি সুন্দর। অসমের কোনো কোনো জায়গায় এটাকে বরঠুটীয়া মাছরাঙ্গা অবলা হয়ে থাকে। কাজিরাঙ্গায় সকালবেলা তাকে খেপাতে আসা মাছরাঙ্গাটার কথা উদয়শঙ্করের মনে পড়ে গেল।
অসমের অরুণ্যে সাত প্রকারের মাছরাঙ্গা পাখি দেখতে পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত দেখতে পাওয়া মাছরাঙ্গা গুলিকে ইংরেজিতে কমন কিংফিশার বলে জানা যায়। বৈজ্ঞানিক নাম এলিডো এথিছ। পাখিটার মাথা এবং পিঠ নীল সবুজ রঙের । বুকটা খয়েরী । এই মাছরাঙার পুচ্ছ্বাংশ ছোটো। অসমের কোন কোন জায়গায় নীল মাছরাঙ্গা বলে পরিচিত পাখিকে ইংরেজিতে বলা হয় ব্লু– ইয়ার্ড কিংফিশার। বৈজ্ঞানিক নাম এলিডো মেনিন টিং। এই মাছরাঙ্গার শরীর নীল, থুতনি সাদা, বুক খয়রি রংয়ের। পাখিটির ডানায় কালো কালো দাগ দেখতে পাওয়া যায়। ইংরেজিতে হোয়াইট থ্রোটেড কিংফিশার বলে যে মাছরাঙ্গা গুলি পরিচিত সেগুলিকে অসমিয়াতে সাদা- বুকের মাছরাঙ্গা বলা যেতে পারে। বুকটা সাদা বলে পাখিটার নাম হয়েছে হোয়াইট থ্রোটেড। এই ধরনের মাছরাঙ্গা ঠোট লাল, মাথার রং গাঢ় খয়েরী, পিঠের ডানা এবং লেজ নীল। কালো মাথার মাছরাঙ্গাকে ইংরেজিতে ব্ল্যাক-কেপড কিংফিশার বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নামহেলিয়ন পিলিয়েটা। মাছরাঙ্গা গুলির মাথা কালো, গলার চারপাশে এবং থুতনি সাদা, ঠোঁটটা লাল এবং বুক খয়েরী ধরনের। ইংরেজি ক্রেস্টেড কিংফিশারকে ঝুটিওয়ালা মাছরাঙ্গা বলা হয়। এদের ঠোঁট কালো ছাই রঙের। ডানাগুলিতে সাদাকালো ছিট রয়েছে। মাথার দিকে ঠরঙা পাখির সমাহার দেখতে পাওয়া যায়। এইসব মাছরাঙ্গার বৈজ্ঞানিক নাম মেগাকেরাইল লুণ্ডব্রিজ। শেষের মাছরাঙ্গা হল চিত্রবিচিত্র মাছরাঙ্গা। পাইড কিংফিশার। বৈজ্ঞানিক নাম শ্রাইল রুডিছ। দেখতে মাছরাঙ্গার মতোই কালো– সাদা। ঠোঁট কালো এবং অন্য মাছরাঙ্গা থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করা যায়।
মাছরাঙ্গা পাখিটার কলরব উদয় সম্পর্কে মাছরাঙার পৃথিবীতে বিচরণ করার সুযোগ আর সুবিধা দিল। তার মনে এক এক করে প্রতিটি মাছরাঙ্গার প্রজাতির রং- রূপ এবং তাদের প্রাকৃতিক বিচরণ মনের মধ্যে ভেসে এল। সে দেখতে পেল একটা ক্রেস্টেড কিংফিশার এসে জলাশয়ের ওপরে উড়ে ডানা নাড়ছে এবং নিমেষের মধ্যে ওপর থেকে জলে খসে পড়ে পরের মুহূর্তেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। পাখিটার ঠোঁটের মধ্যে একটি ছোটো আকারের মাছ। এই মাছরাঙ্গা গুলির শিকারের পদ্ধতি অতি মনোরম। অন্য কোনো পাখির সঙ্গে মিলে না। শিকারের লক্ষ্য স্থির করার জন্য পাখিগুলি জ্যামিতিক অংক করে।
উদয়শঙ্কর স্থির করল বড় কুড়িহা অঞ্চলের পাখিদের আবাসস্থলে দেখতে পাওয়া মাছরাঙ্গা পাখিদের প্রজাতির তথ্যাদি সংগ্রহ করার সে চেষ্টা করবে। এখানে সাতটি প্রজাতির মাছরাঙ্গা একসঙ্গে দেখতে পেলে তার ভালো লাগবে।
মাছরাঙ্গা প্রজাতির তথ্যাদি সংগ্রহের কথা ভাবতে ভাবতে উদয়শঙ্কর দেখতে পেল কিছুক্ষণ আগে দূরে বসে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকা মাছরাঙ্গা পাখিটা তার অলক্ষিতে এসে সামনের শুকনো ডালটাতেতে বসে শিকারের জন্য অপেক্ষা করছে। সে পাখিটাকে পুনর্বার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করল। অত্যন্ত সুন্দর পাখি।
দূরে অদূরের কোনো কোণে সূর্য দেবতা রাতের বিছানা ত্যাগ করে আড়মোড়া ভাঙছে। আঙ্গুল বর্ণের আলোর কণা দিগন্ত ভেদ করে ধীরে ধীরে উকি দিতে শুরু করেছে। কুয়াশার সঙ্গে হওয়া সেই যুদ্ধটা অতিক্রম করে দুই একটি কণা রোড অরুণ্যের মধ্যে এসে ছিটকে পড়েছে। উদয় শঙ্করের ক্ষুধা পেয়েছে। সে ঘড়িটার দিকে তাকাল।
নটা বেজে ১৫ মিনিট।
উদয় শঙ্করের অলক্ষিতে তার হাতের ঘড়িটা থেকে দিনের প্রথম ভাগের সমরটা সরে গেল।
সকলের আহারের জন্য সে যখন হরিণের দোকানে পৌঁছাল, দোকানের সামনে কাকাবাবু অপেক্ষা করছিলেন।
–কী হে যুবক। কোথায় যাবে?
কী বলবে কী না বলবে ভেবে পায়না। উদয়শঙ্কর কিছুটা ইতস্তত বোধ করল। এখানে কিছু খেতে আসবে বলে বুঝতে পারলে বলবে তুমি আমাদের বাড়িতে যেতে পারতে!
– কাকাবাবু এই সময় আপনি এখানে। কোথাও যাবেন নাকি?
-– বৌমার সম্পর্কিত একজন অতিথি আসার কথা ছিল। আমি ভাবলাম তাকে এগিয়ে এসে নিয়ে যাই।
— ও তাই। আপনাকে দেখে আমি কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম।
– তুমি এখানে?
— কাকাবাবু,একটু …
বাক্যটা সম্পূর্ণ না করে উদয়শঙ্কর চায়ের দোকানটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দিল।
—হ্যাঁ, যাও ।ক্ষুধা থাকতে খাওয়া ভালো।
উদয়শঙ্কর হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে বলে কাকুকে জানাতে চাইছিল না।
– আজ সন্ধ্যায় নিশ্চয় আমাদের বাড়ি আসছ?
– কাল তো গিয়েছিলাম। আজকে আবার যেতে হবে!
– কেন আসবে না? গতকাল গিয়েছিলে বলে আজ যেতে কোনো বাধা আছে নাকি?
উদয়শঙ্কর কী উত্তর দেবে? অনেক কঠিন প্রশ্নের উত্তর না থাকার মতো উদয়শঙ্করের হাতে এই সাধারণ প্রশ্নটিরও উত্তর নেই।
সে সাধারণভাবে কাকাবাবুকে সান্তনা দেবার জন্য বলল– চেষ্টা করব কাকাবাবু।
– উহু। চেষ্টা- টেষ্টা বুঝিনা। আসতে হবেই।
উদয়শঙ্কর ভাবল এখন হে পড়ল ফড়িংয়ের মরণের পালা। নতুন- বউ থাকা ঘর, সবসময় এভাবে আসা যাওয়া করলে প্রতিবেশীরা অন্য কিছু ভাবতে বেশি সময় লাগবে না। তাই নিজে থেকে সাবধান হওয়া ভালো। অবশ্য এসব তার নিজস্ব চিন্তা, তার বোধে সে এভাবে ভাবা উচিত ছিল না।
উদয়শঙ্করর মাথা নেড়ে কাকাবাবুর কথায় সায় দিয়ে বলল–' আপনি অতিথির সঙ্গে ব্যস্ত থাকবেন নাকি।'
– রাত পর্যন্ত থাকবে কি থাকবে না জানি না। থাকলেও আড্ডা জমবে। আমি তোমার কথা সবাইকে বলেছি।
– কেন কাকাবাবু?
– আমি জীবনে যত মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি, তোমার চরিত্রের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়নি। অন্তত পাখি দেখে ঘুরে বেড়ানো মানুষ।
কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য উদয়শঙ্কর কাকাবাবু কে জিজ্ঞেস করলেন– এক কাপ চা?
-– সাধারণত আমি হোটেলে কিছু খাই না, কিন্তু তুমি বলছ যখন–
– সেরকম কোনো কথা নেই কাকাবাবু। আপনার ইচ্ছার বিপরীতে আমি আপনাকে বাধ্য করতে চাই না।
– একটু বেশি কঠোরভাবে বললে নাকি?
উদয়শঙ্কর কাকুর হাত খামচে ধরে কাকাবাবুকে হোটেলের ভেতরে নিয়ে গেল এবং একটা চেয়ার টেনে এনে সেখানে বসতে ইঙ্গিত করল। বিনা বাক্যব্যয়ে কাকাবাবু চেয়ারটাতে বসলেন এবং উদয়শঙ্করের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চা দেওয়া ছেলেটি এগিয়ে এসে উদয়শঙ্করকে ডাকল– দাদা।
উদয়শঙ্কর ছেলেটি করা সম্বোধন থেকে তার সঠিক প্রশ্নটি বুঝতে পারল। সেই কাকাবাবু কে জিজ্ঞেস করল– কাকাবাবু পুরি খাবেন?
মানুষটা ইতস্তত করে বলল– বোধহয় চায়ের দোকানে এসব খাওয়ার কথা মনে পড়েনা।
– একবার মনে করে দেখতে পারেন।
– দুই প্লেট পুরি এনো। একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে এনো।
প্রত্যেকেই পুষ্কর বলে খ্যাপানো ছেলেটি উদয় শঙ্কর ডাকলই হাসতে হাসতে কাছে চলে আসে এবং উদয় শঙ্কর কিছু চাইলেই ফায়ার ব্রিগেডে কাজ করা মানুষের মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয় । উদয়শঙ্কর জানে না সেই আত্মিক আতিথেয়তার ঠিকানা কি । উদয় শঙ্কর ছেলেটিকে একবারের জন্য ও পুষ্কর বলে ডাকেনি। সেভাবে ডাকলে হয়তো ছেলেটি কখন ও তার কাছাকাছি আসত না।
ছেলেটি রেখে যাওয়া পুরি দুটো কাকাবাবুকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে খেতে দেখে উদয়শঙ্করের ভালো লাগল। উদয়শঙ্কর জানে এই আন্তরিকতার নাম অথবা পরিপূরক উত্তর হল বৃদ্ধাবস্থায় লাভ করা নিঃসঙ্গতার সান্নিধ্য। বৃদ্ধ অবস্থায় মানুষ এমন এক একাকীত্বতায় ভোগে যা থেকে বন্ধুত্বের সান্নিধ্যে পরিত্রাণ পেতে ইচ্ছা করে । অথচ বয়সের পার্থক্য চিন্তার দূরত্ব আদির জন্য স্থিতি লওয়া শূন্যতা তাদের সর্বস্তরের বন্ধুত্ব থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কাকাবাবু ভেবেছেন উদয়শঙ্কর তার সেই শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
প্লেটটিতে সাধারণ একটা টুকরোও না রেখে কাকাবাবু পুরিদুটো খেলেন।
– কাকাবাবু আর ও একটি পুরি!
– না না লাগবে না। পুরি খাওয়ার আমার অভ্যাস নেই।
– তাহলে কেন খেলেন?
মাঝেমধ্যে কাকাবাবুকে ক্ষেপিয়ে উদয়শঙ্করের ভালো লাগে। সেই জন্যই উদয়শঙ্কর কাকাবাবু কে এভাবে বলল।
– একমাত্র তোমার জন্য।
উদয়শঙ্করের মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মানুষের সম্পর্কের বন্ধন মানুষকে কীভাবে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধায় জড়িয়ে ধরতে পারে তার জ্বলন্ত মুহূর্তের সাক্ষী হল উদয়শঙ্কর।
– দু কাপ চা দেবে। কাকাবাবু একটা মিষ্টি খাবেন নাকি?
– খাব না।
কাকাবাবু ইতস্তত করে বলল। উদয়শঙ্কর বুঝতে পারল, কাকাবাবু একটা মিষ্টি পেলেও খুব একটা আপত্তি করবে না।
— ভাইটি, একটা মিষ্টিও দেবে।
— লাগবেনা, লাগবেনা।
— কিছুই হবে না কাকাবাবু। একটাই মিষ্টিমাত্র।
ছেলেটিকে উদয়শঙ্কর দু কাপ চায়ের ফরমায়েশ দেওয়ার আগে দুজনের জন্য দু কাপ চা নিয়ে এসেছিল। সে গ্লাসে আনা দুই কাপ চা দুজনের সামনে রাখল এবং একটা মিষ্টি আনতে গেল। চায়ের গ্লাস থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে উদয়শঙ্কর ভাবল মানুষের জীবনটাও এক একটি ধোঁয়া থাকা চা। নির্দিষ্ট সময়ে ঠান্ডা হওয়া এক কাপ চায়ের মতো মানুষের চলন্ত জীবন একসময়ে ধোঁয়াহীন, উত্তাপহীন এবং অবশেষে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আর এই ধরনের এক একটি গরম চা সময়ে মানুষের জন্য সম্পর্কের সারথি হয়ে জীবন অতিবাহিত করার জন্য প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।
আজকের মতোই। অনবরত সামরিক কায়দায় জীবন উদযাপন করা কাকাবাবু উদয় সংকর ভাবার বিপরীতে তার সঙ্গে আজ হোটেলের টেবিলে চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়েছে।
চায়ের গ্লাসে শেষ চুমুক দিতে যেতেই কাকাবাবুর পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠল।
– এসে গেছে বোধহয়।
কাকাবাবু উদয় শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে ফোনটা পকেট থেকে বের করে রিসিভ করল।
– হ্যালো– হ্যালো। এক মিনিট। লাগবেনা। লাগবেনা। আপনি এক কাজ করুন। সামনের তুলিকা মিঠাই দোকানটিতে চলে আসুন।
ফোনটার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে কাকাবাবু মোবাইলটা টেবিলের ওপরে রাখলেন।
– মানুষটা এখনই চলে আসবেন। বাইরে বেরিয়ে যাব নাকি?
– আপনি তো মানুষটাকে এখানে আসতে বললেন। তিনি আপনাকে অনর্থক খোঁজার চেয়ে আপনি কিছুক্ষণের জন্য এখানেই অপেক্ষা করুন, তিনি নিজেই এসে উপস্থিত হবেন।
উঠতে গিয়েও কাকাবাবু পুনরায় বসলেন। টেবিলের উপরে থাকা জলের গ্লাসটা এপাশে- ওপাশে কাত করে তিনি চুপ করে থেকে উদয়শঙ্করের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। উদয়শঙ্কর সেদিনের খবরের কাগজের প্রকৃতি বিষয়ক পৃষ্ঠাটা মেলে কিশোর চৌধুরীর একটা লেখা দেখতে পেয়ে পড়তে লাগলেন। ছোটো লেখা। পাঠশালার কোথাও বৃক্ষরোপনের অভিজ্ঞতার কাহিনি। নিচে ফোন নাম্বারটাও দিয়েছে। উদয় শঙ্কর 'পড়ে ভালো লাগল' বলে একটা মেসেজ পাঠালেন।
হোটেলটাতে প্রবেশ করা প্রায় আধবয়সী মানুষটিকে দেখে কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন —
— আসুন আসুন। রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
– না না ।কোনো অসুবিধা হয়নি।
– উদয়শঙ্কর, ইনি আমার বৌমার কাকাবাবু।
উদয়শঙ্করর মানুষটিকে নমস্কার জানাতেই মানুষ টিও উদয় শঙ্করকে প্রতি নমস্কার জানালেন।
– চল। আমাদের বাড়িতে যাই।
পকাকাবাবু অতিথির সঙ্গে উদয়শঙ্করকেও তাদের বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন।
– একটু সময় বসুন, নতুন মানুষ একজন এসেছেন। খালি মুখে কীভাবে পাঠাই।
কাকাবাবু কিছুটা ইতস্তত করলেন।
– তুমি যেভাবে বলছ, এটা যেন তোমার ঘর।
– কী যে বলেন কাকাবাবু, সংসার না থাকা মানুষের জন্য হোটেলটাই নিজের ঘর।
বৌমার কাকাবাবু দুজনের কথাবার্তা বুঝতে পারছে না। মানুষটার বোধহয় ক্লান্তিবোধ হচ্ছিল, তিনি বসলেন।
– আমার মেয়ের বাড়িতে এসেছিলাম, গুয়াহাটিতে থাকে। ভাবলাম একটু এগিয়ে এসে ভাইঝির সঙ্গেও একবার দেখা করে যাই। দেহের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, পরে কখন ও আসতে পারব কিনা কে জানে।
– না, না। ঠিকই করেছেন। এভাবে খবরাখবর করলে বৌমাও খুশি হবে।
উদয়শঙ্কর বৌমার কাকুকে জিজ্ঞেস করলেন– কাকাবাবু আপনিও কিন্তু আমার কাকাবাবুই হবেন– আপনি মিষ্টি খান তো?
– মিষ্টি, কেন জিজ্ঞেস করলেন? অবশ্য চিনি বা মিষ্টি খাওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোনো বাধা নিষেধ নেই।
– কাকাবাবু– উদয়শঙ্কর বলল – আজকের দিনে এটা বজায় রাখা সবচেয়ে কঠিন কাজ। আপনি যে পেরেছেন।
উদয়শঙ্কর ছেলেটিকে মিষ্টি এবং পুরি বৌমার কাকাবাবুও আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করায় উদয়পুশঙ্করের মনটা পরিতৃপ্ত হয়ে পড়ল। দুজন জ্যৈষ্ঠ ব্যক্তিকে সকালবেলা আপ্যায়ন করার সুযোগ পাওয়াটাকে বোধহয় লোকে বলে– সৌভাগ্য।
‐- তোমার নামটা যেন কী ছিল?
‐– উদয়শঙ্কর, কাকাবাবু‐-
‐- ও উদয়শঙ্কর‐- কত বছর পরে যে এভাবে হোটেলে চা–পুরির স্বাদ নিলাম আমার মনে পড়ছে না‐- কাকাবাবু বলা কথাটাই বৌমার কাকা ও বললেন। হয়তো বলে 'জেনারেশন গ্যাপ ফেক্টর' বা হয়তো বয়ঃসন্ধির কারক। এই কারকের জন্য ইচ্ছা থাকলেও তারা জীবনের কোনো মাদকতা গ্রহণ করতে পারেনা। অন্য অর্থাৎ হয়তো বা স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা। কথাগুলি এতটা বিশ্লেষণ করে দেখতে উদয়শঙ্করের ইচ্ছা হল না।
দুজনের অনুরোধকে উপেক্ষা করে উদয়শঙ্কর পর্যটন আবাসের দিকে এগিয়ে চলল। তারা চেয়েছিল তাদের সঙ্গে উদয়শঙ্কর কাকাবাবুর বাড়িতে যাক।' যাচ্ছি 'বলে উদয়শঙ্কর দুজনকেই প্রত্যাখ্যান করল।
তাঁরা তাঁদের সময়টুকু নিজেদের মতো করে কাটাক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন