হে আমার স্বদেশ- ২১
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(
(২১)
মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন এবং শাশ্বত। কিন্তু পরম আত্মীয়ের মৃত্যু প্রাজ্ঞ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেও নির্মম, হৃদয়বিদারক।
অবশেষে ১৮৯৫ সনের ২৭ মে সোমবার শুক্লা তৃতীয়ার দিন দীননাথ বেজবরুয়া সজ্ঞানে পুণ্যভূমি মাজুলীর বৈকুণ্ঠসম কমলাবারী সত্রে দেহত্যাগ করলেন।পরের দিন গোবিন্দচন্দ্র পাঠানো টেলিগ্রাম থেকে লক্ষ্মীনাথ দুঃসংবাদটা জানতে পারলেন। বাড়িতে শোক- মন খারাপের ছায়া নেমে এল। অন্তরাত্মায় বিচ্ছিন্নতার তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হল। কিন্তু আত্মিক এই বিয়োগের জন্য লক্ষ্মীনাথ মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। তথাপি মন মানতে চায় না, আত্মার বিয়োগ ব্যথাটা ক্ষণে ক্ষণে তীব্র হয়ে উঠে। মনের আকাশে ভেসে বেড়ায় পিতার চলা-ফেরা, কথা-বার্তা। মনে পড়ে তাকে নিয়ে পিতার ক্ষোভ বেদনার শাসন- অনুশাসন। অনুভব করেন ক্ষমাশীল পিতার স্নেহ-ভালোবাসা। তবে তিনি আর ইহ সংসারে নেই।তাঁর দেহটা ইতিমধ্যে মাজুলীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেছে।তাঁর বৈকুন্ঠবাসী আত্মা শান্তি লাভ করেছে।
তখন ডাক্তার গোলাপচন্দ্র বেজবরুয়া এস এস করমন্ডলে ছিলেন। লক্ষ্মীনাথ তাকে নিয়ে এলেন। বিধি অনুসরণ করে শিব সাগরে গিয়ে সব পুত্রকে একসঙ্গে পরলোকগত পিতার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে হবে। কিন্তু কিছুদিন আগে লক্ষ্মীনাথ অসম থেকে এসেছেন। এখনই আবার ফিরে গেলে ব্যবসার বিস্তর লোকসান হবে। এদিকে গর্ভবতী প্রজ্ঞার সন্তান প্রসবের দিন এগিয়ে আসছে।অন্যদিকে গোপালচন্দ্র খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করা মানুষ। পিতার শ্রাদ্ধে তাঁর উপস্থিতি বিঘ্ন ঘটাতে পারে । গোপালচন্দ্রের সঙ্গে এসব বিবেচনা করে অসমে না গিয়ে লক্ষ্মীনাথ কলকাতায় শ্রাদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
লক্ষ্মীনাথের শাশুড়ি মা খবরটা জানতে পারলেন। তিনি ঠাকুর বাড়ির সরকারের মাধ্যমে জামাতার পিতৃ শ্রাদ্ধের জন্য শ্রদ্ধা সহকারে ১০০ টাকা, হবিষ্যের সামগ্রী এবং লক্ষীনাথের জন্য ধুতি গামছা পাঠিয়ে দিলেন । শাশুড়ি মা পাঠানো টাকার সঙ্গে আরও একশ টাকা যোগ করে লক্ষ্মীনাথ গোবিন্দচন্দ্রের নামে শিব সাগরের ঠিকানায় টেলিগ্রাম মানি অর্ডার করলেন।
বি বরুয়া কোম্পানির কাঠের ব্যবসা বেড়েছে।অশৌচের দিন কয়টি বাড়িতে থেকে লেখালেখি করবেন বলে ভেবেছিলেন যদিও লক্ষ্মীনাথকে বাইরে বের হতে হল। গুণাভিরামের বিধবা কন্যা স্বর্ণ লতার সঙ্গে দেখা করে তাঁর বিয়ের কথা আলোচনা করলেন। তার মাঝখানেই নিমতলায় গিয়ে গিরিশচন্দ্র বসুর মধ্যস্থতায় কলকাতার রঙ্গলাল লক্ষ্মীনারায়ণ এবং ভিকরাজ বগলা অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে বি বরুয়া কোম্পানির ব্যবসায়িক একটা চুক্তিপত্র তৈরি করলেন। এদিকে প্রজ্ঞার মেজ দাদা ক্ষিতীন্দ্রনাথ জানাল যে পিতৃ বিয়োগের কথা জানতে পেরে 'কর্তামশাই' মানে ঋষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি বাড়ি থেকে বেরোতে পারেন না। লক্ষ্মীনাথ ক্ষিতীন্দ্রনাথের সঙ্গে কর্তামশাই থাকা বিজিতলা রোডের বাড়িতে এলেন। অন্যান্য দিনের মতো এবারও লক্ষ্মীনাথ তাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কর্তামশাই অশৌচ ব্রতে থাকা লক্ষ্মীনাথের প্রণাম গ্রহণ করলেন না । তিনি লক্ষ্মীনাথের পরলোকগত পিতার কথা বলে মৃতের বিদেহী আত্মার সদ্গতি কামনা করে পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালেন ।
পরিবেশটা শোক জনিত কারণে ভারী হয়ে পড়েছে লক্ষ্য করে কর্তামশাই তারপরে বললেন,' লক্ষ্মীনাথ ,বিয়ের পর প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি আমার কাছে আশীর্বাদ নিতে এসেছিলে, আশীর্বাদ করে তোমাকে একটি সোনার কলম উপহার দিয়ে কি বলেছিলুম, মনে পড়ে ?'
সেকি আর ভুলতে পারি ,কর্তামশাই?সবিনয়ে লক্ষ্মীনাথ বললেন,আপনার সেই উপহার তো আমার জীবনের অতুলনীয় এক সম্পদ,অফুরন্ত এক প্রেরণা ।'
' কিন্তু যা শুনতে পেলুম, তুমি এখন লক্ষ্মীর পেছনে ছুটছ। আসলে আমি তোমাকে যতটুকু চিনতে পেরেছি, তুমিতো বাপু সরস্বতীর সাধক। সেই সাধনায় বিঘ্ন ঘটছে নাকি?'
'কর্তামশাই আপনি তো জানেন, আমাদের এখানে জমিদারি বা অন্য কোনো আয়ের উপায় নেই। বিয়ের পরে সংসার যখন হয়েছে, অর্থ উপার্জনের জন্য লক্ষ্মী দেবীর পূজা তো করতেই হবে।'
'দেখ ভায়া, লক্ষীর সঙ্গে সরস্বতীর কিন্তু সর্বদাই ঝগড়া। সেই ঝগড়া সামলে চলতে পারাটা বড়ো শক্ত।'
' সেটা আমিও জানি। তবে আপনার আশীর্বাদে তার মধ্যেই আমি সরস্বতীর সাধনা করে চলেছি।'
ঋষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতার্থেই একজন উদারমনা জ্ঞানী পুরুষ। যখনই তাঁর সান্নিধ্যে আসে, ক্ষণিকের জন্য কথাবার্তা হয় যদিও তাঁর প্রতিটি কথাই লক্ষ্মীনাথের কাছে অনুপ্রেরণামূলক। তিনি লক্ষীনাথের চেতনায় থাকা সাংস্কৃতিক বোধটাকে উৎসাহিত করে তোলেন। এমনিতেও এটা সত্যি যে কাঠের ব্যবসায় যোগ দিয়ে ভোলানাথ করতে দেওয়া কাজের চাপে লক্ষ্মীনাথ এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে বাড়িতে ফিরে আগের মতো বই পড়া এবং লেখালেখির কাজে মগ্ন হতে পারেন না। এটা তাঁর সৃষ্টি সত্তাটা বিকাশ করার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কথাটা মিথ্যা নয়। কর্তামশাইয়ের সতর্কবাণীতে লক্ষ্মীনাথ সচেতন হলেন। পুনরায় আগের মতো লেখালেখির কাজে লেগে পড়বেন বলে শপথ নিলেন।
৬ জুন গোপীকৃষ্ণ পাল লেনের বাড়িতে বিধি অনুসরণ করে শ্রাদ্ধের আয়োজন করে লক্ষ্মীনাথ পিতৃবিয়োগের অশৌচ থেকে মুক্ত হলেন।
শ্রাদ্ধের পরে একনাগরে তিন দিন পরিশ্রম করে ' অসমীয়া ভাষা' প্রবন্ধটি শেষ করলেন। মাঝখানে একদিন দাদা গোলাপ চন্দ্রের সঙ্গে মিনার্ভায় গিয়ে থিয়েটার দেখলেন। তারপরে প্রসবকাল এগিয়ে আসায় প্রজ্ঞাকে জোড়াসাঁকোতে রেখে ব্যবসায়ের কাজ নিয়ে ভোলানাথের সঙ্গে আসানসোলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
আসানসোলে একদিন থেকে পরের দিন মনোহরপুরে এলেন। কিন্তু সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার ফলে বাইরে বেরোতে পারলেন না। হোটেলে থেকে 'লাইফ অফ কুইন ভিক্টোরিয়া' পড়লেন। পরদিনও ধারাসার বৃষ্টি। কয়েকটি ব্যবসায়িক পত্র লেখা ছাড়া অন্য কোনো কাজই হল না। মনোহরপুরের এক বেলার কাজ শেষ করে চক্রধরপুরে গেলেন। রাত একটার সময় উজানমুখী মেইল ট্রেনে নাগপুর যাত্রা করলেন। পরের দিন বিকেলে নাগপুরে এসে পৌঁছলেন। নাগপুরে থাকতেই লক্ষ্মীনাথ খবর পেলেন যে প্রজ্ঞা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে( ২৬ জুন বুধবার, ১৮৯৫)। তৎক্ষণাৎ লক্ষ্মীনাথের মানসপটে অপূর্ব সুন্দরী দেবকন্যার একটি মুখ ভেসে উঠল। মনটি কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশ্যে ভেসে চলল । শিশু কন্যাটিকে দেখতে ইচ্ছে হল। কিন্তু সঙ্গে রয়েছে ভোলানাথ বরুয়া। এরকম একটি ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভোলানাথের ধমক খেতে হবে ভেবে লক্ষ্মীনাথ চুপ করে রইলেন।
ব্যবসায়ের কাজে একনাগাড়ে ২৫ দিন বাইরে থেকে কলকাতায় ফিরে এলেন। প্রজ্ঞা একটি শিশুকন্যা উপহার দিল। ঠাকুরবাড়ি এসে পিতৃত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত লক্ষ্মীনাথ সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন । পদ্মের পাপড়ির মতো স্বর্গীয় এক আভায় শিশু কন্যাটিকে নিয়ে ঠাকুরবাড়ির সবাই আনন্দিত হয়ে উঠেছে। শ্বশুর বাড়িতে আত্মীয় কুটুম্বের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের দিন চারেক থাকার ইচ্ছা। কিন্তু ভোলানাথ ডেকে পাঠাল। এমনি তো ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে এবং ব্যবসার টাকা পয়সা লেনদেন গুলি লক্ষীনাথের মাধ্যমে হয়। তাই শ্বশুর বাড়িতে থেকে আনন্দ করার উপায় নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গোপিকৃষ্ণ লেনের বাড়িতে এলেন।
ব্যবসায়ের কাজ ছাড়া মনে মনে সংকল্প করা অনুসরণ করে অধ্যয়ন এবং সাহিত্য সাধনার কাজও অব্যাহত রেখেছেন। ইতিমধ্যে লেখা 'অসমীয়া ভাষা' শীর্ষক প্রবন্ধটি
অ.ভা.উ.সা সভায় পাঠ করলেন এবং সদস্যদের দ্বারা প্রবন্ধটি উচ্চ প্রশংসিত হল। তারপরে প্রবন্ধটি ' জোনাকী'তে খন্ড খন্ড করে প্রকাশ পেতে লাগল। কিছুদিন আগে 'স্বর্গারোহণ' নামে একটি গল্প লিখেছিলেন । সাম্প্রতিক বিষয়ের ওপরে ছদ্মনামে লেখা রম্য রচনা 'কৃপাবর বরুয়ার কাগজের পুঁটলি' শীর্ষ লেখাগুলি লিখছেন।
সকালে নিজের পড়ার ঘরে বসে ' কাগজের পুটুলি' শীর্ষক লেখাগুলির একটি লেখা শুরু করেছেন, তখনই ভোজপুরি দারোয়ান এসে বলল,' বাবু একঠো লেড়কা আপকো সালাম করনা মাঙতা–।'
'একঠো লেড়কা ! বোলাও উনকো!'
কিছুক্ষণ পরেই ধীরে ধীরে সন্ত্রস্ত পদক্ষেপে সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করল, উনিশ-কুড়ি বছর বয়সের এক যুবক। মাথা তুলে যুবকটির দিকে তাকিয়েই লক্ষ্মীনাথ চিনতে পারল,' তুমি– লক্ষ্মীমপুরের কুশল দুয়ারা। সেই অসম থেকে কলকাতা আসার সময় স্টিমারে তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।'
এগিয়ে এসে কুশল লক্ষ্মীনাথের পা ছুঁয়ে সেবা করে বলল,' স্যার আপনি তাহলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পেরেছেন। আমি আরও ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো এত দিনে আমাকে ভুলেই গেছেন।'
' অসমিয়া অসমের ছেলেকে ভুলে গেলে কীভাবে হবে, বলতো? তারপরে খবর কি? কোন কলেজে নাম লেখালে?'
' সিটি কলেজে।'
' আমিও সেই কলেজে পড়েছিলাম। কোথায় থাক?'
' ৫৩ কলেজ স্ট্রিটের একটি মেসে।'
' বাঃ তোমার সঙ্গে আমার অনেক মিল দেখছি! আমিও কলেজ স্ট্রিটের সেই মেসটিতে ছিলাম।' লক্ষ্মীনাথ উচ্ছসিত হয়ে পড়লেন,' মেসে কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি?'
কুশলের মুখে মন খারাপের একটা কালো ছায়া নেমে এল।
' স্যার আপনাকে যে বলেছিলাম– খুবই কম টাকা নিয়ে আমি কলকাতায় এসেছিলাম। এতদিনে টাকা শেষ হয়ে গেছে। গত মাসের মেসের খরচ দিতে পারিনি। সঙ্গীরা মেসের মালিককে অনুরোধ করায় এই মাসটা আমাকে থাকতে দিয়েছে। এরপরে আমাকে বের করে দেবে। তাহলে পরীক্ষা না দিয়েই আমাকে বাড়ি চলে যেতে হবে।'
লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। করুণভাবে কুশলের শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
' স্যার আপনার কাছে আমি টাকা পয়সা চাইতে আসিনি। কণ্ঠস্বর যদিও করুণ কুশল স্পষ্টভাবে বলল,' আমি খবর পেয়েছি, আপনি আমাদের অসমের ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে যুক্ত ভাবে কাঠের ব্যবসা করেন। আপনাদের বিজনেসটা বড়ো। এই বিজনেসে কয়েকজন কর্মচারী কাজ করে। আপনাদের বিজনেসে আমার করার মতো যদি কোনো কাজের সুযোগ করে দেন–।'
' তারমানে চাকরি! পড়াশোনা করতে এসে পড়া বাদ দিয়ে চাকরি করবে!'
' চাকরি করব। সঙ্গে পড়াশোনা করব। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্যই চাকরি করব।'
'বাঃ সুন্দর! তোমার এই স্পিরিটটা ভালো লাগল। তবে আমাদের এই বিজনেসে তোমার পক্ষে কাজ করাটা কষ্টকর হবে। তবু এত করে বলছ যখন কলেজের ছুটির দিনগুলি, শনিবার বিকেল বেলা এবং রবিবার গুলি তুমি আমাকে সাহায্য করতে পার।'
' হবে, আমি আসব।'বড়ো কিছু একটা পাওয়ার আনন্দে কুশলের মুখে হাসি ফুটে উঠল,'স্যার, আপনি তো জানেনই– আমাদের অসমে একটা কলেজ স্থাপন করার জন্য যে লেখালেখি চলছিল, কলেজটা নাকি হবে না।'
' ব্যবসায়ের কাজের জন্য মাঝখানে আমি একমাস বাইরে ছিলাম। অসমে কী হচ্ছে না হচ্ছে খবরই পাইনি। তবে আমি তো গুয়াহাটিতে কলেজ হবে বলেই শুনেছিলাম।'
' হবে না।অসমে নতুন করে নিযুক্ত কমিশনার সাহেব নাকি এই বলে রিপোর্ট দিয়েছে যে এখন কলেজ স্থাপনের কোনো আবশ্যকতা নেই।'
' তুমি কার কাছ থেকে জানতে পারলে?'
' গত সপ্তাহ থেকে আমাদের মেসের সিনিয়র ছাত্রদের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা চলছে।'
' না না, অসমে একটা কলেজ লাগবেই। আচ্ছা আমি খবর নেব। তুমি আগামী সপ্তাহ থেকে আসবে–।'
কুশল বেরিয়ে যাবার পরে লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে পড়লেন। গুয়াহাটিতে একটি সরকারি কলেজ স্থাপন করা হলে অসমের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য কলকাতা আসতে হবে না। দুঃখী ছাত্ররা কলেজের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। সেটাতে কী এমন অসুবিধা হল যে নব নিযুক্ত কমিশনার সাহেব অসমে কলেজ স্থাপন করতে হবে না বলে প্রতিবেদন দিলেন? লক্ষ্মীনাথ তক্ষুনি গুয়াহাটির চীফ কমিশনার অফিসে কর্মরত বন্ধু হেমচন্দ্র গোস্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
অ.ভা.উ.সা সভার যে কয়েকজন মাতৃভাষার জন্য নিবেদিত প্রাণ' জোনাকী' প্রকাশের ভেতরে বাইরে থেকে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের সাধনা আরম্ভ করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম পুরোধা ছিল হেমচন্দ্র গোস্বামী।এখনও সে লক্ষ্মীনাথের কাছে আদরের 'গোঁসাই'। কোমল সুরে কথা বলা, সাহিত্য এবং জাতির ইতিহাসের প্রতি অনুরাগ থাকা, পরিশ্রমী হেমচন্দ্র 'জোনাকী' প্রকাশনার জন্য উদয়াস্ত শ্রম করার জন্যই বি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।অবশেষে বি এ ডিগ্রী না নিয়েই সে অসমে ফিরে গিয়ে একটি প্রাইভেট স্কুলের হেডমাস্টার হয়েছিল।কিন্তু স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সোনারাম উকিলের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ইস্তফা দিয়ে হেমচন্দ্র অসমের ইতিহাস লিখতে আরম্ভ করা কৃষি এবং রাজস্ব বিভাগের অফিসার এবং জাতি তত্ত্ব বিভাগেরই ডাইরেক্টর এডওয়ার্ড গেইটের সঙ্গে দেখা করে। তিনি সংগ্রহ করা ১৭ টি ইতিহাসের এগারোটি অসমিয়া ভাষায় ।গেইটে হেমচন্দ্রকে এই এগারোটি ইতিহাস ইংরেজিতে অনুবাদ করার দায়িত্ব দিলেন। হেমচন্দ্র দক্ষতার সঙ্গে সেগুলি অনুবাদ করে নির্দিষ্ট তারিখের ভেতরে জমা দেয় এবং তার জন্য ৯০ টাকা পারিতোষিক পায় ।
হেমচন্দ্র যে ভাষা সাহিত্যের অনুরাগী ,তাঁর নির্ভুল অনুবাদ এবং মুক্তোর মতো হস্তলিপি দেখে এডওয়ার্ড গেইট এবং অন্যান্য ইংরেজ অফিসাররা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন । তারপরই চীফ কমিশনার অফিসে ৭৫ টাকা বেতনে তাকে কাজ করার সুযোগ দান করেন ।
হেমচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে লক্ষ্মীনাথ জানতে পারল, হ্যাঁ কুশল ঠিকই বলেছে। কলেজ প্রতিষ্ঠা করার বিপক্ষে রিপোর্ট দেওয়াটা অসমের জন্য, একটি বড়ো প্রবঞ্চনা। প্রয়োজনীয় তথ্যের সঙ্গে কমিশনারের রিপোর্টের প্রতিলিপি সংগ্রহ করে লক্ষ্মীনাথ আর ও বেশি অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি অ.ভা.উ.সা সভার সম্পাদককে সভা আহবান করতে বললেন।
তখনই সভা আহবান করা হল। সভার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই উপস্থিত সদস্যদের সামনে লক্ষ্মীনাথ নিজের বক্তব্য তুলে ধরলেন–' শ্রদ্ধাভাজন সভাপতি মহোদয় এবং উপস্থিত মাননীয় সদস্যরা, আপনারা জানেন যে ১৮২৬ সনে ব্রিটিশ রাজশক্তি অসমের শাসনভার নিয়ে অসমিয়া বাংলা ভাষার উপভাষা বলে ১৮৩৬ সনে অসমের স্কুল কাছারিতে বাংলা ভাষা প্রবর্তন করে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের গলা চেপে ধরেছিল। তখন আমাদের জাতিটার এতই শোচনীয় অবস্থা ছিল যে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সেই অন্যায় নীতি উঠিয়ে নেবার জন্য আমাদের কেউ সাধারণভাবে কোনো আবেদন নিবেদন ও করেনি। তারপরে আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা কীভাবে পুনরায় অসমিয়া ভাষা প্রবর্তন করল, আপনারা জানেন। তারপরেও কোনো কোনো বঙ্গভাষী আমাদের ভাষার স্বতন্ত্রতার উপরে প্রশ্ন তুলে আক্রমণ করে থাকে। আমরা সেসবের প্রতিবাদ করেছি বা ' অকাজের কথা' বলে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এবারের কথাটা উড়িয়ে দেবার মতো সাধারণ লোকের কাছ থেকে আসেনি। কথাটা অসম প্রদেশের রাজধানী শিলং পর্বতের চৃড়ায় বসবাস করা আমাদের রাজার সোনা রুপোর মুখ থেকে বেরিয়েছে । মিস্টার হেনরি কটন সাহেব আমাদের উঠে আসা যুবকদের গায়ে দোষ দিয়ে বলেছেন যে তারা অসমকে নিঃসঙ্গ করার চেষ্টা করে অসমের উন্নতির পথে বাধার সৃষ্টি করছে ।'
'বেজবরুয়া মহাশয় আপনার বাক্যগুলি রসাল।' বয়োজ্যেষ্ঠ করুণা গোহাঁই বললেন,' তথাপি বলছি –আমাকে ক্ষমা করবেন , ভূমিকা দীর্ঘ হয়েছে ,অনুগ্রহ করে মূল কথাটিতে আসুন।'
লক্ষ্মীনাথ গম্ভীর ভাবে বললেন,' মূল কথাটি হল, সম্প্রতি নিযুক্ত হওয়া অসমের কমিশনার হেনরি কটন সাহেব অসমের ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন । ইতিমধ্যে একটা নির্দেশের মাধ্যমে সরকার গুয়াহাটি থেকে এফ এ শ্রেণিটা তুলে দিয়েছে। এখন প্রস্তাবিত কলেজটি গুয়াহাটিতে স্থাপন করতে হবে না বলে সাহেব অভিমত ব্যক্ত করেছেন।'
পেছন থেকে একজন যুবক সদস্য উঠে বলল,' কটন সাহেবের রিপোর্টটা পড়ে দিন।'
' গোটা রিপোর্টটা পড়তে সময় লাগবে। আমি রিপোর্টের বিশেষ অংশটুকু আপনাদের সামনে পাঠ করব। আপনারা শুনুন, কটন সাহেব এক জায়গায় লিখেছেন–'I am not anxious to give any encouragement to the feeling of provincialism which I find to be unfortunately too ripe in the Assam valley districts and would rather impress upon the educated Assamese of the present generation that they can't be independent of Bengal in their language or association .They are dependent of Bengal as Welshmen are dependent on English.And I attribute the slowness of its progress in large measure to the unwise feeling by the Assamese among themselves of a policy of national exclusiveness ….'
লক্ষীনাথ থামলেন।
সামনে বসে থাকা সদস্যদের চোখ মুখে ক্ষোভ উত্তেজনা ফুটে উঠল।
সিটি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রুদ্র বরুয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত । জোর প্রতিবাদ করা দরকার ।'
' প্রতিবাদ করব। প্রতিবাদ করতেই হবে। পরিকল্পিতভাবে প্রতিবাদ করার জন্যই এই সভার আহবান করা হয়েছে। কিন্তু তার আগে কথাগুলি ভালোভাবে বুঝে নিন।' লক্ষ্মীনাথ বলতে লাগলেন, উক্ত স্তবকটিতে অসমিয়ার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথমটি হল'to give any encouragement to the feeling of provincialism', অর্থাৎ গুয়াহাটিতে একটি কলেজ স্থাপন করলে আঞ্চলিকতাবাদকে উৎসাহ দেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত,'they cannot be independent of Bengal in their language'. অর্থাৎ 'দে' মানে অসমিয়ারা ভাষার ক্ষেত্রে বঙ্গের চেয়ে স্বতন্ত্র হতে পারে না। তৃতীয়ত,' They are dependent of Bengal as Welshmen are dependent on English.' তার মানে ওয়েলসের মানুষ যেমন ইংরেজদের উপরে নির্ভরশীল ঠিক একই ভাবে অসমিয়ারা বাঙালিদের উপর নির্ভরশীল। বাঙালিদের গায়ে ভর না দিয়ে সোজাভাবে দাঁড়ানো সম্ভব নয় ।'
শ্রোতাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ল। রুদ্র বরুয়া পুনরায় বলে উঠল –' না প্রতিবাদ পাওয়া দরকার । খুব শীঘ্রই প্রতিবাদ করা দরকার ।'
এই রিপোর্টটা পড়ে আমার এরকম ধারণা হয়েছিল যে কটন সাহেবের অধীনে কাজ করা কোনো বাঙালি কেরানি উচ্চশিক্ষা বিষয়ের নোটটা লিখে অন্যান্য চিঠিপত্রের সঙ্গে সই করার জন্য তার কাছে রেখে দিয়েছিল এবং তিনি মানে এইচ জে এ কটন সাহেব একের পর এক সই করে থাকার সময় সেই নোটটিতেও সই করে দিয়েছেন। কিন্তু কটন সাহেবের জানা উচিত, তিনি যাকে প্রভিনসিয়ালিজম বলেছেন অসমিয়ারা তাকে পেট্রিয়টিজম বলে । তিনি যাকে সংকীর্ণতা বলেছেন অসমিয়রা তাকে আত্মমর্যাদা আত্ম গৌরব এবং মাতৃভূমির প্রতি নিবিড় ভালোবাসা বলে । তারপর কটন সাহেব বলেছেন যে আমাদের অসমিয়া ভাষা কখনও স্বতন্ত্র হতে পারে না। কিন্তু কটন সাহেবের জানা উচিত যে অসমিয়া একটি স্বতন্ত্র ভাষা ,বাংলার অপভ্রংশ নয়। আর এই কথা সরকার ইতিমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। অসমে অসমিয়া ভাষার বিজয়দুন্দুভি বেজে উঠেছে , অসমিয়া ভাষার সৌরভ ধুবড়ি থেকে সদিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, অসমিয়া ভাষার উন্নতি সাধিনী সভা গুলির পবিত্র মন্দিরের নিশানে' অসমিয়া ভাষার জয়'এর নিশান আনন্দে উড়তে শুরু করেছে। তৃতীয় অভিযোগটা হল–।'
লক্ষ্মীনাথ থামলেন। ক্ষণিকের জন্য চুপ করে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে পুনরায় বলতে লাগলেন,' ইংরেজ চীফ কমিশনার কটন সাহেবের মুখ থেকে নির্গত হয়েছে যে ওয়েলসমেনের রাজার জাতি ইংরেজের যে সম্পর্ক অসমিয়ার সঙ্গে বাঙালির সেই সম্পর্ক! এটা আবার কী ধরনের কথা! ইংরেজরা ওয়েলসের রাজা , ইংরেজি রাজ ভাষা , ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ভাষা । ওয়লসের কোনো সদস্য পার্লামেন্টে নিজের এলাকার দুঃখ দুর্দশা, অভাব অভিযোগের কথা বলার জন্য ইংরেজিতে বলতে হবে। ওয়েলস মেনে জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য স্পেলিং বুক থেকে আরম্ভ করে জনসন,বার্ক, হান্সলে,টিন্ডল, হাবার্ট স্পেন্সারের ইংরেজি ভাষার বই পড়তে হবে । ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি ও ইংরেজি ভাষার সাহায্য না নিয়ে করতে পারেনা। এরকম ভাষা এবং এরকম একটি জাতির সঙ্গে কটন সাহেব অসমিয়া এবং বাঙালির সঙ্গে তুলনা করছেন !
কিন্তু এখানে কটন সাহেবকে জিজ্ঞেস করছি – অসমিয়ারা বাংলা না শিখলে বাংলার কোন পার্লামেন্টে নিজের দেশের দুঃখ দূর্গতির জন্য কথা বলতে না পেরে বোবা হয়ে থাকতে হবে ? কটন সাহেবের কাছ থেকে জানতে ইচ্ছে করে , বাংলা না জানার জন্য কোন বড়ো ব্যবসায়ী ধনী মহাজনের সঙ্গে অসমিয়া মনের ভাব প্রকাশ করতে না পেরে ব্যবসায় লোকসান করতে হবে । প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে অসমিয়ারা বাংলা না জানার জন্য অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, ব্রাজিল ,ইত্যাদি কোন দেশ থেকে বিফল মনোরথ হয়ে চলে আসতে হবে? বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ না করে ইংরেজি শিক্ষিত অসমিয়া কোন প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাতে না পেরে চিরকাল মূর্খ হয়ে থাকবে?'
লক্ষ্মীনাথের শ্লেষপূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সদস্যরা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল। তারা বুঝতে পারলেন যে চীফ কমিশনার কটন সাহেবের রিপোর্টটির কোন মূল্য নেই এবং এটি কাঁচা ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা। সঙ্গে ভয় শঙ্কা কাটিয়ে উঠে প্রত্যেকেই আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করলেন যে উক্ত রিপোর্টটির প্রতিবাদ হতেই হবে।
সভায় উপবিষ্ট বয়োজ্যেষ্ঠ করুণা গোহাঁই এতক্ষণ আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের তেজোদীপ্ত ভাষণ শুনছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,' মাননীয় বেজবরুয়া মহাশয়, আপনার বক্তৃতার ভাব-ভাষা আপনার বিশ্লেষণ শক্তি, স্বদেশ স্বজাতির প্রতি আপনার দায়িত্ববোধের তুলনা হয় না। বক্তৃতার শুরুতে আপনি বললেন, বাংলা ভাষা প্রবর্তন করায় আমাদের তখনকার বড়ো মানুষ কোনো প্রতিবাদ করেনি। সেটা যে আমাদের জাতির অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় তা দ্বিতীয়বার বলার প্রয়োজন রাখে না । কিন্তু আজ অসমিয়াদের মনে নতুন এক চেতনার সৃষ্টি হয়েছে । এখন অসমিয়া আপনার মতো পুরুষের নেতৃত্বে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছে । ইংরেজের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হতেই হবে। তার জন্য আপনাকেই নেতৃত্বের ভার নিতে হবে।'
' কিন্তু প্রতিবাদ জানানোর পদ্ধতিটা কী হবে ?'
করুণা গোহাঁই বললেন,' আপনার হাতে কটন সাহেবের রিপোর্টটা রয়েছে যখন আপনি তার প্রতিবাদ লিখুন । সমস্ত কথা বিস্তৃতভাবে লিখে পুস্তিকার আকারে ছাপানোর বন্দোবস্ত করুন। তারপরে আমরা অ.ভা.উ.সা সভার তরফ থেকে সরকার এবং সরকারি শাসন বিভাগে অধিষ্ঠিত সমস্ত অফিসারকে পাঠিয়ে দেব ।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন