হে আমার স্বদেশ- ১৯
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(১৯)
মা এত চিঠিপত্র লেখে না। অসুস্থতার কথা লিখে মা যখন চিঠি পাঠিয়েছে তখন বাবার অবস্থা নিতান্ত গুরুতর । চলাফেরায় অসমর্থ হয়ে বাবা নিশ্চয় বিছানা নিয়েছে। অসুস্থ বাবার বিছানায় পড়ে থাকা দৃশ্যটা কল্পনায় ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।
কিছুদিন আগে প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে শিবসাগরে গিয়ে বাবার ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখেই লক্ষ্মীনাথের অন্তর কেঁদে উঠেছিল। সেরকম অসুস্থ অবস্থায় প্রজ্ঞা আঁকা তৈলচিত্রটায় নিজের প্রতিকৃতিটার দিকে তাকিয়ে এবং উপহারের চিহ্নস্বরূপ বহুমূল্য বেনারসি পাটের ধুতিটা হাতে নিয়ে বাবা বড় আনন্দিত হয়েছিল। সন্তুষ্ট মনে কাঁপা কাঁপা হাতে বৌমা প্রজ্ঞাকে আশীর্বাদ করেছিল। তারপরে অসুস্থ শরীরেই স্নান করে উঠে পাটের বেনারসি ধুতিটা আনন্দের সঙ্গে পরে গোঁসাইঘরে নাম প্রসঙ্গ করতে বসেছিল। জাতির বিচার না মানা ম্লেচ্ছ ব্রিটিশের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করা ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত ঠাকুরবাড়ির মানুষদের প্রতি বাবার ধারণা ভালো ছিল না। ঠাকুর বাড়ির কন্যাকে বিবাহ করার জন্য ত্যজ্যপুত্র করে দীর্ঘদিন লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। তার জন্য লক্ষ্মীনাথের মনে বাবার প্রতি ক্ষোভ অভিমান সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বৌমা প্রজ্ঞাকে এভাবে আদর করে বরণ করে নেবার জন্য বাবার প্রতি থাকা লক্ষ্মীনাথের সমস্ত ক্ষোভ অভিমান নাই হয়ে গিয়েছিল। বাবার অন্তরের স্নেহ ভালোবাসা অনুভব করে লক্ষ্মীনাথের তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল।
মায়ের চিঠিটা পড়ার পরে লক্ষ্ণীনাথ অস্থির হয়ে পড়ল। তৎক্ষণাৎ স্থির করল না, অসমে যেতেই হবে। কিন্তু এখন আর আগের মতো করে যাব বলে ভাবলেই যাওয়া যায় না।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভোলানাথ বরুয়ার সঙ্গে কলকাতার শোভারাম বসাক লেনে ছিল। কাঠের ব্যবসা বেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে থাকা লোকের সংখ্যা বাড়ল। ভাড়ায় নেওয়া শোভা রাম বসাক লেনের ঘরটা ছোটো বলে মনে হতে লাগল। তার জন্য তারা ১৪ নাম্বার গোপীকৃষ্ণ লেনের বড় একটি ঘর ভাড়ায় নিল। এই ঘরটা রাজপথের কাছে, দোতলা। ঘরটার পৃথক পৃথক দুটি ভাগ। রাজপথের দিকে ভোলানাথ থাকতে লাগল। ভেতরের দিকে প্রজ্ঞাকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ সংসার পাতল। আগে ভাড়া ঘর নিলেও প্রজ্ঞা বছরের অধিকাংশ সময় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে মায়ের কাছে ছিল। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে সে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গেই থাকছে।
ভোলানাথের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা এবং লক্ষীনাথের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কলকাতার প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কাঠের ব্যবসাটা দাঁড়াতে শুরু করেছে। অবশ্য তার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। কলকাতা মহানগর ছাড়াও ঠিকা লাভ করার জন্য আসানসোল, শিবপুর,ঝাড়চোগোড়া, সম্বলপুর, নাগপুরে যেতে হবে। এইসব ছেড়ে তৎক্ষণাৎ অসমে রওয়ানা হওয়াটা সম্ভব নয়। তাছাড়া এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েও অসমে রওয়ানা হওয়াটা উচিত হবে না। লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথকে বাবার অসুস্থতার কথা জানাল। লক্ষ্মীনাথ অসমে রওনা হওয়া মানেই অন্ততপক্ষে দুটো সপ্তাহ ব্যবসায়ের প্রধান কাজ বন্ধ থাকবে। তার জন্য অনেক টাকা লোকশান হবে। তবে লক্ষ্মীনাথের অশীতিপর বৃদ্ধ পিতা যখন শয্যাগত, তখন আর কোনো উপায় নেই। কোনো উপায় না পেয়ে ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথকে যাবার অনুমতি দিল। কিন্তু অনুমতি পাওয়ার দিনেই বের হতে পারল না। কারণ আট মাসের গর্ভবতী প্রজ্ঞাকে এখানে এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া যায় না । পরের দিন সকালে একটা গাড়ি ডাকিয়ে এনে প্রজ্ঞাকে শাশুড়ি মায়ের কাছে রেখে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেইলে লক্ষ্মীনাথ অসমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা দার্জিলিং মেইল অসম পর্যন্ত যায় না। শিয়ালদহ থেকে যাত্রাপুর, যাত্রাপুর থেকে বাষ্প চালিত জাহাজে অসমে। হঠাৎ যাত্রা করার জন্য লক্ষ্মীনাথ জাহাজের দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট পেল না। বাধ্য হয়ে ৩৭ টাকার প্রথম শ্রেণির টিকিট নিয়ে কোকিলা মুখের দিকে যাত্রা করল। পরের দিন সকালে গোয়ালপাড়া পৌঁছাল। প্রথম শ্রেণীতে সহযাত্রী রূপে পেল পিটার নামে একজন সাহেবকে। তার সঙ্গে ভালোভাবে কাটল এবং আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে লক্ষ্মীনাথকে তিনি পানীয় সহযোগে আপ্যায়ন করলেন। বিকেলে কোকিলা মুখে পৌঁছানোর পরে যোরহাটে থাকা মেজ দাদা গোবিন্দচন্দ্রের টেলিগ্রাম পেল। তিনি লক্ষ্মীনাথকে যোরহাটে নামতে নিষেধ করে শিবসাগরে যেতে বলার জন্য পুনরায় তিন টাকা দিয়ে দিসাংমুখ পর্যন্ত টিকিট কাটল। সকাল দশটার সময় দিসাংমুখ পৌঁছে বিনন্দ দাদার সঙ্গে দেখা হল। তারপর দুজনে হাতিতে করে দুপুর একটার সময় শিবসাগর পৌঁছাল।
বাড়ি পৌঁছেই মা ঠানেশ্বরীর মুখোমুখি হল। হাতের ব্যাগটা রেখে মাকে প্রণাম জানিয়ে লক্ষ্মীনাথ বাবার ঘরে প্রবেশ করল।
দীননাথ বেজবরুয়া মহাশয়। সুদূর কান্বকুব্জ থেকে অসমে আগত কলিবর বরুয়ার যোগ্য উত্তর পুরুষ। আহোম স্বর্গদেবদের শেষ রাজা পুরন্দর সিংহের রাজ বৈদ্য। আয়ুর্বেদশাস্ত্রের সুপন্ডিত, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ। শুধু তাই নয়, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের সঙ্গে তিনি মহাপুরুষ শঙ্করদেবের এক শরণ বৈষ্ণব অমৃত সুধার একনিষ্ঠ পূজারী। সেই ভাব- আদর্শেই তিনি ব্যবহারিক জীবনটাকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালিত করেছেন। তার কাছ থেকেই লক্ষ্মীনাথ বৈষ্ণব আচার- সংস্কারে নিজের জীবনের চারিত্রিক ভিতটা গড়ে তুলেছেন। সেই জন্য বেজবরুয়া মহাশয় নিজের ধর্ম সংস্কৃতি নিয়ে অন্ধ নয়। তিনি কালের প্রবাহকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। দেশাধিকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইংরেজি ভাষা শিখেছিলেন এবং ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা হাকিমের পদে নিযুক্ত হয়ে অসমের বিভিন্ন জেলায় দক্ষতার সঙ্গে চাকরি করেছিলেন।
হাকিমের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে কর্মোদ্যোগী পুরুষ বসে থাকেন নি। বাড়িতেই আয়ুর্বেদ চর্চার সঙ্গে শিবসাগরের সামাজিক -সাংস্কৃতিক জগতে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আজ, বয়সের সঙ্গে অসুখ-বিসুখ কাবু করে ফেলা দীননাথ বেজবরুয়ার অবস্থা একেবারে জীর্ণ-শীর্ণ, খুবই শোচনীয়।
বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় অস্থি -কঙ্কাল সার বাবার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের অন্তরটা ভেঙ্গে পড়ল। তার দুচোখ দিয়ে টপ টপ করে জল ঝরে পড়ল। আবেগ মথিত কন্ঠে 'বাবা' বলে আওয়াজ দিয়ে দীননাথ বেজবরুয়ার শুকনো- শীর্ণ পা দুটি স্পর্শ করে প্রণাম করার জন্য এগিয়ে এল।
কণ্ঠস্বর শুনেই দীননাথ বুঝতে পারলেন যে কলকাতা থেকে তাঁর পুত্র 'লখী' এসেছে। বয়স এবং অসুখ বিসুখ দুর্বল করে ফেললেও তাঁর চেতনা বোধ ঠিকই আছে। পুত্র প্রণাম করতে যেতেই ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,–' আমি বিছানায় পড়ে আছি, লখী। বিছানায় পড়ে থাকা মানুষকে প্রণাম করতে নেই।'
তিনি ওঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিছানা থেকে উঠে বসার শক্তি তার নেই। ঠানেশ্বরী এগিয়ে এলেন। দুই হাতে ধরে বেজবরুয়াকে উঠিয়ে বসিয়ে দিলেন। বিছানায় বসে গায়ে দেওয়া কাপড়টা মুড়ে নিয়ে ছেলের মাথায় ডান হাত রেখে প্রণাম গ্রহণ করে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বললেন–' একা এসেছিস।'
' হ্যাঁ ,বাবা।'
' বৌমা?'
লক্ষ্মীনাথ অসহায় ভাবে মা ঠানেশ্বরীর দিকে তাকাল।
ঠানেশ্বরী বলল,' বৌমা অন্তঃসত্ত্বা। আট মাস। বৌমাকে মায়ের কাছে রেখে লখী আপনাকে দেখতে এসেছে।'
'ও'। নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে দীননাথ স্নেহ মাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,' বৌমার শরীরটা ভালো আছে তো?'
' হ্যাঁ, ভালোই আছে।'
লক্ষ্মীনাথ বাড়ি এসেছে শুনে অসুস্থ দেহ নিয়ে রবিনাথ দাদা এল। যোরহাট থেকে গোবিন্দচন্দ্র এবং বিনন্দচন্দ্রও এল। নিজেদের সমস্ত আত্মীয়, অনেকদিন পরে সবাই একত্রিত হল যদিও দীননাথের অসুস্থতার জন্য জন্য কারও মনে শান্তি নেই। সবাই বিমর্ষ, সবাই বুঝতে পারল বিছানায় পড়ে থাকা এটাই বাবার অন্তিম কাল। কিন্তু পরম আত্মীয়ের বিষয়ে এরকম কথা উচ্চারণ করা যায় না । এদিকে দাদু যদিও দীননাথের চেয়ে ছোটো, শৈশবে লক্ষ্মীনাথকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া শ্রীরবিনাথ সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু বৈদ্যশাস্ত্রে পারদর্শী , তার চিকিৎসায় অনেকেই আরোগ্য লাভ করা এমনকি অনেকে তার কাছ থেকে কবিরাজি শিক্ষা গ্রহণ করে সংসার প্রতিপালন করা দীননাথের স্বাস্থ্য দিন দিন শোচনীয় হতে লাগল। অসুস্থতার খবর শুনে আত্মীয়রা, শিব ঠাকুরের বয়োজ্যেষ্ঠরা তাকে দেখতে এসেছে। এমনকি মাজুলীর কমলাবারী সত্র থেকে গোস্বামীও এসে তাকে দেখে গেল ।
দুদিন থেকে গোবিন্দচন্দ্র এবং বিনন্দ চন্দ্র যোরহাটে চলে গেল। বাবার অন্তিম কালে লক্ষীনাথের শিবসাগরে থাকার ইচ্ছা। ঠিক এই সময় কলকাতা থেকে ভোলানাথ বরুয়ার একটি জরুরী টেলিগ্রাম এল।
টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে মন খারাপ করে ভারাক্রান্ত লক্ষ্মীনাথ বাবার ঘরে প্রবেশ করল।
সারাটা দিন বিছানায় পড়ে থাকলেও সকালের দিকে দীননাথ একটু ভালো থাকেন। হাঁটুতে জোর নেই, দাঁড়ালেই মাথা ঘুরতে থাকে। তবু লাঠিটা নিয়ে মনের জোরে ঘরের ভেতরে ধীরে ধীরে কিছুক্ষণ হাঁটেন। আজও সেভাবে হেঁটে বিছানায় বসে দুধ- জল খাচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঠানেশ্বরী।
ভোলানাথের টেলিগ্রাম অনুসরণ করে লক্ষ্মীনাথের তখুনি কলকাতায় ফিরে যাওয়া উচিত কিন্তু বাবার অনুমতি না নিয়ে বাড়ি থেকে বের হবে কীভাবে? এদিকে কথা বলতেও খারাপ লাগছে।
'লখী, সরকার দুবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও অসমে চাকরি না করে কলকাতায় থেকে সদাগর ভোলানাথের সঙ্গে উড- সাপ্লায়ের ব্যবসা করছিস। শুনেছি তোদের ব্যবসা নাকি ভালোই চলছে— ।'
এই কথাটুকু বলতেই দীননাথ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।
' হ্যাঁ বাবা, আগে আমরা বড় কন্ট্রাক্টর এর অধীনে সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করতাম। লক্ষ্মীনাথ বলল,' এখন আমরা নিজেই কন্ট্রাকটারের কাজ করতে শুরু করেছি।'
গোবিন্দ বলল,' ভোলানাথ ধুরন্ধর ধরনের মানুষ। এদিকে আমাদের বেজবরুয়া বংশের কারও শরীরে ব্যবসায়ীর রক্ত নেই। তুই যে ব্যবসা কতটা বুঝিস সেই সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। ব্যবসা নিয়ে যাতে নাকানি চোবানি নাখাস, তার জন্য সাবধানে থাকবি।'
লক্ষ্মীনাথ কী বলবে বুঝতে পারল না। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে জানালার কাছে থাকা একটা চেয়ারে বসল।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ধীরে ধীরে ভারাক্রান্ত কন্ঠে দীননাথ বলল,' ডাক্তার হয়ে গোলাপ পশ্চিমে গিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছে না। গোবিন্দ যোরহাট,গোলাঘাট, শিবসাগরে একের এক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। বিনন্দও একই পথ অনুসরণ করছে। ব্রজনাথ নিরীহ- সরল ছেলে হয়েই রইল। সহজ সরল শ্রীনাথও জীবনে কিছু একটা করতে পারবে বলে মনে হয় না । লক্ষ্মণকে আমাদের বংশের বৈদ্য শাস্ত্র শিখিয়ে বুঝিয়ে তুলেছিলাম । আমাদের ফাঁকি দিয়ে সে অকালেই ওপারে চলে গেল। তুই– তুইতো আমাদের বংশ কুল করা কাজটার প্রতি আগ্রহ দেখালি না। আর যা দেখছি, গোলাপের মতো তুইও আর অসমে ফিরে আসবি না। তোদের বিচারে আমার এইসব বার্ধক্যের প্রলাপ, এসব তোদের ভালো লাগার কথা নয়।'
বাবার কন্ঠে ক্ষোভ- অতৃপ্তির সুর। এই সমস্ত কথার উত্তর দিলে বাবার কষ্ট যন্ত্রনা বাড়বে। লক্ষ্মীনাথ চুপ করে রইল।
' শোন লখী , অনুমান করছি আমার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে—।'
'ওহো–।' ঠানেশ্বরী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,' কি যে কুলক্ষণীয়া কথাগুলি বল !
' এটা সত্য, সনাতন ,শাশ্বত।' ঠানেশ্বরীর দিকে তাকিয়ে কণ্ঠস্বর একটু শক্ত করে দীননাথ বলল,' মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতেই হবে। তার জন্য ভাবছি, দিন দশেকের ভেতরে আমি আমার বৈকুণ্ঠসম কমলাবারী সত্রে যাব। সেখানেই থেকে মহাপ্রভু গোবিন্দের শ্রীচরণে নিজেকে সঁপে ইহ সংসার থেকে মুক্তি কামনা করব।'
' বাবা!'
' এই কথায় তোরা আমাকে কোনো বাধা নিষেধ আরোপ করবিনা। ধর্ম, অর্থ, কাম ,মোক্ষ– এটাই মানব জীবন। আমার জীবনে ধর্ম, অর্থ এবং কামের পর্ব পূরণ হল। এখন গুরু স্থানে স্বজ্ঞানে মোক্ষ লাভ করাই আমার জীবনের অন্তিম উদ্দেশ্য, একান্ত বাসনা। গোলাপের মতো তুইও প্রবাসী হলি। পিতা-মাতা থেকে, স্বদেশ স্বজাতি থেকে বছরের পর বছর ধরে দূরে থাকা…।'
' বাবা–।' এবার লক্ষ্মীনাথ চুপ করে থাকতে পারল না। বাবা যাতে মনে দুঃখ না পায়, সে কথা মনে রেখে অনুযোগের সুরে বলল,–' প্রবাসী হয়েও আমি আমার সাধ্য অনুসারে মাতৃভাষা এবং সাহিত্যের সেবা করে চলেছি।'
দীননাথের কাশি উঠল। কাশতে কাশতে গলা পরিষ্কার করে নিল। এতক্ষণ কথা বলে তিনি দুর্বল বোধ করছেন। তার জন্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। ঠানেশ্বরী তাকে শুতে বললেন। কিন্তু বিছানায় না পড়ে তিনি বললেন,' করেছ ,ভালোই করেছ। যেভাবে করছ তাতে আমি গৌরব অনুভব করি। কিন্তু আমার মন বলে, স্বদেশ স্বজাতির মাঝখানে থাকলে আরও বেশি ভালোভাবে করতে পারতে।'
বাবার এই কথাটা লক্ষ্মীনাথ মেনে নিতে পারল না। আজ তাঁর যে মানসিক স্তর, চিন্তা মনন সাংস্কৃতিক চেতনা– সেই সমস্ত বঙ্গের বৌদ্ধিক সমাজ, বঙ্গের কলকাতায় প্রবাহিত হওয়া প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের শিক্ষা দর্শনের অবদান। কলকাতায় যে ধরনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক চিন্তা চর্চার পরিবেশ বিদ্যমান, বিশেষ করে শ্বশুর বাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, ভায়রা আশুতোষ চৌধুরী ইত্যাদি যেভাবে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করে এবং দেশ-বিদেশের সাহিত্য দর্শনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে আলোচনা করে… সেইসব অসমে নেই। সত্যি কথা বলতে গেলে অসমে এখন ও সেই ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। তাই শিকড়ের টানে বাড়িতে এলেও লক্ষ্মীনাথ এখানে মানসিক খোরাক পায়না। কিন্তু এসব তো বাবাকে বলা যাবে না।
দীননাথ বসে থাকার শক্তিও হারিয়ে ফেলছে। তিনি বিছানায় লম্বা হয়ে পড়লেন। ঠানেশ্বরী তার মাথার বালিশটা ঠিক করে দিলেন। এতক্ষণ কথা বলে দীননাথ এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন যে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। অস্ফুট কণ্ঠে দুবার ঠাকুরের নাম নিয়ে চোখ বুজলেন।
লক্ষ্মীনাথ নিথর হয়ে বসে আছে। হাতে কলকাতা থেকে পাঠানো ভোলানাথের টেলিগ্রাম। কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য বাবার অনুমতি নেবে। কিন্তু এই অবস্থায় বাবাকে ছেড়ে যাওয়াটা…। এদিকে সে নিরুপায়। ব্যবসার কথা। না গেলে নতুন যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। তার ফলে অনেক টাকার লোকসান হবে। ভোলানাথ বরুয়া তার জন্য অসন্তুষ্ট হবে। অবশেষে লক্ষ্মীনাথ আস্তে করে ডাকল,' বাবা–। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই দীননাথ বলল– কী বলতে চাইছিস, বল–।'
' কলকাতা থেকে ভোলানাথ দাদা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে । বিজনেসের কিছু একটা অসুবিধা হয়েছে । খুব শীঘ্রই আমাকে কলকাতায় পৌঁছাতে হবে ।'
দীননাথ ধীরে ধীরে চোখ মেলল। করুণভাবে লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব নিরাসক্ত সুরে বলল ,'যা– যাওয়া মানুষ যাবেই–।'
ইতিমধ্যে শিবসাগরের আত্মীয়-স্বজনের ভেতরে দুর্গেশ্বর দ্বারিকা দেখা করল। গুঞ্জদের সঙ্গে দেখা করায় তার মা লক্ষীনাথকে নিজের হাতে বোনা গামছা উপহার দিল। বড় বৌদি প্রজ্ঞাকে দিল হাতির দাঁতের সুন্দর একটি চিরুনি এবং বড় দাদা ব্রজনাথ দিল একটি কটারি। খোকন এবং শ্রীমতী ফুকনের বাড়িতেও একদিন দেখা করে এল। যাবার দিন সকাল বেলা বাবাকে বমি করতে দেখে লক্ষ্মীনাথের বুকটা হাহাকার করে উঠল। এবার স্পষ্ট করে বুঝতে পারল যে এরপরে অসমে এসে সে আর বাবাকে দেখতে পাবে না। তার জন্যই অন্যান্য বারের চেয়ে এবারের বিদায়টা বেশি করুণ, বেশি হৃদয়বিদারক হয়ে পড়ল। বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করার সময় নিজেকে সামলাতে পারল না। লক্ষ্মীনাথের দুচোখ দিয়ে ধারাসার চোখের জল নেমে এল।
শিবসাগর থেকে গরুর গাড়িতে দিসাংমুখ, দিসাং মুখ থেকে বিকেলে কোকিলামুখ, কোকিলা মুখ থেকে ট্রলি রেলে যোরহাট, যোরহাটে গোবিন্দচন্দ্রের ঘরে এক রাত থেকে তেজপুরে রওনা হল। সে তেজপুরে আসার কথা প্রিয় বন্ধু চন্দ্র কুমার আগরওয়ালাকে জানিয়েছিল। সেই অনুসারে চন্দ্র কুমার স্টেশনে এসে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করে ভীষণ আনন্দিত হল। লক্ষ্মীনাথের ও এত ভালো লাগল যে কলকাতায় পৌঁছানোটা জরুরি যদিও বন্ধুর সঙ্গে একদিন থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। চন্দ্র কুমার লক্ষ্মীনাথকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল।
অনেকদিন পরে দুই বন্ধুর মিলন। কত কথা, কত স্মৃতিচারণ…. কলকাতায় প্রথম সাক্ষাৎ, কলেজ স্ট্রিটের ম্যাচে কফি হাউসে ইডেন গার্ডেনে বসে কত আলোচনা, আলোচনার মধ্যে জোনাকী কাগজ প্রকাশের পরিকল্পনা, অসমীয়া ভাষা উন্নতি সাধনী সভায় বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে চন্দ্রকুমারের সম্পাদনায় জোনাকী প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত, তারপরে চন্দ্র কুমার আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের বাড়িতে যাওয়ার পরে ঘটক বৈকন্ঠ দত্তের মাধ্যমে ঠাকুরবাড়ির কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীর সঙ্গে তার বিবাহের প্রস্তাব, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির মানুষ ব্রাহ্ম– বৈষ্ণব হয়ে ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যাকে কীভাবে বিবাহ করা যেতে পারে সেই সব নিয়ে হেমচন্দ্র ,চন্দ্রকুমারের সঙ্গে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ইত্যাদি নিয়ে কত স্মৃতিচারণ। দুই ঘন্টা পার হয়ে গেল। তথাপি কথার শেষ হয় না। রাতের আহার খাবার পরে পুনরায় আলোচনার আরম্ভ হল।
' আচ্ছা বেজ, এখন কী লিখছ?'
চন্দ্রকুমাররের প্রশ্নে লক্ষ্মীনাথের মনটা দুঃখে ভরে পড়ল,' না মাজিউ, বিশেষ কিছুই লিখতে পারিনি।'
'কেন?'
' কাঠের ব্যবসায় অত্যন্ত পরিশ্রম। সকাল থেকে রাত এক প্রহর পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আগে ভোলা দাদা এবং আমি একসঙ্গে ঘোরাফেরা করতাম। ব্যবসা বৃদ্ধি পাওয়ায় কলকাতার বাইরের পার্টির সঙ্গে ভোলা দাদা যোগাযোগ করে। আমি কলকাতার পার্টি গুলির সঙ্গে ডিল করি। তাছাড়া টাকা পয়সার হিসেব রাখা, ব্যাংক এবং পার্টির পেমেন্ট ইত্যাদি যাবতীয় কাজ আমাকে দেখতে হয়। লেখা পড়ার জন্য আমি সময় দিতে পারি না।'
' না না, এটা ভালো হচ্ছে না। তুমি তোমার ক্রিয়েটিভ সত্তাকে অনাদর করছ।'
' কী আর করব মাজিউ? ঠাকুর বাড়ির কন্যাকে বিয়ে করেছি যদিও সেই বাড়ির ট্রেডিশন মেনে ঘরজামাই হয়ে তো আর থাকতে পারি না। এদিকে বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রজ্ঞাকে মাসে মাসে দেওয়া দুশো টাকা বন্ধ হয়ে গেল । বাইরে মানে এখন গোপীকৃষ্ণ লেনে বড় দেখে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। সেই বাড়িতে একটা স্ট্যান্ডার্ড মেনটেন করতে হয়। তাই টাকার প্রয়োজন বুঝেছ, আর ও টাকা চাই। ভোলা দাদার সঙ্গে বিজনেসে নেমে টাকা উপার্জন করার কৌশল শিখেছি। অন্যদিকে, আমি বাবা হতে চলেছি।'
'বাঃ এটা বেশ আনন্দের খবর!'
' তার জন্য আগামীতে সংসারের খরচ আরও বাড়বে। খরচের কথা চিন্তা করে ভোলা দাদার টেলিগ্রাম পেয়ে বাবাকে কঠিন অসুখে রেখে কলকাতা ফিরে যাচ্ছি।'
'বিজনেসের জন্য এসব করতেই হয়। পরিবারের কথাও ভাবতে হবে। তার মধ্যেই লিখতে হবে। লেখা বাদ দিতে পারবেনা।'
' অল্পস্বল্প লিখছি। ব্যস্ততার মধ্যেও' অসমীয়া ভাষা'র ওপরে একটা প্রবন্ধ লিখছি।'
' তোমার কৃপাবর?'
' কৃপাবর আমার দ্বিতীয় সত্তা। রসাল ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ নিয়ে কৃপাবর মাঝেমধ্যে আসতেই থাকবে। আমিও কৃপাবর হয়ে লিখতে ভালোবাসি।'
' সত্যিই ভালো হয়েছে। অসমিয়া জাতির চারিত্রিক দোষ গুলি শোধরানোর জন্য কৃপাবর চরিত্রটির সৃষ্ট করে তুমি বড় শক্তিশালী অস্ত্র একটা হাতে তুলে নিয়েছ।'
' না মাজিউ,ভালো হলেও কত আর ভালো বলবে? এমনিতেও সাহিত্যের মাঠে আমরা বহু পেছনে পড়ে আছি। এখনও আমরা সবক্ষেত্রেই পেছনে। আমাদের জাতির জন্য, আমাদের ভাষা সাহিত্যের জন্য অনেক কিছু করার আছে। এবার বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার আগের দিন বাবার সঙ্গে কথাবার্তা হল। আমি প্রবাসী হওয়ার জন্য বাবা দুঃখ প্রকাশ করলেন। বাবা চান কলকাতা থেকে চলে এসে আমি অসমে থাকি। কিন্তু বাড়িতে থাকলে আমি আমার ভাষার দৈন্য দশা বুঝতে পারতাম কি? অর্থনৈতিক সামাজিক দিকে আমরা যে এখনও এতটা পেছনে পড়ে আছি, শিবসাগরে থাকলে সেই ছবিটা আমার চোখের সামনে ফুটে উঠত কি?'
লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বরে আবেগ। কিছুটা উত্তেজিত ও। এটা বাবার প্রতি তার ক্ষোভের প্রকাশ।
চন্দ্রকুমার সেটা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলল,' বেজ, মেসো পুরোনো ধ্যান ধারণার মানুষ।তাঁর কথায় খারাপ পেতে নেই। এমনিতেও বুড়ো বয়সে সব পিতাই ত়াঁর পুত্র সন্তানের কাছে থাকাটা কামনা করে। বাড়িতে বা বাড়ির কাছে আরাম-আয়েশের জীবনধারণ না করে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের রাজধানী কলকাতার গতিশীল জীবনের প্রত্যাহ্বান স্বীকার করে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের তুমি সেবা করে চলেছ– তার গুরুত্ব মেসো বুঝতে পারছে না।আচ্ছা, তুমি কাল কলকাতা রওয়ানা হবে বললে– আরও একদিন থেকে যাও না?'
' তোমার সঙ্গে থাকাটা আমার অতি আনন্দের। কিন্তু ভোলা দাদা টেলিগ্রাম করেছে, তাড়াতাড়ি না পৌঁছালে হুলস্থুল করবে।’
‘তাহলে আগামীকাল বিকেলের দিকে স্টিমারে যাত্রা কর। তেজপুরে এসেছ যখন সকালে বামুনি পর্বত এবং ভৈরবী গোঁসাইনীর ম্নন্দিরটা দেখে যাও।
তেজপুর ঘাট থেকে মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র দিয়ে যাত্রাপুর। সতেরো টাকার বিনিময়ে জাহাজের আপার ক্লাসের টিকেট নিল।পরের দিন সকাল সাড়ে দশটায় গুয়াহাটি পৌছাল। গুয়াহাটিতে হেমচন্দ্র গোস্বামী থাকে। লক্ষ্ণীনাথের অসমে আসার কথা তাকে জানানো হয়েছিল।কিন্তু জাহাজঘাটে হেমচন্দ্রকে দেখতে না পেয়ে লক্ষ্ণীনাথের খারাপ লাগল।গুয়াহাটি থেকে জাহাজ ছাড়ার পরে গোয়ালপাড়া, তারপরে ধুবরি,ধুবরির পরে বঙ্গ …প্রতিবারই জলপথে কলকাতায় যাবার সময় লক্ষ্ণীনাথের মনটা বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এইবার যে অতি আদরের পিতাকে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় দেখে এসেছে। দেহরক্ষা করার জন্য এক সপ্তাহের ভেতরে বাবা তাঁর গুরুস্থান কমলাবারী সত্রে যাত্রা করবে,এরপরে পিতাকে আর দেখতে পাবে না…আসন্ন আত্মিক বিচ্ছিন্নতার তীব্র যন্ত্রণাটা লক্ষ্ণীনাথকে কষ্ট দিতে লাগল। সে আর জাহাজের কেবিনের ভেতরে একা বসে থাকতে পারল না। কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের ডেকে রেলিঙ ধরে এসে দাঁড়াল।
বৈশাখ মাস।মাঝখানে দুদিন হালকা বৃষ্টি পড়ার জন্য আবহাওয়া স্যাঁতসেঁতে। এদিকে ভাটির দিকে যাত্রা করার ফলে জাহাজের বেগটা বেশি।ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ তুলে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে জাহাজ এগিয়ে চলেছে।ওপরের আকাশটা মেঘলা হওয়ার জন্য তারাগুলি ঢাকা পড়ে আছে। তার জন্যই নদী বক্ষ দিয়ে গতিশীল জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অন্যান্য বারের মতো রাতের সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পেল না। শৈশবে এই নদী বক্ষ দিয়ে নৌকায় লখিমপুর থেকে বাবার সঙ্গে বরপেটায় যাবার সময় রাতের দৃশ্যাবলী দেখে সে রোমাঞ্চিত হয়েছিল।
ছোট্ট করে উত্তপ্ত নিশ্বাস একটা ফেলে লক্ষ্মীনাথ নিজের কেবিনের উদ্দেশ্যে যেতে উদ্যত হতেই ডেকের মাথার দিকে সাধারণ ধুতি কামিজ পরা আঠারো উনিশ বছরের চেহারার একটি যুবককে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। যুবকটি অন্ধকার ঘিরে ধরা উত্তর পাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্ণীনাথের খারাপ লাগল। সে যুবকটির দিকে এগিয়ে গেল।
‘এই যে তুমি কোথাকার? কোথায় যাচ্ছ?’
যুবকটি করুণভাবে লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করল I তারপর নিজের পরিচয় তুলে ধরল। তার নাম কুশল দুয়ারা I গতবছরের আগের বছর সে লক্ষ্মীমপুর সরকারি হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তার কলকাতায় পড়ার ইচ্ছে কিন্তু বাড়ির অবস্থা এতই খারাপ যে তাকে কলকাতায় পড়ানোর মতো আর্থিক ক্ষমতা তার পিতার নেই। তাই গত দেড় বছর সে একটি প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে কলকাতায় কলেজে পড়তে যাচ্ছে
‘তবে স্যার, যে টাকা নিয়ে এসেছি, এফ এ ক্লাসে ভর্তির মাসুল দেওয়ার পরে টেনেটুনে চার মাস কলকাতার মেসে থাকতে পারব। তারপর কীভাবে চলবে সেটা ভেবে কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’
লক্ষ্মীনাথ কুশলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার নিজের ভাই লক্ষ্মণের কথা মনে পড়ল। কুশলের মুখটা যেন লক্ষ্মণের মতোই। লক্ষ্মীনাথের মনে কুশলের জন্য ভালোবাসা জন্মাল।
এখন কুশল যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, এটা এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অসমের অধিকাংশ যুবকের সমস্যা। উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় যায় অসমের আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থ্য থাকা উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে, চা বাগানের মালিক জমিদার এবং মৌজাদারের সন্তানরা। কুশলের মতো দুঃখী পরিবারের ছেলেরা কীভাবে কলকাতার ফীস দিয়ে মেসের মাসিক খরচ যোগাবে? তাই আর্থিকভাবে পেছনে পড়া বহু প্রতিভাবান অসমিয়া সন্তানকে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। অসম মাতৃর এতই দুর্ভাগ্য যে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা দেশ অধিকার করার পরে আজ ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ৭০ বছরে অসমে একটিও কলেজ স্থাপিত হল না। মাঝখানে শুনেছিল কলকাতায় থাকা গভর্নর জেনারেল অসমে কলেজ স্থাপন করার কল্পনা করছেন কিন্তু সেটারও বাস্তব রূপায়ণ হয়নি। কবে হবে কেউ বলতে পারেনা।
'স্যার–।' কুশল বলল,' আমাদের অসমে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা যায় না কি?'
' জনগণ সঙ্গে থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।' লক্ষ্মীনাথ কিছুটা উষ্মার সঙ্গে বলল,' কিন্তু আমাদের ঢিলেমি স্বভাবের জন্য অসমিয়া মানুষের সেইসব নিয়ে কোনো চিন্তা- নেই। এদিকে বিদেশি শাসকের নিজের গরজ আর কতটুকু থাকবে? আচ্ছা তুমি যে এন্ট্রান্স পাশ করে দেড় বছর মাস্টারি করে টাকা জমিয়ে পড়াশোনা করার জন্য কলকাতায় রওনা হয়েছ এটা খুব বড় কথা । মনে আত্মবিশ্বাস রাখবে,আত্মবিশ্বাস থাকলে তোমার জীবনের লক্ষ্য পূর্ণ হবেই।'
' আপনি কলকাতায় থাকেন, তাই নয় কি?'
' হ্যাঁ আমি কলকাতার ১৪ নম্বর গোপীকৃষ্ণ লেনে থাকি। কোনো অসুবিধা হলে আমার বাড়িতে যাবে।
'স্যার ,আপনার নামটা বলবেন কি?'
' আমার নাম লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া'
সঙ্গে সঙ্গে কুশল উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল। লক্ষ্মীনাথের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে কুশল বলল-‘জোনাকির পাতায় আপনার লেখা আমি সব সময় পড়ি। আপনার সব লেখাই আমার ভালো লাগে।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন