পাখিদের পাড়া পড়শী ৩
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi
দ্বিতীয় অধ্যায়, ৩
(তিন)
উদয়শঙ্কর এবার পাখিদের পাড়া পড়োশিতে গেলে কীভাবে কাজ করবে সেই বিষয়ে কিছুটা ভেবে নিচ্ছিল। বলতে গেলে হোম ওয়ার্ক। সে ভাবছে– হাড়গিলা গুলির ওপরে ব্যক্তিগত অধ্যয়ন অব্যাহত রাখার সঙ্গে জায়গাটার বিষয়েও কিছুটা সম্যক জ্ঞান আহরণ করতে হবে। পাগলাদিয়া নদীর বাঁধের মধ্যের মাটি ব্যবহার করার কোনো সুযোগ গ্রহণ করার চিন্তা তার মনে বারবার আসছে।কী করবে সে লক্ষ্য স্থির করতে পারছে না। তার আগে স্থানীয় মানুষগুলির সঙ্গে তাকে এক সৌহার্দ্যমূলক ব্যবহার এবং সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে। আশেপাশের মানুষগুলির সঙ্গে একটু মেলামেশা করে হাড়গিলার সংরক্ষণের ওপরে সজাগতা আনার চেষ্টা করা যেতে পারে।
মাঝেমধ্যে একটা পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তোলার চিন্তা উদয়শঙ্করের মনে আসে। কিন্তু কীভাবে এগোলে ফলদায়ক হবে তা সে অনেক ভেবে চিন্তেও বুঝে উঠতে পারেনা। যাবার সময় পৃথিবীকে সে কিছু একটা দিয়ে যেতে চায়। কিন্তু একটি শর্তে– তা হল উদয়শঙ্কর এমন একটি কাজ করে রেখে যেতে চায় যা ইতিমধ্যে কেউ সম্পাদন করে নি অথবা করার চিন্তা চর্চাও করে নি। তবে কীভাবে কী রেখে যাওয়া উচিত সে কিছুই স্থির করতে পারছেনা। তার মনটা ধোঁয়াশা কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অনেক কিছু করার ইচ্ছা।
অনেক স্বপ্নের সন্ধ্যা পার করে উদয়শঙ্কর বিচলিত হয় না। হয় দৃঢ়মনা। দিনগুলি গড়িয়ে চলতে থাকে,সে নভেম্বর মাসের নির্দিষ্ট দিনটির জন্য অপেক্ষা করে,যে দিনটিতে সে উপস্থিত হবে পাখিদের পাড়া পড়োশিতে ।
তখনই উদয়শঙ্কর সৌম্যদার কাছ থেকে একটা ফোন কল পেল– আমরা মানসে একটা শিবিরের আয়োজন করছি। এবার উপস্থিত থাকতে পারবে কি?
কাজিরাঙ্গায় শিবিরটা অনুষ্ঠিত হওয়ার একমাস পরে মানসে একটি শিবির অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকের ব্যস্ততার জন্য উদয়শঙ্কর সেই শিবিরে যোগদান করতে পারেনি। সে সৌম্যদাকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলেছিল–' সৌম্যদা, জানোই তো ব্যাংকের চাকরি।যাব বললেই কোথাও যাওয়া যায় না।
সৌম্যদা তার কথায় সায় দিয়ে জানিয়েছিল– হবে। পরবর্তী সময় শিবির অনুষ্ঠিত করলে তোমাকে জানাব।
এবার ফোন করার সময় সৌম্যদা উদয়শঙ্করকে সেই কথাই মনে করিয়ে দিল।
– তোমাকে বলেছিলাম যে মানসে শিবির অনুষ্ঠিত করলে তোমাকে জানাব। মনে রাখবে আনুষ্ঠানিকতা নয় কিন্তু।তুমি এলে প্রকৃতি বিষয়ক নতুন নতুন কথা শিখতে পারবে। আমাদের প্রত্যেকটি শিবিরেই নতুন নতুন বিষয়ের অবতারণা করা হয়।
সৌম্যদার কথায় উদয়শঙ্কর আবেগিক হয়ে পড়ার মতো হয়ে পড়ে ।
– কী যে বলেন সৌম্যদা ! আমি কিছু …
— আমি ব্যাংকের ব্যস্ততার কথা জানি।
— এবার যাবই। তবে শিবির কবে অনুষ্ঠিত হবে?
— অক্টোবর মাসে। পুজোর বন্ধের সময়।
— সুন্দর খুব সুন্দর। পারব। আর পারব মানে যাবই।
অসমের কয়েকটি রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্য অথবা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশ করার অভিজ্ঞতা থাকলেও খুবই কাছ থেকে মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যে প্রবেশ করার সুযোগ সুবিধা উদয়শংকরের হয়নি। তার জন্য তার মনে আক্ষেপ ছিল। বিভিন্ন জনের মুখে অভয়ারণ্যের মাধুকরী কথাগুলি সে শুনেছিল। মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্য ভ্রমণ করে অনুরাধা শর্মা পুজারী লেখা ভ্রমণ বিষয়ক একটি প্রবন্ধ সে পড়েছিল। গল্পকার গীতালি বরা একটি লেখায় বড় উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বর্ণনা করেছিল মানস নদীর তীরের মথনগুরির টুরিস্ট লজে জ্যোৎস্না রাত কাটানোর স্বপ্নের মতো মনে হওয়া অভিজ্ঞতার বাস্তব কাহিনি।
মনের ইচ্ছা সব সময় অবদমিত করে রাখা যায় না।সুযোগের খোঁজে থাকলে সুবিধা বের করে আর সুবিধা গ্রহণে উদয়শঙ্কর কখনও কার্পণ্য করে না।সৌম্যদা শিবির অনুষ্ঠিত করায় মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যের গহনে প্রবেশ করার সুবিধা বের হল উদয়শঙ্করের।
সৌ্ম্যদারা মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যে আয়োজন করা এটাও হল একটি ‘নেচার ক্যাম্প’বা প্রকৃ্তি শিবির।
প্রকৃ্তি শিবিরের জন্য অসমের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত প্রকৃ্তিপ্রেমীরা ২৪ অক্টোবর দুপুরবেলা বারোটার সময় বরপেটা রোড স্টেশনে সাক্ষাৎ করার জন্য স্থির করা হল।সেই অনুসারে অসমের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত প্রকৃ্তিপ্রেমীরা বরপেটা রোড স্টেশনে মিলিত হয়।উদয়শঙ্কর রেলযোগে এসে যথাসময়ে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়ে অসমের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত প্রকৃ্তিপ্রেমীদের সঙ্গে কাজিরাঙ্গার মতো পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করল।তারমধ্যে অনেকের সঙ্গেই তার পুরোনো পরিচয় রয়েছে।তখনই সৌ্ম্যদা এসে উপস্থিত হলেন।কেউ কাউকে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করার দূরত্ব অতিক্রম করে ক্ষণিকের জন্য হলেও আন্তরিকভাবে কাছাকাছি চলে এল।
একটি বাস,একটি টাটাসুমো এবং একটি ব্যক্তিগত বাহন নিয়ে মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্য অভিমুখে দলটির যাত্রা আরম্ভ হল।দলটিতে প্রায় পঞ্চাশজন প্রকৃ্তিপ্রেমী।এত বড় একটি দল নিয়ে প্রকৃ্তিশিবির অনুষ্ঠিত করাটা প্রকৃ্তপক্ষে এক সাংগঠনিক পরাকাষ্ঠা।উপস্থিত প্রত্যেকেরই সীমাহীন আগ্রহ এবং নিষ্ঠাকে অবহেলা করা যায় না।প্রকৃতি শিবিরে যোগদান করার জন্য রাকেশ সাউদ নামে ছাত্র একজনের নেতৃ্ত্বে আই আইটি গুয়াহাটি থেকে ছয়জন ছাত্রের একটি দল ব্যাপক উৎকণ্ঠা নিয়ে শিবিরে উপস্থিত হয়েছে।অসমের বাইরের এই ছাত্রদলটির সদস্যরা হল ক্রমে ফরিদাবাদের অরুণ ঢিলন,দিল্লির হিমাংশু শর্মা,জ্যোতি ছেত্রী অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকান্ত কাটলা,যোগানন্দ ইত্যাদি।উদয়শঙ্কর অবাক হল যে এই ছাত্রদের অরণ্য সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই।অরণ্য কাকে বলে,দেখতে কীরকম,আই আই টির ছাত্র হয়েও যে তারা জানে না ভাবতে অবাক লাগে।হয়তো সৌ্ম্যদার সঙ্গে দেখা হওয়ার তার অবস্থাও এরকম ছিল।
প্রকৃ্তি শিবিরে যোগদান করা প্রকৃ্তিকর্মীদের নৈশযাপন এবং আহারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ‘আস্থা নেচার্স ট্যুরস এণ্ড ট্রাভেলস’মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যের খুবই কাছের বাঁশবারিস্থিত ‘বিরিণা’য়।ফাতেমাবাদ চা বাগিচার একটি পুরোনো বাংলো লীজে নিয়ে ‘বিরিনা’নামে ট্যুরিস্ট লজটি স্থাপন করা হয়েছে।‘আস্থা নেচার্স ট্যুরস এণ্ড ট্রাভেলস’এর স্বত্তাধিকারী শৈলেশ চৌধুরী প্রকৃ্তি শিবিরটা অনুষ্ঠিত করায় সমস্ত প্রকারের সহায় সহযোগ করার জন্য প্রকৃ্তি কর্মীদের অর্থনৈ্তিক বোঝা অনেকখানি লাঘব হয়েছে।
‘বিরিণার’সম্মুখ ভাগের বাগানের মধ্যে চারটি সুন্দর তাঁবু লাগানো হয়েছে।পরবর্তী সময়ে জয়দীপ শীল একটা ব্যক্তিগত তাঁবুও সেই টেন্টের কলোনিতে সংযোজিত করে নিল।সারি সারি করে চেয়ার এবং টেবিল সাজিয়ে শিবিরে অংশগ্রহণ করা সবাইকে অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল বিরিনার কর্মচারীবৃন্দ।
দীর্ঘযাত্রার শেষে প্রকৃতি কর্মীরা হাত মুখ ধুয়ে নিজের আসনে বসে পড়ল। সৌম্যদা আরম্ভ করল পরিচিতি পর্ব।শিবিরটার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হল সপ্তম শ্রেণিতে পড়তে থাকা নিষ্কমনা।
তারপরে আরম্ভ হল ভোজন পর্ব । প্রত্যেকেরই খুব ক্ষুধা পেয়েছিল।
উদর অসন্তুষ্ট হলে মন অতৃপ্ত হয়।
দীর্ঘ সারি পেতে প্রত্যেককেই নিজের নিজের আহারের থালা নিয়ে একান্ত মনে ভোজন উপভোগ করতে দেখে উদয়শঙ্করের ভালো লাগল। একেই বোধহয় বলে তৃপ্তির আহার।'বিরিণা'র কর্মচারীদের বৃত্তিগত মানসিকতার জন্য রন্ধন এবং পরিবেশন ওদের কাছে বেশ সুখ দায়ক হল। আজকাল বৃত্তিগত তৎপরতা চট করে দেখা যায় না। যেভাবে চলছে চলতে থাকুক– এভাবেই সংশ্লিষ্টরা কাজ এড়িয়ে চলে। ভালো লাগে না।
খাওয়া পর্ব শেষ হওয়ার পরে প্রত্যেকেই পুনরায় মিলিত হয়ে প্রকৃতির শিবিরটা থেকে কে কী আশা করে সেই বিষয়ে ব্যক্ত করা ছাড়াও শিবিরে অংশগ্রহণকারীরা ব্যক্ত করা ব্যক্তিগত কথাগুলি যথার্থতে উপভোগ্য হল।তারপরে সৌম্যদা রাত্রিযাপনের জন্য কাকে কোথায় যেতে হবে নির্দিষ্ট করে দিল।'বিরিণা'র সামনের উদ্যানে স্থাপন করা তিনজন করে থাকার সুবিধা থাকা তাঁবু কয়েকটি ছাড়াও দুটো করে বিছানা থাকা দুটো ঘর পাঁচজন করে থাকতে পারা খড়ের চালা নির্মিত একটি কটেজ এবং একটি তাঁবুর মতো ঘরে প্রকৃতি কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেইমতো সৌম্যদা সদস্যদের নির্দিষ্ট স্থানে ভাগ করে দিল।
তখনই সৃষ্টি হল সমস্যার। প্রকৃতি কর্মী হিসেবে দলটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছয়জন সদস্য কোনোমতেই একে অপরকে ছেড়ে চলতে চায় না। তারা একই দলে থেকে নৈশ যাপন করার মানসিকতা দেখাল। তাদের কথা মেনে নেওয়া সৌম্যদাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাদের মনোভাব থেকে বোঝা গেল তারা প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি কর্মী না হয়ে পর্যটক হিসেবে শিবিরে এসেছিল। প্রকৃতি বিষয়ক শিক্ষা লাভ করার চেয়ে নিজেকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁরা ছিল তৎপর। অবশেষে তারা দলটি থেকে সরে গেল।ফলে প্রকৃতি বিষয়ক দৃঢ় সাংগঠনিক মানসিকতায় দলটির অন্য সদস্যরা পুষ্ট হয়ে উঠল।প্রত্যেকেই নিজের নিজের স্থানে গিয়ে নিজের জিনিসপত্র নির্দিষ্ট জায়গায় রাখল।সবার জন্য থাকার ব্যবস্থা সম্পুর্ণ হওয়ার পরে উদয়শংকর প্রভাকর চক্রবর্তী এবং নবজিৎ বর্মনের সঙ্গে একই তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করে নিল। উদয়শঙ্করের জন্য তাঁবুতে রাত যাপনের এটিই প্রথম অভিজ্ঞতা ।
শিবিরের প্রথম দিনের কার্যক্রমের দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যের মধ্যে ময়ূরের মিষ্টি ডাক। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রত্যেকেই স্বভাবসিদ্ধভাবে ক্রমে প্রকৃতির কাছাকাছি চলে এল।বেঁকী নদীর তীরে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখে প্রতিটি প্রকৃতিকর্মী যথেষ্ট পুলকিত হয়ে পড়ল। কেউ জলে হাত মুখ ভেজাল,কেউ দূরে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে সৌন্দর্য সুধা পান করতে লাগল। আইআইটি থেকে শিবিরে আসা প্রতিটি ছাত্রের উন্নত ক্যামেরার লেন্স গুলি টিপে টিপে ধরে রাখল স্মৃতি হতে চাওয়া ক্ষণিক মুহূর্তগুলি।
দলটি ফিরে এসে শিবির পাওয়া পর্যন্ত আলো-আঁধারি অন্ধকার রাতের অন্ধকারে রূপান্তরিত হল। হেঁটে আসা বলে সদস্যরা বেশ ক্লান্ত অনুভব করতে লাগল। শিবিরে এসে হাত পা ধুয়ে কেউ কেউ নিজেকে সতেজ করে নিল। অন্য সদস্যরা ইতিমধ্যে নিজের নিজের আসন গ্রহণ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে শুরু করেছে। তারপরে আবার আরম্ভ হল আলোচনা পর্ব।
চেয়ারগুলি ইতিমধ্যে গোলাকার ভাবে সাজিয়ে নেওয়া হয়েছিল। গোলাকার ভাবে বসার ফলে প্রতিটি অংশগ্রহণকারীই প্রতি জন অংশগ্রহণকারীকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেল। প্রকৃতি কর্মীদের মধ্যে কেউ বন্য জন্তুপ্রেমী, কেউ সর্প প্রেমী, কেউ আবার পাখির বিষয়ে জানতে বড় উৎসুক। তাদের মধ্যে আবার প্রণব কুমার ভাগবতী প্রজাপতির বিষয়ে আগ্রহী। প্রকৃতি সংগঠনকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে সাংগঠনিক কর্মী হিসেবে মনোনিবেশ করার জন্য কয়েকজন সদস্য ঔৎসুক্য দেখানো শিবিরটির উল্লেখযোগ্য দিক হিসেবে বিবেচিত হল।সৌম্যদার সঙ্গে বার্তালাপে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী নিজের নিজের মনোভাব সহৃদয়তার সঙ্গে ব্যক্ত করল।
রাতের আহার তৈরি হওয়া পর্যন্ত প্রশিক্ষণ পর্ব, আলোচনা-পর্যালোচনা, প্রশ্নমঞ্চ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতে থাকল।
পরিবেশ কর্মীদের মনোভাব থেকে বোঝা গেল যে তাঁরা শিবিরটিতে অংশগ্রহণ করে খুব তৃপ্তি লাভ করেছে ,লাভান্বিত হয়েছে।শেখার আগ্রহ থাকলে জ্ঞানের কোনো পরিধি থাকে না। উপস্থিত প্রতিটি প্রকৃতি কর্মী উত্থাপন করা প্রশ্ন সমূহ সেই কথাকেই প্রতিফলিত করল ।
খাওয়া-দাওয়ার শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে প্রায় প্রতিটি সদস্যই বিছানার দিকে এগিয়ে চলল । পরেরদিন ভোর বেলা তাদের শয্যা ত্যাগ করতে হবে এবং মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যের গহণ অরণ্যে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন ঘুমোতে গেল না তারা আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ল।
সর্পবিদ হওয়ার বাসনা মনে পুষে রাখা নবজিৎ বর্মন মুক্ত আড্ডার স্বপক্ষে যুক্তি উত্থাপন করল– শোবার সুবিধা প্রতিদিন পাই আর আগামী কাল ও পাব। কিন্তু এভাবে সতীর্থ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ এবং সুবিধা সহজে পাওয়া যায় না ।
আড্ডাবাজ দলটি কত রাত পর্যন্ত আড্ডায় মশগুল হয়েছিল উদয়শঙ্কর বুঝতে পারল না। কেবল মাঝখানে একবার জেগে উঠে সে তাদের সঙ্গে থাকা কোনো মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। সম্ভবত সে মৃদুস্মিতা মেধি। ছেলেদের জমানো আড্ডা তাকেও বিছানা থেকে সম্ভবত সেখানে ডেকে নিয়ে গেল ।
তাঁবুর ভেতরে উদয়শঙ্করের নৈশ যাপন সুখকর হল। রাতে ভাল ঘুম হল এবং নির্দিষ্ট সময় চারটার সময় সে জেগে গেল। নৈমিত্তিক কর্ম সমাপন করে এক কাপ চায়ের প্রয়োজন অনুভব করে সে এদিকে ওদিকে তাকাল। রন্ধনশালার ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে রয়েছে যদিও চায়ের কোনো আয়োজন সে দেখতে পেল না।
চা বাগানের মাঝখানের উঁচু উঁচু শিরিষ গাছের ডালে বসে থাকা অপরিচিত পাখিগুলি নতুন দিন একটাকে শিস দিয়ে সম্ভাষণ জানাতে শুরু করেছে । সকাল বেলাটির দৃষ্টিনন্দন আরম্ভনি ঘটল। শারদীয়া একঝাঁক বাতাস উদয়শংকরকে ছুঁয়ে গেল। ধীরে ধীরে'বিরিণা'র তাঁবু এবং রুমগুলিও জেগে উঠতে লাগল। নিত্যনৈমিত্তিক কার্য সমাপন করার জন্য প্রত্যেকের ব্যস্ততা উদয় শঙ্করের চোখে পড়ল। একসময় সবাই এসে গোল করে পেতে রাখা চেয়ারগুলিতে বসল।
আগামী দিনটির পরিকল্পনার বিষয়ে সৌম্যদা সবাইকে অবগত করাল। উদয়শঙ্করের মতো যারা মানস অভয়ারণ্যের অভ্যন্তরে প্রথমবারের জন্য পদার্পণ করবে তাদের মন উৎসাহে ভরে পড়ল। এক অনামী শিহরণ তাদের সর্বশরীর শিহরিত করে গেল। কাজিরাঙ্গায় প্রথমবারের জন্য প্রবেশ করার সময় এই একই অনুভব হয়েছিল উদয়শঙ্করের।
— তোমরা এখন তাড়াতাড়ি কর। এখানে দেরি করা মানে আমরা ভেতরে কম সময় পাব।
সৌম্যদা সর্তকতার সুরে সবাইকে আহবান জানাল।
খোলাখুলি ভাবে পেতে রাখা টেবিলের ওপরে চা বিস্কুট, শুকনো রুটি ঘুগনি, সিদ্ধ ডিম ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা আছে।সৌম্যদার আহ্বানকে সমর্থন জানিয়ে শিবিরের সমস্ত অংশগ্রহণকারীরা সারি পেতে সকালের আহার পর্বে যোগ দিল। নবজিৎ ডিম খায় না। সে ডিমটা নিয়ে উদয়শঙ্করের থালে দিল।
– তোমরা হলে যুবক, তোমাদেরই তো খাওয়া আমার থালে দিলে যে?
–' দাদা, আপনি আমার রুমমেট, সেই জন্যই আমি না খাওয়া ডিমটা আপনার প্রাপ্য।
নবজিতের মন্তব্যে উদয়শংকর কেবল রসই পেল না, আন্তরিকতাও দেখতে পেল।
সকালের আহার-পর্ব সম্পন্ন হওয়ার পরে প্রস্তুত হয়ে থাকা গাড়িতে উঠার জন্য দলটিকে দুটো ভাগে ভাগ করা হল। কাজিরাঙ্গায় ভাগ করার মতো। সাফারি গাড়ি দুটির সামনের দিকের আয়নায় গন্ডার এবং গৌড়ের স্টিকার লাগিয়ে সেইমতো বিভাজিত দল দুটিকে বসানোর ব্যবস্থা করা হল। অন্য গাড়িটি একটি টাটা সুমো। সুমোটিতে উদয়শংকর,সৌম্যদা, রাকেশ, রবীন এবং রাধুনি পরমা ছোয়াছিল বসল। পরমার উপাধিটি উদয়শংকরকে খুবই আকর্ষণ করল।ছোয়াছিল নামের উপাধি উদয়শংকর আগে শোনেনি । চালকের আসনে প্রত্যেকেরই প্রিয় মতি নামের চলকটি। সুমোটিতে দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে আসা হয়েছে । রন্ধন এবং ভোজন-পর্ব হবে মথনগুরির ' আপার বাংলো'র রন্ধনশালা এবং ভোজন কক্ষে।
মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যের ভেতর প্রবেশ করবার জন্য প্রয়োজনীয় বিভাগীয় কাজকর্মটুকু সৌম্যদা মূল প্রবেশ দ্বারে সম্পন্ন করে নিল। মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যে প্রবেশ করার জন্য প্রতিটি ভারতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে প্রবেশ কর হিসেবে পঞ্চাশ টাকা এবং প্রতিটি গাড়ির জন্য দেড়শ টাকা ধার্য করা হয়েছে। সেইসব দেওয়ার কাজ সৌম্যদার। আমরা প্রত্যেকেই শিবিরের জন্য নির্ধারিত মাশুল শিবিরে আসার পরে জমা দিয়ে লেনদেন থেকে অবকাশ পেয়েছি ।
মূল প্রবেশপথটা পার হওয়ার পরে দলটিকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য অপেক্ষা করে থাকা উঁচু উঁচু গাছের প্রকৃতি সৃষ্ট ভালোবাসার তোরণের মধ্য দিয়ে তিনটি গাড়ির শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল। বরপেটা রোড থেকে ফতেমাবাদ চা বাগিচার মধ্য দিয়ে ভুটান অভিমুখে মূল পথটা মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্য হয়ে এগিয়ে গেছে। পথটা গাড়ি চলাচলের জন্য যথাযথ। কিছুদুর যাবার পরে গাড়ির সারিটা ডানদিকে একটা মোড় নিয়ে এগিয়ে গেল। আরও কিছুদূর যাওয়ার পরে গাড়ির গতি বাঁদিকে ধাবমান হল। ঘনঘন গাছপালা ফেলে রেখে পথের দুপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে উঁচু উঁচু ঘাসবন। ঘাসগুলি উঁচু বলে দলটির চোখে কোনো জন্তু আদি না পড়াটাই স্বাভাবিক। দলটি মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্য দেখতে গেছে। নিদৃষ্ট জন্তু বা পাখির প্রতি অন্তত আজ তাদের কোনো দুর্বলতা নেই। সেজন্য কোনো জন্তু না দেখা অথবা দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ তাদের নেই।
কিছুটা আসার পরে দলটা এসে বুড়াবুড়ি নিরীক্ষণ টাওয়ার পেল। সাধারনত এই নিরীক্ষণ টাওয়াটার আশেপাশে হাতি দেখতে পাওয়াটা নাকি নিতান্তই স্বাভাবিক কথা। কিন্তু এখানেও প্রকৃতি কর্মীদের নৈরাশ্য সঙ্গ দিল। দুটো দলের নেতৃত্বে থাকা রাকেশ সাউদ এবং গোলাপ গগৈ দল দুটিকে হাতির বিষ্ঠা, হাতি কীভাবে গাছে গা ঘষে শক্তি প্রদর্শন করে ইত্যাদি দেখানো ছাড়াও কাঁচা মাটিতে ছাপ বসিয়ে যাওয়া বিভিন্ন জীবজন্তুর পদক্ষেপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।উপস্থিত প্রকৃতি কর্মীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের নিজের জ্ঞান ভান্ডার বৃদ্ধি করায় যত্নবান হল।
উদয়শঙ্কর ক্যামেরার সাহায্যে জন্তুর পদক্ষেপের আলোকচিত্র নিল। পরবর্তীকালে এই ছবিগুলি কাজে আসতে পারে।
বুড়ো বুড়ি নিরীক্ষণ টাওয়ার থেকে এসে প্রকৃতি কর্মীর দলটি মফো নিরীক্ষণ টাওয়ারে পৌঁছালো। টাওয়ারটিতে থাকা বনকর্মচারীরা টাওয়ারের সামনে উঁচু উঁচু আধা শুকনো আধা কাঁচা ঘাস গুলিতে আগুন ধরিয়েছিল।সেটা তাদের নিয়মমাফিক কর্তব্য।নিরীক্ষণ টাওয়ারে উদয়শঙ্কর কোনো বিশেষত্ব দেখতে পেল না। সেখানে কোন বিশেষত্ব ছিলনা বলে সৌম্যদা সাধারণভাবে নিরীক্ষণ শিবিরটা প্রকৃতি কর্মীদের দেখিয়ে গাড়ির চালক কয়জনকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিল ।
মফোর পরে কুড়িবিল নিরীক্ষণ টাওয়ার হয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল উশিলার মধ্য দিয়ে রয়শিংলায়।
এই নিরীক্ষণ টাওয়ারটির কোথাও কোনো নাম ফলক দেখতে পাওয়া যায় না । উদয়শঙ্কর তাদের সঙ্গে যাওয়া রবীনের মুখ থেকে জায়গা গুলির নাম জেনে বুঝে নিয়েছে । সেই জন্য নামের উচ্চারণ এবং বানানের মধ্যে থাকতে পারা বিভ্রাট উদয়শঙ্করের মনে সন্দেহ জাগাল। প্রকৃতি প্রেমীরা আসতে থাকা পথটি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে যাবার পরে দেখতে পেল পথটা জার্মান বন এবং অন্যান্য বনলতায় প্রায় আবৃত। মতি চালানো সুমোটা পেছনের গাড়ি দুটির জন্য পথ কেটে কেটে যাচ্ছে। অন্যান্য প্রকৃতি পর্যটকরা এই পথটি ব্যবহার করে না। মতি আশা করেছিল অক্টোবর মাসের কোমল হতে চলা রোদ্দুরের মজা নেবার জন্য বাঘ বা অন্য কোনো বিড়াল জাতীয় প্রাণী পথটির উপরে শুয়ে বসে সময় কাটাবে। পথটির দু'পাশে মাঝেমধ্যে মুক্ত অঞ্চল এবং মাঝেমধ্যে অটব্য অরণ্য। গাড়ি তিনটি ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। কাজিরঙ্গার মতো কোথাও কোনো জন্তু উদয়শঙ্কর অথবা প্রকৃতিপ্রেমীদের দেখতে পাওয়া যায়নি।সত্যি কথা বলতে গেলে মানস রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্যে বসবাস করা বন্যপ্রাণীদের জন্য পর্যটককে মজা দেবার কি আর গরজ পড়েছে। তারমধ্যে একজোড়া বন্যমোরগ দলটিকে মুহুর্তের জন্য দেখা দিয়ে অরণ্যের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
প্রকৃতিপ্রেমীর দলটি ধীরে ধীরে গন্তব্য স্থল মথনগুরিতে এসে পৌঁছালো। কুলু কুলু ধ্বনিতে মানস নদীটা পাহাড় থেকে সমতলে শিলাময় বক্ষের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। কিছুটা দূর থেকে ভেসে আসা নদীর সুললিত কুলু কুলু ধ্বনিতে প্রকৃতিপ্রেমিকদের নদীর কাছে যাবার নিমন্ত্রণ জানাল– এসো, এসো। আমার কাছে এসো।
গাড়ি তিনটা থামার সঙ্গে সঙ্গে তিনজন প্রকৃতি কর্মী মানস নদীর দিকে ধাবিত হল। কে কাকে পায়!
চোখের সামনে স্ফটিকের ধারের মতো শীতল জল বিধৌত নদীর প্রবাহমান ধারা। জুতো স্যান্ডেল খুলে সেই নদীর বক্ষ স্পর্শ করার মজা কে না গ্রহণ করবে! নদীর বক্ষে সেবলা দিয়ে তৈরি ঘর ছোট বড় পাথরে অক্ষয় শৈল ভান্ডার। সেই পাথরে পা রাখা যায় না, পা রাখলেই পিছলে পড়ার আশঙ্কা। সাবধান না হলে বিপদ ঘটার পূর্ণ সম্ভাবনা থাকে।
প্রথমেই সৌম্যদা একটা পাথরে বসে জুতো জোড়া খুলে একপাশে রেখে দুটো পা নদীর জলে ভিজিয়ে নিল। উদয়শঙ্কর, কিশোর, জ্যোতিপ্রসাদরাও পেছনে পড়ে থাকল না। তারাও জুতো খুলে পা টিপে টিপে জলে নেমে পড়ল।
বরফ শীতল জল উদয়শঙ্করের দুটো পা স্পর্শ করায় শীতল শিহরন তার শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল। কঙ্কণা এবং মৃদুস্মিতা ভয়ে ভয়ে জলে নামল। বয়সে ছোট হলেও নিষ্ক'মনার মতো সাহসী। নবম শ্রেণীর ছাত্রী কিন্তু দেখতে মহাবিদ্যালয়ে পড়া মেয়ের মতো মনে হয়। উঁচু লম্বা।
– ঐ ছোট্ট মেয়ে।
সৌম্যদার কণ্ঠস্বরে সে ঘুরে তাকাল।
— একেবারে সাবধান। না হলে সাগরে পৌঁছে যাবি।
নিষ্কমনা সাবধান হল। সে তার সঙ্গে আসা মা ভারতীর বাঁ হাতটা খামচে ধরল। মায়ের মুখমন্ডল দেখতে ভয়ার্তের মতো মনে হচ্ছে। তথাপি মানসের জলের আকর্ষণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ইচ্ছা মা-মেয়ের নেই।
অদূরে গাছপালায় সবুজ হয়ে থাকা ভুটান রাষ্ট্রের রাশি রাশি উচ্চ বেটে পর্বতমালা উদয়শঙ্কর বসে থাকা পাথরটা থেকে দিগন্তের দিকে চোখ তুলে তাকাল। কী এই প্রকৃতি,কী এই পৃথিবী। খন্ড খন্ড সাদা মেঘের মধ্যে শরৎকালের নৈসর্গিক বন্দনা। মানুষের চিন্তার সীমার পরিধির ওপারে কি অপরিচিত বাস্তব । ভাবতে ভাবতে উদয়শঙ্কর দিশাহারা হয়ে পড়ে । নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে হয়ে পড়ে শঙ্কিত। কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আমরা এই চরাচরের জগতে। অথচ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মাপে মানুষই শক্তিধর ।
নদীর সান্নিধ্য ছেড়ে প্রকৃতি কর্মীরা এসে নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হল। উদয় শংকর চিন্তার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে তাদের সঙ্গ ধরল। নদীর বালিচরে থাকা পাথর গুলি হল তাদের জন্য বসার আসন । নদীর খাড়াই থেকে জলের ঘাট পর্যন্ত উঁচু থেকে নিচু ক্রমান্বয়ে পড়ে থাকা পাথরগুলি প্রাকৃতিক গ্যালারি রূপ লাভ করেছে ।
সৌম্যদা উপস্থিত প্রত্যেককে প্রকৃতির বিষয়ে প্রাথমিক ধারনা দেবার জন্য নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।কাজিরাঙ্গায় অনুষ্ঠিত হওয়া প্রকৃতি শিবিরেও তিনি এই ধরনের বক্তব্য রেখেছিলেন। অসমের জনজাতীয় সমাজ এবং পরম্পরাগত ধারণায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করার জন্য প্রয়াস করে তিনি বলেছেন – জনজাতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বা জনজাতীয় সমাজে পরম্পরাগত ভাবেই রাভাদের প্রত্যেক পরিবার কিছু না কিছু একটা বন্য প্রাণীকে তাদের বংশের কেউ বলে বিশ্বাস করে এবং সেই বন্য প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করে না। কেবল স্তন্যপায়ী প্রাণীই নয় স্থানীয় মাছের ক্ষেত্রেও এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সক্রিয়। বর্তমানের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হয়েও আমাদের আধুনিক সমাজ তথা সরকার স্থানীয় মাছ সংরক্ষণের ওপরে যতটুকু গুরুত্ব দেয়নি পরম্পরাগত ভাবে আমাদের জনজাতীয় লোকেরা তাদের সমাজে সামাজিক বিধির মাধ্যমে সেই গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক কথাটা হল আমাদের জনজাতীয় পরম্পরাগত সংরক্ষণ প্রক্রিয়া গুলি আমাদের আধুনিক সমাজে সংরক্ষন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবেশিত নয় তার পরিবর্তে বিদেশী কোনো শ্লোগানকে জনপ্রিয় করার জন্য আমরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে পড়ি।
সৌম্যদার কথার সঙ্গে নদীর কুলু কুলু ধ্বনি বাদ্য সঙ্গত করছে এবং উপস্থিত প্রকৃতি কর্মীরা অতি মনোযোগের সঙ্গে শুনে চলেছে তার বক্তব্য। প্রসঙ্গত সৌম্যদা উল্লেখ করছে' অসমের মানুষ নিজের আনন্দ,অহমিকা, বীরত্ব বা প্রমোদের জন্য বন্য প্রাণী হত্যা করেনি।'
সৌম্যদা বলে চলেছিলেন– ব্রিটিশ যখন অসমে এসে বসতি স্থাপন করছিল সেই সময়ের অসমের মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর সম্পর্কের কথা লিখিত রূপে পাওয়া যায় না। কেননা সেই সময়ের লেখকরা বন্যপ্রাণীকে ততটা গুরুত্ব দিত না। কিন্তু দুই একজন ব্রিটিশ লেখকের লেখা থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে সেই সময়ের অসমে শিকারের প্রচলন ততটা প্রকট ছিল না। সে রকমই একজন ব্রিটিশ লেখক হলেন প্যাট্রিক হেনলি। প্যাট্রিক হেনলি লেখা ' টাইগার ট্রেটস ইন আসাম' নামের বইটিতে আমরা তার স্পষ্ট প্রমাণ পাই। বইটির এক জায়গায় প্যাট্রিক হেনলি লিখেছেন যে 'ছিয়নী,কুমাও, মহীশূর বা অন্যান্য অঞ্চলে আমি দেখার মতন মানুষ নিজের অহমিকা চরিতার্থ করার জন্যই নিষ্ঠুর অত্যাচার এবং নিধনের দ্বারা বন্যপ্রাণীদের ক্রুদ্ধ করে তোলার পরিবেশ অসমে নেই।' প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত বন্যপ্রাণীর থেকে দুই একটিকে নিজের প্রয়োজনে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা আলাদা কথা কিন্তু ব্যক্তিগত আনন্দে আত্মহারা হওয়ার মানসে বন্য প্রাণীকে নির্বিচারে হত্যা করে আনন্দ লাভ করা অসমিয়ার পরম্পরা কখনও ছিল না। আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই এই সত্যকে উপলব্ধি করেছিল যে জল,বায়ু, মাটি , অরণ্য বন্য প্রাণী এবং মানুষের সমন্বয়ে তথা একে অপরের পরিপূরক হয়ে থাকলে পৃথিবীতে জীবন প্রবাহ অনুকূল হয়ে থাকবে। মানুষকে স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতির এই সত্তাকে যতনে রক্ষা করে চলতে হবে।
উপস্থিত প্রকৃতি কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সৌম্যদার বক্তব্য ছিল অতীব অনুপ্রেরণামূলক।
সৌম্যদার পরে গোলাপ গগৈ এবং রাকেশ সাউদ পুনরায় প্রকৃতি শিবিরের জন্য নির্দিষ্ট করা পাঠ এগিয়ে নিতে লাগল।
গোলাপ গগৈ পক্ষী নিরীক্ষণের প্রসঙ্গে নিজের বক্তব্য রাখার বিপরীতে রাকেশ সাউদ হস্তী সংরক্ষণ এবং হস্তী মানুষের সংঘাতের ওপরে তথ্য সহকারে ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করল। প্রকৃতি কর্মী প্রণব কুমার ভাগবতীকে প্রজাপতির বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা কী ধরনের, কীভাবে প্রজাপতিদের অধ্যয়ন করা যেতে পারে তার ওপরে মন্তব্য রাখার জন্য সৌম্যদা অনুরোধ জানাল। প্রণব স্বভাবসিদ্ধ বাক ভঙ্গিমায় প্রজাপতি বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞান দান করার জন্য তার বক্তব্যে প্রজাপতির বিচিত্র জগতটি অতি অপূর্ব এবং মনোমুগ্ধকর বলে অভিহিত করল।
প্রণব বলে গেল– রংবেরঙের উড়ন্ত প্রাণীরা প্রকৃতিকে সুজলা সফলা কবে তোলায় অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রজাপতির সাহায্যেই ফুলে পরাগ যোগ সম্ভব হয় এবং উদ্ভিদের বংশবিস্তার হওয়ায় তা কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
প্রজাপতির প্রতি প্রকৃতি কর্মীদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রণব চেষ্টা করছে। প্রকৃতি কর্মীদের মধ্যে প্রজাপতি সম্পর্কে না জানা সদস্যের সংখ্যাই বেশি। এই দুই কুড়ি চারজন প্রকৃতি কর্মীর নিরলস সাধনাকে মানুষ নদীর উপর দিয়ে ঝিরঝির করে বইতে থাকা শীতল বাতাস স্বাগত জানালো।তার মধ্যে প্রত্যেকের চোখ মানস নদীর ওপারের ঘন জঙ্গলে নিবদ্ধ। কে জানে হয়তো হাতি বা মোষ বের হয়। রাকেশ ইতিমধ্যে দলটিকে জানিয়ে রেখেছে যে সামনের অরণ্যের মাঝখান থেকে হাতি বা মোষের দল বেরিয়ে এসে মানস নদীতে জল কেলি করে।
প্রকৃতি বিষয়ক পাঠদানের শেষে এখন আরম্ভ হবে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। মথনগুরির ' ফরেস্ট বাংলো'টা পাবার জন্য প্রকৃতি কর্মীরা ছোট টিলা একটিতে বেয়ে উঠতে হচ্ছে। টিলাটি বেয়ে উঠার সময় নবজিৎদের উৎসাহের অন্ত নেই । কেউ প্রজাপতির ফটো নিচ্ছে কেউ অপরিচিত ফুলের । প্রণব একটি ফড়িংয়ের আলোকচিত্র নেবার জন্য ফড়িং এর পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। সময়ের হিসেবে দুপুরের খাবার সময় হয়েছে।
প্রকৃতিক কর্মীরা ছোট টিলাটি বেয়ে মথনগুরি 'ফরেস্ট বাংলো'য় উপস্থিত হল। দোতলা বাড়িটা একেবারে নদীর তীরে অবস্থিত। একটি প্রকাণ্ড পাথরের প্রাচীর দিয়ে নদী থেকে ডেকে নিয়ে বাড়িটা নদীর বুকে একপাশে তৈরি করা হয়েছে বলে বাড়িটির ভিত ছুঁয়ে নদীর জল বয়ে চলেছে। বাড়িটা দেখতে পুরোনো বলে মনে হচ্ছে। বাড়িটার গায়ে হয়তো কয়েক বছর ধরে কারো হাত পড়নি। উদয়শঙ্কর দেখতে পেল দোতলা বাড়িটিতে কয়েকটি ঘর রয়েছে। ঘরগুলি থেকে নদীটি এবং প্রকৃতির বিনন্দীয়া রূপ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।বাড়িটির প্রতি কর্তৃপক্ষ উদাসীন বলে বাড়িটি তার রূপ সৌন্দর্য হারাতে চলেছে। ,
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন