স্মৃতিকথা- ২০
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
( গত মাসের পর)
।। ২০।।
ক্লাস টেনে থেকে স্কুলে প্রচারিত হয়ে গেল আমি কবিতা লিখি, গান লিখি সুর দিই আর গাই । ছেলেরা আমাকে বেশ অবাক চোখে দেখতো । প্রতিদিন টিফিনের সময় আমার গান আর রবিনের বেঞ্চ বাজনা শুরু হয়ে যেত । মজা নিত সহপাঠীরা । এ যেন প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তাদের । ক্লাস টেনে স্কুলের সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ক্লাসের উৎসাহে আমি গানে নাম দিলাম । গাইলাম আধুনিক গান, সেই পুজোর বিখ্যাত গান ' এই যে নদী যায় সাগরে ' । পেয়েছিলাম দ্বিতীয় পুরস্কার । আমার তখন সে কি আনন্দ! পুরস্কার পাওয়ার পর বাড়িতে দেখালাম । বাবা মা আনন্দ পেলেও সামনে তেমন প্রকাশ করেনি । কারণ সামনে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা । সত্যি সত্যি তখন আমাকে উচ্ছ্বাস দেখানো সাজে না ।
তখন মেদিনীপুর শহরকে ভালো করে চেনার চেষ্টা করছি । ছোটবেলায় যখন এ শহরে থাকতাম তখন যে যে জায়গায় ঘুরেছি সেগুলো দেখতে দেখতে খুব ছোটবেলার কথা মনে হত । দেখতাম হাতিশালার গলিতে সেই গনেশ দাদুনের বাড়ি । তার মুদি খানার দোকান । সেখানে বাদল কাকু ঘোর ব্যবসায়ী হয়ে বসে আছে ।আমাকে সে চিনতে পারে না। আমিও পরিচয় দিতাম না। সেই অলিগন্ঞ্জ প্রাইমারি সামনে দিয়ে যেতে যেতে নস্টালজিয়া গ্রাস করতো ।
মনে পড়ে যেত ছোটবেলায় বাবার সাইকেলের হাতলে বসে প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া । রাজনারায়ণ লাইব্রেরির সামনে ছোট্ট পার্কেদিদিদের সঙ্গে স্লিপে চড়া । একবার স্লিপের এক জায়গায় ভাঙা ছিল । সেখানে কেটে গিয়ে কি রক্তারক্তি কান্ড । গনেশ দাদুনের বাড়িতে বোলতার কামড়ে হাত ফুলে ঢোল হয়ে গেল । মা স্রেফ চুন দিয়ে সারিয়ে দিল । মনে আছে তখন রাজনারায়ণ লাইব্রেরির একটু দূরে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে । আমি পকেট ভর্তি করে নুড়ি পাথর তুলে আনতাম । বাড়িতে সেই পাথর নিয়ে এসে খেলতাম । আজ সে সব অতীত । মনে মনে হাসিও পায় । তখন আমার কাছে পৃথিবী কত ছোট ছিল! আর সেই ক্লাস টেনের এই আমি চরিত্রটি বুঝতে পারছে শুধু খেলাধূলা মজা নয়, বাস্তব বলেও একটা জিনিস আছে । সে বড় কঠোর । রাস্তাঘাট মানুষজন সে বাস্তব আমায় শেখায় । স্কুলের টিচারবর্গ আমাদের এই কঠোর বাস্তবের কথা শোনায় ।বলেন পড়াশোনা কর, না হলে কোন উপায় নেই । বিভূতি মুখোপাধ্যায় নামে আমাদের ক্রেমিস্ট্রি টিচার বলতেন, দেখবি তোরা ক' দিন বাদে পাঁচ ছ টাকাতে চাল পাবি না ।কুড়ি টাকা দিয়ে কিনতে হবে । মন দে পড়াশোনাতে । কলেজে উঠে পাস করে চাকরির চেষ্টা কর। না হলে খেতে পাবি না । কথাটা যে কত বড় সত্য, তা আজ বুঝিয়ে বলতে হবে না ।
সে সময় বাবা মা-র দুঃখ বোঝার মতো মন ছিল না। তারা আমাকে কঠিন বাস্তবের সামনে দাঁড়াতে দিত না। আমি বুঝতাম না বাবা মাস মাইনে যা পেতো তাতে কিভাবে আমাদের চলতো । ফলে আমি স্বাধীনভাবে কল্পনা করতে পেরেছি । ছোটবেলা থেকে অন্নচিন্তা চমৎকারা ঘিরে ধরেনি । বাবা মা শুধু চাইতো আমি যেন পড়াশোনা করে পাসটা করে যাই , আর একটা চাকরি পাই । সেই সঙ্গে পরিপূর্ণ ভদ্রলোক হই । মা বাবার ভেতরে অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে , খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়েছে । কিন্তু কেউ কাউকে অশ্লীল কথা বলেনি । তাই বাজে কালচার আমার মধ্যে ঢুকতে পারেনি । না হলে ভবিষ্যৎ হয়তো অন্য ধারায় যেতে পারতো ।
ভালোই চলুক। ভাই নৃপেন
উত্তরমুছুন