হে আমার স্বদেশ- ১৭
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(১৭)(১৭)
সাহিত্যিক সম্বন্ধীদের সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া বিতর্কে বিজয়ী হওয়ার পরেও লক্ষীনাথের মনে যে ক্ষোভ মন খারাপের সৃষ্টি হয়েছিল, অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার চন্দ্রমোহন গোস্বামী দেবের সঙ্গে কথাবার্তা হওয়ার পরে সেই ক্ষোভ এবং মন খারাপ নাই হয়ে গেল। আসলে, গোস্বামী দেবের কথাবার্তা থেকে লক্ষ্মীনাথের সংগ্রামী সত্তাটা আন্তরিক সমর্থন লাভ করল । এবার সে আগের চেয়ে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করল যে একজন মানুষের পরিচয়ের অন্যতম প্রধান উপাদান দুটি হল তাঁর মাতৃভূমি এবং তাঁর মাতৃভাষা। তাই মাতৃভাষার সম্মান– স্বতন্ত্রতা রক্ষা করাটা প্রত্যেকের জন্য একটি পবিত্র কর্তব্য।
গুরুদেবকে বিদায় দেওয়ার পরে লক্ষ্মীনাথের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যেতে ইচ্ছা হল।তাঁর বাড়ির কথা মনে পড়ল। আকুল ভাবে বাবার কথা মনে পড়তে লাগল, মা, দাদা, বৌদিদের কথা মনে পড়তে লাগল। সত্যিই সে বড় অস্থির হয়ে পড়ল। সেদিন গুণাভিরাম বরুয়া ঠিকই বলেছিলেন, পুরোনো চিন্তা ভাবনা নিয়ে চলা মা-বাবারা ক্ষোভ অভিমান নিয়ে থাকলেও শিক্ষার সংস্কৃতির আলোকে এগিয়ে যাওয়া লক্ষ্মীনাথের অনুরূপ আচরণ করা ঠিক নয়, করাটা উচিত নয়। আজ গোস্বামীদেবও প্রায় একই সুরে উপদেশ দিলেন। তাই বাড়ি যেতে হবে। খুব শীঘ্রই শিবসাগরে যাত্রা করবে।
বিকেলে ঠাকুরবাড়িতে এল। প্রজ্ঞা তার জন্য' জলখাবার' নিয়ে এল। ফুলকো লুচি আর চাটনির সঙ্গে দুটো সন্দেশ খেয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' পরি আমি বাড়ি যাব ঠিক করেছি।'
' বাড়ি!'
' মানে আসামে, আমাদের বাড়ি–।'
' কবে?'
' কালকেই।'
' আমি, আমি যাব না তোমার সঙ্গে?'
' আগে আমি গিয়ে বাড়ির পরিবেশ- পরিস্থিতিটা বুঝে আসি। তারপর তোমাকে নিয়ে যাব ।'
'বাড়ির পরিস্থিতি! বাড়ির পরিস্থিতি কি আমার জন্য অনুকূল নয়?'
' না, কথাটা হল– আমাদের বিয়েটা বাড়ির সবার অমতে হয়েছিল কিনা–।' লক্ষ্মীনাথ বিব্রত, কিছু পরিমাণে অস্থির।
' বাড়ির সবাই আমাকে স্বীকার করে নিতে পারে কিনা, এই নিয়ে তুমি খুব চিন্তিত, তাইতো?'
' চিন্তিত মানে আমাদের বাড়ির কেউ তোমাকে কিছু শোনাবে, সেসব শুনে তোমার খারাপ লাগবে, তুমি কষ্ট পাবে, এটাতো আমার ভালো লাগবে না।'
' কেউ কিছু শোনাবে! আমি কি অন্যায় করলাম যে–?'
' ওহো, তুমি কোনো অন্যায় করনি। তোমার কোনো অন্যায় হয়নি। আমারই দুর্ভাগ্য যে আমাদের বাড়ির মানুষ তোমাকে সসম্মানে গ্রহণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার মনে আশঙ্কা জাগছে ।'
' এ তোমার দুর্ভাগ্য নয়। আমারই পোড়া কপাল যে আমাকে বিয়ে করে তোমার এত কষ্ট হয়েছে। আমি তোমার দুর্ভাবনার কারণ হয়েছি।'
এই সমস্ত কথা দুজনের জন্যই গ্লানি দায়ক। দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে। বিশেষ করে লক্ষ্মীনাথ, অসহায় একটা যন্ত্রনা গলা পর্যন্ত উজিয়ে আসছে। যন্ত্রণাটা তার কণ্ঠরোধ করতে লাগল। অসহায় কন্ঠে লক্ষ্মীনাথ বলল,' অমন করে বল না, লক্ষ্মীটি। বুকে বড় লাগছে।'
কিন্তু প্রজ্ঞা আশ্বস্ত হল না। বিয়ের পরে বিগত কয়েকটি মাসে দুজনের মধ্যে এই ধরনের নিবিড়তার সৃষ্টি হয়েছে যে লক্ষ্মীনাথ না খেলে সে খেতে পারে না, লক্ষ্মীনাথ সঙ্গে না থাকলে রাতে তার চোখে ঘুম আসে না। লক্ষ্মীনাথ অসমে চলে গেলে দিনগুলি কীভাবে পার করবে? প্রজ্ঞার মুখে কালো মেঘ নেমে আসে।
' ঠিক আছে। তুমি তোমার মায়ের কাছে যাবে, আমি তো আর তোমাকে বারণ করতে পারব না। কিন্তু মায়ের আদরে তুমি যেন আমাকে ভুলে যেও না।'
' তোমাকে ভুলে যাব! এ কী বলছ পরি! বাড়ি গেলেও তোমার কথা, তোমার চালচলন, তোমার হাসি, তোমার নাকের পাশা, স্নান করে আসার পর তোমার ভেজা চুল থেকে ঝরে পড়া বিন্দু বিন্দু জল, তোমার কোমল কোমল আঙ্গুল, তুমি দেওয়া জল খাবার, দুপুরের আহার সাজিয়ে দিয়ে আমার পাশে পাখা নিয়ে বসা, তুমি সাজিয়ে দেওয়া কোমল বিছানা… এসব, এসব কি কখনও ভুলতে পারব?'' কাব্য কথা বলে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ!'
' কাব্য এমনিতেই সৃষ্টি হয় না,পরি। তাছাড়া আমি কবি নই। কাব্যরস পান করে আনন্দ পাই যদিও রবি কাকার মতো কবিতা লিখতে পারি না। কিন্তু তোমার যে ভালোবাসা পাই, তুমিই আমাকে কবি করে তুলেছ।'
ম্লেচ্ছ ব্রাহ্মণ কন্যাকে পত্নী বলে গ্রহণ করার জন্য লক্ষ্মীনাথ পতিত হল, এখন সে মা-বাবার কাছে ত্যাজ্য পুত্রের মতো, খারাপ পেয়ে দাদা গোবিন্দচন্দ্র যোগাযোগ রাখেনি, এমনকি একটা খবরও নেয়নি। এরকম একটি অবস্থায় লক্ষ্মীনাথ বাড়ি ফিরেছে। রায় বাহাদুর গুণাভিরাম এবং চন্দ্র মোহন গোস্বামীদেব যতই আশ্বাস দিক না কেন, বিশেষ করে বাবা ঘরের মেঝেতে তাকে পা রাখতে দেবে কিনা এবং দিলেও ক্রোধ উত্তেজনায় কিরকম ব্যবহার করবে ইত্যাদি ভেবে ভেবে দুশ্চিন্তায় ভারী মন নিয়ে শিবসাগর এসে পৌছাল। তাকে দেখে ঘরের কার কিরকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে, কী পরিস্থিতিতে কী রকম ব্যবহার করবে… এসব নিয়েও ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে খবর না দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল।
কিন্তু লক্ষ্মীনাথকে দেখে বাড়ির কেউ মুখ ফিরিয়ে নিল না, কেউ গালিগালাজ করল না, এমনকি কেউ যে অসন্তুষ্ট হয়েছে তাও মনে হল না। বরং এতদিন পরে তাকে দেখা মাত্র বাড়ির সবাই আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল। ভাইপো ভাইঝিরা তাকে দেখে' কাকু এসেছে' বলে চিৎকার করে উঠল। দুই বৌদিও হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। তারপরে পিতা দীননাথ এবং মা ঠানেশ্বরীও হারানো পুত্রকে ফিরে পেয়ে ক্রোধ ক্ষোভ ভুলে গিয়ে ভীষণ আনন্দিত হল।
বাড়ির মানুষদের হল কী? তারা এরকম ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি! এটা স্বপ্ন না বাস্তব? লক্ষ্মীনাথ বিমূঢ় হয়ে পড়ল। বোবা দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকাল।
আসলে, বৈষ্ণব ধর্মের নৈষ্ঠিক আচারে সমর্পিত দীননাথ মহাশয়ের একটি মহৎ গুণ আছে। তিনি যেকোনো বিষয়ে গভীর চিন্তা করে নিজের মনে বিচার করে সারটা গ্রহণ করতে পারেন। ইতিপূর্বে কয়েকবারের এর প্রমাণ দিয়েছেন এবং কষ্ট হলেও, মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও এবারও তিনি তাই করলেন। তবু একটি কথায় লক্ষ্মীনাথের মনে একটি সংশয় জাগল। একটা সময়ে যে মানুষটি ব্রাহ্মদের মোটেই দেখতে পারতেন না, ছেলে ব্রাহ্ম মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে জানতে পেরে উকিল কালীপ্রসাদ চলিহা এবং অন্যান্য বহু ব্যক্তিকে ডাকিয়ে এনে ঠাকুর পরিবারের অভিভাবকদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করার পরিকল্পনা করেছিলেন; সেই ব্যক্তি কোনো ধরনের প্রায়শ্চিত্ত না করিয়ে, ঠাকুর পরিবারের বিরুদ্ধে একটাও কটু কথা না বলে অথবা গালিগালাজ না করে, এত দ্রুত ছেলেকে গ্রহণ করলেন। এটা কি আত্মবিশ্লেষণের দ্বারা মানসিক উত্তরণ না হেডমাস্টার গোস্বামী দেবের বক্তব্য অনুসারে পিতার অন্তরের অবোধ অনাবিল অপত্য স্নেহ ?
প্রত্যেকেই সহজ ভাবে কথাবার্তা বললেও লক্ষ্মীনাথ নিজে অনেকক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারল না।
বড়ো বৌদি হাসতে হাসতে বলল,' শেষ পর্যন্ত বাঙালি একজনকে নিয়ে এলে! খুব সুন্দরী বোধ হয়!'
' হ্যাঁ, সুন্দরী।'
' তার রূপ তোমাকে এতটাই মোহিত করেছে যে আমাদের ভুলে থাকলে!'
' আমি তোমাদের ভুলে যাইনি।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' আর ভুলে যাইনি বলেই তোমাদের দেখতে এসেছি।'
' তবে বিয়েটা যে আমাদের বাদ দিয়েই করলে!'
' তোমরাই আমাকে এভাবে বিয়ে করতে বাধ্য করেছ।'
' আমরা বাধ্য করেছি! আমরা কীভাবে বাধ্য করলাম, বলতো?'
' কেন, আমার মতামত না নিয়েই তোমরা আমার জন্য একটি মেয়েকে ঠিক করে ফেল নি কি!'
মেজ বৌদি অভিমান করে বলল,' তথাপি তুমি এভাবে বিয়ে করার জন্য আমরা তোমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছি!'
' এভাবে বিয়ে করতে আমারও খুব খারাপ লেগেছিল।'
বড়ো বৌদি পুনরায় বলল,' শোন লখী, তুমি নাকি ঠাকুরবাড়ির ঘরজামাই হয়ে আছ?'
এবার লক্ষ্মীনাথের রাগ হল। অথচ কিছুই বলল না। কেবল মুচকি হাসল।
যত্ন করে রাতের ভাত লক্ষ্মীনাথকে খেতে দিয়ে সরল মনের ঠানেশ্বরী বলতে লাগল,' যেদিন তোর বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর শিবসাগরে এসে পৌঁছাল, সেদিনই কথাটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। আমি আর তোর বাবা শোকে বিহ্বল হলাম । শহরের মানুষের মুখে নানান কথা শোনা গেল। বাঙালি পট্টিতেও তুমুল হুলুস্থুল লাগল। কলকাতার ঠাকুররা বাঙ্গালিদের শিরের মুকুট– এরকম একটি বাড়িতে অসমিয়া ছেলের বিয়ে! বিস্তৃতভাবে খবর নেবার জন্য কালীপ্রসাদ শিবসাগরের সিভিল সার্জন কলকাতার বাঙালি হেমচন্দ্র ব্যানার্জীর সঙ্গে দেখা করতে গেল।'
'আচ্ছা। দেখা করে এসে তোমাদের কী বলল?'
' কালীপ্রসাদ বলল, কলকাতার জোড়াসাঁকোতে কয়েকঘর ঠাকুর পরিবার আছে। তাদের মধ্যে দীনদরিদ্র কোনো পরিবারে নাকি তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে । কথাটা শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল ।'
'আর–। লক্ষ্মীনাথ মনে মনে মজা পেল, তোমরা তার কাছ থেকে আর কী কী শুনলে?'
' ডাক্তার সাহেব বললেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারে যদি বিয়ে হয়ে থাকে– তাহলে সেই পরিবারে নাকি তোকে ঘর জামাই হয়ে থাকতেই হবে।' ঠানেশ্বরী বলল,' সত্যিই কি তুই ঘর জামাই হয়ে আছিস?'
লক্ষ্মীনাথের ভাতের গরাসটা গিলতে অসুবিধা হল। মায়ের দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,' আমাদের বংশের কেউ কখনও ঘর জামাই হয়েছে কি?
' না হয়নি। আমি জানি, তুইও ঘরজামাই হয়ে থাকতে পারবি না।'
' তাহলে কেন জিজ্ঞেস করছ?'
' লোকে যে বলে বেড়াচ্ছে।'
' লোকে অনেক কথাই বলে।' লক্ষীনাথের গলার স্বর চড়ল,' লোকে বললেই সত্যি হবে নাকি?'
' এত রাগ করিস না–।' স্নেহের কন্ঠে ঠানেশ্বরী বলল,' ভাতগুলি খেয়ে নে।'
লক্ষ্মীনাথ পুনরায় খেতে লাগল।
' এলি–।' কিছুক্ষণ পরে ঠানেশ্বরী বলল,' বৌমাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারতি!'
' ম্লেচ্ছ বলে তোমরা ব্রাহ্মদের ঘৃণা কর, আমার সঙ্গে বিয়ের বন্দোবস্ত হয়েছে জেনে ঠাকুরবাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য কালীপ্রসাদ কাকাকে দায়িত্ব দাও, রাগ করে কেউ আমার বিয়েতে গেলে না, বিয়ের পরে এতদিন পার হয়ে গেল, একটা খবরও করলে না; এরকম একটি অবস্থায় বউকে নিয়ে কীভাবে আসি?'
অভিমানের সুরে বলল। শেষের দিকে লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বর অবরুদ্ধ হয়ে এল। তার আর খাওয়া হল না। ভাতের থালায় জল ঢেলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
লক্ষ্মীনাথের বিয়ে নিয়ে শুধু শিবসাগরে নয়, যোরহাট এমনকি গোলাঘাটেও আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকে অনেক ধরনের সমালোচনা করেছিল, অনেক অপপ্রচার চালিয়েছিল। সে সবের অনেক কথাই লক্ষ্মীনাথের কানে এল।তাঁর খারাপ লাগল। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হল। শতবর্ষের অন্ধ সংস্কার এবং কুপমন্ডুকতা কাটিয়ে উঠে কবে যে এই সমস্ত মানুষ মানবতার মর্যাদা দিতে শিখবে? কথাটা দুর্ভাগ্যজনক। তবে উপায় নেই। এসবে গুরুত্ব না দিয়ে এক সপ্তাহ পরেই লক্ষ্মীনাথ কলকাতা যাত্রা করল।
বিয়েটা এভাবে করায় বাড়ির সবার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের মধ্যে একটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছিল। বাড়ির প্রত্যেকেই ভেবেই নিয়েছিল, লক্ষ্মীনাথ আর ফিরে আসবে না। কিন্তু সে যে এল, পুনরায় যে সবার সঙ্গে মিলন হল, তার জন্যই অন্যান্য বারের চেয়ে এবার বিদায় কালে প্রত্যেকেই আবেগিক হয়ে পড়ল। ছেলে বিয়ে করল, বৌমাকে আশীর্বাদও করতে পারল না, কথাটা ভেবে ঠানেশ্বরী চোখের জল ফেলল। বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে পড়া দীননাথও গভীর কন্ঠে লক্ষ্মীনাথকে বলল,' বৌমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসবি'... বাবার এই একটি মাত্র কথায় লক্ষ্মীনাথের মনের ক্রোধ,ক্ষোভ, মান-অভিমান জল হয়ে গেল। এবার লক্ষীনাথের মনে বিশ্বাস জাগল, বাবা ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে বিয়েটাকে স্বীকার করে নিয়েছে। তাই এরপরে প্রজ্ঞাকে নিয়ে আসা যেতে পারে। এখন বাড়িতে নিয়ে এলে প্রজ্ঞার অসম্মান হবে না।
পুনরায় যাত্রা। সেই একই পথ। একই ধরনের যান।
পুনরায় শিবসাগর থেকে দিছাংমুখ। দিছাংমুখ ঘাট থেকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনে টানা জাহাজে ব্রহ্মপুত্রের বুকে দীর্ঘ ভ্রমণ । লক্ষ্মীপূর্ণিমার দিন ব্রহ্মপুত্রের বালিচরের কাছে বাধা নৌকায় লক্ষ্মীনাথের জন্ম …. জাহাজে কলকাতা অভিমুখী হলেই লক্ষ্মীনাথের নিজের জন্মের কথাটা মনে পড়ে। সঙ্গে অসমের জনজীবনের প্রাণ ধারা ব্রহ্মপুত্র মহিমাময় এক রূপ নিয়ে তার সামনে উদ্ভাসিত হয়। চোখের সামনে ভাসতে থাকে শৈশবে বাবার সঙ্গে নৌকায় এই শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার সময় অপরূপ সেই দৃশ্য গুলি…।
একদিন সকালে নলখাগড়া এবং কাশবন থাকা ভেজা বালুচরে একদল বন্য মোষ দেখেছিল। মাঝিরা নদীর ওপারে নিয়ে যেতে চাইতেই মোষগুলি ভয় পেয়ে দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। বড়োদের সঙ্গে সমানতালে দৌড়াতে না পেরে চার পাঁচটা মোষের বাচ্চাকে পেছনে পড়ে দৌড়াতে দেখে লক্ষ্মীনাথের খুব ভালো লেগেছিল! ওদের ধরে লক্ষ্মীনাথের খুব আদর করতে ইচ্ছা করছিল। তারপরে নল-খাগড়ার ওপরে ছোট ছোট কাছিমের বাচ্চাকে দেখতে পেয়েছিল। নৌকার সামনে এলেই ওরা টুপ করে জলে ডুবে যেত। অপরূপ এই দৃশ্যগুলি দেখে লক্ষ্মীনাথেরও সেভাবে ডুব দিতে ইচ্ছে করছিল। আর ঐ যে– তীরের একটি ঝুপড়িতে থাকা বুড়োবুড়ি যে বাবাকে দেখেই ' বাবা মশাই' বলে ডেকে নৌকা থামিয়ে ঘুণ রোগের বৃত্তান্ত বলে ঔষুধ নিত…. নির্জন বালুচরে কুঁড়েঘর বানিয়ে ওরা সেখানে থাকত দেখে লক্ষ্মীনাথের শিশু মনটা দুঃখে কাতর হয়ে পড়ত। কেবল তাই নয়, নদীর দুটি তীরের চাষবাস, মাঠে চড়তে থাকা গরু- ছাগল, সবুজ গাছপালায় ভরা শান্ত জনপদ– সবকিছুর ওপরে বিশাল নীল আকাশ…।
এটাই অসম, এইসবই মাতৃভূমি অসমের প্রাকৃতিক রূপ। চির পরিচিত, অতি আদরের এই অসম থেকে সরে গিয়ে কলকাতায় থাকলেও লক্ষ্মীনাথের চেতনা- বোধ- সত্তায় এই সমস্ত দৃশ্যই ভেসে বেড়ায়। এইসবকে উপাদান রূপে নিয়েই সে মাতৃভাষার সেবা করে। ঠাকুর বাড়ির কন্যা প্রজ্ঞা সুন্দরীকে বিয়ে করার পরে সেই পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিবেশ, তাতে থাকা সাহিত্যকলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরদের প্রভাবে মোহমুগ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাভিমান এবং স্বকীয় ব্যক্তিত্বে সেই বাড়ির সাংস্কৃতিক প্রভাবের মোহ কাটিয়ে উঠলেও যে কিছুটা বাকি ছিল, এবার বাড়িতে এসে মা-বাবা আত্মীয়-স্বজনের স্নেহ ভালোবাসা ফিরে পেয়ে এবং অসমের প্রাকৃতিক রূপ- বৈচিত্র্যকে নতুন করে প্রত্যক্ষ করে সেই মোহও নাই হয়ে গেল। লক্ষ্মীনাথ তারপরে মনে মনে সংকল্পবদ্ধ হল, এমএ এবং আইন পাশ করার পরে হাইকোর্টের উকিল হয়ে মাতৃভাষার উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য আগের চেয়ে আরও বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেকে নিয়োগ করবে।
লক্ষ্মীনাথ এটাও জানে, অসম তথা ভারত বর্ষ এখন ইংরেজদের অধীন। কংগ্রেসের যোগদান করা বিনন্দ বরদলৈর ভাবধারা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে একমত হতে না পারলেও মাতৃভূমি যে অনন্তকালের জন্য বিদেশি শাসকের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে না, এটা সে অস্বীকার করে না। অসম তথা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাগবেই। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন জাতির উন্নতি। লক্ষ্মীনাথ ভাবে, মাতৃভাষার উন্নতিই স্বজাতির উন্নতি। মাতৃভাষার সেবাই হল দেশের সেবা, জাতীয় জীবনের আনন্দের বিজয় পতাকা এবং অসমের লুপ্ত গৌরবের পুনরুত্থান।
এভাবে সংকল্পবদ্ধ হয়ে যতই কলকাতার কাছাকাছি চলে এসেছে, ততই প্রজ্ঞার কথা মনে পড়ছে। এতদিনে ঠাকুরবাড়ির কয়েকজন নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে,তাদের চেয়ে প্রজ্ঞা আলাদা। প্রজ্ঞা পারিবারিক ঐতিহ্য- সংস্কৃতির অনেকখানিই পেয়েছে। লেখাপড়ায় তার আগ্রহ রয়েছে, অভিনয় করতে জানে, ছবি আঁকতে জানে, রন্ধন শিল্প ছাড়াও ঘরোয়া কাজে অভিজ্ঞ। তা বলে তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণে পরিবারের অন্যান্যদের মতো সাংস্কৃতিক অহমিকা নেই। কোনো ক্ষেত্রেই লক্ষ্মীনাথের ওপরে নিজের মত আরোপ করতে চেষ্টা করে না। কখনও নিজের মতে তাকে পরিচালিত করতে চায় না। সাহিত্য- শিল্পের প্রতি অনুরাগ তাকে যথার্থই সু-সংস্কৃত করেছে। বিয়ের পরে মিলনের আবেগে লক্ষ্মীনাথ ভেবেছিল, ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাদের মিলন, ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাদের এই যুগল জীবন। গত কয়েক মাসের দ্বৈত জীবনযাপন করে তার প্রমাণ পেয়েছে। সঙ্গে এটাও প্রতিফলিত হয়েছে যে তাদের মিলন ক্ষেত্রে ভাষা, ধর্ম, পারিবারিক ঐতিহ্য- পরম্পরা, ক্ষেত্রীয় আচার- সংস্কার গুলি কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। তাই প্রজ্ঞা যথার্থই তার জীবন সঙ্গিনী, প্রজ্ঞা তার জীবনী শক্তি, প্রজ্ঞা তার জন্য প্রেরণার এক উৎস। প্রজ্ঞাকে নিয়ে তার ঘরোয়া জীবনটি আনন্দময়।
শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে মেসে না গিয়ে লক্ষ্মীনাথ জোড়াসাঁকোয় এল। বলতে গেলে প্রজ্ঞার আকর্ষণে আসতে হল। বিকেল বলে প্রত্যেকেই নিজের নিজের ঘরে। লক্ষ্মীনাথ ভেতর মহলে এল। কিন্তু ঘরে কেউ নেই বলে মনে হচ্ছে। প্রজ্ঞা ভেতরে নেই বা থাকলেও শুয়ে আছে। যদি শুয়ে থাকে তাকে চমকে দেবার জন্য কোনো আওয়াজ না দিয়ে নিঃশব্দের ভেতরে চলে এল। না, প্রজ্ঞা বিছানায় নেই। সে ঘুমোয় নি । মেঝেতে স্ট্যান্ড একটায় ভারী কাগজ লাগিয়ে ছবি আঁকায় মগ্ন ।
লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞার পেছনে দাঁড়াল। কাগজে আঁকা স্কেচ দেখেই বুঝতে পারল, প্রজ্ঞা যে তার কাছ থেকে বাবার একটা ফোটো চেয়ে নিয়েছিল, সেটা দেখে ইতিমধ্যেই বড় একটি কাগজে বাবার মুখ ফুটিয়ে তুলেছে। দৃশ্যটা দেখে লক্ষ্মীনাথের অন্তরে অভূতপূর্ব এক শিহরণ খেলে গেল। প্রজ্ঞা তার সঙ্গে শিবসাগর যেতে চেয়েছিল। সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে আশঙ্কা করে প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে যায়নি। তার জন্য প্রজ্ঞা অভিমান করে থাকেনি। বরঞ্চ লক্ষ্মীনাথের অনুপস্থিতিতে প্রজ্ঞা বাবার ছবিটা তুলির সাহায্যে চিত্ররূপ দিচ্ছে। এটা বাবার প্রতি প্রজ্ঞার শ্রদ্ধা ভালোবাসা। অস্ফুট আবেগে লক্ষ্মীনাথ বলল,পরি, তুমি বাবার ছবি আঁকছ!'
লক্ষ্মীনাথের আবেগের ঘোর কাটেনি। সে প্রজ্ঞার কথার উত্তর না দিয়ে পুনরায় সেভাবেই বলল,' তোমার তুলিকায় আমার বাবার ছবি!'
' কেন, আমি আঁকতে পারি না? তোমার বাবা কি আমার বাবা হতে পারেন না?'
মতবিরোধ হওয়ার জন্য অ.ভা.উ.সা সভা তথা জোনাকী থেকে বেরিয়ে গিয়ে বেনুধর রাজখোয়া, কৃষ্ণপ্রসাদ দুয়ারা চৌদ্দ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনে 'আসামিছ লিটারেরি ক্লাব' গঠন করলেন। কিছুদিন পরে তাদের সঙ্গে পদ্মনাথ গোহাঞিবরুয়াও যোগদান করল । এই ক্লাব থেকে কৃষ্ণাপ্রসাদ দুয়ারার সম্পাদনায় 'বিজুলী' পত্রিকা প্রকাশিত হল। পরের বছর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করল পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া। তা বলে তিন বছর ধরে প্রকাশিত জোনাকীর প্রচার কমল না। বরং বেড়ে গেল। চতুর্থ বছরের জন্য লক্ষ্মীনাথ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করায় লেখকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেল। জোনাকীর পাতায় নতুন নতুন লেখকের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে 'কৃপা বর বরবরুয়ার কাকতর টোপোলা'র সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ লেখা 'পদ্মকুমারী' শীর্ষক উপন্যাসটি খন্ড খন্ড ভাবে প্রকাশিত হতে লাগল। এখন জোনাকীতে লেখা প্রকাশ পাওয়াটা অসমিয়া লেখকের পক্ষে গর্বের বিষয় । তাই সম্পাদনার কাজ বেড়েছে । কলেজের ক্লাসে উপস্থিত থাকা, হাইকোর্টের বিখ্যাত উকিল ব্যারিস্টারদের সওয়াল জবাব শোনা নিজের পড়াশোনা , প্রজ্ঞার সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে সামাজিকতা রক্ষা করা , তারপরে নিজের লেখালেখি… অফুরন্ত কাজ। লক্ষ্মীনাথ একেবারে সময় পায় না।
কলেজ বন্ধ হওয়ায় ছাত্ররা বাড়ি চলে গেল। ছাত্রদের না থাকার জন্য বহু স্মৃতি জড়িত দুই নম্বর ভবানীচরণ দত্ত লেনে থাকা মেসটা ভেঙ্গে গেল। লক্ষ্মীনাথ সপ্তাহে দুই একদিন জোড়াসাকোঁ যায়। জোনাকীর কাজের সুবিধা হয় বলে সপ্তাহের বাকি কয়েকটি দিন শোভারাম বসাক লেনে একটা ভাড়া ঘর নিয়ে চন্দ্রকুমারের সঙ্গে থাকতে লাগল। এর মধ্যে চন্দ্রকুমার বিএ পড়ার জন্য পাটনা চলে গেল। চন্দ্রকুমার চলে যাওয়ার পরে আনন্দচন্দ্র আগরওয়ালা এবং লক্ষ্মেশ্বর শর্মা সেই মেসে থাকতে লাগল। তাদের সহায়ক রূপে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ জোনাকীর কাজ চালাতে লাগল। এখন জোনাকী কেবল অ.ভা.উ.সা. সভার মুখপত্র নয়। সুদক্ষ সম্পাদনার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের নিজের লেখাগুলি উন্নত হয়ে উঠা জোনাকী অসমিয়াদের জন্য একটি জাতীয় পত্রিকা হয়ে উঠল। প্রত্যেকেই, এমনকি কট্টর সমালোচকরাও লক্ষ্মীনাথের প্রশংসা করতে লাগল।
কিন্তু বিদ্যায়তনিক দিকে, মানে আগন্তুক পরীক্ষার জন্য লক্ষ্মীনাথ নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে পারল না। এম এর সঙ্গে আইন পরীক্ষার জন্য যেভাবে অধ্যয়নে ব্রতী হওয়া প্রয়োজন, সেটা তার দ্বারা সম্ভব হল না।
এদিকে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে মেসে থাকতে লাগল নগাঁওয়ের পুরোনো গুদামের ভোলানাথ বরুয়া। লেখার প্রশংসাকারী, সাহেব বলে সম্বোধন, মজার গল্প এবং রঙ্গিণ কথায় কিছুদিনের মধ্যে ভোলানাথ লক্ষ্মীনাথের মন আকর্ষণ করল। ঠাকুর বাড়ির কন্যাকে বিয়ের কথাটা নিয়ে উদার মন্তব্য করায় লক্ষ্মীনাথের প্রসন্নতা বৃদ্ধি পেল। লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথের মন যুগিয়ে চলতে লাগল।
এই সময় বিএল পরীক্ষার দু মাস আগে থেকে ভোলানাথ অসুস্থ হয়ে পড়ল। পড়াশোনা একপাশে ফেলে রেখে লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথের সেবা করতে লাগল। পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে ভোলানাথ সুস্থ হল। তারপর কোমর বেঁধে পড়াশোনায় নেমে পড়লেও লক্ষ্মীনাথ শেষ রক্ষা করতে পারল না। ভালোভাবে প্রস্তুতি না নিয়ে তাকে এম এ পরীক্ষায় বসতে হল। এম এ পরীক্ষার ফলাফল ভালো হল না । অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারা নতুন করে কার্যকরী করা পরীক্ষা নীতিটিও আইন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার অন্যতম কারণ। লক্ষ্মীনাথ এই পরীক্ষা নীতির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, সতীর্থরা বিশ্বাসঘাতকতা করায় লক্ষ্মীনাথকে মামলায় পরাজিত হতে হল। হতাশায় লক্ষ্মীনাথের অন্তর ভেঙ্গে পড়ল।
মানুষের জীবনে একবার যখন দুঃসময় নেমে আসে, সেখান থেকে তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে।
কলকাতায় আসার পর থেকে লক্ষীনাথের জীবনে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করা বিশিষ্ট অসমিয়া ব্যক্তি হলেন রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়া। ইতিহাসবিদ, সংস্কৃতি সচেতন, সদানন্দময় এই ব্যক্তিকে লক্ষ্মীনাথ মনে মনে বৌদ্ধিক গুরুর মর্যাদা দিয়ে এসেছে। কিন্তু ঈশ্বরের কেমন অবিচার যে তাঁর একমাত্র জামাতা নন্দকুমার রায়ের( স্বর্ণলতার পতি) অকাল মৃত্যু ঘটল। এই শোক সামলাতে না সামলাতেই তাঁর মহীয়সী পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়া ইহলোক ত্যাগ করলেন। বয়সে বড় ছিলেন যদিও সম্পর্ককে মর্যাদা দিয়ে এই মহিলা লক্ষ্মীনাথকে যে কত স্নেহ করতেন। যখনই দেখা করতে গেছে– নানা ধরনের রান্না করে লক্ষ্মীনাথকে তৃপ্তি সহকারে খাইয়েছে। মৃত্যুর খবর পেয়ে লক্ষ্মীনাথ গিয়ে দেখল, মায়ের মৃতদেহের পায়ের ওপরে মাথা রেখে অকাল বিধবা স্বর্ণলতা বিলাপ করছে। দৃশ্যটা দেখে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে সামলাতে পারল না। দুচোখ থেকে অবিরল ধারায় জল পড়তে লাগল। এদিকে গুণাভিরাম মহাশয়– বুড়ো বয়সে নিঃসঙ্গ, নিরাশ্রয় করে রেখে যাবার শোকের শেলে বিদ্ধ হয়েও পত্নীর প্রাণহীন দেহের দিকে অচল-অটল ভাবে তাকিয়ে রয়েছেন।
সব দিকে গুণী,বিদ্বান উচ্চ আদর্শের ব্যক্তি হয়েও কেন যে তাকে এই করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হল! পত্নী বিয়োগের দুই বছর পার হতে না হতেই রায়বাহাদুর নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সাহেব ডাক্তার ম্যাকডোনাল্ডের অধীনে থাকায় তার চিকিৎসার কোন ত্রুটি হল না। কলকাতাবাসী অসমিয়া ছাত্ররা প্রতিদিন খবর নিতে লাগল। সেবা যত্নের যাতে ত্রুটি না হয়, তার জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগল। ছাত্ররা তার অসুস্থ দেহের পাশে নিয়মিত ভাবে পাহারা দিতে থাকল। তবে বিধির বিধান কে খন্ডাবে! একুশ দিন জ্বরে ভোগে রায়বাহাদুর গুণাভিরাম পরলোক গমন করলেন।
সেবা- যত্ন চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মরাও যত্ন নিয়েছিল। তাদের দিক থেকে আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। আর মৃত্যুর পরে বিষ্ণুপ্রিয়ার মৃতদেহ নিমতলায় নিয়ে যাবার মতোই ব্রাহ্মরা রায়বাহাদুরের মৃতদেহ নিয়ে নীরব শোভাযাত্রা করার প্রস্তাব দিল। তার জন্য তাদের তরফ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হল।
কিন্তু কলকাতার মেসে থাকা অসমিয়া ছাত্ররা তার বিরোধিতা করল।
শোকসন্তপ্ত কন্ঠে হেমচন্দ্র বলল,' ব্রাহ্ম হলেও রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়ার কথা আলাদা। তিনি আমাদের অসমিয়া জাতীয় জীবনের একজন অন্যতম সাংস্কৃতিক পুরুষ।'
তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে পদ্মনাথ বলল,' তিনি অসাম বন্ধু কাগজের সম্পাদক ছিলেন। নগাঁও শহরে হাকিম থাকা অবস্থায় তাকে কেন্দ্র করে একটি সাহিত্যগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। তিনি জোনাকী, বিজুলী ইত্যাদি কাগজে নিয়মিতভাবে প্রবন্ধ লিখতেন। তিনি আমাদের অসমিয়া জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ। নতুন প্রজন্মকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করা অসমিয়ার জাতীয় পুরুষ। তাই তাঁর জীবনের এই অন্তিম অনুষ্ঠানে আমাদের তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই হবে।'
অসমিয়া ছাত্রদের প্রবল চাপের কাছে ব্রাহ্মদের প্রচেষ্টা সফল হল না।
গুণাভিরামের প্রাণহীন দেহটা কাঁধে নিয়ে অসমিয়া ছাত্ররা নিমতলা ঘাটে এল। গ্রাম্য সদস্য এবং উপাসকদের সঙ্গে থেকে ব্রাহ্ম গীত গাইল যদিও শেষকৃত্য সম্পন্ন করার সমস্ত কাজে অসমিয়া ছাত্ররাই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করল।
অগ্নিময় চিতার সামনে অশ্রু সজল নেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষ্মীনাথের মনে পড়ল উদ্দীপনাময় সেই বাণী।,'... তোমার লেখায় আমি নতুন যুগের নতুন ভাবধারার সুর শুনতে পেয়েছি । সর্বসাধারণ অসমিয়াকে তুমি সেই ভাবধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।'
লক্ষ্মীনাথের অন্তরে এই কথাগুলি গুরুবাণীর মতোই প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
দাহ সংস্কার কর্মের পরে গঙ্গাস্নান করে লক্ষ্মীনাথ অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে মেসে এল। মেসে শোক সভার আয়োজন করল। সভায় গুণাভিরাম বরুয়ার জীবন এবং সাহিত্যের ওপর আলোকপাত করে প্রত্যেকেই শ্রদ্ধা নিবেদন করল। লক্ষ্মীনাথ প্রয়াত বরুয়াকে প্রবাসী অসমিয়া ছাত্রদের ' অভিভাবক এবং সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক' বলে অভিহিত করে তার আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যাবার জন্য সংকল্পবদ্ধ হতে সবার কাছে আবেদন জানাল।
তারপরে মেসে থাকবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু প্রজ্ঞার কথা খুব বেশি করে মনে পড়তে লাগল। এটা এক অন্য আকর্ষণ। ব্যাখ্যাতীত নিবিড় এক টান। যেন সাংস্কৃতিক গুরুকে হারিয়ে ব্যথিত অন্তরটার একটি আশ্রয় প্রয়োজন। এদিকে অন্তরঙ্গ বন্ধু মাজিউ কলকাতায় নেই। তাই প্রজ্ঞার কাছে যেতেই হবে। লক্ষ্মীনাথ বিকেলের দিকে জোড়াসাঁকোয় চলে এল।
বিশাল গেট পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়ে গেল। অন্যসময় রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে সবিনয়ে লক্ষ্মীনাথ তাকে শ্রদ্ধা জানায়। কিন্তু আজ রবীন্দ্রনাথ নিজেই লক্ষীনাথের দিকে এগিয়ে এল।
' নিমতলা থেকে এলে বুঝি?'
সবিনয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' হ্যাঁ , কাকাবাবু।'
' সংস্কার কার্য সম্পন্ন হল?'
' হ্যাঁ, সব ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।'
রবীন্দ্রনাথের চোখে– মুখে বিষাদের ছায়া।
' সত্যিকারের সংস্কৃতিমনস্ক পুণ্যাত্মা ব্যক্তি ছিলেন রায় বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়া। কেন যে বিধাতা এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এত নিষ্ঠুর হলেন!' গম্ভীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ বললেন,' আর তোমরা–'আসামী' ছাত্রবৃন্দ ব্রাহ্ম ধর্মের সংস্কার না মেনে নিজেরাই যে ওঁর পুণ্য দেহ কাঁধে করে নিমতলায় নিয়ে গেলে– তোমরাই যে সংস্কারাদি করলে,এতে ওঁর আত্মার শান্তি হবে। তোমাদের থেকে এই সম্মান ওঁর প্রাপ্য ছিল।'
এভাবে বলে, রবীন্দ্রনাথ আকাশের দিকে তাকিয়ে পরমাত্মার স্মরণ করে রায় বাহাদুরের বিদেহী আত্মার সদ্গতির জন্য প্রার্থনা জানালেন। তারপরে মন্থর পদক্ষেপে অন্দরমহলের দিকে এগিয়ে গেলেন।
অসমিয়া বাংলার উপভাষা বিতর্কের পরে অসমিয়া বাংলার জাতীয় জীবনের কোনো বিষয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের আর আলোচনা হয়নি। কোনো প্রসঙ্গে কখনও কোনো কথা উভয়েই বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারা মন্তব্য থেকে বিরত ছিলেন । কিন্তু আজ গুণাভিরাম বরুয়ার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম এবং বাঙালি হয়েও অসমিয়া জাতীয়তাবাদী কর্মকে উদারভাবে সমর্থন জানিয়ে যেভাবে শোক প্রকাশ করলেন, তাতে লক্ষ্মীনাথ অভিভূত হয়ে পড়ল। অসমিয়া বাংলার উপভাষা বলে মন্তব্য করে রবীন্দ্রনাথ'ভারতী'তে বিতর্কিত 'ভাষা বিচ্ছেদ' প্রবন্ধ লেখার জন্য লক্ষ্মীনাথের মনে যে অবদমিত ক্রোধ-ক্ষোভ ছিল সেটা নাই হয়ে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন