স্মৃতিকথা- ১৯
এই আমি চরিত্র
( গত মাসের পর)
মেদিনীপুর শহরের কর্ণেলগোলা তল্লাটটি বেশ বর্ধিষ্ণু জায়গা । আমাদের ভাড়া বাড়ি থেকে দেখা যায় আমার নতুন স্কুল মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল আর তার পাশে মেদিনীপুর কলেজ । আমাদের একটা ঘর ছিল হল ঘরের মতো । সেই ঘর দিয়ে দেখা যেত রাস্তাঘাট আর ছাদে উঠলেই পেয়ে যেতাম সারা কর্ণেলগোলার ভিউ । শীতকালে বিশাল ছাদটি ছিল আমার নিজস্ব জায়গা । কর্ণেলগোলায় আসার পড়ার চাপ কিছুটা বাড়লো । তখন ক্লাস নাইনে । সায়েন্স নিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছি ।কিন্তু সত্যি বলতে পড়ায় তেমন মন নেই । রোজ স্কুল যাই ঠিকমতো ক্লাস করি এই পর্যন্ত । সারাদিন মনটা কেমন উড়ু উড়ু । কিছু কৌতুহলী দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি । তার ভেতর জানার চেষ্টা করি । অবিলম্বে সারা ক্লাস বুঝে গেছে আমি বেশ অন্যরকম ।পাড়ায় মেতে থাকতাম আমার সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে । বাবা মা আমার মনোভাব বুঝে আমার স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই অক্ষয় রায়ের টিউশন ক্লাসে ভর্তি করে দিলো । অক্ষয় বাবু ছিলেন দাদারও মাস্টারমশাই । দাদার সঙ্গে কথা বলে উনি আমাকে ভর্তি নেন ।অক্ষয় বাবু পড়াতেন সায়েন্স সাবজেক্ট আর ওই স্কুলেরই আরেক মাস্টারমশাই পঙ্কজাক্ষ নন্দ পড়াতেন ইংরেজি আর বাংলা । আর একজন স্কুল মাস্টারমশাই মনোজ বাবু যিনি নির্মল হৃদয় আশ্রমে ( চার্চ স্কুলে) পড়াতেন । তিনি বায়োলজি দেখাতেন ।
স্বাভাবিকভাবেই ক্লাসের পড়া টিউশন খেলাধুলা নিয়ে জীবন কাটতে শুরু করলো । কর্ণেলগোলা থেকে অক্ষয় রায়ের টিউশন ক্লাস বেশ খানিকটা দূরে ছিল । যেতে হত রবীন্দ্র নগরে ।সপ্তাহে ছ'দিন পড়ানো হত তখনকার দিনে পঁচিশ টাকায়! কার্যত অনেকখানি সময় পড়াশোনার সঙ্গে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে পড়ার দিকে কিছুটা হলেও মনোনিবেশ ঘটলো। সব দিক থেকে মোটামুটি একটা জায়গাতে এলেও বাদ সাধলো অঙ্ক। অক্ষয় বাবু নাকাল হয়ে শেষ অবধি ক্লাস সিক্স থেকে অঙ্ক করানো শুরু করলেন । অঙ্ক তাতেও আশানুরূপ এগোল না ।
স্কুলে কিছু সহপাঠী হয়ে গেল । তার ভেতর থেকে এখনকার ভাষাতে বেস্টফ্রেন্ড হয়ে দাঁড়ালো রবীন্দ্রনাথ দে নামে এক সহপাঠী । রবিনের অশেষ গুণ । সে মেদিনীপুরের বিখ্যাত মিষ্টি দোকান ছোট বাজারের রাসু ময়রার নাতি । বাড়ির ছোট ছেলে, আমারই মত । তার হাতের আঁকা ছিল অসাধারণ । স্কুলে ক্লাসে বসে অবলীলায় মাস্টারমশাইদের ছবি আঁকতো সে খাতার নীচে কাগজ লুকিয়ে । তাছাড়া হাতের মুদ্রার মাধ্যমে সে অসাধারণ কোকিল ডাকতো । একবার তাকে নিয়ে মজার ঘটনা ঘটেছিল স্কুলে । কলেজিয়েট স্কুলে যেখানে প্রেয়ার হত সেখানে একটা বাঁধানো বটগাছ ছিল । সে গাছে উঠে সে মাঝে মাঝে অসাধারণ কোকিল ডাকতো । ক্লাস টেনে পড়ার সময় বর্ষাকালে টিফিনের সময় রবি গাছে উঠে কোকিলের ডাক ডাকতে শুরু করলো । পাশে অ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টারমশাই বিভূতি বসুর চেম্বার । তিনি বর্ষাকালে কোকিলের ডাক শুনে হকচকিয়ে গেলেন । আওয়াজ অনুসরণ করে দেখেন একটা ছেলে আনমনে হাত দুটো মুঠো করে মুখে দিয়ে কোকিল ডেকে যাচ্ছে । সারা স্কুলের ছাত্র বিভূতি বাবুকে দারুন ভয় পেত । আড়ালে তাঁকে ' কাঠ বিভূতি ' বলতো । বিভূতি বাবু এসব দেখে স্বভাবসুলভ গলায় এক হুঙ্কার ছাড়লেন । রবি চমকে উঠে দেখে বিভূতি বাবু । ভয়ে সে উঁচু ডাল থেকে মারলো এক লাফ । বিভূতি বাবু ভয় পেয়ে গেলেন, ছেলেটার কিছু হল না তো! কিন্তু আশ্চর্য পরক্ষণেই রবি চোখের নিমেষে উধাও হয়ে ক্লাসে এসে বসলো যেন কিছুই হয়নি।
ভালো লাগলো ধন্যবাদ আপনাকে
উত্তরমুছুন