পাখিদের পাড়া পড়শী ২/৯
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi
দ্বিতীয় অধ্যায়, ২/৯
কঁহরার রাষ্ট্রীয় প্রধান পথ পার হয়ে তাদের যাত্রা আরম্ভ হয়েছে। হালকা জনবসতির মধ্যে দিয়ে কিছু দূর গিয়ে দলটা রাষ্ট্রীয় উদ্যানের মূল প্রবেশদ্বারের সামনে উপস্থিত হল। গাড়ির শোভাযাত্রা দেখতে পেয়ে সেখানে থাকা রক্ষী ফেলে রাখা লোহার তালাটা খুলে দিল।
সমতল ঘাস এবং মাঝে মধ্যে জলাঞ্চল। পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে গাড়ির শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে।
গাড়ির চাকা উড়িয়ে যাওয়া ধুলোর আতিশয্য থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতি দুটি গাড়ির মধ্যে ব্যবধান রাখা হয়েছে । তবু ধুলো থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হয়নি। লীনা উড়না দিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে নিয়েছে। সুনীল দাস একজোড়া চশমা পড়ে নিয়েছে। কিছুটা দূরে এসে তিনি চশমা জোড়া খুলে নিয়ে অনুরাগকে বললেন– চশমা পড়লে সবকিছু ডুপলিকেট দেখা যায় অনুরাগ। ধুলোর ভয়ে আমি কি চশমা পরে কাজিরাঙ্গা দেখব নাকি!
অনুরাগ সুনীল দাসের কথায় সায় দিল– হ্যাঁ সুনীলদা। কোনোটায় রঙিন দেখায় আবার কোনোটায় মেঘলা দেখায় । খুলে রাখাই ভালো। কাজিরাঙ্গার অভ্যন্তরে দলটির প্রথম সাক্ষাৎ হল একদল হরিণের সঙ্গে। কয়েকটা ভাগে বিভক্ত হয়েছিল ফুটকি হরিণের দলটা। ফুটকি হরিণকে ইংরেজিতে বলা হয় স্পটেড ডিয়ার। বৈজ্ঞানিক নাম এসি এসি। হরিণ গুলিকে দেখতে তাম্র বর্ণের এবং শরীরে গোলাকার সাদা সাদা দাগ দেখতে পাওয়া যায়। পুরুষ হরিণের বড় বড় শিং থাকে, স্ত্রী হরিণের থাকেনা ।ক্ষিপ্রতায় বংশবৃদ্ধি হওয়া হরিণের প্রধান খাদ্য লতা পাতা এবং মূলত ঘাস।
শিবিরে অংশগ্রহণ করা দলটি কঁহরা থেকে যাত্রা আরম্ভ করে মিহিমুখ, কাঠপোড়া, বরুণটিকা, ভেইষামারী হয়ে হোলালপথে যাওয়ার কথা। মিহি মুখ পেতে হলে আরও কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। হরিণের দলটা দেখে চালকেরা গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। কাজিরাঙ্গার ভেতরে গাড়ি চালানো প্রতিজন চালক বন্য জন্তু দেখলেই গাড়ির গতি ভালো ভাবে কমিয়ে দিয়ে পর্যটকদের বন্যজন্তু ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করার সুবিধা করে দেয়।
মন্থর গতিতে যাওয়া গাড়ির গতি বেগ কিছুক্ষণ পরে শূন্য হয়ে পড়ল। অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন গাড়ি থেকে নামতে চেয়েছিল। বনকর্মীরা বাধা প্রদান করায় তাদের ইচ্ছাও অপূর্ণ হয়ে রইল। তারা গাড়ির ওপর থেকে হরিণের দলের আলোকচিত্র নিল। এই জায়গাটা একেবারে খোলামেলা। আদিগন্ত ছড়িয়ে রয়েছে ঘাসের মেলা। কয়েক মিনিট পরে চালকেরা গাড়ি স্টার্ট করায় গাড়ি থেকে আলোকচিত্র নেওয়ায় যতি পড়ল।
কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পরে গাড়ির শোভাযাত্রা দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একটি পর্যটক বাহনের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই বাহনের আরোহী কয়েকজন একটা গাছের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
গাছের ওপরের দিকে সবাই দৃষ্টি নিক্ষেপ করায় দেখতে পেল গাছের ওপরের একটা ডালকে জড়িয়ে রয়েছে একটি অজগর সাপ। আকারে খুব একটা বড় নয়। কোনো কারণে ভয় পেয়ে অথবা শিকারের অনুসরণ করে সাপটা গাছের ওপরে উঠেছে। সাধারণত ভয় পেলে সাপ গাছের বেশি ওপরে উঠে যায়। গাড়ির শব্দও তার একটা কারণ হতে পারে। এই ধরনের অজগর সাপের ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান পাইথন। বৈজ্ঞানিক নাম পাইথন মলুরাছ। মানুষের সমাগম দেখে বোধহয় সাপটার ভয়ে হাত পা পেটের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। একদম নড়াচড়া করছে না। কিছুক্ষণ সাপটাকে লক্ষ্য করে গাড়ির শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে এগোতে লাগল।
মিহি মুখ পেতে আর একটু বাকি আছে। মিহি মুখ পৌঁছে গাড়ির শোভাযাত্রা দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই সেখানে থাকা 'ওয়াচ টাওয়ার'টার দিকে এগিয়ে গেল। তিন তলা একটি ঘরের সমান উঁচু টাওয়ারটাতে উঠার জন্য সিঁড়িতে অংশগ্রহণকারীরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যামেরা গুলি ঝলসে উঠছে। রেলিঙে হেলান দিয়ে দূর-দূরান্তের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনের ইচ্ছা পূরণ করছে । হয়ে পড়ছে ভাবপ্রবণ, কল্পনাবিলাসী।
উদয়শঙ্কর যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত করা যায় ততদূর পর্যন্ত তাকিয়ে রইল। তার চোখে হলুদ এবং সবুজের মিশ্রিত একটি চিত্র । শীতকাল বলে গাছ- বনের পাতাগুলি হলদে হয়ে উঠেছে । দূরে ঘাসের মধ্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী।বনরক্ষীরা শুকনো ঘাসগুলি পুড়িয়ে ফেলার জন্য আগুন জ্বালিয়েছে। শুকনো ঘাসগুলি পুড়িয়ে ফেললে সেখানে নতুন গাছ জন্মাবে। তৃণভোজী জন্তুগুলির জন্য সেই কোমল ঘাসগুলি হবে উপাদেয় খাদ্য ।
মিহি মুখ থেকে ওদের দলটি কাঠপোড়ার দিকে এগিয়ে গেল। মিনিমুখ থেকে কাঠ পোড়ার দূরত্ব তিন চার কিলোমিটারের মতো হবে। ধুলো উড়িয়ে গাড়ির শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে।
কাজিরাঙ্গা দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে সঙ্গে যাওয়া হরেণ গগৈ উদয়শঙ্করের সামনে এক উৎসুক বিবরণ তুলে ধরতে প্রয়াস করল।
– একবার জুন মাসে কাজিরাঙ্গা এসেছিলাম। তখন কাজিরাঙ্গার অভ্যন্তরে প্রবেশ অথবা দর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে।আসলে সেই সময়টা কাজিরাঙ্গা দর্শনের সময় ছিল না। আমাদের কেবল কাঠপোড়া পর্যন্ত আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কাজিরাঙ্গায় গন্ডার, হাতি,মোষ, হরিণ অথবা কখনও সুযোগ পেলে ব্যাঘ্র দর্শন সম্ভব হয়। কিন্তু আমাদের জন্য সেদিন অপেক্ষা করছিল এক বিরল দৃশ্য। কাঠপোড়া পেতে হলে দুটো কাঠের সেতু পার হতে হয়। একটি কাঠের সেতুর নিচে জলধারা প্রায় মৃতপ্রায় হয়ে এসেছে। অন্য কাঠের সেতুটির নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হাঁটু জল। রাতের মুষলধারে বৃষ্টিতে বিলের জল উপচে এসে সেই জলস্রোতকে গতিময় করে তুলেছে। আর আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে এগুলি কি– ধীরস্রোতের জলের মধ্যে ঝাকে ঝাকে উজিয়ে আসা চিতল মাছের শোভাযাত্রা।শুধু উজিয়ে আসা বললে ভুল হবে আসলে তা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চিতল মাছের অপূর্ব জলকেলি। আমাদের সঙ্গে থাকা বনরক্ষীর বক্তব্য অনুসারে এক একটি চিতল মাছের ওজন সর্বোচ্চ ষোলো সতেরো কেজি হবে। জল থেকে শূন্যে লাফিয়ে উঠে পেট দেখিয়ে জলের উপরে পিঠ পেতে থাকা রুপোলী মাছের জলকেলি দেখে আমাদের দলটা অবাক হয়ে গিয়েছিল। জীবনে প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়েছি চিতল মাছের অনবদ্য জলক্রীড়া।
উদয়শঙ্কর শুনে চলেছে হরেণ গগৈর অভিজ্ঞতা প্রসূত ব্যাখ্যা। হরেণ গগৈ কাজিরাঙ্গার ভেতরে প্রবেশ করেনি বলে তাকে বলেছিল। সম্ভবত নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত সীমা বেঁধে দিয়েছিল বলে তিনি এরকম বলেছিলেন। কিন্তু তিনি দেখছি ইতিমধ্যে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
দলটা এসে বরুণটিকায় পৌঁছালো। এই অঞ্চল উঁচু উঁচু বনানীতে অধ্যুষিত।
সেই বনানীর মধ্যে তিনটি হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতিগুলি গাড়ির শোভাযাত্রাকে দেখে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ঘাস উপড়ে নিয়ে মুখের মধ্যে ভরছে, ঘাস শরীরকে ঘিরে ধরা মশা মাছি তাড়াচ্ছে । ধীর গতিতে এগিয়ে আসা গাড়ির শোভাযাত্রাটা হাতি তিনটা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছে। বনরক্ষী কয়েকজন নিজের নিজের গাড়িতে থাকা অংশগ্রহণকারীদের সাবধান করে দিল, কেউ যেন হাতি গুলি অসুবিধা পাওয়ার মতো কোনো কাজ না করে ।
এই ধরনের হাতির বৈজ্ঞানিক নাম ইলিফাছ মেমাছ।
দলটির মধ্যে থাকা পুরুষ হাতিটা গাড়িগুলি চালানোর জন্য সন্তুষ্ট হল না । সে কান দুটো খাড়া করে শুঁড়টা সোজা করে গাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাতে লাগল। এক বিশেষ ভঙ্গিমা দেখিয়ে হাতিটা আগে পিছে করতে লাগল। মাঝে মাঝে মধ্যেই সে অনেকটাই এগিয়ে আসে। আবার পরক্ষনেই পিছু হটে এরকম একটা ভাব করে যেন মুহূর্তের মধ্যেই গাড়ি গুলি মাটিতে মিশিয়ে দেবে।
উদয়শঙ্করের সঙ্গে একই গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে আসা লীনা আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে উঠল।
•
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন