হে আমার স্বদেশ- ১০
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(দশ)
জেনারেল অ্যাসেম্বলি কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে কীভাবে যে দুটো বছর পার হয়ে গেল লক্ষ্মীনাথ বুঝতেই পারল না। তখন সে তৃতীয় বার্ষিকীর ছাত্র। কলকাতার প্রতিটি কলেজের মতো জেনারেল অ্যাসেম্বলি কলেজেও ছাত্রদের সংগঠন আছে, ছাত্র নেতা আছে। তারা 'নবীন বরণ', আলোচনাচক্র, তর্ক সভা, বক্তৃতা অনুষ্ঠান, সরস্বতী পুজো ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। লক্ষ্মীনাথ এই সমস্ত অনুষ্ঠানে সেভাবে অংশগ্রহণ করে না। তাঁর অন্যতম প্রধান কর্ম হল নিষ্ঠার সঙ্গে অ.ভা.উ.সা. সভার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন । তারপরে দুই নম্বর ভবানীচরণ দত্ত লেনে অবিমিশ্র অসমিয়া ছাত্রদের মেসে চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্রের সঙ্গে থাকার পর থেকেই কম বেশি পরিমাণে জোনাকীর কাজও দেখতে হচ্ছে। এদিকে কলেজের পাঠ্যপুস্তক পড়ছে,'লিটিকাই' প্রহসনটা শেষ হয়ে আসার পরে রম্য রচনা গুলিও লিখছে। কৃপাবর বরুয়ার ছদ্মনামে লেখা জোনাকীর দ্বিতীয় বছরের সপ্তম সংখ্যা থেকে' কৃপাবর বরুয়ার কাগজের পুঁটলি ' খণ্ড খণ্ড ভাবে বেরোচ্ছে । প্রথম খন্ড বের হওয়ার পরেই অভিনব হাস্য ব্যংগাত্মক রচনা বলে পাঠকমহলে সমাদর লাভ করেছে। ফলে ভোকেন্দ্র বিনন্দদের মত কটু সমালোচকরাও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে । এখন আর তারা লক্ষ্মীনাথকে অসমিয়া সাহিত্যের 'বরপূজারী', প্রবাসী অসমিয়া ছাত্রদের লিডার, মাত্রাধিক পিউরিটান ইত্যাদি কথায় উপহাস করে না। শৈশবে শিবসাগরে সঙ্গীদের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ যেভাবে নেতা হয়ে উঠেছিল, সেভাবেই কলকাতার অসমিয়া ছাত্র মহলে সে একজন নেতৃস্থানীয় সাহিত্যিক ছাত্র হয়ে পড়ল।
লক্ষ্মীনাথ একজন তরতাজা যুবক। চেহারা আকর্ষণীয়। সাজ-পোশাকে সাহেব। ফর্সা মুখে ঘন কৃষ্ণ দাড়ি। ধনুকের মত ভ্রুর নিচে চোখ জোড়া উজ্জল । চলাফেরাতেও সজীব বুদ্ধিদীপ্ততা। অসমিয়া হোক বাংলা হোক রসগ্রাহী কথাবার্তায় তৎক্ষণাৎ সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারে। এই ধরনের সুস্থ শরীর এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর মন নিয়ে লক্ষ্মীনাথ নিজেও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল।
তা বলে তার জ্ঞানের পিপাসা কমল না । বিশেষ করে সেদিন কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আসার সময় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের দুজন সংস্কৃতিবান যুবক পুরুষের যে সান্নিধ্য লাভ করল, তাদের প্রেরণাদায়ক কথাগুলি লক্ষ্মীনাথকে অধিক অনুপ্রাণিত করে তুলল। পাঠ্যপুথি'পলগ্ৰেভস গোল্ডেন ট্রেজারি অফ লিরিকস' ছাড়াও সে বাইরন,শেলী, কীটস এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি পড়তে শুরু করল। এইসব কবিতার ভাব- রস,ছন্দ- অলঙ্কার, রূপকল্প লক্ষ্মীনাথের রোমান্টিক সত্তাটিকে সমৃদ্ধ করে তুলল। বিশ্ব বিখ্যাত কবিদের মতো করে সে বৌদ্ধিক ঔৎসুক্য মানব জীবনের রহস্যের সন্ধান করতে লাগল।তাঁর চেতনাতেও মানবীয় বিভূতি দ্বারা জীবনের রূপ গুলি বর্ণিল এবং ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠল। শয়নে স্বপ্নে কেবল সেই সমস্ত রূপক দেখতে লাগল। তারপরে তার অবস্থাটা এরকম দাঁড়াল যেদিকেই তাকায়, সেদিকেই পুঞ্জিভূত সৌন্দর্য দেখতে পায়, তার চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠে স্তূপীকৃত মাধুর্য এবং সেই সব থেকে সে অনুভব করে অনাস্বাদিত এক আনন্দ। আনন্দের আতিশয্যে সে নিজে নিজেই গেয়ে উঠে,
' সুখ ভরা এ ধরায়
মন বাহিরেতে চায়
কাহারে বসাতে চায় হৃদয়ে!
তাহারে খুজিব দিক- দিগন্ত।'
কখনও আবার নিজের অজান্তে আনন্দের আবেশে গুন গুন করে উঠে,
' আমি স্বপনে রয়েছি ভোর
সখি, আমারে জাগাইওনা।'
এভাবে সে নিজের কল্পনায় একজন সুন্দরীকে মানসপ্রতিমা রূপে গড়ে নিল। কল্পনায় গড়ে তোলা মানস-প্রতিমাটিকে নিজের ভাব সম্পদে অপরূপ করে বন্দনা করে সে গাইল,
' আমার পরাণ যাহা চায়,
তুমি তাই ,তুমি তাই গো!
মোর, কেহ নাই কিছু নাই গো।'
অর্থাৎ,তার হৃদয়ে ভাবের লহর উঠল। ভাবের সেই লহর মন থেকে অন্য সমস্ত কিছু চিন্তা চেতনাকে ভাসিয়ে নিল। তারপরে সেই নির্বাক মানস প্রতিমার সামনে নিজেকে নিবেদন করে গাইল ,
'তোমার সকলি ভালো লাগে
ওই রূপরাশি
ওই খেলা, ওই গান, ওই মধু হাসি
ওই দিয়ে আছ ছেয়ে জীবন আমারি
কোথায় তোমার সীমা ভুবন মাঝারে।'
…. এভাবে শুধু বাংলায় নয়, অসমিয়া এবং ইংরেজিতেও প্রেমের কবিতা লিখে লক্ষ্মীনাথ তার ক্লাসনোটের বইয়ের পাতাগুলি ভরিয়ে ফেলল। সমস্ত কবির কাছেই স্বরচিত কবিতা অত্যন্ত মূল্যবান। প্রেমের জিনিস। লক্ষ্মীনাথ কবিতার খাতাটা সযত্নে লুকিয়ে রাখে এবং রুমে কেউ না থাকা অবস্থায় বের করে পড়ে অপার আনন্দে আপ্লুত হয়। কিছুদিন পরে তাঁর এরকম একটি ভাব হল যে কাব্য সাহিত্যে সে যথেষ্ট উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে। সঙ্গে এটাও অনুভব করল যে ম্যাগাজিনের কাগজের পাতায় ছাপিয়ে এইসব কবিতাকে অমর করে রাখাটা তাঁর দায়িত্ব ।
কিন্তু কোন পত্রিকায় পাঠাবে ভেবে পেল না। অসমিয়া কবিতাগুলি জোনাকীর পাতায় সহজেই ছাপাতে পারি। কিন্তু জোনাকীর পাঠকদের মধ্যে তাঁর সমালোচক- নিন্দুক অনেক। ছাপানো কবিতার ভুল ত্রুটি বের করে ঠাট্টা তামাশা করে তাঁর কবিতার তিতো-কষা রস বের করেই ছাড়বে। না,অসমিয়া কবিতা গুলি থাকুক, তার চেয়ে বাংলা কবিতাগুলির একটা গতি করা যেতে পারে। সেখানেও সে একটা বুদ্ধি বের করল। স্বনামে ছাপতে পাঠালে অসমিয়া সঙ্গীরা অসমিয়া হয়ে বাংলায় কেন লিখতে গেলে' বলে অশান্তির সৃষ্টি করবে। তার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে একটা উপায় বের করল। একটা ছদ্ম নাম নিলে কেউ ধরতে পারবেনা। অনেক ভেবে চিন্তে' রঙ্গলাল চট্টোপাধ্যায়' নামটা গ্রহণ করল। অর্থাৎ লক্ষ্মীনাথ রচনা করা কবিতাগুলির কবি হবেন একজন বাঙালি ভদ্রলোক। অবশেষে দুটো প্রেমের কবিতা এনভেলাপে ভরিয়ে দুটো বাংলা কাগজে পাঠিয়ে দিল।
এক মাস পার হয়ে গেল। বইয়ের দোকানে গিয়ে' বঙ্গবাসী' এবং 'বঙ্গসূর্য' কাগজ দুটি কিনে এনে উল্টে পাল্টে দেখে নিল । না কোথাও দেখতে পেল না। লক্ষ্মীনাথ হতাশ হয়ে পড়ল। তবু তার মধ্যেই নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিল, আগামী মাসে নিশ্চয় বের হবে। কিন্তু অন্তরে সৃষ্টি হওয়া হতাশা কবিতা রচনার উৎসাহটা কমিয়ে দিল। আরও একমাস অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আবার নতুন করে প্রকাশিত কাগজ দুটি দেখল। এবারও নেই।… হলটা কী? কাগজের সম্পাদক তাঁর কবিতার মূল্য বুঝতে পারল না নাকি? খুব সম্ভব সেটাই হবে। মুল্য বুঝতে না পেরে কবিতা দুটি ফেলে রেখেছে। নাকি ডাকযোগে পাঠানো তার কবিতা দুটি এখনও সম্পাদকের হাতে পৌঁছে নি?
অস্থির লক্ষ্মীনাথ সম্পাদককে চিঠি লিখল,
' মাননীয় সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,
' বঙ্গবাসী', কলকাতা।
সবিনয় নিবেদন,
নমস্কার গ্রহণ করবেন।
দুই মাস পূর্বে আমি একটি কবিতা পাঠিয়েছিলাম । কবিতাটি মহাশয়ের হস্তগত হল কিনা জানতে পারলাম না। যদি পেয়ে থাকেন কোন সংখ্যায় ছাপা হবে জানালে বাধিত হব। যদি ছাপা না হয়, অনুগ্রহ করে নিম্নোক্ত ঠিকানায় ফেরৎ পাঠাবেন। কারণ, আমি কবিতাটির নকল রাখিনি । ইতি –
শ্রী রঙ্গলাল চট্টোপাধ্যায়
পুনঃ আমি আপনার দ্বারা সম্পাদিত 'বঙ্গবাসী'র একজন গ্রাহক এবং হিতাকাঙ্খী।'
কেবল চিঠি লিখেই লক্ষ্মীনাথ ক্ষান্ত হল না। এই ধরনের দুটি চিঠির সঙ্গে দুটো ডাকটিকিট দিয়ে দিল, যাতে দ্রুত সম্পাদকের উত্তর পেয়ে মনের অস্থিরতা- উদ্বেগ দূর করতে পারে।
পুনরায় অপেক্ষা। কিবা উত্তর আসে? উৎকণ্ঠায় ভরা অস্থিরতায় সময় দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। কোনো কিছুতেই লক্ষ্মীনাথের মন বসে না। কোনো কাজেই আগের মতো একাগ্র হতে পারে না। বইপড়ায় এত নেশা ছিল, বই নিয়েও বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না।
অবশেষে চিঠি দুটি এল। চিঠি দুটি হাতে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ এত শঙ্কাকুল এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে মেসে থাকতে পারল না। কবিতা দুটি ছাপা হলে আনন্দে নিস্তব্ধ হয়ে যাবে, ছাপা না হলে হতাশায় ভেঙ্গে পড়বে– এ সবের কোনোটাই সে মেসের সদস্যের সামনে প্রকাশ করতে পারবে না । তাই চিঠি দুটি তৎক্ষণাৎ পকেটে ভরে মেস থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। তাকে বেরোতে দেখে হেমচন্দ্র বলল,' কোথায় যাচ্ছ,বেজ?'
' এমনিতেই একটু বেরোচ্ছি।'
: দাঁড়াও, আমিও–।'
' এখনই প্রয়োজন নেই।' লক্ষ্মীনাথ সন্ত্রস্ত কন্ঠ বলে উঠল, তুমি যাবে, আমি এই কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসব।'
সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না।
এটা লক্ষ্মীনাথের পক্ষে একেবারে অস্বাভাবিক আচরণ। হতবাক হেমচন্দ্র অবাক হয়ে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীনাথের চলে যাওয়া দেখল।
দুই নম্বর ভবানীচরণ দত্ত লেন থেকে গোল দীঘির পার।
বিকেলবেলা।
ভাদ্রমাস যদিও সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়ার ফলে গরমটা এত প্রকট নয়। তাছাড়া বিকেলের দিকে গঙ্গার উপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাস গরমটাকে কমিয়ে দেয়। এই বাতাস শরীরের ক্লান্তি অবসাদও মুছে দেয়। এই সময় মহানগরের অট্টালিকায় বসবাস করা প্রবীণরা খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসে। গোলদিঘির পারের বেঞ্চ গুলিতে তারা বসে। বুকভরে মুক্ত বাতাস টেনে নেয়। আর সঙ্গে অথবা পাশে বসা মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে থাকে।
এখনও সেই একই দৃশ্য। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের সেদিকে লক্ষ্য নেই। একটা খালি বেঞ্চে বসে পকেট থেকে এনভেলপ দুটো বের করল। প্রথমটি থেকে চিঠিটা বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে পড়তেই তার অন্তর অসাড় হয়ে পড়ল। বঙ্গবাসী সম্পাদকের কবিতা রসজ্ঞানের নিতান্তই অভাব। বেরসিকের মতো লিখেছে ' আপনার কবিতাটি ছাপানোর অযোগ্য। ফেরত পাঠালাম।'
লক্ষ্মীনাথ হতাশ হয়ে পড়ল। হতাশায় রাগ হল। দ্বিতীয় কবিতাটি' বঙ্গ সূর্যে' বের হবে ভেবে ক্ষীণ আশা নিয়ে চিঠিটা বের করে পড়তে লাগল। কিন্তু কী চরম দুর্ভাগ্য, এই সম্পাদক কবি চিত্তকে নির্মম ভাবে আঘাত করে রসিকতা করেছে,' আপনার কবিতাটি আমাদের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে যত্নপূর্বক রাখিয়া দিয়াছি। আপনার কাছে পাঠাতে কষ্ট হল। পারলাম না ক্ষমা করবেন। আপনি নিশ্চয় স্কুল কি কলেজের ছাত্র। কবিতা লেখার বৃথা প্রয়াস ত্যাগ করিয়া পাঠ্যপুস্তকে মনোযোগ দিলে বাধিত হব ।'
এবার হতাশার সঙ্গে দেখা দিল ক্রোধ। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বঙ্গসূর্যের সম্পাদকের উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করতে শুরু করল, সম্পাদক, তুই সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিস! আসলে , কবিতা কাকে বলে তুই জানিস না। তোর সম্পাদক হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই । কলকাতার অপদার্থ লেখক কবির লেখায় তোর কাগজ পরিপূর্ণ। তোর কাগজের পাতা দিয়ে আমি আমার জুতোর ধুলো মুছব, দাঁড়া!'... মনে মনে এভাবে গালিগালাজ করার পর বুকের জ্বালা কিছুটা কমল। কিন্তু খুব খারাপ লাগছে। বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছে। হাতের চিঠি দুটো ছিঁড়ে গোলদিঘির জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেঞ্চে হেলান দিয়ে চোখ বুজল।
কতক্ষন এভাবে পার হয়ে গেল, লক্ষ্মীনাথ বলতে পারেনা।
' বাছা তুমি যে এমন করে চোখ বুজে আছ। শরীর ভালো তো?'
কণ্ঠস্বর শুনে চোখ মেলে লক্ষ্মীনাথ দেখল,একজন বৃদ্ধ বাঙালি ভদ্রলোক। তার পাশে বেঞ্চে বসেছে। তার গায়ে নয়নচুক কাপড়ের হাত কাটা ফতোয়া।পরনে কালো পারের ফিনফিনে ধুতি। বুকপকেটে চেন লাগানো সোনার ঘড়ি।কাঁচা পাকা চুলের মাঝখানে সিঁথি। হাতে হাতির দাঁতের বাঁকানো মাথা থাকা পালিশ করা লাঠি।
বাঙ্গালিদের এভাবে উপযাচক হয়ে কথা বলার স্বভাবটা লক্ষ্মীনাথ মোটেই পছন্দ করে না। এটা তার মতে' দস্তুরত দোরস্ত না হওয়া' কথা। তাছাড়া এখন তার মনের যে অবস্থা। উত্তর দিতে ইচ্ছা হল না। কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটির স্নেহময় কণ্ঠস্বরে সে উত্তর না দিয়ে থাকতে পারল না। সোজা হয়ে বসে বলল,'না, শরীর আমার ভালোই।'
' তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তা তুমি কোন কলেজে পড়?'
ইচ্ছা নেই যদিও লক্ষ্মীনাথ উত্তর দিল।
বাঙালি বাবুটি লক্ষ্মীনাথের আরও কিছুটা কাছে এসে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, 'কোথায় থাক তুমি?'
লক্ষ্মীনাথের কাছে অসহনীয় হয়ে পড়ল। তবু বলল, ভবানীচরণ দত্ত লেনের ছাত্রদের মেসে থাকি।'
' মা বাবা ভাই বোনদের রেখে বিদেশের মেসবাড়িতে থাকা খাওয়া । কষ্ট, বড় কষ্ট হে বাপু। আচ্ছা ভাই, তোমার কতদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি ?'
লক্ষ্মীনাথের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে মহা বিরক্ত হয়ে বলল–' আমি আর আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আমাকে মাফ করবেন।'
তারপর ও আর সেখানে দাঁড়াল না। দ্রুত সেখান থেকে মেসে চলে এল।
এদিকে লক্ষ্মীনাথ যেভাবে মেস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, তা লক্ষ্য করে হেমচন্দ্র চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। চন্দ্রকুমারকে সমস্ত কথা বলল এবং দুজনেই সিদ্ধান্তে এল যে লক্ষ্মীনাথের নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু হয়েছে।তাঁরা আর মেস থেকে বের হল না। অধীর আগ্রহে লক্ষ্মীনাথের পথ চেয়ে রইল।
অবশেষে লক্ষ্মীনাথকে আসতে দেখে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তিনজন একসঙ্গে লক্ষ্মীনাথের রুমে ঢুকল।
লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রকুমার স্নেহমাখানো সুরে জিজ্ঞেস করল,' বেজ, ব্যাপারটা কি?'
লক্ষ্মীনাথ নিরুত্তর।
অধৈর্য হয়ে হেমচন্দ্রও জিজ্ঞেস করল,' আসলে তোমার কি হয়েছিল, বলতো?'
ইতিমধ্যে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে সামলে নিয়েছে। জামাটা খুলে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখে বিছানায় বসল। তারপর নিজে নিজেই গেয়ে উঠল,
' হে অসম( বঙ্গ), ভান্ডারে তব বিবিধ রতন–
তা সবে(অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধনে- লোভে মত্ত , করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;–
কৈলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন ।'
লক্ষ্মীনাথ থামল। অসহায় ভাবে আদরের বন্ধু চন্দ্রকুমারের দিকে তাকাল। হেমচন্দ্রের দিকে তাকাল। তারপরে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।
চন্দ্রকুমার এগিয়ে এল। তাঁর মুখে সেই মিষ্টি হাসি। ভালোবাসা আকুলতায় তেমনই সংবেদনশীল। লক্ষ্মীনাথের এই হতাশার মূলে কী সেটা সে বুঝতে পারল। তার জন্যই মাইকেল মধুসূদনের উক্ত সনেটটির বাকি অংশটুকু বলতে শুরু করল,
' স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে–
' ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি ,অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!'
পালিলাম আজ্ঞা সুখে;পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।'
অবশেষে লক্ষ্মীনাথ সমস্ত কিছু খুলে বলল। দুই বন্ধুর সামনে সমস্ত কথা বিস্তারিতভাবে খুলে বলে মনের জ্বালা কমাল।
' এটা আমার জন্য ভালো শিক্ষা হল, বুঝেছ। এর প্রয়োজন ছিল।' লক্ষ্মীনাথ বলল ,ও তোমরা হাসছ!'
' একদিন একটা বই খুঁজতে গিয়ে তোমার কবিতার খাতাটা আমার হাতে পড়ল।'হাসতে হাসতে চন্দ্রকুমার বলল,' তোমাকে না জানিয়ে কয়েকটি কবিতা পড়েছিলাম। সেদিন কফি হাউসে ঠাকুরবাড়ির সুধীন্দ্রনাথ এবং বলেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা , তারা আমাদের বাংলায় লিখতে বলল, এটাই তোমাকে–'
'না, আমার মনে তাদের বিশেষ কোনো প্রভাব পড়েনি।' লক্ষ্মীনাথ বলল,' আগে থেকেই ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্য আমাকে আকর্ষণ করে। তোমরা তো জানোই, আমি মাইকেলের ভক্ত। মাইকেলের অমিত্রাক্ষর ছন্দে প্রকাশ করা বীররস আমাকে আকর্ষণ করে। মাইকেলের কাব্যগুলি সত্যিই একটি অপূর্ব সৃষ্টি । তার জন্যই একবার পরিকল্পনা করেছিলাম আমিও 'মেঘনাধ বধ'এর মতো একটা মহাকাব্য রচনা করব। আর জান, তার জন্য কাগজ কিনে এনে লিখতেও শুরু করেছিলাম। তারপরে বঙ্কিমচন্দ্রের রম্য রচনাগুলি ভালো লাগে, রবি ঠাকুরের কবিতা গুলির মধ্যেও নান্দনিক ভাব অনুভূতিতে সমৃদ্ধ জীবনের ছন্দ খুঁজে পাই, বাংলা নাটক প্রহসনগুলিও আমাকে আকর্ষণ করে । তাছাড়া বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারি। বাংলায় ভাব প্রকাশের জন্য বিন্দুমাত্র অসুবিধা অনুভব করিনা। তাই আমার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল যে বাংলায় হয়তো কবিতা লিখতে পারব।'
' সত্যিই পারবে।'হেমচন্দ্র বলল,' এটা তোমার শুরুমাত্র। শুরুতে অনেকেরই এই ধরনের ব্যর্থতা আসে। চেষ্টা করলে তুমিও বাংলায় ভালো কবিতা লিখতে পারবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, অসমিয়া হয়ে তুমি কেন বাংলায় কবিতা লিখবে? বাংলা ভাষার উন্নতি করার জন্য মাইকেল আছে, হেমচন্দ্র আছে, দ্বিজেন্দ্রলাল আছে, রবীন্দ্রনাথ আছে–তাঁরা তাদের মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করছে। এদিকে অসমিয়া হয়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষায় না লেখাটা অন্যায় হবে না কি?'
' হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ গোঁসাই।' একটা নিঃশ্বাস ফেলে লক্ষ্মীনাথ এবার আত্মস্থ হল।
' তা করতে হলে আমাদের সাহিত্যে পাশ্চাত্যের রোমান্টিক ধারা আনতে হবে।'
লক্ষ্মীনাথ বলল,' সেদিন কফি হাউসে বসে এই রোমান্টিকতার বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার শেষে আমাদের সাবধান করে সুধীন্দ্রনাথ একটা কথা বলে ছিল । তিনি বলেছিলেন মাতৃভাষার সাহিত্য রচনা করতে গেলে অন্ধভাবে পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করাটা আমাদের পক্ষে আত্মঘাতী হবে –।
'ও'। হেমচন্দ্র বলল পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেও আমরা যেভাবে নিজেদের ঐতিহ্য পরম্পরা বর্জন করি না বা করাটা উচিত নয়, সেভাবে বঙ্গে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে থেকেও আমরা বাঙালি নই বাংলা সাহিত্য রচনায় ব্রতী হইনা। কারণ আমাদের সাহিত্য অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। আমাদের সাহিত্যের জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আর তার জন্য অ.ভা.উ.সা. সভায় এবং আমরা প্রকাশ করা জোনাকীর পাতায় আমাদের সংকল্প নিয়েছি।'
চন্দ্রকুমার নিশ্চুপ। গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে।
'কী ভাবছ,মাজিউ?'
একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে চন্দ্রকুমার বলল,'বেজ, মাত্রাধিক রোমান্টিকতায় তুমি কিছুটা আবেগিক হয়ে পড়েছিলে নাকি?'
' ঠিকই অনুমান করেছ।' লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বরে আত্মগ্লানি, আবেগে আমি বাস্তবতা হারিয়ে অবিবেকী হয়ে পড়েছিলাম। হেম গোঁসাই বলা কথাটা আমার কাছে একটা লেসন হল। এখন থেকে আমি তোমাদের মতো অসমিয়ায় কবিতা লেখার চেষ্টা করব।'
' বেজ, তোমাকে আমি একটা খারাপ খবরের কথা বলিনি।'
' খারাপ খবর! কী খারাপ খবর?'
মন খারাপের সুরে চন্দ্রকুমার বলল,'আমাদের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় বেনুধর রাজখোয়া, কৃষ্ণপ্রসাদ দুয়ারারা যে ১৪ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনে গিয়ে 'আসামিজ লিটারেরি ক্লাব খুলেছে। সেই গ্রুপে নাকি পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া যোগদান করবে।'
লক্ষ্মীনাথ আর শুয়ে থাকতে পারল না। এমনিতে পদ্মনাথ তার সঙ্গে খুব ভালো। মতের মিল হয় না বলে প্রায়ই তর্ক হয়। তর্কবিতর্কের মাধ্যমে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেই আলাদা সংগঠনের সঙ্গে সামিল হওয়াটা কেমন কথা! এভাবে আলাদা আলাদা সংগঠন করলে অ.ভা.উ.সা.র সভা দুর্বল হয়ে পড়বে। অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের জন্য সম্মিলিতভাবে সেবা করার শক্তি কমে আসবে । বাংলায় কবিতা লিখে কাগজে ছাপাতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণার চেয়ে পদ্মনাথ তাদের গোষ্ঠী ছেড়ে 'আসামীজ লিটারেরিক্লাব'এ যোগদান করার খবরটা লক্ষ্মীনাথের কাছে বেশি বেদনাদায়ক হয়ে পড়ল।
'মাজিউ, আমাদের জন্য এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কথা যে মহান উদ্দেশ্য একটা নিয়ে আমরা অসমিয়ারা একসঙ্গে কাজ করতে পারিনা।'
গম্ভীর কণ্ঠে লক্ষ্মীনাথ বলল,' তবে এটাও একটা বাস্তব। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।'
হেমচন্দ্র প্রত্যয়ের সুরে বলল,' নিশ্চয়।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন