পাখিদের পাড়া পড়শী ২/৮
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi
দ্বিতীয় অধ্যায়, ২/৮
কিশোর চৌধুরী হাতে থাকা পুস্তিকাটির পাতা উল্টে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত নির্দিষ্ট সময় এবং তারিখ গুলি তাঁর মনে নেই। পুস্তিকাটির পৃষ্ঠায় চোখ বুলানোর সময় প্রয়োজন হওয়া সময়টুকুতে কিশোর হয়ে পড়েছে মৌন এবং তারপর পুনরায় আরম্ভ করছে ।
– ফলস্বরূপ কাজিরাঙ্গা মুক্তভাবে চলতে থাকা শিকার প্রক্রিয়া বন্ধ হয় এবং বনাঞ্চলটি দর্শকের জন্য মুক্ত করে দিতে সুবিধা হয় । ১৯৫০ সনে বন সংরক্ষক পিসি ট্রেছি কাজিরাঙ্গা বনাঞ্চলকে কাজিরাঙ্গা ওয়াইল্ড লাইফ সেঞ্চুরি হিসেবে নামকরণ করে। সেভাবে চোরাই গন্ডারের শিকার বন্ধ করার প্রয়াসে ১৯৫৪ সনে অসাম রাইনোসেরস বিল গ্রহণ করা হয় ।১৯৬৮ সনে দ্য অসম ন্যাশনেল পার্ক অ্যাক্ট অফ ১৯৬৮ আইনটি বলবৎ করা হয় এবং কাজিরাঙ্গাকে রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্য হিসেবে গ্ৰহণ করা হয়।১৯৭৪ সনের ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে কেন্দ্রীয় সরকার অভায়ারণ্যটিকে সরকারি মান্যতা প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৫ সনে ইউনেস্কো কাজিরাঙ্গাকে বিশ্ব ঐতিহ্য পূর্ণ স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে ।২০০৬ সনে কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্যকে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীনে আনা হয়। কিন্তু আপনারা কিছুক্ষণ আগে গেঁথে রাখা একটি ফলকে ব্যাঘ্র প্রকল্প ২০০৭ সনে ১০০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ঘোষণা করা হিসেবে উল্লেখ করা দেখতে পাবেন।
হাতে থাকা পুস্তিকাটির অবলম্বনে নিজের বক্তব্য রেখে কিশোর চৌধুরী বসল।
— কিশোর আমাদের কাজিরাঙ্গার বিষয়ে কিছু কথা অবগত করাল। নয় কি ?
সৌম্যদা লীনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করায় লীনা সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়লো ।
– স্যার । তথ্যগুলি লিখে নিতে পারলে ভালো ছিল।
অনুরাগ নামের ছেলেটি সৌম্যদার কাছে নিজের আগ্রহ প্রকাশ করল ।
— অনুরাগ, তোমার নাম অনুরাগ নয় কি?
—হ্যাঁ স্যার।
— তুমি কিশোরের কাছ থেকে সেই পুস্তিকাটা সংগ্রহ করে নিতে পার।
— ঠিক আছে স্যার।
অনুরাগ সৌম্যদার কথায় সম্মতি জানাল।
— এই সুযোগে আমরা কাজিরাঙ্গা সম্পর্কে দুই চারটি ছোটখাটো কথা জেনে নিতে পারি। যেমন কাজিরাঙ্গাটা কত বড়? নয় কি? কাজিরাঙ্গার ক্ষেত্রফল প্রায় ৪৩০ বর্গ কিলোমিটার। কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্য নগাঁও এবং গোলাঘাট জেলায় অবস্থিত। কাজিরাঙ্গা উদ্যানে চার ধরনের উদ্ভিদ অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলি হল তৃণভূমি,এল- লিউ- ভিয়েল ইন -আন-ডেটেড গ্রেচ ল্যান্ড;কাঠনি,এল-লিউ- ভিয়েল সে-ভেন-আ উডল্যান্ডস, সবুজ অরণ্যানি, ট্রপিক্যাল ময়েস্ট মিক্সড ডেসিডিউআস ফরেস্ট এবং কম সবুজ অরণ্যানি অঞ্চল ট্রপিক্যাল সেমি এভারগ্রীন ফরেস্ট । কাজিরাঙ্গায় লম্বা দীর্ঘ ঘাস, ছোট মুক্ত জঙ্গল, জলাশয়, জলাঞ্চল এবং বালিতে ঘিরে রাখা অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। আর আপনাদের জেনে রাখা প্রয়োজন যে সমগ্র কাজিরাঙ্গাকে চারটি প্রশাসনিক রেঞ্জে ভাগ করা হয়েছে। সেই কয়েকটি হল কাজিরাঙ্গা রেঞ্জ,কঁহরা, ইস্টার্ন রেঞ্জ, আগরাতলি ওয়েস্টার্ন রেঞ্জ বাগরি এবং বুড়া পাহাড় রেঞ্জ, ঘোড়াকাটি । তাছাড়া এই রেঞ্জ কয়েকটি ব্লকের অন্তর্ভুক্ত। সেগুলি হল– বাগরি, হালধিবারি, কাজিরাঙ্গা, পানবাড়ি, ভবানী, চারিঘরীয়া, বরালি মারা এবং তামুলি পথার। প্রকৃতি কর্মীদের জন্য জ্ঞাতব্য বিষয় ।
উদয়শঙ্কর অবাক হয়ে সৌম্যদার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । মানুষটা কীভাবে এত কথা মনে রাখতে পারে। সে আগেও লক্ষ্য করেছে মানুষটা পাখি, জন্তু, গাছের নাম , বলার সঙ্গে সঙ্গে জায়গার নাম গুলিও স্বচ্ছন্দে বলে যেতে পারে ।
আরও একটি কথা জেনে রাখা ভালো যে কাজিরাঙ্গা মূলত একশৃঙ্গ গন্ডারের জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে মিশ্রিত ধরনের বন্য জন্তু দেখতে পাওয়া যায় । পৃথিবীর ভেতরে কাজিরাঙ্গা রাষ্ট্রীয় উদ্যানে বাঘের ঘনত্ব সর্বাধিক । সরকারি তথ্যমতে প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৩২ টা। কাজিরাঙ্গা রাষ্ট্রীয় উদ্যানে স্তন্যপায়ী প্রাণীর ৩৫ টি প্রজাতি আছে । তার মধ্যে ১৫ টি প্রজাতি আই ইউ সি এনের তালিকা অনুসরণ করে বিপন্নপ্রায় প্রাণীর 'রেড লিস্ট', লাল তালিকার অন্তর্ভুক্ত। অভয়ারণ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণী ছাড়াও ৯ ধরনের উভয়চর প্রাণী, ২৭ ধরনের সরীসৃপ, ৪৮০ ধরনের পাখি এবং প্রায় ৪২ ধরনের নানা রকম মাছ পাওয়া যায় ।
লীনার কথার সূত্র ধরে কাজিরাঙ্গার বিষয়ে বলার পরে আলোচনা হল প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠনের সাংগঠনিক দিকের ওপরে। প্রতি জন আগ্রহী ব্যক্তি কীভাবে নিজের নিজের অঞ্চলে নিজের সাধ্য অনুসারে কাজ করতে পারে, ছোট কাজেই সংরক্ষণ আন্দোলনকে কীভাবে বহুমাত্রা প্রদান করতে পারে ইত্যাদি কথার আলোচনা হল। প্রতিযোগী অংশগ্রহণকারীকে সৌম্যদা কথোপকথনে জড়িত করলেন। শেষে পরের দিনের কার্যসূচির বিষয়ে বলে সৌম্যদা শেষ করলেন।
শীতার্ত কাজিরাঙ্গায় নটা বাজতেই রাত গভীর হয়ে পড়ল।
রাতের আহার গ্রহণ করার শেষে বিছানায় উষ্ণতার তাপ নেওয়া প্রকৃতি কর্মীদের ক্লান্ত শরীরকে অতি কম সময়ের ভেতরে নিদ্রা দেবী নিজের কোলে টেনে নিলেন।
সকাল বেলাটা গত রাতের মতোই আরম্ভ হল। গতানুগতিক শিবিরের ব্যস্ততা। হাতে দাঁতন, বাথরুম, চা পর্ব, সামূহিক আড্ডা।
উদয়শঙ্কর আজও এক পাক হেঁটে এসেছে। গতকালের চেয়ে আজ কিছুটা কুয়াশা বেশি করে পড়েছে। ধোঁয়ার মতো গাছগুলির মাঝে মাঝে কুয়াশা লম্বায় ঝুলে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মুখটা মেলে দিলেই মুখের ভেতর থেকে তপ্ত নিশ্বাসের সঙ্গে ধোঁয়ার মতো জলীয়বাষ্প বেরিয়ে আসে। দুই হাতের তালু ঘষে উদয়শংকর শরীরের উত্তাপ বাড়াতে চেষ্টা করে। গরম চায়ের গ্লাসটা দুই হাতের মধ্যে নিয়ে উদয়শঙ্কর আরাম অনুভব করে।
প্রচন্ড শীতের প্রকোপের মধ্যেও চোরাশিকারি উদ্যানের কোন নিভৃত কোণে শিকারের আশায় ওত পেতে রয়েছে। গত এক সপ্তাহে তিনটি গন্ডার হত্যা করে খড়গ কেটে উধাও হয়ে যাওয়ায় তারা সফল হয়েছে। সবই যেন নিলিপ্ত অথবা সাধ্যের বাইরে। কোথাও কোনো খুঁত আছে অথবা নিষ্ঠার অভাব।
দূরে উদয়শঙ্করের জন্য কোনো একটি অচিন পাখি ইকাও ইকাও করে চিৎকার করে কোথাও উড়ে গেছে। বারান্দার একটি চেয়ারে বসে দূর সীমান্তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উদয়শঙ্কর দেখতে পাচ্ছে কুয়াশায় ঘেরা সবুজের বিস্তৃতি। আত্মমগ্ন হয়ে নিজেকে হারাতে চেয়েও সে ফিরে এল। এই সময়টুকু তার ব্যস্ততার সময়।
তাড়াতাড়ি করে সে সকালের আহার খেতে গেল।সৌম্যদা, কিশোর গোলাপ এবং হরেন গগৈ মুখোমুখি বসে খাওয়ায় মগ্ন ।
হরেন গগৈ তাকে ডাকল– এসো, এসো উদয়শঙ্কর।
– আপনি কোথায় ছিলেন। আসার সময় দেখতে পেলাম না যে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল।
—বারান্দার একটু ওদিকে।
সৌম্যদা তাকে সকালের আহার সাজিয়ে রাখা টেবিলের কোণে এগিয়ে আসার জন্য দেখিয়ে দিল। সে সেদিকে এগিয়ে গেল।
তিনটে পুরি একটু ডাল এবং একটা সিদ্ধ ডিম নিয়ে উদয়শঙ্কর ওরা চারজন বসে থাকা টেবিলের কাছে খালি টেবিলের সামনে বসল।
তাদের মধ্যে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। চারজনই খাওয়ায় ব্যস্ত।
হরেন গগৈ উদয়শঙ্করকে জিজ্ঞেস করলেন–' তুমি কখন ও কাজিরাঙ্গার ভেতরে গিয়েছো কি ?
— না দাদা। আজ প্রথম।
— আমিও সেভাবে ভেতরে যাইনি বলতে পার। হরেন গগৈ উদয়শঙ্করের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেন।
— আমার মনে হয় অসমের প্রতিটি ব্যক্তিকে কাজিরাঙ্গা দর্শনের প্রাকমুহূর্তে এক অনামি শিহরণ দোলা দিয়ে যায়।
উদয়শঙ্করের মন্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সৌম্যদা কাকে জিজ্ঞেস করল— কেন, তোমার এরকম হয়েছে নাকি?
— হয়নি বলে বলতে পারছিনা।
শিবিরে অংশগ্রহণ করা অংশগ্রহণকারীদের জন্য কাজিরাঙ্গা দর্শনের সমস্ত ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করে রাখা ছিল।তাঁরা যথাসময়ে যথাস্থানে গিয়ে মারুতি জীপে উঠলেই হল।
দলটির জন্য চারটি মারুতি জিপসি ঠিক করে রাখা আছে। ক্রমিক নম্বর অনুসরণ করে এক একটি দলের জন্য এক একটি গাড়ি। দলগুলির নামকরণ করা হয়েছে রাইনো, টাইগার, ইলিফ্যান্ট এবং হলৌ। একইভাবে জিপসি কয়েকটির সামনের আয়নায় সংগঠনের দ্বারা ছাপানোর রাইনো, টাইগার, এলিফ্যান্ট এবং হলৌর একটি স্টিকার লাগিয়ে রাখা আছে যাতে দলগুলি নির্দিষ্ট গাড়িটা খুঁজে পাওয়ায় কোনো অসুবিধার সম্মুখিন হতে না হয়।
নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যেকেই হুড়মুড় করে এসে নিজের নিজের ভাগের গাড়ি গুলিতে উঠে নিল। সামনের চালকের কাছের আসনে একজন নিরাপত্তারক্ষী। বাকি আরোহীরা পেছনে দাঁড়ানো। স্মৃতিকে স্থায়িত্ব দানের জন্য হাতে ক্যামেরা গুলি প্রকৃতি কর্মীরা সাবধানে খামচে ধরেছে। হরেন গগৈ আরও সাবধান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন