হে আমার স্বদেশ- ৮
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(আট)
মানুষের ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাস কেবল রাজা এবং সেনাপতিদের দ্বারা সাম্রাজ্য বিজয়ের কাহিনি নয়। মানবীয় চেতনা সম্পন্ন সৃজনশীল মানুষই তাদের উত্তর পুরুষদের জন্য গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করে। রাজ সিংহাসনে না থাকা মানবীয় কর্মে আত্মনিবেদিত এই সমস্ত মানুষ গড়ে তোলা সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস রাজা মহারাজার বীরগাথার চেয়ে মহৎ।
কলকাতার এক একটি মেসে অনুষ্ঠিত হওয়া অসমিয়া ছাত্রদের শনিবারের টি-পার্টি বা চা খাওয়ার আসরগুলি প্রাণ পেয়ে উঠল। এই আসরগুলিতে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করা লক্ষ্মীনাথ, চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্র ছাড়া সত্যনাথ বরা, পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়া, কনকলাল বরুয়া, বেনুধর রাজখোয়া, আনন্দচন্দ্র আগরওয়ালা, দুর্গা প্রসাদ মজিন্দার বরুয়া, রত্নেশ্বর বরুয়া আদি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করলেন । সেদিন লক্ষ্মীনাথ তুলে ধরা বক্তব্যের প্রভাব সবার উপরেই ভালোভাবে পড়েছিল। অসমের সাম্প্রতিককালের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বিষয়টি চাপা পড়ে গেল । সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসাধারণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করাটাই জাতির মুক্তির উপায় এবং তার জন্যই যে অসমিয়া ছাত্রদের জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করা উচিত, বিনন্দ বরদলৈর এই মতবাদটি নিয়ে আলোচনা হল না। অবশেষে প্রত্যেকেই একমত হলেন যে অসমিয়া জাতির মুক্তির সিংহদুয়ার হল মাতৃভাষার উন্নতি সাধন। ফলস্বরূপ,১৮৮৮ সনের ১৫ তারিখ ৬৭ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত চায়ের আসরে জন্ম লাভ করল 'অসমীয়া ভাষা উন্নতি সাধিনী(অ.ভা.উ.সা)সভা' এবং শৈশবে পদার্পণ করা মাতৃভাষা কীভাবে লালিত পালিত হবে, কীভাবে তা পৃথিবীর অন্যান্য ধনী এবং উন্নতশীল ভাষার সমান হয়ে আপন গৌরব সূর্যের আভা চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে দুঃখী এবং অন্ধকারে আবৃত অসমের মুখ আলোকিত করতে পারবে; কীভাবে সে দুর্বল, অসুস্থ এবং জীর্ণ অবস্থা থেকে সবল সুস্থ এবং শক্তিশালী হয়ে উঠবে তার উপায় সাধনই হল এই সভার উদ্দেশ্য।'
নিঃসন্দেহে এই দিনটি অসমিয়া জাতির কাছে এবং অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন । বিশেষ করে এই দিনটি আরও বেশি মহত্বপূর্ণ এইজন্য যে অসমিয়া ভাষা উন্নতি সাধিনীর সভাটি সংগঠিত হয়ে উঠল একমুঠো প্রবাসী অসমিয়া প্রবাসী ছাত্রের দ্বারা অসমের বাইরে বঙ্গ সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষার পীঠস্থান কলকাতার একটি মেসে। কেবল সভা গঠন করেই সদস্যরা ক্ষান্ত হল না। দূরদর্শী চেতনায় তারা সুপরিকল্পিত কিছু কার্যসূচিও গ্রহণ করল। সেগুলি হল–
ক) পুরোনো পুঁথি সংগ্রহ এবং প্রকাশ ।
খ)অসমের সমস্ত শিক্ষানুষ্ঠানে অসমিয়া ভাষার প্রচলন।
গ) শুদ্ধ ব্যাকরণ এবং বর্ণ বিন্যাসের প্রচলন ।
ঘ) সংস্কৃত এবং অন্যান্য ভাষা থেকে ভালো ভালো পুঁথির অনুবাদ করণ।
ঙ) অসমের সামাজিক এবং ধর্মীয় রীতিনীতির বৃত্তান্ত সংগ্রহ এবং সেগুলির ইতিহাস প্রণয়ন।
চ) পাঠ্যপুথির অভাব দূরীকরণ এবং সাহিত্য সৃষ্টি.
. ইত্যাদি।
এভাবে সভা গঠন করে ভবিষ্যৎ কার্যসূচির রূপ দান করতে রাত দশটা বেজে গেল। কিন্তু কারও সময়ের প্রতি লক্ষ্য ছিল না। একমাত্র বিনন্দ বরদলৈ ছাড়া কোনো সদস্যের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার অভাব ছিল না। অবশেষে সমস্ত গুছিয়ে সাড়ে দশটায় সদস্যরা নিজের নিজের মেসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
সভার কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা লক্ষ্মীনাথ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাছাড়া মির্জাপুর স্ট্রিটের ছোট ঘরটিতে এতক্ষণ ধরে কাজ করায় মাথা ব্যথা করছে। কপালের কাছটা ব্যথা করছে। এত রাতে নির্জন হয়ে পড়া গলি দিয়ে হাঁটার পরে বাইরের মুক্ত বাতাস তাকে সুস্থ করে তুলল। তার সঙ্গে চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্র। তারাও ক্লান্ত। কিন্তু মনের মধ্যে বড় কিছু একটা, স্বজাতির জন্য মহান কিছু একটা করার উৎসাহে ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করছে না।
' বেজ, বিনন্দ এসেছিল।' চন্দ্রকুমার বলল,' কিন্তু সভার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে চুপ করে বসে রইল।'
' কিছু একটা বললে কারও সমর্থন পাবে না ভেবেই চুপ করে রইল।' লক্ষ্মীনাথ বলল।
' কিন্তু আমরা প্রস্তাবগুলি গ্রহণ করার পরে সে কিছু কমেন্ট পাস করল।' হেমচন্দ্র বলল।
লক্ষ্মীনাথ এবং চন্দ্রকুমার প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল,'কী ধরনের কমেন্ট?'
' এই সমস্ত প্রস্তাব নাকি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের উপাদানে দূষিত।' হেমচন্দ্র বলল,' এভাবেই বলে সে বোঝাতে চাইল যে এ সবেই অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের কিছু উন্নতি হতে পারে। কিন্তু অসমিয়া জাতির বিশেষ কোনো উন্নতি হবে না।'
', এই সমস্ত কথা বিনন্দ সভায় বলল না কেন? সভার শেষে এইসব কমেন্ট পাশ করার উদ্দেশ্য কি?'
কঠিন সুরে বলে চন্দ্রকুমার লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকাল। লক্ষ্মীনাথ কিছুই বলল না। সে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। উজ্জ্বল আলো ফেলে রাজপথের অন্ধকার দূর করে একটা গাড়ি আসছে।
সাংস্কৃতিক ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য মানুষকে সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হতে হয়। শৈশবে স্বগৃহের ধর্মীয় পরিবেশে লক্ষ্মীনাথের নৈতিক চরিত্র এবং বৈষ্ণব ভাবরসে আধ্যাত্মিকতা বিকাশের জন্য গুরু হলেন তার পিতা। স্কুলের জীবনে তার শিক্ষাগুরু ছিল হেডমাস্টার চন্দ্রমোহন গোস্বামী। এখন এই কলকাতায় এসে লক্ষ্মীনাথ সাংস্কৃতিক গুরুরূপে ' অসম বুরঞ্জী'র( ইতিহাস) প্রণেতা সাহিত্যিক গুণাভিরাম বরুয়াকে স্বীকার করে নিয়েছেন। ইংরেজ সরকারের চাকুরীজীবি হয়েও জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্ধুদ্ধ গুণাভিরাম বরুয়ার অনুপ্রেরণায় লক্ষ্মীনাথ এখন আগের চেয়েও জ্ঞান পিপাসু হয়ে পড়েছে। কলেজের ক্লাস গুলিতে উপস্থিত থাকার সঙ্গে মেসে দুবেলা অধ্যয়ন করে। পাঠ্যপুথির অধ্যয়ন ছাড়াও কলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের 'বঙ্গদর্শন' এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ভারতী পত্রিকা দুটি পড়ে, বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত বইগুলি পাঠ করে। ইংরেজি সাহিত্যের বই সংগ্রহ করে এনে পড়তে শুরু করেছে। তাছাড়া কলকাতার পাবলিক হল গুলিতে কোনো মনীষী বক্তৃতা দেবে শুনলেই লক্ষ্মীনাথ নোট বই এবং কলম নিয়ে যত অসুবিধাই হোক না কেন সভায় গিয়ে হাজির হয়। মনোযোগের সঙ্গে পন্ডিত দার্শনিকদের তুলে ধরা বক্তব্য শুনেই ক্ষান্ত থাকেনা, বক্তব্যের মূল কথাগুলি নোট বইয়ে লিপিবদ্ধ করে আনে। এইসব বিষয়ে পরম মিত্র চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করে।এভাবে লক্ষ্মীনাথ জ্ঞানের পরিধি সম্প্রসারিত করে চলেছে। তারপরে লক্ষ্মীনাথ প্রায়ই গুণাভিরাম বরুয়ার বাড়িতে যায়। বছরের বেশিরভাগ সময় অসমে থাকলেও শ্রী বরুয়ার লেখিকা পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়া এবং শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় । তাদের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন বাঙ্গালিদের সান্নিধ্য লাভ করে, তাদের সঙ্গে মতের বিনিময় হয়… এভাবেই লক্ষ্মীনাথের চিন্তা চেতনা সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে । মোটকথা লক্ষ্মীনাথ সঠিকভাবেই উপলব্ধি করছেন যে নিজেকে বিকশিত করার পরিশুদ্ধ চেতনায় অন্তরাত্মাকে জাগাতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা, প্রয়োজন সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ জ্ঞান, চাই মননশীল ব্যক্তিদের নিবিড় সান্নিধ্য।
রবিবার রাতে দেরি করে শুয়ে ছিল যদিও তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল। সকালে উঠেই প্রাতঃকৃত্যাদি করে স্নান করে এসে নিজের রুমে বাবার নির্দেশ অনুসারে নাম প্রসঙ্গ করল । তার পরে রঘু দিয়ে যাওয়া চা জলপান খেয়ে পড়ার টেবিলে বসল। রবিবার যখন আজ আর পাঠ্য বই পড়বে না। গতকাল কলেজ লাইব্রেরীতে পেয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের ' কমলাকান্তের দপ্তর'। বইটির দুই একটি প্রবন্ধ 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় আগেই পড়েছিল। কমলাকান্ত ছদ্মনামে বাঙালির ভন্ডামি, শঠতা, নীচতা তথা বঙ্গের সমাজ জীবনের ব্যভিচার অন্ধকার সংস্কারকে আঘাত করে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ধর্মী রচনা। মাইকেল মধুসূদনের ' মেঘনাদ বধ' এবং 'বীরাঙ্গনা' কাব্যের বীররস যেভাবে মোহিত করে, সেভাবে 'কমলাকান্তের দপ্তর'এর কমলাকান্তরুপী বঙ্কিমচন্দ্রের এই গ্রন্থটিও লক্ষ্মীনাথকে আকৃষ্ট করে, ভাবায়।
' মে আই কাম ইন, ডিয়ার?'
লক্ষ্মীনাথ মাথা তুলে দেখল, অনুমতি প্রার্থী যদিও আগন্তুক ইতিমধ্যেই রুমের ভেতরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু তাকে দেখতেই লক্ষ্মীনাথের অন্তর জ্বলে উঠল। আগন্তুক আর কেউ নয়, সদিয়ার ভোকেন্দ্র চন্দ্র বরুয়া। কলকাতায় আসার পরেই বিগত আড়াই বছরে অসমিয়া ছাত্রটির চরিত্রে নানারকম গুণের বিকাশ ঘটেছে। তাঁর স্বল্পশিক্ষিত পিতা প্রভূত ধনসম্পত্তির অধিকারী। অপত্য স্নেহ এতটাই অন্ধ যে বাড়ি থেকে টাকা এনে পড়াশোনা না করে একমাত্র ছেলেটি যে সূরা এবং জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে , পরাক্রান্ত পৌরুষের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য যে কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লীতেও যাওয়া আসা শুরু করেছে– এই সমস্ত খবর পিতার কাছে নেই। অসম মাতৃর এই রত্ন নিরীহ স্বভাবের ছাত্র হেমচন্দ্রকে নাকানি চোবানি খাইয়ে ছেড়েছিল এবং এর দুরাচারের জন্যই হেমচন্দ্র ত্রাহি মধুসূদন স্মরণ করে মেস থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও নিজেকে সংযত রেখে লক্ষ্মীনাথ ভাবল , এর আবার এখানে আসার কী প্রয়োজন হল?
' বস,ভোকেন্দ্র।' বইটা বন্ধ করে লক্ষ্মীনাথ বলল,' তারপরে, তোমার খবর কি?'
' আমার আর কী খবর থাকবে! খবর তো তোমার।'
ভোকেন্দ্র বলল,' তুমি এখন 'লিডার'। সবজায়গাতেই তোমার জয়জয়কার। দিকে দিকে তোমারই নাম।'
' তাই নাকি। তবে ভোকেন্দ্র, আমি 'লিডার' নই। আমি নিজেকে একজন সাধারণ কর্মী বলেই ভাবি। তথাপি কেউ যদি আমাকে'লিডার' বলেছে অথবা মানছে – তাতে কারও কোনো অসুবিধা হয়েছে নাকি?'
' অসুবিধা হতে লাগে না। তবু হচ্ছে–।'
' কী ধরনের অসুবিধা, অনুগ্রহ করে বুঝিয়ে বলবে কি?'
' অসুবিধা মানে, জ্বলুনি। মানে, তুমি তো বুঝতেই পারছ, জেলাসি– সাম আর জেলাস টু ইউ। বিশেষ করে, তুমি যে ইঞ্জিনিয়ার বলিনারায়ণ বরার 'মৌ' এর বিরুদ্ধে লেগে কাগজটা বন্ধ করে দিলে, তারপরেই বলিনারায়ণ বরা এবং তাঁর সঙ্গীরা তোমাকে খারাপ পেতে শুরু করল।'
ভোকেন্দ্রর কথা শুনে লক্ষ্মীনাথ গম্ভীর হয়ে পড়ল।
'মৌ' কাগজটির বিরুদ্ধে পত্রযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময় লক্ষ্মীনাথ বাংলা সাহিত্য এবং বঙ্গ সংস্কৃতির প্রতি মাত্রাধিক আসক্ত ছিল। তার জন্যই সুযোগ্য বলিনারায়ণ বরার 'মৌ' কাগজটা যে প্রথম থেকেই কলকাতার বাংলা কাগজগুলির অনুসরণ না করে স্বাধীন চিন্তার পথে এগিয়ে চলেছিল, এটা সে বুঝতে পারেনি। এভাবে প্রতিবাদ প্রবন্ধ লিখে 'মৌ' কাগজটা বন্ধ করে দেওয়াটা বিপথে পরিচালিত হয়ে শক্তি ক্ষয় করাই ছিল। তার জন্য এখন তার খারাপ লাগে।
' তারপরে অন্তরঙ্গ বন্ধু দুজনের সঙ্গে অসমিয়া ভাষার উন্নতির জন্য তুমি এভাবে উঠে পড়ে লেগেছ অসমিয়া জাতির ঐক্য সংহতির কথা বলে লেকচার মেরে থাক–।' ভোকেন্দ্র পকেট থেকে চুরুটের প্যাকেট বের করল। প্যাকেট থেকে একটা চুরুট বের করে আগুন জ্বালিয়ে নাক-মুখ দিয়ে গল গল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,' কিন্তু তুমি দেখছি কেবল বাংলা বই পড়। কথায় কথায় বাংলা কবিতা কোট কর। তোমার বাঙালি বন্ধু বেশি। অসমিয়াদের চেয়ে তুমি বাঙ্গালি বন্ধুদের বেশি প্রাধান্য দাও। ওদের সঙ্গে এত সুন্দর করে বাংলায় কথা বল যে আমরা বুঝতেই পারিনা যে তুমি শিবসাগরের অসমিয়া।'
এইবার লক্ষ্মীনাথের রাগ হল। এতটাই রাগ হল যে ভোকেন্দ্রকে ঘর থেকে বের করে দিতে ইচ্ছা হল।
' আর এটাও জানতে পারলাম, তুমি নাকি আজকাল প্রায়ই বাঙালি বন্ধুদের বাড়িতে যাও–।'
ভোকেন্দ্র বলল,' তারা আদর টাদর করে তোমাকে ডিনার ,লাঞ্চ খাওয়ায়। তোমার আরও একটি সুখবর শুনলাম–।'
' সুখবর!'
' প্র্যাকটিক্যালি এই সুখবরটা শুনেই আমি এখন তোমাকে' উইশ' করতে এলাম। কোনো এক মুখার্জি উকিল নাকি তার রুপসী কন্যাকে তোমার হাতে তুলে দিতে চাইছে? বিয়েতে মত দিলেই বিলাতে যাওয়ার খরচ দিয়ে তোমাকে ব্যারিস্টার করে আনবে? ভালো, কপালটা তোমার সত্যিই ভালো। ইটস এ গোল্ডেন অপরচুনিটি। তুমি রাজি হয়ে যাও, লক্ষ্মী।'
লক্ষ্মীনাথ হাসতে লাগল। বিরক্তি এবং ক্রোধটা হাসিতে প্রকাশ করে বুকটা হালকা করে মজা করার সুরে বলল,' কৃষ্ণ কৃষ্ণ! প্রভু, আমাকে রক্ষা কর। অবশ্য প্রভু ঈশ্বরের ইচ্ছা হলে তাই করতে হবে। একজন বঙ্গ ললনাকে বিয়ে করলে খুব একটা খারাপ হবে না নাকি।'
' খারাপ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। বঙ্গ ললনা সুতো কাটা, তাঁত বোনা, বাগান দেখাশোনা করা, ফসল কাটার কাজকর্ম না জানলেও ঘর গৃহস্থালিতে অতি উত্তম। তারা নানা ধরনের মুখরোচক রান্না রাঁধতে জানে। আর তাছাড়া তাদের ভালোবাসাও যথেষ্ট উষ্ণ। লক্ষ্মী, তুমি এই সুযোগটা হারিও না । আর এর জন্য একটি সেলিব্রেশন হওয়া দরকার ।'
' সেলিব্রেশন!'
' মানে পার্টি। ছোট করে, মানে তোমরা তিনজন এবং আমি, আমরা চারজন মেসের এই রুমে ড্রিঙ্কস এর গ্লাস নিয়ে তোমার আগন্তুক জীবনটা সোনালি হয়ে উঠুক বলে আমরা 'উইশ' করব।'
' ভোকেন্দ্র, তোমার মতো আমার বাড়ি থেকে শত শত টাকা আসে না। নিজের স্কলারশিপ এবং বিলাত থেকে ডাক্তারদাদা পাঠানো পঁচিশ টাকাতে আমার সারাটা মাস চালাতে হয়। তাছাড়া এখন আমার বইপত্র কেনার খরচ বেড়েছে। পার্টি দেওয়ার খরচ করাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।'
' কুছ পরোয়া নেহি। ইউ আর মাই ফ্রেন্ড, আই উইল বিয়ার ফর ইউ। এসো, আজকেই বসি। লেট আস সেলিব্রেট–।'
লক্ষ্মীনাথের মুখটা শক্ত হয়ে পড়ল ।
' ইস, তুমি রাগ করছ কেন?' বসা থেকে উঠে নাটকীয় সুরে ভোকেন্দ্র বলল,' তুমি কেবল কলেজের ক্লাস কর, বই পড়, পাবলিক হলে গিয়ে বক্তৃতা শোনো এবং বন্ধুদের সঙ্গে 'জ্ঞানগর্ভ' আলোচনা কর। কলকাতায় থেকেও কলকাতার আসন চার্মটা তুমি দেখনি। এতদিন ধরে কলকাতায় আছ। এখনও তুমি ময়নামতির কুঠিতে গিয়ে বাইজি নাচ দেখলে না, মধুকর হয়ে সোনাগাছিতে—।'
'ভোকেন্দ্র–.'
' ইস, ইউ আর সো বেরসিক! ইউ আর রিয়েলি পিউরিটান।'
অবশেষে নিরাশ হয়ে ভোকেন্দ্র বিদায় নিল।
বিরক্তি আর ক্রোধে মনটা এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে সে আর 'কমলাকান্তের দপ্তর' এ মনসংযোগ করতে পারল না। এদিকে রুমমেট রমাকান্তও নেই। ছুটি নিয়ে সে কিছুদিনের জন্য বাড়ি গিয়েছে। রবিবারের দুপুরে খেতে দেরি হয়। দুপুরের আহার না করেই লক্ষ্মীনাথ মেস থেকে বেরিয়ে পড়ল। এরকম অবস্থায় তাঁর মনে পড়ল চন্দ্রকুমারের কথা। অন্তরঙ্গ বন্ধু মাজিউর সান্নিধ্যে মনটা স্থির শান্ত হয়ে আসবে। লক্ষ্মীনাথ আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে যাবার জন্য বাসে উঠল। জানালার কাছে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভোকেন্দ্রর কথাই ভাবতে লাগল। ভোকেন্দ্ররা কেবল নিজের সুখ ভোগ নিয়ে ব্যস্ত, সে সবই জানে। ওরা ভালো নয়, অন্যকেও ভালো কিছু করতে দেয় না। এই ধরনের ছাত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ঠিক নয়। একটু প্রশ্রয় দিলেই ভোকেন্দ্র মদের বোতল নিয়ে ঘরের ভেতরে আসর বসাত।
আকস্মিকভাবে লক্ষ্মীনাথকে আসতে দেখে চন্দ্রকুমার খুবই আনন্দিত হল। মেসে খাওয়া দাওয়া করে নি। চন্দ্রকুমারের পিতা হরিবিলাস আগারওয়ালা কথাটা জানতে পেরে অন্দরমহলে গিয়ে লক্ষ্মীনাথের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। কয়েক পুরুষ ধরে অসমে বসবাস করছেন যদিও আগরওয়ালারা মূলত রাজস্থানের মানুষ হওয়ার জন্য তাদের বাড়িতে আমিষ আহার নিষিদ্ধ। নিরামিষ আহার লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগে। তৃপ্তির সঙ্গে পেট ভরে খাওয়ার পরে চন্দ্রকুমারের সঙ্গে বসে রসালো ভাষায় ভোকেন্দ্রর কথাগুলি বলল। সমস্ত শুনে চন্দ্রকুমার বলল,'ভোকেন্দ্ররা একটি শ্রেণি। যারা সৃজনমূলক কাজকর্ম করতে চায় তাদের ক্ষেত্রে এরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ওদের গুরুত্ব দেবার কোনো প্রয়োজন নেই।'
' গুরুত্ব দিইনা। কিন্তু গায়ে পড়তে এলে কী করবে? আমার খুব রাগ হয়েছিল জান।'
' ক্রোধকে সামলাতে হবে।' মুচকি হেসে চন্দ্রকুমার বলল, যাইহোক, তুমি এসে ভালোই করেছ। আজ তুমি না এলে আমি তোমাদের মেসে যেতাম।'
' বিশেষ কোনো কথা—?'
' বিশেষ মানে বড় কিছু একটা ভাবছি। গত কয়েকদিন ধরে কথাটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এটা নিয়ে সবসময়ই ভাবছি। এমনকি, রাতে ঘুমের মধ্যেও ভাবতে থাকি।'
' বলতো কী কথা?'
' দেখ আমরা মহা উৎসাহে অসম ভাষা উন্নতি সাধিনীর সভার আয়োজন করলাম। অনেকগুলি প্রস্তাব নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটা কার্যসূচিও প্রস্তুত করলাম। সেই কার্যসূচি অনুসারে আসামের জেলায় জেলায় শাখা সভাগুলি গঠিত হচ্ছে । কিন্তু আমাদের মধ্যে যারা লেখালেখি করে, যারা সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত, তাদের জন্য ভালো একটি পত্রিকা নেই । 'আসাম নিউজ',' আসাম বিলাসিনী' এবং 'আসাম বন্ধু'র চেয়ে একটু অন্য ধরনের … আমাদের মতো যারা নতুন লিখতে শুরু করেছে সেই সমস্ত তরুণ কবি লেখকদের রচনা নিয়ে নতুন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি পত্রিকা।'
' নতুন, সম্পূর্ণ অন্য ধরনের পত্রিকা!' লক্ষ্মীনাথের চোখজোড়া বড় হয়ে উঠল,' সত্যিই তুমি বড় কিছু একটা ভাবছ! আমার স্বপ্ন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে!'
একটা পত্রিকা বের করতে পারলে আমাদের রচনা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে অসমিয়া ভাষা উন্নতি সাধিনীর সভায় সময়ে সময়ে গ্রহণ করা কার্যসূচি গুলি প্রচারের কাজে সুবিধা হবে। সভার বক্তব্যটুকু আমরা মানুষের মধ্যে প্রচার করার সুযোগ পাব। সঙ্গে আমাদের মানুষকে সচেতন করতে পারব। আমাদের জাতিটিকে শিক্ষিত করে তুলতে পারব।'
' এটা সত্যিই মহৎ কাজ হবে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন যুগের নতুন প্রজন্মের লেখায় সমৃদ্ধ একটি পত্রিকা আমাদের খুবই প্রয়োজন। কথাটা শুনে আমাদের হেম গোঁসাইও নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে।'
' হেমগো়ঁসাইর সঙ্গেও আলোচনা করব। আর জান বেজ, আমি পত্রিকাটির একটি নামও ইতিমধ্যে ঠিক করেছি।'
' কী নাম ঠিক করলে?'
আবেগ মাখানো সুরে চন্দ্রকুমার উচ্চারণ করল,' 'জোনাকী।'
'জো-না-কী!' লক্ষ্মীনাথের কন্ঠে উচ্ছ্বাস,' সুন্দর, বড় কাব্যিক নাম।মাজিউ, সত্যিই তুমি কবি! নামকরণে তোমার কাব্য প্রতিভার মূর্ত প্রকাশ অনুভব করছি। আমাদের এখন জ্যোৎস্নার প্রয়োজন। শিক্ষা জ্ঞানের আলোকে আমাদের জাতিকে উজ্জ্বল করে তুলতে হবে। ডাক, হেম গোঁসাইকে ডেকে আনো।'
' ডাকতে হবে কেন? চলো, আমরাই তার ঘরে যাই।'
কলেজ স্ট্রিটের মেসে মদ্যপী, চরিত্রহীন ভোকেন্দ্র বরুয়ার রুমমেট হয়ে থাকতে গিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে হেমচন্দ্র লক্ষ্মীনাথের শরণাপন্ন হয়েছিল। লক্ষ্মীনাথ তার থাকা-খাওয়ার জন্য চন্দ্রকুমারের সাহায্য চেয়েছিল। চন্দ্রকুমার এই কুঠিতে এনে হেমচন্দ্রকে এক সপ্তাহের জন্য সঙ্গে রেখেছিল । তারপর কুঠীরই একটি ঘরে হেমচন্দ্রকে থাকতে দিয়েছে। সেদিন থেকে হেমচন্দ্র এখানে আর্মেনিয়ান স্ট্রিটেই থাকে।
চন্দ্রকুমার –লক্ষ্মীনাথ বেরিয়ে এল। পত্রিকা বের করার পরিকল্পনা নিয়ে দুজনের মনে প্রবল উৎসাহ। আমার সঙ্গে ঘরের সামনে এসে লক্ষ্মীনাথ চিৎকার করল,' এই হেম গোঁসাই, বড় খবর !'
হেমচন্দ্র নিজেই রান্না করে খায়। খেয়েদেয়ে বাসন মেজে সব গুছিয়ে উঠেছে মাত্র, তখনই লক্ষীনাথের কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হল। দুজনের কাছ থেকেই পত্রিকা প্রকাশ করার কথা শুনে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল, আমরা একটি পত্রিকা বের করব! পত্রিকাটিকে আমরাই নতুন করে গড়ে তুলব। খুব ভালো কথা। তবে আমরা পারব কি ?'
' কেন পারব না?' চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করল, আমাদের মধ্যে কিসের অভাব দেখেছ?'
'একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে হলে প্রচুর টাকার দরকার। বিশেষ করে, টাকা না হলে–।'
' কাজ করার জন্য টাকা লাগে ঠিকই। কিন্তু বড় কাজ করতে হলে টাকার চেয়েও বেশি দরকার ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে ধন কোনো বাধা নয়। তোমাদের টাকা-পয়সার কথা ভাবতে হবে না ।'জোনাকী' প্রকাশ পাবে ধরে নিয়ে কাজে লেগে পড়।'
পরের সপ্তাহের শনিবার অসমিয়া ভাষা উন্নতি সাধিনীর সভা আহ্বান করা হল। সভার মূল কার্যসূচি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ। যথারীতি সভার সম্পাদক লক্ষ্মীনাথ আলোচনার সূত্র ধরল। তাকে সমর্থন করে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার প্রয়োজন এবং তার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে বিস্তৃতভাবে বক্তব্য তুলে ধরল। হেমচন্দ্র,পদ্মনাথ, সত্যনাথ, বেণুধর, আনন্দচন্দ্র আদি নিজের নিজের ইতিবাচক মত প্রকাশ করে জোনাকী নামটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করল। এই সন্দর্ভে চন্দ্রকুমারের পরিকল্পনা এবং পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্দেশ্য শুনে উপস্থিত প্রতি জন সদস্য এতটাই মোহিত হয়ে পড়ল যে সর্বসম্মতভাবে তাকে জোনাকীর সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করল। এভাবে চন্দ্রকুমার একাই জোনাকীর সম্পাদক, প্রকাশক এবং স্বত্বাধিকারী হয়ে অসমিয়া ভাষা উন্নতি সাধিনী সভার সমস্ত সদস্যের সহযোগিতা কামনা করল।
মহা উৎসাহে প্রস্তাবিত মাসিক পত্রিকাটির কাজ আরম্ভ হল। অসম থেকে কলকাতায় পড়তে আসা অসমিয়া ছাত্রদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হল। আগে তাদের অধিকাংশই কবিতা, প্রবন্ধ ,রূপকথা স্মৃতিকথা ইত্যাদি লিখেছিলেন যদিও সেই অভ্যাসটা নিয়মিত ছিল না। এখন অ.ভা.উ.সা. সভার মুখপত্র হবে জোনাকী।অ.ভা.উ.সা সভার সদস্যদের লেখনি ছাপা হয়ে বের হবে। তাই তারা নতুন এক উৎসাহে লিখতে শুরু করল। সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে চন্দ্রকুমার লক্ষ্মীনাথকে লিখতে অনুরোধ করল।
কিন্তু লক্ষ্মীনাথ এখনও লেখালেখিতে হাত দেয়নি। চিঠিপত্র লেখে যদিও তার হাতের সাহিত্য প্রায় কিছুই সৃষ্টি হয়নি । কিন্তু অন্তরঙ্গ বন্ধু মাজীউর অনুরোধ সে কীভাবে উপেক্ষা করবে? অধিকাংশ সাহিত্যিক সাহিত্য জীবন আরম্ভ করে কবিতা রচনার মাধ্যমে। লক্ষ্মীনাথের মনে খুব বেশি কাব্য ভাবের সৃষ্টি হয় না । এমনিতেও সে কবি যশ প্রার্থী নয়। অন্যদিকে কিছু একটা লেখার জন্য যে পরিবেশের প্রয়োজন সেটাও নেই । মেসের রুমে বসে সাহিত্য রচনার কথা সে ভাবতেই পারে না। অবশেষে সে জায়গা খুঁজে নিল ইডেন গার্ডেন।
শৈশবে অভিনয় পছন্দ করত। অভিনয় দেখে অভিনেতার সংলাপ অনেকদিন বলে যেতে পারত। কলকাতায় আসার পরে স্টার, ন্যাশনাল, আদি থিয়েটারে নাটক উপভোগ করাটা একরকম নিয়মিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’, মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’, অমৃতলাল বসুর ‘বিবাহ বিভ্রাট’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘পাষাণী’, ‘সীতা’… আদি নাটক পড়েছে। সঙ্গে পড়েছে মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, অমৃতলাল বসুর 'কৃপণের ধন', 'চোরের উপর বাটপারি' ইত্যাদি প্রহসন। অবশেষে লক্ষ্মীনাথ নাটক লিখবে বলে স্থির করল। বড় নয়। গম্ভীরভাবের নাটক নয়। ছোট হাস্যরসাত্মক প্রহশন । তার জন্য বেছে নিল শৈশবে পড়া 'লিটিকা'র গল্পটা।
রবিবার। আজ কলেজ নেই।অ.ভা.উ.সা, সভা বসবে না। তাড়াতাড়ি দুপুরের আহার গ্রহণ করে কাউকে কিছু না বলে লক্ষ্মীনাথ চুপি চুপি ইডেন গার্ডেনের উপবনে চলে এল। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কোথাও কোনো মানুষ না দেখে একটা গাছের নিচে বেঞ্চে বসল। সঙ্গে এনেছে বালির কাগজ এবং পেন্সিল। কীভাবে আরম্ভ করবে, এটা নিয়ে অসুবিধায় পড়লেও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না। লক্ষ্মীনাথ লিখতে শুরু করল।
লক্ষ্মীনাথের কলম গতিশীল হল।
বালির কাগজে পেন্সিলে লেখা শব্দের সারিতে লক্ষ্মীনাথের সাহিত্য যাত্রা শুরু হল। লক্ষ্মীনাথের চেতনা বোধ থেকে জন্ম নেওয়া শব্দগুলি কাগজে বন্দি হতে লাগল। বালির কাগজে শব্দগুলি বন্দি হওয়ার পরে যখন বাক্যের রূপ লাভ করল , বাক্যগুলি যখন এক একটি পরিবেশ সৃষ্টি করল, পরিবেশে থাকা পাত্ররা যখন শব্দের দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করল, তখন সেইসব এক একটি মানুষরূপে মূর্ত হয়ে উঠল। লক্ষ্মীনাথের মন- বোধ চেতনা- সত্তা প্রাণময় শব্দের মায়াকাননে ঢুকে পড়ল।
এভাবে'লিটিকা' প্রহসনের প্রথম পর্ব প্রস্তুত হল। কিন্তু কেটেকুটে শুদ্ধ করার সময় কোথায়? চন্দ্রকুমার বারবার তাগাদা দিয়ে চলেছে। উপায় না পেয়ে নকল না রেখেই লক্ষ্মীনাথ চন্দ্রকুমারের হাতে লেখাটা গুঁজে দিল।
জোনাকী প্রকাশিত হবে।অ.ভা.উ.সা. সভার অনেক সদস্যের কাছ থেকে লেখা এল। তাবলে সবার লেখা ছাপানো যায় না। আবার কোনো ভালো লেখা যাতে বাদ না পড়ে সেটাও দেখতে হবে। তাছাড়া নির্বাচিত লেখাগুলির সংশোধন, পরিমার্জনার কথাও আছে। আপডেট দেওয়ার পরে প্রুফ দেখার কথা আছে। অঙ্গসজ্জা, প্রচ্ছদের কথাও বিবেচনা করতে হবে। জোনাকী প্রকাশ করার উদ্দেশ্য এবং সংকল্পের কথা ব্যক্ত করে সম্পাদকীয়ও লিখতে হবে। তাই সম্পাদকের কাজ অনেক। এই কাজে সাহায্য করার জন্য চন্দ্রকুমার হেমচন্দ্রের সাহায্য চাইল। হেমচন্দ্র নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী। সে উদার ভাবে সাহায্য করতে লাগল।
অবশেষে চন্দ্রকুমারের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হল।১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অ.ভা.উ.সা. সভার সদস্যরা জোনাকীর প্রথম সংখ্যা হাতে পেল।
অসমিয়া সাহিত্যের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। অসমিয়া সাহিত্য সরস্বতীর চরণে নিবেদন করা প্রথম জুলাই সংখ্যায় চন্দ্রকুমারের 'বনকুঁয়রী' কবিতা প্রকাশ পেল। প্রকাশ পেল লক্ষ্মীনাথের 'লিটিকা' প্রহসণের প্রথম খন্ড। তাছাড়া কমলাকান্ত ভট্টাচার্য লিখল' জাতীয় উন্নতি।' রত্নেশ্বর মহন্ত লিখল' আনন্দরাম বরুয়া'। সঙ্গে সম্পাদক চন্দ্রকুমার 'আত্মকথা'য় লিখলেন,'... আমরা জানি, আমাদের দেশ শিক্ষায় পেছনে, জ্ঞানে ভিখারী, ধনে দুঃখী, সংখ্যাবলে শক্তিহীন,স্বাস্থ্যে রোগি, কাজে অলস এবং পরাধীন– কিন্তু আমরা নিজে শক্তিশালী হয়েই কাজে হাত দিতে পারি। আমরা লড়াই করতে বেরিয়েছি অন্ধকারের বিপক্ষে। উদ্দেশ্য– দেশের উন্নতি 'জোনাক'।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন