পাখিদের পাড়া পড়শী ২/৫
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi
দ্বিতীয় অধ্যায় ২-৫
(দ্বিতীয় অধ্যায় ,২/৫)
বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে তার সঙ্গে মতবিনিময় করে। উদয়শঙ্কর তার জন্য অন্য এক ধরনের প্রাপ্তি অনুভব করে।
শিবিরের অংশগ্রহণকারীরা ঔৎসুক্যের সঙ্গে তৈরি হয়েছে এবং সৌম্যদার চার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিবিরের সামনের রাস্তাটিতে দাঁড়িয়ে দুজন বনকর্মী পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। দুজনেরই পরনে খাকি পোশাক এবং কাঁধে রাইফেল। দুজনেরই শারীরিক অবস্থা দেখতে তথৈবচ। বয়স পঞ্চাশের উর্ধে। অপুষ্টি এবং অভাব দুজনকেই জর্জরিত করছে বলে এক কথায় বলা যেতে পারে।
সৌম্যদা বনকর্মী দুজনের কাছে যাওয়ায় একজন বনকর্মী সরে গেল।তাঁর কর্তব্য স্থান আলাদা। সৌম্যদা অন্য একজন বন কর্মীর সঙ্গে কথা বলছে এবং কোন দিকে যেতে হবে সে কথা তাকে বুঝিয়ে দিল।
গোলাপ গগৈ এবং কিশোর চৌধুরীর হাতে দুটো বাইনোকুলার। প্রণব গগৈর হাতে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ক্যামেরা এবং সঙ্গে অন্য একটি ক্যামেরা।ট্রাইপডটা এবং কম শক্তিশালী ক্যামেরাটা তিনি কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে অন্য ক্যামেরাটি হাতে নিয়েছেন। উদয়শঙ্করের হাতে একটা 'সোনির কুলপি' ক্যামেরা। প্রণব গগৈর হাতে থাকা ক্যামেরার তুলনায় উদয়শঙ্করের হাতের ক্যামেরাটাকে একটা খেলনার ক্যামেরা বলে মনে হচ্ছে। উপস্থিত অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের সবার হাতে এক-একটি ক্যামেরা। সুনীল দাস ক্যামেরা আনেনি। পত্নী লীনা একটা ক্যামেরা থাকলে ভালো হত বলে আক্ষেপ করছে যদিও মনে কোনো ব্যথা রাখেনি। নেই তো নেই। এভাবেই চলবে!
সৌম্যদার ইঙ্গিতে প্রত্যেকেই শিবিরের বারান্দা থেকে নেমে এসে বনরক্ষী এবং সৌম্যদকে অনুসরণ করলেন।তাঁরা রাষ্ট্রীয় প্রধান পথের দক্ষিনে অবস্থিত কহঁরার গায়ে লেগে থাকা অভিমুখে যাত্রা করল । কিছুক্ষণ হাঁটার পরে তাঁরা গভীর অরণ্যে প্রবেশ করল।
কার ও মুখে টু শব্দ নেই । সৌম্যদা ইতিমধ্যে অরণ্যের ভেতরে কথা বলা নিষেধ করেছেন । কুয়াশার আচ্ছদন তখনও সুরক্ষা কবচের মতো অরণ্যটিকে ঢেকে রেখেছে । শিশিরে ভিজে রয়েছে খসে পড়া গাছের পাতার গালিচা। প্রকৃতি শিবিরের অংশগ্রহণকারীদের পদক্ষেপে সেইসব মৃত পত্রের আচ্ছাদন মড়মড় করে উঠে নি।
কিছুক্ষণ হাঁটার পরে তারা অরন্যের মাঝখানের যথেষ্ট প্রশস্ত মুক্ত একটি জায়গায় এসে উপস্থিত হল।সৌম্যদা ইঙ্গিতে তাদের সেই জায়গায় অপেক্ষা করতে বলল। উৎসুক্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট স্থানে সৌম্যদার পরবর্তী আদেশ অথবা অনুরোধের জন্য অপেক্ষা করে রইল। তার মধ্যে দুই এক জন নিজেদের মধ্যে কথোপকথন আরম্ভ করল। কয়েকজন আলোক ছবি তোলার অতি উৎসাহে দলটি থেকে কিছুটা দূরে অরণ্যের ভেতরে প্রবেশ করার প্রয়াস করল।
– বাদল, বাদল।
সৌম্যদা তাদের মাঝখানের একজনের নাম ধরে ডেকে কাছে আসতে বলল।
– তোমরা জানো কি যে তোমরা এখন হিংস্র শ্বাপদের অরণ্যে। তোমাকে দেখতে থাকা একটা বাঘ কাছেই খাপ পেতে থাকতে পারে। হাতির একটা দল আমাদের একেবারে কাছে থাকতে পারে।
নিজের ভুল এবং দোষ নীরবতার সঙ্গে স্বীকার করে বাদল মুখ দিয়ে টু শব্দও উচ্চারণ করল না । অভিজ্ঞ বন কর্মিটি তখনও তার কাঁধে রাইফেলটা ঝুলিয়ে রেখেছে । বাদলের সঙ্গে একসঙ্গে যাওয়া ছেলেদুটিও অবাধ্য ছাত্রের মতো পুনরায় অন্য সবার সঙ্গে এসে সারি বেঁধে দাঁড়াল। তার মধ্যে দুই একজন দলটির আলোকচিত্র সংগ্রহ করছে । কেউ আবার নিজের ক্যামেরায় নিজের ফোটো নেবার জন্য অন্যের সাহায্য গ্রহণ করছে।
– তোমাদের মধ্যে এক কে ছিল? গুনতে আরম্ভ কর।
সৌম্যদা গুনতে আরম্ভ কর বলার সঙ্গে সঙ্গে এক নম্বর এক বলে আরম্ভ করার পরে বাকিরাও নিজের নিজের নম্বার সমূহ আওড়াতে লাগল। কেবল দুটো নম্বরের মাঝখানে কোনো একজনের মৌখিক বিবাদের মতো মনে হল।
অরণ্য বা প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হলে আমাদের অরণ্যের প্রত্যেকটি উপাদানকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। আপনারা কি কখনও গাছের প্রেমে পড়েছেন? কখনও গাছের আকুল আহ্বান শুনেছেন? আপনারা প্রত্যেকেই একটি গাছের কাছে যান।
সৌম্যদার নির্দেশ অনুসরণ করে প্রতি জন অংশগ্রহণকারী কাছেই থাকা এক একটি গাছের কাছে গেল। উঁচু গাছগুলির নিচে দাঁড়িয়ে তারা উপর দিকে তাকাতে লাগলেন। উদয়শঙ্করকেও একটি গাছের কাছে যেতে দেখে সৌম্যদা তাকে গোলাপদের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত করলেন । উদয়শঙ্করকে উদ্যোক্তার সারিতে দাঁড় করানোয় তার গর্ব হতে লাগল।
– এখন আপনারা গাছগুলিকে মৌন হয়ে জড়িয়ে ধরে থাকুন এবং অনুভব করুন আপনাদের কী ধরনের অনুভব হয়।
এক একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে থেকে অংশগ্রহণকারীরা মৌন হয়ে রইল।
উদয়শঙ্কর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারল না। একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে সে মাথাটা গাছে রাখল। এক অনন্য অনুভব তার মগজ এবং শরীর আন্দোলিত করে তুলল। এটাই বোধহয় শ্বাশ্বত প্রকৃতির আকুল স্পর্শ এবং প্রকৃতির সঙ্গে থাকা মানুষের নিবিড় সম্পর্কের মধ্যে অব্যক্ত সৌধ।
এভাবে কিছুক্ষণ অংশগ্রহণকারীরা পরস্পর এক একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে থাকার সময় সৌম্যদা বলল– হবে।
অংশগ্রহণকারী প্রকৃতি কর্মীরা এসে পুনরায় নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়াল।
সৌম্যদা তাদের মাঝখানের কয়েকজনকে কী রকম অনুভব হল ব্যক্ত করতে বললেন। তাদের মন্তব্য থেকে বোঝা গেল যে তারা এক অনন্য অনুভব লাভ করেছে কিন্তু সেই অনুভব ভাষায় বোঝাতে তারা অক্ষম।
সৌম্যদা উদয়শঙ্করের দিকে তাকাল।
– বোঝাতে না পারা অনুভব। পার্থিব পরিবেশে কী জানি এরচেয়ে মহত্তম কোনো অনুভব হতে পারেনা । উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে,সেই প্রাণের মর্ম জীবনে প্রথমবারের জন্য উপলব্ধি করেছি। একটি মনোরম জগতে প্রবেশ করার জন্য এর চেয়ে আলাদা সুযোগ সুবিধা অন্য কি হতে পারে। এই বিরল অভিজ্ঞতার জন্য আমি আপ্লুত।
উদয়শঙ্কর ভাবুক হয়ে পড়েছে। কথাটা বলে সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছে।
সৌম্যদা অন্য একজনের নাম ধরে বলল– প্রিয়াঙ্কুশ।
প্রিয়াঙ্কুশ কী বলবে বুঝতে পারছ না। সে একবার চার পাশে তাকাল এবং পরে থাকা টি–শার্টটা কিছুটা ঠিক করার মত করে বলতে লাগল– ভালোই লেগেছে। আগে এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়নি।
সৌম্যদা লীনার দিকে তাকাল। লীনা দলটির মধ্যে একমাত্র মহিলা। পুরুষের দলের সঙ্গে সে সবগুলি কার্যক্রমে যতটা অস্বস্তি অনুভব করতে লাগছিল তার কিয়দংশ ও অনুভব করেনি। আসলে তার মনে অস্বস্তি জনিত কোনো ভাবই আসেনি।
– ভালো লেগেছে স্যার। জীবনে আজ পর্যন্ত গাছকে জড়িয়ে ধরে দেখি নি। গাছটা আমার সঙ্গে আমি ভাষা বুঝতে না পারা ভাষায় যেন কথা বলল বলে মনে হল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন