হে আমার স্বদেশ
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
(তিন)
গোয়ালন্দ থেকে রেল ভ্রমণটা লক্ষ্মীনাথের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভ্রমণ করতে এতটা খারাপ না লাগলেও খুব একটা আরামদায়ক নয়। কয়লার ভাপ সৃষ্টি করে ভারী ইঞ্জিনটা যেভাবে দুটো সামান্তরাল রেলের ওপর দিয়ে লৌহযানটিকে টেনে গতিশীল করার সময় ঘর্ষণ সৃষ্টি করে, কানে তালা লাগানো উকি দেয়, কয়লার ছাইয়ে ভরা কালো ধোঁয়া চোখে মুখে এসে পড়ে... এসব অস্বস্তিদায়ক, কিছু সময়ের সাশ্রয় হলেও রেল ভ্রমণ নৌকা ভ্রমনের মতো আরামদায়ক এবং উপভোগ্য নয় ।
রেলে শিয়ালদহ পৌছাতে বিকেল হল।
শিয়ালদহ ভারতবর্ষের একটি উল্লেখযোগ্য রেলস্টেশন। কেবল আসাম থেকে আসা যাত্রীই নয়, ইংরেজ শাসকরা কলকাতায় ভারতের রাজধানী চেষ্টা করায় দিল্লি, মুম্বাই, মাদ্রাজ সমস্ত জায়গা থেকে যাত্রীরা রেলে এসে শিয়ালদহ স্টেশনে নামে এবং শিয়ালদহ থেকেই সেই সব জায়গায় যাত্রা করে। তাই দিনরাত সবসময়ই ট্রেন আসছে, যাচ্ছে। তার জন্য স্টেশনে সবসময়ই ভিড়। গোবিন্দচন্দ্র একটা কুলিকে ডেকে ট্রেন থেকে জিনিসপত্রগুলি নামিয়ে আনল। স্টেশনটির যাত্রীদের ব্যস্ততা, ভোজপুরি কুলিদের চিৎকার চেচামেচি, ভেণ্ডরদের বিচিত্র সুরে গ্রাহক ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টা, রেল কর্মীদের দৌড়াদৌড়ি, উকি মেরে মেরে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়া... সবকিছু দেখে লক্ষ্মীনাথ দিশাহারা হয়ে পড়ল। দাদার সঙ্গে থেকেও সে অসহায় অনুভব করল।
কুলীর সঙ্গে স্টেশন থেকে বাইরে এসে গোবিন্দচন্দ্র ঘোড়ায় টানা একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করল। তাতেই জিনিসপত্র তুলে দিয়ে দুজনেই উঠে বসল। কালো লুঙ্গি পরা কোচোয়ান ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষাতেই গাড়িটা যখন প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেল , তখন লক্ষ্মীনাথ অনুভব করল যে সত্যিই সে কলকাতায় পৌঁছে গেছে। এটি তার স্বপ্নের কলকাতা। গত বছর থেকে দেখতে থাকা কলকাতায় আসার স্বপ্নটা আজ বাস্তবে পরিণত হল । লক্ষ্মীনাথ চলমান ঘোড়ার গাড়িতে দাদার বাঁ পাশে বসে পথের গাড়ি- মোটর দেখছে, ঘোড়ার গাড়ি দেখছে, মানুষে টানা রিক্সা দেখছে, বিভিন্ন বয়সের পথচারীকে দেখছে, দেখছে রাস্তার দু'পাশের সুউচ্চ অট্টালিকা, দেখছে সুদৃশ্য দোকান-পাট... তার কাছে সমস্ত কিছুই নতুন, সমস্ত কিছুই অপরিচিত।
গোবিন্দচন্দ্রের সঙ্গে অসমিয়া ছাত্রদের থাকা মেসের একটি ঠিকানা আছে। সেটা অনুসরণ করে গোবিন্দ চন্দ্র কোচোয়ানকে নির্দেশ দিল। মূল রাস্তা থেকে বাঁ দিকের একটা গলি দিয়ে এগিয়ে একটা দোতলা অট্টালিকার সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। জায়গাটার নাম শানকিভাঙ্গা। ইতিমধ্যে গোধূলি নেমে এসেছে। আবাসীরা বেড়াতে বের হলেও মেসে থাকা তিন জন ছাত্রের সঙ্গে দেখা হল। স্বদেশে যাই হোক না কেন , প্রবাসে অসমিয়া মানুষ মাত্রই সহৃদয়। ছাত্র কয়েকজন তাদের আদর যত্ন করে ভেতরে নিয়ে বসাল। তারপর অসমের কোথা থেকে এসেছেন, কী ব্যাপার ইত্যাদি জিজ্ঞেস করল। তাদের আদর আপ্যায়নে সন্তুষ্ট হয়ে গোবিন্দচন্দ্র ভাইকে দেখিয়ে কলকাতায় আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। তারপর তিনি' পেয়িং গেস্ট' রূপে থাকার মতো কোনো ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ জানালেন। তিন জন ছাত্রের মধ্যে তেজপুরের অমূল্য শর্মা বলল যে তার একটি পরিচিত পরিবার আছে। তবে তাদের বাড়ি কালীঘাটে। রাত হয়ে গেছে যখন আজ এখানেই থাকুন। কাল সকালে অমূল্য শর্মা তাদের কালীঘাট নিয়ে যাবে। রাতে ছাত্ররা খাবার আমন্ত্রণ জানাল যদিও পিতার নির্দেশ অনুসরণ করে জাত রক্ষার জন্য গোবিন্দচন্দ্র এবং লক্ষ্মীনাথ মেসের আহার গ্রহণ করল না। বাড়ি থেকে পাঠানো শুকনো আহার কিছু গ্রহণ করে ছোট ঘরটির একজনের বিছানায় কোনোভাবে দুজন রাতটা কাটিয়ে দিল ।
পরের দিন । প্রাত্যহিক কাজগুলি করে নিলেও সুবিধা না থাকার জন্য নাম প্রসঙ্গ পুথি পাঠ,কীর্তন ইত্যাদি হল না । বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকেই এসবে বিঘ্ন ঘটছে। পিতৃ আজ্ঞা অনুসারে সন্ধ্যা আহ্নিক ও করতে পারেনি। এত দিনের অভ্যাস, নিষ্ঠা সহকারে পালন করে যে আত্মিক শান্তি লাভ করে তা আর হল না। তার জন্য অনেকদিন বিদেশে বসবাস করা মেজ দাদার কোনো বিকার দেখা না গেলেও লক্ষ্মীনাথের ভেতরে ভেতরে অসুবিধা হতে লাগল।
পুনরায় একটা ঘোড়ার গাড়ি ডেকে এনে মালপত্র তুলে দিয়ে অমূল্য শর্মার সঙ্গে দুই দাদা-ভাই কালীঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
সকালবেলার কলকাতা। ইংরেজদের অধীন কলকাতা। রাস্তাগুলি পাইপের প্রবল জলস্রোতে ধুয়ে নেওয়া হচ্ছে । এখনও দোকানপাট খোলেনি। লোকজনের ভিড় নেই। সকালের স্নিগ্ধ রোদের আলো কলকাতা শহরকে রঙিন করে তুলেছে। এবার লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগল। শিশুসুলভ কৌতুহল নিয়ে মেজদাকে রাস্তাঘাট, চোখের সামনে ভেসে উঠা অট্টালিকাগুলির নাম জিজ্ঞেস করছে। চার বছর কলকাতায় বসবাস করে অভিজ্ঞ গোবিন্দচন্দ্রও মহা উৎসাহে ভাইকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে।
কালীঘাট পৌঁছাতে আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগল। অমূল্য নিয়ে আসা বাড়িটা মূল কালীঘাটে নয়। মূল কালীঘাট থেকে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একটা গলির ভেতরে ঢুকে সেটা অতিক্রম করে অন্য একটি গলির ভেতরে ঢুকে এগিয়ে গিয়ে পুরোনো একটি বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। বাড়িটার দেওয়ালগুলি ইটের তৈরি। চালের টিনটা মরচে ধরা। কোচোয়ান গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে আনার আগেই অমূল্য বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। গোবিন্দচন্দ্র গাড়ির ভাড়া দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে বাইরের বারান্দায় অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরেই অমূল্যের সঙ্গে শক্তপোক্ত আধবয়সী একজন মানুষ বেরিয়ে এলেন। তার পরনে হাঁটুর ওপরে ধুতি। খালি গায়ে ধবধবে সাদা পৈতা। মাথায় টিকি। অমূল্য গোবিন্দচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,' এই যে,ইনি মেসোমশাই। বেণীমাধব হালদার। মেসোমশাই ,ওরা আসাম থেকে এসেছেন।'
কোনোরকম শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে হালদার মহাশয় জিজ্ঞেস করলেন,' তা পেয়িং গেস্ট হয়ে কে থাকবে?'
' এই যে এই ছেলেটি, নাম লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া।'
' বেজবরুয়া! ব্রাহ্মণ ?'
' হ্যাঁ ,মেশোমশাই। নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ।'
' বেজবরুয়া টাইটেল!'
' বেজবরুয়া আসামের রাজার দেওয়া উপাধি। ওদের বাবা রাজবৈদ্য ছিলেন।' অমূল্য বলল,' আপনি ওকে লক্ষ্মী বলে ডাকবেন।'
মানুষটার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগল না। তাই প্রথম সাক্ষাতের শিষ্টাচারটুকু দেখাতে অসুবিধা হচ্ছিল। গোবিন্দচন্দ্র চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই লক্ষ্মীনাথ হালদার মহাশয়ের পায়ে হাত দিয়ে একটা প্রণাম করে নিল ।
' থাক থাক বাবা দীর্ঘজীবী হও।' আশীর্বাদ জানিয়ে হালদার মহাশয় বললেন,' তা দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো। ওগো গিন্নি– এই দেখ, অমূল্য কাকে নিয়ে এসেছে!'
ভেতর মহল থেকে একজন মোটাসোটা মহিলা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। তার কপালে বড় করে সিঁদুরের ফোঁটা। সিঁথিতে লম্বা করে সিঁদুরের রেখা। অমূল্য লক্ষ্মীনাথকে দেখিয়ে সব কিছু বলল। মহিলাটি এগিয়ে এসে স্নেহ মাখা দৃষ্টিতে লক্ষ্মীনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল–' ওমা কী সোনার চাঁদ ছেলেগো। মুখটা দেখছি একেবারে গোপাল ঠাকুরের মতো।'
বেণীমাধব হালদারের ঘরে লক্ষ্মীনাথের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। আচার-আচরণে বাঙালি আদিখ্যেতা থাকলেও মানুষগুলিকে ভালোই লাগল। লক্ষ্মীনাথও তাদের বাড়িতে থাকতে রাজি হল। টাকার বিনিময়ে থাকা খাওয়ার অতিথি হওয়ায় বেশি দাম দর করতে হল না। আসলে, ওদের একটি ছেলে ছিল। ছেলেটির অকাল মৃত্যু হওয়ায় এভাবে পরের ছেলেকে বাড়িতে রেখে সেবা-যত্ন করে। এর আগে অমূল্যও এখানে ছিল। এখান থেকে কলেজ দূর হয় বলেই সে শানকিভাঙা মেসে চলে গেছে। যাইহোক, লক্ষ্মীনাথের জন্য একটি ঘর ঠিক করে দেওয়া হল। ঘরটিতে তার বিছানাপত্র এবং টিনের সুটকেসটি এনে রাখা হল। গোবিন্দচন্দ্র বেণীমাধবের সামনে হাতজোড় করে' আমার ভাই কলকাতায় নতুন, ওকে দেখে শুনে রাখবেন' বলে অনুরোধ করে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিল। টাকাটা পেয়ে হালদার বাবু গদগদ ভাবে বললেন– ' আপনি তা নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। আপনাদের ভাই আমাদের এখানে বাড়ির ছেলের মতোই থাকবে।'
গোবিন্দচন্দ্র ব্যস্ত মানুষ। তাঁর কাজের শেষ নেই। তাঁর পক্ষে বেশি দিন কলকাতায় থাকা সম্ভব নয়। আজকেই লক্ষ্মীনাথের কলেজের ভর্তির কাজটা শেষ করে ফেলবেন বলে স্থির করলেন। হালদার বাবুর ঘরে রসগোল্লা- সন্দেশ সহকারে জলযোগ করে এন্ট্রাশ পাশের কাগজপত্রসহ লক্ষ্মীনাথকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ক্লাস আছে বলে অমূল্য আগেই চলে গেছে। কালীঘাট থেকে ঘোড়ায় টানা ট্রামে যাওয়া যায়। তারপরে আরও প্রায় এক মাইল রিপন কলেজ পর্যন্ত হাঁটতে হবে । সেই ঝামেলা এড়াতে দুজনেই ঘোড়ার গাড়িতে উঠল।
পথে গাড়ি- মোটর, মানুষে টানা রিক্সা অফিস কাছারিতে যাওয়া বাবুদের ভিড় বেড়েছে। মাঝেমধ্যে সদর সাহেবরা ঘোড়া দৌড়িয়ে আসছে যাচ্ছে। তাদের সামনে কেউ পড়ে গেলে ক্রোধে লাল হয়ে 'হট যাও',' হট যাও' বলে চিৎকার করে উঠছে। দুটো ঘোড়ায় টানা জুরিগাড়িও দেখা গেল । এসব হল সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার অথবা কলকাতার জমিদারদের জন্য বিলাসী যান। ঘোড়ার খুরের ঠকঠক শব্দের সঙ্গে গাড়িতে বাঁধা নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ তুলে মধ্যম গতিতে যাওয়া এই গাড়িগুলি দেখে লক্ষ্মীনাথ অভিভূত হয়ে পড়ল।
অবশেষে মির্জাপুর স্ট্রিট এসে পড়ল। মির্জাপুর স্ট্রিটেই রিপন কলেজ। প্রতিষ্ঠিতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। কলকাতার শিক্ষিত মহলে এটি সুরেন বাবুর কলেজ বলে পরিচিত। গোবিন্দচন্দ্র লক্ষ্মীনাথকে সঙ্গে নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করলেন । সাহেবি কায়দায় সম্ভাষণ জানিয়ে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতেই অধ্যক্ষ মহোদয় নাম ভর্তির তারিখ পার হয়ে গেছে, পাঠ্য বিষয় অনেকখানি পড়ানো হয়ে গেছে , এই অবস্থায় ভর্তি করলে ছাত্রের পক্ষে অসুবিধা হবে বলে জানালেন। কিন্তু ভাইকে নিয়ে সুদূর আসাম থেকে এসেছে, এতদূর থেকে এসে কীভাবে ফিরে যাবে - এ কথা বলে গোবিন্দচন্দ্র বিশেষভাবে অনুরোধ জানালেন । অধ্যক্ষ মহোদয় চিন্তিত হয়ে পড়লেন। স্বাস্থ্যবান সুন্দর তরুণ লক্ষ্মীনাথের বিনম্রভাব দেখে তাঁর ভালো লেগে গেল। অবশেষে অধ্যক্ষ মহোদয় ভর্তি হওয়ার জন্য অনুমতি প্রদান করলেন।
নাম ভর্তির সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গোবিন্দচন্দ্র লক্ষ্মীনাথকে কলেজটা দেখালেন। কলেজ থেকে বেরিয়ে বইপত্র কেনার জন্য কলেজ স্ট্রিটে এলেন।
কলেজস্ট্রিট মানেই বইয়ের বাজার। পথের দুপাশে কেবলই বইয়ের দোকান। ফুটপাতে তো বইয়ের দোকানের মেলা বসেছে । অবশ্য ফুটপাতের বইগুলি পুরোনো। বইয়ের জন্য একটি আলাদা বাজার দেখে লক্ষ্মীনাথ বিষ্মিত হল। এইসব দেখে , কলেজের জন্য প্রয়োজনীয় বইপত্র কিনে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করল। ভাইকে কলকাতার বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলি দেখানোর ইচ্ছা রয়েছে যদিও আষাঢ় মাসের প্রচণ্ড গরমের জন্য গোবিন্দচন্দ্র সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন। তারপর দুজনেই পথের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় এল । গাছের গোড়ায় বসে একজন বিহারী বেপারী নারকেল বিক্রি করছে । দুজনেই ডাবের জল খেল।
' লক্ষ্মী, কম সময়েই সব কিছু হল। এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর।'
গোবিন্দচন্দ্র বললেন,' প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, কলেজে প্রতিটি সাবজেক্টের কোৰ্স এগিয়ে গেছে। সেইটুকু নিজে নিজে করে নিতে হবে।'
লক্ষ্মীনাথ চিন্তিত। শান্ত কন্ঠে বলল, হ্যাঁ, পড়তে হবে।
থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হল, এডমিশন হল, বইপত্র কেনা হল। এখন থাকতে পারবি তো?'
লক্ষ্মীনাথ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল,মাথা নিচু।
'পারতেই হবে। কিন্তু সাবধানে থাকবি। ভালোর সঙ্গে কলকাতায় বদমাশ,ঠগ, জুয়াচোররা ঘুরে বেড়ায়। তাই দেখে শুনে চলতে হবে। তাছাড়া এখানে কয়েক বছর থাকবি যখন শিক্ষিত অভিজাত ঘরের বাঙালি পরিবারের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবি।' ইত্যাদি উপদেশ দেওয়া ছাড়া বাঙালির শিক্ষা, জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাঙালির সহৃদয়তার বিষয়ে গোবিন্দচন্দ্র বিস্তারিতভাবে বলে ভাইয়ের মনে সাহস জোগাল।
কিন্তু লক্ষ্মীনাথের বুকটা ভারী হয়ে উঠেছে। এভাবে বলে তাকে কলকাতায় রেখে দাদা অসমে ফিরে যাবার ভূমিকা তৈরি করছে। মুখে থাকতে পারবে বললেও মন থেকে সেই সাহস পাচ্ছে না। শিবসাগরের বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশ, পিতা -মাতা আত্মীয়-স্বজনদের ভালোবাসা… সেইসব এই কলকাতা শহরে নেই। এখানে, এই শহরে বড় বড় অট্টালিকা আছে, বিভিন্ন ধরনের যানে চলাচল করা মানুষের গতিশীলতা আছে, নাগরিক জীবন বিন্যাসের জন্য বহু ধরনের বিলাসী সামগ্রী আছে, আধুনিক শিক্ষার সংস্কৃতির চর্চার বিশ্ব দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ সেইসবের মধ্যে নিজের ভালোলাগা জিনিসগুলির বিশেষ কিছু খুঁজে পাইনি ।
মন খারাপ করে কষ্ট পাচ্ছিস বলে মনে হচ্ছে ! গোবিন্দচন্দ্র বিরক্তি প্রকাশ করল,'ও বুঝতে পেরেছি, হোম সিকনেস– বাড়ির জন্য মন কেমন করা। শোন লক্ষ্মী, বেশি করে বাড়ির কথা মনে পড়া অসুস্থতার লক্ষণ। এটাকে যতই প্রশ্রয় দিবি, ততই তোকে পেয়ে বসবে । জীবনে এগোতে পারবি না। আর শোন, বেশি খারাপ লাগলে আমাদের ভাগ্নীদের বাড়িতে যাবি।
' আমাদের ভাগ্নী!'
' বিষ্ণুপ্রিয়া। রায়বাহাদুর গুনাভিরাম বরুয়ার পরিবার। তারা মানিকতলা স্ট্রিটে ভাড়াঘর নিয়ে থাকে। বয়সে তোর চেয়ে বড় যদিও খুব মিষ্টি। এদিকে ভাগ্নির জামাই বড় উদার, খুবই পরোপকারী।'
' কিন্তু তারা ব্রাহ্ম।'
' ব্রাহ্ম হলেও আমাদের আত্মীয়। বিদেশে এসেছিস, এখন আর ধর্মের কথা গুলি এভাবে ধরে থাকলে হবে না। এমনিতেও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা উচিত। আপদে-বিপদে সহায়ক হয়।'
তথাপি লক্ষ্মীনাথ আশ্বস্ত হল না। আগামীকাল দুপুর বেলা দাদা গোবিন্দচন্দ্র যে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে অসমে রওনা হবে এটা লক্ষ্মীনাথ অন্তর থেকে মেনে নিতে পারছে না।
শূন্যতার বোধটুকু মানুষকে অসহায় করে তোলে। সঙ্গে বহন করে চলে শারীরিক দুর্বলতা। গোবিন্দচন্দ্রকে বিদায় দেওয়ার পরে লক্ষ্মীনাথেরও সেরকমই অবস্থা হল। এমনিতেও গত কয়েকদিনের নৌকা ভ্রমণ, রেল ভ্রমণ, তারপরে শানকিভাঙ্গা মেসে এক রাত কাটিয়ে কালীঘাটে এসেই পুনরায় কলেজে নাম লেখাতে যাওয়া – দেহ একেবারেই বিশ্রাম পায়নি। তারচেয়েও বড় কথা, এই কয়েকদিন খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো হয়নি। বিকেলের দিকে কালীঘাটে এসে হালদারের ঘরে প্রবেশ করে ভীষণ ক্লান্ত অনুভব করল । হালদারের পরিবার 'জলখাবার' খাইয়ে কিছুটা সুস্থ করে তুললেও আত্মীয় পরিজনের বিষয়ে বিরামহীন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে লক্ষ্মীনাথকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। সংক্ষেপে তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে দেওয়া ঘরটিতে নিজের বিছানাপত্রগুলি সাজিয়ে রাখতে লাগল। তারপরে কলেজ স্ট্রিট থেকে দাদা কিনে দেওয়া একটা বই নিয়ে পড়তে যেতেই সীমাহীন অবসাদে চোখদুটি বুজে এল।
বিছানায় পড়ে কখন গভীরঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল লক্ষ্মীনাথ বলতেই পারেনা । জেগে উঠল মাসিমার স্নেহময় কন্ঠে,' বাবা লক্ষ্মী, রান্না হয়ে গেছে– উঠ। মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও।'
ক্ষুধা অবশ্যই লেগেছে। কয়েকদিন ধরে ভাতের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। গোয়ালন্দে জাহাজ থেকে নেমে শিয়ালদহের ট্রেনে উঠার আগে ভাত খাওয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল। মেজদা উড়িয়া বামুনের দ্বারা পরিচালিত' আদর্শ হিন্দু হোটেল'এ ভাত খাওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু যে অবস্থায় ক্ষুধার্ত মানুষগুলি যেভাবে ভাত খাচ্ছিল, দৃশ্যটা দেখে তার খাবার আর কোনো আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া বামন বলে বললেও হোটেলের রাঁধুনীরা কতটা বামুন সেই সম্পর্কেও সন্দেহ থেকে গিয়েছিল। সে যাই হোক না কেন, কল কল করতে থাকা পেটের ক্ষুধা নিয়ে লক্ষ্মীনাথ রান্নাঘরে এল । মেঝেতে পেতে দেওয়া বড় পিঁড়িতে বসতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল মেসোমশাই ?'
' তিনি ফেরেননি। এখনও তাসের আড্ডা চলছে। রাত দশটার আগে আড্ডা ভাঙবে না।' মাসিমা বললেন,' তুমি বস বাবা, খেয়ে নাও।'
হালদারের পরিবারে একটা কাঁসার থালায় ভাত এবং পিতলের ছোট ছোট দুটি বাটিতে ডাল এবং মাছের তরকারি এনে লক্ষ্মীনাথের সামনে এগিয়ে দিল। কিন্তু এটা কি দেখছে? যত্ন করে বেড়ে দেওয়া ভাতগুলি একটু লালচে । পরিমাণেও কম । পাতে একটুখানি ডাটা শাক। দু-একটি শজনে ডাঁটার চচ্চড়ি, একটা বাটিতে আধার চেয়েও কম পাতলা মুগ ডাল । অন্য বাটিতে তেল মসলা দিয়ে রান্না করা মাছের তরকারি। লক্ষ্মীনাথের বাড়ির কথা মনে পড়ল । মনে পড়ল মা যত্ন করে রেঁধে দেওয়া তৃপ্তিকর আহারের কথা ।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাসিমা স্নেহের সুরে বললেন,' ভালো করে খাচ্ছ না যেন্দে ও মায়ের কথা মনে পড়ছে বুঝি।আহারে, মায়ের ছেলে মাকে রেখে এখন বিদেশে। তা বাবা ,আমি তো তোমার মায়ের মতোই। খেয়ে নাও বাবা, খেয়ে নাও ।'
এভাবে বলার জন্য লক্ষ্মীনাথ আরও বেশি করে আবেগিক হয়ে পড়ল। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। দু'চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। তারপর খেতে গিয়ে সবকিছুতেই মাত্রাধিক ঝাল থাকায় তার চোখের জলের স্রোত আরও বেড়ে গেল। ক্ষুধার তাড়নায় তবু কিছুটা খেয়ে নিল। কিন্তু ভালো করে বুঝতে পারল, এভাবে খাবার খেয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব ।
ভোররাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে প্রাত্যহিক কাজকর্ম করে বাবা তাকে গঙ্গা স্নান করতে বলেছিল। সেটা আর হল না। হালদার বাড়ির বাথরুমে হাত পা ধুয়ে নাম প্রসঙ্গ করবে– সেটাই বা এখানে কীভাবে করবে? এখানে তো বাড়ির মতো 'ঠাকুর ঘর 'নেই। হালদার কুলীন ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য একটা' ঠাকুর ঘর'। তাতে রোজ ভক্তিভাবে পূজা-অর্চনা হয়। এই ঠাকুর ঘরে বসে লক্ষ্মীনাথ গুণ গুণ করে গুরুর নাম স্মরণ করল। কিন্তু রত্নাবলী পাঠ করা হল না। বদুলা আতার চরিতাবলী থেকে কোনো ঘটনা বলা হল না, চিরাচরিতভাবে কেউ আশীর্বাদ দিল না, কাশি ঘন্টা শঙ্খ বাজানো হল না– লক্ষ্মীনাথের মনে হল কিছু যেন বাদ পড়ে গেল। তার অন্তরাত্মা তৃপ্ত হল না। এছাড়া উপায় কী? এটা বিদেশ। বিদেশি অনাত্মীয় মানুষের বাড়িতে একজন অতিথি হয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ পড়াশোনা করে কলেজের জন্য তৈরি হয়ে নিল। এই বাড়িতে ভাত খাওয়া তার জন্য একটা যন্ত্রনা দায়ক কাজ। তথাপি না খেয়ে কীভাবে বেরোবে। শুধু জলের মতো ডাল এবং একটা তরকারি দিয়ে তাকে খেতে হল। তারপর মাসিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে গলিগুলি পার হয়ে মেজদা বুঝিয়ে দেওয়া অনুসারে ট্রামে উঠে বসল।
ট্রামে উঠাটাও লক্ষীনাথের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিশাল রাস্তার পাশ দিয়ে পাতা এক জোড়া রেলের ওপর দিয়ে একজোড়া দুরন্ত এবং শক্তিশালী ঘোড়া টেনে নিয়ে যাওয়া যান। কালীঘাটের দিকে ভিড় কিছুটা কম । কিন্তু যতই এগোতে লাগল, ততই ভিড় বাড়তে লাগল। স্কুল –কলেজের ছাত্র-ছাত্রী অফিস কাছারির বাবুরা, সাধারণ মানুষকে নিয়ে ঘোড়া দুটি ট্রামটিকে অনেক কষ্টে টেনে নিয়ে যাচ্ছে । ভিড় বেড়ে চলায় ঘোড়া দুটির কষ্ট আরও শোচনীয় হয়ে পড়ল। তবুও ওদের পিঠে চালকের হাতের দীর্ঘ চাবুকের আঘাত নির্মমভাবে পড়ছে । আঘাত পেয়ে ঘোড়াদুটি মুখ উঁচু করে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠে ট্রামটাকে টেনে নিয়ে চলেছে। দৃশ্যটি দেখে লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। এদিকে যেভাবে এগিয়ে চলেছে, সময়ে কলেজে পৌঁছাতে পারবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে। ট্রাম মির্জাপুর স্ট্রিটে পৌঁছনোর আগেই ট্রাম থেকে নেমে পড়ে প্রায় এক মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে কলেজে গিয়ে পৌঁছাল। হালদার গিন্নি রান্নাবান্না করে যে আধপেটা খাইয়ে দিয়েছিল তা ইতিমধ্যেই হজম হয়ে গেছে । কলেজের ক্লাসে ঢুকে তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ল। প্রথম কথা হল, সতীর্থরা সবাই অপরিচিত। লক্ষ্মীনাথ শিবসাগরের অভিজাত বেজবরুয়া পরিবারের সন্তান। আত্মাভিমানী লক্ষ্মীনাথ উপযাচক হয়ে কারও সঙ্গে কথা বলল না। দ্বিতীয়ত, অধ্যাপকদের বক্তৃতা ইংরেজিতে। বাঙালি অধ্যাপকদের ইংরেজি তবুও কিছুটা বুঝতে পারল । সাহেব অধ্যাপকদের বক্তৃতার কিছুই বুঝতে পারল না। বিশেষ করে, গণিতের ক্লাসে অধ্যাপক পাঠদান করা বিষয়টি দুর্বোধ্য কিছু সাংকেতিক চিহ্ন বলেই মনে হল। অর্থাৎ কলেজে দেরি করে ভর্তি হওয়াটা তার পক্ষে সত্যি কাল হয়ে দাঁড়াল। ভর্তি হওয়ার সময় অধ্যক্ষ মহোদয় এই কথাগুলি বলেছিলেন। তথাপি পারবে বলে মনে আশা নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু কোনো ক্লাসের কোনো বিষয়ই বুঝতে না পেরে লক্ষ্মীনাথ চোখের সামনে অন্ধকার দেখল। তার এরকম মনে হল আধুনিক শিক্ষায় উন্নত দেশে যাবার জন্য সে একটি গরুর গাড়িতে উঠেছে এবং ওপাশে জ্ঞানের ভান্ডারের সঙ্গে অধ্যাপকরা অন্য সমস্ত ছাত্রকে নিয়ে রেলের গাড়িতে দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
লক্ষ্মীনাথের মনটা হতাশার ভরে উঠল। কলকাতায় পড়ার জন্য আসা নিয়ে বাবা বাধানিষেধ আরোপ করায় দেড় মাস সময় পার হয়ে গেল, তার জন্যই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বাবার প্রতি তার অভিমান হল। রাগ হল। তবু সে কলেজে আসতে শুরু করল। বাড়িতে বইপত্র পড়ে পাঠ্য বিষয় বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই হল না। কিছুই বুঝতে পারল না। এদিকে ওদিকে কোনো বন্ধু নেই যে তার সঙ্গেই মনের দুঃখ বেদনার কথা প্রকাশ করে সমাধানের চেষ্টা করবে। একবার ভাবল শানকিভাঙ্গা মেসে থাকা সেই অমূল্য শর্মার সঙ্গে দেখা করবে। আবার ভাবল, রায়বাহাদুর গুণাভিরাম বরুয়ার বাড়িতে গিয়ে তাদের সাহায্য চাইবে। কলকাতার মতো মহানগরে বাড়ি খুঁজে পেয়ে কারও সঙ্গে দেখা করাটা খুব একটা সহজ নয়।
হতাশা এবং মন খারাপ নিয়ে এরকম হল যে সপ্তাহের অন্তিম দিন লক্ষ্মীনাথ শেষের দুটো ক্লাস না করেই বেরিয়ে এল। না, লাভ নেই। এখন এই কয়েক মাস পড়ে পরীক্ষায় পাশ করা অসম্ভব।
লক্ষ্মীনাথ কলেজ চৌহদ থেকে বেরিয়ে আসছিল। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল,' শোন তো ভায়া-
ঘুরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীনাথ দেখল, ফিনফিনে ধুতি পরা এবং গিলা করা পাঞ্জাবি পরনে সুদর্শন যুবক । পায়ে ঢাকাইয়া চপ্পল । কাঁধে গোলাপি রংয়ের সুন্দর কাপড়ের ব্যাগ । কথাবার্তা আচার আচরণে বাঙালি আভিজাত্য । পাশ দিয়ে গেলেই তাদের সাজ-পোশাকের স্নিগ্ধ সৌরভ একটা ছড়িয়ে পড়ে । লক্ষ্মীনাথ আগেও তাদের দেখেছে । এটাও লক্ষ্য করেছে যে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকার চেয়ে তারা কলেজের অন্যান্য অনুষ্ঠানে বেশি সক্রিয় ।
এগিয়ে এসে অপেক্ষাকৃত লম্বা যুবকটি বলল,' তুমি বাপু সবার থেকে দূরে দূরে থাক। ক্লাসে কিছু বল না। সতীর্থদের কারও সঙ্গে কথা বলতেও আগ্রহ দেখাও না । ব্যাপারটা কি, বলতো?'
কিছু একটা বলার আগেই অন্য একজন তার নাম জিজ্ঞেস করল ।
লক্ষ্মীনাথ নিজের নাম বলল ।
'উপাধি বেজবরুয়া । তারমানে আসামে বাড়ি। আসামের কোথায় থাক?'
' শিবসাগর।'
' শিব সাগর জায়গাটা শিলঙের কাছাকাছি, তাই না?'
আসাম সম্পর্কে বঙ্গসন্তানের ভৌগোলিক জ্ঞান দেখে ভারাক্রান্ত মনেও লক্ষ্মীনাথ কৌতুক অনুভব করল।
'না, শিব সাগর আপার আসামের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রংপুর শহরের আধুনিক নাম।'
' ইতিহাস প্রসিদ্ধ রংপুর।'
' রংপুর শিবসাগরের ঐতিহাসিক নাম। এই রংপুরে আহোম রাজারা ছয় শত বছর রাজত্ব করেছিলেন । আহোম সেনাপতি লাচিত বরফুকন মোঘল সেনাপতি মানসিংহকে পরাজিত করে অসম থেকে বিতাড়িত করেছিলেন ।'
লক্ষ্মীনাথের কন্ঠে আত্মগৌরবের সুর।
লম্বা যুবকটি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু বেঁটে যুবকটি কপাল কুঁচকে বলল,' শুনেছি অসম এখনও জঙ্গলে ভর্তি। হিংস্র জন্তু জানোয়ার এবং বিষধর সাপের স্বাধীন সাম্রাজ্য।'' আসামী' মানুষেরা সব আফিং খেয়ে ঝিমোয়। সেখানে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয় ।'
কথাগুলি আক্রমনাত্মক নয়। এইসব যেন অসম তথা অসমিয়ার বদনাম। লক্ষ্মীনাথের খুব খারাপ লাগল।কী বলবে ভেবে পেল না।
' আচ্ছা ভায়া, শুনেছি– আসামে গিয়ে মানুষ ভেড়া হয়ে যায়, এই কথাটা কতটুকু সত্য বলতো?'
জানার উদ্দেশ্যে গভীরভাবে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু এবার লক্ষ্মীনাথের মাথা গরম হয়ে গেল। কোনোমতে রাগটা সামলে নিয়ে বলল–' আমাদের আসামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। অতুলনীয় এই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মানুষ মোহিত হয়ে আসামেই চিরকালের জন্য থেকে যায়। সেটাকেই ভেড়া বনে যাওয়া বলে।'
' বা, বেশ ভালো বলেছ ভায়া!' দীর্ঘদেহী যুবকটি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,' তোমার রসবোধ দেখছি বড়ই সূক্ষ্ম।'
অন্যজনও সপ্রশংস হাসিতে বলল,' তাছড়া তুমি অসমিয়া হয়েও এমন সুন্দর বাংলা বলতে পার, চেহারাটাও এমন অনিন্দ্যসুন্দর– তোমার সঙ্গে দেখছি আমাদের ভালোই জমবে।'
বৰ ভাল। এজন মহান ব্যক্তিৰ জীৱনীমূলক উপন্যাস। সকলোকে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন