বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০২২

হে আমার স্বদেশ-৪ ।। সন্তোষ কুমার কর্মকার ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস ।। He Amar Swadesh-4

 হে আমার স্বদেশ- ৪

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস




  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।



(৪)

হালদার দম্পতি কথাবার্তায় ভালো। স্নেহশীল। কিন্তু তাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে লক্ষ্মীনাথের  সত্যিই বড় কষ্ট হল। খেতে বসলেই বাড়িতে মা যত্ন করে রান্না করা ঢেঁকি, লাই-লফা, পুদিনা, পালং শাকের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে পেঁপের খার (অধিক পরিমাণে লবণের গুণ থাকা রসায়ন, অসমিয়া দের প্রিয় খাদ্য ) দিয়ে রান্না করা অরহর ডালের স্বাদ। মনে পড়ে এক ধরনের টক ফল আর কচু দিয়ে রান্না করা মুগ ডালের কথা। কল্পনায় দেখতে পান থালার সামনে বেড়ে দেওয়া আইর বা কাতলা মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা মুগ ডালের বাটি। মনে পড়ে দিখৌ– দিসাং নদী আর ডিমৌর  বিলগুলো থেকে ধরে আনা তাজা তৈলাক্ত কুঢ়ি মাছ,পাবদা এবং রুই মাছ দিয়ে রান্না করা মাছের টকের অপূর্ব স্বাদ। মনে পড়ে দিসাংমুখের মোষের আঠালো দুধ দিয়ে তৈরি কোমল চালের জলখাবার। না, সে সবের কিছুই এখানে নেই। এদিকে হালদার মহাশয়ের  ঘরটা এত ছোট। এটা যেন  ঘর নয়, ইট এবং লোহায় তৈরি একটা বদ্ধ কুটির । এই ঘরে হাত–পা মেলে সাঁতরে স্নান করার মতো পুকুর নেই, গাছপালা দিয়ে সাজানো বাগান নেই, বড়োসড়ো কোনো ঠাকুর ঘর নেই । এখানে কিছুক্ষণ থাকলেই শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে । তাছাড়া প্রতিদিন কলকাতার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কলেজে যাওয়া আসা, কলেজে গিয়ে শিক্ষণীয় বিষয় গুলির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব না করা … লক্ষ্মীনাথের  জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠল । সবদিক থেকে হতাশ হয়ে সে স্বপ্নের কলকাতার সঙ্গে বাস্তব কলকাতার কোনো দিক দিয়েই  মিল দেখতে পেল না। কলকাতায় কীভাবে থাকতে হবে, অসুবিধায় পড়লে কী করতে হবে … এই সমস্ত কিছুই দাদা গোবিন্দচন্দ্র বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল । সে সবে  কোনো কাজ হল না। কলকাতার ' ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় নিদারুণ মর্মব্যথার কাতরতায় লক্ষ্মীনাথ অসুস্থ হয়ে পড়ল। তারপরে আর উপায় রইল না। সংকোচ জড়তা ভেঙ্গে  সমস্ত কিছু জানিয়ে বাবার কাছে চিঠি লিখল । চিঠি পাওয়া মাত্র পুত্র বৎসল পিতা দীননাথ লক্ষ্মীনাথকে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন।

এযেন বন্ধন মুক্তির অনুমতি। আনন্দে আকুল হয়ে পরের দিনই সঙ্গী এক দাদার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ শিয়ালদহের ট্রেনে উঠে বসল। ট্রেনে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে জাহাজে অসমের ধুবরি, ধুবরিতে দীননাথের নাতি পূর্ণানন্দ হাকিম পদে অধিষ্ঠিত সরকারি অফিসার । দায়িত্বশীল দীননাথ টেলিগ্রাম করে লক্ষ্মীনাথের আসার  কথা পূর্ণানন্দকে জানিয়ে দিয়েছিল। পূর্ণানন্দ ধুবরি  ঘাট থেকে লক্ষ্মীনাথকে নিজের সরকারি আবাসে নিয়ে যায়। সেখানকার খাবার খেয়ে এবং অসমের আলো-বাতাস পেয়ে দুদিনেই লক্ষ্মীনাথ সুস্থ হয়ে উঠল। ধুবরিতে  আরও দুদিন থেকে লক্ষ্মীনাথ দিসাংমুখে  পৌঁছাল। সে যে সেদিন দিসাংমুখে পৌঁছাবে সে কথা বাবাকে জানায়নি । তাই দীননাথ ঘোড়া পাঠাননি। দিসাংমুখ  থেকে আট মাইল পথ পায়ে হেঁটেই লক্ষ্মীনাথকে  বাড়িতে পৌঁছাতে হল।

 তখন বিকেল হয়ে এসেছে। দাদার মাধ্যমে বাবার মত আদায় করে সে কলকাতায় পড়তে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে টিকতে না পেরে পড়াশোনা অর্ধ সমাপ্ত রেখেই চলে এল। এখন বাড়ির সবার সামনে, বিশেষ করে বাবার সামনে কীভাবে দাঁড়াবে? বাবা হয়তো খুব খারাপভাবে গালিগালাজ করবেন। ভয় এবং লজ্জায় লক্ষ্মীনাথের মুখটা মলিন হয়ে পড়েছে । সাড়া শব্দ না করে ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর চলে এল।

কিন্তু কী আশ্চর্য! লক্ষ্মীনাথকে বাড়ি ফিরতে দেখে সবাই আনন্দিত হল। মমতাময়ী ঠানেশ্বরীর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগল। তাঁর  ভাবটা এরকম যেন হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পেয়েছে । অন্যদিকে ছেলেকে দেখে দীননাথ এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়ল যে ঠাকুর ঘরে ঢুকে ঠাকুরকে প্রণাম করে কৃতজ্ঞতা জানাল। এই সমস্ত দেখে আশ্বস্ত হলেও লক্ষ্মীনাথ ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। 

স্নান করে আসতেই ঠানেশ্বরী চিড়া দুধ মালভোগ কলার জলখাবার নিয়ে এল। মায়ের যত্ন করে দেওয়া জল খাবার খেতে খেতে মনে হল যেন কত বছর ধরে এইসব খাবার খায়নি।

লক্ষ্মীনাথকে  এভাবে খেতে দেখে ঠানেশ্বরীরও ভালো লাগল। কিন্তু নিজে এত লেখাপড়া না জানলেও এক মাস পার না হতেই ছেলে যে এভাবে পড়া ছেড়ে কলকাতা থেকে চলে এল, এটাকে তিনি সহজভাবে নিতে পারলেন না।

' তোর পড়া তো শেষ হয়নি–'

লক্ষ্মীনাথ মায়ের দিকে তাকাতে পারল না। হাতের বাটিটা নিচে নামিয়ে রেখে জল খেয়ে বাটিটাতে   মুখ হাত ধুয়ে আস্তে করে বলল–' হয় নি।'

' পড়া শেষ না করেই চলে এলি, এখন কি করবি?'

কলকাতায় থাকার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে লক্ষ্মীনাথ এই কথাটা ভাবেনি। মা জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটা তাকে চিন্তা করতে বাধ্য করল। এখন বাড়িতে কী করবে, তা একটি প্রশ্ন।বড় প্রশ্ন। লক্ষ্মীনাথ উত্তরে কিছুই বলতে পারল না। মায়ের সামনে থেকে বেরিয়ে আসতেই বারান্দায় বড় বৌদির মুখোমুখি হল।

বয়সে বড় হলেও বড় বৌদির সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের সম্পর্কটা মধুর। বৌদির বাপের বাড়ি জোকতলায়। বাবা জোকতলার মৌজাদার। শ্রাদ্ধ বা এইধরনের সামাজিক কাজকর্মে বাপের বাড়ি গেলে বড় বৌদি লক্ষীনাথকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। দুই একদিন বাপের বাড়িতে খুব আদর যত্ন করে লক্ষ্মীনাথকে খাওয়াতেন। তিনি অল্পস্বল্প লেখাপড়া জানেন। বড়দাদা ডিব্রুগড় অথবা গুয়াহাটি গেলে বড় বৌদি গোপনে তার কাছে চিঠি লিখতেন। তারপরে লক্ষ্মীনাথকেই   সেই সমস্ত চিঠি ডাকে দিয়ে আসতে হত। প্রথমবারের চিঠিটা চাদরের নিচে লুকিয়ে নিয়ে ডাকঘরের কোথায় দিতে হবে সঠিক ভাবে না জেনে, ডাকঘরের সামনে পড়ে থাকা একটা ভাঙ্গা বাক্সের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পরে সেই চিঠিটা কীভাবে উদ্ধার করে সঠিক জায়গায়  ফেলেছিল সে এক বিরাট ইতিহাস। সে যাই হোক না কেন, চিঠি লিখে স্বামীকে পাঠানোর ক্ষেত্রে বড় বৌদি যে লক্ষ্মীনাথকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছিল, সেটা বুঝতে পেরে লক্ষ্মীনাথ শৈশবে গৌরব অনুভব করত।

'কী হল, বাবার সঙ্গে এত লড়াই করে কলকাতায় গেলে– সেখানে মন বসল  না যে!' মুখ টিপে হেসে বড় বৌদি বললেন,' মেজদাদা তোমাকে বাঙালি বামুনের ঘরে রেখে আসল। বাঙ্গালিদের রান্না করা সুক্ত, ইলিশ মাছের তরকারি, মুড়িঘন্ট, মোচার  ঘন্ট, মিষ্টি দই, রসগোল্লা, সন্দেশ ইত্যাদি ভালো লাগল না?'

বড় বৌদির কথায় ব্যঙ্গ। খারাপ লাগলেও এতটা গায়ে না লাগিয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' মিষ্টিগুলো খেতে ভালোই লেগেছিল। কিন্তু যে বাড়িতেই ছিলাম, স্বামী-স্ত্রী আমাকে স্নেহও করতেন। কিন্তু তাদের আহারের মান আমাদের চেয়ে অনেক নিচু স্তরের। তাছাড়া তরকারিতে যেভাবে ঝাল দেয়, খেতে গেলে চোখের জল এসে যায়। বাঙ্গালিরা যে  কীভাবে এই খাবার এত তৃপ্তি করে খায় ?'

' ও মা! কষ্ট করতে হয়েছে তাহলে!'

বড় বৌদি দুই পা এগিয়ে এসে গলার স্বরটা একটু নামিয়ে জিজ্ঞেস করল কলকাতার যুবতিরা খুব সুন্দরী। কথাবার্তাতেও  নাকি খুব চৌকস?'

' তা তো বটেই। কলকাতায় মেয়েরাও কলেজে পড়ে। ওদের জন্য আলাদা একটি কলেজ আছে।'

' তাই নাকি!'

' বেথুন কলেজ। সেই কলেজে শুধু মেয়েরাই পড়ে।'

' তরতাজা যুবক তুমি। কলকাতার কোনো মেয়ে তোমার প্রেমে পড়ল না যে?'

' আমি আর সেখানে থাকলাম কতদিন যে  সেখানকার কোনো মেয়ে আমাকে ভালবাসবে। কার ও সঙ্গে পরিচয়ই তো হল না।'

' পরিচয় হলে নিশ্চয় তোমাকে ভালোবাসত। তুমিও–।'

' হ্যাঁ ভালো লাগলে আমিও ভালোবাসতাম।'

' তোমার তাহলে একজন কলকাতাবাসীনিকে আনারই ইচ্ছা?'

' আনতে পারি।'

' বাঙালি মেয়ে আনলে বাবা তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেনা, দেখে নিও।'

বাড়িতে কাজকর্ম নেই। পড়াশোনা ভালো লাগে না। ঠাকুর ঘরের আনুষ্ঠানিকতা আছে… অভ্যাসবশত সেই সমস্ত করে। বহুদিন বিরতির পরে আরম্ভ করে প্রথম দুই দিন ভালোই লাগল। মনোযোগের সঙ্গে করে মাঝখানের অনিয়মটুকুর জন্য  সৃষ্টি হওয়া অতৃপ্তির ভাবটা নাই  হয়ে গেল। তার পরে সেগুলিও যান্ত্রিক হয়ে পড়ল। তাই মা রাধে রেঁধে বেড়ে  দেওয়া ভাত খায়, যত্ন করে দেওয়া জল খাবার  খায় এবং সারাটা দিন টহলরাম শর্মা হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

এভাবে বারো দিন অতিবাহিত হল।

তখনই গোলাঘাট  থেকে গোবিন্দচন্দ্র এল। পড়াশোনা ছেড়ে কলকাতা থেকে লক্ষ্মীনাথের চলে আসার কথাটা সে ভালোভাবে নিল না। অনুমতি চেয়ে লেখা চিঠিটা পেয়েই বাবা যে টেলিগ্রাম করে লক্ষ্মীনাথকে ডেকে আনল , এটাও তার মতে  উচিত হয়নি। ঘরের ভেতর ঢুকে জলখাবার খাওয়ার আগেই উগ্র মেজাজের মানুষ গোবিন্দচন্দ্র লক্ষ্মীনাথকে নিজের রুমে ডেকে পাঠাল। লক্ষ্মীনাথ ভয়ে ভয়ে এল। কাছে বসিয়ে নিয়ে গোবিন্দ্রচন্দ্র একটার পর একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে লক্ষ্মীনাথ থেকে সমস্ত কথা জেনে নিল। এভাবে যতই জানতে পারল,ততই তার ক্রোধ বেড়ে গেল।

' রিপন কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারকে এত অনুরোধ করে তোকে ভর্তি করে রেখে আসলাম। অসম থেকে যাওয়ার জন্য তিনি তোকে ভর্তি করে নিলেন, অথচ তুই তাঁর সম্মান রক্ষা করলি না।' ক্রোধ ভরে গোবিন্দ চন্দ্র বললেন,' আর তোকে নিয়ে কলকাতায় যাওয়া, কিছু ঠিকঠাক করে দুদিন পরেই বাড়িতে ফিরে আসা– কত কষ্ট করলাম! দেরি করে নাম লেখানোর জন্য অসুবিধা হবে বলে অনুমান করে তোকে রেখে আসার আগের দিন কতভাবে বোঝালাম!না, আমার বোঝানোতে  কোনো লাভ হল না। এত কষ্ট- শ্রম, এত অর্থ ব্যয় সমস্ত কিছু বৃথায় গেল!'

' না দাদা–।' ক্ষীণকন্ঠে লক্ষ্মীনাথ বলল, কালীঘাট থেকে রিপন কলেজ অনেক দূরে। তাছাড়া হালদার বাড়ির–।'

' কালীঘাট থেকে রিপন কলেজ দূরে, হালদার বাড়ির খাওয়া দাওয়া ভালো নয়, সেই সব খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লি– আমার কাছে এসব আজেবাজে অজুহাত দেখিয়ে রেহাই পাবি না। দেখ, আমিও কলকাতায় চার বছর থেকে এসেছি। সেখানে থেকে অসুস্থ গোলাপও এফ এ পাশ করে মেডিকেল পড়েছে। তুই কেন পারবি না? আসলে, হোম সিকনেস– তুই হোম সিকনেসের শিকার হয়েছিস । এই রোগটি থেকে কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় সবই তো তোকে বলেছিলাম । তুই  সেসব বুঝতে পারলি না। কথাগুলি বুঝে নিয়ে কলকাতার পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করলি না। কলকাতার শানকিভাঙ্গা বা কালীঘাটে যে আমাদের শিবসাগরের এই বাড়িটা উঠিয়ে নিয়ে  যাওয়া যাবে  না আর সেভাবে ভাবাটা যে গাছে গরু উঠার কথা এটা তোর মাথায় এল না। তুই কোন কিছু চিন্তা ভাবনা না করে কলকাতা থেকে চলে আসার সময় একবার নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবলি না। এন্ট্রান্সের দরজা পার হতে তোর একটা বছর লোকসান হয়েছে ।এখন এফ এ তেও আরও একটা বছর নষ্ট হতে চলেছে।'

শেষের দিকে তার গলাটা ধরে এল। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে সে সত্যিই মর্মাহত হয়ে পড়েছে।

লক্ষ্মীনাথ শুনছে। বলার মতো কিছু নেই। মাথা তুলে দাদার দিকে তাকানোর সাহস ও নেই ।

' কিছু অসুবিধা হয়েছে বলে তুই একেবারে কলকাতায় ছেড়ে চলে এলি! ও তুই একটা বেকুব না গাধা। এরকম হলে এই সংসারে তুই দেখছি কিছুই করতে পারবি না। আমরা যখন পড়তাম, তখন কথাটা অন্যরকম ছিল। এখন দিনকাল খুব খারাপ হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে আরও খারাপ হয়ে পড়বে। তোর সমবয়সীরা সব এগিয়ে যাবে, তুই পেছনে পড়ে থাকবি। লেখাপড়া শিখে জীবনে যদি কিছু করতে চাস, কষ্ট করার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে। আর এখনও সময় আছে, তাড়াতাড়ি কিছু একটা না করলে এই বছরটাও তোর  নষ্ট হবে।'

এভাবে বলে, বিরক্তি আর ক্রোধ সহকারে গোবিন্দচন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লক্ষ্মীনাথ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এবার সে অন্তরের গভীর থেকে উপলব্ধি করল যে কলকাতা থেকে এভাবে চলে আসাটা ভুল হয়েছে। এভাবে না এসে প্রথমে গোবিন্দ দাদাকে সব কিছু জানানো উচিত ছিল।তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করা হলে কী জানি হয়তো এই ভুলটা হত না।

কাছে আসেনি যদিও বাইরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ঠানেশ্বরী সমস্ত কথা শুনছিল। ছেলের অবস্থা দেখে তার খারাপ লাগল। তিনি ঘরের ভেতরে এসে মাথা নিচু করে বসে থাকা লক্ষ্মীনাথের পাশে দাঁড়াল।

' কড়াভাবে বললেও মেজদাদা ঠিকই বলেছে। তোর ভালোর জন্যই বলেছে।' স্নেহের  সঙ্গে ঠানেশ্বরী বলল,' তাই খারাপ পাস না। সময় আছে যদি কিছু একটা কর।'

মা ও ভালো উপদেশই দিয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীনাথের মনটা শান্ত হল না। নিষ্কর্মা হয়ে দিনগুলি পার করার জন্য অনুভব করা যন্ত্রণা, শুভার্থীদের অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য পাওয়া অস্বস্তি এবং দুই একজনের ব‍্যঙ্গসূচক মন্তব্য শুনে মনের মধ্যে একটা জ্বালা ছিলই। মেজদার কথায় ভুলটা উপলব্ধি করার পরে সেই জ্বালাটা বেড়ে গেল। বৈঠকখানা ঘরে ভক্তদের নিয়ে বাবা ভাগবত পাঠ করছেন। লক্ষ্মীনাথ সেদিকে গেল না। ঠাকুর ঘরে রাতের প্রসঙ্গে অংশগ্রহণ করলেও নিজে সক্রিয় হল না। এমনকি রাতের আহার খেতেও ইচ্ছা হল না।

বিছানায় পরেও অন্যদিনের মতো ঘুমোতে পারল না। এখন মনের মধ্যে এরকম একটা ভাব জাগছে যে আবার তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরে যাওয়াই উচিত হবে। অথচ সাহস গোটাতে পারছে না। মেজদাদা এবং মা সেভাবে বললেও কলকাতায় যেতে হলে বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আসার জন্য বাবা যে ভাবে আনন্দ প্রকাশ করলেন, এখন কি তিনি পুনরায় কলকাতা ফিরে যাবার জন্য অনুমতি  দেবেন? আগেরবার বাবার অনুমতি আদায় করতে মেজদাদা সাহায্য করেছিল। এবার তো এই  বিষয়ে মেজদাদাকে  বলতেই পারবেনা।

কী করবে? কীভাবে এগোবে?

ভেবে ভেবে কোনো সমাধান না পেয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারপরে ঘুমে ঢলে পড়ল। ঘন্টা তিনেক পরে ঘুম হালকা হয়ে এল। লক্ষ্মীনাথ স্বপ্ন দেখতে লাগল।

… ট্রেনে করে যাচ্ছে, কিন্তু ট্রেনের শিসটা অনেক দূরে… তারপরই দেখল কলকাতার প্রশস্ত রাজপথ… একজন সাদা চামড়ার সাহেব' হট যাও,হট যাও 'বলে চিৎকার করে একটি দুরন্ত ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে…। কিছুক্ষণের বিরতির পরে পেছনে ট্রাম গাড়ির শব্দ শুনতে পেল… লক্ষ্মীনাথ ট্রামে বসে আছে… ঘোড়া দুটি যাত্রীতে পরিপূর্ণ ট্রামটা টেনে নিয়ে যেতে পারছে না… এদিকে তার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে… তারপরে সমস্ত কিছু পরিষ্কার। পুনরায় গভীর ঘুম।… আবার স্বপ্ন। এবারের স্বপ্নটি মনোরম। কলকাতার রাস্তা দিয়ে ঝুমঝুম  শব্দ তুলে মধ্যম গতিতে দুটি ঘোড়ায় টানা একটি জুড়িগাড়ি এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্মীনাথ সেই গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। আগ্রহ এবং কৌতূহলের সঙ্গে সেদিকে তাকিয়ে দেখল, জুড়িগাড়িটির জানালার পাশে বসে আছে একজন অপরুপা সুন্দরী যুবতি…। 

সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠেই লক্ষ্মীনাথ মনে মনে স্থির করল, দ্বিতীয়বার কলকাতায় যাবার জন্য সে নিজেই বাবার অনুমতি চাইবে এবং বাবা অনুমতি না দিলেও সে আর অপেক্ষা করবে না।ঠাকুর ঘরের সমস্ত কাজ সমাপন করে জলখাবার খেয়ে দীননাথ মহাশয়  এখন ঔষধালয়ে। বাবা লক্ষ্মণকে আয়ুর্বেদের পাঠ শেখাচ্ছেন। বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই বিদ‍্যা গোবিন্দ, গোলাপ, শ্রীনাথ এবং লক্ষ্মীনাথকে শেখাতে না পেরে দীননাথ এখন লক্ষ্মণকে নিয়ে পড়েছেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র শেখানোর জন্যই ইংরেজি স্কুল থেকে লক্ষ্মণের নাম কাটিয়ে এনে বাড়িতে প্রতিদিন তাকে  দুই বেলা সেই শাস্ত্র পাঠ করান, সংস্কৃত শ্লোক গুলি অনুবাদ করে অসমিয়ায় ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন, কোন রোগের কী লক্ষণ, রোগ নিরাময়ের জন্য কোন ধরনের ঔষধি গাছের মূল, পাতা, ছালের আবশ্যক এবং সেগুলি থেকে কীভাবে ওষুধ প্রস্তুত করতে হয় ইত্যাদি নিজে করে দেখিয়ে দেন। লক্ষ্মণের এই অবস্থা দেখে ইংরেজি বিদ্যায় অনুরক্ত লক্ষ্মীনাথ ভাবল, লক্ষ্মণের ইহকাল ও পরকালে অন্ধকার নেমে আসছে। কিন্তু লক্ষ্মণ পিতার একান্ত বাধ্য। তার জন্যই ইতিমধ্যে সে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে কিছু পরিমাণে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। তাকে বুঝিয়ে উঠে এক ধরনের ঔষধ তৈরি করার আদেশ দিয়ে দীননাথ ফুকন নগর থেকে আসা ভব চলিহার পিত্তদোষ নিরাময়ের ঔষধ দিলেন।

চলিহাকে বিদায় দিয়ে দীননাথ বৈঠকখানা ঘরে এলেন। বড় চেয়ারটাতে গুনাভিরাম বরুয়ার ' আসাম বন্ধু' কাগজটা নিয়ে বসতেই লক্ষ্মীনাথ তার সামনে এগিয়ে এল। এটাই সুযোগ। এখন না বললে বাবা বেরিয়ে যাবেন। হিন্দু মহাসভা নাম ঘরে কিছু একটা সামাজিক বিচার রয়েছে। সেই সভায় বাবা সভাপতিত্ব করবেন। কিন্তু মনে মনে যতই সংকল্পবদ্ধ হয়ে আসুক না কেন, প্রসঙ্গটা তুলবে কীভাবে?

' কিছু একটা বলবি বলে মনে হচ্ছে?'

বাবা এভাবে বলায় লক্ষ্মীনাথ সাহস পেল।

' বাবা–।' আওয়াজটা দিয়েই লক্ষ্মীনাথ বাবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল,' আমি পড়াশোনা করব, তার জন্য আমি আবার কলকাতা যাব বলে ভাবছি।'

তারপরই ভয় এবং জড়তা তাকে ঘিরে ধরল। ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকাল। কিন্তু বাবা রাগ করেনি। বিন্দুমাত্র বিরক্ত হন নি।

' কয়েকদিন ধরে তোর কথাই ভাবছি।' কোমল সুরে দীননাথ বললেন–' তুই কলকাতা থেকে ফিরে আসায় সুখী হয়েছিলাম যদিও এখানে যেভাবে দিন কাটাচ্ছিস, আমার ভালো লাগেনি। ভবিষ্যৎ নেই বলে আয়ুর্বেদ শিখে চিকিৎসক হতে চাস না, ওকালতি ব্যবসা ভালো নয় বলে উকিল হতে চাস না। এদিকে তোর যে ধরনের মতিগতি, কাছারিতে ঢুকে কুড়ি পঁচিশ টাকার চাকরি করা বা অ্যাপ্রেন্টিস হওয়াটাও তোর পছন্দ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তাই তোর উচ্চশিক্ষা লাগবেই। এদিকে অসমে একটি কলেজ নেই। দস্যু মানের অত্যাচার থেকে ইংরেজ আমাদের রক্ষা করে দেশের ভার নিয়ে স্থিরতা আনল। ইংরেজ সুশাসন দিল, শিক্ষা প্রসারের জন্য স্কুল স্থাপন করল, কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য এখনও অসমে একটি কলেজ স্থাপন করল না। তাই আমিও ভেবে চিন্তে দেখলাম তুই পুনরায় কলকাতায় পড়তে যাওয়া ছাড়া নান‍্যঃ পন্থা বিদ্যতে।'

লক্ষ্মীনাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন মেজদাদা গোবিন্দচন্দ্র ঠিকই বলেছিলেন, এমনিতে যত কড়া এবং কঠিন স্বভাবের মানুষ বলে মনে হোক না কেন, বাবার অন্তরটা কোমল। বাবা সত‍্যিই স্নেহশীল।

' আগেরবার গোবিন্দ তোকে নিয়ে গিয়েছিল, এবার কার সঙ্গে যাবি?'

উচ্ছ্বসিত হয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল, আমি একাই যেতে পারব, বাবা।'

' একা যাবি! পারবি তো?'

' পারব, বাবা।'

' কলকাতায় থাকা– খাওয়া?'

' কালীঘাটের হালদার বাবুর বাড়িতে থাকব না। কলেজের কাছেই কোথাও বন্দোবস্ত করতে হবে।'

' কে বন্দোবস্ত করে দেবে?'

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ বলল,' সেবার গিয়ে কিছুটা পরিচিতি হয়েছে যখন নিজেই কিছু একটা করে নিতে পারব।'

দীননাথ চিন্তা মুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু ছেলের মুখে আত্মবিশ্বাস– প্রত্যয় দেখে ধীরে বলল,' আচ্ছা, ঠিক আছে।'

সত্যিই এবার আর কালীঘাটে পর গৃহে বাস নয়। পিতার দ্বারা নির্দেশিত জাতির বিচারকেও গঙ্গার জলে বিসর্জন দেবে। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে ৫৩  নম্বর কলেজস্ট্রিটে চলে এল। সেখানে অসমিয়া এবং বাঙালি ছাত্রদের মিশ্রিত একটি মেসবাড়ি রয়েছে। এই মেসে থাকে কলকাতা হাইকোর্টের অসমিয়া অনুবাদক রমাকান্ত বরকাকতী। তাকে ধরে থাকা খাওয়ারএকটা সুবিধা করে দেওয়ার অনুরোধ করতেই কাজ হয়ে গেল। শিবসাগরের অবসরপ্রাপ্ত হাকিম মহাশয় দীননাথ বেজবরুয়ার পুত্র লক্ষ্মীনাথকে  সাহায্য করতে পেরে রমাকান্ত সুখী হল। এদিকে ৫৩ নম্বর কলেজস্ট্রিটের মেসের কাছেই  সিটি কলেজ। সুবিধা হবে ভেবে রিপন কলেজ থেকে নাম কাটিয়ে এনে লক্ষ্মীনাথ সিটি কলেজে নাম লিখিয়ে নিল।

তারপরে আরম্ভ হল প্রস্তুতি- পর্ব। ছয়  মাস পড়াশোনা না করে কাটিয়েছে। এদিকে কলেজে পাঠদান প্রায় শেষ। ছাত্ররাও পড়াশোনার বিষয় প্রায় শেষ করে এনেছে। পরীক্ষার আর মাত্র তিন মাস বাকি। তিন মাসের মধ্যে সমস্ত কিছু বুঝে নিয়ে পরীক্ষা ঘরে বসে লিখতে হবে… এটা অসম্ভব বলেই মনে হল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ এবার' উদ্দেশ্য সাধন না হলে শরীর পতন' সংকল্প নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।

অবশ্য সযত্ন প্রচেষ্টায় যে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যায়, সে অভিজ্ঞতা তার আগেও হয়েছে। পড়ায় মাঝারি লক্ষ্মীনাথ প্রথমবার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সফল হতে পারেনি। কিন্তু অকৃতকার্য হওয়ার অপমান- গ্লানি তাকে সংকল্পবদ্ধ করে তুলেছিল । তার জন্য শিবসাগরের জনগণের নামঘরে প্রবেশ করে সে একান্তমনে অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিল এবং পরের বছর দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল।' যত্ন সর্ব জয়' মন্ত্রে বিশ্বাসী লক্ষ্মীনাথ এবারও পড়াশোনা করতে লাগল এবং তিন মাসের অক্লান্ত শ্রমের দ্বারা পাঠ্য বিষয় গুলি মোটামুটি ভাবে অধিগত করতে সক্ষম হল। তবু রাহুর দশা ঘুচল না । বিপদ হল গণিত বিষয়টা নিয়ে। স্কুল থেকেই সে গণিত আতঙ্কে ভোগা  ছাত্র। এফএ শ্রেণির  গণিতের পরিসর আর ও বেশি। তবে ইচ্ছাশক্তি এবং আত্মবিশ্বাস অনেক বড় সমস্যাতেও পথ তৈরি করে দেয়। এই সময়ে লক্ষ্মীনাথের জন্য গণিতের ঘরোয়া শিক্ষকরূপে অবতীর্ণ হল তার এককালের অন্তরঙ্গ বন্ধু ঘনশ্যাম বরুয়া ।

শৈশব থেকে লক্ষ্মীনাথ ঘনশ্যমের সঙ্গে বড় হয়েছে। পড়াশোনায় মেধাবী বলে ঘনশ্যম লক্ষ্মীনাথের চেয়ে এগিয়ে গেছে এবং এবার সে বি এ  পরীক্ষা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে । কলকাতা থেকে যে সমস্ত অসমিয়া ছাত্র পড়াশোনা করছে, তাদের মধ্যে ঘনশ্যম সবচেয়ে মেধাবী। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এটাই যে নিরহংকার ঘনশ্যমের শরীরটা প্রায়ই ভালো থাকেনা । খাওয়া-দাওয়ার বিন্দুমাত্র গন্ডগোল হলেই পিত্ত- আমাশয়ে   আক্রান্ত হয়। তথাপি মেসে মেসে গিয়ে নিজের ইচ্ছায় আনন্দমনে ঘনশ্যাম অংক এবং শক্তি অনুসারে অন্যান্য বিষয়েও অসমিয়া ছাত্রদের সাহায্য করে।৫৩ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের মেসে এসেও ঘনশ্যাম লক্ষ্মীনাথকে গণিত শেখাতে লাগল। এভাবে লক্ষ্মীনাথের রাহুর দশাটা কেটে গেল।

ঘনশ্যমের সাহায্য নিয়ে অনেকক্ষণ গণিতচর্চা হল । দ্বিপদ  উপপাদ্য বুঝে এবং অধ্যায়টির বেশ কয়েকটি অংক করতে সক্ষম হয়ে আনন্দিত মনে লক্ষ্মীনাথ বলল – সাহিত্য দর্শন ইতিহাসের সঙ্গে এই গণিতের কোনো সম্পর্ক আছে কি ঘন?'

' তুই একটা সাংঘাতিক প্রশ্ন  জিজ্ঞেস করলি,লখী।' হাতের কলমটা ফেলে রেখে ক্ষীণ স্বাস্থ্যের ঘনশ্যাম বিছানায় গড়িয়ে পরে বলল,'গণিত– ম্যাথামেটিক্স হল পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো সাবজেক্ট। গণিত সর্বশাস্ত্রের মুকুটমণি। নিয়মিত গণিত চর্চার মাধ্যমে ধী শক্তি বাড়ে। গণিত চিন্তা শক্তি বাড়ায়। আমাদের চিন্তাগুলিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে।'

' তাই নাকি। গণিতে গাধা হওয়ার জন্যই আমার অবস্থা এরকম শোচনীয় নাকি?'

' তোর অবস্থা শোচনীয় মানে?'

' এই যে, নিজেকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে বারবার ভুল করছি। ভুল করেছি বলেই পড়াশোনায় এতটা পিছিয়ে রয়েছি–।'

ঘনশ্যাম চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পরে প্রসঙ্গ বদলে বলল,' আচ্ছা চল, একটু বেরিয়ে আসি–'

' কোথায় যাবি?'

' ময়দানে চল–।'

' মানে গড়ের মাঠ। গড়ের মাঠ এখান থেকে অনেক দূরে। নয়টার আগে ফিরতে পারব না।'

' তাহলে কফিহাউসে চল।'

না,না গত ছয় মাস পড়াশোনা না করে এক ধরনের পাগলামি করে ঘুরে বেরিয়েছি। এবার মনকে বেঁধে নিয়েছি। এফ এ পরীক্ষায় আমাকে পাস করতেই হবে।'

' করবি হে করবি।' ঘনশ্যম বলল,' কিন্তু শুধুমাত্র কলেজ এবং মেসে  বসে পড়াশোনা  করা বিদ্যায় কাজ দেয় না। আজকের যুগে  জীবনটাকে গড়ে তুলতে হলে কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কেও জানতে হবে, বুঝতে হবে।'

' কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবন।'

' এখানে কত কিছু ঘটছে খবর রাখিস কি? বেঙ্গলের কোন সাহিত্যিক কী লিখছে, কোনজন  পন্ডিত কী চিন্তা করছে, বাংলা থিয়েটারে কোন নাটক গুলি মঞ্চস্থ হচ্ছে, কলকাতার কোন পাবলিক হলে কোন দার্শনিক বা জাতীয় নেতা কী বক্তৃতা  দিচ্ছে , কলকাতা থেকে প্রকাশিত কোন খবরের কাগজ জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে কী ধরনের ভূমিকা নিচ্ছে… এইসব লক্ষ্য করিস কি ?'

না ,করে না। দেরি করে কলেজে নাম লিখিয়েছে বলে সতীর্থদের কারও সঙ্গেই লক্ষ্মীনাথের সেভাবে বন্ধুত্ব হয়  নি। এই মেসে  চারজন অসমিয়া ছাত্র থাকে। পাঠ্য বই পড়ায় ব্যস্ত থাকার জন্য তাদের সঙ্গেও লক্ষ্মীনাথের কথাবার্তা হওয়ার সুযোগ হয় না। অবশ্য মেসের বাঙালি সদস্যদের মাধ্যমে কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতের কিছু টুকরো টুকরো খবর তার কানে আসে। তা বলে সেইসব নিয়ে চিন্তা করার মানসিকতা তার তৈরি হয়নি। কিন্তু ঘনশ্যাম যেভাবে বলল, তাতে লক্ষ্মীনাথ চিন্তা করতে বাধ্য হল। তার মনে পড়ল সেদিন দেখা স্বপ্নটির  কথা। শিব সাগর থেকে দ্বিতীয় বার কলকাতা রওনা হওয়ার দুদিন আগে দেখা সেই স্বপ্নটা–সেই, কলকাতার রাস্তা দিয়ে ঝুনঝুন শব্দে একটা জুড়িগাড়ি চলেছে। গাড়িটির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অপরূপা এক যুবতির মুখ…। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের এরকম মনে হল যেন অপরূপ একটি জগত থেকে সেই রূপসী যুবতি হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। সে সেই জগতে যাবে। সেই জগতে গিয়ে তার ঐশ্বর্য দিয়ে সে নিজেকে ঋদ্ধ করে তুলবে।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...