হে আমার স্বদেশ
সন্তোষ কুমার কর্মকার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।
আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এক
'লক্ষ্মী–।'
বৈঠকখানা থেকে বাবার আওয়াজ ভেসে এল।
লক্ষ্মীনাথ বাইরের বারান্দার কাঠের বেঞ্চে বসে আছে। গতকাল গোলাঘাট থেকে মেজদা গোবিন্দ্রচন্দ্র এসেছিলেন। রাতে বাবার সঙ্গে কলেজে পড়ার জন্য লক্ষ্মীনাথকে কলকাতা পাঠানোর ব্যাপারে কথা হয়েছে। আজ সকালে গোলাঘাট রওনা হওয়ার সময় মেজদা লক্ষ্মীনাথকে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন। তথাপি লক্ষ্মীনাথ আশ্বস্ত হতে পারছে না। কারণ, অন্যদিনের তুলনায় বাবা আজ বেশি গম্ভীর। সকালে ঠাকুর ঘরে পূজা আহ্নিক করতে বেশি সময় নিয়েছেন। নাম কীর্তনের সময় বাবার গলাটা ধরে আসছিল। তার চেয়েও বড় কথা, ঠাকুর ঘরের কাজগুলি ওকে দিয়েই করান। আজ সেগুলি শ্রীনাথকে দিয়ে করালেন। তার মানে মেজদা ওকে কলকাতা পাঠানোর ব্যাপারে চাপ দেওয়াটা বাবার ভালো লাগেনি।
বাবা কেন কলকাতা পাঠাতে চান না লক্ষ্মীনাথ জানে। কিন্তু উপায় কী? সে যে দুই দাদা গোলাপ চন্দ্র এবং গোবিন্দচন্দ্রের মতো কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা করবে বলে ভেবে নিয়েছে।
বাবার ডাক শুনেও লক্ষ্মীনাথ সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে পারেনি। তবু সে বৈঠকখানা ঘরের দিকে এগিয়ে গেল ।
'বাবা লক্ষ্মী–।'
এবারের ডাকে মন খারাপ মেশানো স্নেহ। বাবার এই স্নেহটুকু তার মনে সৃষ্টি হওয়া ভয় আর আশঙ্কাটা কিছু পরিমাণে কমিয়ে দিল । সে বিনম্র সুরে জানাল, 'আসছি ,বাবা।'
কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে বাবা দুঃখ পেয়েছেন। ছেলে হয়ে বাবার দুঃখ এবং মন খারাপের কারণ যে হওয়া উচিত নয়, তা লক্ষ্মীনাথ বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন বলেই লক্ষ্মীনাথের মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। সে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বৈঠকখানা ঘরে বাবার সামনে এসে দাঁড়াল।
হাতল থাকা একটি বড় ছেলে দীননাথ বেজবরুয়া বসে আছেন।সত্তরের কাছাকাছাকাছি বয়স যদিও সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। তিনি দুবার বিয়ে করেছেন। দুই পক্ষের তেরো জন জীবিত সন্তানের পিতা তিনি। আচার-আচরণে দীননাথ নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ। ইংরেজ সরকারের হাকিমের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পর থেকে পরিবারের সঙ্গে নিজের বাড়ি শিবসাগরে বসবাস করছেন । তা বলে অবসর জীবনের জড়তা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ব্রাহ্ম লগ্ন থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত বৈষ্ণব আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি দেহমন নিয়ন্ত্রিত করে থাকেন। তাছাড়া আহার নিদ্রাতেও তিনি সাত্ত্বিক।এই বয়সেও বংশ-পরম্পরা গত ভাবে লাভ করা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চর্চা করছেন এবং জনগনের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রয়েছেন। শিবসাগরে সামাজিক কাজকর্মেও তিনি সক্রিয় । এদিকে প্রতিদিন বিকেলে শিবসাগরের বয়োজ্যেষ্ঠ জনগণ বিভিন্ন সত্র থেকে আগত সত্রাধিকার এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা তাঁর বাসগৃহে সমবেত হন । তাঁদের সঙ্গে দশম- ইত্যাদি শাস্ত্রপুরাণ পাঠ, গীতা ভাগবতের তাত্ত্বিক আলোচনা- ব্যাখ্যায় সমগ্র বাড়িটা প্রাণ পেয়ে উঠে।
অন্যদিকে এই সময়ে দীননাথ সাপ্তাহিক ইংরেজি -অসমিয়া ' আসাম নিউজ' কাগজ পড়েন। কাগজ কলম নিয়ে খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রবন্ধের ভুল বের করে সম্পাদককে চিঠি লেখেন । এখন কাগজটা সামনের নিচু টেবিলটাতে পড়ে রয়েছে । তার মানে কাল রাতে লক্ষ্মীনাথের বিষয়ে গোবিন্দচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করা কথাগুলি নিয়ে তার মন এখনও অস্থির হয়ে রয়েছে। মানসিক এই অস্থিরতার জন্যই তিনি খবরের কাগজটিতে মনোসংযোগ করতে পারেননি।
দীননাথ ছেলের দিকে তাকালেন। লক্ষ্মীনাথ এন্ট্রান্স পাস করার দেড় মাস হয়েছে। পড়াশোনায় মাঝারি ধরনের যদিও স্বভাব চরিত্র ভালো। ধর্ম কর্মেও মতি রয়েছে। সে এখন আঠারো বছরের তরুণ। চেহারাটা বেশ আকর্ষণীয়। চোখেমুখে একটা সপ্রতিভ ভাব ফুটে উঠেছে। মেজো ছেলে গোবিন্দচন্দ্রের মতো এত গতিশীল মনের না হলেও লক্ষ্মীনাথ বুদ্ধিমান। দীননাথ লক্ষ্মীনাথের মধ্যে সাফল্যের প্রতিশ্রুতি দেখতে পান। ছেলের মুখের দিকে তাকালে দীননাথ পিতৃ গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে উঠেন। মনের মধ্যে অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও এখনও ছেলের দিকে তাকিয়ে তার ভালো লাগল। অন্তঃসলিলা অপত্য স্নেহে তাঁর অন্তর সিক্ত হয়ে উঠল।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দীননাথ ধীরকণ্ঠে বললেন–' গতকাল রাতে তোর মেজদার সঙ্গে তোর বিষয়ে অনেক কথা হল। তোর দাদা আমাকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে বলল। কলকাতা যাবার খরচসহ তোর অন্যান্য সমস্ত খরচের দায়িত্ব ও বহন করবে বলে জানাল। সমস্ত কিছু শুনে আমি আর অমত করতে পারলাম না। তবে আমি কেন তোকে কলকাতা যাওয়ায় বাধা দিয়েছিলাম, তা তুই বুঝতে পেরেছিস কি?'
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা লক্ষ্মীনাথের পক্ষে খুব কঠিন। পিতার দিকে তাকিয়ে অসহায় সুরে সে শুধু বলল,' পেরেছি, বাবা।'
' পেরেছিস, বুঝতে পেরেও কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা করার এত আগ্রহ।' দীননাথ মনে মনে বিড়বিড় করলেন। তার পরই তার মুখে ক্রোধের ভাব দেখা গেল,' ওরে, তোরা কি জানিস না– আমাদের পূর্বপুরুষরা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন, পন্ডিত মানুষ ছিলেন। আমাদের পূর্বপুরুষ কলিবর কনৌজ থেকে এসে তখনকার সময়ের স্বর্গদেউ জয়ধ্বজ সিংহের অনুরোধে অসমে এই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর পান্ডিত্যে অভিভুত হয়ে জয়ধ্বজ সিংহ রাজসভায় তাকে বেজবরুয়ার (রাজবৈদ্য) পদ প্রদান করেছিলেন। সেদিন থেকেই আমরা বংশ-পরম্পরা ভাবে বেজবরুয়া। তখন থেকেই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চর্চার মাধ্যমে মানুষকে সেবা করাটাই আমাদের কর্ম এবং ধর্ম। আমাদের এই শাস্ত্র প্রাচীন যদিও সনাতন, শাশ্বত। এই শাস্ত্রের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে এমন কিছু গুণ আছে , যা বিশ্ব ভূমন্ডলের অন্য কোনো দেশে দেখতে পাওয়া যায়না। অথচ তোরা, তোদের দাদা ভাইদের মধ্যে কোনো একজন এর মুল্য বুঝলি না। আমিও তোদের বোঝাতে পারলাম না। আজকের শিক্ষা, বিশেষ করে কলকাতার ইংরেজি শিক্ষা তোদের নিজের দেশের ঐতিহ্য পরম্পরাকে অবজ্ঞা করতে শেখাল–।'
লক্ষ্মীনাথ তখন ডাক্তার গোলাপ দাদার কথা বলতে চাইল। পিতার প্রবল বিরোধিতায় ডাক্তারি পাশ করে গোলাপ দাদা বলেছিল, ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে আজকের যুগে অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারি বিদ্যার দ্রুত প্রসার হয়ে চলেছে। নতুন যুগের মানুষ এলোপ্যাথি চিকিৎসার প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছে । তাই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বর্তমান আছে যদিও ভবিষ্যৎ নেই । তবে এসব কথা বলা যাবে না। বললে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নিষ্ঠাবান বাবা দুঃখ পাবেন। ক্রোধে গর্জন করে উঠবেন। এক পলকের জন্য পিতার রোষতপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথ পুনরায় মাথা নিচু করল।
' এখনও আমার সেই দিনটির কথা মনে পড়ে। এটা আমার জন্য, তোদের জন্য, এই বেজবরুয়া বংশের প্রত্যেকের জন্য কত বড় গৌরবের কথা।' দীননাথ তারপর বলতে লাগলেন,' স্বর্গদেব পুরন্দর সিংহ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে আমার আমার পাণ্ডিত্য- পারদর্শিতার কথা জানতে পেরেছিলেন। তারপর আমাকে কামরূপের কামাখ্যা ধামে নিয়ে গিয়ে কামাখ্যা দেবীর সামনে শপথ করিয়ে নিয়ে রংপুরের রাজবৈদ্য নিযুক্ত করেছিলেন। সাহেবরা দেশের শাসনভার গ্রহণ না করলে আজও আমি সসম্মানে স্বর্গ দেবের সেবা করে যেতাম। কিন্তু এসব নিয়ে তোরা গর্ববোধ করিস না। এদিকে আমার সহায়ক হিসেবে কাজ করেছিল রাজকুমার নামে বাঙালি ছেলেটি। আমার কাছে কাজ শিখে সে বৈদ্য হয়ে টাকা পয়সা রোজগার করছে। চিকিৎসার টাকায় সে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংসার প্রতিপালন করছে। অথচ আমার নিজের ছেলেদের মধ্যে একজনেরও আজ পর্যন্ত এই বিদ্যার প্রতি কোনো রকম আগ্রহ বা আসক্তি দেখতে পেলাম না। যা দেখছি, এত যত্নে, এত আগ্রহের সঙ্গে অধ্যয়ন করা আয়ুর্বেদের জ্ঞান এবং এত বছর ধরে লাভ করা অভিজ্ঞতার কিছুই আমার ছেলেদের দিয়ে যেতে পারব না।'
দীননাথ চুপ করলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পুনরায় বললেন,' তোর আগের দুজন কলকাতা গিয়ে ইংরেজি পড়াশোনা করে প্রবাসী হল। ওরা আর বাড়ির প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করে না। ইংরেজি শিখে তুইও বাইরে থাকবি। তোরা সবাই বাইরে থাক, বাড়িতে কে থাকবে? আমার জীবিত কালটা কোনোভাবে পার হয়ে যাবে। আমার মৃত্যুর পরে পরিবারটা কে দেখবে? আচ্ছা, আয়ুর্বেদে তোর আগ্রহ নেই, মানছি। কলকাতা না গিয়ে অসমে থেকে ওকালতি পড়তে পারিস। ওকালতি পড়ে কালীপ্রসাদ চলিহার মতো উকিল হয়ে শিব সাগরে প্র্যাকটিস করতে পারতিস।'
' বাবা–।' নীরব থাকতে না পেরে অনুযোগের সুরে লক্ষ্মীনাথ বলল,' আপনিইতো নাম ভর্তি করেও ওকালতি ব্যবসাটা ভালো নয় বলে দাদার নামটা পরে কাটিয়ে এনেছিলেন।'
' নাম কাটিয়ে দিয়েছিলাম সত্যি–।' প্রতিবাদ করে ওঠার জন্য লক্ষ্মীনাথের উপর রুষ্ট না হয়ে কণ্ঠস্বর নামিয়ে এনে দীননাথ বললেন,' কিন্তু কলকাতার ইংরেজি শিক্ষা তোর দাদার সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি করে দিল। আর এখন আমার কি বয়স হয়নি? দাদারা বড় হয়েছে, পড়াশোনা করে অর্থ উপার্জন করছে। চোখের সামনে ওরা থাকলে বুকে সাহস পাই, ভরসা পাই। কী আর বলব। তোদের এসব বলে লাভ নেই। এসব তোরা বুঝতে পারবি না, বুঝতে চেষ্টাও করবি না। তোদের কাছে আমার এই ওজর আপত্তির কোনো মূল্য নেই। আসলে, আমার কোনো ছেলে চিকিৎসক হয়ে জনগণের সেবা করুক, ছেলেরা বাড়িতে থেকে বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি ঘটাক– এটাতে যেন প্রভু ঈশ্বরের সায় নেই। কৃষ্ণ, কৃষ্ণ!'
অবশেষে নিজেই প্রভু ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করলেন যখন,লক্ষ্ণীনাথের কলকাতায় পড়তে যাবার কথাটা দীননাথ মেনে নিতে প্রস্তুত হয়েছেন। লক্ষ্মীনাথের মনটা নেচে উঠতে চাইছিল। কিন্তু বাবার সামনে আনন্দ বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করাটা উচিত হবে না ।
' কলকাতার কলেজে পড়ার এতই ইচ্ছা যখন-যা, আমি আর বাধানিষেধ আরোপ করব না।' একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে দীননাথ অবশেষে বললেন,' কলেজে নাম লেখানোর সময় হল বোধহয়?'
উৎসাহিত হয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' কলেজের নাম লেখানোর দিন পার হয়ে গেছে, বাবা। এন্ট্রান্সের ফলাফল বের হওয়ার পরে কলকাতায় যাব কি যাব না করতে করতেই দেড় মাস পার হয়ে গেল।'
' যাবিই যখন, তৈরি হয়ে নে।' এবার স্বাভাবিক সুরে দীননাথ বললেন–' কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র কী কী লাগবে সব জোগাড় কর। কলকাতা, ওটা বাঙ্গালীদের রাজ্য। তোর জন্য পুরোপুরি বিদেশ। সেখানে গিয়ে প্রথম তুই কোনো পাত্তাই পাবিনা। তাছাড়া শুনতে পাচ্ছি আমাদের অসমিয়া ছাত্ররা নাকি মেসে থাকে। মেসে নানা ধরনের লোকের বসবাস। তাতে আচার- সংস্কার নেই। জাতের বিচার নেই। তাই তুই মেসে থাকতে পারবি না। তোর সঙ্গে মেজ দাদা গোবিন্দ যাবে। সে চার বছর কলকাতায় ছিল। কলকাতার সমস্ত কিছু জানে। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে সেই তোকে রেখে আসবে ।'
লক্ষ্মীনাথের প্রাণে মুক্তির বাতাস লাগল। দুই চোখের সামনে কলকাতার কল্পিত দৃশ্যগুলি ভেসে বেড়াতে লাগল। ইংরেজরা গড়ে তোলা কলকাতা এখন ভারতবর্ষের রাজধানী। কলকাতা থেকেই ভারতের শাসন নীতি পরিচালনা করা হয়। ইংরেজরা কলকাতায় বসতি স্থাপন করার পরেই বাঙালিরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠল এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হয়ে তারা আধুনিকতার দিকে পা বাড়াল। তারপরে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হল। স্থাপিত হল অনেকগুলি কলেজ। সেই সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করা বাঙালিরা অসমে স্থাপিত বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক রূপে নিযুক্ত হয়ে অসমিয়াদের শিক্ষিত করে তুলল। অসমের যে সমস্ত স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব– আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন,গঙ্গাগোবিন্দ ফুকন,গুনাভিরাম বরুয়া... তারাও কলকাতায় শিক্ষা লাভ করা ব্যক্তি । কলকাতায় শিক্ষা গ্রহণ করে অসমে ফিরে এসে অসমিয়া সন্তানরা হাকিম - মুন্সেফ হয়েছে । সেই একই পথ অনুসরণ করে এই বাড়ির সু-সন্তান গোবিন্দ চন্দ্র - গোলাপচন্দ্রও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি রূপে বংশের সুনাম ছিনিয়ে এনেছে। আজ লক্ষ্মীনাথের জন্যও সেই পথ উন্মুক্ত হল।
যাত্রার জন্য জোর প্রস্তুতি চলল। জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাসী দীননাথ মহাশয় পঞ্জিকা পুঁথি দেখে দিন স্থির করলেন । প্রথমে অনুমতি না দিলেও তিনি কোনো বিষয়ে কঠোর মনোভাবের মানুষ নন । বুঝিয়ে বললে তিনি বাস্তবকে স্বীকার করে নেন। এদিকে জাতীয় শিক্ষা- সংস্কৃতি- ঐতিহ্য পরম্পরার বিষয়ে সচেতন যদিও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তিনি উদার। তাছাড়া দস্যু লুণ্ঠনকারী মানের আক্রমণ থেকে ইংরেজরা অসমিয়া জাতিকে রক্ষা করেছে চাঁদপুরে ইংরেজরা অসমের জনজীবনে স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছে। ইংরেজরাই স্কুল স্থাপন করে অসমিয়াদের শিক্ষিত করে তুলেছে। এইসব কারণে তিনি ইংরেজদের শ্রদ্ধা করেন। এখন যেহেতু ইংরেজরা এ দেশের রাজা, তাই প্রজাদের রাজার ভাষা শিখতেই হবে। যুগের জন্যও এটি প্রয়োজন এবং সেই অনুসারে সন্তানদের যোগ্য করে তোলাটা পিতার কর্তব্য।
এভাবে ভেবে লক্ষ্মীনাথকে কলকাতা যাবার অনুমতি দিয়ে দীননাথ বসে থাকলেন না। খুব শীঘ্রই ছেলেকে রওয়ানা করার জন্য নিজেই উদ্যোগী হয়ে পড়লেন। তিনি গোলাঘাটে থাকা গোবিন্দচন্দ্রকে খবর দিলেন। এদিকে শিব সাগর থেকে প্রথম যেতে হবে দিসাংমুখ। দিসাংমুখ থেকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন লাগানো জাহাজে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে কলকাতা যাত্রা । শিব সাগর থেকে দিসাংমুখ প্রায় সাত মাইল পথ । জিনিসপত্র নিয়ে এতটা পথ যাওয়ার উপায় ঘোড়া অথবা হাতি । দীননাথ বাড়ির চাকর ধনীকে ভুটিয়া ঘোড়াটা প্রস্তুত করার আদেশ দিয়ে গরুর গাড়িতে করে লক্ষ্মীনাথের জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেওয়া স্থির করলেন।
লক্ষ্মীনাথ কলকাতা যাত্রা করবে। মনের অসন্তুষ্টি জড়তা কাটিয়ে উঠে দীননাথ ছেলের যাত্রা করানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেও ঠানেশ্বরীর মাতৃমন বিষন্ন হয়ে পড়ল। দীননাথের প্রথম পত্নীর মৃত্যুর পরে ঠানেশ্বরীকেই অন্দরমহলের দায়িত্ব সামলাতে হয়েছিল। কাজের লোকজন থাকলেও বড় সংসার। তাছাড়া অতিথি, অন্দরমহলের কাজের লোকদের সামলানো - উদয়াস্ত খাটতে হয়।তাই মা হয়েও লক্ষ্মীনাথকে সেভাবে আদর যত্ন করার সময় পান না। তবে লক্ষ্মীনাথ যে মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা পায়নি এমন নয়। জন্মের এক বছর পরে বড়মাই লক্ষ্মীনাথকে যত্নআত্তি করেছিলেন।বড়মার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ খাওয়া-দাওয়া করত,ঘুমোত। মাঘ মাসের ভোরে উঠে বড়মার সঙ্গে দিখৌ নদীতে স্নান করতে যেত। তাঁর সঙ্গে কার্তিক মাসে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালাত, আকাশ বাতি জ্বালাত।বড়মা ছেলেটিকে এত আদর যত্ন করার জন্য কোনো দুঃখ ছিল না। কিন্তু এখন ছেলেটি বাড়ি ছেড়ে সুদূর কলকাতায় যাবে– কলকাতা, ওটা বিদেশ। মানুষ আলাদা, ভাষা আলাদা।কলকাতার কোথায় থাকবে, কী খাবে, তার সামনে কে যত্ন করে ভাত বেড়ে দেবে? কথাগুলির ভাবলেই ঠানেশ্বরীর বুকটা হাহাকার করে উঠে।
যাত্রার আগের দিন। টিনের বাক্সে কাপড়চোপড় ভরিয়ে , ধনীর মাধ্যমে বিছানাপত্র বেঁধে লক্ষ্মীনাথ বিছানায় শুয়েছে মাত্র।ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করল ঠানেশ্বরী। কাছে দাঁড়িয়ে করুণভাবে লক্ষীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
আসন্ন বিদায়ের কথা ভেবে মায়ের যে এই অবস্থা লক্ষ্মীনাথ তা বুঝতে পারল। বিছানা থেকে উঠে মাকে সান্তনা দেবার সুরে বলল,' দুঃখ করছ কেন! পড়াশোনার জন্য বিদেশ তো যেতেই হবে।'
ঠাণেশ্বরীর দুই চোখ ছলছলে হয়ে এল। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,' কলকাতা বড় শহর। সেখানে গিয়ে কোথায় থাকবি?'
' জাতের বিচার নাই বলে বাবা মেসে থাকতে মানা করলেন। মেজদাদা নাকি তার কোনো পরিচিত বামুন মানুষের ঘরে আমার থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেবে।'
' তারা তো বাঙ্গালী।'
' কলকাতায় বামুনের বাড়িতে থাকতে হলে তো বাঙালির ঘরেই থাকতে হবে।'
' বাঙালিরা মশলা ঝাল খায়।সেই সব খেতে পারবি?'
কলকাতায় গেলে মায়ের রান্না, মা আদর করে তৈরি করা খাবার পাবেনা। মায়ের কাতর মুখটির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। কিন্তু মন খারাপের ভাবটা বাইরে না দেখিয়ে শুকনো কন্ঠে বলল,' খেতে তো হবেই। বিদেশে তা ছাড়া আর উপায় কি?'
ঠাণেশ্বরীর কোমল মনটা কেঁপে উঠল। এরকম মনে হতে লাগল তিনি বড় কিছু একটা হারাতে চলেছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য অসম থেকে ছেলেরা কলকাতা গিয়েই থাকে। শিবসাগর থেকেও অনেক ছেলেরা গেছে। এমনকি, এই বাড়ি থেকেও গিয়েছিল। লক্ষ্মীনাথের যাওয়াটা নতুন কথা নয়। তথাপি তিনি নিজেকে প্রবোধ দিতে পারলেন না।তাঁর দুচোখ থেকে জলের ধারা অবিরাম গড়িয়ে পড়তে লাগল।
'মা, কাঁদছ? লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে পড়ল,ইস এত কান্নার কী আছে? পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসব তো।'
ঠানেশ্বরী বেদনার্ত কাতর স্বরে বলে উঠল,' তুই কি আবার ফিরে আসবি?'
অন্যান্য দিনের চেয়ে কিছুক্ষণ আগেই জেগে উঠল। জেগে উঠেই নিত্যকর্ম সেরে পুকুরে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ঠাকুর পূজার জন্য ফুল তুলতে ফুলের বাগানে ঢুকে ছিল। এখন এই কাজটা ভাই লক্ষ্মণ করে। কিন্তু আজ লক্ষ্মীনাথ করতে লাগল। বিদ্যা অর্জনের জন্য বাড়ি থেকে যাত্রা করবে, জীবনের জন্য এটি একটি পবিত্র ব্রত। তার জন্য মনে ভক্তি সমন্বিত ভাব আনতে হয়। ফুল তুলে এনে লক্ষ্মীনাথ ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করল। বাবার পূজার কোষা– অর্ঘ্য, থাল চন্দনের ঝুড়ি ইত্যাদি ধুয়ে সাজিয়ে দিল। চন্দন পিষল। তারপরের ঠাকুর ঘরে বসে দাদা শ্রীনাথ এবং ভাই লক্ষণের সঙ্গে গীত - ভটিমা গাইল( ঈশ্বর বা গুরুকে উদ্দেশ্য করে রচনা করা গান) । লক্ষ্মীনাথই আজ কীর্তন পুথি খুলে কীর্তন গাইল। এভাবে চলতে থাকা অবস্থায় অন্য দিনের মতো আজও দীননাথ এসে পুজোয় বসল। পুজোর পরে নাম প্রসঙ্গের শেষে আশীর্বাদ পর্ব শেষ হল।তারপরে কাসি ঘন্টা বাজানো হল।... শৈশব থেকে লক্ষ্মীনাথ বাড়িতে এই বৈষ্ণব আনুষ্ঠানিতা দেখে আসছে। পিতার অনুশাসন নির্দেশে এই সমস্ত পালন করে লক্ষ্মীনাথ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই সবই এই বাড়ির সংস্কার। এই সংস্কার লক্ষ্মীনাথের অন্তরকে শুদ্ধ করে তুলেছে। এই শুদ্ধতাই তাকে আনন্দ দান করে। আর আজ যে বাড়ি ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে, এই শুদ্ধাচার এবং নৈতিক পবিত্রতা নিয়েই যাবে।
সকালের নাম প্রসঙ্গ, পুজো পাঠ সমাপন করে দীননাথ জল খাবার খেলেন। জলখাবার খেয়ে উঠে তিনি লক্ষ্মীনাথকে ডেকে পাঠালেন, 'যাবার জন্য সবকিছু তৈরি তো?'
' হ্যাঁ, বাবা।' আমি একবার চট করে আমাদের গোস্বামী স্যারকে প্রণাম জানিয়ে আসি।'
' হেডমাস্টার চন্দ্রমোহন গোস্বামী?'
' হ্যাঁ, বাবা।'
' যাওয়া উচিত। শুভ কর্মে বের হওয়ার আগে গুরুর আশীর্বাদ নিতেই হবে। এমনিতেও তিনি কলকাতার মানুষ। সম্ভ্রান্ত পরিবারের গোঁসাই। তিনি নিশ্চয় তোকে কিছু পরামর্শ দেবে। কিন্তু গোস্বামীর স্যারের কাছে যাবার আগে আমার কয়েকটা কথা শুনে নে।' গম্ভীর কণ্ঠে দীননাথ বললেন শাস্ত্রে বিদেশে নিয়ম নাস্তি' বলে একটা কথা থাকলেও বিদেশে ম্লেচ্ছদের কথা কান্ড থেকে দূরে সরে থাকতে হবে । কলকাতায় আমাদের হিন্দু মানুষের সংখ্যাই বেশি।তাই সেখানেও জাতের বিচার যে নাই তা নয় । আর তুই যেহেতু কলকাতায় সৎ ব্রাহ্মণ একজনের বাড়িতে থাকবি, তাই নিত্য গঙ্গা স্নান করবি, আমাদের নিয়ম নীতি অনুসরণ করে সন্ধ্যা আহ্নিক করবি।সুবিচার থাকলে নাম প্রসঙ্গ ও করবি। এই সমস্ত করলে প্রভু গোবিন্দ তোকে শক্তি দেবে, নিয়মিত আচরণ তোর অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তুলবে।'
লক্ষ্মীনাথ পলকহীন চোখে পিতার ভালোবাসায় স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ।
তারপর দীননাথ পাশের পড়ার টেবিলে রাখা একটি ছোট নোটবুক নিয়ে লক্ষ্মীনাথের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা তুই নিয়ে যা। সঙ্গে রাখবি। ঘরের আচার-আচরণ পালনের সঙ্গে বিদেশে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন থাকবি। জনক-জননী, দাদা ভাই আত্মীয়স্বজন না থাকা বিদেশে নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে হবে। তার জন্য কোন অসুখে কী ঔষধ খেতে হবে ,কী কি ধরনের সাবধানতা গ্রহণ করতে হবে …. এই নোটবুকটিতে সমস্ত লিখে দিলাম ।'
শুরুতে বিরোধিতা করা পিতাকে এতটা তৎপর হতে দেখে লক্ষ্মীনাথ অবাক হল। ছেলে কলকাতায় যাবে, সেখানে যাতে কুশলে মঙ্গলে থাকে তার জন্য পিতা এত চিন্তা করছেন। পিতা এত দায়িত্বশীল, এত স্নেহপ্রবণ। লক্ষ্মীনাথের পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা বেড়ে গেল । নোটবুকটা হাতে নিয়ে স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল।
' দাঁড়িয়ে আছিস! দীননাথ বললেন , সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে ধনী গরুর গাড়িতে রওয়ানা হয়ে গেছে। তোরা দুজন একসঙ্গে ঘোড়ায় যাবি। ফিরে আসার সময় ধনী ঘোড়াটা নিয়ে আসবে । এখন যা স্যারকে প্রণাম করে আয় গিয়ে–।'
চন্দ্রমোহন গোস্বামীর বাড়ি কলকাতায়। তিনি এখন শিবসাগরের সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্কুল জীবনে লক্ষ্মীনাথ অনেক শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছে। সেই সব শিক্ষকের স্মৃতি খুব একটা সুখের নয়। কিন্তু হেডমাস্টার চন্দ্রমোহন গোস্বামী প্রথম থেকেই লক্ষ্মীনাথের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছেন। গোস্বামীর পাণ্ডিত্য বিশাল।একজন শিক্ষক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হল, তিনি ছাত্র বৎসল এবং স্নেহপ্রবণ। ছাত্রদের মধ্যে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে একবার তিনি কোহিমা বদলি হয়ে যাওয়ায়, কেবল তার অধীনে পড়াশোনা করার জন্যই পদ্মনাথ গোহাঞিবরুয়া পায়ে হেঁটে কোহিমায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।
গোস্বামী স্যার এখন বাড়ি থেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন। ধুতি পাঞ্জাবী পরা স্বাস্থ্যবান পুরুষ। চোখে কালো ফ্রেমের পাওয়ার থাকা চশমা। বাইরের বারান্দায় লক্ষ্মীনাথকে দেখেই গোস্বামী স্যার বেরিয়ে এলেন।
' ও, লক্ষী এসেছিস–।' প্রসন্ন হাসিতে গোস্বামী বললেন, তুই যে আজ কলকাতায় যাচ্ছিস, আমি জানি। তবে তুই একা যাচ্ছিস না সঙ্গে কেউ যাবে?'
'মেজদাদা যাবে।'
'গোবিন্দ সঙ্গে যাবে যখন তোর কোনো চিন্তা নেই।'
' স্যার আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি।'বলেই, লক্ষ্মীনাথ চন্দ্রমোহন গোস্বামীর পর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন।
লক্ষ্মীনাথকে দুই হাতে আদর করে তুলে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে চন্দ্রমোহন গোস্বামী বললেন, আশীর্বাদ নিতে এসেছিস, তোদের প্রতি আমার আশীর্বাদ সবসময়ই রয়েছে। কিন্তু একটা কথা, উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য কলকাতা যাচ্ছিস – কলকাতায় ভালোর সঙ্গে খারাপও রয়েছে। কলকাতার ভালোগুলি অত্যন্ত ভালো। তার জন্যই কলকাতা এখন ভারতের শিক্ষা- সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি। আশা করছি শিক্ষা সংস্কৃতির দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা আধুনিক কলকাতার ভালো দিকটা তুই গ্রহণ করবি। আচ্ছা, বেরিয়েছিস –- তোদের বাড়িতে গিয়ে বাবার সঙ্গে একবার দেখা করা উচিত ছিল। স্কুলের কাজের চাপে যেতে পারলাম না।'
' হবে, স্যার।' সবিনয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' আপনি কলকাতা গেলে জানাবেন। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব।'
' ঠিক আছে। আমি এখান থেকেই তোকে বিদায় জানাচ্ছি।'
' ঠিক আছে, স্যার। তাহলে আসছি ।'
আচ্ছা, এগিয়ে যা–। দুই হাত জোড় করে লক্ষ্মীনাথের নিরাপদ যাত্রার জন্য পরমেশ্বরের কাছে মিনতি জানিয়ে চন্দ্রমোহন উচ্চারণ করলেন দুর্গা– দুর্গা।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন