পাখিদের পাড়া পড়শী ২/১
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider para porshi
দ্বিতীয় অধ্যায় (দুই)-ক
জ্যোতিষের বিয়েতে যাওয়ার পর থেকে উদয় শঙ্করের বরকুরিহার কথা খুব বেশি করে মনে পড়তে লাগল।
উদয়শঙ্করের ভাষায় পাখিদের পাড়া-প্রতিবেশীকে।
জলাশয়, শিমুলগাছ গুলি এবং তাতে বাসা তৈরি করা বকগুলি, বাপুটি, জলে গড়িয়ে পড়া শিশু গাছের দ্বারা নির্মিত প্রাকৃতিক চেয়ারটা, পুষ্কর নামের হরিণের হোটেলের ছেলেটি, গঙ্গা পুকুর, শৃগাল পরিবার, পুরোহিত শর্মার বুট মুগের প্রসাদ, সুনন্দ , কাকাবাবুর পরিবার, টিম টিম করে জ্বলতে থাকা হারিকেন লেম্পটা, রাতের বিশ্রী শব্দ গুলি– কথাগুলি মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত উপকরণ এসে উদয়শঙ্করের মন এবং মস্তিষ্কে দোলা দিচ্ছিল ।
বরকুরিহায় যাবার ঠিক করে রাখা নির্দিষ্ট দিনগুলির জন্য সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
সুনন্দ তাকে প্রায়ই ফোন করত। মনে করিয়ে দিয়েছিল পাখি বিষয়ক বইটি নিয়ে যেতে যেন ভুলে না যায়। কাকাবাবু মাঝেমধ্যে ফোন করছিলেন। খবরা-খবর করছিলেন। সাধারণত নিজের কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে ফোনের লাইনটা কাকাবাবু কেটে দিয়েছিলেন। উদয়শঙ্কর কিছু বলতে চেয়েও থেমে গিয়েছিল। সে ফোন করলে হয়তো নিজের অজ্ঞতাবশত কাকাবাবু ফোন রিসিভ করতে পারেন নি। উদয়শঙ্কর কারও প্রতি কোনো কথায় আক্ষেপ রাখে না, অন্তত মানুষগুলি আন্তরিকতাপূর্ণ ভাবে তার সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে ।
বরকুরিহায় যাবার জন্য উদয়শঙ্কর ছুটি নিয়েছে। সে মনে করছে – এবার সে বকগুলি জন্ম দেওয়া বাচ্চাদের রঙ তামাশা দেখতে পাবে, ওদের কলরব শুনতে পাবে। ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে সঞ্চয় করতে পারবে নতুন অথবা বিরল অভিজ্ঞতা।
আর সৌম্যদা–সৌম্যদার সঙ্গেও উদয়শঙ্করের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।সৌম্যদা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ফোন করে তার খবর নিয়ে থাকে । কখনও সৌম্যদা তার কাজের বিশদ বিবরণ উদয়শঙ্করের সামনে তুলে ধরে।
শেষবার ফোন করার সময় উদয়শংকর সৌম্যদাকে সুনন্দের কথা বলে।
– একজন ভালো ছেলের সঙ্গে দেখা হওয়া অনেক ভালো কথা, সামাজিক ভাবে কাজ করতে সুবিধা হয়। তুমিও দেখছি সে রকম কোনো নতুন পরিকল্পনা করতে পার।
– একটা প্রকৃতির শিবিরের আয়োজন করা যেতে পারে!
– পার তো।
– আপনি আসবেন তো?
– কেন যাব না! না যাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। সুনন্দ নামের ছেলেটিকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পার। তার মাধ্যমে সেই অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের প্রকৃতি বিষয়ক সচেতন করে তোলা যেতে পারে বোধহয়। ভেবে দেখ।
– হ্যাঁ সৌম্যদা, করা যাবে বোধহয়।
– এবার আমি সেখানে গেলে একটা প্রকৃতি শিবিরের আয়োজন করার চেষ্টা করব।
সৌম্যদার সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে উদয়শঙ্কর স্মৃতির মাধ্যমে ফিরে গিয়েছিল সে যোগদান করা প্রথম প্রকৃতি শিবিরে। সেই প্রকৃতি শিবিরটা কাজিরাঙ্গায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নভেম্বর মাসের শীতার্ত দিন, দুদিনের জন্য। পর্যটকদের জন্য কাজিরাঙ্গা সেই সময় উপযুক্ত সময়।সৌম্যদা উদয়শঙ্করকে ফোন করে নির্দিষ্ট দিন-তারিখ জানিয়েছিল।
– তুমি তো বাসে আসবে নয় কি? কহরায় নেমে তুমি সোজাসুজি মূল কার্যালয়ের দিকে এলে আমাদের সংগঠনের একটা ব্যানার দেখতে পাবে। সেখানকার দুটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলে ওরা তোমাকে শিবিরের বন্দোবস্ত করা জায়গায় নিয়ে যাবে। আমি নিজেও শিবিরেই থাকব।
সৌম্যদার কথায় উদয়শঙ্কর সায় দিয়েছিল।
সৌম্যদার ব্যবস্থানুসারে উদয়শঙ্কর ঠিক সময়ে শিবিরে উপস্থিত হয়েছিল। তখন দুপুর দুটো বাজে। সে লক্ষ্য করল শিবিরে থাকা কোনো ব্যক্তিই তার পরিচিত নয়। একমাত্র সৌম্যদা ছাড়া।সৌম্যদা ইতিমধ্যে শিবিরে উপস্থিত হওয়া পরিবেশ কর্মীদের মধ্যে বসে আড্ডা জমিয়ে তুলেছিল। সৌম্যদা মানুষটা মজার। কিন্তু তার কথা শুনলে উদয়শঙ্করের এরকম মনে হয়, পরিবেশ গম্ভীর করে রাখার জন্য মানুষটা সর্বদা যত্নশীল। নামচাংয়ে যাবার সময়ও মানুষটাকে সে সেভাবেই দেখেছিল।
– এলে। আসার সময় পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো। মানে রাস্তা বন্ধ, ইনক্লাব,মুর্দাবাদ ইত্যাদি। ডিব্রুগড় পার হয়ে সেদিকে গেলে কথাই নেই, চিন্তায় পড়ে যেতে হয়, কখন কোথায় পথ বন্ধ বা অবরোধ হয়ে যায় বলা যায় না।
– না সৌম্যদা। আমি সেরকম কিছুই পাইনি।
– তাহলে তো ভালোই। তুমি মুখ হাত ধুয়ে নাও।ভাত খেয়েছ কি? না খেয়ে থাক যদি– অলক, তুমি ওকে একটু দেখিয়ে দাও তো।
অলক নামের ছেলেটির সঙ্গে উদয়শঙ্কর বেরিয়ে গেল। উদয়শঙ্কর তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছায় তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল– আমি উদয়শঙ্কর। ডিব্রুগড় থেকে এসেছি।
– আমি অলক শেনচোওয়া। টিয়কে ঘর।
–কী পড়ছ?
– এইবার বিএ পাস করেছি।
– এমনিতেই ছোট ছেলে।
কথাটা বলে উদয়শঙ্কর অলকের দুই বাহু জড়িয়ে ধরে কিছুদূর এগিয়ে গেল।
রান্নাঘরের বেসিনে ওপরের নল দিয়ে আসা জলে হাত দেওয়াই যায় না। বলতে গেলে বরফের মতো ঠান্ডা। জল নয় যেন গলিত বরফ। নলটির নিচে হাত দিয়ে উদয়শঙ্কর প্রথমে হাতটা টেনে নিল এবং তারপরে সাধারণভাবে মুখটা ধুয়ে নিল।আর ভাত,অতি ক্ষুধায় ভাত তাকে খুব তৃপ্তি দিল ।
খাওয়া-দাওয়া করে ফিরে এসে উদয়শঙ্কর দেখতে পেল সৌম্যদা ভিন্ন পরিবেশ কর্মীর মধ্যে বসে নিয়ে বিজ্ঞান এবং অন্ধ বিশ্বাসকে নিয়ে গল্পগুজব করছে।সৌম্যদা উপস্থিতদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করছে– ঢেঁকিয়ার ফুল তুমি সত্যিই দেখতে পেয়েছ ?
– হ্যাঁ, দাদা পেয়েছি।
নৈর্ব্যক্তিক ভাবে সৌম্যদা জিজ্ঞেস করলেন– কোথায়?
– আমাদের গ্রামের একজনের বাড়িতে।
– কীভাবে দেখলে?
– মানুষটা একটা কাচের বোতলের ভেতরে বোতলের মুখটা বন্ধ করে ফুলটা ভরে রেখেছে।ঢেঁকিয়া গাছের গোড়া থেকে কানের মতো ফুলটা। বাড়িতে যেই যায় তাকেই বোতলটা দেখিয়ে বলে – এটা ঢেঁকিয়ার ফুল।
সৌম্যদা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল –ঢেঁকিয়া অপুষ্পক উদ্ভিদ । জান কি?
ঢেঁকিয়ার ফুল দেখতে পাওয়া ছেলেটি সৌম্যদার মুখের দিকে উৎসুক্যতার সঙ্গে তাকিয়ে রইল।সৌম্যদা আর কী বলেন!
– অপুষ্পক অর্থাৎ ফুলবিহীন ঢেঁকিয়ার ফুল তুমি কোথায় দেখতে পাবে।সেসব মানুষের অন্ধবিশ্বাস।ঢেঁকিয়ার ফুল দেখতে পেলে সাংঘাতিক কিছু সৌভাগ্যের উদয় হবে বলে থাকে। এইসবই অপপ্রচার।
কৌশিক নামের ছেলেটি ইতস্তত করে সৌম্যদার দিকে তাকিয়ে রইল।এবার সৌম্যদা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল – কেউ একজন বলুন তো গরুর দাঁত কয় পাঁটি? প্রত্যেকেরই জানা একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউ আগ্রহী হল না।
– বলুন, আপনি বলুন হরেনদা। আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই তিনি হরেনদা, হরেন গগৈ।ডিগবয় অয়েলে চাকরি করেন।
উঁচু লম্বা ফর্সা মানুষটার পরনে নীল জিন্স প্যান্ট এবং সাদা টি-শার্ট। হাতে ক্যাননের দামি ডি এস এল আর একটা। মানুষটা ক্যামেরাটা বিছানায় রেখে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করতেই সৌম্যদা বললেন– বসে বসেই বলুন হরেনদা, আমরা আড্ডার মধ্য দিয়ে দুই একটা ছোটখাটো কথা জানতে চাইছি।হরেনদা বসলেন। কিছুটা ঔৎসুক্যের সঙ্গে তিনি বললেন – এক পাটি।
– তুমি বল প্রাগজ্যোতিষ।
সৌম্যদা তরুণ বয়সের কুড়ির গণ্ডি অতিক্রম না করা একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন।
–স্যার, এক পাটি।
সৌম্যদা বুঝতে পারলেন সবার কাছ থেকে একই উত্তর আসবে।
–উহু,না।দুপাটি।কেবল ওপরের পাটির ছেদক এবং কৃন্তক দাঁতগুলি থাকেনা বলে পাঠ্যসূচিতে পাওয়া ধরনে একপাটি বলে। গরুর পেষক দাঁতগুলি থাকে।
হরেন গগৈ সৌ্ম্যদাকে জিজ্ঞেস করলেন-তারমানে পাঠ্যপুঁথিতে ভুল করে লেখা আছে।
-ভুল করে লেখা বলব না,ভুল করে উপস্থাপনা করা হয়েছে।দৈনন্দিন কথাবার্তায় আমরা এভাবে
অনেক কথাই ভুল করে উপস্থাপনা করি। শ্বকঅবজার্ভারকে সকেটজাভার বলি। প্যাংকশ্যারকে পাম্পচার বলি।বালিশের ওয়ারকে উয়ার বলি।আরও অনেক আছে।‘পমিয়ালে এঅনা’আমাদের উজানের মানুষগুলি শুনেছে।কাহিনিটা সবাই শুনেছে।নয়কি হরেন দা?
মুচকি হেসে হরেনদা সৌম্যদার কথায় সায় দিল। এখানে পমিয়ালে মানে পাম্প দিল। আর ও একটি কথা জিজ্ঞেস করি। পর্ক বললে আমরা শুয়োরের মাংস, বিফ বললে গরুর মাংস বুঝি। সেভাবে ছাগলের মাংস বোঝাতে মাটন বলে থাকি। সেটাও ভুল। আসলে ছাগলীর মাংসকে কী বলা হয় এখানের কেউ জানে কি?
সৌম্যদা উপস্থিত সবার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল।
– আপনি বলতে পারবেন কি দাস। ইনি সুনীল দাস। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী। ভাঙ্গাগড়ের মেডিকেল কলেজে চাকরি করেন । সঙ্গের এই মহিলা তাঁর পত্নী।
সপত্নীক সুনীল দাস উপস্থিত সবাইকে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানাল। বাকিরা প্রতি নমস্কার জানানোর পরে পুনরায় সৌম্যদা দাসকে জিজ্ঞেস করলেন– বলতে পারবেন কি দাস?
– জানিনা সৌম্যদা । আমরা তো মাটনই বলে থাকি।
লজ্জিত ভাবে সুনীল দাস বললেন।
–হবে। আমিই বলে দিচ্ছি। মাটন বললে ভেড়ার মাংস কে বোঝায়। ছাগলীর মাংসকে বলা হয় সেভন। এইসব আমাদের সমাজে প্রচলিত ভুল প্রয়োগ। ভাষার প্রকৃতির ওপরে করা ধ্বংসযজ্ঞ। তার মধ্যের কিছু অন্ধ বিশ্বাস উদ্ভূত আর কিছু আমাদের প্রচলিত অজ্ঞতা। এইসব সমাজের প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে। আমাদের তার প্রতিও সজাগ থাকা প্রয়োজন।
প্রত্যেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে সৌম্যদার বক্তব্য শুনে যাচ্ছে। সাধারণ বলে ভাবা কথাগুলি সময়ে বেশি দরকারি হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।সৌম্যদা এই ধরনের বিষয় উপস্থাপন করায় সবাই লাভান্বিত হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন