লেখার সহজ উপায়
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস
কয়েকদিন আগে একজন লেখককে ' আমার অসম' এর জন্য একটি বিশেষ লেখা দিতে অনুরোধ করেছিলাম। লেখার বিষয়টাও আমিই ঠিক করে দিয়েছিলাম। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর কাছ থেকে লেখাটা না পেয়ে আমি তাকে তাগাদা দিতে আরম্ভ করলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন যে তাঁর প্রবন্ধের খসড়াটা ইতিমধ্যেই লিখে শেষ করেছেন; কিন্তু ফেয়ার কপিটা লিখতে কিছু সময় লাগছে ।তাঁর কথা শুনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। একজন লেখককে যদি তার প্রতিটি লেখা দুবার করে লিখতে হয়, তাহলে তিনি জীবনে কতগুলি লেখার সুযোগ পাবেন? আমি অবাক হওয়ার আরও একটি বিশেষ কারণ ছিল এই যে আমি নিজে কখনও আমার কোনো লেখা দুবার করে লিখিনি। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে আমার কলমের ডগা দিয়ে যাই বের হয় তাকেই বেদবাক্য বলে গ্রহণ করে নিই, বাক্য গুলিকে যথাসম্ভব পরিপাটি করার চেষ্টা করি না। প্রত্যেক মানুষেরই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কাজ করার কৌশল উদ্ভাবন করে নেয়। এই ক্ষেত্রে ভালো-খারাপ এর প্রশ্ন ওঠেনা। আমি আমার লেখাগুলি দ্বিতীয়বার লেখার বা ফেয়ারর কপি করার প্রয়োজন বোধ করি না কেবল এই জন্য যে লেখার আগে আমি প্রতিটি বাক্যকে অনেকবার ভেঙ্গেচুড়ে নিয়ে বাক্যগুলি মোটামুটি ভাবে ভালো হয়েছে বলে অনুভব করার পরেই সেগুলি কাগজে লিখি। আমার নিজের বিশ্বাস যে এভাবে মগজের ভেতরে বাক্যগুলি যথাসম্ভব নিখুঁত করে গঠন করে নিলে সেগুলি দ্বিতীয় বার লেখার চেয়ে বা ফেয়ার কপি করার চেয়ে সময় কম লাগে।
আমি এই কথা কখন ও বলি না যে ফেয়ারকপি করাটা একটি খারাপ অভ্যাস, বা আমি যেভাবে লিখি সেই নিয়মটাকেই সবাই অনুসরণ করা উচিত। কিছু লেখা– বিশেষ করে কবিতা, নাটক এবং উপন্যাসের মতো সৃজনধর্মী লেখা – ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেকবার লেখার প্রয়োজন হতে পারে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নাকি তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়া The Old Man and the Sea নামের উপন্যাসটি দুশোবার নতুন করে লিখেছিলেন। টলস্টয় তাঁর ' যুদ্ধ এবং শান্তি' নামের সুবৃহৎ মহাকাব্যিক উপন্যাসটি লেখার সময় দিনের সাত ঘণ্টা করে পরিশ্রম করে কখনও কখনও এক সপ্তাহে মাত্র কুড়ি পৃষ্ঠা লিখতে পেরেছিলেন; অর্থাৎ মাত্র এক পৃষ্ঠা লিখতে তাঁর সময় লেগেছিল প্রায় আড়াই ঘন্টা। কোনো কোনো কবি কিন্তু আব্দুল লেখকদের চেয়েও এক কাঠি ওপরে। উদাহরণস্বরূপ রবার্ট লুই স্টিভেনসনের কথা বলা যেতে পারে। তিনি নিজের এপিটাফ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য Requiem নামের একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু সুদীর্ঘ দশ বছর ধরে তিনি কবিতাটিকে ঘষেমেজে মসৃণ করতে করতে অবশেষে তা পরিণত হল মাত্র আট সারির একটি ছোট কবিতা । মাত্র একটি কবিতাকে নিটোল রূপ দেবার জন্য দশ বছর ধরে পরিশ্রম করে স্টিভেনশন অবশেষে যে কবিতাটা জগত কে উপহার দিলেন, সেই কবিতাটি হল:
Requiem
Under the wide and starry sky
Dig the grave and let me lie:
Glad did I live and gladly die
And I laid me down with a Will.
This be the verse you grave for me:
Here he lies where he longed to be:
Home is the sailor ,home from sea,
And the hunter home from the hill.
এই সমস্ত কথাই সত্যি। কিন্তু আমি বলতে চাওয়া কথাটা হল এই যে কবিতা এবং উপন্যাসের মতো সৃষ্টিধর্মী রচনাগুলি অনেকবার ঘষে-মেজে এবং পালিশ করে থাকার প্রয়োজন হলেও খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিনে সচরাচর প্রকাশিত বক্তব্যধর্মী রচনা গুলির জন্য বারবার লিখে থাকার বা ফেয়ার কপি করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রথম ধরনের লেখার ক্ষেত্রে লেখক শব্দ- চয়ন, শব্দ- স্থাপন আঙ্গিক এবং প্রকাশভঙ্গি নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ঠ চিন্তা এবং পরিশ্রম করতে হয়, লেখাগুলি বারবার কাটাকুটি করে সেগুলিকে একটি আকাঙ্ক্ষিত আকৃতিতে আনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বক্তব্যধর্মী লেখার জন্য লেখকের নিজের বক্তব্যটুকু পরিষ্কারভাবে চিন্তা করে নিয়ে সেগুলিকে সরল এবং শুদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করতে পারলেই যথেষ্ট। লেখকের কলম থেকে কেবল তখনই শব্দগুলি সহজে বেরিয়ে আসতে চায় না– যখন বলতে চাওয়া বিষয়টি সম্পর্কে লেখকের সম্যক চিন্তা পরিষ্কার নয়, তাঁর ভাষাও স্বচ্ছন্দ নয়।
অবশ্য চিন্তা পরিষ্কার হলেই যে ভাষাও নিজে থেকে সাবলীল হবে সেটাও ঠিক নয়। বেশিরভাগ লেখকই লিখতে বসে এক ধরনের দুশ্চিন্তাজনিত মানসিক অস্থিরতা অনুভব করে। তাকে এরকম একটা ভয় গ্রাস করে ফেলে যে তাঁর লেখাটা যত ভালো হওয়া উচিত ততটা ভালো হয়তো হবেনা; বাক্যগুলি সুগঠিত এবং সুন্দর করার জন্য তিনি যে রকম শব্দ ব্যবহার করা উচিত সেরকম শব্দগুলি তার কলমের ডগা দিয়ে হয়তো বের হয়ে আসবে না। এই উদ্বেগজনিত ভয়ই তাঁর চিন্তা স্রোতকে বারবার বাধাগ্রস্ত করে– যার ফলে তার কলমের ডগা দিয়ে বের হতে চাওয়া শব্দগুলি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বারবার থমকে থাকে। রুফিনা দাঁড়িয়ে যেরকম নিজের চেহারা সম্পর্কে মাত্রাধিক ভাবে সচেতন ঠিক তেমনি নিজের সুস্পষ্ট বক্তব্য না থাকা লেখকরাও ভাষার সৌন্দর্য সম্পর্কে প্রয়োজনাধিক ভাবে সচেতন। তাঁরা লিখতে বসে দুশ্চিন্তাজনিত মানসিক অস্থিরতায় ভোগার সেটাই প্রধান কারণ। এই ধরনের সমস্ত মানসিক কষ্ট উপশম করতে পারার অমোঘ বিধান দিয়ে গেছেন রবার্ট লীণ্ড। তিনি বলেছেন –'The safe rule in writing is to say what one precisely means-even if it appears to destroy the shape of the sentence.If the sense does not give the sentence good shape,then all the high sounding words in the dictionary will not do so. উপরে লেখকের যে সমস্ত সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি কেবল সাধারণ লেখকের সমস্যা নয়। মূলত দার্শনিক হয়েও সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো প্রতিভাধর ও লেখককেও একই ধরনের সমস্যা ব্যতিব্যস্ত করেছিল। How I write নামের একটি রচনায় রাসেল এই সমস্যাগুলির বিষয়ে আলোচনা করে তিনি নিজে কী ভাবে সমস্যাবলীর সমাধান করলেন সেই কথাও বর্ণনা করেছেন। রাসেলের অভিজ্ঞতা থেকে সমস্ত লেখকই শিক্ষা নিতে পারে ।
যে কোনো লেখকের মতোই বার্ট্রান্ড রাসেল ও জীবনের প্রথম বর্ষের অনেক বিখ্যাত লেখকের গদ্যশৈলীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি জন স্টুয়ার্ট মিল ,লোগান পিয়ার্সল স্মিথ, ওয়াল্টার পেটার এবং গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অতি দ্রুত তিনি এই সিদ্ধান্তে এলেন যে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাকে নিজের আদর্শ নিজেই তৈরি করে নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ লোগান পিয়ার্সল স্মিথ তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে একজন লেখক তাঁর প্রত্যেকটি লেখা দুইবার লেখা উচিত।One must always rewrite। সেই উপদেশ পালন করার জন্য রাসেল আবিষ্কার করলেন যে তার দ্বিতীয়বারের সংশোধিত লেখাটির চেয়ে প্রথমবারের লেখাটি সব সময় বেশি ভালো হয় ।এই আবিষ্কারের ফলে তিনি অনেক শক্তি এবং সময় বাঁচাতে সক্ষম হলেন।
লেখক জীবনের শুরুতে রাসেল সেই যন্ত্রণাদায়ক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন -যে সমস্যা ছোট বড় সমস্ত লেখককে জীবনের একটা সময়ে পীড়িত করে। লিখতে বসে তার মনে প্রায়ই এরকম ভাব হয়েছিল যে লেখাটা যেন তার সাধ্যের অতীত।'I would fret myself into a nervous state from fear that it was never going to come right.I would make one unsatisfying attempt after another,and in the end have to discard them all.' রাসেল কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করলেন? অনেক চিন্তা করেও তিনি দেখলেন যে কিছু একটা বিষয়ে লেখার জন্য ঠিক করে বিষয়টি সম্পর্কে প্রাথমিক চিন্তাভাবনা টুকু করার পরে তিনি যদি তার চিন্তা অবচেতন মনে রাখেন, পাখির ডিমে তা দেওয়ার মতো তাঁর অবচেতন মন স্টার চিন্তায় উসকে দিতে থাকে, সচেতনভাবে মন থেকে কোন কথা বের করে আনার জন্য তিনি তাড়াহুড়ো করেন না ,সেরকম একটি সময়ে তিনি বলতে চাওয়া কথাগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং অবারিত গতিতে বেরিয়ে আসে তার মন থেকে। Having,by a time of very intense concentration ,planted the problem in my sub-consciousness ,it would germinate underground until,suddenly,the solution emerged with blinging clarity ,so that it only remained to write down what had appeared as if in a revelation.
সমস্ত বৃত্তির মানুষই অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য চেষ্টা করে বা করা উচিত। লেখকরা ও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ ডক্টর স্যামুয়েল জনসন লেখকদের দেওয়া উপদেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ইংরেজ লেখকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে ভালো ইংরেজি গদ্য লেখার জন্য প্রতিটি লেখককে গভীর মনোযোগ দিয়ে জোসেফ এডিসনের গদ্য সম্ভার পাঠ করা উচিত। কীভাবে পড়া উচিত, কীভাবে লেখা উচিত– এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য ইংরেজি ভাষায় অনেক বই এবং প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ওপরে উল্লেখ করা বার্ট্রান্ড রাসেল ছাড়াও এইচ জি ওয়েলস, রবার্ট লীণ্ড, সমারসেট মম এবং জর্জ অরওয়েল ইত্যাদি লেখকদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। জর্জ অরওয়েল, হ্যারল্ড লাস্কির মতো বিশ্ববন্দিত পণ্ডিতরাও দুর্বোধ্য এবং দুষ্পাঠ্য গদ্যের কঠোর সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখেছেন। গদ্যশৈলীর ক্রমোৎকর্ষ সাধন করার জন্য এই ধরনের অবিরাম চেষ্টার ফলেই ইংরেজি ভাষা আজ বিশ্ব ভাষায় পরিণত হয়েছে । অবশ্য এই ক্ষেত্রে ইউরোপের অন্যান্য উন্নত ভাষাগুলি পেছন পড়ে থেকে নেই । ফরাসিদের গদ্য সাধনা প্রায় কিংবদন্তিতুল্য ।
অসমিয়া ভাষায় কিছু উৎকৃষ্ট গদ্ রচিত হয়েছে যদিও সাধারণভাবে অসমিয়া গদ্যের মান আশানুরূপ উন্নত বলা যেতে পারে না। গদ্য রচনার বিষয়ে চিন্তা চর্চা ও যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি। গদ্যের গুরুত্ব বোঝার জন্য ইএম ফ্রস্টারের একটি উক্তি স্মরণ করলেই যথেষ্ট হবে । আমি আমার একাধিক রচনায় তাঁর এই উক্তিটি উদ্ধৃত করেছি। কিন্তু আমি সেই একই উক্তিকে মন্ত্রের মতো বারবার আওড়াতে চাই –' গদ্যের অবনতি ঘটলে ভাবের আদান প্রদানের সমস্ত সুগম পথ বন্ধ হয়ে যায়, আর তার ফলে সভ্যতার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়।'
---------
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন