বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

কীভাবে মরা উচিত ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস, Homen Borgohain

 কীভাবে মরা উচিত

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস 



(১)

জীবনের অনিবার্য পরিণতি হল মৃত্যু।কিন্তু কেবল মানুষেরই মৃত্যু আছে,মানুষের বাইরে অন্য কোনো প্রাণীর মৃত্যু নেই।কথাটা বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হলেও এটাই সত্য।মৃত্যুর সঙ্গে চেতনা এবং অহংবোধ জড়িত।পৃ্থিবীতে প্রাণের কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে একমাত্র মানুষই চেতনা তথা আত্মচেতনা নামের এই রহস্যময় গুণটি আয়ত্ত করতে সমর্থ হয়েছে।প্রকৃ্তির নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত প্রাণীরই জীবলীলা একদিন হঠাৎ স্তব্ধ হয়।কিন্তু একমাত্র মানুষের বাইরে অন্য কোনো প্রাণীই তাকে মৃত্যু বলে জানে না।মৃত্যুর ধারণা একান্তভাবে মানুষের আবিষ্কার। চেতনার বিকাশের ফলে মানুষের মনে অহংবোধের জন্ম হয়।একমাত্র মানুষই নিজেকে বলতে সক্ষম হল ‘আমি’-অর্থাৎ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমি একটি অদ্বিতীয় সত্তা।মানুষের এই অহংবোধ তাঁর মনে অমরত্বের কল্পনা জাগিয়ে তুলে।মানুষ নিজের মধ্যে থাকা এই ‘আমি’টার চির বিলুপ্তি চায় না,চায়না চেতনার চির সমাপ্তি।মৃত্যুকে আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে উদয় হল মৃত্যু-ভয়।একভাবে দেখতে গেলে এই মৃত্যু এবং মৃত্যু-ভয় মানুষের ধর্ম,দর্শন,সাহিত্য এবং শিল্প কলার মূল চালিকাশক্তি।আর্থার কোয়েস্টলার এক কথায় ঘোষণা করেছেন যে মৃত্যু না থাকলে মানুষ কবিতা লিখত না,সাহিত্য সৃষ্টি করত না,ধর্মের ধারণাও তার মনে আসত না।

মানুষের জীবনের একটি প্রধান সমস্যা হল মৃত্যু-ভয়।মানুষ সচেতনভাবে মৃত্যুর কথা চিন্তা না করলেও তাঁর অবচেতন মনে চিরু-জাগরুক হয়ে থাকে মৃত্যু- ভয়।এই মৃত্যু-ভয় তাঁর জীবনের ওপরে বিষাদের একটি দীর্ঘ ছায়া বিস্তার করে থাকে।মৃত্যু-ভয় জয় করার জন্য মানুষ নানা উপায় অবলম্বন করে।সেইসবের মধ্যে প্রধান উপায়টি হল পরকাল এবং আত্মার অমরত্বের কল্পনা। মৃত্যু-ভয়ই হল ধর্মের জন্মদাতা।সমস্ত ধর্মই মানুষকে এই সান্ত্বনা দান করে যে মৃত্যুকে ভয় করার কোনো কারণ নেই,কারণ আত্মা অমর।কিন্তু আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ধার্মিক লোকদের মধ্যেও বেশিরভাগই কেন জানি আত্মার অমরত্বের বিষয়ে সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হতে পারে না।জীবনের দীপশিখা একবার নিভে যাবার পরে সে অনন্ত অন্ধকারে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে নাকি-এই গোপন ভয় মানুষকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে।

কিন্তু ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়।যুগ যুগ ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যু-ভয়কে জয় করতে পেরেছে। কেউ পেরেছে ধর্মীয় আশ্বাসের সাহায্যে,আবার কেউ পেরেছে যুক্তির সাহায্যে। সব মানুষেই মৃত্যুভয় জয় করতে চায়। মৃত্যু ভয় জয় করার একটি প্রধান উপায় হল মৃত্যু-ভয় জয় করা মানুষের উদাহরণ থেকে শিক্ষা লাভ করা। এই ধরনের হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে। আমি এখানে কেবল দুটি উদাহরণ দিতে চাই। দুটি উদাহরণই আমি পড়েছি বার্ণার্ড লউনের The Lost Art of Healing নামের গ্রন্থে। বার্ণার্ড লউন একজন বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী। ১৯৮৫ সনে তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল। তিনি বইটির এক জায়গায় বলেছেন,চূড়ান্ত বিচারে ভালো মরণ হল ভালোভাবে যাপন করা একটি জীবনের দর্পণ মাত্র।১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে জেইমস বসওয়েল ডেভিড হিউমকে তাঁর মৃত্যুশয্যায় দেখা করতে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম ছিলেন তাঁর যুগের একজন নেতৃস্থানীয় মানবতাবাদী। যেহেতু হিউম এখন মৃত্যুর দরজায় উপস্থিত হয়েছেন ,সেইজন্য এই কট্টর নিরীশ্বরবাদী মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে ঈশ্বরের দয়া ভিক্ষা করবে নাকি সেকথা জানার জন্য জেইমস বসওয়েলের মনে ভীষণ কৌতূহল হল। মৃত্যু এবং চরম বিনাশের চিন্তা হিউমকে আতঙ্কিত করছে নাকি সেকথা জানার জন্য বসওয়েল তাকে প্রশ্ন করলেন। হিউম উত্তর দিলেন –‘জন্মের আগেও আমি ছিলাম না,মৃত্যুর পরেও আমি থাকব না। জন্মের আগে আমার অস্তিত্ব না থাকার কথাটা যদি আমাকে আতঙ্কিত না করে,তাহলে মৃত্যুর পরে আমার অস্তিত্ব না থাকা কথাটা কেন আমাকে আতঙ্কিত করবে?’হিউম নির্ভয় মনে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছে।জীবনের অন্তিম মুহূর্তে হিউমের মনে বিরাজ করা গভীর প্রশান্তি বসওয়েলকে গভীরভাবে অভিভূত করেছে। মৃত্যু-ভয় বিন্দুমাত্র কাতর করতে না পারা ডেভিড হিউমের অবিচলিত মানসিক প্রশান্তি সমসাময়িক ব্রিটেনের ওপরেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।‘

ডেভিড হিউম যেমন তাঁর যুগের একজন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন,ঠিক তেমনই লিউয়িস টমাস ছিলেন কুড়ি শতিকার একজন শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং জীব বিজ্ঞানী।বহু বছর তিনি য়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যাথলজি বিভাগের মুরব্বি অধ্যাপক ছিলেন।সেখান থেকে অবসর নিয়ে তিনি Memorial Sloan Kettering Institute of Cancer Research এর অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি যতটা বিখ্যাত,ঠিক ততটাই বিখ্যাত একজন অসাধারণ প্রতিভাশালী লেখক তথা প্রাবন্ধিক হিসেবে। বিজ্ঞানের বিষয়-বস্তু নিয়ে লেখা তাঁর বই এবং রচনাগুলি উচ্চমানের সাহিত্য সৃষ্টি বলে স্বীকৃ্তি লাভ করেছে।তাঁর দুটি বহু পরিচিত গ্রন্থ হল  The Lives of A Cell এবং Notes of a Biology Watcher.  

লিউয়িস টমাসের মৃত্যুর বিষয়ে বার্ণাড লউন তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন –মৃত্যুর বারোদিন আগে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা রজার রসেনব্লাট লিউয়িস টমাসের একটা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। টমাস তাকে বলেছিলেন –‘মৃত্যু যখন একটা অধিবিদ্যামূলক তথা দার্শনিক ঘটনা ছিল,তখন মৃত্যুকে এক প্রকারের শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছিল।কিন্তু আজকাল মৃত্যুর প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ হয়।ফলে একে একটা ব্যর্থতার প্রকাশ বলে ধরা হয়।একজন মরনোন্মুখ রোগি একপ্রকারের কিম্ভূত-কিমাকার জীব।সমস্ত অস্বাভাবিকতার ভেতরে মৃত্যুর দীর্ঘ প্রক্রিয়াটাই হল মানুষের জন্য সবচেয়ে অগ্রহণীয়। এ যেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে একটা অপরাধ। আমাদের সংস্কৃতি তথা জীবন দর্শনে আগে না হওয়া একটা ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করেছে।সেটা হল এই যে আজকাল আমরা মৃত্যুর জন্য লজ্জিত হই। আমরা মৃত্যু থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করি।আমরা যেভাবে চিন্তা করি সেদিক থেকে দেখতে গেলে মৃত্যু হল একটা ব্যর্থতা।  আসলে মৃত্যুর যন্ত্রণা বলে কোনো জিনিস নেই।আমি এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে মৃত্যুর মুহূর্তে যন্ত্রণা সম্পূর্ণ নাই হয়ে যায়।  শরীর মরতে শুরু করার সময় একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে।মানুষের শরীরে হাইপোথেলামাছ এবং পিটুইটারি গ্রন্থি শরীরে পেষ্টাইড হরমোন মুক্ত করে দেয়।এণ্ডরফিনস।যন্ত্রণা অনুভব করা কোষগুলিতে তারা লেপ্টে লেগে থাকে। মোটের উপর আমি বিশ্বাস করি যে মৃত্যুর সময়ে প্রকৃতি মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল হয়।’ 

সাংবাদিক তাকে এবার জিজ্ঞেস করলেন-‘মরার সময় কীরকম অনুভূতি হয়।’

টমাস উত্তর দিলেন –দুর্বলতা।এটা দুর্বলতা।আমি আমার শরীরের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করেছি।’

কীভাবে মরা উচিত সেকথা জানার জন্য কোনো আর্ট আছে কি?’-রসেলব্লাট জিজ্ঞেস করলেন।

লিউয়েস টমাস উত্তর দিলেন-কীভাবে বেঁচে থাকা উচিত তার নিশ্চয় একটা উত্তর আছে।‘ 


(২)


ডেভিড হিউমের দর্শন এবং লিউয়িস টমাসের বিজ্ঞান –এই দুটির বিষয়ে আমি বিশেষ কিছু জানি না।অবশ্য ডেভিড হিউমের দর্শনের চেয়ে লিউয়িস টমাসের বিজ্ঞানের বিষয়ে নামমাত্র বেশি কথা জানি।কিন্তু দুজনের জীবনের বিষয়ে আমি কিছু কথা জানি।আগেই বলা হয়েছে যে ডেভিড হিউম ছিলেন তাঁর যুগের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ভাবুক এবং দার্শনিক।তাঁর বিখ্যাত দার্শনিক বই দুটির নাম হল –Inquiry Concerning Human Understanding এবং    Treatise of Human Nature  তাঁর এই দুটি বইকে ইংরেজি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক গ্রন্থ বলে মনে করা হয়।

ডেভিড হিউমের মৃত্যুর পরে তাঁর বন্ধু বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তাঁর বন্ধুকে লেখা একটি চিঠিতে ডেভিড হিউমের বিষয়ে লিখেছিলেনঃ আমাদের একজন অসামান্য প্রতিভাবান এবং কখন ও ভুলতে না পারা বন্ধুর মৃত্যু হল।তাঁর দর্শনের বিষয়ে বিভিন্ন জন নিজের নিজের বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে তাঁকে হয় প্রশংসা করবে না হয় নিন্দা করবে।কিন্তু তাঁর চরিত্র এবং আচরণ সম্পর্কে কখনও কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। আমার এভাবেও বলতে ইচ্ছা করে যে তাঁর মানসিক ভারসাম্য এবং প্রশান্তির তুলনা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।তাঁর মিতব্যয়িতা এরকম ছিল যে নিজের চরম আর্থিক দুর্দশার সময়েও তিনি অন্যকে সাহায্য করা থেকে কখন ও বিরত ছিলেন না।সমাজে শান্তিতে বাস করতে হলে মানসিক প্রফুল্লতার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি।কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক প্রফুল্লতা হয় চপলতা এবং তরলতার নামান্তর মাত্র।কিন্তু ডেভিড হিউমের মানসিক প্রফুল্লতার সঙ্গে জড়িত হয়েছিল ব্যাপক জ্ঞান,গভীর চিন্তা,অসামান্য বোধশক্তি এবং কঠোর মানসিক সংযম।অতি জ্ঞানী এবং সদাচারী মানুষ বলে বললে যে ধরনের মানুষের কথা আমাদের মনে পড়ে ,ঠিক তেমনই একজন মানুষ ছিলেন ডেভিড হিউম।’

জীবনের সর্বশেষ বছরটিতে ডেভিড হিউম একটি আত্মজীবনী মূলক রচনা লিখেছিলেন। আত্মজীবনীটা লিখতে গিয়ে তাঁর প্রয়োজন হয়েছিল মাত্র সাড়ে তিন হাজার শব্দের।অ্যাডাম স্মিথের বর্ণনায় আমরা ডেভিড হিউম নামের মানুষটির স্বভাব চরিত্রের একটি মোটামুটি আভাস পেয়েছি। ডেভিড হিউম নিজে নিজের বিষয়ে কী ভেবেছিলেন সেই বিষয়ে জানার জন্য তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা থেকে কয়েকটি নির্বাচিত অংশ নিচে উদ্ধৃত করা হল-‘অহঙ্কার অনুভব না করে নিজের বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে কিছু বলা শক্ত। সেজন্য আমি খুব সংক্ষেপে বলব।আমি যে নিজের বিষয়ে লিখতে শুরু করেছি তাতেই অহঙ্কার ফুটে উঠেছে বলে মনে করা যেতে পারে। কিন্ত আমি কেবল নিজের লেখার বিষয়েই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা লিখব।সেটাই আমার জীবন,কারণ আমার সমগ্র জীবন লেখাপড়ার কাজেই অতিবাহিত হয়েছে। আমার বেশিরভাগ লেখাই প্রথম অবস্থায় এই ধরনের এরকম কোনো কৃতকার্যতার মুখ দেখেনি যে যার জন্য আমি গর্ব অনুভব করতে পারি ।…

আমি ফ্রান্সে থাকার সময় Treatise of Human Nature নামের বইটি লিখেছিলাম। ১৭৩৮ সালের শেষের দিকে আমি বইটি প্রকাশ করলাম । কিন্তু এই বইটির মতো দুর্ভাগা বই বোধহয় অন্য কোনো মানুষ লিখেননি। ছাপাখানা থেকে সেটা বের হল একটা মৃত শিশু হয়ে । বইটি কার ও মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারল না । কিন্তু আমার স্বভাবটা  ছিল রঙ্গীন এবং আশাবাদী। বইটির ব্যর্থতার আঘাত সামলে নিয়ে আমি পুনরায় গভীর মনোযোগের সঙ্গে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করলাম।... 

' আমার বইটির বিষয়বস্তুর চেয়ে তার লেখার ধরনটাই বইটির ব্যর্থতার কারণ বলে আমি মনে করেছিলাম। বইটি প্রকাশ করার জন্য আমি যেন বড় বেশি তাড়াহুড়ো করে ছিলাম। সেই জন্য আমি বইটির প্রথম অংশটি নতুন করে লিখে তাকে আমার দ্বিতীয় বই অর্থাৎ Inquiry Concerning Human Understanding এ সন্নিবিষ্ট করলাম । কিন্তু এই বইটি ও প্রায় প্রথম বইটির মতোই পাঠকদের দ্বারা  অবহেলিত হয়ে রইল। কিন্তু আমার স্বাভাবিক মানসিক শক্তি এ রকমই ছিল যে এইসব হতাশা আমাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারল না। তারপরে আমি Political Discourses এবং Inquiry Concerning The Principles of Morals নামের দুটি বই রচনা করলাম। ইতিমধ্যে আমার প্রথম দুটি বই বিষয়ে সরকারি ভাবে আলোচনা হতে শুরু করেছিল। বই দুটির   নতুন সংস্করণ ও প্রকাশ করতে হয়েছিল। বই দুটির নিন্দাসূচক সমালোচনাও হয়েছিল। কিন্তু আমি এই বলে একটা সংকল্প নিয়েছিলাম এবং তাকে কঠোর ভাবে পালন করেছিলাম যে আমি কখনও কার ও সমালোচনার উত্তর দেব না; আর যেহেতু আমার সহজে রাগ হত না, এইজন্য আমি সমস্ত সাহিত্যিক বাকবিতণ্ডা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। এইসব ছিল ক্রমান্বয়ে আমার খ‍্যাতি  বৃদ্ধির লক্ষণ। সে আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ জুগিয়েছিল। প্রতিটি কথার খারাপ দিকের চেয়ে ভালো দিকটার  উপরেই আমার চোখ পড়ত। আমি মনে করি যে বছরে ১০  হাজার পাউন্ড উপার্জন হওয়া একটি জমিদারির মালিক হওয়ার চেয়ে এরকম একটি মনের অধিকারী হতে পারাটা বহুগুণে বেশি কাম্য।…

'১৭৭৫ সনের বসন্তকালে আমার পাকস্থলীর একটা অসুখ আরম্ভ হয়। প্রথম অবস্থায় আমি তার জন্য বিশেষ চিন্তিত হইনি। কিন্তু পরে আমি অনুভব করলাম যে এই অসুখ আরোগ্য হওয়ার আশা নেই এবং এটা আমার প্রান হরণ করবে। আমার মৃত্যু তাড়াতাড়ি হওয়াটাই কামনা করেছিলাম। পাকস্থলীর অসুখটা থেকে আমি বিশেষ কোনো যন্ত্রণা অনুভব করিনি; কিন্তু তারচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে আমার স্বাস্থ্যের দ্রুতগতিতে অবনতি হওয়া সত্ত্বেও আমি মুহূর্তের জন্য ও মানসিক  প্রফুল্লতা হারাইনি। বরং আমি এটাই বলতে চাই যে আমার জীবনের কোনো একটা সময় পুনরায় যাপন করার জন্য আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আমার অসুস্থতার এই সময়টিকেই আমি বেছে নেব। আমি যত আগ্রহে বই পড়ি তত উৎসাহে আমি মানুষের সঙ্গ ও উপভোগ করি ।

'শেষে  নিজের চরিত্রের বিষয়ে আমি এটাই বলতে চাই যে আমি একজন নরম প্রকৃতির মানুষ। আমার নিজের মনের ওপরে সংযম আছে। আমি একজন মুক্তমনা, সমাজ প্রিয়  এবং রঙ্গিন স্বভাবের মানুষ । আমি মানুষের প্রতি অনুরক্ত হতে পারি । আমার সমস্ত কামনা- বাসনা এবং আবেগ-অনুভূতির ক্ষেত্রে আমি মধ্যম পন্থা অনুসরণ করে চলি। সাহিত্যিক খ‍্যাতির প্রতি আমার দুর্বলতা আছে । কিন্তু উপর্যপরি হওয়া হতাশা আমার মনে কোনো তিক্ততার সৃষ্টি করতে পারেনি। যুবক এবং ফুর্তিবাজ মানুষ আমার সঙ্গ যে রকম ভালোবাসে, ঠিক তেমনি ভালোবাসি গহীন গম্ভীর অধ্যয়নশীল মানুষও। মার্জিত স্বভাবের মহিলার সঙ্গ আমাকে বিশেষভাবে আনন্দ দেয়। তারাও আমার সঙ্গ পছন্দ করে বলে আমি অনুভব করি । বেশিরভাগ বিখ্যাত মানুষই মিথ্যা অপবাদ এবং কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়ে থাকতে পারে না । কোনো মিথ্যা অপবাদ কলঙ্ক আমাকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি । আমার বন্ধুরা আমার স্বভাব চরিত্রের স্বপক্ষে ওকালতি করার মতো কোনো পরিস্থিতি কখন ও উদ্ভব হয় নি; অন্যদিকে আমার নিন্দুকরাও আমার নিন্দা করার জন্য কোনো কারণ বা সুযোগ খুঁজে পায়নি। আমার নিজের বিষয়ে এই কথাগুলি বলতে আবার যে বিন্দুমাত্র অহংকার ফুটে উঠেনি সে কথা আমি বলব না; কিন্তু  সেই  অহংকার যথার্থ নয় বলেও আমি ভাবি না। তখন আমি নিজের বিষয়ে যে কথাগুলো বললাম সেই কথাগুলির সত্যাসত্য যে কোনো মানুষই অতি সহজে পরীক্ষা করে দেখতে পারে।' 

-------

 

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।








  



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...