পাখিদের পাড়া পড়শী - ৭
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
Pankaj Gobinda Medhi
(নয়)
সুনন্দকে ফোন করায় সে বলল সে নাকি বাঁধের ওপরে রয়েছে।
আমি বললাম– দাঁড়াও আমি যাচ্ছি। মোবাইল চার্জ করতে হবে।
চার্জারের সঙ্গে মোবাইলটা এবং ক্যামেরার ব্যাটারিটা নিয়ে আমি বাঁধের দিকে এগিয়ে গেলাম।
সুনন্দ বাঁধের ওপরে একজন আধবয়েসী মানুষের সঙ্গে একান্ত মনে কথা বলছে। মানুষটা দেখতে ক্ষীণ। বয়স আনুমানিক পঁয়ষট্টি। চুল ছোট করে কাটা। আরক্ষী বা সামরিক বাহিনীতে কাজ করা মানুষের মতো। দাড়ি কামিয়ে মুখটা নিটোল করে রেখেছে। চুল এবং ছোট করে কাটা গোঁফ প্রায় পেকেছে। মানুষটার পরনে শুধু একটা গেঞ্জি, ধুতিটা লুঙ্গির মতো ভাঁজ করে পরেছে।
আমাকে দেখে সুনন্দ কথা বলল। আমি দুজনের কাছে এগিয়ে গেলাম।
– ইনি কে? আমি চিনতে পারলাম না যে!
মানুষটা আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে সুনন্দকে জিজ্ঞেস করল।
– তিনি আমাদের থানের নতুন করে তৈরি হওয়া পর্যটক নিবাসটিতে গত কয়েকদিন ধরে আছেন।
– কবে থেকে আছেন? কেন আছেন? সেই ঘরটাতে থাকার মতো উপযুক্ত কি?
কথা বলার সময় মানুষটা সামরিক বাহিনীর লোক– সাবধান বিশ্রাম– বলার মতো কমান্ডিং সুরে কথা বলছেন।
সুনন্দ বোধহয় তার কোন প্রশ্নের আগে উত্তর দেবে ঠিক করতে পারল না এবং সেই মুহূর্তে যে প্রশ্নের উত্তর মনে এল সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল–' হ্যাঁ কাকু। আপাতত পর্যটক নিবাসটিতে থাকার মতো ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু–
–কী কিন্তু?
মানুষটা সুনন্দের কথা শেষ হওয়ার আগেই পূর্বাপর সুরে বলল।
– পর্যটন বিভাগের কোনো দায়িত্বশীল অফিসার উদ্বোধন করার কথা ছিল। তবে কারেন্ট না থাকার জন্য তাঁরা উদ্বোধন করতে পারেনি।
কারেন্ট নেওয়া তো নাকি থানার দায়িত্ব। তার মধ্যে তাদের করণীয় নেই। কারেন্টের জন্য অনেকটা তার টানতে হবে। থানার কমিটি পয়সা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। তাই–
– তাই, এখন বুঝতে পারলাম। তবে কারেন্টের কানেকশন যে মন্দির সমিতিকে নিতে হবে সেই কথাটা আমি আগে জানতাম না।
সুনন্দের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে মানুষটা আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল–
– আমি হরগোবিন্দ ডেকা। ইন্ডিয়ান মিলিটারির রিটায়ার্ড পারসন।
আমি মানুষটার হাতটা খামচে ধরলাম। তার হাতটা খামচে ধরে বন্দুকের ট্রিগারে খামচে ধরার মতো মনে হল। হরগোবিন্দ ডেকা মৃদু ভাবে ঝাঁকিয়ে আমার হাতটা সামরিক কায়দায় ছেড়ে দিল।
– সুনন্দের সঙ্গে কবে থেকে পরিচয়?
– থানেই। পুরোহিত শর্মা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
– রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী কথা বলবি, নতুন পরিচয়,চল সুনন্দ আমাদের বাড়িতেই চল। এক কাপ চা খাই।
সুনন্দ আমার দিকে তাকাল।
– আমার যে মোবাইল চার্জ করার কথা ছিল।
– করবে ।আমার ঘরেও করতে পারবে।
বন্ধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিল অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী কথা বলার সঙ্গী পেলে চট করে ছেড়ে দেয় না। তবে আমারও উপায় ছিল না। হরগোবিন্দ ডেকার পেছন পেছন সুনন্দ এবং সুনন্দর পেছন পেছন আমি এগিয়ে গেলাম।
বাঁধ থেকে সোজাসুজি নেমে গিয়ে মানুষটার ঘরটা পাওয়া যায়। বাঁধই তাদের আসা-যাওয়ার মূল পথ।
মানুষটার বাড়ির প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে ভালো লাগছে। আসা-যাওয়া করার পথের দুপাশে ফুলের বাগিচা। গোলাপ-টগর ,বোগেনভেলিয়া। উঁচু উঁচু শেফালী ফুলের গাছ দুটিতে ফুল ধরেছে। টিন লাগানো পুরোনো অস টাইপের ঘর। তিন ইঞ্চি ইটে গাথা হাফ ওয়াল, কাঠে নির্মাণ করা ফ্রেমে লাগানো ইকরা- খাগরির ওপরে সিমেন্ট বালির প্লাস্টার, চুন তেল দিয়ে মসৃণ করে রাখা পুরোনো ঘরটা সম্পূর্ণ অসমিয়া ধরনের ঘর। মেঝেটা পাকা। মূল দরজাটা শৈল্পিক নৈপুণ্যতার সঙ্গে তৈরি করা হলেও তাতে আলকাতরা মাখানো। মোটকথা ঘরটি পুরোনো বর্ধিষ্ণু পরিবারের ঘর। ঘরের ভেতরে ঢোকার মূল দরজার ওপরে একটা হরিণের শিং আভিজাত্যের চিহ্ন হিসেবে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে।
হরগোবিন্দ ডেকা মূল দরজাটা আস্তে করে ঠেলে দিল। বাইরের তুলনায় ভেতরটা অন্ধকার। জানালা বন্ধ রাখার জন্য ঘরটার ভেতরে সামান্য কাঁচা মাছের গন্ধ করছে। মানুষটা ঘরের টিউব লাইটটা জালিয়ে দিল।
– তুমি এই প্লাগে চার্জারটা লাগাতে পারবে।
প্রথমে ক্যামেরার ব্যাটারিটা একটু চার্জ করে নেবার জন্য ক্যামেরার চার্জারটা প্লাগে লাগিয়ে নিল।
– সুনন্দ বস।
সুনন্দ আমার ক্যামেরার চার্জারটা প্লাগে লাগানো দেখছিল।
– বসছি কাকা।
প্লাগে চার্জারটা লাগিয়ে রেখে আমিও এসে নতুন ধরনের একজনের একটি সোফায় এসে বসলাম।
– বল তোমার বাড়ি কোথায়? তোমাকে কিন্তু তুমি বলেই ডাকছি। কিছু মনে করছ না তো?
– না না। কেন মনে করব? আপনি আমাকে তুমি বলেই সম্বোধন করবেন ।
– বল তোমার বাড়ি ?
– কাকু, আমার বাড়ি বলতে সেরকম কিছু নেই। চাকরি সূত্রে যেখানে থাকি সেখানেই আমার বাড়ি। আমি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াতে চাকরি করি। বর্তমানে তিনসুকিয়ায় থাকি।
কাকু আমাকে কী করি অথবা কোথায় চাকরি করছি এই ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে অনুমান করে আমি প্রথমেই জানিয়ে দিলাম– আমি স্টেট ব্যাংকে চাকরি করি।
– স্টেট ব্যাঙ্কের চাকরি? ভালোই তো দেখছি। পরিবার-পরিজন?
আমি কিছুক্ষণ মৌন হয়ে থাকায় তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন–
–বিয়ে- সাদি, তোমার ছেলে মেয়ে?
– নেই।
– নেই মানে?
একান্ত বাধ্য ছাত্র শিক্ষাগুরুর কথা শুনে থাকার মতো সুনন্দ আমাদের দুজনের কথোপকথন শুনছিল।
– সময়ে বিয়ে করাই হল না।
মানুষটা কিছু জিজ্ঞেস না করার মতো প্রশ্নই যেন আমাকে জিজ্ঞেস করল। তিনি ইস-আস করতে লাগলেন।
– খারাপ পেয়ো না। আমার জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি। অবশ্য তোমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়নি। মাত্র চল্লিশ হয়েছে বোধহয়।
– না না। খারাপ পাওয়ার কিছু নেই। আপনি আন্তরিকতার সঙ্গেই জিজ্ঞেস করেছেন। আমার বিষয়ে বলতে গেলে একটি উপন্যাস হবে।
সুনন্দ আর কাকাবাবু একমনে আমার কথা শুনছিল।
– বলতো বল। যদি তোমার মনে হয় যে তোমার কথাগুলি আমাকে বলা যেতে পারে।
– না পারার কিছু নেই কাকাবাবু। আমার মা আমার শৈশবেই মারা গেছে। বাবা আমাকে ফেলে একবার একবার করে দুবার সংসার করেছে। তিনি এখনও জীবিত। কিন্তু আমি জানিনা তিনি কোথায় থাকেন। আমার খোঁজ করেনি যখন আমিও খোঁজ করতে যাইনি। আমি খ্রিস্টান মিশনারিতে পড়াশোনা করেছি। সেখান থেকেই চাকরি পেলাম। জীবনের পার করার সময়টুকু ছাত্র হয়ে এবং চাকরি করেই কাটালাম। বিয়ে করার কথা কেউ বলল না।তাই বিয়ে করা আর হয়ে উঠল না।
আমার জীবনের সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি।
এতক্ষণ সৈন্য বাহিনীর একজন প্রাক্তন সৈনিক হয়ে থাকা মানুষটি নিমেষের মধ্যে একজন করুণাময় ব্যক্তিতে পরিবর্তিত হল।
– দুঃখ হচ্ছে। খুব খারাপ লাগল। যাইহোক এখন সংসার পাতার ইচ্ছা আছে কি?
– সেই সব কথা ভাবার মতো অবকাশ না পাওয়ার মতোই জীবনটা সাজাতে চেষ্টা করছি। আজকাল আমি পাখিদের পাড়া পড়শিতে ঘুরে বেড়াই।
– বুঝতে পারলাম না। কথাগুলি সোজাসুজি বলছ না কেন।
পুনরায় সামরিক আদব কায়দায় মানুষটা আমাকে নির্দেশ দেওয়ার মতো বলল।
– বছরের ছুটি নিতে চাইলে আমি একমাস ছুটি নিতে পারি। সেভাবে ছুটি নিয়ে সেই মাসটা অসমের অরণ্যে পাখি এবং বন্য জীবজন্তু ইত্যাদির জীবন প্রক্রিয়া নিরীক্ষণ করে বেড়াই। বাকি এগারো মাস সেই একই দিনের পুনরাবৃত্তি। চাকরি জীবনের ব্যস্ততায় সময়গুলি নিজের অলক্ষিতে পার হয়ে যায়।
– এভাবে জীবনটা পার হবে কি?
কিছুই ভাবিনি কাকা বাবু।
আমাদের কথাবার্তার মধ্যে সুনন্দ একবারও কথা বলেনি। কেবলমাত্র শুনে গেছে।
হরগোবিন্দ ডেকা ভেতরের দিকের দরজার পর্দাটা সামান্য ফাঁক করে উকি দিয়ে চিৎকার করে বললেন – এই মেয়ে, তিন কাপ চা। অতিথি এসেছে। ঘরোয়া অতিথি।
হরগোবিন্দ ডেকা মানুষটা আমার প্রতি আগ্রহী হলেন এবং আমার জীবনের কথা শোনার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি আমার কথা বলার জন্য মোটেও আগ্রহী নই। আসলে আমার বিষয়ে বলার মতো তেমন কোনো কথাই নেই।
আমি আমার অরণ্য জীবনের দু'একটি কথা বলে মানুষটার ইচ্ছে পূরণ করার প্রয়াস করলাম। ভ্রমণ বিষয়ক কাহিনি বা শিকারের কাহিনি শুনতে মানুষ ভালোবাসে। বক্তব্য রাখা ব্যক্তির বর্ণনা সাবলীল হলে শ্রোতা নিজেই ভ্রমণ করা বা নিজে শিকারে যাবার আল্লাদ অনুভব করে। সম্ভবত আমি কাকুকে আমার স্বপক্ষে পরিচালিত করতে সমর্থ হয়েছি। তিনি একান্তমনে আমার কথা শুনে যাচ্ছেন।
পনেরো ষোলো বছরের একটি মেয়ে একটি ট্রেতে তিন কাপ চা এবং তিন প্লেটে কিছু খাবার জিনিস সাজিয়ে আনল। কাকাবাবু মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের ইঙ্গিতে ট্রে টা কোথায় রাখবে জানালো এবং আমার কথায় মনোযোগ দিল।
কাকু আমার কাছ থেকে আমার জীবনের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করল। আমি সৌম্যদা লাভ করা ভূতের অভিজ্ঞতা নিজের মতো করে বলে গিয়েছি। অরণ্যের আশেপাশে একটি গ্রামে ভুতের ছাগল নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ভূত কীভাবে ছাগলটাকে গড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে কাহিনি আমি কাকাবাবুকে শুনিয়েছি। আসলে সেটা ভুত ছিল না। ছিল একটা ঘোং । রাতের অন্ধকারে কালো ঘোঙকে গ্রামবাসীরা কোনোমতেই চিনতে পারোনি।
–খান।
মেয়েটি সম্মান সহকারে চা খাবার কথা বলল।
আমার নাতনি।
– কোন শ্রেণীতে পড়ে?
– দশম শ্রেণীতে।
– ভালোভাবে পড়াশোনা কর। অংক বুঝতে কঠিন মনে হয়?
– না।
ইতস্তত করে মেয়েটি ভেতরে চলে গেল।
–আজকালকার মেয়ে । পড়াশোনায় খুব একটা আকর্ষণ নেই। টিভিতেই মনোযোগ। খাও খাও, চা খাও।
আমি ভেবেছিলাম হরগোবিন্দ ডেকা মেয়ে মেয়ে বলে ডাকায় তার নিজেরই কোনো মেয়ে বেরিয়ে আসবে।সেই জায়গায় নাতনি বেরিয়ে এল। আমি ক্যামেরার চার্জারটা খুলে মোবাইলের চার্জারটা প্লাগে লাগিয়ে দিলাম। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে আসছিল।
চা পর্ব এবং চার্জ পর্ব শেষ হওয়ার পরে আমি মানুষটার কাছ থেকে বিদায় চাইলাম।
– আবার আসবে তুমি। আমার ঘরে চার্জ দেওয়ার প্রয়োজন হলে এসে দিয়ে যাবে। আমি থাকব। জানইতো রিটার্ড মানুষ, কথা বলতে ভালোবাসি।
মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সত্যি কথাটা মানুষটা নিজেই প্রকাশ করলেন।
•
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন