কর্মব্যস্ততা
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-- বাসুদেব দাস
মানুষের বয়স হিসাব করার জন্য আমরা সাধারণত মাত্র একটি মাপকাঠি ব্যবহার করিঃ সেটা হল রৈখিক সময়ের পরিমাণ। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫০ সনে জন্মগ্রহণ করা একজন মানুষের বয়স ২০০০ সনে হবে ৫০ বছর। বয়সের এই হিসেবটিকে একমাত্র হিসেব বলে স্বতঃসিদ্ধ হিসেব বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু বয়সের এই কালানুক্রমিক হিসেব ছাড়াও আরও একটি হিসেব আছে। সেটিকে মনস্তাত্ত্বিক হিসেবে বলা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একজন ৮০ বছরের মানুষের জরাজীর্ণ শরীরে বাস করতে পারে একটি ৪০ বছরের যৌবন সুলভ সতেজ মন; অন্যদিকে একজন ৪০ বছরের মানুষের মনটা হতে পারে একজন ৮০ বছরের মানুষের মনের মতো নিরুদ্যম, নিরুৎসুক এবং জীবন-বিমুখ। বয়সের অনুভূতি অন্য একটি কথার ওপরেও নির্ভর করে। অপুষ্টি ,অনিয়ম বা নানা ধরনের রোগব্যাধি যদি শরীরটাকে দুর্বল বা ধ্বংস করে, তাহলে পূর্ণ যৌবনেও একজন মানুষ নিজেকে অকাল বৃদ্ধ বলে অনুভব করতে পারে? অন্যদিকে নিষ্ঠার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে দেহ মন সুস্থ রাখতে পারলে আশির গণ্ডি অতিক্রম করা মানুষও যৌবনের প্রাণ-প্রাচুর্য অনুভব করতে পারে। ৮০ বছর বয়সে জর্জ ক্লিমাঞ্চো (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী) একজন সুন্দরী যুবতীকে দেখে সরব স্বগতোক্তি করেছিলেনঃ ইস, এখন যদি আমার বয়স ৭০ হত !' অর্থাৎ ৭০ বছর বয়সে তার হৃদয়ে বিরাজ করছিল জীবনের বসন্ত ঋতু।
পৃথিবীর সমস্ত দেশেই মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বাইবেল মানুষের আয়ু নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল সত্তর বছর। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে ৭০ বছর বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া মানুষের সংখ্যা এখন অত্যন্ত কম। উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলিতে মানুষের আয়ু বৃদ্ধির প্রবণতা এরকম হয়েছে যে আগামী শতকে সেই সমস্ত দেশের মানুষও ৭০ বছরের চেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। মানুষ বেশি বছর বেঁচে থাকার একমাত্র অর্থ হল এই যে মানুষের দুঃখ হবে আগের চেয়ে বেশি দীর্ঘকালীন। সাধারণ অর্থে বার্ধক্য মানেই দুর্বলতা, স্থবিরতা এবং জীবনটাকে ভোগ করার অক্ষমতা।যদি তাই হয়, তাহলে মানুষের আয়ু বৃদ্ধির ফলে কী লাভ হবে– যদি বর্ধিত আয়ুটুকু বেশিরভাগ মানুষের জন্যই মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষাকে আরও বেশি দীর্ঘ করে তোলা ছাড়া অন্য কিছু না করে? যখন ৮০ বছরের মানুষকেই দীর্ঘজীবী বলে ভাবা হয়েছিল, তখন এরকম একজন মানুষের বার্ধক্য স্থায়ী হয়েছিল খুব বেশি দশ বা পনেরো বছর। যদি আগামী শতকের মানুষের আয়ু নব্বই বছরে বৃদ্ধি পায় এবং সমগ্র পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ শতায়ু হয়, তাহলে বার্ধক্য স্থায়ী হবে কুড়ি বছর বা তার চেয়েও বেশি। অর্থাৎ মৃত্যুর প্রতীক্ষা- কাল হবে দ্বিগুণ।
কিন্তু কেবল বার্ধক্যের যন্ত্রণা এবং মৃত্যুর প্রতীক্ষা দীর্ঘ করার জন্যই নিশ্চয় মানুষের আয়ু বৃদ্ধি হয়নি। আয়ু বৃদ্ধি মানুষের সামনে একটা নতুন প্রত্যাহ্বান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সফলভাবে সেই প্রত্যাহ্বানের মোকাবিলা করতে হলে মানুষকে এমন কিছু উপায় উদ্ভাবন করতে হবে এবং জীবন-যাপনের প্রণালীতে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটাতে হবে যার ফলে মানুষের যৌবন এখনের চেয়ে বেশী দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং বার্ধক্যও হবে উপভোগ্য।
কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী গবেষণা করে এই কথা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকা মানুষেরা আশি নব্বই বছর বয়সেও জীবনটা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করে; অন্যদিকে অলস এবং নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করা বেশিরভাগ মানুষই পঞ্চাশ -ষাঠ বছর বয়সে বেঁচে থাকার উদ্যম এবং আনন্দ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমরা এই কথাটা জানার জন্য ১৯৯৯ সনে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল জানার জন্য অপেক্ষা করার কোনো দরকার নেই।১৯১২ সনে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাওয়া এ্যালেক্সিস কেরেল অনেক বছর আগেই এই কথা বলে গেছেন।'Man,The Unknown' নামের বিখ্যাত গ্রন্থটিতে তিনি লিখেছেন–' কাজ তথা পরিশ্রম সমস্ত শারীরিক এবং মানসিক কর্ম- দক্ষতা বৃদ্ধি করে। পেশীগুলি যতই বেশি করে কাজ করে ততই সেগুলি বেশি শক্তিশালী হয়। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলির মতোই বুদ্ধি এবং নৈতিক চেতনাও পরিশ্রম তথা অনুশীলনের অভাবে মৃতপ্রায় হয়। ব্যক্তির সর্বাধিক বিকাশের জন্য যে জিনিস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় তাহল অবিরাম কর্মোদ্যম। প্রধানত বৌদ্ধিক এবং নৈতিক অনুশাসনের সাহায্যে আমরা নিজেকে পুননির্মাণ করতে পারি। বিশেষ করে মধ্যবয়স এবং বৃদ্ধ বয়সে এই ধরনের অনুশাসন বেশি প্রয়োজনীয়।'
প্রায় একই কথা বার্ট্রান্ড রাসেলও বলেছেন আজ থেকে প্রায় আড়াই কুড়ি বছর আগে লেখা তাঁর একটি রচনায়।তাঁর মতে সমস্ত সুখী মানুষের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল এই যে তাঁরা সব সময়ে কর্মব্যস্ত হয়ে থাকে। রাসেল আরও একটি ভালো কথা বলেছেন। নদী তার উৎস থেকে বের হওয়ার সময় সংকীর্ণ এবং ছোট হয়ে থাকে। যতই সে সাগরের কাছাকাছি যায় ততই সে বিস্তৃত হতে আরম্ভ করে। রাসেলের মতে মানুষের জীবনটাও সেই রকমের হওয়া উচিত। জীবনের প্রথম দিকে মানুষ নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে থাকে; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে। কিন্তু রাসেলের মতে জীবনের শেষ বয়সে মানুষের কর্মক্ষেত্র এভাবে প্রসারিত হওয়া উচিত– যাতে সে তার সমাজকেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। আয়ু বৃদ্ধির ফলে মানুষের বার্ধক্য আগের চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘকালীন হবে। সেই সময়টুকুই যদি বৃদ্ধ লোকেরা নানা ধরনের সমাজসেবার কাজে আত্মনিয়োগ করে, তাহলে বৃদ্ধ লোকেরা এবং তাদের সমাজ উভয়েই উপকৃত হবে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও বলেছেন যে বৃদ্ধ লোকরা বেঁচে থাকার আনন্দ পেতে হলে তারা যেকোনো কাজে উদ্দেশ্যহীনভাবে ব্যস্ত হয়ে থাকলেই হবে না; যে সমস্ত কাজ তাদের সমাজের সঙ্গে বেশি করে যুক্ত এবং জড়িত করে সেইসব কাজ তাদের জীবন আনন্দময় করে তুলবে। তাই নতুন শতকের মানুষের বার্ধক্য মৃত্যুর প্রতীক্ষার পরিবর্তে হতে হবে জীবনের সাধনা।
--------
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন