বিদেহ নন্দিনী~ ৩৯
(৩৯)
লঙ্কা নগরে দিনরাত কেবল কান্নার রোল। প্রতিটি বাড়িতে হয় কারও পিতা না হলে ভ্রাতা অথবা পতি বা পুত্রের যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে বলতে শুনেছি। বাড়িতে নাকি পুরুষ মানুষ নাই হয়ে গেছে। অনবরত শুনতে থাকা কান্নার ধ্বনি আমাকে শোকাতুর করে তুলল। নিজেকে দোষী বলে মনে হতে লাগল। যেন এতগুলি জীবের দুঃখের এবং বধের কারণ বলে আমার মনে হতে লাগল। জীবনের প্রতি মায়া একেবারে নাই হয়ে গেল । যে কোনো মুহূর্তে দেহের অবসান ঘটানোর কথা মনে পড়তে লাগল।
ইন্দ্রজিৎ বধের পরে যদিও স্বামী রামচন্দ্রের জয় নিশ্চিত বলে ভেবেছিলাম, পরে রাবণের যুদ্ধের পিপাসা ,উগ্রক্রোধ, আগুনের মতো জ্বলে ওঠা চোখ দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ইন্দ্রজিৎ বধে শোকে জর্জরিত হয়ে পড়া রাবণ একটা সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। সেদিন সেইসময় রাবণের সঙ্গে মন্ত্রী সুপার্শ্ব না থাকলে আমি রাক্ষস রাজের তরোয়ালে দু'খন্ড হয়ে যেতাম। রাবণ ক্রোধে আর্তনাদ করে বলেছিল -'আমার পুত্র ইন্দ্রজিৎ শত্রুর মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য নকল সীতা দু'খন্ড করে দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ আমি আসল সীতাকে দু'টুকরো করব। এ কথা বলে রাবণ চিৎকার করে খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী সুপার্শ্ব আমার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে বাধা দিয়ে বললেন-' হে মহারাজ দশানন, আপনি সাক্ষাৎ কুবেরের ভাই হয়ে একজন অবলা নারীকে বধ করার জন্য বেরিয়ে এসেছেন। হে রাজন বৈদেহীকে বধ করলে আপনার যশস্যা থাকবে না। স্ত্রীবধ করে আপনি পাপে ডুবতে চাইছেন কেন। হে বীর জনকনন্দিনীকে বধ করার চিন্তা মন থেকে পরিহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে চলুন । রামচন্দ্রকে আপনার যুদ্ধ করার কৌশল পরাক্রম দেখান। ত্রিভুবন জয় করা গৌরব অক্ষুন্ন রাখুন।'
মন্ত্ৰী সুপার্শ্বের কথা শুনে রাবণ খোলা তরোয়াল খাপে ভরিয়ে আমার দিকে ক্রোধের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। আমি নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পরে আমি অশোক বন থেকে লংকা নগরীর উল্লাস অনুমান করতে পেরেছিলাম। রাক্ষসপুরীর আকাশ বাতাস রণধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। রাক্ষস সৈন্য নতুন উদ্যমে জয়ধ্বনি করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে গেল।মহিলারা প্রত্যেকে ফুল চন্দন চাল ছিটিয়ে রাজার মঙ্গল এবং জয়ের কামনা করে বিদায় দিলেন।
রাবণ সুসজ্জিত হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল যদিও আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল যে আমার স্বামী রামচন্দ্র এই দুরাত্মার জীবনের অবসান ঘটাবে।তার হয়তো জন্মই হয়েছে এই পাপাত্মাকে নিপাত করার জন্য। তাই আমি উদ্বিগ্ন হয়ে যুদ্ধের ফলাফলের জন্য পথ চেয়ে রইলাম। অন্তরে ভগবানকে প্রার্থনা জানিয়ে ছিলাম তিনি যেন রাম লক্ষ্ণণকে অনন্ত শক্তি প্রদান করে এই মহাযুদ্ধে দুজনের পথের সহায়ক হয়ে থাকেন। আমি পুত্রবতী হওয়ার জন্য আমাকে যেন সধবা করে রাখেন ।
মনের মধ্যে কথাগুলি নাড়াচাড়া করে থাকার সময় ত্রিজটা এসে উপস্থিত হল। এই কয়েকদিন তিনি ঘরে ঘরে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে বেড়ানোর কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন । আমার কাছে বসে প্রথমে আমার স্বাস্থ্যের খবর নিলেন। তারপর তার মনের কথা বলতে শুরু করলেন -' মা সীতা, অধর্মী লোকের সুখ,শান্তি আর নিস্তার নেই। রক্তের গর্বে দুদিন ছটফট করে প্রতাপ দেখায় যদিও শেষ পরিণাম ভয়াবহ হয় । মহারাজ রাবণের যুদ্ধের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে ।অবশ্য তিনি রাম লক্ষ্ণণকে এমনিতেই ছেড়ে দেননি। তোর দেবর লক্ষ্ণণ কোনোমতে রক্ষা পেয়েছে। রাবণ শক্তিশালী বাণ মেরে ভাই বিভীষণকে বধ করতে যেতেই লক্ষ্ণণ দ্রুতগতিতে এসে বিভীষণকে আড়াল করে ফেলে। তারপরে অযোধ্যা নন্দন রাজার উপরে বাণ বর্ষণ করতে শুরু করে। বিভীষণকে রক্ষা করে বীরত্ব দেখানোয় ক্রোধিত রাবণ শ্বশুর ময়দান নির্মাণ করা এক প্রাণনাশ কারী বাণ লক্ষণের দিকে নিক্ষেপ করলেন। নিমেষের মধ্যে লক্ষ্ণণ ঢলে পড়ল। সবাই ভেবেছিল তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। কিন্তু বৈদ্য সুষেণ, মহাবীর জাম্ববন্ত,হনুমান ইত্যাদি বীরদের সেবা শুশ্রূষায় লক্ষ্ণণ সুস্থ হয়ে উঠেন। ভাইকে এভাবে আঘাত করায় রামচন্দ্র প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে তীক্ষ্ণ বাণে রাবণকে জর্জরিত করে ফেলছেন বলে এইমাত্র খবর এসেছে।
কথাটা বলে ত্রিজটা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর দুই হাত বুকের উপরে রেখে চোখদুটি বন্ধ করে ভক্তিভরে বলতে শুরু করলেন-‘ এখন যে যুদ্ধ হচ্ছে তা অতি ভয়াবহ। রামচন্দ্র যুদ্ধ করছেন মাটিতে দাঁড়িয়ে। রাজা রাবণ যুদ্ধ করছেন সুসজ্জিত রথের উপরে উঠে। সৎ লোকেরা অসমান যুদ্ধ সহ্য করতে পারেনা। তাই দেবরাজ ইন্দ্র সারথি মাতালের হাতে তার রথ পাঠিয়ে দিলেন রামচন্দ্রের জন্য। এর অর্থ সহজেই অনুমান করা যায়।’ কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্রিজটা চলে গেলেন।
আমিও ভয়,শঙ্কা, আশা নিরাশা অনিশ্চয়তার মধ্যে স্বামী রামচন্দ্রের চরণ চিন্তা করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে সরমা এল। তার মুখে উত্তেজনার ছাপ। তবুও ধীর-স্থিরভাবে আমার কুশল জিজ্ঞেস করে বললেন- বৈদেহী,রণক্ষেত্রে রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে । সৈন্যদের মৃতদেহ পর্বতের রূপ ধারণ করেছে। রামচন্দ্র এবং রাবণের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পতি বিভীষণ পাঠানো গুপ্ত খবর অনুসারে দুইয়ের মধ্যে এত ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হচ্ছে যে পৃথিবী নাশ হয় বলে সমস্ত প্রাণী ভয়ে কম্পমান হয়ে পড়েছে। এভাবে সরমা যুদ্ধের খবর দিতে থাকার সময় রাজপ্রাসাদের একদিক থেকে এক বিকট আর্তনাদ এবং হৃদয়বিদারক ক্রন্দন ধ্বনি ভেসে এল। আমি কান খাড়া করে রইলাম।সরমা দ্রুত আমার কাছ থেকে রাজ প্রাসাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। আমি কান পেতে শুনতে চেষ্টা করেও কিছুই বুঝতে পারলাম না।কেবল মাত্র কান্না, চিৎকার, চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ির শব্দ কানে এসে পড়ল।
কয়েক মুহূর্ত পরে ত্রিজটা থেকে শুরু করে এককর্ণা,একাক্ষী,অকর্ণিকা ইত্যাদি রাক্ষসীরা আমার দিকে ছুটে এল।ত্রিজটা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলল-‘ জানকী,প্রভু রামচন্দ্র মহর্ষি অগ্যস্ত মুনি উপহার দেওয়া ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে মহা প্রতাপী, ত্রিভুবন বিজয়ী লঙ্কেশ্বরের জীবনের অবসান ঘটিয়েছে। কথাটা অবরুদ্ধ কন্ঠ বলে সরমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পাহারা দেওয়া প্রহরীরাও চিৎকার জুড়ে দিল।
সমস্ত লঙ্কা নগরী শোকে ডুবে গেল। ত্রিজটা এবং প্রহরীরা গলাগলি করে কাঁদতে কাঁদতে রাজপ্রাসাদের দিকে বেরিয়ে গেল।
মহামন্ত্রী সুপার্শ্ব আমার নিরাপত্তার জন্য অশোকবনে দৌড়াদৌড়ি করে অন্য নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন