বিদেহ নন্দিনী~ ৩৮
(৩৮)
দুঃখের দিন সহজে পার হতে চায় না ।ভালো দিন আশা করার জন্য যুদ্ধ অনেক দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। রাক্ষস পুরীতে যত মহাবীর রয়েছে প্রত্যেকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে যদিও রাম বাহিনীর ক্ষতি করে নিজের বীরত্ব প্রদর্শন করে তবে মৃত্যুবরণ করেছে। মাঝখানে শুনেছিলাম রাবণের মন একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। ব্রহ্মাস্ত্রের প্রভাবে মৃত্যু হওয়া রাম লক্ষ্ণণ সহ অন্যান্য বীররা কীভাবে পুনরায় জীবন ফিরে পেল একথা ভেবে নাকি রাবণ একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মনে মনে ভেবেছিলাম দেরিতে হলেও রাবন হয়তো নিজের ভুল উপলব্ধি করে স্বামী রামচন্দ্রের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করবে কিন্তু দশাননের সুবুদ্ধির উদয় হবে কী পরেরদিন শুনলাম রাবণ নাকি এবার তার তিনজন ভাইপোকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে । কুম্ভকর্ণের পুত্র বিকুম্ভ, কুম্ভ এবং খরের পুত্র মকরাক্ষকে। তিনজনেই মহাবীর। কিন্তু অত্যন্ত পরাক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করে এই তিন বীর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল। এই ঘটনার পরে আমি যুদ্ধের খবর আর কিছু জানতাম না।
অশোক বনও রাবণের অন্তপুরের একটি প্রমোদ বন। অবশ্য প্রাসাদ থেকে বন অনেকটা দূরে। একদিন হঠাৎ রাবণের অন্তঃপুরে কাউকে মাঝেমধ্যে বিলাপ করে কাঁদতে শুনলাম। সেই কান্না শুনে প্রহরীরাও এক জায়গায় জড়ো হল। কোনো একজন দৌড়ে গিয়ে অন্তঃপুরে প্রবেশ করার সিংহদ্বারের প্রহরীর কাছে দাঁড়াল। আমি যদিও রাবণের অন্তপুরের দিকে কখনও মাথা তুলে তাকাইনি, স্বর্ণ অন্তঃপুরকে যদিও নরক বলে মনে করতাম , সেখানে কে থাকে কী ঘটে যদিও কোনোদিন জানতে ইচ্ছা করিনি, আজ হঠাৎ নারীর কান্না শুনে আমি বড় বিচলিত হয়ে পড়লাম। আমি কান খাড়া করে অশোক গাছের নিচ থেকে দুই পা এগিয়ে গেলাম যাতে সেই নারীর গভীর শোকের কারণ জানতে পারি। কিছুক্ষণ পরে বিলাপ থেকে জানতে পারলাম সেই বিলাপ মহারানী মন্দোদরীর। যুদ্ধে তাঁর পুত্র ইন্দ্রজিৎ নিহত হয়েছে। সেই সময় আমার অন্তরে এক মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে অন্যায় যুদ্ধ করে শর বর্ষণ করা ইন্দ্রজিৎকে বধের জন্য আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত হইনি। কিন্তু একজন পুত্রহারা মাতার বিলাপ আমার মন বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছিল। রাবণ পুত্র অবধ্য ইন্দ্রজিতের বধ কীভাবে সম্ভব হল এবং কার শরে মৃত্যু হল জানার জন্য আমি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম।
হঠাৎ ভেতরে ত্ৰিজটার কথা শুনতে পেলাম। তিনি মহারানী মন্দোদরীকে শোক সম্বরন করার জন্য বোঝাচ্ছেন-' মা দুঃখ কর না। বীর মহাবীরেরা সব সময় যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করতে চায়। তোমার পুত্র মেঘনাদ তার প্রতাপ এবং বীরত্ব দেখিয়ে মহাযুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছে। তাই দুঃখ করার কিছু নেই তবে মায়ের মন ,মনকে প্রবোধ দেওয়া বড় কঠিন।'
মন্দোদরী বিলাপ করে বলতে লাগল-‘ আমার দেবর কুম্ভকর্ণ এবং বিভীষণ বলে ইন্দ্রজিৎ অন্যায় যুদ্ধ করে। এখন রাম লক্ষ্ণণ অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি কি? আমার পুত্র ইন্দ্রজিৎ অগ্নি পূজা সম্পন্ন করতে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে শত্রুবাহিনী আক্রমণ করাটা উচিত হয়েছে কি? পুজো করতে থাকা অবস্থায় উঠে এসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াটা শত্রুপক্ষের গুরুতর অপরাধ নয় কি?’
রাম লক্ষণকে দোষারোপ করাটা বোধহয় ত্ৰিজটার ভালো লাগেনি। সব সময় সত্য এবং সহজ কথা বলা ত্রিজটা মন্দোদরীকে বলতে শুনতে পেলাম-' মহারানী একবার ভেবে দেখুন রাম লক্ষ্মণ সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় যুদ্ধ করার জন্য বিনা কারণে এসেছিলেন কি? ঝামেলা করেছি আমরা, তাই আমাদেরকেই ভোগ করতে হবে। তারা যুদ্ধ করবেই। তাছাড়া ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধ করতে যাবার আগে একটা বড় দোষ করে গেছে।'
ত্রিজটার কথা শুনে মন্দোদরী বিলাপ করতে করতেই জিজ্ঞেস করল -'দোষ? কী দোষ করেছে আমার পুত্র?'
ত্ৰিজটা বলল-' তোমরা রাজা-রানীরা সব সময় ভালো কথাগুলিই জানতে পার। যে সমস্ত কথা বললে তোমরা সন্তুষ্ট হয়ে পুরস্কার বিতরণ কর সেরকম কথাই সংবাদদাতারা তোমাদের পরিবেশন করে। আমি কিন্তু বুড়ি ত্ৰিজটা ভালো খারাপ সমস্ত খবরই রাখি। এখন শত্রু সৈন্যদের নিকুম্ভিলার যজ্ঞস্থানে কেন যেতে হল বলছি শোনো। কুম্ভ ,বিকুম্ভ ,মকরাক্ষকে বধের পরে রাজা ইন্দ্রজিৎকে যুদ্ধে পাঠালেন। ইন্দ্রজিৎ এবারও পরাক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল যদিও তার বাণে আগের সেই প্রখরতা ছিল না। অদৃশ্য হয়ে থাকা ইন্দ্রজিৎকে রাম লক্ষ্মণ বারবার আঘাত করতে পারছিল। তিনি বুঝতে পারলেন যে এবার তার নিস্তার নেই ।রাম লক্ষ্মণ সর্পিল বাণ বা সেই ধরণের বাণ মেরে তাকে বধ করবে। পুনরায় পুজো করে ইন্দ্র দেবতাকে সন্তুষ্ট না করলে তার বিপদ আছে। তাই ইন্দ্রজিৎ তখনই যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নগরে ফিরে এলেন। সবাই ভাবল ইন্দ্রজিৎ পরাজয় বরণ করে চলে গেছে। আজ আর যুদ্ধ করতে আসবে না। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে গেল। রথের উপরে সবাই দেখতে পেল মায়া বিদ্যা সৃষ্টি করা অবিকল সীতা দেবীর মতো দেখতে একজনকে বসিয়ে রেখেছে। হনুমান রাঘব ঘরণীকে যেরকম দেখে গিয়েছিল অবিকল সেই ধরনের, সাজ পোশাক সেই একই মলিন, মুখমন্ডল দুঃখের । সেদিন যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে ধরে নিয়ে সমস্ত সৈন্যদের সঙ্গে রাম লক্ষ্মণ রণক্ষেত্র থেকে কিছুটা দূরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধক্ষেত্রের রথে রাখা হনুমানকে দেখিয়ে সীতার চুলে ধরে মারধোর করতে লাগল। তারপর গর্জন করে বলল-' বাঁদররা তোদের রাম, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব সবাই এই কুলক্ষণীয়া সীতার জন্য এসেছিলি না। আমি তোদের চোখের সামনে একে বধ করব।যার জন্য যুদ্ধ করতে এসেছিলি সেই মানুষটাকে আমি এই মুহূর্তে শেষ করব। এই কথা বলে ইন্দ্রজিৎ মায়া সীতাকে তরোয়াল দিয়ে দু'টুকরো করে ফেললেন । তারপরে অট্টহাস্য করে রণস্থল থেকে ফিরে এলেন। ইন্দ্রজিৎ এই ঘটনাটা ঘটিয়েছিল একমাত্র রাম লক্ষ্মণের মনোবল নষ্ট করার জন্য, যাতে তারা দুঃখে কান্নাকাটি করার সময় ইন্দ্রজিৎ পূজার কাজ সম্পন্ন করে আসতে পারে। কিন্তু তিনি ভাবা মতে ঘটনাগুলি ঘটল না। বিভীষণ ভাইপো ইন্দ্রজিতের বুদ্ধি বুঝতে পারবে না কি ?তিনি যেহেতু রামের শরণ নিয়েছেন , নিজের প্রভুর অনিষ্ট হতে দেবেন কি? তাই রামচন্দ্র ভাইকে সৈন্য-সামন্ত দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে পাঠালেন। সেই সময় মন্দিরের বাইরে রাক্ষস সৈন্যকে সাবধানে থাকার জন্য বলে ইন্দ্রজিৎ পুজো করছিল। লক্ষ্ণণ বাহিনী রাক্ষসের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক দিক থেকে সৈন্যদের হত্যা করতে লাগল। মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত ইন্দ্রজিৎ পূজা সম্পন্ন না করে উঠে এসে যুদ্ধ করতে লাগল। বড় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছিল দুই বীরের মধ্যে । অবশেষে লক্ষ্মণ ঐন্দ্রাস্ত্র নামে এক ভয়ানক বাণ তুলে নিলেন। সেই অস্ত্র দিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র অসুর দমন করতেন। লক্ষ্মণ ঐন্দ্রাস্ত্রকে স্তুতি করে ইন্দ্রজিতের দিকে নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই অস্ত্র চারপাশ আলোকিত করে তুলে ইন্দ্রজিতের মস্তক ছেদ করে মাটিতে ফেলে দিল। তাই রানী তুমি ভেবে দেখ এই দোষগুলি আমরা নিজেরাই তৈরি করিনি কি,? কথাগুলি আমার কানে বাজতে থাকল।মনে মনে ভাবলাম মায়া সীতা হলেও অপমানের ও একটা সীমা থাকে। আরও কপালে কি দেখতে শুনতে হবে? আচ্ছা আমার যাই হোক না কেন ত্রিজটার কথায় অবাক না হয়ে পারলাম না । মাতার সামনে পুত্রের ,মহারানীর সামনে মহারাজার দোষের কথা নির্ভীকভাবে বলার জন্য আমি তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানালাম। এভাবে অপ্রিয় সত্য কথা ত্রিজটাই সবাইকে বলতে পারে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন