বিদেহ নন্দিনী~ ৪০
(৪০)
আমার স্বামী রামচন্দ্র লঙ্কা জয় করলেন। আজ তিন দিন হল। ভেবেছিলাম রাবণ বধের পরে স্বামী রামচন্দ্র দৌড়ে আমার কাছে আসবে। তাকে আসতেই হবে আমার খোঁজে। আমি তো অশোক বন থেকে স্বামীর খোঁজে বেরিয়ে যেতে পারিনা। আমি এখন বন্দি ।কুরূপা রাক্ষসীরা ছাড়াও অশোক বন বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা বেষ্টিত।
যেকোনো মুহূর্তে স্বামী রামচন্দ্র অশোক বনে প্রবেশ করতে পারেন। এই আশায় আমি প্রতিটি ক্ষণ গুনছিলাম। স্বামীর জন্য প্রতীক্ষা করে অবশ হয়ে পড়েছিলাম। একটা সময় আমার মনে হল স্বামী যুদ্ধ করতে করতে ভুলে গেল নাকি প্রকৃতপক্ষে তার লঙ্কা আক্রমণের উদ্দেশ্য কী ছিল? লঙ্কা জয় করাতেই তার কর্তব্য শেষ হল ভেবেছে নাকি? কথাগুলি ভেবেচিন্তে আমার শোক দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অশোক গাছের নিচে শুয়ে পড়লাম। তৃতীয়দিন পবনপুত্র হনুমান দেখা করতে এল। সে আমাকে প্রণাম জানিয়ে বলতে আরম্ভ করল-' হে পরম শ্রদ্ধার দেবী, আপনাকে জানাতে পেরে সুখী হয়েছি যে আপনি এখন অসহায় বন্দি নন। লংকা বর্তমানে প্রভু রামচন্দ্রের অধীনে। তিনি আপনার উদ্ধারের জন্যই অসাধ্য সাধন করে দুর্জন রাবণ এবং দূরাত্মাদের বধ করে এখন ধর্মাত্মা বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করেছেন। তিনি বিভীষণের মাধ্যমে মৃতদের আত্মার সদগতির জন্য যা করা প্রয়োজন সমস্ত কার্য করিয়ে নিলেন। এমনকি তার অভিষেক কার্য সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে লঙ্কার রাজা হলেন পরম পূজনীয় পুরুষ বিভীষণ। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে মনে মনে বসে থাকায় হনুমান বলল -'হে দেবী, এতগুলি শুভসংবাদ দেওয়ার পরেও আপনি আমার কোনো কথার কোনো উত্তর দিচ্ছেন না কেন। প্রভু রামচন্দ্র আপনার কাছে কোনো বার্তা পাঠাননি বলে হয়তো আপনার অভিমান হয়েছে। কিন্তু হে কোশল বধূ, রাম বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য আমাকে আপনার কাছে পাঠাতে কিছু বিলম্ব হয়েছে। প্রভু বিভীষণকে সিংহাসনে বসিয়ে নিয়ম অনুসারে তার অনুমতি নিয়ে আমাকে আপনার কাছে এই শুভ সংবাদ দেবার জন্য পাঠিয়েছেন।
আমি মনের ক্ষোভ লুকিয়ে বললাম -'হে বীর তোমার কথাগুলি আমাকে এত আনন্দ দিয়েছে যে আমার মুখের কথা হারিয়ে গেছে। এই শুভ সংবাদের জন্য আমার তোমাকে পুরস্কৃত করা উচিত। কিন্তু আমি কী দেব?’
আমার কথা শুনে হনুমান বলল -'হে মাতা, আপনার এই বচনই আমার জন্য উপহার স্বরূপ।' তারপরে হনুমান তখনও আমাকে পাহারা দিতে থাকা রাক্ষসদের দিকে তাকিয়ে বলল -'হে বৈদেহী, এই রাক্ষসেরা আপনাকে অনেক কথা শুনিয়েছে। অনেক মনোকষ্ট দিয়েছে ।ওদের উপযুক্ত শাস্তি দেব নাকি?’
আমি রাক্ষসদের দিকে তাকালাম-হনুমানের কথা শুনে ভয়ে ওদের মুখ শুকিয়ে গেছে। আমি দৃষ্টির দ্বারা ওদের বুঝিয়ে দিলাম যে আমার সম্মতি পেলেই হনুমান ওদের মারধর করবে। তারপর হনুমানকে বললাম-' হে বীর শ্রেষ্ঠ, ওদেরকে মারার দরকার নেই। ওরা রাজার দাসী মাত্র ।দাসী আদেশ পালন করে মাত্র।আমার হয়তো কপালে লেখা ছিল ওদের কড়া কথা শোনার। অবশ্য রাবণের মৃত্যুর পর থেকে ওরা আমাকে আর কথা শোনায় না।' তারপরে হনুমানকে বললাম -'হে পবন নন্দন, তোমার প্রভুকে বল গিয়ে যে আমি এখনই তার দর্শন করতে চাই। আমার কথা শুনে হনুমান আনন্দমনে বিদায় নিয়ে তার প্রভুকে সংবাদ দিতে গেল।’
আমি ভেবেছিলাম হনুমানের মুখে আমার বার্তা পাওয়ার পরে স্বামী তখনই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। কিন্তু আমি ভাবা কথাটা সত্যি হল না । কিছুক্ষণ পরে বিভীষণ সরমার সঙ্গে এল।আমি বিভীষণকে প্রথমবারের জন্য দেখলাম। ব্যক্তিত্ববান একজন পুরুষ। আমরা দুজন দু'জনকে অভিনন্দন জানালাম। বিভীষণ বললেন -'হে দেবী, রামচন্দ্র আপনার দর্শন পাবার জন্য অধীর হয়ে আছে ।তাই আপনি স্নান করে অলংকার এবং নতুন সাজ পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিন।' আমি বিভীষণের কথার প্রতিবাদ করে বললাম-'হে রাজন স্বামীর দর্শন পাওয়ার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে আছি। তাই বিন্দুমাত্র সময় খরচ না করে আমি যেভাবে আছি সেভাবেই তার সঙ্গে দেখা করতে চাই ।'
পরে বিভীষণ আমার কথা শুনে বললেন-' হে কোশল বধূ ,প্রভু রামচন্দ্র যেভাবে আপনাকে তার সামনে আসাটা চাইছেন সেভাবেই আসুন। সঙ্গে সঙ্গে সরমা আমার হাত ধরে তার রাজপ্রাসাদের দিকে নিয়ে গেল। সরমা সাজিয়ে দেওয়া দ্রব্যে আমি স্নান করলাম। অলংকার এবং সাজপোশাক পরলাম। মুখে প্রসাধন দিলাম। আমি মাত্র যন্ত্রদানবের মতো কাজগুলি করে যাচ্ছিলাম। তার মধ্যে কোনো উৎসাহ ,আগ্ৰহ ছিল না ।আমি সাজসজ্জা করে তৈরি হওয়ার পরে বিভীষণ আমাকে রাজকীয় দোলায় উঠিয়ে রামের কাছে নিয়ে যাবার জন্য দোলাভারীকে আদেশ দিলেন। আমাকে দেখার জন্য বাঁদর এবং রাক্ষস সেনাদের মধ্যে ঠেলা ধাক্কা পড়ে গেল। দোলার আগে আগে যাওয়া পাহারাদাররা লাঠির আস্ফালন করে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিল। সেই কার্য স্বামীর ভালো লাগল না। তিনি উচ্চ স্বরে বললেন-' মিত্র বিভীষণ সীতাকে পায়ে হেঁটে আমার কাছে আসতে বল। সবাই তাকে দেখুক ।এই সমস্ত সেনা কখনও না-দেখা বা কোনো কিছুই না জানা সীতাকে উদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে ।এখন তারা সীতাকে দেখলে কী হবে? এরা আমার পরমাত্মীয়। প্রকৃতপক্ষে কাপড়চোপড় নারীর আবারণ নয়। স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া সম্মান এবং নিজের সদাচার এই দুটোই একজন নারীর পূর্ণ আবরণ। তাছাড়া বিপদকালে শারীরিক বা মানসিক রোগের সময়, স্বয়ম্বরে, যজ্ঞস্থলীতে বা বিবাহ মন্ডপে নারীকে অনেকেই দেখে। কোনো দোষের কথা নয়। তাই জানকী দোলা থেকে নেমে পায়ে হেঁটেই আমার কাছে আসুক। তাকে সবাই দেখুক।স্বামীর কথাগুলি যদিও আমি অন্তর থেকে সমর্থন করেছিলাম তথাপি লোকারণ্য পথের মধ্য দিয়ে আড়াল বিহীনভাবে হেঁটে যেতে একটু লজ্জা করছিল। তবু আমি দোলা থেকে নেমে স্বামীর কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। আমার পেছন পেছন আসছিল বিভীষণ। স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি তাকে একবার নয়ন ভরে দেখলাম। আমার মনটা প্রসন্ন হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমি শোকাতুর হয়ে পড়লাম। আমার দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগল। কতক্ষন এভাবে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি বুঝতেই পারিনি ।হঠাৎ তার কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। স্বামী বললেন-' শত্রুকে বধ করে তোমাকে উদ্ধার করলাম। আমার মনে এখন কোনো আক্ষেপ নেই। রাবণ আমাকে করা অপমান তাকে বধ করে শোধ নিয়েছি ।এই যে দেখছ হনুমান, সুগ্রীব, বিভীষণ ,বাঁদর এবং ভালুক বীররা, এরা আমাকে কম সাহায্য করে নি, বিভীষণ দুরাত্মা রাবণকে ছেড়ে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছে । এই সমস্ত কিছুর চেষ্টা আজ সফল হল।
তিনি কথাগুলি বলার সময় আমি আবার মুখের দিকে তাকালাম ।আমি অবাক হলাম ।তিনি আমার দিকে না তাকিয়ে কথাগুলি বলছেন। দৃষ্টি উদাস। স্বামী রামচন্দ্র আমাকে নিয়ে যেন সন্তুষ্ট নয় বলে মনে হল। তিনি পুনরায় বললেন-' সীতা, তোমার একটা কথা পরিষ্কারভাবে জানা উচিত যে রাবণকে বধ কেবল তোমাকে ফিয়ে পাবার জন্য করি নাই। দৈব আমার উপরে চাপিয়ে দেওয়া অপমানের প্রতিশোধ নিতে বধ করেছিলাম। আরও একটি কথা । আমি সমস্ত কিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু দুর্নাম সহ্য করতে পারিনা । রাবণ তোমাকে কোলে বসিয়ে নিয়ে হরণ করেছিল । তোমার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তোমার চরিত্র বর্তমানে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয় । তাই তোমাকে দেখে আমি আনন্দলাভ করছি না । তোমাকে উদ্ধার করতে না পারলে আমার অপযশ কিন্তু এখন তোমাকে গ্রহণ করলে আমার বিখ্যাত বংশের দুর্নাম হবে। আমি এখন সেই অপযশ থেকে মুক্ত। বর্তমানে তোমার প্রতি আমার মমতা আসক্তি কিছুই নেই ।এক সময় আমরা দুজন একসঙ্গে ছিলাম বলেই এখন আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে গ্রহণ করতে পারব কি? তাই তোমার যেখানে যাবার ইচ্ছা সেখানে যেতে পার। যদি ইচ্ছা হয় ভরতের সঙ্গেও থাকতে পার। বানররাজ সুগ্ৰীব বা বিভীষণের সঙ্গে থাকতে চাইলেও আমার আপত্তি নেই। কোনো একজনকে পতি হিসেবে গ্রহণ করতে চাইলেও আমার সম্মতি আছে। পাপাত্মা রাবণ তোমাকে দীর্ঘদিনের জন্য পেয়েও দূরে সরে ছিল বলে কে বিশ্বাস করবে? তাই আমি স্পষ্টভাবে বলছি আমার জীবনে তোমার প্রয়োজন আর নেই। আমি তোমাকে গ্রহণ করতে পারব না।'
স্বামীর কথা শুনে আমার কান মাথা গরম হতে লাগল। লোকারণ্য সভাঘরে লজ্জা, অপমান সহ্য করতে হওয়ায় আমি মরে যাব বলে মনে হচ্ছিল। আমি মাথা তুলে কোনো দিকে তাকাতে পারলাম না ।আমার দুই চোখ দিয়ে গরম অশ্রু ধারা বয়ে যেতে লাগল। তবু দুর্ভাগ্যের জন্যই এই ধরনের অপমান সহ্য করতে হয়েছে বলে ভেবে শোক সম্বরণ করে দৃঢ় কন্ঠে স্বামীকে বললাম-' হে অযোধ্যা কুমার, আমার চরিত্রকে সন্দেহ করে এই ধরনের কথা বলা আপনার উচিত হয়নি। আপনি যে সমস্ত শব্দ প্রয়োগ করে যে ধরনের বাক্য উচ্চারণ করেছেন, সেগুলি অতি নিম্ন শ্রেণির পুরুষ, নিম্নশ্রেণির স্ত্রীর সামনে বলে থাকে। রাবণ আমাকে হরণ করার সময় আমার দেহ স্পর্শ করেছিল সত্যি, তখন আমার কোনো উপায় ছিল না।কিন্তু তার বাইরে রাবণ আমাকে স্পর্শ করা তো দূরের কথা,এমনকি কাছে আসতেও সাহস করেনি।আমি ক্ষণিকের জন্য ও আপনার চিন্তা থেকে দূরে সরে যাইনি। আমার দেহমন এবং চিত্ত সমস্ত কিছুই আপনাকে সঁপে দিয়ে আপনার চরণ চিন্তা করছিলাম। তাই আমি আপনার এত কটু কথা সহ্য করতে পারব না। যদি আপনার আমার ওপরে সন্দেহ হয়েই থাকে বা আমাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই ছিলেন তাহলে মহাবীর হনুমানের কাছে আগেই বলে পাঠালেন না কেন? তখনই আমি পবনপুত্র হনুমানের সামনে প্রাণ ত্যাগ করতাম। আচ্ছা যাই হোক না, আপনাকে আমি কোথায় যাব, কী করব এই সমস্ত চিন্তা করে সময় অপচয় করতে হবে না। আপনি বংশের গৌরব উজ্জ্বল করে নিজের গুণ গরিমা অক্ষুন্ন রেখে ভালো থাকুন। আমি কী করব এই সিদ্ধান্ত আমি নিজেই গ্রহণ করব।
কথাগুলি বলে আমি লক্ষ্মণের দিকে তাকালাম। তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম, দাদার কথায় সে খুব দুঃখ পেয়েছে। আমি রুদ্ধকন্ঠে লক্ষ্ণণকে বললাম-‘তুমি শুনতে পেয়েছ তো দাদা কি বলেছে? তার আমার ওপরে সন্দেহ হয়েছে? এই মুক্ত সভায় আমাকে পরিত্যাগ করেছে বলে ঘোষণা করেছেন। আমি এই ধরনের অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। তাই তুমি আমার জন্য চিতা প্রস্তুত কর। আমি আমার দুঃখের জীবন এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটাব।’
কথাটা বলে আমার লক্ষ্ণণের জন্য খারাপ লাগল। এতদিন আমি মনে মনে ভেবেছিলাম প্রথম যখন লক্ষ্ণণের সঙ্গে দেখা হবে তার কাছে ক্ষমা চাইব। সেদিন পঞ্চবটী মনে কটু কথা বলার জন্য। কী কল্পনা করেছিলাম কী ঘটে গেল। আমি পুনরায় লক্ষ্ণণের দিকে তাকালাম। সে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। একদিকে আমি অন্যদিকে দাদা। সে অসহায় দৃষ্টিতে দাদার দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে স্বামী রামচন্দ্র লক্ষ্ণণকে আদেশ দিলেন-‘ সুমিত্রা নন্দন, জানকীর জন্য চিতা প্রস্তুত কর।’
স্বামী রামচন্দ্রের নিষ্ঠুর বাক্য শুনে ত্রিজটা সহ অন্যান্য রাক্ষসীরা ইস ইস করতে লাগল। আমি মাথা তুলে তাদের দিকে তাকাতে পারলাম না। অগ্নিতে পুড়ে যাব বলে সেই সময় আমার ভয় করছিল না। মাত্র এই সহজ-সরল রাক্ষসেরা সাক্ষাৎ দেবতা বলে অভিহিত করা রামচন্দ্রকে যে একটি ইতর প্রাণীর চেয়েও অধম বলে ভাবছে সে কথা ভেবে দুঃখ পেলাম।
ইতিমধ্যে উপায়বিহীন হয়ে লক্ষ্ণণ চিতা প্রস্তুত করল। আমি ধীর-স্থিরভাবে কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলাম। তারপর রামচন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে দাউ দাউ করে জ্বলে ঊঠা চিতার দিকে এগিয়ে গেলাম।ত্রিজটা থাকতে না পেরে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল-‘ দেবী, পৃথিবীতে যদি এখনও সামান্যতম ধর্ম থেকে থাকে, তাহলে অগ্নি দেবতা তোমাকে রক্ষা করবে।’
আমি ত্রিজটা এবং সমবেত জনগণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে বললাম-‘ হে অগ্নিদেব, আমার যদি দেহ, মন, চিত্ত বিন্দুমাত্র কলুষিত হয়ে থাকে তাহলে তোমার শক্তি আমাকে দগ্ধ করে, জীর্ণ করে ফেলুক। হে অন্তর্যামী অগ্নি দেবতা, রাঘব আমাকে কলঙ্কিনী বলে আখ্যা দিয়েছে। আমার চরিত্রে তিনি সন্দেহ করেছেন। আমি যদি নিষ্কলুষ, আমি যদি পবিত্র তাহলে আমাকে রক্ষা কর। হে কৃপাময় অগ্নি দেবতা, আমি যদি ক্ষণিকের জন্য রামচন্দ্রের কথা ভুলে না থাকি তাহলে তুমি আমাকে দয়া করবে।’ তারপর আমি চন্দ্র সূর্যকে মুখ্য করে সমগ্র দেবতাকে সম্বোধন করে বললাম-‘ হে দেবগণ, যদি তোমরা আমাকে শুদ্ধ বলে ভেবে থাক তাহলে অগ্নি দেবতা আমাকে নিশ্চয় রক্ষা করবে।’
এ কথা বলে আমি অগ্নিতে প্রবেশ করলাম। ত্রিজটা, এককর্ণাদের কান্না, বাঁদর সৈন্যদের আর্তনাদ সমবেত রাক্ষসদের ব্যথা ভরা শব্দ তখনও আমার কানে বাজছিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অগ্নির লেলিহান শিখা আমাকে ঘিরে ধরল। তারপর কী হয়েছিল আমি কিছুই জানিনা।
যখন আমি জ্ঞান ফিরে পেলাম, আমি ছিলাম অগ্নি দেবতার দুই হাতের তালুতে। অগ্নি দেবতা ছোট্ট শিশুকে কোলে নেবার মতো আমাকে তার দুই হাতে নিয়ে অগ্নির মাঝখান থেকে বের করে রাঘব কে বললেন-‘ রাম এই হল তোমার নিষ্পাপ সতী-সাধ্বী পত্নী সীতা। তার মন, শরীর, অন্তর একেবারে শুদ্ধ। উপায়হীন হয়ে রাবণের অন্তঃপুরের মধ্যে থাকা অশোক বনে বন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিল যদিও কোনোদিন রাবণ সীতাকে স্পর্শ করতে সাহস করেনি। নির্মল চরিত্রের সীতা নিষ্পাপ। তাকে আগের মতোই স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আদর যত্ন করবে। বৈদেহী কে কখনও কড়া কথা বল না। এটি আমার অনুরোধ নয়, আদেশ।’
ইতিমধ্যে সেখানে ব্রহ্মা, মহেশ্বর, দেবরাজ ইন্দ্র, সূর্য, বায়ু, বরুন সহ সমগ্র দেবতা এবং আমার শ্বশুর দশরথ এসে সমবেত হয়েছিলেন। তারা প্রত্যেকে স্বামী রামচন্দ্রকে দু্রাত্মাদের বধ করে শান্তি স্থাপন করার জন্য অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে আমার প্রতি অবিচারের জন্য বক্তব্য রাখেন। প্রত্যেকেই আমার পবিত্রতার কথা বলেছিল।–‘ অযোধ্যা কুমার, জানকী পতিব্রতা, শুদ্ধাচারী এবং কলুষহীন জীবনের অধিকারী। তার মনে কষ্ট দিও না। তুমি তাকে আগের মতোই আদর করে রাখবে।’
স্বামী ছলছল চোখে সবাইকে বললেন-‘ হে পরম পূজনীয় দেবতারা এবং আমার পিতৃদেব দশরথ আমি জানতাম যে সীতাকে দীর্ঘদিন ধরে রাবণের অন্তঃপুরে অশোকবনে থাকতে হয়েছিল যদিও শুদ্ধ জীবন যাপন করেছিল। সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দিতে পারে ভেবে আমি অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করেছিলাম। আমি ভালোভাবে জানি সীতা কায়মনোবাক্যে আমাকে চিন্তা করে। তাকে আমার থেকে কেউ পৃথক করে দিতে পারবে না। সীতা বিহীন জীবন আমার কাছে অসম্ভব।’ এভাবে বলে স্বামী রামচন্দ্র আমাকে কাছে টেনে নিলেন।
দেবরাজ ইন্দ্র স্বামীকে পুরুষ শ্রেষ্ঠ বলে সম্বোধন করে বর দিতে চাইলেন। স্বামী রামচন্দ্র দেব রাজের কথায় আনন্দিত হয়ে বললেন-‘ হে পরম দেবতা, আপনি আমাকে এই বর দিন যেন বরের দ্বারা যুদ্ধে নিহত সমস্ত বাঁদর এবং ভালুক সেনা পুনরায় জীবিত হয়ে উঠে। সঙ্গে আরেকটি বর দিন যাতে এই ভালুক, বাঁদররা কোনোদিন খাদ্যের সমস্যায় না পড়ে।
দেবরাজ পরম সন্তোষের সঙ্গে সেই বর প্রদান করে আমাকে আশীর্বাদ করে দেবতাদের সঙ্গে প্রস্থান করলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন