পাখিদের পাড়া পড়শী - ৭
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
Pankaj Gobinda Medhi
(সাত)
আমার থাকার সমস্যার সমাধান হল।
এই বিষয়টাকে নিয়েই আমি যথেষ্ট বিপদে পড়েছিলাম। কোথায় থাকব কীভাবে থাকব আগে যোগাযোগ করার উপায় না থাকায় বিমূঢ় হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল।
আশীর্বাদ নেবার জন্য পুরোহিতের পায়ে হাত দেওয়াটা কে জানে হয়তো আশীর্বাদে পরিণত হল।
– প্রভুর নাম? আমার প্রভুর নাম কৈলাস শর্মা।
ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে ডাকতে আসা সহায়কটিকে আমি জিজ্ঞেস করায় মানুষটা বলল। সঙ্গে সে বলল তার নাম বাপুটি ।
কৈলাস শর্মা পুজো করে থাকার সময় অনেক ভক্তের আগমন ঘটল ।দলে দলে মেয়ে-স্ত্রী । শিশু-কিশোর-কিশোরী।পুরুষের সংখ্যা কম। বাঁশ অথবা ধাতুতে নির্মিত খরাহিতে কলাপাতায় থেকে তারা প্রসাদ নিয়ে এসেছে ।
কৈলাস শর্মা পুজো শেষ করার জন্য দু ঘন্টা সময় নিলেন। সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপরে।
– আজকের জন্য বিশ্রাম ?
আমার কাছে আসা পুরোহিত শর্মাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
– কোথায় বিশ্রাম ! শান্তি জল নিতে আসবে দুই এক জন। আচ্ছা আপনার থাকা-খাওয়া? এখানে তো থাকবেন কিছুদিন?
কথাটা তিনি নিজেই উপস্থাপিত করায় আমি খুশি হলাম ।
– হ্যাঁ।কয়েকদিন থাকব বলে ভাবছি। আমার কাজটা শেষ হতে কয়েকদিন সময় লাগবে।
– কেবলমাত্র পাখি দেখাই কাজ?
– হ্যাঁ।
আমি সায় দিলাম। পুরোহিত শর্মা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।পাখি দেখতে এসে একজন মানুষ কীভাবে জীবনের মধুরতম সময় অতিবাহিত করতে পারে ত়াঁর কোনো ধারণা ছিল না।
– পর্যটক নিবাসটা সাজালে হয় কিন্তু শুভ উদ্বোধনই করা হল না। মাঝেমধ্যে শুনি দু'একদিনের মধ্যে পর্যটন বিভাগের কোনো অফিসার এসে উদ্বোধন করবে। তবে সমস্তই নিষ্ফল চেষ্টা। শোনা কথা শোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল। পেছনে একটি রুম আছে। রুমের চাবি মন্দির পরিচালনা করা সম্পাদকের হাতেই রয়েছে।সেই রুমটা ঠিকঠাক করে দেওয়া যাবে। তবে রুমটা ছোট।
– আমি কোনোমতে থাকতে পারলেই হল।
বাপুটি ইতিমধ্যে এসে আমার কথা শুনছিল।
– বাবুটি চাবিটা বিপুলকে বলে নিয়ে আসতে হবে।– এখানে একা কীভাবে থাকবে? রাতের বেলা ও বের হয় না।
– কে বের হয়?
– সে সে।
বাপুটি যেন তার নাম করতেও সাহস করছে না।
এখানে কারেন্ট কারেন্ট নেই, রাতের বেলায় এই জায়গা উপদেবতা আর ভুতের রাজত্ব হয়ে উঠে।
জানিনা আপনি কীভাবে এখানে থাকার সাহস করছেন।
– দেখছি। মানুষ তো কিছু করবে না?
– রাতের বেলায় মানুষের এখানে আসার সাহস নেই। ভয়ে পায়খানা বেরিয়ে যাবে।
– বাপুটিরা রাতে এখানে ভূত বের হয় বলে বিশ্বাস করে। তারা নাকি ভুত দেখেছে।
পুরোহিত শর্মা বললেন।
ভূত-প্রেতের প্রসঙ্গ উঠায় আমি বিষয়টাতে খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না। এসব কথা বলে লাভ নেই ,সময় নষ্ট। আমি এরকমই ভাবি। অযথা আলোচনা দীর্ঘ করা ছাড়া ফলাফল শূন্য।
পুরোহিত শর্মা পর্যটন নিবাসের পেছনদিকে থাকা ছোট ঘরটির চাবি বাপুটির মাধ্যমে আনালেন। রুম টা খুলে বাপুটিকেই রুমটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে দেবার জন্য আদেশের সুরে বললেন। বাপুটি মুখে কী সব বিড়বিড় করে রুমটি পরিষ্কার করতে লাগল। সম্ভবত তাকে যাতে ভূত বা অপদেবতা কোনো ধরনের অমঙ্গল না করে সেই জন্য মুখ দিয়ে মন্ত্রের মতো কীসব উচ্চারণ করছিল। আমার সেরকমই মনে হল।
আমি রুমের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম। রুমটিতে একটি ছোট তক্তপোষ রয়েছে। একটা হ্যারিকেন দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা আছে। রুমটা ভালোই লাগল। আমি ভাবার চেয়ে যথেষ্ট সুবিধাজনক। এতটা সুবিধা পাব বলে আমি আশা করিনি।
ব্যাগটা এনে আমি রুমে ঢুকিয়ে রেখে বাপুটির কাছ থেকে চাবিটা হস্তগত করলাম। চাবিটা আমাকে দিতে বাপুটি ইতঃস্তত বোধ করছিল। তোর মনের ভাব আমি এখানে থাকা অনুচিত।
– আপনার খাওয়া-দাওয়া?
পুরোহিত শর্মা জিজ্ঞেস করলেন।
– বিশেষ চিন্তা করিনি।বগলচ চকে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– ঠিকই। হরিণের হোটেলটা ভালো, আপনার চাওয়া অনুসারে সবকিছুই তাতে পাবেন। অর্ডার দিলেই হল ।
হরিণের হোটেল। পুরোহিত শর্মার কথা শুনে আমিও হরিণ বলে ভেবেছিলাম মানুষের নামটা। তবে না ,হরেন।হরেন মানুষের মুখে মুখে হরিণ হয়ে গেছে। তাঁর কথা মতো আমি হরিণের হোটেলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করব বলে ঠিক করলাম। সকালে যে পুরি-তরকারি খেয়েছিলাম সেটাই হরিণের দোকান।
পুরোহিত কৈলাস শর্মা, বাপুটি আর থানে উপস্থিত হওয়া ভক্তদের মধ্যে থেকে কখন যে দুপুর পার হয়ে বিকেল হল বুঝতেই পারলাম না। ক্ষুধা পেয়েছিল যদিও পেটের ক্ষুধা পেটেই মরে গেল। বাপুটি এনে বুট-মণ্ড কলা আপেলের একটা হাতে তুলে দিয়েছিল। সেটা খাওয়ার পরে আর ক্ষুধা লাগল না। রাতের চিন্তা করে বাপুটিকে দিয়ে এক লিটার কেরোসিন তেল আনিয়ে নিতে আমি ভুলে যাইনি ।
তিনটের সময় পুরোহিত শর্মা এবং বাপুটি বাড়ি চলে গেল।
যাবার সময় বাপুটি আমার দিকে করুণভাবে কয়েকবার তাকাতে তাকাতে গিয়েছিল। যেন আজকের রাতটাই আমার শেষ রাত। তারা চলে যাবার পরে আমার মনে হল এই বিশাল সাম্রাজ্যে আমিই এখন একমাত্র অধীশ্বর। আমি রুকসেকটা খুলে বিছানাটা পাতার ব্যবস্থা করলাম। বিছানা মানে বিছানার চাদর একটি এবং ফুলিয়ে ব্যবহার করতে পারা একটি বালিশ। রুমের এক কোণে বাপুটি রেখে যাওয়া ঝাড়ুটা দিয়ে আমি বিছানার ওপর থেকে ধুলোবালি ঝাড়তে চেষ্টা করলাম। রুমটা ধুলোয় পূর্ণ হয়ে পড়ল।ঘরে জল আনার কোনো বাসন আছে কিনা তাকিয়ে দেখলাম। না, কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি নামঘর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে নামঘরের কোণে বাপুটি রেখে যাওয়া বালতিটা হাতে নিয়ে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলাম ।
পুকুর থেকে আনা জল হাতের অঞ্জলিতে নিয়ে ছিটিয়ে দেওয়ায় ধুলো দূর হল। ব্যাগটা থেকে পুরোনো কাগজের পুঁটলিটা বের করে তা থেকে কয়েকটি আমি বিছানার ওপরে পেতে তার ওপরে বিছানার চাদরটা মেলে দিলাম। চাদরটাতে লেগে থাকা বিলাস পাশওয়ানের লণ্ড্রির গন্ধটা আমার নাকে এসে লাগল । রুকসেকটা থেকে বের করে হাওয়াই স্যান্ডেল জোড়া, টুথব্রাশ শোবার সময় পরার জন্য ব্যবহার করা কাপড়গুলি আমি বিছানায় সাজিয়ে রাখলাম। গত রাত থেকে একই কাপড় পরে রয়েছি। কেমন যেন লাগছে। কাপড় ছেড়ে হাফপ্যান্ট পরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অবশ শরীরটা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে বলে মনে হল। ঘরটিতে সিলিং নেই বিছানার ওপর দিয়ে মাঝখান দিয়ে একটা পার্লিং রয়েছে । রাতে হয়তো সেখানে পাখি পড়ে। পাখির বিষ্ঠার দাগ বিচ্ছিন্নভাবে লেগে রয়েছে । নিজের অজান্তেই চোখে কখন ঘুম নেমে এল বুঝতেই পারলাম না । যখন জেগে উঠলাম বাইরে অন্ধকার । আমার ঘরের সামনে ঝাকে ঝাকে জোনাকি পোকা এসে ভিড় করেছে । দূরে অপরিচিত পাখি চিৎকার করছে । এক কাপ চায়ের খুব প্রয়োজন অনুভব করলাম । বগলচকে যেতে হবে । কিছু একটা খেয়ে এলে রাতটা আজ এভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
লং প্যান্ট পরে স্পোর্টিং দুইহাতে ঢুকিয়ে নিয়ে হাতে টর্চটা নিলাম। দরজায় তালা মেরে বগলচ চকের অভিমুখে এগিয়ে গেলাম। সকালে যে গাছের নিচে বসে ছিলাম এখন সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুকুরের সিঁড়িতে পাখিগুলি বসে আছে। জল পতঙ্গের শব্দ কিচিরমিচির করে এসে আমার কানে পড়ছে।
একদিন রাতে এসে গাছের ডালের নিচে বসতে হবে। মনে মনে ভেবে আমি বগলচ চকের দিকে এগিয়ে গেলাম।
একই হোটেলে স্লাইস রুটি কয়েক পিস রসগোল্লার সঙ্গে উদরস্থ করে রাতের আহার সমাপন করে হাতে একটা জলের বোতল নিয়ে আমি রুমে ফিরে এলাম। অবশিষ্ট স্লাইস পিস এবং একটা মিষ্টি বেঁধে দিতে বলায় ছেলেটি সুন্দর করে বেঁধে একটা ক্যারিব্যাগে ভরিয়ে দিল। এটা আমার কাল সকালের আহার।
অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগছে। রাস্তা দিয়ে বেল বাজিয়ে দুই চার জন সাইকেল যাত্রী পার হয়ে গেলেও জনসমাগম প্রায় শূন্য। জোনাকি পোকার ঝলমল এবং পতঙ্গের শব্দ। অত্যন্ত প্রয়োজনেই আমি টর্চের আলো নিক্ষেপ করেছি। অন্ধকার প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলে আসার সময় কখন যে ঘরে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।
ঘরের ভেতরে মশার বড় উপদ্রব। মানুষের গন্ধ পেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এসে ঘরের ভেতরে ঢুকেছে। মশার উপদ্রব সহ্য করতে না পেরে সঙ্গে আনা মশা তাড়ানোর জন্য একটা কয়েল জ্বালিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম মশারিটা টাঙ্গিয়ে নেওয়া ভালো। মশারি টাঙ্গানোর ব্যবস্থা করে মশারিটা টাঙিয়ে নিলাম। অতিরিক্ত রশি সঙ্গে থাকার জন্য মশারিটা টাঙ্গাতে খুব একটা অসুবিধা হল না। ল্যাম্পের কম আলোতে ঘরটা সুন্দর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পরিবেশ অনুকুল না হওয়ার জন্য আজ পড়াশোনা করতে ইচ্ছা হল না। পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য অন্তত কিছু সময়ের প্রয়োজন হয়।
শরীরটা অবশ অবশ এবং ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে।
বিছানায় শুয়ে পড়ে দীর্ঘ রাতটাকে সঙ্গী করার জন্য খুব ইচ্ছা হচ্ছে। ঘুমোনোর হিসেবে আমার এখনও ঘুমানোর সময় হয়নি। এখন সাড়ে আটটা বাজে। মশা তাড়ানোর কয়েলটাতে একটু জল ছিটিয়ে নিভিয়ে দিয়ে ল্যাম্পের আলোটা কমিয়ে বিছানা থেকে একটু দূরে রেখে দিলাম। টর্চটা বালিশের পাশে রাখা আছে। প্রয়োজনে হাত দিলেই পাওয়া যাবে। মশারিটা ভালোভাবে বিছানার চাদরের নিচে গুঁজে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে যেতেই টিনের চালে ধপাশ করে কিছু একটা পড়ল। অনাহত শব্দটিতে আমি চমকে উঠলাম তবে ভয় পেলাম না। নিশ্চয় রাতচরা পাখির লড়াই চলছে। নাকি সে এসেছে– বাপুটির পরি না পিশাচিনী।
কিছুক্ষণ আমি বিছানায় বসে রইলাম। না আর কোনো শব্দ নেই।
কেউ এলে ভালোই হত। অন্তত রাতের সঙ্গী হত। পরি হলেও পিশাচিনী হলেও রাতটা কথা বলে কাটিয়ে দেওয়া যেত। জিজ্ঞেস করতাম পরি হওয়ার অভিজ্ঞতা, পিশাচিনী হওয়ার অভিজ্ঞতা।
বিছানাটায় গড়িয়ে ভালোই লাগল। কিছু একটা নতুন আমেজ পেলাম। নতুন ঘরে থাকার মতো মনে হল। হঠাৎ মনে পড়ল দেড় দুই কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই বিশাল অরণ্য অঞ্চলে এই মুহূর্তে রাত কাটানো আমিই একমাত্র মানুষ।
রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল। একবারও জাগলাম না। রাতে ঠান্ডা লাগায় কখন যে পাতলা কম্বলটা গায়ের ওপরে জড়িয়ে নিয়েছি বুঝতেই পারিনি।
বাইরে এখনও ভালো করে ভোর হয়নি বলে কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটালাম । ভালো লাগছে । ঠান্ডা গরমের আমেজ নিয়ে কখনও বেশ মজা লাগে। নাম ঘরের টুইতে পড়ে দুটো পেঁচা শব্দ করে চলেছে। পেঁচা রাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনে ডাকে। পেঁচার ডাক শুনে কত রাত হয়েছে বুঝতে পারা যায়। ভয়াল রাতকে পেঁচার ডাক আরও ভয়াল করে তোলে। এখন পেঁচাটা যেভাবে ডাকছে তাতে ভোর হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
দরজাটা খুলে দিলাম। বাইরের এক ঝাঁক ঠান্ডা বাতাস ভেতরে চলে এল। দিনে গরম থাকলেও ভোরের দিকে ঠান্ডা লাগে। আমি সোজাসুজি পুকুরের পারে গেলাম। হাতে টুথব্রাশ। পুকুর থেকে কিছুটা দূরে থাকা অস্থায়ী পায়খানাটা আমার নিত্যকর্মের জন্য উপযুক্ত স্থান। আমি সেটা ব্যবহার করার জন্য সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
সকালের দিকে পাখিদের পাড়া পড়শিতে হানা দেওয়ার জন্য যতটা সম্ভব কম সময়ের মধ্যে আমি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম। বাইনোকুলার এবং ক্যামেরাটা আমার নিজের সঙ্গী। দুটোই পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে আমি সোজাসুজি শিমুল গাছের নিচে যাওয়ার কথা ভাবলাম। কাল সেখানে দেখতে পাওয়া পাখির ঝাঁকটা দেখতে খুব ইচ্ছা হল । রাতে শিশির পড়েছে। জুতোয় শিশির লেগে আছে। খান থেকে বের হওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম।
হঠাৎ ঝোপের মধ্যে কিচির মিচির শব্দ শুনে আমি নিশ্চুপ হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটা শিয়াল ঝোপ থেকে কাচ্চা বাচ্চা সহ প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। শিয়ালটা আমাকে দেখেনি। আমি অত্যন্ত সন্তর্পনে দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাতেই বসে পড়লাম এবং ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে সুইচ অন করে একটা ভালো ছবির জন্য তৈরি হয়ে রইলাম । শিয়াল পরিবার ধীরে ধীরে আমার বিপরীত দিকে চলতে শুরু করেছে । ফুটফুটে বাচ্চাগুলি মায়ের পেছন পেছন খুনসুটি করতে করতে এগিয়ে যেতে দেখে মনটা প্রসন্ন হয়ে পড়ল। যাত্রার ভালো খারাপ বুঝতে না পারলেও শুরুটা আমার খারাপ মনে হল না।
ক্লিক ক্লিক করে আমি কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম।
শিয়াল কেনেডি গোত্রের মাংসাহারী প্রাণী। এই প্রজাতিটির নাম কেনিস আওরাস। আমাদের অতি পরিচিত প্রতিবেশী। এক সময়ে অসমের শহরে-নগরে এই প্রাণীটি বেশ সুলভ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওদের সংখ্যাও কমে এসেছে। ঝোপঝাড় কমে আসায় শিয়াল বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় আহারের উৎসও কমে এসেছে।
কিছুদূর এভাবে প্রাতঃভ্রমণ করার শেষে পথের বিপরীত দিকে থাকা ঝোপের মধ্যে শিয়াল পরিবারটা লুকিয়ে পড়ল। আমি এভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম যাতে তারা আমার উপস্থিতি অনুভব না করে। এখানে থাকার সময়টুকুতে এই প্রাণীগুলিকে যতটা সম্ভব আমার উপস্থিতি অনুভব করতে দেব না।
শিমুল গাছের নিচে এসে পরিবেশটা ভালো লাগল। মনটা পরিস্কার হয়ে গেল। আমি শুনতে পাচ্ছি জল-পাখির কিচিরমিচির শব্দ এবং দেখতে পাচ্ছি জলাশয়ের মাঝখানে ভাসতে থাকা কুয়াশার একটা মেজি। সূর্য দেবতা উঁকি দিতে এখনও অনেক সময় বাকি আছে। শিমুল গাছের নিচে শিশিরের একটা আস্তরণ পড়েছে। দন্ত্য-দ এর আকৃতি নিয়ে আমি শিমুল গাছে হেলান দিয়ে বসার চেষ্টা করলাম এবং ক্যামেরাটা ধরে জলাশয়ের মধ্যে ভাসতে থাকা কুয়াশার মেজিটার দুটো ছবি তুলে নিলাম।
ক্যামেরাটা সরিয়ে এবার আমি হাতে বাইনোকুলারটা তুলে নিলাম। আমার চোখের সামনে জলাশয়ের জলে এক ধরনের জলচর পাখির সমাবেশ। জলাশয়ের চারদিকে থাকা কচুরিপানা থেকে জলচর পাখিগুলির ঝাঁককে আলাদা করে চেনা যায় না।জলচর পাখিগুলির খয়েরি রং জলাশয়ের জলের ওপরে একটি কম্বল মেলে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমার কানে স্পষ্ট হয়ে বাজতে শুরু করেছে জলচর পাখির ছোট ছোট শিশ ধ্বনি। এই ধরনের পাখি কে ইংরেজিতে হুইশলিং ডাক বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম ডেন্ড্রোসিগনা জাভানিকা।
জলাশয়ের এক পারে একটা ঘাট। সেখানে হয়তো স্নান করা বা কাপড় ধোয়া ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করা হয়।পাথরের একটি টুকরো পড়ে থাকা থেকে এই ধরনের নাম হয়েছে। সেই জায়গার জলের ঘাটে একজোড়া চক্রবাক, রাডি শেলডাক, টাডোরা ফেরিণ্ডইনিয়া পাখি মহা আয়েস করে বসে আছে। পাখিটা দেখতে এ রকম লাগছে যেন গলাটা ছোট করে শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে বসে থাকা পাখিটা একটা ভাবুক মানুষ। চক্রবাক পাখি নাকি মনের মিল থাকা পতি পত্নীর মতো জোড়ায় থাকে । চক্রবাক পাখি জোড়ার এই মিল আমরা চক্রবাক পাখি দেখলেই দেখতে পাই । কিন্তু পাভ মাছের পাভ কোথাও দেখতে পাইনি, মানুষের মুখে কেবল শুনেছি। চক্রবাক আমাদের কাছে শীতকালের অতিথি পাখি।
অনেক সময় একভাবে থেকে পা দুটি ব্যথা করছে। পুব দিকের আকাশটা ক্রমশ হিঙ্গুল বর্ণ ধারণ করছে। কোমল আকাশের মুখে ধীরে ধীরে রোদ ছড়িয়ে পড়ছে।আমি শিমুল গাছের নিচ থেকে উঠে এলাম। ভাবলাম সম্পূর্ণ জায়গাটা একবার ভালো করে দেখে নেওয়া যেতে পারে। নদীর তীর পর্যন্ত একবার গিয়ে দেখি । নদীটি কত দূরে আছে আমি সঠিক অনুমান করতে পারলাম না ।
পাকা রাস্তাটা দিয়ে আমি এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলাম। ডান দিকে ছেড়ে এসেছি থানে যাওয়ার রাস্তাটা।
আমার মাথার ওপর দিয়ে একটি ছোট এরোপ্লেনের মতো একটি বক মাটিতে নামার ভঙ্গিমায় ডানা দুটি মেলে উড়ে যাচ্ছে ।সম্ভবত জলাশয়টার তীরে নামবে। বকটা দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। আমার মনে হল আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হবে। রাস্তার দু'পাশে গভীর জঙ্গল। ছোট বড় বিভিন্ন গাছ।
কিছুদুর যাবার পরেই আমি দেখতে পেলাম একটি পাকা সেতু। সেতু পর্যন্ত আমার হাঁটার গতি ধীরে ধীরে বাড়িয়ে দিলাম। এখানে পাগলা দিয়া নদীটি দেখতে অত্যন্ত মনোহর। অন্তত আমার ভালো লেগেছে। সেতু এবং নদীর জলের মধ্যে ব্যবধান সাধারণত দেখতে পাওয়া নদীসমূহের চেয়ে কিছুটা বেশি। নদীর দু'পারের পরিবেশ গাছপালায় পরিপূর্ণ। সবুজের ভিত অতিক্রম করে নদীটা এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল। সেতু দিয়ে নদীটা অতিক্রম করে ওপারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। নদীর এপারে বাঁধটা যত দূরে রয়েছে নদীর ওপারে কিন্তু বাঁধটা একেবারে কাছে।বাঁধ থেকে নদীর বুকে নেমে যাবার জন্য মানুষ আসা-যাওয়া করা একটা সংক্ষিপ্ত পথ দেখতে পেলাম। নদীর ওপারে যাওয়ার ইচ্ছা হল না। জায়গাটা আমার কাছে একেবারে অপরিচিত নয় বলে নয়, আসলে এত দৌড়াদৌড়ি ক্রার মতো আমার কিছু নেই। নদীর এপার সম্পর্কে আমার সাধারণ ধারণা কিছু আছে।
–'থানটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে নদী পর্যন্ত বনাঞ্চল।'
কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করায় পুরোহিত শর্মা গতকাল বলেছিলেন। তবে নদীটা কত দূরে আমি কিছুই ধারণা করতে পারছিলাম না।
সামনের দিকটায় থাকা সেতুর মাথাটা বেশ উঁচু এবং খাড়াই। ওপর থেকে নদীর তীরে বালি অংশ পর্যন্ত চল্লিশ ফুটের মতো মতো হবে। তবু আমি সেই জায়গা দিয়ে নিচে নেমে যাবার কথা ভেবে ছিলাম। গাছের একটা শিকড় ধরে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসার মতো আমি সাবধানে নিচে নেমে যাবার চেষ্টা করলাম। শিশিরে মাটি এবং গাছ পাতাগুলি পেছল হয়ে আছে। পিঠে ক্যামেরা এবং বাইনোকুলার দুটোই রয়েছে। আমাকে সাবধানে এগোতে হবে। একটু কষ্ট করে আমি সেতুর উপর থেকে ভূমি ভাগ পর্যন্ত নেমে আসতে সক্ষম হলাম। শুকনো গাছ পাতা বৃক্ষের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আমি নদীর বালুচরে পৌছালাম। সাধারণভাবে নদীর জল খুব বেশি গভীর নয়। সেতুর ওপর থেকে নদীর বুকে কোনো কোনো জায়গা আমি গাঢ় নীল দেখতে পেয়েছিলাম এবং অনুমান করেছিলাম সেই জায়গাগুলোতে জলের কিছু গভীরতা রয়েছে।
নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি একটা বাঁক ঘুরে থমকে দাঁড়ালাম এবং নিমেষের মধ্যে পিছিয়ে এলাম। গ্রামের বৌ-ঝিরা নদীর ঘাটে স্নান করছে। তারা আমাকে দেখতে পাওয়ার আগেই আমি অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করলাম। বাইনোকুলারটাকে চিনতে না পারলেও ক্যামেরাটাকে তারা চিনতে পারবে। ক্যামেরা হাতে মহিলাদের স্নানের ঘাটে অপরিচিত মানুষ দেখে চিৎকার চেচামেচি করলে সন্ধেবেলায় থানে কোনো সরকারি জায়গায় হয়তো আমার বিপক্ষে বিচার বসবে এবং হয়তো জরিমানাও ধার্য্য করা হতে পারে ।
অরণ্যের মাঝে মধ্যে হেঁটে আমি আমার সামনে দেখতে পেলাম অন্য একটি জলাশয়।আগের জলাশয়ের চেয়ে এই জলাশয়টি বড় এবং ভয়াল। এই জলাশয়টির তীর থেকেই জলের গভীরতা বেশি। সেই জন্য জলাশয়টিতে জলচর জাতীয় পাখির উপস্থিতি দেখা গেল না। শিমুল তীরের জলাশয়টির চারপাশ প্রায় মুক্ত হওয়ার বিপরীতে এই জলাশয়টির চারপাশে গভীর অরণ্য। ওই জলাশয়টি মানুষ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে, এই জলাশয় সম্পূর্ণ পাণ্ডববর্জিত। জলাশয়টির তীরে মানুষ আসা যাওয়ার করায় গাছপালা মরে সৃষ্ট হওয়া ছোটখাটো একটা পথও দেখতে পাওয়া গেল। গাছপালার অর্ধেকেরও কম অংশ মাটিতে আর আধার চেয়ে বেশি অংশ জলাশয়ের জলে ডুবে রয়েছে । মাটিতে থাকা অংশটিতে অনায়াসে বসতে পারা যায়। ক্যামেরা আর বাইনোকুলারটা খামচে ধরে বসে দেখলাম। বড় ভালো লাগল। আমার জন্য একটি প্রাকৃতিক চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে মনে হল। জায়গাটা থেকে জলাশয়টির চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়।সামনে একটি বাঁশ বন। বকের নিরাপদ আশ্রয়স্থল । অদূরে বেশ কয়েকটি উঁচু শিমুল গাছ । শিমুল গাছটিতে কোনো পাখির পুরোনো বাসা।
বাসাগুলি চিনতে আমার বিশেষ কোনো অসুবিধা হল না। হ্যাঁ সেগুলি বক পাখির বাসা। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাইনোকুলারটা নিয়ে আসতে হবে এবং গাছের নিচে গিয়ে ওদের বিষ্ঠা পরীক্ষা করতে হবে। যদি এগুলি বকের বাসা হয় তাহলে সকালবেলায় এবং সন্ধ্যেবেলা এখানে বক দেখতে পাওয়া যেতে লাগে। আমার মনের কোনো অংশ হঠাৎ উদ্বেল হয়ে পড়ল। এই গাছগুলির মধ্যে কোনো একটি থেকেই হয়তো আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিটা ওই জলাশয়ের অগভীর জলে আহারের খোঁজে গিয়েছে।
আমার ক্ষুধা পেয়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। দশটা বেজে গেছে। সময়টা এত সুন্দর ভাবে পার হয়ে যাচ্ছে যে আমি বুঝতেই পারিনি। থানটার অবস্থিতি অনুমান করে আমি এগিয়ে গেলাম। জঙ্গলের মাঝে মাঝে এসে আমি থানটিতে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তার কোনো এক অংশে এসে উপস্থিত হলাম।
বেশি ক্ষুধা পেয়েছে বলে পর্যটক নিবাসের নির্দিষ্ট ঘরটিতে ফিরে না গিয়ে সোজা সুজি বগলচ চকে যাওয়াই স্থির করলাম ।
•
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন