পাখিদের পাড়া পড়শী - ৬
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
Pankaj Gobinda Medhi
((ছয়)
নলবাড়ির বরকুরিহা গ্রামে যাবার জন্য আমি বেলতলা চৌরাস্তায় উইঙ্গারে উঠেছি। সকালের প্রথম গাড়ি। ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসটা সকাল পাঁচটার সময় পল্টন বাজার রেল স্টেশনে এসে পৌঁছেছে। সনাতন কলিতা আমাকে দেওয়া পরামর্শ অনুসারে আমি আদাবারির বাসস্ট্যান্ডে না গিয়ে বেলতলা চারালিতে এসেছি। নলবাড়িতে যাবার প্রথম গাড়িটা তখন ও যায়নি।
নলবাড়ি নলবাড়ি বলে চিৎকার করতে থাকা ছেলেটি আমাকে দূর থেকে জিজ্ঞাসা করছে–'দাদা কোথায় যাবেন? বগলছ চক বলতেই ছেলেটি আমাকে এক প্রকার ঠেলে নিয়ে যাবার উপক্রম হল ।
আমি পিঠ থেকে রুকসেকটা নামিয়ে ছেলেটি খুলে দেওয়া গাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম। ব্যাগটা আমাকে সাবধানে এই জন্যই রাখতে হয়েছিল যে তার ভেতরে ক্যামেরা এবং বাইনোকুলারটা ছিল। ছেলেটিকে আমি বলেছিলাম যে এরমধ্যে ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকা জিনিস রয়েছে, তাই সাবধানে রাখতে হবে।
– হবে দাদা হবে, তাই হবে।
ছেলেটি আমাকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে পেছনের সিটে বসিয়ে দিল। চারজন বসতে পারা সিটটাতে ইতিমধ্যে চারজন বসে পড়েছিল।
– পাঁচ জন বসতে হবে? ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
– এভাবেই মানুষ যাওয়া-আসা করছে, আপনিও পারবেন।
– পারতে তো হবেই। যেরকম দেশ সেরকম বেশ।
আরও চারজন যাত্রী না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি যাবে না। চারজন মানুষ আসবে বলে অপেক্ষা করে থাকা ছেলেটি চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে মাঝেমধ্যে নলবাড়ি নলবাড়ি বলে চিৎকার করে গাড়ির চালক এবং সহকারিরা দলবেঁধে আড্ডা মারতে থাকা জায়গাটিতে ফিরে আসে। হাসি ঠাট্টা, অশ্লীল এবং বিশ্রী কথাবার্তা। সকালবেলায় জনগণ চলাফেরা করা জায়গায় এত অশ্লীল এবং বিশ্রী কথা বার্তা বলতে পারে এরা। স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে ওদের পাশ দিয়ে অভিভাবকরা পার হয়ে যাচ্ছে। কারও প্রতিবাদ নেই, কেউ কোনো কথা বলছে না। নিজের বিপদ কেউ ডেকে আনতে চায় না।
চারজন মানুষকে গাড়ির ভেতরে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দেবার পরে উইঙ্গারটা চলতে শুরু করল। তবে এটা যাত্রী বহন করার গাড়ি নাকি শুয়োর বহন করা গাড়ি। দুজনের আসনে তিনজন, চারজনের আসনে পাঁচজন করে মানুষ বসিয়ে নিয়েছে। পা-টাকে এদিক-ওদিক করার উপায় নেই। অসমের কোনো শহর বা নগরে অভূতপূর্ব ঘটনা আমি এখানে দেখতে পাচ্ছি। যাত্রীরাও হয়তো এসবে অভ্যস্ত। সামনে-পেছনে করে কোনোমতে বসে নিশ্চুপ হয়ে যাত্রা করছে।
সময় তখন সকাল সাড়ে ছয়টা।
সনাতন কলিতার বক্তব্য অনুসারে এক ঘণ্টার মধ্যে আমি বগলছ চক পেয়ে যাব। কষ্ট করে হলেও এক ঘন্টা সময় অতিবাহিত করার মতো সক্ষমতা আমার রয়েছে। তবে যাত্রীদের সুবিধা অসুবিধার প্রতি পরিবহন বিভাগ এবং আরক্ষী বিভাগে অন্তত কিছুটা হলেও দরদ থাকা উচিত ছিল।
চল্লিশ টাকা ভাড়ার এই দুরত্বটুকু নির্দিষ্ট এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। রুকসেকটা নামিয়ে বগলছ চকটার চারপাশে একবার তাকালাম। বিভিন্ন দোকানের ওপরের ফলকনামায় বগলছ চক লেখা আছে। চকটিতে ইতিমধ্যে সারাদিনের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। গুয়াহাটি যাওয়া গাড়ি গুলি এসে অপেক্ষা করছে এবং গুয়াহাটি গুয়াহাটি বলে চিৎকার করে করে চলে যাচ্ছে। গুয়াহাটির দিক থেকে আসা দুই একটি গাড়ি নলবাড়ি নলবাড়ি, সার্থেবারি সার্থেবারি, পাঠশালা পাঠশালা বলে চিৎকার করতে করতে চলে যাচ্ছে। যাত্রীদের মধ্যে যারা উঠার উঠছে যারা নামার তারা নামছে।
আমার এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করল। গুয়াহাটি রেল স্টেশনেই খাব বলে ভেবেছিলাম, খাওয়া হল না। দ্রুত বেলতলা চৌরাস্তায় পৌঁছাতে হবে।
আমি' তুলিকা মিষ্টি ঘর' নামের চায়ের দোকানটির ভেতরে ঢুকে গেলাম। হাতে বহন করে নিয়ে যাওয়া ব্যাগটা আমি বসতে চাওয়া নির্দিষ্ট টেবিলের কাছে রাখলাম। দোকানের মালিক একান্তমনে সেদিনের খবরের কাগজ পড়ছে। একটি ছোট ছেলে খালি স্টিলের একটা গ্লাস ঠং করে আমার সামনের টেবিলে এনে রাখল এবং কাছেই থাকা জলের জাগটা ছেঁচড়ে এনে গ্লাসটার কাছে রেখে জিজ্ঞেস করল– দাদা,পুরি খাবেন।গরম গরম পুরি ।
আমি খুশি হলাম। এখনই গরম পুরি কয়েকটি খেয়ে নিলে সারাদিনের জন্য আর চিন্তা থাকবে না। খাবার কিছু পেলে পেলাম ,না পেলেও অসুবিধা নেই।
ছেলেটির তিনটি পুরি এবং একটা বাটিতে ধোঁয়া উড়তে থাকা বুট মসুর মিশ্রিত এক বাটি ডাল এনে আমার সামনে রাখল। পুনরায় ভেতরে গিয়ে ছেলেটি নতুন করে কাটা পেঁয়াজ দুই টুকরো এবং চারটে লঙ্কা এনে একটি প্লেটে করে আমার সামনে এগিয়ে দিল। গরম পুরিগুলি খেয়ে ভালো লাগল। ডালটারও একটা নতুন স্বাদ রয়েছে। ছেলেটি অন্য গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করার মধ্যেই এক হাতা ডাল আমার সামনের বাটিতে পুনরায় ঢেলে দিয়ে গেল।
–এই যে ভাই, আর ও দুটি পুরি দিও।
চ্যাংড়া ছেলে। বিদ্যুৎ গতিতে দুইটি পুরি এবং এক হাতা ডাল দিয়ে পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এই ধরনের স্মার্ট ছেলে মালিকের জন্য গৌরবের,পাশের দোকানের কাছে হিংসা এবং গ্রাহকের জন্য সুবিধার।
পুরি-ডাল আমার পেটের ক্ষুধা প্রশমিত করল। মনের ক্ষুধা দূর করার জন্য আমি ছেলেটিকে মালিক কেস গুলির সেলফে রেখে দেওয়া দৈনিক খবরের কাগজগুলি আনতে দিলাম। প্রতিদিন সকালবেলা দৈনিক খবরের কাগজটি আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। হত্যা, হিংসা, বলাৎকার, ডাকাতি, লুন্ঠন দুর্নীতির খবরের মধ্যে অসমের দুই চার জন মানুষ ব্যতিক্রমী কাজ করে থাকার খবর মনটিকে উৎফুল্লিত করে। এই ধরনের খবর চট করে প্রকাশ করা হয় না, তার মধ্যে যখন পাই তখনই ভালো লাগে, নিজেও কাজ করার জন্য উৎসাহিত হই।
পয়সা দেবার সময় আমি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম– বরকুরিয়া এখান থেকে কত দূরে।
– সামনেই। আপনি কোথায় যাবেন? কোনো অতিথির বাড়িতে?
আমি মাথা নাড়লাম। না না কোনো অতিথির বাড়িতে নয়–
– তাহলে?
– পাখি দেখতে এসেছি।
– ও তাই নাকি! অনেক পাখি আসে এখানে। বাঁদিকে সোজা যেতে থাকুন, পাঁচ মিনিটের রাস্তা।
মাথা নেড়ে দোকানিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রুকসেকটা পিঠে ঝুলিয়ে নিলাম এবং এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলাম, অনির্দিষ্ট লক্ষ্য পথের দিকে।
কিছুদূর হেঁটে এটা একটি গ্যাস এজেন্সি– ইণ্ডেনের ।
হাঁটতে ভালো লাগছে। দুই একজন পথিক এবং বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন আমার দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় ভাবছে পিঠে সংসারটা নিয়ে এই সকালবেলায় লোকটা কোথায় যাচ্ছে!
গঙ্গাপুখুরি বরকুরিহা হাইস্কুল পার হওয়ার পরে রাস্তাটা ক্রমশ উঁচু হয়ে একটা বাঁধের ওপরে উঠে গেছে।
দোকানির কথাই সঠিক। এতোটুকু আসতে আমার পাঁচ মিনিট সময় লেগেছে। রাস্তাটা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার অবাক হওয়ার পালা। রাস্তার বাঁ পাশে থাকা জলাশয়ে অজস্র পরিভ্রমী পাখি। এই পাখিদের বাসস্থানের কথা আমি আগে শুনিনি।সনাতন কলিতাও বলে নি। পাখির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আমাকে বরকুরিহা সম্পর্কে নূনতম তথ্য দিয়েছিলেন।
অতি সন্তর্পনে আমি রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে রুকসেকটা একপাশে রেখে একটা শিমুল গাছের নিচে বসেছিলাম। আমি একদৃষ্টে পাখিগুলির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আকাশে উড়ছে, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে জলে এবং জলের ঘাটে নেমে পড়ছে। আমার মনটা আনন্দে ভরে উঠল। আমি ভাবতে পারিনি আমি এমন একটি উপভোগ্য পরিবেশের সম্মুখীন হব।
বাইনোকুলার এবং ক্যামেরাটা বের করার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু সেই দুটি এত সাবধানে এর ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা আছে যে রুকসেকটা খুলে দুই একটি সামগ্রি বের না করে বাইনোকুলারটা বের করা সম্ভব নয়।
দূরে মুক্ত আকাশ। জলাশয় যেখানে শেষ হয়েছে তার ওপারে রাস্তাটা। গঙ্গাপুখুরি হাই স্কুলের পূবদিকের সীমানার রাস্তাটা এসে পাকা রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আমার ধারণা হল পাকা রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া এই কাঁচা রাস্তাটা সম্ভবত একটি বাঁধের অংশ। কেন না আমাকে বলা হয়েছিল যে একটু দূরে গেলেই আমি নদীটা পেয়ে যাব।
শামুক ভাঙ্গা পাখির ঠোঁটের কোট কোট শব্দ আমি ভালোভাবে শুনতে পাচ্ছি। আমি বসে থাকা শিমুল ডালের ওপরের দিকে তাকালাম। কয়েকটি শামুক ভাঙ্গা পাখি গাছের ডালে বসে আছে।
আমি সহজেই গাছটাতে মাথা রেখে দুই চোখ বন্ধ করে নিলাম। একটু ঘুম ঘুম ভাব ছিল বলে দুচোখ বুজে এল। কত সময় হবে পার হয়ে গেল আমি বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। পেটে পড়া পুরিগুলি ও আমার ঘুমের সহায়ক হল। পরিচিত কোনো বিকট শব্দ শুনে আমি জেগে গেলাম। রাস্তা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ করে একটি ট্রাক পার হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকটির এই বিকট শব্দ শুনে পাখির বিশাল ঝাঁকটা থেকে ছোট ছোট দুটি ঝাঁক আকাশে উড়ে গেল ।
এই জলাশয়টি আমার অনাগত দিন গুলি ভালোভাবে অতিক্রান্ত হতে সাহায্য করবে । উঁচু উঁচু শিমুল এবং কদম গাছ দেখতে পাচ্ছি যখন বক নিশ্চয় থাকতে পারে । ইতিমধ্যে এখানে বক থাকার ব্যাপারে আমি কিশোরের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়েছি।জায়গাটা আমার সত্যিই ভালো লাগল। এখানে দেশী-বিদেশী কত পাখি আছে তার একটি তালিকা করার আমি পরিকল্পনা করে ফেললাম।
রুকসেকটা নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম । ভাবলাম থাকার জায়গার সন্ধান করতে হবে । ব্যাগটা পিঠে বসিয়ে আমি পাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিছুটা এগিয়ে যাবার পরেই আমি তীর চিহ্ন দেওয়া একটি নামফলক দেখতে পেলাম । নাম ফলকে লেখা রয়েছে 'ভঙ্গুয়া গোঁসাইর থান'। তীর চিহ্ন দেওয়া সংকীর্ণ রাস্তাটা দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। রাস্তাটা দুদিক থেকে বেড়ে আসা পাতলা ধরনের জার্মান বন ঢেকে ফেলেছে। রাস্তার দু'পাশে ছাতিম, জরি,নাহর গাছ একটা দুটো এখানে সেখানে দেখা যাচ্ছে । তবে রাস্তাটা বেশ আঁকাবাঁকা।উঁচু-নিচু। জনসমাগম শূন্য। গভীর অরণ্য ।
রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে অনেকখানি খোলা জায়গা। আমার সামনে এটা একটি থান। থান এবং নামঘরটা চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের পুরোনো বলে মনে হয় । ঘরটা দেখলে এরকমই মনে হয়। তার কাছে উঁচু ভিটেতে অর্ধেক তৈরি অন্য একটি মন্দির। পুরোনো থানটি থেকে এই মন্দিরটি আকৃতিতে যথেষ্ট বড় এবং গম্ভীর।
আমি থানটির সামনে এগিয়ে গেলাম। থানটি, নতুন করে তৈরি হওয়া মন্দিরটির ওপাশে নতুন করে তৈরি একটি ঘর। বক্র রেখার মাথায় থাকার জন্য রাস্তা থেকে আমি এই ঘরটা দেখতে পাইনি।
ঘরটির সামনে–' পর্যটক নিবাস, অসম পর্যটন নিগম' বলে লেখা আছে। নামফলকটা দেখে আমি অতিশয় আনন্দিত হয়ে পড়লাম। অন্তত আমার থাকার সমস্যার সমাধান হওয়ার আশা আছে।
থানটিওর পরিসরে আমি কোথাও একজন ও মানুষ দেখতে পাইনি। আমি কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে পর্যটক নিবাসের বারান্দায় রেখে ক্ষণটির চারপাশে ভালো করে দেখতে লাগলাম। থানটির মূল দরজায় একটি তালা ঝুলে রয়েছে। নাম ঘরের অর্ধেক দেওয়াল ইট দিয়ে তৈরি। একটা শালিক পাখি ডানা নাচিয়ে নাচিয়ে বেড়ার ওপর দিয়ে স্যাৎ করে উড়ে চলে গেল। নাম ঘরের মেঝেটা কাঁচা। মূল মন্দিরের ঘরটা পাকা। বেড়ায় কোনো রং নেই। দরজাটা পুরোনো, কাঠের, আলকাতরা মাখানো। তালা মারার পরেও দরজাটা কিছুটা ফাঁক হয়ে থাকে। ফাঁক দিয়ে আমি ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। অন্ধকারের জন্য ভেতরে কী আছে সব দেখার আমার সৌভাগ্য হল না।
আমি থানটার পেছন দিকে এগিয়ে গেলাম। থানটার মূল মন্দিরটির গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে একটি ধুতরা এবং একটি জবা গাছ। লাল জবা ফুলগুলি জ্বলজ্বল করছে। বেশ কয়েকটি ধুতরা ফুল ঝুলে থাকতে দেখলাম। তার মাঝেমধ্যে দু'একটি পুষ্ট কালো গুটি গাছটাতে লেগে রয়েছে ।
মন্দিরের সামনে খোলা মাঠ । কেউ কেউ তাতে চাষ করে । এখন ছন পড়ে আছে। মাঠ যেখানে শেষ সেখানে অরণ্যের আরম্ভ। একটা টিয়া পাখি টিটি শব্দ করে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যাচ্ছে। এখানে সম্ভবত বনভোজ খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। একটি ছোট ফলকে লেখা রয়েছে–' বনভোজনের জন্য ব্যবহৃত থালা বাটি গ্লাস যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে ফেলবেন না।'
নতুন করে তৈরি করা মন্দিরটার দিকে এগিয়ে গেলাম। মন্দিরের গাঁথুনি এবং চালার ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়ে গেছে। ভেতরটা কেবল প্লাস্টার করা এবং দরজা-জানলা লাগানো বাকি আছে। মেঝের কাজও হয়নি। টুকরো ইট-বাঁশ, রশি- গুণা ইত্যাদি যেখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
নতুন করে তৈরি মন্দিরের কিছুটা দূরে একটা গভীর কুয়ো বসানো আছে। সেখানে একটি ফলক লাগানো হয়েছে।ফলকে লেখা রয়েছে–' বনভোজে আসা সদাশয় জনগণ এর জল ব্যবহার করতে পারবেন।'
কুয়ো থেকে কিছুটা দূরে একটা পুকুর। পুকুরটা খুব বেশি বড় নয়। জলের গভীরতাও খুব বেশি মনে হল না। পুকুরটির পারে একটি ফলক গাঁথা আছে। ফলকটিতে লেখা আছে –' পুকুরে নেমে বাসনপত্র ধোয়া এবং স্নান করা নিষেধ।' পুকুরের পারটি একেবারে শূন্য। কোনো গাছপালা নেই।
নির্জন ভয়াল থান চৌহদে ঘুরেফিরে আমি প্রায় একঘন্টা সময় অতিবাহিত করলাম । কোনো মানুষেরই আসার ইঙ্গিত পেলাম না । আমি খান থেকে পাকা রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়া ছোট সম্পূর্ণ রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ।
আমি দাঁড়িয়ে থাকার পিছন দিকটাতে , মন্দিরটার পুকুরের দিকে সাইকেলের বেলের শব্দ শুনতে পেলাম । বেল বাজায় নি। ঝাঁকুনিতে আপনা থেকে বেল বেজে উঠেছে। আমি ঘুরে তাকালাম। কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কেবল শব্দটা ক্রমশ আমার কাছে এগিয়ে আসছে। আমি শব্দটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। একজন আধবয়সী মানুষ মাঠের মাঝখান দিয়ে লোহা একটা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসছে। মানুষটার পরনে ধুতি। গায়ে গেঞ্জি। কাঁধে একটি জরাজীর্ণ গামছা। সাইকেলের হ্যান্ডেলে একটা বাজারের ব্যাগ ঝোলানো রয়েছে। ব্যাগটা থেকে হাতা ,খুন্তি বা হোমে জ্বলা কাঠ– কিছু একটা বেরিয়ে রয়েছে। আমি সঠিক দেখতে পাচ্ছি না।
মানুষটা সাইকেলটাকে পর্যটন নিবাসের বারান্দায় আলগোছে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা হাতে নিয়ে থানের দিকে এগিয়ে এল। আমার ব্যাগটা দেখতে পেয়ে সেটা সে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে কিছুটা পিছনে যাওয়ার মতো করে আমাকে দেখতে পেল। মানুষটার মনের ভেতরে জাগা শঙ্কা কিছু পরিমাণ দূর হওয়ায় আমার দিকে এগিয়ে এল।
– কাউকে খুঁজছেন? কাছে এগিয়ে আসা মানুষটা আমাকে জিজ্ঞেস করল।
– হ্যাঁ ।আপনাকেই খুঁজছিলাম।
মানুষটা বোধহয় আমি উপহাস করছি বলে ভাবল। মানুষটাকে কিছু সহজ করে তোলার জন্য আমি বললাম– বেড়াতে এসেছিলাম।
মানুষতো সাইকেল থেকে নামানো ব্যাগটা হাতে নিয়ে থানের দিকে এগিয়ে গেল এবং বলে গেল – এখানে অনেক মানুষ আসে, কিন্তু বেড়ানোর জন্য তো কেউ আসে না ।
– আপনি উজান অসমের মানুষ নাকি?
মানুষটার কথায় আমি মাথা নাড়লাম। জানিনা তিনি কী বুঝলেন। কোমরের খোঁচ থেকে একগুচ্ছ চাবি বের করে তিনি মন্দিরের তালা খুললেন এবং দরজাটা ভালোভাবে খুলে দিলেন। ভেতর থেকে একটা বালতি নিয়ে তিনি সোজা পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
আমি মানুষটার পেছন পেছন এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলাম। মানুষটার সঙ্গে দু'একটি কথা বলে পরিবেশটাকে আমি নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। তবে মানুষটা যথেষ্ট ব্যস্ততা দেখাতে লাগল।
– আমি– মানুষটা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন এবং পুনরায় বলতে শুরু করলেন– আজ আসতে অনেক দেরি হল। গতরাতে গাভিটা একটা বাচ্চা দিয়েছে। পুরোহিত আসার সময় হয়ে গেছে। মেঝেটা পরিষ্কার করা এবং বাসনপত্র ধোয়া না পেলে তিনি আমার সাত পুরুষ উদ্ধার করবেন। আমি এখন আসছি।
কথাটা বলেই মানুষটা দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন।
আমি থানের সামনে বকুল গাছের নিচে পড়ে থাকা পাথরটাতে বসে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মানুষটা পুরোহিতের সহায়ক। বালতিতে আনা জল তামার নির্মিত একটি ঘটির মধ্যে ছিটিয়ে তিনি মেঝেটি দ্রুত মুছে ফেললেন। তারপরে পুজোর জন্য ব্যবহার করা বাসনপত্র গুলি পুকুরে নিয়ে গিয়ে বালি দিয়ে মেজে চকচকে করে আনলেন। একটা বাঁশের ঝাড়ু দিয়ে নামঘরটা ঝাড়ু দিয়ে উঠে নামঘরের চারপাশটা ঝাড়ু দিতে শুরু করতেই আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পুরোহিত এসে উপস্থিত হলেন। আমি অনেকটা নিচু জায়গায় বসে থাকবার জন্য পুরোহিতকে আসছে দেখতে পাইনি।
পুরোহিতের পরনে ধুতি, গায়ে একটি নামাবলী। মাথার চুলের মাঝখানে একটি সাদা ফুল, কপালে চন্দনের ফোঁটা। মানুষটার ভুরি রয়েছে। গায়ের রং দুধে আলতা। মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে এলেন। তিনি সহায়ক রাখা জায়গায় সাইকেলটা না রেখে নাম ঘরের বেড়ায় হেলান দিয়ে রেখে সোজাসুজি পুকুরের দিকে চলে গেলেন। তিনি সেখানে মুখ হাত ধুয়ে কোমরে জড়িয়ে নেওয়া গামছাটা বের করে তা দিয়ে মুখ হাত মুছে আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
আমি পুরোহিতকে নমস্কার জানালাম এবং তাকে আকৃষ্ট করার জন্য আমার ডান হাতটা তাঁর পায়ের দিকে এগিয়ে দিলাম। এটাই আমাদের সাংস্কৃতিক পরম্পরা। জানিনা ধর্মীয় পরম্পরা কিনা। পুরোহিত বিড়বিড় করে আমার অপরিচিত একটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতে লাগলেন। নিশ্চয়ই আমার কুশল কামনা করছেন এবং অভিষ্ট সিদ্ধ হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন।
আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা বের করতে যেতেই তিনি বললেন– উহু উহু। আমি কখনও বিনিময় ছাড়াও মানুষকে আশীর্বাদ দিই, শুভকামনা জানাই।
পুরোহিতের প্রতি ভক্তিতে আমার মাথা নত হয়ে এল। একজন পুরোহিত হিসেবে নয় একজন ভালো মানুষ হিসেবে।
পুরোহিতও আমার প্রতি যথেষ্ট সুপ্রসন্ন হলেন। হয়তো চরণ স্পর্শ করায় আমার প্রয়াস কাজে লেগেছে। কম সময়ের মধ্যে নিজের অজান্তে আমরা বন্ধু হয়ে পড়লাম। আমি এখানে আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলার সঙ্গে খুব কম সময়ের মধ্যে তার পরিবারের খবরা খবর নিলাম এবং তিনি নিজের গৌরবান্বিত অতীতের গাথা বর্ণনা করতে লাগলেন। কামাখ্যা মন্দিরের কয়েকজন পুরোহিত, ধুবড়ির মা-মহামায়া মন্দিরের পুরোহিতরা তারই পরিবারের বলে প্রকাশ করে গৌরব অনুভব করলেন ।
আমার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করায় আমি মানুষটাকে কিছুই বলতে পারলাম না।
– আপনার বোধহয় পূজার সময় হয়ে গেছে?
আমার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করায় বিষয় পরিবর্তন করার জন্য আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
– হ্যাঁ ,পুজোর সময় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই লোকজনে ভর্তি হয়ে যাবে।
ব্যস্ততা দেখিয়ে পুরোহিত মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি দ্রুত পুজোয় বসে পড়লেন।
কিছুক্ষণ পরেই ধুপ এবং পোড়া মিঠা তেলের সুগন্ধ এসে আমার নাকে লাগল। আমি তখন ও পাথরের ওপর বসে ছিলাম।
মায়ের কথা মনে পড়ল। মা পূজো করত কি করত না সে কথা আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।
•
•
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন