পাখিদের পাড়া পড়শী - ৫
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
Pankaj Gobinda Medhi
(পাঁচ)
সৌম্যদা আমাকে নামচাঙে নিয়ে যাবার পর থেকে অরণ্যের প্রতি আমার নতুন করে ভালোবাসা এবং আগ্রহ জাগল।
রাতের বেলা স্বপ্নেও আমি অরণ্যের মধ্যে আছি বলে মনে হতে লাগল।
মাঝখানে একদিন সৌম্যদাকে ফোন করে বললাম– কোথাও কোনো পাখি নিরীক্ষণ শিবির বা কোন ক্যাম্প আদি শিবিরের আয়োজন করা হলে আমাকে জানাবেন। বন্ধের সঙ্গে মিলিয়ে ক্যাম্পের আয়োজন হলে ভালো। দুই একদিনের জন্য হলে ছুটিও নিতে পারা যায়।
সৌম্যদা আমাকে আশ্বাস দিলেন।
এভাবে আমি একবার কাজিরাঙ্গায়,একবার মানসে, আরও একবার অভয়ারণ্যের শিবিরে অংশগ্রহণ করলাম। এই শিবিরগুলিতে আমার অংশগ্রহণ আমার জন্য অরণ্য বিষয়ক ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের সহায়ক হল। ফলে আমি বিভিন্ন পাখি গাছ এবং জীবজন্তুর সম্যক জ্ঞান এবং সেই সমস্ত সনাক্ত করতে সক্ষম হলাম। শিবিরে গেলে পাখির বেশ কিছু আলোকচিত্র সঙ্গে নিয়ে যাই। সামনে দেখতে পাওয়া পাখিগুলি আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করি। সেই মতে পাখিগুলির নাম মুখস্থ করে নিই। চট করে মনে পড়ে না। নাম গুলি কেমন যেন চাইনিজ চাইনিজ বলে মনে হয়। এরকম মনে হয় প্রতিটি পাখির নাম একই। তাতে আবার অসমের বিভিন্ন স্থানে পাখিগুলির স্থানীয় নাম ভিন্ন। ইংরেজি নাম মুখস্থ না করলে স্থানীয় নাম দিয়ে পাখি সনাক্ত করা অসুবিধাজনক।
এখন আমি ইগ্রেট এবং হেরণের মধ্যে বৈসাদৃশ্য জানতে পেরেছি। সাধারণভাবে দেখতে পাওয়া পাখিগুলির ইংরেজি নামগুলি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক নাম মনে রাখার আমার বিশেষ প্রয়োজন নেই, কেননা আমি কোনো সেই ধরনের গবেষক নই। ছোট আকারের পাখিগুলি আমাকে প্রায়ই খুব অসুবিধায় ফেলে। স্ট্রায়েটেড গ্ৰাসবার্ড এবং মার্শ বেবলারের মধ্যে পার্থক্য বের করাটা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। স্মল নিলটায়া এবং লার্জ নিলটায়ার কোনটি ছোট ছিল কোনটি বড় মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সবকিছু উপেক্ষা করে আমি আমার পাখির চর্চা অব্যাহত রেখেছি।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পাখির প্রেমে পড়েছি। কোন পাখির রং এবং কোনো পাখির ডাক – প্রকৃতির কী মনোরম সৃষ্টি।
শৈশবে ছাত্রাবাসে থাকাকালীন বিছানায় গড়িয়ে দুপুরের মুক্ত আকাশের দিকে তাকানোর সময় চোখে পড়েছিল আকাশে চক্রাকারে উড়ে বেড়ানো শকুন, চিল এবং হাড়গিলাদের । তখন এই পাখিগুলি বিষয়ে খুব একটা জানতাম না। শকুনের মৃতদেহ খাওয়া দেখার দু'একটি দৃশ্য আমার মনে আছে ।ওদের খাবার পদ্ধতিও ছিল আলাদা।
– ওদের নির্বাচিত রাজা শকুন না আসা পর্যন্ত খাবারে মুখ দিত না। সমবয়সীদের মধ্যে কেউ একজন বলেছিল।
একটি মৃত গরুর চারপাশে একান্ত ভাবে বসে থাকা শকুনের দলটিকে দেখে সমবয়সীর কথা বিশ্বাস করেছিলাম। রাজা শকুনটির আসার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে রাজা শকুনটি এসেছিল। দীর্ঘ একটা ছোঁ মেরে আকাশ থেকে শব্দ করে নেমে এসেছিল রাজা শকুনটা। পাখা দুটো বিস্তারিত ভাবে মেলে দিয়ে শূন্যেই ছেঁচড়ে নেমে এসেছিল ,আমাদের বিদ্যালয়ে ছেঁচড়ে নেমে আসার জন্য তৈরি করা ঢালু খেলনাটিত আমরা উপর থেকে নিচে ছেঁচড়ে নেমে আসার মতো। ডানা দুটি বিস্তৃতভাবে মেলে দেওয়ায় ডানার ফাঁক ফোকরগুলি আমাদের চোখে পড়েছিল। মৃত গরুটির কিছু দূরে এসে পড়া রাজা শকুনটি লাফিয়ে লাফিয়ে মৃত দেহটার কাছে চলে এসেছিল। তারপর শুরু করেছিল খুঁটতে।
– রাজা শকুনের ঠোঁটে গরুর চামড়া ফালা ফালা করার জন্য ছুরির মতো ধার থাকে।
আমাদের মধ্যের কোনো একজন সমবয়সী তখন বলা কথা এখন অবশ্য বিশ্বাস করিনা।
মাঠের জলাশয়ে অপেক্ষা করে থাকা বক এবং হাড়গিলাগুলি সম্পর্কে আমাদের বেশ কৌতূহল ছিল। ঝপাং ঝপাং শব্দে ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছ শামুকগুলি মুখের ভেতরে ভরছিল। কখনও কখনও শকুনের খাবারের অবশিষ্টাংশ পাওয়ার জন্য শকুনের ঝাঁক থেকে কিছুটা দূরে বিমর্ষ মনে অপেক্ষা করে থাকা বক গুলিকে শকুনের তাড়িয়ে দেওয়াও দেখেছিলাম। তখন বক এবং হাড়গিলার মধ্যে পার্থক্য জানার কোনো প্রয়োজন বোধ করিনি। আমাদের সঙ্গের দু'একজন বক বা হাড়গিলাকে উড়িয়ে দিয়ে বেশ মজা পেত। ডানা দুটি মেলে এরোপ্লেনের মতো উড়ে যাওয়া দেখার জন্য ওরা এরকম করত। এই সমস্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে হত। এই ক্ষেত্রে আমি আরও বেশি ব্যতিক্রম ছিলাম বলে আমাকে সঙ্গে নিত না। কদাচিৎ ঘটনাক্রমে আমি ওদের সঙ্গে গিয়ে শকুন, বকের সঙ্গ লাভ করেছিলাম।
কথাগুলি আজ গল্পের মতো মনে হয়।
বক দুই-একটি দেখা গেলেও মানুষের বসতির মধ্যে শকুন প্রায় নাই হয়ে গেল।
– পশুধনের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা বিষ নাশক ডাইক্লফেনেক সোডিয়ামের অপরিমিত ব্যবহারই শকুনের জন্য কাল হল।ডাইক্লফেনেক সোডিয়াম প্রয়োগ করা জন্তুর শব খাবার ফলে শকুনের দেহে পার্শ্বক্রিয়া ঘটে। মৃত শকুনের পোস্টমর্টেম করলে পাকস্থলীতে ঘা জাতীয় কিছু বুদবুদ বের হতে দেখা যায়।
সৌম্যদা বলেছিলেন।
আমি শকুনের অবলুপ্তির কারণ জানতাম না। ভেবেছিলাম প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতাই শকুনের অবলুপ্তির মূল কারণ। মনে পড়ে যেতেই আমি বক এবং হাড়গিলার কথা সৌম্যদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
–পাখি এক ধরনের, প্রজাতি দুটো। বক হল গ্রেটার এডজুভেন্ট স্টর্ক এবং হাড়গিলা হল লেসার এডজুভেন্ট স্টর্ক। দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দেখলেই বোঝা যায়। বক আকৃতিতে বড় এবং হাড়গিলা তুলনামূলকভাবে ছোট।
– দুটো প্রজাতিকেই আমি ভালোভাবে জানি। কিন্তু এদেরও যে বংশ হ্রাস পাচ্ছে?
–বক এবং হাড়গিলাও মাংস খায়। তাই ডাইক্লফেনেক সোডিয়ামের কথা এদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাছাড়া কীটনাশক ঔষধ এবং রাসায়নিক সারের প্রভাব পড়েছে এই দুই ধরনের পাখি দুটির প্রজাতি ওপরে। অস্তিত্বের সংকট হলেও পাখিগুলি অসমের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়। শকুনের সংরক্ষণ এবং প্রজননের জন্য বিভিন্ন মানুষ কিছু কাজ করছে। কিন্তু বকের ওপরে সেভাবে কাজ হয়নি।
– অসমের কোন কোন জায়গায় আছে তার জরিপ হয়েছে কি?
– হয়েছে।
– এই বিষয়ে জানার জন্য–
বকের বিষয়ে জানার জন্য আমি কিছুটা উদগ্রীব হয়ে পড়লাম। কেন জানি সৌম্যদার সঙ্গে পাখিদের বসতিতে ঘুরে বেড়ানোর সময় বকের কথা আমার খুব বেশি করে মনে পড়ত। লাফিয়ে লাফিয়ে চলা এই পাখিগুলি বড় গভীর ধরনের। খাবারের ধরণ, মাটিতে পড়া এবং উঠার সময় পাখিগুলি উড়ার প্রক্রিয়া আমার ভালো লেগেছিল। বকের বিলুপ্ত হওয়া আমার কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাখিগুলোর বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানতে চেয়েছিলাম।
– এই বিষয়ে জানার জন্য তুমি কিশোর কুমার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে পার। পাখিগুলোর বিষয়ে তিনি ১০ দিনের একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সৌম্যদার কাছ থেকে কুমার চৌধুরীর ফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করে আমি তার সঙ্গে, তিনি চাকরি করা ডিব্রুগড়ের সরকারি কার্যালয়ে দেখা করেছিলাম।
কিশোর কুমার চৌধুরীর বয়স দুকুড়ির কাছাকাছি হবে। মেপে জোকে কথা বলেন। দেখতে ছোটখাটো মানুষটা হালকা গড়নের। সামান্য ফর্সা। মুখে অনবরত একটা হাসি লেগে আছে। বয়সে আমার চেয়ে দুই তিন বছরের ছোট হতে পারে বা সমবয়সী ও হতে পারে।
সৌম্যদার সূত্র ধরে আমি মানুষটার সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমার অন্য কোনো পরিচয় দিতে হয়নি। কেবল বলেছিলাম স্টেট ব্যাংকে চাকরি করি।সৌম্যদার প্রভাবে পড়ে সুযোগ পেলেই পাখিদের বসতিতে ঘুরে বেড়াই।
কিশোর কুমার চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল– আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি।
– আপনি আমাকে অসমের বকদের বিষয়ে কিছু বলুন। পাখিগুলি সম্পর্কে আপনার হাতে যদি কিছু তথ্যাদি থেকে থাকে অনুগ্রহ করে আমাকে দিন।
কিশোর কুমার চৌধুরী হাসিমুখে আমাকে সমস্ত রকম সাহায্য করার আশ্বাস দিলেন।
বললেন– আপনার ঠিকানাটা দিন। মোবাইল নাম্বার, ই-মেইল এবং পোস্টাল অ্যাড্রেস।
কিশোর কুমার চৌধুরীকে তাঁর নির্দেশ অনুসারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য মোবাইল নাম্বার, ই-মেইল এবং ডাক ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে দিলাম।
– দুই-একদিনের মধ্যে আপনি আমার হাতে থাকা তথ্যাদি পেয়ে যাবেন।
আমি পুলকিত মনে কিশোর কুমার চৌধুরীর কাছ থেকে ফিরে এলাম।
সত্যিই কথা অনুসারে কিশোর কুমার চৌধুরী আমাকে বক সম্পর্কীয় বিভিন্ন তথ্যাদি প্রেরণ করলেন। তার ভেতরে তিনি অসমের একটি মানচিত্র পাঠিয়েছেন, যেখানে লাল চিহ্ন দিয়ে অসমের কোথায় কোথায় বক পাওয়া যায় তার উল্লেখ রয়েছে। মানচিত্রের নিচের দিকে ক্রমিক নম্বরের সঙ্গে জায়গাগুলির নাম লেখা আছে। তিনি পাঠানো তথ্য গুলি আমার খুব কাজে লাগল।
অরণ্য বিষয়ে অধ্যয়ন করার আগে ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজ করে এসে রাতের দিকে আমার ক্লান্ত লাগত এবং বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখে সময় কাটাতাম। এভাবেই আমার ঘুম এসে যেত।
আজকাল আমার ক্লান্তি বোধ হয় না। বিভাগীয় কাজ গুলি শেষ করে এসে আমি দ্বিগুণ উৎসাহে অরণ্য অধ্যয়নে লেগে যাই। বককে বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়ার পরে আমি কখনও সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। সাতটার সময় আমি ব্যাংক থেকে যাবতীয় কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসতে পারি। তারপরে একঘন্টা সময় বাজার-টাজার করা ইত্যাদি ছোট-বড় কাজে অতিক্রান্ত হয়ে যায়। আটটার সময় আমি পাখি বিষয়ক বইপত্র গুলি বের করে নিই।
ডঃ ক্রিস্টোফার পেরিনসরের ' বার্ড লাইফ' বইটিতে পাখির বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারি। অ্যাড ক্যামেরুন বিভিন্ন পাখির ঠোঁট, ডানা, ঠেং ইত্যাদি সুন্দর করে অঙ্কন করে পার্থক্য গুলি বুঝিয়ে দিতে প্রয়াস করেছেন। পাখির কুজন, প্রজনন, ডিম, বাচ্চা, বাচ্চাকে আহার খাওয়ানো ইত্যাদি ব্যবহারিকভাবে চিত্রের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করেছেন। বইটি পড়ে থাকার সময় আমি পাখির মধ্যে হারিয়ে যাই।
সেলিম আলি ভারতীয় পাখির বর্ণনা করেছেন তাঁর ' দ্য বুক অন ইন্ডিয়ান বার্ডস' গ্রন্থটিতে। গ্রন্থটির মাধ্যমে ভারতে সচরাচর দেখতে পাওয়া পাখিগুলির সঙ্গে পরিচয় করা যায়। গ্রন্থটি আমাকে পাখিদের মধ্যে নিয়ে গেছে।
সৌম্যদ্বীপ দত্তের' অসমের চরাই পর্যবেক্ষণের হাত পুথি' আমার কাছে একটি সর্বক্ষণের সঙ্গী বই।এই বইটিতে বক সম্পর্কিত আমার প্রয়োজনীয় কোনো তথ্যাদি না পেলেও কিশোর কুমার চৌধুরী দেওয়া তথ্যাদি আমার কাছে যথেষ্ট ছিল।
বকের আশ্রয়স্থল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে বকের পেছন পেছন ঘুরতে আমার খুব ইচ্ছা করছে। বক কীভাবে ঘর তৈরি করে, কীভাবে প্রজনন করে, শাবকদের কীভাবে বড় করে, গাছের নিচে বসে বসে পাখিদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা উপভোগ করার ইচ্ছা রয়েছে। তার জন্য আমাকে দুর্গাপূজা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেই সময়ে আমি অর্জিত ছুটি নিতে পারব।তার আগে আমাকে নির্দিষ্ট করে নিতে হবে, কোথায় গেলে আমার সুবিধা হবে। অনেকদিন আমি গুয়াহাটিতে যাইনি। গুয়াহাটিতে দুদিন থাকার ইচ্ছা আছে। মহানগরের কোলাহলের মধ্যে দুদিনই যথেষ্ট। সাধারণত দুদিন গুয়াহাটিতে থাকলেই তারপর থেকে আমি বিরক্তি অনুভব করতে থাকি। অরণ্যের মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা হওয়ার পরে যান্ত্রিকতার যন্ত্রণা, নাগরিকের অহৈতুক ব্যস্ততা, প্রাপ্তির জন্য অযথা হাহাকার করতে দেখে মানুষগুলির প্রতি আমার করুণা জন্মাতে থেকে ।
কিশোর আমাকে দেওয়া অসমের মানচিত্রটির লাল দাগ গুলির ওপরে আবার চোখ বুলাতে লাগলাম। অসমের সব জায়গায় বক পাওয়া যায় না দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ আমার পাগলাদিয়া তীরের এই নির্দিষ্ট জায়গাটায় চোখ পড়ল। গুয়াহাটি থেকে বেশি দূরে নয় এবং পাগলাদিয়া নদীর তীরে। মানচিত্রের নিচে লেখা টীকা থেকে জায়গাটার নাম আমি জানতে পারলাম–বরকুরিহা। নলবারী জেলার অন্তর্গত।
বরকুরিহা– আমার নামটা ভালো লাগল এবং আমি পূজার সময় বরকুরিহা যাওয়াটা স্থির করে নিলাম।
জায়গাটা সম্পর্কে খবরা-খবর নিয়ে জানতে পারলাম বরকুরিহা কোনো বনাঞ্চল বা কোনো অরণ্য অঞ্চল নয়। একটি গ্রাম। আশির দশকের প্রথম ভাগে নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় মূল পাগলাদিয়া নদী মরা নদীটির মধ্যের এক বিস্তৃত অঞ্চল অরণ্যভূমিতে পরিবর্তিত হয়েছে। কথাটা বলেছিল আমাদের ব্যাংকের শাখাতেই কাজ করা নলবারীর সমীরণ কলিতা। জায়গাটার বিষয়ে বিস্তৃতভাবে কলিতা বলতে সমর্থ হল না। তিনি ততটুকুই জানেন ।
– মানুষগুলি কেমন ?
– সমস্ত মানুষ একই। আপনি ভালো তো জগৎ ভালো। আপনি যেভাবে তাদের নেবেন তারাও ঠিক সেভাবে আপনাকে নেবে।
– না না। আমি সেটা জিজ্ঞেস করিনি। মানুষগুলির আর্থিক অবস্থা কেমন?
আমার কথাটি উল্টো অর্থ করার জন্য সমীরণ কলিতাকে আমি সেভাবেই বললাম।
– অসমের কোথায় কার ভালো অবস্থা। প্রতিটি গ্রামই একই রকম। দুই চার জনের অবস্থা ভালো, বাকিদের তথৈবচ।
বরকুরিহার একটা সম্যক ছবি মনের মধ্যে এঁকে নিয়ে অক্টোবর মাস পর্যন্ত অধীরভাবে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।
সৌম্যদাকে ছাড়া এবার আমি অরণ্যে একা থাকতে যাব। অরণ্য নয় বনাঞ্চলে। শিবিরের আয়োজন করব। পাখি দেখব। রোদ বাতাস বৃষ্টির মায়াময় খেলা দেখব। পাশেই থাকা গ্রামটিতে যাব। মানুষগুলির সুখ-দুঃখের সমভাগী হওয়ার চেষ্টা করব। ছেলেমেয়েদের প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য উৎসাহিত করব। আর মনের মধ্যে রয়েছে অনেক জল্পনা-কল্পনা।
কে বলবে আমি নিঃসঙ্গ। জীবনের নিঃসঙ্গতা ছাড়াও যা পেয়েছি সেটাই তো–
আমার মনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া উৎসাহের নদীতে অলেখ অজস্র ঢেউ উঠেছে এবং ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যেতে থাকা ঢেউগুলিকে নতুন নতুন ঢেউ এসে গ্রাস করে চলেছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন