বিদেহ নন্দিনী~ ৩৭
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(৩৭)
কুম্ভকর্ণকে বধ করার পর থেকে পাহারা দেওয়া রাক্ষসীরা একেবারে নিরীহ প্রাণীর মতো ব্যবহার করতে লাগল। আমার মন ভালো না থাকলে ওদের বিচার হতে পারে বলে ধরে নিয়ে আমাকে মিষ্টি ভাবে সম্ভাষণ জানাতে লাগল। কেউ কেউ বলেছিল আমাদের কোনো দোষ নেই। আমরা রাজার আদেশ পালন করছি মাত্র। রাজার নুন খেয়েছি যখন তার কথা শুনতেই হবে। তাই আমি ওদের আচার-ব্যবহার থেকেই কোন দিন কার জয় কার পরাজয় অনুমান করতে পেরেছিলাম ।ওদের মধ্যে কথাবার্তা শুনে জানতে পেরেছিলাম যে ভাই কুম্ভকর্ণের মৃত্যুতে রাবণ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।শোক সম্বরণ করতে না পেরে লঙ্কেশ্বর নাকি শোকে দুঃখে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। নিজের পিতাকে শোক এবং হতাশায় ভেঙ্গে পড়তে দেখে ত্রিশরা,দেবান্তক,নরান্তক এবং অতিকায় নামে রাবণের চার পুত্র রামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। চারজনই নাকি অনেক বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুকে বরণ করে।
একদিন হঠাৎ পাহারা দেওয়া রাক্ষসরা আমাকে আবার আগের মতো কটু বচন শোনাতে লাগল। আমি ওদের ব্যবহারে অবাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেলাম। কে জানে রাম বাহিনীতে কোনো সংকট দেখা দিয়েছে কিনা? তা নাহলে ওরা পুনরায় কেন এ ধরনের ব্যবহার করবে? এদিকে রণক্ষেত্রের কোনো খবর পাচ্ছি না। সাধারণত ত্রিজটা ঘনঘন আসে। কিন্তু এই কয়েকদিন ত্রিজটা আসেনি।রাবণের চার পুত্রের একদিনেই মৃত্যু হওয়ায় রাজার পত্নীদের মধ্যে হাহাকার লেগেছে। বিশেষ করে পুত্র অতিকাইর মৃত্যু সংবাদে রাবণের পত্নী ধন্যমালিনী নাকি পাগলের মতো হয়ে পড়েছে। তাই যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ জানাটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই মনটা শক্ত করে রাম বাহিনীর মঙ্গলের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম।
পরেরদিন বিকেলের দিকে বিভীষণের পত্নী সরমা উপস্থিত হল। আমি তার কাছ থেকে সমস্ত কিছু জানতে পারলাম। সরমা দ্রুত কথাগুলি বলে গেল -'জনক নন্দিনী, রাম বাহিনীতে বড় বিঘ্ন ঘটে গেল। তুমি সেসব কিছুই জান না ।না জানায় ভালোই হয়েছে ।আমি জানতে পেরে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। সারারাত ছটফট করে কাটিয়েছি ।আজ সকালে পতি বিভীষণের গোপন সংবাদ পাওয়ার পর মনে আশা জেগেছে। কথাটা বলে সরমা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। আমি রাম বাহিনীতে কী বিঘ্ন ঘটেছিল জানার জন্য ব্যগ্ৰ হয়ে পড়লাম।সরমার দুই হাত আঁকড়ে ধরে বললাম-' হে মাতা, স্বামী রামচন্দ্রের সেনাবাহিনীতে কী ঘটেছিল আমাকে খুলে বল। আমি প্রহরীদের ব্যবহারে এক ধরনের অমঙ্গলের আভাস পেয়েছিলাম। সরমা বলল-' পুত্র, ভ্রাতাকে হারিয়ে শোকে অধীর হয়ে পড়া রাবণকে আশ্বাস দিল রাবণ মন্দোদরীর পুত্র মেঘনাদ অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ ।ইন্দ্রজিৎকে যুদ্ধে যেতে দেখে রাবণ পুনরায় উৎসাহিত হয়ে পড়েছিল। ইন্দ্রজিৎ নিজে অদৃশ্য হয়ে থেকে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে একদিক থেকে বাঁদর সেনা ধ্বংস করে যেতে লাগল। সুগ্রীব, হনুমান, নীল, নল,জাম্ববন্তকে ধরে প্রত্যেকে বীর আহত হয়ে পড়ল। এমনকি তোমার স্বামী রামচন্দ্র এবং দেবর লক্ষ্মণ ও সেই বাণে বিদ্ধ হল। ইন্দ্রজিৎ অদৃশ্য হয়ে থাকার ফলে এই দুই মহাবীর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই একটা সময়ে দুজনেই রণক্ষেত্রে ঢলে পড়ল। রাম বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে শেষ করে ইন্দ্রজিৎ বীরদর্পে লঙ্কায় ফিরে এল। অনেকদিন পরে রাবণের মুখেও হাসি ফুটল। এদিকে বাহিনীতে কেবল আমার পতি বিভীষণ সুস্থির অবস্থায় ছিলেন। হনুমান আঘাত পেয়েছিল যদিও সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এসেছিল। দুজনেই পড়ে থাকা বীরদের মধ্যে চিৎকার করে করে উৎসাহজনক বাক্যে দেহে প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিল। তারা বলছিল-' হে বীর সকল, ভয় পেয়ো না ।তোমাদের কার ও মৃত্যু হয়নি ।রাম লক্ষ্মণের ও মৃত্যু হয়নি ।দুজনেই ব্রহ্মদেবের প্রতি সম্মান জানিয়ে অস্ত্র পরিহার করে ইন্দ্রজিতের বাণ সহ্য করে মাত্র মূর্ছিত হয়ে পড়েছে। কথাটা বলে সরমা কিছুক্ষণের জন্য চোখ দুটি বন্ধ করে স্থির হয়ে রইল। তারপর পুনরায় বলতে শুরু করল-' আমার পতি বিভীষণ জেনেছিল যে ব্রহ্মাস্ত্র সক্রিয় হয়ে থাকে মাত্র পাঁচ প্রহর। যাদের দেহে তখনও পর্যন্ত প্রাণ থাকে তাদের সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলার জন্য এক বিশেষ ওষুধের প্রয়োজন ।সেই ঔষধের বিষয়ে জানে একমাত্র বৃদ্ধ ভালুক জাম্ববন্ত। এদিকে জাম্ববন্ত ও রণে আহত হয়ে পড়ল। তার দেহে তখন ও প্রাণ আছে না নেই জানার কোনো উপায় নেই। কারণ সত্তরকোটি বাঁদর ভালুক পড়ে থাকা জায়গায় জাম্ববন্তকে খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। দুজনে হাতে মশাল নিয়ে জাম্ববানকে খুঁজতে শুরু করল। একবার স্বামী বিভীষণ হঠাৎ জাম্ববান্তকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জাম্ববান্তের কানের কাছে চিৎকার করতে লাগল-' হে প্রভু, আপনার দেহে প্রাণ আছে কি ?জাম্ববন্ত নাকি বড় কষ্টে বলে উঠল-' দয়ালু বিভীষণ, আমাদের পবনপুত্র হনুমান কুশলে আছে তো ?আমার পতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-' হে বীর ,এতগুলি বীর , মহা বীরের বিষয়ে জিজ্ঞেস না করে আপনি কেবল পবনপুত্র বিষয়ে কেন জিজ্ঞেস করলেন ?'
জাম্ববন্ত নাকি তখন বললেন-' তিনি কুশলে থাকলে বাকি সবাই প্রাণ পেয়ে উঠবে। কথাটা শুনে হনুমান জাম্ববন্তের পা'দুটি ধরে প্রণাম জানিয়ে বলল-' আমি কুশলে আছি প্রভু। আমাকে আদেশ দিন আমি কী করতে পারি।' জাম্ববন্ত তখন হনুমানকে মহা সমুদ্র পার হয়ে সুদীর্ঘ আকাশ পথ অতিক্রম করে হিমালয় যেতে বললেন। সেখানে গেলে ঋষভ এবং কৈলাস পর্বত দেখতে পাবে। সেই পর্বত শৃঙ্গ ঔষধি গাছে পরিপূর্ণ। মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরনী এবং সন্ধানী নামের অদ্ভুত অজ্ঞান হয়ে থাকা প্রাণীদের জন্য মহৌষধ এই গাছকে ঔষধি হিসেবে প্রয়োগ করলেই সবাই পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠবে বলে জাম্ববন্ত জানাল। জাম্ববন্তর কথা শুনে হনুমান বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে পর্বতের উপরে উঠে নিজের দেহটা বিশাল করে তুললেন। তারপর আকাশপথে উত্তর দিকে যেতে শুরু করলেন। হনুমান লক্ষ্যস্থানে অবতরণ করে গাছ সমূহ জ্বলজ্বল করে থাকতে দেখলেন। পরে যখন তুলতে গেলেন তখন গাছগুলি অর্ন্তধান করল। হনুমান বুঝতে পারলেন যে কেউ কু-অভিপ্রায় এরকম করেছে। তা না হলে গাছগুলি ভুতে পাওয়া। তাই গাছের খোঁজে সময় নষ্ট না করে সমগ্র শৃঙ্গ টাকে পিঠে নিয়ে রাত ভোর হওয়ার আগেই রণক্ষেত্রে উপস্থিত হল। জাম্ববন্তের উদ্যোগে মহৌষধ উদ্ভিদের মহিমায় তখনও কোনমতে প্রাণে বেঁচে থাকা রাম বাহিনীর দেহে শক্তি সঞ্চার হল। তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল। প্রতিজনই নাকি অসীম শক্তির অধিকারী হল। তোমার স্বামী এবং দেবর আগের চেয়েও জ্যোতির্ময় হয়ে পড়ল। বায়ুপুত্র আনন্দে গিরিশৃঙ্গ কে প্রণাম জানিয়ে পুনরায় যথাস্থানে স্থাপন করে ফিরে এল।’
সরমা কথাটা বলে শেষ করতেই আমরা রাম বাহিনীর জয় ধ্বনি শুনতে পেলাম। সেইজয়ধ্বনি শুনে সরমা সরল ভাবে বললেন- বৈদেহী সহজ সরল মানুষের কখনও মৃত্যু নেই। তাই তুমি চিন্তা করনা। আমার বিশ্বাস অতি দ্রুত প্রভু রামচন্দ্র তোমাকে উদ্ধার করবেন। এভাবে অনেক্ষণ আমার সঙ্গে কাটিয়ে সরমা চলে গেল। আমিও স্বামী রামচন্দ্রের চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়লাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন